Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

বেতাল পঞ্চবিংশতি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

    যক্ষ তোমায় যে রাজা চন্দ্রভানুর কথা বলেছিল, এই মৃতদেহ, যেটা তুমি কাঁধে নিয়ে যাচ্ছ সেটা তারই। আর শ্মশানের সেই সাধু হলো কুমোর যোগী শান্তশ...

    যক্ষ তোমায় যে রাজা চন্দ্রভানুর কথা বলেছিল, এই মৃতদেহ, যেটা তুমি কাঁধে নিয়ে যাচ্ছ সেটা তারই। আর শ্মশানের সেই সাধু হলো কুমোর যোগী শান্তশীল। সে রাজা চন্দ্রভানুকে মেরে শিরীষ গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল আর এখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমায় খুন করা।
     আমি এখনই এই শব ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তুমি এটা ঐ সাধুর কাছে নিয়ে যাও। শবটা পেলেই সে পূজা শুরু করবে, তারপর পূজা শেষ হলে তোমায় বলবে, দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর। তুমি যেই মাথা নীচু করে প্রণাম করতে যাবে অমনি সে খড়গ দিয়ে তোমার মাথা কেটে ফেলবে।
তাই সাবধান করে দিচ্ছি, তুমি ও কাজ একদম করতে যাবে না। বলবে, আমি রাজা, কাউকে কোন দিন প্রণাম করি নি। কি ভাবে প্রণাম করতে হয় তা আপনি আমায় দেখিয়ে দিন। তোমার কথা শুনে সন্ন্যাসী যেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবে, অমনি তুমি খড়গ দিয়ে এক কোপে তার মাথাটা কেটে ফেলবে। তারপর তাহলেই তার সমস্ত যোগফল তোমার হবে। তুমি অনেকদিন শান্তিতে রাজত্ব করতে পারবে। আমি যা বললাম তুমি অবশ্যই তা করবে, নইলে কিন্তু সে তোমায় বলি দেবে।
    এই বলে বেতাল সেই শব ছেড়ে চলে গেল। বিক্রমাদিত্য শব নিয়ে শ্মশানে গেল। তারপর সাধু পূজা শেষ করে রাজাকে প্রণাম করতে বললেন। তারপর বেতালের কথামত সাধু যেই প্ৰণাম করতে গেল বিক্রমাদিত্য সাথে সাথে খড়গ দিয়ে এক কোপে তার মাথাটা কেটে ফেললেন। 
     এতে শ্মশানের চারদিক থেকে ভূতেরা রাজার জয়ধ্বনি করে উঠল। দেবতারা দেখা দিয়ে বললেন, তোমার উপর আমরা খুব খুশি হয়েছি। বর চাও। 
     বিক্রমাদিত্য বললেন, আশীর্বাদ করুন যে এই পঁচিশটা গল্প আর বেতালের কথা যেন লোকে কখনো না ভোলে 
    দেবতারা ‘তথাস্তু’ বলে চলে গেলেন। 
বিক্রমাদিত্য তখন  সাধু আর রাজা চন্দ্রভানুর মৃতদেহ দুটো নিয়ে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে ফেলে দিলেন। সাথে সাথে দুই ভয়ংকর রাক্ষস দেখা দিয়ে বলল, মহারাজ, আমরা হলাম তাল-বেতাল। আপনি যা হুকুম করবেন, আমরা তাই করবো। 
বিক্রমাদিত্য বললেন, ঠিক আছে, দরকার পড়লে তোমাদের ডাকব । এখন যাও। 
এরপর রাজধানীতে ফিরে বিক্রমাদিত্য বহুবছর সুখে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর সুনামের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

    দক্ষিণাত্যে ধর্মপুর নামে এক নগর ছিল। সেই নগরে মহাবল নামে এক ক্ষমতাশালী রাজা ছিলেন । প্রতিপক্ষ রাজা প্রচুর সৈন্য নিয়ে রাজধানী অবরোধ করলে...

    দক্ষিণাত্যে ধর্মপুর নামে এক নগর ছিল। সেই নগরে মহাবল নামে এক ক্ষমতাশালী রাজা ছিলেন । প্রতিপক্ষ রাজা প্রচুর সৈন্য নিয়ে রাজধানী অবরোধ করলে রাজা মহাবল তাঁর সমস্ত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন । কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন না থাকায় ক্রমে সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হলো। তখন নিরুপায় হয়ে মহাবল প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে গভীর বনে ঢুকলেন ।
     অনেক পথ হাঁটায় তিনজনই ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়লেন। তখন রাজা স্ত্রী ও কন্যাকে একটি গাছের তলায় বসিয়ে খাদ্যের সন্ধানে বের হলেন । এদিকে দিনের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে এল বনে । কিন্তু মহাবল আর ফিরলেন না। মা ও মেয়ে গুড়িসুবি মেরে কোনরকমে গাছতলায় বসে রইল।
     ঐদিনই কুন্ডিনের রাজা চন্দ্রসেন তাঁর বড় ছেলেকে নিয়ে মৃগয়া করতে ঐ বনে ঢুকেছিলেন। তাঁরা ঐ গভীর বনের মধ্যে মানুষের পায়ের চিহ্ন দেখে খুবই বিস্মিত হলেন । এবং আরও বিস্মিত হলেন এই দেখে যে ঐ পায়ের চিহ্ন স্ত্রীলোকের ।
     পিতা-পুত্র দু’জনে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যার মুখে দেখলেন দুটি পরমাসুন্দরী নারী গাছের নীচে বসে একে অপরের দিকে চেয়ে কাঁদছে।
এই অবস্থা দেখে তাদেরও খুব দুঃখ হলো । তাঁরা অনেক করে তাঁদের বুঝিয়ে শান্ত করলেন এবং সসম্মানে তাঁদের রাজধানীতে নিয়ে গেলেন। 
     কিছুদিন পর রাজা চন্দ্রসেন ৰিয়ে করলেন সেই রাজকন্যাকে আর রাজপুত্র বিয়ে করলেন রাণীকে। 
    গল্প এখানেই শেষ করে বেতাল বললো, বল রাজা, এদের যখন ছেলেপূলে হবে তখন তাদের মধ্যে কি সম্বন্ধ হবে বেতালের প্রশ্ন শুনে বিক্রমাদিত্য অনেক ভাবলেন কিন্তু ঠিক উত্তরটা এল না তাঁর মনে, তাই তিনি নীরবেই পথ চলতে লাগলেন। 
     যেমন কথা হয়েছিল, তাতে উত্তর দিতে না পারলে রাজার বুক ফেটে মরে যাওয়া উচিত। কিন্তু বিক্রমাদিত্যের বুদ্ধি, সাহস আর ধৈর্য্য দেখে বেতাল খুব খুশি হয়েছিল। সে কোন ক্ষতি না করে বললো, রাজা, এবার আমি যা বলি তা মন দিয়ে শোন। আমার কথামত কাজ করলে তোমার উপকার হবে।

    কলিঙ্গদেশে যজ্ঞশর্মা নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর কোন পুত্র না থাকায়, অনেক দেবতার কাছে প্রার্থনা করার পর একটি পুত্র লাভ করেন।      ...

