Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

বত্রিশ পুতুলের উপাখ্যান লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

    পরদিন রাজা ভোজরাজ সিংহাসনে বসতে গেলে শেয পুতুলটি বললো, হে রাজন, আমার নাম উন্মাদিনী, এই সিংহাসনে একমাত্র বিক্রমাদিতাই বসবার যোগ্য। তাঁর ত...

    পরদিন রাজা ভোজরাজ সিংহাসনে বসতে গেলে শেয পুতুলটি বললো, হে রাজন, আমার নাম উন্মাদিনী, এই সিংহাসনে একমাত্র বিক্রমাদিতাই বসবার যোগ্য। তাঁর তুল্য রাজা এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই। তিনি কাঠের খড়্গ নিয়ে সারা পৃথিবী জয় করে একচ্ছত্র রাজা হয়েছিলেন। তিনি সমস্ত রাজাদের পরাজিত করে, দরিদ্রদের অকাতরে দান করে দারিদ্রমোচন করেছিলেন।
    হে রাজন, আপনি তো শুনলেন রাজা বিক্রমাদিত্যের সকল গুণের কথা। যদি এই সব , গুণ আপনার থাকে তবে অবশ্যই সিংহাসনে বসুন।
    ভোজরাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বত্রিশটি পুতুল এবার সমস্বরে ভোজরাজকে বললো, হে রাজন, আপনিও সামান্য একজন রাজা নন, আপনার মত পবিত্র চরিত্র, কলাবিশারদ, ঔদার্য গুণসম্পন্ন রাজা বর্তমানে আর কেউ নেই। আপনার অনুগ্রহে আমাদের পাপ ক্ষয় হল। আমরা শাপমুক্ত হলাম।
    আমরা বত্রিশজন পাৰ্বতীর সখী ছিলাম। আমরা দেবীর অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী ছিলাম।
   একদিন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি আমাদের অভিশাপ দিলেন, তোরা নিজীব পুতুল হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের সিংহাসনের শোভা বৃদ্ধি কর গিয়ে। আমরা তখন তাঁকে ভক্তিসহকারে প্রণাম করে এই শাপের অবসানের জন্য প্রার্থনা করলাম। তখন দেবী বললেন, সেই সিংহাসনে একসময় রাজা বিক্রমাদিত্য বসবেন। তারপর রাজা ভোজরাজ ঐ সিংহাসনে বসতে গেলে তোদের মুখ থেকে রাজা বিক্রমাদিতোর অশেষ গুণ ও দয়াশীলতার কথা শুনবে এবং তখনই তোদের শাপের অবসান হবে।
    এরপর ভোজরাজের অনুমতি নিয়ে পুতুলরা চলে গেল।
    ভোজরাজা আর সিংহাসনে বসলেন না। ঐ সিংহাসনের উপর শিব-পার্বতীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে রোজ পূজা করতে লাগলেন এবং বিক্রমদিত্যের  আদর্শ অনুসরণ করে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।

||কথা শেষ||

    পরদিন রসবতী নামে আর একটি পুতুল বললো, রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে একদিন এক সন্ন্যাসী রাজার হাতে একটি ফল দিয়ে আশীবাণী উচ্চারণ করে বললে...

    পরদিন রসবতী নামে আর একটি পুতুল বললো, রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে একদিন এক সন্ন্যাসী রাজার হাতে একটি ফল দিয়ে আশীবাণী উচ্চারণ করে বললেন, রাজন, আমি অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা চতুৰ্দ্দশীতে মহাশ্মশানে হোম করব। আমার ইচ্ছা আপনি হোন আমার উত্তরসাধক। সেই শ্মশানের অনতিদূরের একটি শিরীষ গাছে এক বেতাল বাস করে। আপনি অতিসন্তপর্ণে তাকে নিয়ে আসবেন।
     রাজা কথা দিলেন।
    তারপর নির্দিষ্ট দিনে রাজা বিক্রমাদিত্য সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁকে সেই গাছটি দেখিয়ে দিলে রাজা বেতালকে কাঁধে নিয়ে যখন নীরবে আসছিলেন তখন বেতাল বললো, হে রাজন, পথশ্ৰম দূর করতে আপনি একটা গল্প বলুন।
রাজা কিন্তু সন্ন্যসীর কথামত মৌনই রয়ে গেলেন।
    বেতাল বললো, আপনি মৌনভঙ্গের ভয়ে কথা বলছেন না বুঝতে পারছি। বেশ, তবে আমিই গল্প বলি, তবে আমার গল্প বলা শেষ হলেও যদি আপনি মৌনভঙ্গ না করেন তবে আপনার মস্তক শতচ্ছিন্ন হবে।
    এই কথা বলে বেতাল গল্প বলতে আরম্ভ করলো।
    হিমালয়ের দক্ষিণ দিকে বিন্ধ্যবতী নামে এক সুন্দর নগরী আছে। সেখানকার রাজার নাম সুবিচারক। তাঁর পুত্রের নাম ময়সেন। একদিন ময়সেন শিকার করতে বেরিয়ে একটি হরিণকে দেখতে পেয়ে তাকে অনুসরণ করে এক গভীর বনে প্রবেশ করলেন। যা হোক, একটা পথ খুঁজে পেয়ে যখন একাকী চলছিলেন তখন একটা নদী দেখলেন। সেই নদীর
তীরে এক ব্রাহ্মণের দেখা পেলেন।
    রাজপুত্র ময়সেন তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, আমি তৃষ্ণার্ত, আমার ঘোড়াটি একটু ধরুন, আমি জল পান করব।
   ব্রাহ্মণ বললেন, কে হে তুমি? আমি কি তোমার চাকর যে তোমার ঘোড়াটি ধরব আর তুমি জল পান করবে? আব্দার তো তোমার মন্দ নয়!
    ব্রাহ্মণের এই কথা শুনে রাজপুত্র ভীষণ রেগে গিয়ে তাঁকে চাবুকের বাড়ি মারলেন।
    ব্ৰাহ্মণ কাঁদতে কাঁদতে রাজার কাছে গিয়ে সব কথা বললেন।
    রাজা পুত্রের এই অন্যায় আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে পুত্রকে নির্বাসনদণ্ড দিলেন।
    মন্ত্রী রাজাকে বললেন, রাজপুত্র সুখে মানুষ হয়েছে, তাঁকে এই গুরুদণ্ড দেবেন না।
    রাজা বললেন, মন্ত্রী, এই দণ্ডই ঠিক হয়েছে। ব্রাহ্মণকে চাবুক মারার এটাই উচিত শান্তি। ব্রাহ্মণকে পূজা করা শাস্ত্রবিধি। আমার আদেশ, রাজপুত্র যে হাতে ব্ৰাহ্মণকে চাবুক মেরেছে সেই হাতখানা কেটে ফেল।
    মন্ত্রী রাজি না হলে রাজা নিজেই পুত্রের হাতখানা কাটতে উদ্যত হলে সেই ব্রাহ্মণ উপস্থিত হয়ে বললেন, হে রাজন, রাজপুত্র ভুল করে এই কাজ করে ফেলেছে, আর কখনও এমন করবে না। আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি তাকে এবারের মত ক্ষমা করুন। আপনার বিচারে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। ব্রাহ্মণের কথায় রাজা তাঁর পুত্রকে ক্ষমা করলেন। ব্রাহ্মণও যথাস্থানে ফিরে গেলেন। গল্প শেষ করে বেতাল বললো, রাজা এবং ব্রাহ্মণ —এই দু'জনের মধ্যে কে গুণে শ্রেষ্ঠ বলুন? রাজা বিক্রমাদিত্য বললেন, রাজাই গুণে শ্রেষ্ঠ।
    রাজার মৌনভঙ্গ হওয়ায় বেতাল পুনরায় শিরীষ কাছে ফিরে গেল। রাজাও আবার সেই শিরীষ গাছে উঠে বেতালকে নামিয়ে তাকে কাঁধে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলেন।
    তখন বেতাল আর একটি গল্প বলতে আরম্ভ করল। এই ভাবে বেতাল পচিশটি গল্প রাজাকে বলেছিল।
    রাজা বিক্রমাদিত্য প্রত্যেকটি গল্পেরই সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। এতে বেতাল রাজার সূক্ষ্মবুদ্ধি দেখে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বললো, হে রাজন, এই সন্ন্যাসী আপনাকে বধ করতে চায়। আমি আপনাকে যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। আপনি যখন আমাকে সেই  সন্ন্যাসীর কাচে নিয়ে যাবেন তখনই সন্ন্যাসী বলবে আপনি পথশ্রমে ক্লান্ত, এই অগ্নিকুণ্ড প্রদক্ষিণ করে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে নিজের নগরে ফিরে যান।
    সন্ন্যাসী এই কথা বললে আপনি যেই সাষ্টাঙ্গ প্ৰণামের জন্য মাথা নত করবেন তখনই সে খড়া দিয়ে আপনাকে বধ করবে। তারপর আপনার মাংস দিয়ে হোম করবে। এই কাজটি করলেই অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি লাভ হবে তার।
     রাজা বললেন, এখন আমার কি কর্তব্য? 
   বেতাল বললো, সন্ন্যাসী যখন আপনাকে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম করতে বলবে তখন আপনি বলবেন-আমি রাজা, সকলে আমাকেই প্রণাম করে, আমি কাউকে প্রণাম করি না তাই জানি না কিভাবে প্রণাম করতে হয়। আপনি আমাকে দেখিয়ে দিন। দেখাবার জন্য যেই সন্ন্যাসী মাথা নত করবে তখনি আপনি তার শিরশেছদ করবেন। তাহলে অষ্টসিদ্ধি লাভ আপনারই হবে।
    বেতালের পরামর্শমত রাজা তাই করলেন।
    বেতাল বললো, হে রাজন, আমি আপনার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি - বর প্রার্থনা করুন।
    রাজা বললেন, আমার প্রতি যদি প্রসন্ন হয়েছ তবে প্রতিশ্রুতি দাও, আমি যখনই তোমাকে ডাকব তখনই আমার সামনে উপস্থিত হবে।
    বেশ, তাই হবে' বললে বেতাল সে স্থান ত্যাগ করলে রাজাও তাঁর নগরীতে ফিরে গেলেন।
    পুতুল বললো, মহারাজ, আপনার কি এমন সাহস আর ধৈর্য আছে?
    ভোজরাজ মাথা নীচু করলেন ।

    পরদিন হংসগামিনী নামে আর এক পুতুল বললো, শুনুন মহারাজ, একদিন রাজা বিক্রমাদিত্য সিংহাসনে বসে আছেন, তাঁকে ঘিরে পাত্ৰ-মিত্র ও রাজকুমারেরা বসে...

    পরদিন হংসগামিনী নামে আর এক পুতুল বললো, শুনুন মহারাজ, একদিন রাজা বিক্রমাদিত্য সিংহাসনে বসে আছেন, তাঁকে ঘিরে পাত্ৰ-মিত্র ও রাজকুমারেরা বসে আছেন, এক জাদুকর ঐ সময় এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, হে রাজন, আপনি সকল কলাবিদ্যায় পারদর্শী, অনেক শ্রেষ্ঠ জাদুকর তাদের কলাকৌশল আপনাকে দেখিয়েছে, আজ আমি একটি বুদ্ধির খেলা দেখাব।
    রাজা বললেন, এখন আমাদের সময় হবে না। আহারের সময় উপস্থিত। আগামী কাল সকালে দেখবো।
   পরদিন বিক্রমাদিত্য সভায় এসে বসেছেন, এমন সময় কাঁধে বিশাল এক খড়্গ নিয়ে একজন লোক এলো, তার সঙ্গে একটি সুন্দরী মেয়ে।
    সভায় উপস্থিত রাজপুরুষেরা এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, হে বিদেশী, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
    সে বললো, আমি ইন্দ্রের পরিচারক ছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে অভিশাপ দেওয়ায় আমি পৃথিবীতে বাস করছি। আমার সঙ্গে যাঁকে দেখছেন, ইনি আমার স্ত্রী। দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে, এখন আমি সেখানেই যাচ্ছি। তাই আপনার কাছে আমার স্ত্রীকে রেখে যেতে চাই।
    এরপর সেই বিশালকায় লোকটি তার স্ত্রীকে রাজার কাছে রেখে খড়্গের উপর ভর করে যেমনি আকাশে উঠে গেল, ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই আকাশ থেকে ভেসে এল 'মার মার, ধর ধর এইরূপ ভীষণ কণ্ঠস্বর।
    সভাস্থ সকলে আকাশের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরেই আকাশ থেকে রাজসভার মাঝখানে একখানি রক্তমাখা খড়গ ও রক্তাক্ত একখানি হাত এসে পড়ল। তারপরই একটা কাটা মুণ্ড ও একটা মুণ্ডছাড়া ধড় এসে পড়লো। সবাই বুঝলো সেই লোকটিই মারা গেছে।
    এই দৃশ্য দেখে সেই স্ত্রীলোকটি বললো, হে রাজন, আমার স্বামী যুদ্ধে শত্রুদের হাতে নিহত হয়েছেন। আমি আর বেঁচে থেকে কি করবো? আমি ওর সঙ্গে সহমরণে যাব।
    এই কথা বলে মেয়েটি রাজার পা জড়িয়ে ধরল। রাজা ব্যথিত মনে চন্দনকাঠ দিয়ে চিতা সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা কবলেন।
    স্বামীর শবসহ সহমরণের জন্য আগুনে ঝাঁপ দিল সেই স্ত্রীলোকটি।
    সূর্য অস্তাচলে গেল।
    পরদিন যথাসময়ে রাজা সিংহাসনে বসেছেন। এমন সময় সেই বিশালাকার লোকটি খড়্গহাতে রাজার সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর গরায় মালা পরিয়ে দিল। তারপর সেই যুদ্ধের নানা বর্ণনা দিতে লাগল। উপস্থিত সকলে এই দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত।
    যুদ্ধের বর্ণনা দেবার পর সেই অতিকায় পুরুষ বললো, যুদ্ধশেষে দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, হে বীর, তোমাকে আর পৃথিবীতে যেতে হবে না। তোমার শাপ কাল শেষ হয়েছে। আমি বললাম, হে প্ৰভু, আমার স্ত্রীকে মর্ত্যের বিখ্যাত রাজা বিক্রমাদিত্যের কাছে রেখে এসেছি। তাকে নিয়ে ফিরে আসছি। এখন আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিন, তাকে নিয়ে স্বর্গে চলে যাই ।
    এই কথা শুনে রাজা এবং সভায় উপস্থিত সকলেই চুপ করে রইলেন।
    সে বললো, আপনারা সকলে চুপ করে আছেন কেন?
    সভাসদর বললো, হে বীর, তোমার স্ত্রী আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছে।
   কারণ জিজ্ঞাসা করায় সকলেই চুপ করে থাকলে সেই পুরুষ বললো, মহারাজ, আপনি ব্ৰহ্মার মত চিরআয়ুষ্মান হোন। আমিই সেই জাদুকর। আপনাকে আমার জাদুর খেলা দেখালাম। রাজা খুব খুশি হলেন।
    এমন সময় কোযাধ্যক্ষ এসে জানালেন, পান্ড্যুরাজ্য প্রভুকে প্রচুর ধনরত্ন কর হিসেবে পাঠিয়েছেন।
    রাজা বললেন, কি পাঠিয়েছে?
    কোষাধ্যক্ষ বললেন, আট কোটি সুবর্ণমুদ্রা, তিরানব্বই কোটি মুক্তার ভার, পঞ্চাশটি হাতী, ও তিনশত অশ্ব।
    রাজা বললেন, এই সবকিছুই এই জাদুকরকে দিয়ে দাও।
     কোয়াধ্যক্ষ রাজার আদেশ পালন করলেন।
    পুতুল বললো, মহারাজ, আপনি কি এতটা উদার হতে পারবেন?
    ভোজরাজ চুপ করে রইলেন, কিছু বললেন না।

    পরদিন অন্য একটি পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম চন্দ্ররেখা, আগে আমার এই গল্পটি শুনুন।     রাজা বিক্রমাদিত্য সভায় বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে বসে ...

    পরদিন অন্য একটি পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম চন্দ্ররেখা, আগে আমার এই গল্পটি শুনুন।
    রাজা বিক্রমাদিত্য সভায় বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে বসে আছেন রাজকুমারেরা। এমন সময় এক স্তুতিকার এসে বললো, হে রাজন, যতদিন পবিত্র গঙ্গা নদী প্রবাহিত থাকবেন, যতদিন আকাশে সূর্যদেব পৃথিবীকে তাপ ও আলো দিয়ে যাবেন, ততদিন পুত্র পৌত্রাদিসহ সুখে রাজত্ব করুন। আমি দূরদেশে বাস করি, আপনার অনেক খ্যাতির কথা শুনে এখানে এসেছি। আপনাকে পেয়ে আজ আমার দারিদ্র্যদশা ঘুচবে। আপনাকে দেখে জম্বরী নগরের রাজা ধনেশ্বরের কথা মনে পড়ছে। তিনি দরিদ্রদের দুঃখ দূর করার জন্য প্রার্থীদের অকাতরে ধন দান করতেন। তিনি একবার বসন্তপুজার আয়োজন করলে অসংখ্য প্রার্থী এসে উপস্থিত হয়েছিল। রাজা সেই প্রার্থীদের আঠারো কোটি সুবর্ণ মুদ্রা দান করেছিলেন। উদারতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ সেই রাজার পর আপনাকেই প্রথম দেখলাম ।
    তার সব কথা শোনার পর রাজা তাঁর কোষাধ্যক্ষকে ডেকে আদেশ দিলেন, একে কোযাগারে নিয়ে যাও, এ যত রত্ন এবং মুদ্র চাইবে, দিয়ে দাও।
    কোযাধ্যক্ষ তাকে তার ইচ্ছামত রত্নাদি দিলে স্তুতিকার ব্রাহ্মণ রাজাকে ‘ব্রহ্মার মত চিরজীবী হোন’ বলে আশীর্বাদ করে চলে গেল।
    গল্প শেষ করে পুতুল বললো, মহারাজ, আপনি কি এমন দান করতে পারবেন? 
    ভোজরাজ নিরুত্তর রইলেন।

    পরদিন শশীকলা নামে আর একটি পুতুল বললো, শুনুন মহারাজ, পৃথিবী পরিক্রমা করতে বেরিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্য এক নগরে এসে উপস্থিত হলেন। সেই নগরের প...

    পরদিন শশীকলা নামে আর একটি পুতুল বললো, শুনুন মহারাজ, পৃথিবী পরিক্রমা করতে বেরিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্য এক নগরে এসে উপস্থিত হলেন। সেই নগরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে এক নদী। সেই নদীর তীরে নানা ফুল ও ফলে শোভিত এক বন ছিল। সেই বনের মধ্যে ছিল অতি মনোরম এক দেবমন্দির। রাজা সেই নদীতে স্নান করে দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে মন্দিরে বসলেন।
    এই সময় চারজন বিদেশী এসে রাজার কাছে বসল। রাজা তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করে পরিচয় জানতে চাইলেন।
    একজন বললো, আমরা অপূর্ব এক দেশ থেকে আসছি।
    রাজা বললেন, সেই অপূর্ব দেশে কি কি দ্রষ্টব্য জিনিস আছে?
    সে বললে, সেই দেশে বেতালপুরী নামে একটি নগর আছে। সেখানে শোণিতপ্রিয়া নামে এক দেবতা আছেন। সেখানকার রাজা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দেশের যাতে কোন অমঙ্গল না হয় তার জন্য প্রতি বৎসর একজন পুরুষকে সেই দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেয়। সেই নির্দিষ্ট দিনে যদি কোন বিদেশী সেই নগরে উপস্থিত হন তবে তাঁকেই দেবতার কাছে বলি দেওয়া হয়। আমরাও সেইরকম দিনে সেই নগরে ভুলক্রমে গিয়ে পড়ি। সেখানকার অধিবাসীরা আমাদের ধরতে এলেই আমরা কোনরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসি।
    এই কথা শুনে রাজা বিক্রমাদিত্য বেতালপুরীতে উপস্থিত হলেন এবং দেবতাকে প্রণাম করে সেই মন্দিরে বসলেন।
সেই সময় একজন লোককে বন্দী করে বহু লোক বাজনা বাজিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হল।
    রাজা বিক্রমাদিত্য বুঝলেন, একেই আজ দেবতার কাছে বলি দেওয়া হবে ; তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, আমি আমার এই দেহ মায়ের পায়ে উংসর্গ করে একে বাঁচাব। এই দেহ খুব বেশী হলে একশত বৎসর থেকে তারপর তো বিনষ্ট হবেই।
    রাজা সেই প্রধান পুরুষদের বললেন, এই লোকটিকে দিয়ে আপনারা কি করবেন?
    তাঁরা বললেন, একে আমরা দেবতার কাছে বলি দেব। এই বলিদানের দ্বারা দেবী তুষ্ট হয়ে আমাদের মঙ্গল করবেন।
রাজা বললেন, এ ভয়ে কাতর এবং দেহও ক্ষীণ, এর দেহ বলি দিলে দেবী তুষ্ট হবেন না। একে ছেড়ে দিন, এর বিনিময়ে আমার শরীর দান করছি। আমার দেহ হৃষ্টপুষ্ট, আমার মাংস উপহার পেলে দেবী তুষ্ট হবেন। আমাকেই বলি দিন।
    এই কথা বলে সেই লোকটিকে মুক্ত করে দিয়ে রাজা নিজে সেই দেবীর সামনে উপস্থিত হয়ে যেমনি নিজের গলায় খড়্গাঘাত করতে উদ্যত হলেন অমনি দেবী সেই খড়গটি ধরে বললেন, তোমার পরোপকারিতা দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, বরপ্রার্থনা কর ।
    রাজা বললেন, হে দেবী, যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়ে থাক তবে আজ থেকে নরবলি বন্ধ হোক।
    দেবী “তথাস্তু’ বলে অন্তধান করলেন। এরপর রাজা তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিজ নগরে ফিরে এলেন।
    পুতুল বললো, মহারাজ, আপনি কি পরের জন্য এতটা চিন্তা করেন? যদি করেন তো সিংহাসনে বসুন।
    ভোজরাজ সরে দাঁড়ালেন।

    পরদিন সুখসাগরা নামে একটি পুতুল এই গল্পটি বললো।    পৃথিবী পর্যটনে বেরিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্য এক ধাৰ্মিক রাজার রাজ্যে প্রবেশ করলেন। সেই রাজ...