    কলিঙ্গদেশে যজ্ঞশর্মা নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর কোন পুত্র না থাকায়, অনেক দেবতার কাছে প্রার্থনা করার পর একটি পুত্র লাভ করেন।
     পুত্র অল্প বয়সেই সবরকম শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠল। বাবা-মার সেবা করেই তার দিন কাটত । কিন্তু এমন গুণবান পুত্রের বয়স যখন আঠারো বছর তখন তার মৃত্যু হলো ।
    বাবা-মার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো । দু’জনে অনেক কান্নকাটি করলেন। মৃতদেহ সৎকারের জন্য গ্রামের সীমানায় চিতা সাজালেন।
    এক বৃদ্ধ যোগী বহুদিন ধরে ঐ শ্মশানে যোগাভ্যাস করছিলেন। তিনি আঠার বছরের ঐ ব্রাহ্মণকুমারকে দেখে ভাবলেন আমার জীর্ণশীর্ণ দেহ দিয়ে আর কোন কাজই হচ্ছে না। আমি যদি ঐ ব্রাহ্মণকুমারের দেহে প্রবেশ করি তবে অনেকদিন যোগাভ্যাস করতে পারব। মনে মনে এই সঙ্কল্প করে যোগবলে তিনি সেই দেহের মধ্যে প্রবেশ করলেন ।
     ব্রাহ্মণকুমার সঙ্গে সঙ্গে জীবন ফিরে পেল। যজ্ঞশম পুত্রকে ফিরে পেয়ে আনন্দে হাসতে লাগলেন কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই কাঁদতে আরম্ভ করলেন ।
     বেতাল এখানেই গল্প শেষ করে রাজ্যকে প্রশ্ন করল, মহারাজ, পুত্রকে ফিরে পেয়ে যজ্ঞশম প্রথমে কেন হাসলেন আর পরে কেন কাঁদলেন?
     রাজা বললেন, পুত্রকে ফিরে পেয়ে ব্রাহ্মণের আনন্দ হওয়াই স্বাভাবিক, সেই আনন্দে তিনি হেসেছিলেন। কিন্তু তিনি পরদেহপ্রবেশনী বিদ্যা জানতেন; ঐ বিদ্যার প্রভাবে পরক্ষণেই জানতে পারলেন পুত্র পুনজীবন লাভ করে নি; যোগী তার যোগ-সাধনার বলে এটা করেছে। এই জন্য পরে কাঁদলেন।
     সঠিক উত্তর পেয়ে বেতাল রাজার কাঁধ থেকে নেমে আবার সেই গাছে গিয়ে ঝুলে পড়ল আর রাজাও তাকে পুনরায় কাঁধ নিয়ে চলতে আরম্ভ করলেন। বেতালও তার পঞ্চবিংশতি গল্প আরম্ভ করল।

     ধর্মপুরে গোবিন্দ নামে এক ব্রাহ্মণের দুটি পুত্র ছিল। বড়জন ভোজনবিলাসী, অৰ্থাৎ রান্না খারাপ হলে তা তার মুখে রুচতো না। ছোটজন শস্যাবিলাসী, ...

     ধর্মপুরে গোবিন্দ নামে এক ব্রাহ্মণের দুটি পুত্র ছিল। বড়জন ভোজনবিলাসী, অৰ্থাৎ রান্না খারাপ হলে তা তার মুখে রুচতো না। ছোটজন শস্যাবিলাসী, আর যাই হোক তার বিছানাটি চাই আরামদায়ক । কোন খুৎ থাকলে তার ঘুম হবে না।
     সেখানকার রাজার কানে কথাটা গেল। তিনি কৌতুহলবশত দুই ভাইকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন এবং জানতে চাইলেন তোমরা কে কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ?
     তারা দু’জন নিজের নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে ভোজনবিলাসীকে পরীক্ষা করার জন্য রাজা ভাল পাচক ডেকে যতরকমের ভাল খাবার হতে পারে সবরকম রান্নার আদেশ দিলেন । রাজার আদেশে পাচক খুব যত্ন কবে নানারকম সুখাদ্য রান্না করলো ।
     রাজা তখন ভোজনবিলাসীকে সঙ্গে করে খাবার ঘরে উপস্থিত হলেন এবং তাকে আহার করতে বললেন; কিন্তু সে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজার কাছে ফিরে এল।

     রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, বেশ তৃপ্তি করে খেয়েছ তো ?
     সে বললো, না মহারাজ, খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হলো না ।
     রাজা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?
    সে বললো, মহাবাজ, ভাতে মরার গন্ধ। আমার মনে হচ্ছে শ্মশানের কাছের কোন ক্ষেতের ধান থেকে ঐ চাল হয়েছে।
    রাজা এই কথা শুনে অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন। ভাবলেন পাগলের প্রলাপ ছাড়া এ আর কিছুই নয়। তিনি তখন কোন কথা না বলে গোপনে ব্যাপারটার সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য ভাণ্ডারকে আদেশ করলেন।
     রাজার আদেশমত ভাণ্ডারী অনুসন্ধান করে রাজাকে জানালেন, মহারাজ, গ্রামের শেয প্রান্তে যে শ্মশান আছে তার পাশের ক্ষেতের ধান থেকেই ঐ চাল হয়েছে।
     রাজা শুনে অবাক হলেন এবং ভোজনবিলাসীকে বাহবা দিয়ে বললেন, তুমি যথার্থই ভোজনবিলাসী। এরপর রাজা এক সুসজ্জিত শয়ন ঘরে ধবধবে সাদা এক শয্যায় শয্যাবিলাসীকে শুতে দিলেন।
      সে অল্পক্ষণ পরেই রাজার কাছে এসে বললো, মহারাজ, শয্যায় আমার শোয়া হলো না।
     রাজা বিস্মিত হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলে শয্যাবিলাসী বললো, মহারাজ, ঐ শয্যার সাতটি তোষকের নীচে একটি চুল আছে; তাতে আমি বড়ই অস্বপ্তি বোধ করছিলাম, তাই উঠে এসেছি।

     রাজা হতবাক ! এও কি সম্ভব? রাজা নিজে সেই শয়নঘরে ঢুকে বিছানার সাতটি তোষকের নীচে সত্যিই একটা চুল পেলেন ।
     রাজা খুশি হয়ে তার প্রশংসা করে বললেন, তুমি প্রকৃতই শয্যাবিলাসী।
     এরপর রাজা সন্তুষ্ট হয়ে দুই ভাইকে প্রচুর পুরস্কার দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
     গল্প এখানেই শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ, এই দুই ভাইয়ের মধ্যে কে সবচেয়ে প্রশংসার যোগ্য ?
    রাজা বললেন, আমার মতে শয্যাবিলাসী। 
    রাজার উত্তর শুনে বেতাল আর একমুহুৰ্তও না থেকে গাছে গিয়ে ঝুলে পড়লো। কিন্তু রাজা বিক্রমাদিত্য কি তাকে ছেড়ে দেবেন? তিনিও সঙ্গে সঙ্গে তাকে কাঁধে নিয়ে আবার চলতে আরম্ভ করলেন। আর বেতালও চতুর্বিংশ গল্প আরম্ভ
করল।

    বিশ্বপুর নগরে নারায়ণ নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি একদিন ভাবলেন, বয়সের ভারে আমি এখন দুর্বল। আর কিছুদিনের মধ্যেই মরতে হব...