    পরদিন সুখসাগরা নামে একটি পুতুল এই গল্পটি বললো।
   পৃথিবী পর্যটনে বেরিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্য এক ধাৰ্মিক রাজার রাজ্যে প্রবেশ করলেন। সেই রাজ্যের প্রজারাও ছিল সদাচারী, অতিথিপরায়ণ ও দয়াশীল।
   সেখানে তিন-চার দিন থাকবেন ঠিক করে বিক্রমাদিত্য এক দেবালয়ে প্রবেশ করে দেবতাকে প্ৰণাম করে মণ্ডপে বসলেন।
   এই সময় রাজপুত্রের মত দেখতে অতি সুদৰ্শন এক যুবককে দেখতে পেলেন। সঙ্গের লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর সেই যুবক আবার চলে গেল!
   রাজা বিক্রমাদিত্য মনে মনে চিন্তা করলেন, কে এই যুবক!
   দ্বিতীয় দিন সেই যুবক একা এসে মন্দিরে বসলো। এবার কিন্তু তার দেহে অলংকার ছিল না।
   দেহ গতকালও ছিল অলঙ্কারভূষিত, সঙ্গে ছিল অনেক লোক। আজ কেন তোমার এই অবস্থা?
   সেই যুবক বললো, গতকাল আমি সেইরকমই ছিলাম কিন্তু দৈবদোষে আজ আমার এই অবস্থা হয়েছে।
রাজা বললেন, কে তুমি ?
   যুবক বললো, আমি একজন জুয়ারী। পাশা খেলায় আমার হাত পাকা, তাছড়া আমি শারীরক্রীড়াও জানি, বুদ্ধিবলও যথেষ্ট আছে। কিন্তু সবই নিরর্থক, দৈববলই প্রকৃত বল।
   রাজা বললেন, বিচক্ষণ হয়েও কেন তুমি এমন পাপ কাজ কর?
   যুবক বললো, জুয়া খেলাই আমার জীবিকা, কি ভাবে তা ত্যাগ করব? যদি আপনি অর্থোপার্জনের কোন উপায় করে দিতে পারেন তবে এসব ছেড়ে দেব।
   এই সময় দুই বিদেশী ব্রাহ্মণ এসে দেবালয়ের একপাশে বসে পরম্পরে আলোচনা করতে লাগলেন। একজন বললেন, আমি পিশাচলিপি দেখেছি, তাতে লেখা আছে এই মন্দিরের ঈশান কোণে তিন ঘড়া মোহর পোঁতা আছে; তবে তার কাছেই আছে এক ভৈরব মূর্তি। যে নিজের গলা কেটে দিয়ে ভৈরবকে তৃপ্ত করতে পারবে সে ঐ ধনের অধিকারী হবে।
   রাজা বিক্রমাদিত্য এই কথা শুনে সেখানে উপস্থিত হয়ে যেই নিজের গলা কেটে ভৈরবকে তৃপ্ত করতে উদ্যত হয়েছেন অমনি ভৈরব দেখা দিয়ে বললেন, তোমার ত্যাগ ও সাহস দেখে তুষ্ট হয়েছি, বর প্রার্থনা কর।
   রাজা বললেন, যদি তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে এই যুবককে কলস তিনটি দিন।
   ভৈরব রাজার কথামত তা দিলে যুবক রাজার প্রশংসা করে ফিরে গেল। রাজা বিক্রমাদিত্যও নিজ নগরে ফিরে এলেন।
   পুতুল বললো, মহারাজ, আপনার কি এমন গুণ আছে?
   সেদিনও ভোজরাজের সিংহাসনে বসা হল না।

    পরদিন আর একটি পুতুল বললো, হে রাজন, আমার এই গল্প শুনুন। ঔদার্য, দয়া, বিবেক ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে বিক্রমাদিত্যের সমকক্ষ রাজা আর কেউ ছিলে...

    পরদিন আর একটি পুতুল বললো, হে রাজন, আমার এই গল্প শুনুন। ঔদার্য, দয়া, বিবেক ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে বিক্রমাদিত্যের সমকক্ষ রাজা আর কেউ ছিলেন না। তিনি যা বলতেন তার অন্যথা করতেন না। শাস্ত্রেও বলেছে— যেমন কথা তেমনি কাজ। সজ্জনদের মন, কথা ও কাজ এক প্রকার হয় ।
    একদিন স্বর্গে ইন্দ্র সিংহাসনে বসে আছেন, তাঁর সভায় অষ্টআশি হাজার ঋষি, তেত্রিশ কোটি দেবতা উপস্থিত আছেন। গন্ধৰ্বরাও আছেন। নারদ বললেন, ভূমণ্ডলে বিক্রমাদিত্যের মত কীর্তিমান, পরোপকারী ও মহাগুণসম্পন্ন রাজা আর নেই। .
    তাঁর কথা শুনে সভায় উপস্থিত সকলেই বিস্মিত হলেন।
    ইন্দ্র তখন সুরভিকে বললেন, তুমি মর্ত্যে গিয়ে বিক্রমাদিত্যের দয়া ও পরোপকারিতা প্রভৃতি গুণের বিষয় সব জেনে আমাকে জানাও।
    তখন সুরভি অত্যন্ত দুর্বল একটি গরুর রূপ ধারণ করে মতে গমন করলেন।
    রাজা বিক্রমাদিত্য পথ দিয়ে যাচ্ছেন এমন সময়  সুরভি নিজে ইচ্ছা করে কাদায় পড়ে গেলেন এবং রাজার দিকে তাকিয়ে করুণস্বরে চীৎকার করতে লাগলেন। 
    রাজা তাঁর কাছে এসে দেখলেন গরুটি অত্যন্ত দুর্বল ও কাদায় পড়ে রয়েছে এবং অদূরে একটি বাঘ। রাজা চেষ্টা করতে লাগলেন গরুটিকে তুলবার। এদিকে সূর্য অস্তাচলে যাবার উপক্রম করেছে, একটু পরেই ঘন অন্ধকার চারদিকে ছেয়ে যাবে। তখন রাজা সেই গরুটিকে রক্ষা করার জন্য সেখানেই রয়ে গেলেন।
    রাত্রি শেষ হয়ে সকাল হল। তখন সুরভি রাজার দয়া ও ধৈর্যগুণ দেখে অবাক হলেন এবং নিজেই সেই কাদা থেকে উঠে এসে রাজাকে বললেন, মহারাজ, আমি স্বর্গ থেকে এসেছি, আসলে আমি গরু নই, আমার নাম সুরভি। আপনার দয়া এবং ধৈর্যগুণ নিজের চোখে দেখতে এসেছিলাম। আপনার মত দয়াশীল রাজা সত্যিই বিরল। আমি সন্তুষ্ট হয়ে বর দেব, প্রার্থনা করুন।
    রাজা বললেন, আপনাদের কৃপায় আমার কোনকিছুরই অভাব নেই। কি প্রার্থনা করব? 
    সুরভি বললেন, আমার কথার অন্যথা হবে না। আমি তবে আপনার কাছেই থাকব। 
    এই কথা বলে তিনিও রাজার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এই সময় এক ব্রাহ্মণ তাঁদের সামনে এসে আশীর্বাদ করে বললেন, বিধাতা আমাকে দরিদ্র করেছেন তাই আমি সকলকে দেখতে পেলেও আমাকে কেউ দেখতে পায় না। 
    রাজা বললেন, কি চান আপনি? 
    ব্রাহ্মণ বললেন, হে রাজন, আপনি আশ্ৰিতের কাছে কল্পতরু। আমার যাতে দারিদ্র্য না থাকে তার ব্যবস্থা করুন। 
রাজা বললেন, তবে আপনি এই কামধেনুটি গ্রহণ করে আপনার দারিদ্র্য দূর করুন। ইনি আপনার সকল ইচ্ছা পূরণ করবেন। 
    রাজা বিক্রমাদিত্য কামধেনুটি তাঁকে দিয়ে নিজ নগরে ফিরে এলেন। 
    পুতুল বললো, পারবেন মহারাজ এমন স্বাৰ্থত্যাগ করতে? 
    ভোজরাজ কিছু বললেন না।


    পরদিন রাজা ভোজ সিংহাসনে বসতে গেলে প্রিয়দর্শনা নামে আর একটি পুতুল এই গল্পটি বললো।     রাজা বিক্রমাদিত্য রাজ্য শাসনকালে এক জ্যোতির্বিদ তা...

    পরদিন রাজা ভোজ সিংহাসনে বসতে গেলে প্রিয়দর্শনা নামে আর একটি পুতুল এই গল্পটি বললো।
    রাজা বিক্রমাদিত্য রাজ্য শাসনকালে এক জ্যোতির্বিদ তাঁর কাছে এসে তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, সূর্যদেব আপনাকে শৌর্য দিন, চন্দ্র দিন ইন্দ্রত্ব, মঙ্গল দিন সুমঙ্গল, বুধ দিন বুদ্ধি, বৃহস্পতি দিন গুরুত্ব, শুক্র দিন পুত্র, শনি দিন কল্যাণ, রাহু দিন বাহুবল ও কেতু বংশের উন্নতি দান করুন।
    রাজা সেই জ্যোতিষীর কাছে জানতে চাইলেন, এ বৎসর কোন গ্রহের কোথায় স্থান তা বর্ণনা করুন।
   জ্যোতিষী বললেন, এ বৎসর রাজা রবি, মন্ত্রী মঙ্গল ও মেঘাধিপতি। শনি রোহিনী শকট ভেদ করে যাবে, সেই কারণে এ বৎসর অনাবৃষ্টি হবে।
    জ্যোতিষীর এই কথা শুনে রাজা বললেন, এর প্রতিকারের কি কোন উপায় নেই?
    জ্যোতিষী বললেন, অবশ্যই আছে। গ্রহহোম করলে বৃষ্টি হয়।
    কথা বলে হোম অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন। অনুষ্ঠান শেষে রাজা চাল, কাপড় প্রভৃতি দান করে ব্ৰাহ্মণদের সন্তুষ্ট করলেন। তারপর দীন, অন্ধ, বধির, পঙ্গু, অনাথ প্রভৃতিদের তুষ্ট করলেন। কিন্তু তাতেও বৃষ্টি হল না!
    গ্রহহোম অনাবৃষ্টির ফলে দেশের লোক হাহাকার করতে লাগল।
    রাজাও সকলের দুঃখে দুঃখিত হয়ে একদিন যজ্ঞগুহে বসে যখন এই কথাই চিন্তা করছেন তখন আকাশবাণী হল--হে রাজন, যদি বত্রিশটি লক্ষণযুক্ত কোন পুরুষের মুন্ডু কেটে দেবীর চরণে উৎসর্গ করতে পার তবে তোমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
    এই আকাশবাণী শোনার পর রাজা দেবীকে প্রণাম নিবেদন করে যেই নিজ মস্তকে খড়্গাঘাত করতে উদ্যত হবেন অমনি দেবী তার হাতখানি ধরে বললেন, হে রাজন, তোমার ধৈর্যগুণ দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি, তুমি তোমার ইচ্ছা মত বর গ্রহণ কযর।
    রাজা বললেন, হে দেবী, যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়েছ তবে রাজ্যের এই অনাবৃষ্টি দূর করো।
    দেবী তথাস্তু বলে অন্তধান করলেন। রাজাও আনন্দিত চিত্তে সভায় উপস্থিত হলেন।
    পুতুল বললো, মহারাজ, আপনি কি প্রজাদের জন্য এতখানি ত্যাগ করতে পারবেন?
    ভোজরাজ সরে দাঁড়ালেন।

    পরদিন সুভগা নামক একটি পুতুল বললো, শুনুন মহারাজ, বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে পুরন্দরপুরী নামে একটি নগরী ছিল। সেই নগরে সম্পদশালী নামে এক বণি...

    পরদিন সুভগা নামক একটি পুতুল বললো, শুনুন মহারাজ, বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে পুরন্দরপুরী নামে একটি নগরী ছিল। সেই নগরে সম্পদশালী নামে এক বণিক বাস করতেন। একদিন তিনি তাঁর চার পুত্রকে ডেকে বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা চার ভাই একসঙ্গে বসবাস করবে এ কথা ভাবতে পারছি না। তাই আমার সমস্ত সম্পত্তি বড় ছোট অনুসারে ভাগ করে রাখছি। আমার মৃত্যুর পর আমার নির্দেশমত তোমরা তা গ্রহণ করবে।
    পুত্ররা এতে রাজী হল।
    একদিন বণিকের মৃত্যু হল।
    তখন চার ভাই শান্তিতে থাকবার আশায় একত্র মিলিত হয়ে স্থির করল পিতার নির্দেশমত সমস্ত সম্পত্তি যার যা ভাগে পাওনা হয় তাই নিয়ে পৃথক থাকাই ভাল।
    এই ঠিক করে খাটের নীচে মাটি খুঁড়ে একটি বড় ভাড়ের মধ্যে চারটি কোটো তারা পেল। তার একটির মধ্যে রয়েছে মাটি, একটিতে কয়লা, অন্য একটিতে হাড় ও শেষটিতে কিছু খড়।
    এই সব দেখে পুত্রদের বিস্ময়ের অন্ত রইল না। তখন চার ভাই মিলে রাজসভায় এসে উপস্থিত হল। সভায় অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি উপস্থিত থাকলেও এর কিছুই বুঝতে পারল না। তখন তারা অন্য এক নগরে গিয়ে উপস্থিত হল।
    এই সময় এক কুমোরের বাড়িতে রাজা শালিবাহন এসেছিলেন। তিনি জানতে পেরে সভায় উপস্থিত হয়ে বললেন, এর মধ্যে বিস্ময়ের কি আছে? বুদ্ধি খাটাবারই বা বিশেষ কি প্রয়োজন আছে। এরা চারজন একই বিত্তবান পিতার পুত্র। সেই ব্যক্তি বেঁচে থাকতেই তাঁর অতুল সম্পদ ভাগ করে রেখে গেছেন। তিনি জ্যেষ্ঠকে মাটি দিয়ে গিয়েছেন, তার অর্থ হল সমস্ত ভূসম্পত্তি জ্যেষ্ঠপুত্র পাবে। দ্বিতীয় পুত্রকে দিয়েছেন খড়, তার মানে যত ধান আছে সব দিয়েছেন তাকে। তৃতীয়জনকে দিয়েছেন হাড়, অর্থাৎ সমস্ত গৃহপালিত পশু তার অধিকারে থাকবে। আর চতুর্থ পুত্রকে দিয়েছেন কয়লা তার মানে এই পুত্র পাবে সমস্ত সোনা।
    শালিবাহন ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে চার ভাই সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরল।
    রাজা বিক্রমাদিত্য এই কথা শুনে তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি তখনই এক দূত পাঠিয়ে শালিবাহনকে আহ্বান করলেন। কিন্তু শালিবাহন রাজার এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বললেন, কে এই রাজা যে ডাকলেই তার কাছে যেতে হবে? যদি তার প্রয়োজন হয় তবে সে নিজেই আমার কাছে আসবে, আমার তাকে কোন প্রয়োজন নেই।
    শালিবাহনের এমন স্পর্ধার কথা দূত মুখে শুনে তিনি রেগে গিয়ে বিশাল সেনা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে।প্রতিষ্ঠান নগরে পৌঁছে প্রথমে দূত পাঠালেন শালিবাহনের কাছে।
    দূত শালিবাহনকে গিয়ে বললো, মহারাজ এসেছেন, আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করুন!
    শালিবাহন উত্তরে বললেন, ওহে দূত, আমি রাজার সঙ্গে দেখা করব তবে সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে,দেখতে চাই রাজা বিক্রমাদিত্য কেমন বীর!
    দূত মুখে শালিবাহনের এই কথা শুনে রাজা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।
শালিবাহন কুমোরের ঘরে তৈরী হাতি, ঘোড়া রথ প্রভৃতি চতুরঙ্গ সেনা গঠন করে মন্ত্রে তাদের প্রাণদান করে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।
    দুই পক্ষের সৈন্যের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজা বিক্রমাদিত্য শালিবাহনের সমস্ত সৈন্যকে পরাজিত করে ফেলল। অবশেষে শালিবাহন উপায় না দেখে শেষ নাগকে স্মরণ করলেন। শেষ নাগ পাঠালেন অসংখ্য সাপ। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে এসে বিক্রমাদিত্যর সৈন্যদের কামড়াতে লাগল।
    এই দৃশ্য দেখে রাজা একা নগরে ফিরে এসে সৈন্যদের বাঁচাতে জলে অর্ধেক দেহ নিমগ্ন করে বাসুকি মন্ত্র জপ করলেন।
বাসুকি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বর প্রার্থনা কর। বিক্রমাদিত্য বললেন, সপরাজ, যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাক তবে শালিবাহনের সঙ্গে যুদ্ধে তোমার দ্বারা প্রেরিত যে সব সাপ আমার সৈন্যদের কামড়ে হত্যা করেছে তাদের বাঁচিয়ে তোলার জন্য অমৃতকুম্ভ প্রদান কর।
    সেই মত বাসুকি অমৃতকুন্তু প্রদান করলেন।
    মহারাজ বিক্রমাদিত্য সেই অমৃতকুম্ভ নিয়ে দিয়ে সৈন্যদের শরীরে ছিটিযে দিতে সব সৈন্য জীবিত হয়ে উঠল। তারপর তিনি শালিবানকে পরাজিত করলেন। শালিবাহন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজার কাছে ক্ষমা চাইলেন। রাজা শালিবানকে ক্ষমা করে দিলেন।
    পুতুল বলল, পারবেন আপনি বিক্রমাদিত্যের মতো ক্ষমাশীল হলে।
    ভোজরাজা চুপ করে রইলেন।

    আর এক পুতুল বলল, মহারাজ, আমার চিত্রলেখা। রাজা বিক্রমাদিত্য কেমন গুণের অধিকারী ছিলেন শুনুন।    একবার রাজা বিক্রমাদিত্য পৃথিবী ভ্রমণ শেষ ক...

    আর এক পুতুল বলল, মহারাজ, আমার চিত্রলেখা। রাজা বিক্রমাদিত্য কেমন গুণের অধিকারী ছিলেন শুনুন।
   একবার রাজা বিক্রমাদিত্য পৃথিবী ভ্রমণ শেষ করে রাজধানীতে ফিরে এলে সুহৃদ এবং রাজ্যের প্রজাদের খুব আনন্দ হল!
    প্রাসাদে প্রবেশ করে স্নান সেরে, ভাল কাপড় পরে তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। ষোড়শোপচারে আৰ্চনা করে স্তব করলেন।
    ‘হে দেবাদিদেব, তুমি আমার পিতামাতা, তুমিই বন্ধু, তুমিই সখা, তুমিই বিদ্যা, তুমিই ধন – তুমিই আমার সর্বস্ব।
এই বলে স্তব শেষ করে দেবাদিদেবকে প্রণাম করে ব্ৰাহ্মণদের গাভী, ভূমি ও তিল দান করে দীন, অন্ধ, বধির, কুব্জ, পঙ্গু  সকলকে দানে তুষ্ট করে খাবার ঘরে প্রবেশ করে বালক, বালিকা, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের খাইয়ে শেষে বন্ধুদের সঙ্গে নিজে খেতে বসলেন।
    সব কাজ শেষ করে রাত্রে তিনি শুতে গেলেন। শেষ রাতে স্বপ্ন দেখলেন - মোষের পিঠে করে তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখেই তিনি বিষ্ণুকে স্মরণ করে বিছানা ত্যাগ করলেন। পরদিন সিংহাসনে বসে উপস্থিত ব্রাহ্মণদের স্বপ্ন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন।
    স্বপ্ন-বৃত্তান্ত শুনে ব্রাহ্মণরা বললেন, রাজন, স্বপ্ন দুই প্রকারের হয়। কতকগুলি শুভফলপ্রদ, আর কতকগুলি অনিষ্টকর। হাতির পিঠে চড়া, বাড়ির উপরে ওঠা, কান্না, শাখ, মৃত্যু, ব্রাহ্মণ, গঙ্গা, সোনা দর্শন সৌভাগ্যের কারণ হয়।
কিন্তু স্বপ্নে মোষ, গাধা, শূকর, বাঁদর, কাঁটাগাছ, ছাই এসব দেখা খুব খারাপ। যাই হোক, এই স্বপ্ন আপনার পক্ষে অশুভ।
    রাজা বললেন, এর প্রতিবিধান কি? 
   তাঁরা বললেন, আপনি স্নান করে যজ্ঞদর্শন করে অলঙ্কার, বস্ত্র ব্রাহ্মণদের দান করুন। তারপর নতুন কাপড় পরে দেবার্চনা করুন ও ব্রাহ্মণদের আবার গাভী, ধান প্রভৃতি দশ রকম দ্রব্য দান করুন এবং অন্ধ, বধির, পঙ্গু, অনাথ সবাইকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দান করে তাদের তুষ্ট করুন। এর ফলে আপনার অমঙ্গল কেটে যাবে।
    রাজা ব্রাহ্মণদের কথামত অনুষ্ঠান করে তিন দিন পর্যাপ্ত দানের জন্য কোষাগার উন্মুক্ত রাখার হুকুম দিলেন।
    গল্প শেষ করে পুতুল রাজাকে ঐরুপ দানশীল কিনা জানতে চাইলেন।
    রাজা নিরুত্তর রইলেন।

    পরদিন রাজা সিংহাসনে বসতে গেলে মদনবতী নামে আর একটি পুতুল বললো, আগে আমার একটি গল্প শুনুন । তারপর সিংহাসনে বসবেন।     রাজা বিক্রমাদিত্য দেশ...

    পরদিন রাজা সিংহাসনে বসতে গেলে মদনবতী নামে আর একটি পুতুল বললো, আগে আমার একটি গল্প শুনুন । তারপর সিংহাসনে বসবেন।
    রাজা বিক্রমাদিত্য দেশভ্রমণ করতে খুব ভালবাসতেন। একদিন তিনি পৃথিবী পর্যটনে বেরিয়ে নানা দেবস্থান দর্শন করে এক প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন। সেই প্রাসাদের মধ্যে রয়েছে বহু শিবালয় ও বিষ্ণুমন্দির। তার চারদিকে সোনার দেওয়াল।
    সেই নগরের বাইরে একটি সরোবরের পাশেই রয়েছে বিষ্ণুমন্দির। রাজা সেই সরোবরে স্নান করে বিষ্ণুকে স্মরণ করলেন-হে নাথ, আমি আপনার মাহাত্ম্যের কিছুই জানি না। আমি আর কাউকে জানি না, অন্যের আশ্রয় চাই না, কেবল আমাকে আপনার শ্রীচরণের দাস করে নিন।
    স্তব হয়ে গেলে রাজা বাইরে এসে দেখেন এক ব্রাহ্মণ এসেছেন। তিনি ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
    ব্ৰাহ্মণ বললেন, আমি একজন তীর্থযাত্রী। আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
    রাজা বললেন, আমিও আপনার মত একজন তীর্থযাত্রী।
    ব্রাহ্মণ ভালভাবে দেখে বললেন, আপনাকে দেখে কিন্তু সাধারণ একজন তীর্থযাত্রী বলে মনে হচ্ছে না। আপনার দেহে রাজলক্ষণ রয়েছে। রাজসিংহাসনে না বসে তীর্থপর্যটন করছেন কেন?
    তাঁর কথা রাজা স্বীকার করলেন। তারপর ব্ৰাহ্মণকে বললেন, আপনাকে এত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন?
ব্রাহ্মণ বললেন, শুনুন তবে, কাছেই নীল নামে একটা পর্বত আছে, সেখানে কামাক্ষী দেবীর অবস্থান। সেখান থেকে পাতালে প্রবেশের একটি সুড়ঙ্গপথ আছে। কিন্তু সেই সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ। একমাত্র কামাক্ষামন্ত্র জপ করলেই সেই দ্বার খুলে যায়। তার মধ্যে রয়েছে রসকুণ্ড। সেই রসের স্পর্শে অষ্ট ধাতু সোনায় পরিণত হয়। আমি বারো বছর কামাক্ষীমন্ত্র জপ করেছি, তবুও সেই দ্বার খোলে নি।
    এইটুকু শুনেই রাজা নীল পাহাড়ে গিয়ে নিজ খড়গ তাঁর নিজের গলা লক্ষ্য করে তুললেন, অমনি দেবতা সেখানে আবির্ভূত হয়ে বললেন, আমি প্রসন্ন হয়েছি তোমার উপর, বর প্রার্থনা কর।
    রাজা বললেন, হে দেবী, আমার প্রতি যদি প্রসন্ন হয়ে থাক তবে এই ব্ৰাহ্মণকে রস প্রদান কর।
    দেবী “তথাস্তু’ বলে ব্ৰাহ্মণকে রস প্রদান করলেন। সেই ব্রাহ্মণ রাজার স্তুতিবাদ করে নিজের দেশে ফিরে গেলেন আর রাজাও পর্যটন শেষ করে তাঁর নগরে ফিরলেন।
    পুতুল বললো, মহারাজ, আপনি কি পরের জন্য এতখানি ত্যাগ করতে পারবেন? ভোজরাজ চুপ করে রইলেন।

    পরদিন রতি লীলা নামে আর একটি পুতুল ভোজরাজকে বললো, রাজন, আমি একটি গল্প বলছি, শুনুন।     রাজা বিক্রমাদিত্যের বুদ্ধিসিন্ধু নামে একজন মন্ত্রী...