    বিশ্বপুর নগরে নারায়ণ নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি একদিন ভাবলেন, বয়সের ভারে আমি এখন দুর্বল। আর কিছুদিনের মধ্যেই মরতে হবে । আমি পরদেহধারণবিদ্যা জানি। এই জরাজীর্ণ দেহ ত্যাগ করে কোন যুবকের দেহ ধারণ করে ইচ্ছামত যতদিন খুশি বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু তার জন্য সংসার ত্যাগ করে বনে যেতে হবে।
    মনে মনে এই কথা ভেবে নারায়ণ বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বনে চলে গেলেন। স্ত্রী-পুত্রদের বলে গেলেন, জীবনের শেষ কটা দিন যোগাভ্যাস করে কাটাতে বনে চললাম ।


     বনে গিয়ে তিনি তাঁর নিজের জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে এক যুবকে পরিণত হলেন । কিন্তু মহারাজ, ব্রাহ্মণ নিজের জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করার আগে কোঁদছিলেন এবং তারপর যখন অন্যের দেহ ধারণ করলেন তখন হাসলেন । ব্রাহ্মণ কেন প্রথমে কাঁদলেন এবং পরে হাসলেন?
     রাজা বললেন, আগের দেহ ত্যাগ করা মানেই এতদিন যাঁরা আপনজন ছিল অথাৎ স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধ থাকল না তাই সেই দুঃখে কাঁদলেন, আর পরে যৌবনদেহ ধারণ করে অনেক ফুর্তি করতে পারবেন ভেবে হাসলেন।
     বেতাল ঠিক উত্তর পেয়ে আবার সেই গাছে গিয়ে উঠলো আর রাজাও তাকে পুনরায় গাছ থেকে নামিয়ে কাঁধে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলেন আর বেতালও ত্রয়োবিংশ গল্প বলতে আরম্ভ করল।

     সেকালে জয়স্থল নগরে বিষ্ণুস্বামী নামে এক ধাৰ্মিক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর চার ছেলে চার অবতার, বাবার ঠিক উল্টো। বড়টি জুয়াড়ী, মেজটি চর...

     সেকালে জয়স্থল নগরে বিষ্ণুস্বামী নামে এক ধাৰ্মিক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর চার ছেলে চার অবতার, বাবার ঠিক উল্টো। বড়টি জুয়াড়ী, মেজটি চরিত্রহীন, সেজটি বেহায়া আর ছোটটি নাস্তিক ।
     এই সময় বাবা-মা দু’জনেই মারা গেলে চার ভাইয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয় হলো। কোন অভিভাবক না থাকায় বিষয় আশয় যা কিছু ছিল আত্মীয়স্বজনেরা সব আত্মসাৎ করলো। তখন চার ভাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, কিছুই আর রইল না যখন তখন আর এখানে থেকে কি খেয়ে বাঁচব আমরা, এর চেয়ে চলো আমরা আমাদের মামাবাড়ি যজ্ঞস্থলে যাই ।
     এইরকম সব যুক্তি করে চার ভাই যজ্ঞস্থলে গিয়ে হাজির হলো। চার ভাই সেখানে থেকে দিন কাটাতে লাগল। কিন্তু সে আর কত দিন ? নিঃস্ব কপর্দকহীন ভাগনেদের কতদিন আর মামারা পুষবেন? চার ভাইই লক্ষ্য করলো মামাবাড়িতে তাদের ক্রমেই যেন অবহেলা করা হচ্ছে, ঘৃণা করা হচ্ছে। এ ভাবটা যেন ক্রমশঃই বৃদ্ধি পেতে লাগল।
     তখন সবাই মিলে ঠিক করলে পৃথিবীর সর্বত্র ঘুরে দিব্য বিদ্যা অর্জন করে একটা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় সবাই এসে মিলিত হবে। এরপর ঐ বিদ্যা লাভের জন্য কেউ গেল পুবে, কেউ গেল পশ্চিমে, কেউ উত্তরে, কেউ দক্ষিণে। সারা পৃথিবী ঘুরে বিদ্যা অর্জন করে একটা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে চার ভাই-ই আবার মিলিত হলো । এরপর কথা উঠলো কে কি বিদ্যা অর্জন করে এসেছে। একজন বললো, কোন মৃত জীবের হাড় পেলে আমি আমার বিদ্যাবলে তাতে মাংস বসিয়ে দিতে পারি। দ্বিতীয়জন বললো, আমি আবার তাতে চামড়া এবং লোম বসিয়ে দিতে পারি। তৃতীয় ভাই বললো, আমি তাতে ঐ জীবের অন্যান্য অঙ্গ সৃষ্টি করে তাকে পূর্ণাঙ্গ করে দিতে পারি। তৃতীয়ের কথা শেষ হলে চতুর্থ ভাই বললো, আমি শিখে এসেছি এইরকম মৃত জীবের দেহে প্রাণ সঞ্চার করতে ।
     শুরু হলো হাড় খোজা, খুঁজতে খুঁজতে পাওয়াও গেল বনের মাঝে কযেকখানা হাড়, সিংহের হাড়। হাড়টা পেয়েই চার ভাই নিজের নিজের বিদ্যা জহির করতে শুরু করে দিল। প্রথম ভাই হাড়ে মাংস লাগিয়ে দিল, দ্বিতীয় বসালে তাতে চামড়া আর লোম, তৃতীয় ভাই ঐ জীবের আর যে যে অঙ্গ বাকী ছিল তা সংযোগ করে তাকে পূর্ণাঙ্গ করে দিল, হয়ে উঠল তখন সেটা একটা সিংহের দেহ, চতুর্থ ভাই-ই বা তখন তার বিদ্যা জাহির করবে না কেন? সে তখন তাতে প্রাণ সঞ্চার করতেই সেই ভয়ংকর সিংহটা কেশর ফুলিয়ে তীক্ষনখরওয়াল থাবার ঘা মেরে ও কামড়ে চার ভাইকেই খেয়ে ফেলল ।
     গল্প শেষ করে বেতাল বললো, এবার বল তো, চার ভাইয়ের সৃষ্ট সিংহ যে চার ভাইকেই শেষ করলো, এর জন্য দোষী কে ?
     উত্তরে রাজা বললেন, দোষ হচ্ছে তার-যে একে প্রাণ দান করেছে, অন্য তিন ভাই শুধু নিজের নিজের বিদ্যার পরিচয় দিয়েছে, জীবটা শেষে কি হয়ে দাঁড়াবে তারা তা বুঝতেই পারে নি, কিন্তু শেষের জন যখন দেখল এ একটা সিংহের দেহ, তখন সে মূর্খের মত তাতে প্রাণ সঞ্চার করতে গেল বলেই এই কাণ্ডটি ঘটল।
     রাজার মুখে এই কথা শুনে বেতাল তাঁর কাঁধ ছেড়ে আগে যেখানে ছিল, সেখানে আবার চলে গেল এবং রাজা আবার সেখান থেকে তাকে তুলে আনলেন।
     বেতালও দ্বাবিংশ গল্প বলতে আবস্তু করল।