    পরদিন রতি লীলা নামে আর একটি পুতুল ভোজরাজকে বললো, রাজন, আমি একটি গল্প বলছি, শুনুন।
    রাজা বিক্রমাদিত্যের বুদ্ধিসিন্ধু নামে একজন মন্ত্রী ছিলেন। সেই মন্ত্রীর একটি পুত্র ছিল এবং তার নাম ছিল অনর্গল। সে ভাল ভাল খাবার খেত আর খেলাধুলা করে বেড়াত, লেখাপড়া একেবারেই করত না।
    একদিন তার পিতা তাকে ডেকে বললেন, তুমি আমার ছেলে হয়েও বিদ্যাভ্যাস কর না, মূর্খ হয়ে রইলে। যে মূর্খ তার হৃদয় থাকে না। শাস্ত্রেও আছে । —যে পুত্র বিদ্বান এবং ধর্মপরায়ণ নয় সে পুত্রের কি প্রয়োজন? যে গাভী বাছুর দেয় না এবং দুধ দেয় না সে গাভীর কি প্রয়োজন? মৃত এবং মূর্খ এই দুইয়ের মধ্যে মৃত তবু ভাল কারণ তা থেকে অল্প দুঃখ পাওয়া যায় কিন্তু মূর্খ যতদিন বেঁচে থাকে ততদিনই দুঃখ দেয়।
    পিতার মুখে এই কথা শুনে অনর্গলের অনুতাপ হল। সে আর দেশে না থেকে দেশান্তরে গমন করল।
ঘুরতে ঘুরতে এক নগরে উপস্থিত হয়ে জনৈক উপাধ্যায়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সকল প্রকার নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করে দেশের পথ ধরল। পথের মধ্যে অরণ্যে সে একটি দেবালয় দেখতে পেল। সে দেবালয়ের কাছেই একটি সুন্দর সরোবর, সেই সরোবরের একদিকের জল খুব গরম। ক্রমে সূর্য গেল অস্তাচলে। রাত্রিকালে সেই গরম জলের মধ্য থেকে আটজন সুন্দরী মেয়ে উঠে এলো। তারা দেবালয়ে গিয়ে পূজা ও নাচগান করে দেবতাকে সন্তুষ্ট করলো। দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে তাদের প্রসাদ দিলেন।
    সকাল হলে তারা অনর্গলকে দেখতে পেল। তাদের মধ্যে একজন বললো, আমাদের সঙ্গে নগরে এস।
    অনর্গলের মনের ইচ্ছা তাদের সঙ্গে যায় কিন্তু সেই গরম জলে তাদের প্রবেশ করতে দেখে ভয়ে সে যেতে পারল না।
    অনর্গল যথাসময়ে নিজ নগরে ফিরে এল।
    রাজা কুশল জিজ্ঞাসা করে বললেন, ওহে অনর্গল, দেশান্তরে গিয়ে আশ্চর্য কিছু দেখেছ কি?
    অনর্গল গরম জলের ঘটনাটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করল।
    রাজা কৌতুহলী হয়ে অনর্গলকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। সূর্য গেল অস্তাচলে।
    মধ্যরাত্রে সেই মেয়েরা এসে পূজা ও নাচগান করে দেবতাকে তুষ্ট করে সকালে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন তাদের মধ্যে একজন রাজাকে দেখে বললো, আমাদের সঙ্গে নগরে এস।
    সাহসী এবং বীর রাজা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করে তাদের সঙ্গে জলে ডুব দিলেন। জলের তলায় সপ্ত পাতালে তাদের নগর। তার রাজাকে সম্বর্ধনা জানিয়ে বললো, আপনার মত বীর ও শৌর্যসম্পন্ন কেউ নেই, আপনি এই রাজ্যের রাজা হোন, আমরা সকলে আপনার সেবা করব।
    আমি নিছক কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই এখানে এসেছি।
    তারা বললো, আমরা সকলেই আপনার উপর প্রসন্ন হয়েছি। আপনি বর প্রার্থনা করুন।
    রাজা বললেন, আপনারা কারা? পরিচয় দিন। তারা বললো, আমরা অষ্ট্র মহাসিদ্ধ। 
    রাজা বললেন, তাহলে আমাকে অষ্ট মহাসিদ্ধ প্রদান করুন |
    তারা রাজাকে অষ্টগুণযুক্ত আটটি রত্ন দান করলেন।
    রাজা সেই রত্নগুলি নিয়ে নিজ নগরের পথে রওনা হলেন। পথে এক ব্রাহ্মণ এসে তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, মহারাজ, আমার অনেকগুলো পোষ্য – আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। স্ত্রীর ভৎসনা সহ্য করতে না পেরে বিদেশে এসেছি। নীতিশাস্ত্রে বলেছে, নির্ধন পুরুষকে বাড়ির সকলেই পরিত্যাগ করে।
    রাজা ব্রাহ্মণের কথা শুনে মনে বড় ব্যথা পেলেন এবং তাঁকে কিছুক্ষণ আগে পাওয়া বিশেষ গুণসম্পন্ন আটটি রত্ন দান করে নিজ নগরে ফিরে এলেন ।
   পুতুল বললো, হে রাজন, আপনার যদি এরূপ ঔদার্য ও দানশীলতা থাকে তবে সিংহাসনে বসুন। সেদিনও ভোজরাজের সিংহাসনে বসা হল না।

    আবার ভোজরাজ সিংহাসনে বসতে গেলে আর একটি পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম মন্মথসঞ্জীবনী। আগে আমার এই গল্পটি শুনুন, তারপর সিংহাসনে বসবেন।     র...

    আবার ভোজরাজ সিংহাসনে বসতে গেলে আর একটি পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম মন্মথসঞ্জীবনী। আগে আমার এই গল্পটি শুনুন, তারপর সিংহাসনে বসবেন।
    রাজা বিক্রমাদিত্য বছরে ছয় মাস রাজত্ব করতেন আর ছয় মাস দেশভ্রমণ করতেন।
   একবার দেশভ্রমণে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে পদ্মালয় নামে এক নগরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে এক উদ্যানে জলপূর্ণ একটি সরোবর দেখে সেই সরোবর থেকে জল পান করলেন। তারপর একটি গাছের নীচে বিশ্রাম করতে বসলেন।
    ঐ সময় আরো কয়েকজন বিদেশী তৃষ্ণার্ত হয়ে ঐ সরোবরে জল পান করে ঐ গাছের নীচে বসে পরস্পর কথোপকথন করতে লাগল।
    তারা সকলেই স্বীকার করল, অনেক দেশ পরিভ্রমণ করেছি কিন্তু কোন মহাপুরুষের দর্শনলাভ আজও হল না ।
    একজন বললো, মহাপুরুষ দর্শন আমাদের ভাগ্যে ঘটবে কি করে? তাঁরা যেখানে থাকেন সে স্থান মানুষের অগম্য। পথ অতি দুৰ্গম, পথে বিঘ্নও অনেক।
    রাজা এই কথা শুনে বললেন, ওহে বিদেশী, এ কথা কেন বলছ, তোমার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। মানুষ যদি পৌরুষ এবং সাহসের সঙ্গে কাজ করে তাহলে কোন কাজই দুঃসাধ্য থাকে না। শাস্ত্রও বলেছে, মানুষ সাহস করলে বাঞ্ছিত দু'প্রাপ্য বস্তুও লাভ করতে পারে, কিন্তু যারা অলস প্রকৃতির তাদের তা কখনও লাভ হয় না; আকাশ থেকে কখনও কখনও জল পাওয়া যায় কিন্তু পাতাল থেকে জল আসবেই।
    রাজার এই কথা শুনে সেই বিদেশী বললো, আপনি কি করতে মনস্থ করেছেন বলুন ?
    রাজা বললেন, এখান থেকে দ্বাদশ যোজন পথ অতিক্রম করতে পারলে মহারণ্যে পৌঁছান যাবে। সেখানে বিরাট এক পর্বত দেখা যাবে- সেখানে বাস করেন যোগীশ্রেষ্ঠ ত্রিকালনাথ। তাঁকে দর্শন করলে তিনি সমস্ত বাঞ্ছিত বস্তু দান করেন। আমি সেখানেই যাচ্ছি।
    বিদেশী বললো, আমরাও আপনার সঙ্গী হব। অনুমতি করুন।
    রাজা বললেন, আপত্তির কোন কারণ নেই। এরপর তারা রাজার সঙ্গে চলতে চলতে দুর্গম অরণ্যপথ দেখে বললো, সেই পর্বত আর কত দুরে? রাজা বললেন, এখান থেকে আট যোজন দূরে সেই পর্বত। পথ খুবই দুৰ্গম, তবু আমরা সেখানে যাবই। ছয় যোজন পথ অতিক্রম করার পর দেখল অতি ভয়ঙ্কর এক সাপ পথ অবরোধ করে পড়ে আছে। তার মুখ থেকে আগুনের মত বিষ বের হচ্ছে। সেই ভয়ঙ্কর সাপ দেখে ভয়ে সকলেই পালিয়ে গেল! রাজা কিন্তু ভয় না পেয়ে এগিয়ে চললেন। সাপটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেন। তারপর যোগী ত্রিকালনাথকে দর্শন করে প্রণাম নিবেদন করলেন। যোগীরাজকে দর্শনমাত্র রাজা বিষমুক্ত হয়ে আগের মত সুস্থ হলেন।
    যোগীবর মৃদু হেসে বললেন, মানুষের অগম্য বিপদসঙ্কল এই স্থান, তুমি এত কষ্ট স্বীকার করে এখানে এসেছ কেন?
    রাজা বললেন, প্রভু, আমি আপনাকে দর্শন করতে এসেছি।
    যোগী বললেন, তোমার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে।
    রাজা বললেন, আমার কোন কষ্টই হয় নি বরং আপনাকে দর্শন করে আমার সকল পাপ দূর হল। আমি আজ ধন্য ।
    যোগীরাজ সন্তুষ্ট হয়ে রাজকে একটি ঘুঁটি, একটি ডাণ্ড ও একখানি কাঁথা দিয়ে বললেন, হে রাজন, এই ঘুঁটি দিয়ে মাটিতে যতগুলি দাগ টানা যায় একদিনে তত যোজন পথ যাওয়া যাবে। এই ভাণ্ডাটি ডান হাতে নিয়ে মৃত সৈন্যের গায়ে স্পর্শ করলেই সে জীবিত হয়ে উঠবে। আর বা হাত দিয়ে স্পর্শ করলে বিপক্ষের সৈন্য বিনাশ হয়ে যাবে। আর এই কাঁথাখানির কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়।
    রাজা ঐ তিনটি মহামূল্যবান জিনিস নিয়ে যোগীবরকে প্রণাম করে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
    পথে দেখলেন এক রাজপুত্র আগুন জ্বালার জন্য কাঠ সংগ্রহ করছে। রাজা জানতে চাইলেন, এ তুমি কি করছ?
    আমার রাজ্য কেড়ে নিয়েছে। আমি আজ সব হারিয়ে দরিদ্রজীবন যাপন করছি, এ আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে; তাই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরবো।
    রাজা তাকে নিরস্ত করে যোগীর কাছে পাওয়া সেই ঘুঁটি, ডাণ্ডা ও কাঁথাখানি তাকে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন এই তিনটি জিনিসের কি কি গুণ।
    রাজকুমার অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে রাজাকে প্ৰণাম করে সেস্থান ত্যাগ করে চলে গেল। রাজা বিক্রমাদিত্যও তাঁর রাজধানী উজ্জয়িনীতে ফিরলেন।
    পুতুল ভোজরাজকে বললো, রাজন, আপনার মধ্যে কি এই উদারতাগুণ আছে?
    রাজা যথারীতি মৌন হয়ে রইলেন।

    ভোজরাজ পরদিন সিংহাসনে বসতে গেলে অপর একটি পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম শৃঙ্গারকলিকা। আপনি সিংহাসনে বসবার আগে রাজা বিক্রমাদিত্যের কেমন ঔদা...