     বিশালপুর নগরে অর্থদত্ত নামে এক ধনী বণিক বাস করতেন। তিনি কমলপুরবাসী মদনদাস বণিকের সঙ্গে মেয়ে অনঙ্গমঞ্জরীর বিয়ে দিলেন।      বিয়ের কিছু...

     বিশালপুর নগরে অর্থদত্ত নামে এক ধনী বণিক বাস করতেন। তিনি কমলপুরবাসী মদনদাস বণিকের সঙ্গে মেয়ে অনঙ্গমঞ্জরীর বিয়ে দিলেন।
     বিয়ের কিছুদিন পর মদনদাস তার স্ত্রী অনঙ্গমঞ্জরীকে তার বাবা মার কাছে রেখে বাণিজ্য করতে বিদেশে রওনা হলো ।
     একদিন অনঙ্গমঞ্জরী জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার লোকজন চলাচল দেখছিল। এমন সময় কমলাকর নামে এক সুন্দর ব্রাহ্মণপুত্রকে দেখে সে মুগ্ধ হলো। কমলাকরও তাকে দেখে মুগ্ধ হলো ।
      দু'জনেই দুজনের জন্য নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে দিল।
    অনঙ্গমঞ্জরীর সখী ঠিক করলো,  এ অবস্থায় কমলাকরকে এখানে আনতে না পারলে অনঙ্গমঞ্জরীকে কিছুতেই বাঁচানো যাবে না। তাই সে কমলাকরের বাড়িতে গিয়ে সমস্ত ঘটনা বলে তাকে অনঙ্গমঞ্জরীর কাছে যেতে বললো।
    কমলাকর সমস্ত শুনে তখনই অনঙ্গমঞ্জরীর সঙ্গে দেখা করতে ছুটলো। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, অনঙ্গমঞ্জরী প্রাণত্যাগ করেছে !
     কমলাকরও দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটিতে পড়ে গেল। সেই যে পড়ল, সে আর উঠল না।
     দু'জনকেই শ্মশানে নিয়ে গিয়ে একই চিতায় দাহ করা হলো। ঠিক সেই সময় মদনদাসও সেখানে উপস্থিত হলো। সব কথা শুনে সেও মনের দুঃখে জুলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করল।
     বেতাল বললো, বল মহারাজ, এই তিনজনের মধ্যে কার ভালবাসা সবচেয়ে বেশী ছিল?
     রাজা বললেন, মদনদাস ! 
    বেতাল বললো, কেন ?  রাজা বললেন, অনঙ্গমঞ্জরী আর কমলাকর তারা একে অপরকে ভালবাসতো তাই মনের দুঃখে দু'জনেই মারা গেল। কিন্তু মদনদাসের কথাই চিন্তা কর, তার স্ত্রী তাকে ভালবাসে না জেনেও সে প্রাণ ত্যাগ করল। তার ভালবাসা অনেক বেশী ছিল।
    উত্তর শুনে বেতাল আবার গাছে গিয়ে ঝুলল আর রাজাও তাকে নামিয়ে রওনা দিলেন । বেতালও একবিংশ গল্প আরম্ভ করল ।

     চিত্রকূট নগরে রূপদত্ত নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। একদিন তিনি একা ঘোড়ায় চড়ে শিকার করতে বেরোলেন। হরিণের আশায় বনে বনে অনেক ঘুরলেন কিন্ত...

     চিত্রকূট নগরে রূপদত্ত নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। একদিন তিনি একা ঘোড়ায় চড়ে শিকার করতে বেরোলেন। হরিণের আশায় বনে বনে অনেক ঘুরলেন কিন্তু একটিও হরিণ না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে তিনি এক ঋষির আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে সুন্দর একটি সরোবর ছিল। তিনি সরোবরের তীরে গিয়ে দেখলেন টলটল করছে নীল জল, তাতে অনেক পদ্মফুল ফুটে আছে। মৌমাছিরা গুনগুন করছে আর ফুলে ফুলে মধু খাচ্ছে। পাখিরা ডালে বসে গান করছে। রাজা মুগ্ধ হয়ে এই সব দেখতে লাগলেন।


     এমন সময় অপূর্ব সুন্দরী এক ঋষিকন্যা আশ্রম থেকে বেরিয়ে সরোবরে নামল স্নান করতে । রাজা তার রূপে মুগ্ধ হলেন।
    এমন সময় ঋষিও ফল, ফুল, সমিধ প্রভৃতি সংগ্ৰহ করে সেই পথ দিয়েই ফিরছিলেন। রাজা তাকে দেখে ভক্তিভরে প্রণাম করলে ঋষি আশীর্বাদ করে বললেন, তোমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হোক ।
     রাজা হাতজোড় করে বললেন, আমি আপনার কন্যাকে বিয়ে করতে চাই। আমার ইচ্ছা পূর্ণ করুন প্রভু।
    ঋষি রাজার এই প্রস্তাবে মনে মনে খুবই ক্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু নিজের কথার সম্মান রক্ষা জন্য হলেন । কিন্তু নিজের কথার সম্মান রক্ষার জন্য রাজার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন।
    রাজা নববধূকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর দিকে রওনা হলেন। পথে রাত হয়ে গেল। রাজা ও তাঁর স্ত্রী ফলাহার করে গাছতলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন ।
     মাঝরাতে এক রাক্ষস এসে রাজাকে জাগিয়ে বললো, আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমি তোমার স্ত্রীর নরম মাংস খাব৷
     রাজা বললেন, তুমি আমার স্ত্রীর মাংস না খেয়ে অন্য যা চাও তাই দেব ।
     রাক্ষস বললো, বেশ, যদি একটা বারো বছর বয়সের ব্রাহ্মণের ছেলের মাথা কেটে আমাকে দিতে পার তবে তোমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে পারি।
     রাজা তখনি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, সাত দিন পর আমার রাজধানীতে এলে তুমি তোমার জিনিস পাবে। 
    পরদিন রাজধানীতে গিয়ে মন্ত্রীকে সমস্ত বিষয় বললেন। মন্ত্রী সব শুনে বললেন, কিছু ভাববেন না মহারাজ, আমি ব্যবস্থা করছি।
     তিনি স্যাকরাকে দিয়ে একটা মানুষের সমান সোনার মূর্তি তৈরী করে তাকে মূল্যবান গয়না পরিয়ে রাজধানীর চারদিকে ঘুরিয়ে ঘোষণা করিয়ে দিলেন, যে ব্রাহ্মণ তাঁর বারো বছরের ছেলেকে বলিদান দেবেন তিনি এই মূল্যবান মূর্তিটি পাবেন।
     এক ব্ৰাহ্মণের বারো বছরের একটি ছেলে ছিল। তাঁরা বড়ই গরিব । দুবেলা খাবার জোটে না। ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে বললেন, দেখ, ছেলেকে বলি দিলে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হব আমরা। ছেলের জন্য ভাবনা কি, আবার হবে। ব্রাহ্মণীও এ বিষয়ে একমত হলেন। 
     রাজা বারো বছরের ব্রাহ্মণপুত্রকে পেয়ে খুব খুশি। আর কোন ভয় নেই। নির্দিষ্ট দিনে রাক্ষসও এসে উপস্থিত। বলি দেবার আগে ব্রাহ্মণপুত্র একটু হেসেছিল। তারপর রাজা খড়গ দিয়ে ব্রাহ্মণপুত্রের মাথাটি কেটে ফেললেন। 
    গল্প এখানেই শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ,  মৃত্যুর সময় সকলেই ভয়ে কাঁদে কিন্তু ব্রাহ্মণপুত্র না কেঁদে হেসেছিল কেন ? 
     রাজা বিক্রমাদিত্য বললেন, হাসবে না ?  বাল্যকালে বাবা-মার কাজ হচ্ছে সন্তানকে সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করা, কিন্তু তা না করে ঐ ব্রাহ্মণপুত্রের বাবা-মা সুখে জীবন কাটাবে বলে নিজের পুত্রকে বলি দিতে পাঠাল; আর রাজার কর্তব্য প্রজাপালন। কিন্তু নিজ স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য নিরপরাধ এক বালককে নিজ হাতে হত্যা করলেন। 
     বেতাল রাজার এই উত্তর শুনে আর বিলম্ব না করে সেই গাছে গিয়ে উঠল আর রাজাও তাকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে কাঁধে নিয়ে রওনা হলেন। বেতালও তার বিংশ গল্প আরম্ভ করল।

    সেকালে কুবলয়পুরে ধনপতি নামে একজন ধনী বণিক ছিলেন। ধনবতী নামে তাঁর এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। অল্প বয়সেই গৌরীদত্ত নামে এক ধনী বণিক-পূত্রের সঙ...

    সেকালে কুবলয়পুরে ধনপতি নামে একজন ধনী বণিক ছিলেন। ধনবতী নামে তাঁর এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। অল্প বয়সেই গৌরীদত্ত নামে এক ধনী বণিক-পূত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হলো।
     কয়েক বছর পর ধনবতীর একটি মেয়ে হলো ! তার নাম মোহিনী। গৌরীদত্তের অকালে মৃত্যু হলে তাঁর জ্ঞাতরিা ধনবতীকে ঠকিযে তার সব সম্পত্তি নিয়ে নিল। অন্ধকার অমাবস্যার রাতে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা হলো ধনবতী ।
     অন্ধকার রাতে পথ ভুলে ধনবতী এক শ্মশানে গিয়ে উপস্থিত হলো । সেখানে এক চোর রাজার আদেশে তিনদিন শূলে বসে ছিল। তিনদিনেও তার প্রাণ যায় নি ।
     অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে ধনবতীর সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল। চোর কাতর স্বরে বললো, আমার এই কষ্টের উপর আবার কষ্ট দিলে কে তুমি?
     এই কথা শুনে ধনবতী বললো, জেনেশুনে তোমাকে কষ্ট দিই নি, অন্ধকারে তোমাকে দেখতে পাই নি । আমাকে ক্ষমা কর । কিন্তু তুমি এই অন্ধকার রাত্রে এখানে কেন কষ্ট ভোগ করছ?
চোর বলল, আমি জাতিতে বণিক। চুরির অপবাধে রাজা আমাকে শূলদণ্ড দিয়েছেন। জন্মকালে এক জ্যোতিষ আমার হাত দেখে বলেছিলেন বিয়ে না হলে আমার মৃত্যু নেই, তাই আজ তিনদিন চলে গেল তবু আমার মৃত্যু হচ্ছে না। কিন্তু এ যন্ত্রণা সহ্য করাও যাচ্ছে না। একমাত্র তুমি আমাকে এই যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দিতে পার। তুমি তোমার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিলে আমি যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচি । আমার অনেক ধনসম্পপত্তি আছে, আমি সে সব তোমায় দেব।
     ধনসম্পত্তির কথা শুনে ধনবতীর আগ্রহ হলো । সে বললো, কিন্তু তুমি তো এখনই মারা যাবে। আমার যে নাতির মুখ দেখবার বড়ই ইচ্ছা আছে, তাতো আর সম্ভব হবে না।
     চোর ধনবতীর কথা শুনে বললো, তুমি কন্যাদান করে আমাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও, আমি অনুমতি দিয়ে যাচ্ছি তোমার কন্যা বড় হলে আবার তার বিয়ে দিয়ে দেবে, তাহলেই নাতির মুখ দেখতে পাবে।
      চোরের কাতর আবদনে ধনবতী তার মেয়ের সঙ্গে চোরের বিয়ে দিল ।
    চোর বললো, সামনে ঐ যে গ্রাম দেখা যাচ্ছে, ওখানে আমার বাডি ! বাড়ির পূর্বদিকে একটা কুয়োর কাছে এক বটগাছের নীচে আমার সমস্ত ধনরত্ন মাটির নীচে আছে, তুমি সেগুলো নিও।
     এই কথা বলার পরই চোরের মৃত্যু হলো।
ধনবতী তখন চোরের কথামত সেই বটগাছের কাছে গিয়ে মাটি খুঁড়ে সমস্ত ধনরত্ব নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। সব ঘটনা বাবাকে বলে সেখানেই দিন কাটাতে লাগল।
     তারপর ধনবতীর মেয়ে মোহিনীর বিয়ে বয়স হয়েছে। একদিন জানালা দিয়ে রাস্তায় এক ব্ৰাহ্মণপুত্রকে দেখতে পেয়ে মোহিনী তার রূপে মুগ্ধ হলো। তারপর ধনবতীকে বলে সেই ব্রাহ্মণপুত্রের সাথে মোহিনীর বিয়ে হলো।
     এর কিছুদিন পর মোহিনীর একটি সুন্দর ছেলে হলো। একদিন রাতে মোহিনী স্বপ্ন দেখলঃ বাঘছাল পরা, তিনটি
চোখ, কপালে বাঁকা চাঁদ, রূপোর মত গায়ের রং, ষাঁড়ের পিঠে বসা এক সুপুরুষ তাকে বলছেন, আগামীকাল মাঝরাতে তোমার ছেলেকে এক হাজার মোহরের সঙ্গে সুন্দর একটি প্যাটরার মধ্যে ভরে রাজপ্রাসাদের সদর দরজার সামনে রেখে আসবে। অপুত্ৰক বাজা তাকে
পুত্রের মত লালনপালন করে বড় করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে সেই হবে রাজা।
     মোহিনীর ঘুম ভেঙে গেলে সে এই স্বপ্নের কথাই ভাবতে লাগল। তারপর মাকে সব কথা খুলে বললো | স্বপ্নাদেশ মত ছেলেকে পাটিরায় ভরে মোহরসহ রাজার প্রাসাদের সদর দরজায় রেখে গেল তারা ।
     এদিকে রাজাও স্বপু দেখলেন সেইরকম এক দিব্য পুরুষ তাঁকে বলছেনঃ মহারাজ, আর ঘুমিয়ে থেক না, এক শিশু তোমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। তাকে নিজ পুত্রের মত প্রতিপালন কর। ভবিষ্যতে সেই রাজা হবে এবং তোমার মুখ উজ্জ্বল করবে।
      রাজার ঘুম ভেঙে গেল এবং তিনি সব কথা রাণীকে বললেন ।
     তখন দু'জনে কৌতুহলী হয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে এসে দেখলেন রাজা যা স্বপ্নে দেখেছেন সেইমত একটা প্যাটরা পড়ে আছে। প্যাটরার মুখ খুলে দেখলেন এক শিশু তার মধ্যে শুয়ে আছে এবং তার গায়ের আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে আছে । রাণী খুশি হয়ে সেই শিশুকে কোলে তুলে নিলেন এবং রাজা মোহরগুলো নিয়ে প্রাসাদে ঢুকলেন।
     পরদিন পন্ডিতেরা সকলে একমত হয়ে বললেন, মহারাজ, এ ছেলে আপনার যোগ্য উত্তরাধিকারী হবে। এই শিশু যে একদিন পৃথিবীর অধীশ্বর হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