    ভোজরাজ পরদিন সিংহাসনে বসতে গেলে অপর একটি পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম শৃঙ্গারকলিকা। আপনি সিংহাসনে বসবার আগে রাজা বিক্রমাদিত্যের কেমন ঔদার্যগুণ ছিল, তা শুনুন ।
    একদিন রাজা বিক্রমাদিত্য সিংহাসনে বসে আছেন। সভায় নানা রাজ্যের সামন্তপুত্রর উপস্থিত আছেন। কেউ কেউ নিজের বংশের মহিমা কীর্তন করছেন, কেউ বা নিজ নিজ বাহুবলের প্রশংসা করছেন।
    এমন সময় একজন ব্যাধ এসে রাজ্যকে প্রণাম করে বললো, মহারাজ, বনের মধ্যে বিরাট এক বরাহ উপস্থিত হয়েছে। পর্বতের মত তার আকার। আপনি যদি দেখতে ইচ্ছা করেন তবে আসুন।
    ব্যাধের কথা শুনে রাজা বিক্রমাদিত্য উপস্থিত কুমারদের সঙ্গে নিয়ে বনের মধ্যে গিয়ে দেখলেন, নদীতীরে কুঞ্জবনের মধ্যে বরাহটি রয়েছে। কোলাহল শুনে বরাহটি কুঞ্জবন থেকে বেরিয়ে এল।
    তখন রাজা ছাব্বিশটি বাণের সাহায্যে সেই বরাহকে আঘাত করলেন কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বরাহটি সেই সকল অস্ত্রাঘাত অগ্রাহ্য করে একটি গুহার মধ্যে প্রবেশ করল। রাজাও ছেড়ে দেবার পাত্র নন, তিনিও পিছনে পিছনে সেই গুহায় প্রবেশ করলেন। গুহার মধ্যে ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে কিছুদূর যাওয়ার পর সুন্দর অট্টালিকা শোভিত একটি নগরী দেখলেন। নানা দেবমন্দির ও উপবন রয়েছে সেখানে। তিনি একটি অতি মনোরম রাজভবন দেখতে পেলেন। বিরোচনপুত্র বলি সেখানে রাজ্যশাসন করছেন।
    রাজভবনে প্রবেশমাত্র রাজা বলি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে প্রভু, আপনার এখানে আসার কারণ কি?
    রাজা বললেন, আপনাকে দেখার জন্যই এসেছি, অন্য কোন কারণ নেই।
    বলি বললেন, যদি আমাকে বন্ধু ভেবে এসে থাকেন তবে দয়া করে কিছু উপহার গ্রহণ করুন।
বিক্রমাদিত্য বললেন, আমার কোন কিছুরই অভাব নেই। আপনার প্রাসাদে যা কিছু আছে তার সবই আমার প্রাসাদে আছে।
    বলি বললেন, প্রভু, আমি সে অর্থে বলছি না, বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ কিছু উপহার দিতে চাইছি।
    এই কথা বলে তিনি তাঁকে রস ও রসায়ন নামে দুটি অদ্ভুত জিনিস দিলেন।
    রাজা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি ঘোড়ার পিঠে চেপে যেমনি পথে এসে পড়েছেন আমনি একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ পুত্রসহ তাঁর সামনে এসে আশীর্বাদ করে বললেন, আমি অত্যন্ত দরিদ্র এবং পীড়িত, অনাহারে দিন কাটছে, যাতে খেয়ে বাঁচতে পারি আপনি তার ব্যবস্থা করুন।
    রাজা বললেন, হে ব্ৰাহ্মণ, এখন আমার কাছে কিছুই নেই। যার দ্বারা আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারি, তবে এই রস ও রসায়ন আছে। রসের দ্বারা যে কোন ধাতু সোনায় পরিণত হয় আর এই রসায়ন যিনি খাবেন জরামৃত্যু তাঁকে স্পর্শ
করতে পারবে না। দুটির যেকোন একটি নিতে পারেন।
    ব্রাহ্মণ বললেন, যে রসায়ন খেলে জরামৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তাই আমাকে দান করুন।
    ব্রাহ্মণপুত্র বললেন, রসায়নে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই, জরামৃত্যু রহিত হলে অনন্তকাল দারিদ্র্য ভোগ করতে হবে, যে রসের দ্বারা ধাতু সোনায় পরিণত হয় তাই আমাদের দিন।
    তখন রাজা বিক্রমাদিত্য দুটি জিনিসই তাঁদের দিয়ে দিলেন। ব্রাহ্মণ সস্তুষ্টচিত্তে রাজাকে আশীর্বাদ করে প্রস্থান করলেন। বিক্রমাদিত্যও তাঁর নগর অভিমুখে চললেন।
    গল্প শেষ করে পুতুল বললো, এবার বলুন রাজা, এমন দানশীলতা আপনার মধ্যে আছে কি? যদি থাকে তবে সিংহাসনে বসুন। 
    সেদিনও ভোজরাজের সিংহাসনে বসা হল না।

    পরদিন রাজা সিংহাসনে বসতে গেলে বিলাসরসিকা নামে একটি পুতুল বললো, আপনার যদি রাজা বিক্রমাদিত্যের মত গুণ থাকে তবে সিংহাসনে বসুন। তার আগে আমার...

    পরদিন রাজা সিংহাসনে বসতে গেলে বিলাসরসিকা নামে একটি পুতুল বললো, আপনার যদি রাজা বিক্রমাদিত্যের মত গুণ থাকে তবে সিংহাসনে বসুন। তার আগে আমার এই গল্পটি শুনুন।
মণিপুরে গোবিন্দশর্মা নামে এক পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন। তিনি যখন তাঁর নিজের পুত্রকে নীতিশাস্ত্র উপদেশ দেন তখন আমিও তা শুনেছিলাম। সেই উপদেশ কি তাই আপনাকে এখন বলব
    যাঁরা বুদ্ধিমান তাঁরা কখনও দুর্জনের সংসর্গে থাকে না ! যদি থাকে তবে একের পর এক অনর্থের সৃষ্টি হয়। সর্বদা সজ্জনের সংসৰ্গই শ্রেয়। সাধুসঙ্গ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আনন্দ আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। কারো সঙ্গে শক্রতা করতে নেই। পরের মনে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। বিনা কারণে ভৃত্যদের তিরস্কার করা ঠিক নয়। গুরুতর দোষ না দেখলে কাউকে ত্যাগ করতে নেই। শত্রুর কাছেও হিত কথা বলবে। দান ও অধ্যয়ন ভিন্ন সময় নষ্ট করতে নেই। পিতামাতার সেবা করা অবশ্য কর্তব্য ।
    রাজা বিক্রমাদিত্য এই সব নিয়ম মেনে চলতেন। একদিন এক বিদেশী পর্যটক সভায় এলে রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো অনেক দেশ ঘুরেছেন, ঘুরতে ঘুরতে আশ্চর্য জিনিস কি দেখেছেন?
    পর্যটক বললেন, এক আশচর্য জিনিস দেখেছি। উদয়াচলে সূর্যদেবের এক মন্দির আছে। সেখান গিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। সেই গঙ্গাতীরে পাপবিনাশন নামে একটি শিবমন্দির আছে। সেইখানে গঙ্গাপ্রবাহ হতে প্রতিদিন একটি করে সোনার থাম ওঠে। সেই থামের উপর নবরত্নখচিত একটি সিংহাসন আছে। সেই থাম ক্রমশ উঁচু হতে হতে সূর্যের কাছে গিয়ে পৌঁছায়, তারপর দিনের শেষে আবার গঙ্গায় ডুবে যায়। প্রতিদিন একই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
    রাজা কৌতুহল দমন করতে না পেরে আর দেরী না করে সেই পর্যটককে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন।
    সকালে সূর্যোদয় হলে দেখা গেল গঙ্গাপ্রবাহ থেকে একটি সোনার থাম উঠল এবং তার উপর একটি রত্নসিংহাসন। রাজা বিক্রমাদিত এই সিংহাসনের উপর নিজে বসলেন। সেটিও দেখতে দেখতে সূর্যের দিকে উঠতে শুরু করল। তিনি যখন সূর্যের কাছে উপস্থিত হলেন তখন সূর্যকিরণের তেজে তাঁর দেহ মাংসপিণ্ডে পরিণত হল। সেই অবস্থাতেই তিনি সূর্যকে প্রণাম করে বললেন, জগতের একমাত্র চক্ষুকে, সৃষ্টি-বিনাশহেতুকে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানাই।
    তখন সূর্যদেব অমৃত ছিটিয়ে রাজাকে বাঁচিয়ে তুলে বললেন, হে রাজন, তুমি খুব সাহসী পুরুষ, প্রাণের মায়া ছেড়ে এখানে উপস্থিত হয়েছ, আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি, বর চাও। 
    রাজা বললেন, মুনিদেরও অগম্য আপনার এই স্থানে প্রবেশ করতে পেরেছি, আমার মত ভাগ্যবান আর কে আছে। আপনার অনুগ্রহে আমার কিছুরই অভাব নেই।
    এই কথা শুনে সূর্যদেব খুব সন্তুষ্ট হয়ে রাজাকে তাঁর নিজের কানের কুণ্ডল দুটি দান করে বললেন, রাজন, এই কুণ্ডল দুটির বিশেষত্ব হচ্ছে, এ থেকে প্রতিদিন একভার সোনা পাবে।
    রাজা কুণ্ডল দুটি নিয়ে সূর্যকে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম করে সেখান থেকে বেরিয়ে যেমনি উজ্জয়িনীর দিকে যাত্রা করলেন অমনি এক ব্রাহ্মণ তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করে যা সংগ্ৰহ করি তাতে বাড়ির সকলের পেট ভরে না !
    ব্ৰাহ্মণের কথা শুনে রাজা কুগুল দুটি তাঁকে দিয়ে বললেন, হে ব্ৰাহ্মণ, এই কুণ্ডল দুটি প্রতিদিন আপনাকে একভার করে সোনা দেবে।
    এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ রাজার প্রশংসা করতে করতে সে স্থান ত্যাগ করলেন । রাজাও উজ্জয়িনীতে ফিরে এলেন।
পুতুলটি বললো, হে রাজন, আপনার যদি এমন গুণ ও ত্যাগব্ৰত থাকে তবে সিংহাসনে বসুন। 
    রাজা এর কোন উত্তর দিতে পারলেন না।

    পরদিন মদনসুন্দরী নামে আর এক পুতুল বলল, ঔদার্যগুণে বিক্রমাদিত্যের সমতুল্য কেউ ছিলেন না।     — এখনও নেই।     ত্যাগই একমাত্র গুণ। বীর্য, ধৈ...