     রাজা শুনে খুশি হয়ে পণ্ডিতদের যথেষ্ট উপহার দিলেন এবং গরিব দুঃখীদের পেট ভরে খাইয়ে নানা প্রকার উপহার দিলেন। ছেলের বয়স ছয় মাস হলে মুখেভাত দিয়ে তার নাম রাখলেন হরিদত্ত। তার  বিদ্যাবুদ্ধি দেখে পণ্ডিতরা হরিদত্তর প্রশংসায় পঞ্চমুখ | যথাকলে হরিদত্ত সর্ববিদ্যায় দক্ষ হয়ে উঠল।
    রাজা একদিন স্বর্গে গেলে হরিদত্ত রাজা হলেন  এবং ক্রমে ক্রমে সমস্ত পৃথিবীর উপর তাঁর একাধিপত্য স্থাপন করলেন।
     কিছুদিন পর হরিদত্ত তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে অনেক তীর্থ ঘুরে শেষে গয়ায় এসে ফল্লু নদীর তীরে শ্রাদ্ধ করে পিণ্ডদানে বসলেন ।
     হরিদত্ত যখন পিণ্ডদান করতে গেলেন তখন জল থেকে তিনখানা ডান হাত উঠে এল ; একটি সেই চোরের, একটি সেই ব্ৰাহ্মণপুত্রের আর অন্যটি রাজার।
     এ পর্যন্ত বলে বেতাল বলল, মহারাজ, আমাকে বল , এই তিনজনের মধ্যে কে হরিদত্তের পিণ্ড পাবার প্রকৃত অধিকারী, যুক্তি দিয়ে এর উত্তর দাও।
     রাজা বললেন, চোরের। কারণ ব্রাহ্মণপুত্র তো টাকার জন্য মোহিনীর কাছে নিজেকে বিক্রি করেছিল। রাজাও প্রতিপালনের জন্য এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই চোর ছেলের জন্য তার সবকিছু দিয়ে গিয়েছিল এবং মোহিনীর মা তাকে কথা দিয়েছিল ছেলে তারই হবে ।
      বেতাল ঠিক উত্তর পেয়ে আবার সেই শিরাষ গাছে গিয়ে ঝুলে পড়ল আর রাজাও তাকে গাছ থেকে পেড়ে আবার রওনা হলেন । বেতাল তখন তার উনবিংশ গল্প আরম্ভ করল।

     হেমকূট নগরে বিষ্ণুশর্মা নামে  এক ধাৰ্মিক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন, তাঁর ছেলের নাম ছিল গুণাকর। ছেলেটি জুয়ো খেলে ব্রাহ্মণ যা কিছু সঞ্চয় করেছি...

     হেমকূট নগরে বিষ্ণুশর্মা নামে  এক ধাৰ্মিক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন, তাঁর ছেলের নাম ছিল গুণাকর। ছেলেটি জুয়ো খেলে ব্রাহ্মণ যা কিছু সঞ্চয় করেছিলেন তা অল্প দিনের মধ্যেই শেষ করে, তারপর চুরি করতে আরম্ভ করল। বিষ্ণুশর্মা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ।
     তখন গুণাকর অনেক দেশ ঘুরে এক শ্মশানে উপস্থিত হয়ে দেখল এক সন্ন্যাসী সেখানে যোগাভ্যাস করছেন। সে যোগীকে প্রণাম করে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। যোগী তাকে দেখেই বুঝলেন এই যুবক ক্ষুধায় কাতর। তাকে একটা মরার খুলিতে করে অনেককিছু খেতে দিলেন।
     গুণাকর বললো, প্রভু, এ খাদ্য গ্রহণ করতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না।
     তখন সন্ন্যাসী যোগাসনে বসে চোখ বুজতেই এক যক্ষকন্যা সেখানে উপস্থিত হলো।
     সন্ন্যাসী বললেন, এই ব্রাহ্মণ ক্ষুধায় কাতর হয়ে আমার আশ্রমে এসেছে, তার উপযুক্ত আহারের ব্যবস্থা কর ।
    সন্ন্যাসীর আদেশ পাওয়া মাত্র যক্ষকন্যার মায়াবলে নিমেষের মধ্যে এক প্রাসাদ দেখা দিল। সে ব্রাহ্মণকে প্রাসাদের মধ্যে নিয়ে গিয়ে অনেকরকম আহারে তাকে সন্তুষ্ট করে, সুদৃশ্য এক পালঙ্কে ঘুমতে দিল। গুণাকর পরম সুখে রাত কাটাল।
    পরদিন সকালে ঘুম  ভেঙ্গে গেলে দেখল গতকালের কিছুই নেই। সে তখন অবাক হয়ে সেই সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা বললো।
    সন্ন্যাসী বললেন, যক্ষকন্যা যোগবিদ্যার প্রভাবে এসেছিল। যে লোকের যোগবিদ্যা জানা নেই যক্ষকন্যা তার কাছে থাকে না।
    এই কথা শুনে গুণাকর সন্ন্যাসীর পা জড়িয়ে ধরে বললো, প্রভু, আমাকে বলুন কিভাবে আমি সেই বিদ্যা শিখতে পারি।
     সন্ন্যাসী তার ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বললেন, চল্লিশ দিন মাঝরাতে গলা অবধি ঠাণ্ডা জলে ডুবে থেকে একমনে এই মন্ত্রটি জপ করবে ।