    পরদিন মদনসুন্দরী নামে আর এক পুতুল বলল, ঔদার্যগুণে বিক্রমাদিত্যের সমতুল্য কেউ ছিলেন না।
    — এখনও নেই।
    ত্যাগই একমাত্র গুণ। বীর্য, ধৈর্য ও জ্ঞান সকলেরই থাকে কিন্তু ত্যাগগুণ অতি বিরল। রাজা বিক্রমাদিত্য এই বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন।
    একবার অন্য দেশের এক রাজার সামনে এক স্তুতিকার বিক্রমাদিত্যের গুণগান করছিল। তা শুনে রাজা ঐ স্তুতিকারের উপর ভীষণ রেগে গেলেন।
    বিক্রমাদিত্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ -- তাঁর কি এমন গুণ আছে?
স্তুতিকার বলল, মহারাজ, দান, পরোপকার, সাহস, শৌর্যে তাঁর মত রাজা আর একজনও নেই। মানুষ সবচেয়ে ভালবাসে নিজের দেহকে কিন্তু রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর নিজের দেহকেও তুচ্ছ জ্ঞান করেন।
    এই কথা শুনে রাজা বললেন, বিক্রমাদিত্যের মত আমিও পরোপকারে জীবন উৎসর্গ করব। তিনি এক যোগীকে বললেন, পরোপকার করার জন্য রোজ যাতে নতুন নতুন বস্তু পাওয়া যায় তার উপায় বলুন।
    যোগী বললেন, সেরকম কোন উপায় আমার জানা নেই। তবে অমাবস্যার রাতে চৌষট্টি যোগিনীচক্রের পূজা করুন। পূর্ণাহুতির জন্য নিজ দেহ আগুনে আহুতি দিতে হবে।
    যোগীর পরামর্শ মত রাজাও ঐরূপ অনুষ্ঠান করলেন। যোগিনীচক্র প্রসন্ন হয়ে রাজাকে নতুন শরীর দান করে বললেন, রাজন, বর প্রার্থনা কর।
    রাজা বললেন, যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে আমার প্রাসাদে যে সাতটি মহাকলস আছে তা প্রতিদিন সুবর্ণপূর্ণ করুন।
    যোগিনীচক্র বললেন, যদি তিন মাস আগুনে তোমার দেহ আহুতি দিতে পার তবে আমরা তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করব।
    রাজা এই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে যথাবিহিত অনুষ্ঠান করে প্রতিদিন আগুনে নিজ দেহ আতুতি দিতে লাগলেন।
    রাজা বিক্রমাদিত্য এই ঘটনার কথা শুনে সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পূর্ণাহুতির সময় স্বয়ং আগুনে ঝাঁপ দিলেন।
    তখন যোগিনীচক্র তাঁকে আবার জীবিত করে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? তোমার দেহত্যাগের প্রয়োজন কি?
    বিক্রমাদিত্য উত্তর দিলেন, পরোপকারের জন্য আমি এ দেহ আগুনে আহুতি দিচ্ছি।
    যোগিনীচক্র বললেন, তোমার কথায় আমরা প্রসন্ন হয়েছি, তুমি বর প্রার্থনা কর।
    বিক্রমাদিত্য বললেন, যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে এই রাজা প্রতিদিন আহুতির জন্য যে কষ্ট পাচ্ছেন তা দূর করুন এবং এর প্রাসাদে যে সাতটি মহাকলস আছে তা সুবর্ণপূর্ণ করুন।
    তারা ‘তথাস্তু বলে চলে গেলেন। রাজা বিক্রমাদিত্যও নিজ নগরে ফিরে এলেন। এরপর পুতুল মহারাজকে বললে, আপনার যদি এরকম পরোপকারের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার মত গুণ থাকে তবে সিংহাসনে বসুন।
    ভোজরাজ সরে দাঁড়ালেন।

    পরদিন হরিমধ্যা নামে আর একটি পুতুল ভোজরাজকে বললো, শুনুন মহারাজ, একবার রাজা বিক্রমাদিত্য দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে সব দেশের রাজাদের নিজ অধীনে এনে স...

    পরদিন হরিমধ্যা নামে আর একটি পুতুল ভোজরাজকে বললো, শুনুন মহারাজ, একবার রাজা বিক্রমাদিত্য দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে সব দেশের রাজাদের নিজ অধীনে এনে সেই সব রাজাদের কাছ থেকে বহু মূল্যবান সব বস্তু উপটৌকন পেয়ে তাঁদের নিজের নিজের সিংহাসনে বসিয়ে আবার রাজধানীতে ফিরে এলেন।
    নগরে ঢোকার মুখে এক দৈবজ্ঞ বললেন, হে রাজন, এখন থেকে চারদিন নগরে প্রবেশের পক্ষে অশুভ।
    দৈবজ্ঞের কথামত বিক্রমাদিত্য নগরের বাইরেই একটি উদ্যানের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে চারদিন কাটালেন।
    সেই সময় ছিল বসন্তকাল। বসন্তের শোভা দেখে মন্ত্রী সুমন্ত্রী রাজার কাছে বললেন, মহারাজ, আসুন আজ বসন্তের পূজা করি। তাঁর পূজা করলে সব অমঙ্গল দূর হবে।
    মন্ত্রীর কথায় রাজা বসন্ত পূজার আয়োজন করলেন। মন্ত্রী একটি সুন্দর সভামণ্ডপ বানিয়ে ব্রাহ্মণদের, গায়কদের এবং নর্তকীদের ডাকলেন অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য। রাজ্যের সকল শ্রেণীর মানুষ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হল।
সভাস্থলে রত্নখচিত সিংহাসন রাখা হল এবং লক্ষ্মীনারায়ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল। পূজার জন্য কুমকুম, কর্পূর, কস্তুরী, চন্দন প্রভৃতি গন্ধদ্রব্য এবং জাতি, যুথিকা, মল্লিকা, কুশ, কেতকী প্রভৃতি ফুল সংগ্রহ করে আনা হল। এরপর রাজা পূজা সম্পূর্ণ করে ব্রাহ্মণদের ও উপস্থিত কলাকুশলীদের জামাকাপড়, টাকাপয়সা অনেক দান করলেন।
    এই সময় এক ব্রাহ্মণ এসে রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন, হে রাজন, আমার একটি আবেদন আছে।
   রাজা বললেন, বলুন ! ব্রাহ্মণ বললেন, আমি একজন ব্রাহ্মণ, নন্দিবর্ধন নগরে আমার বাস। আমার আটটি পুত্র, আমি সন্ত্রীক জগদম্বার নিকট সঙ্কল্প করেছিলাম – আমার কন্যা লাভ হলে কন্যার ওজনের সমপরিমাণ সোনা দান করব আর কন্যাকে কোন পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণের হাতে সম্প্রদান করব। যথাসময়ে আমার একটি কন্যা হয়। এখন তার বিবাহের সময় উপস্থিত। প্রতিশ্রুতি পালন করতে হলে কন্যার ওজমের সমপরিমাণ সোনা দান করতে হবে। একমাত্র রাজা বিক্রমাদিতাই পারেন।আমাকে এই দায় থেকে উদ্ধার করতে। তাই আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি।
    রাজা বললেন, হে ব্ৰাহ্মণ, আপনি যথাস্থানেই এসেছেন।
    তারপর ভাণ্ডারকে ডেকে বললেন, এই ব্রাহ্মণের কন্যার ওজনের সমান সোনা দাও এবং অন্যান্য কাজে ব্যয়ের জন্য আট কোটি স্বর্ণমুদ্রা দাও।
    রাজার আদেশ সঙ্গে সঙ্গে পালিত হল। ব্রাহ্মণ সন্তুষ্ট হয়ে রাজাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন।
রাজাও শুভমুহূর্তে নগরে প্রবেশ করলেন। পুতুল বললো, রাজন, আপনার মধ্যে যদি এরূপ ঔদার্য থাকে তবে সিংহাসনে বসুন। 
    ভোজরাজ নির্বাক হয়ে রইলেন।

    এবার পঞ্চদশ পুতুল বললো, রাজন, আমার নাম নিরুপমা, বিক্রমাদিত্যের পুরোহিতের নাম বসুমিত্র। তিনি দেখতে ছিলেন অত্যন্ত রূপবান আর গুণে ছিলেন সকল...

    এবার পঞ্চদশ পুতুল বললো, রাজন, আমার নাম নিরুপমা, বিক্রমাদিত্যের পুরোহিতের নাম বসুমিত্র। তিনি দেখতে ছিলেন অত্যন্ত রূপবান আর গুণে ছিলেন সকল বিদ্যায় পারদশী ! সেই কারণে রাজার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি রাজ্যের সকল লোকের উপকার করতেন।
    শাস্ত্রে আছে, গঙ্গাস্নান ভিন্ন অন্য কোন উপায়ে পবিত্র হওয়া যায় না। তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, যজ্ঞ বা দানের দ্বারা সদগতি লাভ না হতে পারে, কিন্তু গঙ্গাস্নান করলে ফল পাওয়া যায়।
    বসুমিত্র এই সব চিন্তা করে বারাণসীতে গিয়ে বিশ্বেশ্বর দর্শন করে ও পরে প্রয়াগে মাঘী পূর্ণিমায় স্নান করে দেশে ফেরার জন্য যাত্রা করলেন।
    পথে এক নগর পড়ল। সেই নগরে সুরবালা নামে এক অঙ্গরা রাজত্ব করতেন। তাঁর স্বামী ছিল না। সেখানে লক্ষ্মীনারায়ণের এক বিরাট মন্দির ছিল। তার মধ্যে একটি বিবাহ মণ্ডপ ছিল। মন্দির-দ্বারে একটি বিরাট লৌহপাত্রে তেল গরম হচ্ছে। সেখানে নিযুক্ত লোকরা যে সব বিদেশী ভ্রমণকারী সেখানে আসছেন তাঁদের বলছিল-- যে এই গরম তেলের মধ্যে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করবে সুরবালা তারই কণ্ঠে মালা দেবেন ।
    বসুমিত্র সবকিছু দেখে শুনে নিজ নগরে ফিরলেন। রাজা নিয়মমত জিজ্ঞাসা করলেন, বসুমিত্র দেশের বাইরে গিয়ে বলার মত আশ্চর্য কিছু দেখে থাকলে তা আমাকে বলুন।
    বসুমিত্র তখন সুরবালা ও সেই গরম তেলপাত্রের কথা বললেন।
    রাজা কৌতুহলী হয়ে বসুমিত্রকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলেন। স্নান করে ভক্তিচিত্তে লক্ষ্মীনারায়ণের পূজা করে সেই গরম তেলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। উপস্থিত সকলে হাহাকার করে উঠল। ঐ গরম তেলে পড়ে রাজার শরীর একটি মাংসপিণ্ড পরিণত হল।
    এই সংবাদ শুনে সুরবালা অমৃত এনে সেই মাংসপিণ্ডের উপর ছিটিয়ে দিলে দেখতে দেখতে রাজা আবার তার আগের রূপ ফিরে পেলেন।
    এরপর সুরবালা রাজার গলায় মালা দিতে এলে রাজা বললেন, যদি আমায় সুখী করতে চাও তাহলে আমার কথা শোন।
    সুরবালা বললেন, হে প্রভু, আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে, আপনি আজ্ঞা করুন।
    রাজা বললেন, এই যদি তোমার মনের কথা হয় তবে আমার সামনে উপস্থিত ব্ৰাহ্মণ বসুমিত্রকে বরণ করে নাও।
    সেই অন্সরা ‘তথাস্তু বলে বসুমিত্রের গলায় বরমাল্য দান করে তাঁকে বিবাহ করলেন।
    এরপর রাজা তাঁর রাজধানীতে ফিরে গেলেন। পুতুল বললো, মহারাজ, আপনার যদি এমন সাহস ও উদারতা থাকে তবে অবশ্যই সিংহাসনে বসুন।
    ভোজরাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সেদিনও তাঁর সিংহাসনে বস হল না।

    পরদিন সকালে চতুর্দশ পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম বিদ্যাবতী, বিক্রমাদিত্য সম্বন্ধে আমার কিছু বলার আছে।     বিক্রমাদিত্যের দেশ ভ্রমণের অভ্...