     গুণাকর সন্ন্যাসীর নির্দেশমত চল্লিশদিন ঐ ভাবে জপ করে তাঁর কাছে এসে বললো, প্রভু, আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি! এবার আদেশ করুন আর কি করতে হবে ?
     সন্ন্যাসী বললেন, আরও চল্লিশ দিন জুলন্ত আগুনে দাঁড়িয়ে ঐ মন্ত্ৰ জপ করলেই তোমার মনের বাসনা পূর্ণ হবে।
   গুণাকর বললো, প্রভু, অনেকদিন হলো ঘর ছেড়ে এসেছি, বাবা-মাকে দেখতে বড়ই ইচ্ছা হচ্ছে। আগে বাবা-মাকে দেখে আসি, তারপর আপনার নির্দেশমত কাজ করব।
     সন্ন্যাসীর অনুমতি নিয়ে গুণাকর বাড়ি গেল। অনেকদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে বাবা-মার আনন্দের সীমা নেই। তাঁরা জানতে চাইলেন এতদিন সে কোথায় ছিল?
    তখন গুণাকর সমস্ত কথা খুলে বললো।  শুনে মা বললেন, আমাদের এইভাবে দুঃখ দিয়ে তুই চলে যাস না, যোগাভ্যাস করবার বয়স এটা নয়। ঘরে থেকে সংসার করলেই যোগাভ্যাসের ফল পাবি। আমরা বৃদ্ধ হয়েছি, এখন আমাদের সেবা করাই তোর ধর্ম।
     গুণাকর শুনে একটু হেসে বললো, এই সংসার একেবারেই অসার। এ জগতে কেউ কারো নয়, সবই ভুল। যে পথকে বেছে নিয়েছি, তাকে ছাড়তে পারব না। এই কথা বলে বাবা-মাকে প্রণাম করে সে বাড়ি থেকে চলে গেল, মায়ের শত কান্নাও তাকে আটকাতে পারল না ।
সন্ন্যাসীর আশ্রমে গিয়ে চল্লিশদিন আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে জপ করেও কিন্তু কোন ফল হলো না।

     গল্প এখানেই শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ, কেন ব্রাহ্মণ যুবক সবকিছু করেও সিদ্ধিলাভ করতে পারল না ?
     বিক্রমাদিত্য বললেন, একাগ্রচিত্ত না হলে কোন ফল লাভ হয় না। ব্রাহ্মণের নিষ্ঠার অভাব ছিল। নিষ্ঠাসহকারে কোন কাজ না করলে তা সফল হয় না।
     বেতাল বললো, সে তো সন্ন্যাসীর আদেশমত কোন কষ্টকেই কষ্ট বলে মনে করে নি ? কিভাবে প্রমাণ হবে যে তার একাগ্রতার অভাব ছিল?
      বিক্রমাদিত্য বললেন, যদি সে একাগ্র হতো তবে বাবা-মাকে দেখবার জন্য অত ব্যস্ত হতো না ।
     এই কথা শুনে বেতাল মনে মনে রাজার বুদ্ধির প্রশংসা করল এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই গাছে গিয়ে উঠলো। রাজা বিক্রমাদিত্যও তাকে কাঁধে নিয়ে আবার চলতে আরম্ভ করলেন। বেতালও তার অষ্টাদশ গল্প আরম্ভ করল।

    চন্দ্রশেখর নগরে রত্নদত্ত নামে এক  বণিকের উন্মাদিনী নামে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে ছিল। রত্নদত্ত মনে করতেন তাঁর মেয়ে রাজরাণী হবার উপযুক্ত। ত...

    চন্দ্রশেখর নগরে রত্নদত্ত নামে এক  বণিকের উন্মাদিনী নামে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে ছিল। রত্নদত্ত মনে করতেন তাঁর মেয়ে রাজরাণী হবার উপযুক্ত। তাই মেয়ে বিবাহযোগ্য হলে দেশের রাজার কাছে গিয়ে নিবেদন করলেন, মহারাজ, আমার এক মেয়ে আছে, আপনি তাকে একবার দেখুন। সে আপনার রাণী হবার উপযুক্ত।
     মেয়েটিকে দেখতে রাজা কয়েকজন মন্ত্রীকে পাঠালেন।