    পরদিন সকালে চতুর্দশ পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম বিদ্যাবতী, বিক্রমাদিত্য সম্বন্ধে আমার কিছু বলার আছে।
    বিক্রমাদিত্যের দেশ ভ্রমণের অভ্যাস ছিল। একবার তিনি ঠিক করলেন পৃথিবীতে কোথায় কি আশ্চর্য জিনিস আছে, কোথায় কোন তীর্থে কোন দেবতা আছেন দেখবেন। এই ভেবে তিনি যোগীর বেশে দেশ পর্যটনে বেরিয়ে পড়লেন।
    একসময় তিনি এক নগরে এসে পৌঁছলেন। সেই নগরের কাছে এক তপোবনে জগদম্বার এক বিরাট মন্দির ছিল। তার কাছে একটি নদী ছিল। রাজা নদীতে স্নান করে দেবতার প্রণাম সেরে মন্দিরে বসে সমস্ত দেখতে লাগলেন। এমন সময় এক যোগী সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।
    যোগী রাজাকে বললেন, আপনি কোথা হতে আসছেন?
    রাজা বললেন, আমি তীর্থযাত্রী, তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছি।
    যোগী বললেন, না, আপনি রাজা বিক্রমাদিত্য, একসময় আমি উজ্জয়িনীতে আপনাকে দেখেছি! তা এখানে আসার কারণ কি?
    রাজা বললেন, আমার মনোবাসনা এই যে, পৃথিবী ভ্রমণ করে কোথায় কি আশ্চর্য জিনিস আছে দেখব।
    যোগী বললেন, আপনি বিজ্ঞ হয়েও মূর্খের মত কাজ করছেন। রাজ্যে যদি বিদ্রোহ হয় তখন আপনি কি করবেন?
    —মন্ত্রীর উপর রাজ্যভার দিয়ে এসেছি।
    যোগী বললেন, রাজা, আপনি শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ করেছেন। রাজ্য বা কোন অমূল্য রত্ন নিজের হাতেই রাখা উচিত। বিপদের কথা কি বলা যায়। এইভাবে রাজ্য পরিত্যাগ করে দেশভ্রমণ করা আপনার উচিৎ নয়।
    যোগীর এই কথা শুনে রাজা বললেন, দেবতারা যা বিধান করেন তা হবেই। মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে কতটুকু করতে পারে। বজ্ৰ যাঁর অস্ত্র, দেবতারা যার সেনা, অমরপুরী যাঁর দুর্গ, আর হাতী যাঁর বাহন সেই বলসম্পন্ন ইন্দ্রও মাঝে মাঝে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসেন। অতএব দেবতারাও দৈবের হাতের পুতুল। যা হবার তা হবেই। এ বিষয়ে একটি গল্প শুনুন--
    উত্তরদেশে নদীপৰ্বতবন্ধন নামক একটি নগর আছে। সেখানে রাজশেখর নামে এক ধর্মশীল রাজা রাজত্ব করতেন। একসময় তাঁর জাতিরা একজোট হয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়ে তাঁকে নিবার্সিত করল। রাজশেখর মনের দুঃখে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
    একসময় রাজা স্ত্রীপুত্র সহ একটি গাছের নীচে আশ্রয় নিলেন। সূর্য অন্ত গেল। সেই গাছে পাঁচটি পাখি ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে নানা কথোপকথন করতে লাগলো। একটি পাখি বললো, এই নগরের রাজা মারা গেছেন, তাঁর কোন সন্তান নেই। সুতরাং কে রাজা হবেন? .
    অপর পাখি বললো, এই গাছের নীচে যে রাজা বসে আছেন তিনিই হবেন এই রাজ্যের রাজা।
    তৃতীয় পাখি বললো, তাই হোক। সকাল হতেই পাখিরা যে যার নিজের কাজে বেরিয়ে গেল। রাজাও আহ্নিক সেরে সুর্যকে প্রণাম করে নগরের রাজপথে এলেন।

    ঐ রাজ্যের অমাত্যরা এদিকে রাজা ঠিক করার জন্য একটি হাতীকে সুন্দর সাজ পরিয়ে মালা দিয়ে পাঠিয়েছিল। হাতীটি রাজশেখরকে দেখতে পেয়ে তাঁর গলায় মালা পরিয়ে নিজের পিঠে করে রাজপুরীতে নিয়ে এল। তখন অমাত্যরা মিলিত হয়ে রাজশেখরকে সিংহাসনে বসলেন।
    একসময় তাঁর রাজ্যের বিরোধী পক্ষের রাজারা একজোট হয়ে রাজশেখরকে নির্মুল করার জন্য সেই নগরে উপস্থিত হলেন। রাজা সেই সময় রাণীর সাথে পাশা খেলছিলেন।
    রাণী বললেন, মহারাজ, আপনি পাশা খেলছেন আর এদিকে আপনার জ্ঞাতিশত্রুরা আপনাকে রাজ্যচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে।
    রাজা বললেন, রাণী, দৈব অনুকূল না হলে কিছুই হবে না। আমি যখন গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন আমাকে যিনি এই রাজ্যের অধীশ্বর করেছেন তাঁর উপরই আমার এবং এই রাজ্যের সকল ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত আছি। তিনি যা করবেন তাই হবে।
    রাজার এই কথা শুনে দৈব চিন্তা করলেন, আমিই একে রাজা করেছি, যদি এখন আমি সচেষ্ট না হই তবে এর অনিষ্ট হবে। এই চিন্তা করে দৈব ভীষণ মূর্তি ধারণ করে সমস্ত শত্রুর সামনে এসে রুখে দাঁড়ালেন। তারা পরাজিত হল।রাজশেখর মনের আনন্দে রাজ্য সুখ ভোগ করতে লাগলেন।
    বিক্রমাদিত্যের কাছ থেকে এই গল্প শুনে যোগী সন্তুষ্ট হলেন এবং রাজাকে একটি শিবলিঙ্গ দান করে আশীর্বাদ করে বললেন, এইটি চিন্তামণির মত। মনে মনে যা চিন্তা করবেন তাই পাবেন এর কাছ থেকে। প্রতিদিন ভক্তিচিত্তে এর পূজা করবেন।
    রাজা হৃষ্টচিত্তে যোগীকে প্রণাম করে সেই নগরের পথে চলেছেন এমন সময় এক ব্ৰাহ্মণ এসে রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন, হে রাজন, প্রতিদিন শিবলিঙ্গের পূজা না করে আমি জলগ্রহণ করি না, কিন্তু আজ তিন দিন হল আমার শিবলিঙ্গটি হারিয়ে দিয়েছে, তাই আমি তিন দিন উপবাসী। আপনার হাতের ঐ শিবলিঙ্গটি আমাকে দিলে আমার অশেষ উপকার হয়। রাজা ব্রাহ্মণকে শিবলিঙ্গটি দান করে নিজ নগরে ফিরে গেলেন।
ভোজরাজ পুতুলের কথা শুনে চুপ করে রইলেন ।

    পরদিন ত্রয়োদশ পুতুল বলল, মহারাজ, আমার নাম জনমোহিনী। বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে আর একটি গল্প শুনুন। বিক্রমাদিত্য একবার যোগীবেশে দেশ পরিভ্রমণে ...

    পরদিন ত্রয়োদশ পুতুল বলল, মহারাজ, আমার নাম জনমোহিনী। বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে আর একটি গল্প শুনুন।
বিক্রমাদিত্য একবার যোগীবেশে দেশ পরিভ্রমণে বেরোলেন। গ্রামে এক রাত ও শহরে পাঁচ রাত এইভাবে তিনি কাটাতে লাগলেন ।
একদিন তিনি এক নগরে এসে পৌছলেন। সেই নগরের কাছে নদীতীরে একটি মন্দির আছে। মন্দিরের চাতালে বসে মহাজনরা প্রাচীন পুরাণ পৌরণিকদের মুখে শোনেন। রাজাও স্নান করে সেই চাতালে বসে পুরাণ শুনতে লাগলেন।
    পৌরণিকরা পরোপকারের কথা বলছিলেন-- ধন, ঐশ্বর্য, এ সবই চিরদিনের জন্য স্থায়ী নয়। একমাত্র ধর্ম-কর্ম চিরদিনের, কোটি কোটি গ্রন্থে লেখা আছে, যে পরোপকার করে সেই পুণ্যবান এবং পরকে যে দুঃখ দেয় সেই পাপী। যে দুঃখিতকে দেখে নিজে দুঃখ পায় এবং সুখীকে দেখে নিজে সুখী হয় সেই প্রকৃত ধাৰ্মিক।
    যাঁরা শুনছিলেন তাঁরা সায় দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নদী পার হতে গিয়ে প্রবল শ্রোতে ভেসে গেলেন। ভাসতে ভাসতে বেচারি আকুলভাবে ডাকতে লাগলেন, মহাজনরা, শীঘ্র আসুন, আমরা জলে ডুবে মারা গেলাম। আপনারা আমাদের এ বিপদ থেকে শীঘ্র উদ্ধার করুন।
    সকলেই জলে ভাসমান ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ এক পা নড়ল না তাঁদের বাঁচানোর জন্য। একমাত্র বিক্রমাদিত্য নদীতে লাফ দিয়ে পড়ে প্রবল স্রোত হতে ব্ৰাহ্মণ এবং তাঁর স্ত্রীকে উদ্ধার করলেন।
    তারপর ব্রাহ্মণ সুস্থ হয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যকে বললেন, হে মহাপুরুষ, আপনি আমায় প্রাণদান করে যে পরোপকার করলেন আমি তার প্রতিদানে আপনার কিছু উপকার করতে চাই। এই গোদাবরীর জলের মধ্যে বার বছর ধরে মন্ত্র জপ করে যে পুণ্যফল পেয়েছি তা আপনাকে দান করলাম। তার চান্দ্রয়ানি কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে আমার যা পুণ্য হয়েছে তাও আপনাকে দিলাম। এই বলে ব্রাহ্মণ রাজাকে আশীর্বাদ করে চলে গেলেন;
    এমন সময় এক ভয়ঙ্কর রাক্ষস বিক্রমাদিত্যের কাছে এসে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে?
    --আমি এক ব্ৰাহ্মণ, এই নগরেই আমার বাস। আমি দুষ্কৃতি করে সারা জীবন কাটিয়েছি। সব সময় গুরু, সাধু ও মহাজনদের নিন্দা করতাম, সেই পাপের ফলে ব্ৰহ্মরাক্ষস হয়ে আজ এই গাছে দশ হাজার বছর অতি কষ্টে আছি। আপনি যদি আজ দয়া করেন, তবে আমি উদ্ধার হব।
    রাজা এ কথা শুনে আগে পাওয়া সমস্ত পুণ্য ব্ৰহ্মরাক্ষসকে দান করলেন। ব্রহ্মরাক্ষস সেই পুণ্যফলে দিব্যরূপ লাভ করে রাজার প্রশংসা করে স্বৰ্গে চলে গেল। রাজাও তাঁর রাজধানী উজ্জয়িনীতে ফিরে এলেন।
আপনার যদি এমন পরোপকার গুণ থাকে এবং যদি এমন দাতা হয়ে থাকেন তবে সিংহাসনে বসুন। 
    ভোজরাজ মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে রইলেন।