মেয়েটির রূপ দেখে মন্ত্রীরা মুগ্ধ হলেন কিন্তু সকলে মিলে যুক্তি করলেন, এই মেয়ের সঙ্গে যদি রাজার বিয়ে হয় তবে রাজা রাজকার্য ত্যাগ করে রাণীকে নিয়ে অন্তঃপুরেই সময় কাটাবেন । রাজ্যের প্রজাদের এতে অমঙ্গল হবে। মন্ত্রীরা রাজাকে জানালেন এই মেয়ে মোটেই মহারাণী হবার মত সুন্দরী নয়।
     রাজা এই বিয়েতে অসম্মত হলে রত্নদত্ত সেনাপতি বলভদ্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন। বিয়ের পর তারা সুখেই বাস করতে লাগল।
   ক্রমে বসন্তকাল এলো। একদিন রাজা হাতীতে চড়ে নগরে বসন্তোৎসব দেখতে বেরুলেন, একদল লোক দামামা বাজাতে বাজাতে তাঁর আগে আগে চললে ।
    এই দামামার শব্দ শুনে উন্মাদিনী নিজের বাড়ির ছাদে উঠলো। হাতীটি উন্মদিনীর বাড়ির সামনে এলেই রাজার নজর পড়ল উন্মদিনীর দিকে, কি দেখলেন তিনি? দেখলেন পরমাসুন্দরী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সুন্দরী মেয়ে রাজা আগে কখনও দেখেন নি । খোঁজ খবর করে জানতে পারলেন, মেয়েটি হলো রত্নদত্তের কন্যা, যার সাথে তাঁর বিয়ে হবার কথা ছিল। সে এখন বলভদ্রের স্ত্রী । মন্ত্রীরা তাকে ইচ্ছা করে ঠকিয়েছেন।
    তিনি মন্ত্রীদের অবশ্য কোন শান্তি দিলেন না, কিন্তু নিজে খুব মনমরা হয়ে গেলেন। কিছু খান না, রাজবাড়ি থেকে বের হন না – ক্রমে তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যেতে লাগল। কথাটা বলভদ্রের কানে পৌঁছতে সে রাজার কাছে এসে হাত জোড় করে বললো, মহারাজ, আমার সব কিছু আপনার জন্য। আমি উন্মাদিনীকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব, আপনি তাকে দাসী করে রাখুন।
     তাই শুনে রাজার কি রাগ! বললেন, ছিঃ বলভদ্র, তুমি তোমার স্ত্রীকে অন্যের বাড়িতে দাসীগিরি করতে পাঠাবে? আর আমাকে যদি তুমি ভক্তিশ্রদ্ধা কর, তাহলে আমি এটা মেনে নেব এমন ভাবলে কি করে?
     বলভদ্র মুখ নিচু করে সেখান থেকে চলে গেল। 
কিন্তু রাজার শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। শেষকালে তাঁর মৃত্যু হলো। আর রাজার মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে, বলভদ্রও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিল ।
     বেতাল রাজার কাঁধে থেকে তাঁকে এই অপুর্ব কাহিনী শোনাবার পর বললো, এখন বলো, রাজা এবং তাঁর সেনাপতি এই দুজনের মধ্যে কার মহত্ত্ব বেশী?
     রাজা বললেন, সেনাপতি তাঁর প্রভু রাজার জন্য যা করেছেন তাতে বিস্ময়ের কি আছে? ভৃত্যেরা নিজেদের জীবন দিয়েও প্রভুর প্রাণরক্ষা করতে বাধ্য, কিন্তু রাজা অধর্মের পথে পা না বাড়িয়ে বরং তিনি প্রাণ ত্যাগ শ্রেয় মনে করেছেন। তাই আমার মতে রাজার মহত্ত্বই বেশী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। 
     রাজার মুখে এই কথা শুনে বেতাল তার কাঁধ ছেড়ে আবার সেই গাছে চলে গেল, আর রাজাও আবার সেখানে তাকে আনতে চললেন । পুনরায় কাঁধে নিয়ে যখন রাজা চলতে আরম্ভ করলেন তখন বেতাল তার সপ্তদশ গল্প বলতে আরম্ভ করল।

     সেকালে ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণে হিমালয়ের কোলে পুস্পশর নামে এক নগর ছিল। গন্ধৰ্বরাজ জীমূতকেতু সেখানে রাজত্ব করতেন। তাঁর কোন ছেলে ছিল না। ...

     সেকালে ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণে হিমালয়ের কোলে পুস্পশর নামে এক নগর ছিল। গন্ধৰ্বরাজ জীমূতকেতু সেখানে রাজত্ব করতেন। তাঁর কোন ছেলে ছিল না। পরে কল্পবৃক্ষের আরাধনা করে তাঁর একটি সুন্দর ছেলে হলো। ছেলের নাম রাখলেন জীমূতবাহন। জীমূতবাহন ধাৰ্মিক, দয়ালু ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তিনি অল্প দিনের মধ্যেই সব শাস্ত্রে ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। 
    কিছুদিন পর জীমূতকেতু আবার কল্পবৃক্ষের আরাধনা করে রাজ্যের প্রজাদের জন্য সব রকম সুখ সম্পদ চেয়ে নিলেন। কিন্তু এতে রাজ্যের প্রকৃত মঙ্গল হলো না। প্রজারা প্রচুর ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়ে কুঁড়ে ও অহঙ্কারী হয়ে উঠল। রাজাকেও মানতে চাইল না। রাজ্যে অরাজকতা দেখা দিল। 
     তখন রাজার কয়েকজন জ্ঞাতি প্রজাদের বলতে লাগল, এই রাজা প্রজাদের মঙ্গলের কথা মোটেই চিন্তা করছেন না, একে সরিয়ে অন্য কোন উপযুক্ত লোককে রাজা করতে হবে। 
     প্রজারা তাদের কথায় বিশ্বাস করে রাজদ্রোহী হয়ে প্রাসাদ ঘেরাও করে ফেললো ।
প্রজাদের এই স্পর্ধা দেখে জীমূতবাহন তাঁর বাবাকে বললেন, মহারাজ, জ্ঞাতিরা ষড়যন্ত্র করে আমাদের রাজ্যচ্যুত করতে চাইছে, আপনি আজ্ঞা দিলে এদের উপযুক্ত শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করি। 
     জীমূতকেতু বললেন, ক্ষণস্থায়ী এই জীবনের জন্য প্রাণী হত্যা করা মহাপাপ। বরং রাজপ্রাসাদ ছেড়ে হিমালয়ের শান্ত কোন জায়গায় কুঁড়েঘর তৈরি করে দেবতার আরাধনা করায় অনেক শান্তি পাওয়া যাবে। 
     এরপর তাঁরা প্রাসাদ ছেড়ে হিমালয়ে গিয়ে তপস্যা করতে লাগলেন। 
    সেখানে এক ঋষিকুমারের সঙ্গে রাজকুমার জীমূতবাহনের খুব বন্ধুত্ব হলো। একদিন দুই বন্ধুতে বেড়াতে বেড়াতে কাত্যায়নীর মন্দিরের কাছে গেলে মন্দিরের ভিতর থেকে বীণার শব্দ শুনে কৌতুহলী হয়ে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাঁরা বিস্মিত হয়ে দেখলেন এক পরমাসুন্দরী মেয়ে বীণা বাজিয়ে দেবী কাত্যায়নীর স্তবগান করছেন। মেয়েটি হলো মলয়রাজের কন্যা মলয়বতী।
     কিছুক্ষণ পর গান শেষ করে জীমূতবাহনকে দেখে মলয়বতীর খুব ভাল লেগে যায়। মনে মনে তাঁকে স্বামীরূপে বরণ করে নিয়ে সখীদের দিয়ে তাঁর নাম ও পরিচয় জেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে যান। 
     এরপর বাড়ি ফিরে সখী রাণীমার কাছে সমস্ত বললে তিনি তাঁর স্বামী মলয়কেতুকে সব ঘটনা বলেন। মলয়কেতু তাঁর ছেলে মিত্রাবসুকে ডেকে এবার একটা কিছু করতে হবে। শুনলাম গন্ধবরাজ জীমূতকেতু ও তাঁর পুত্র রাজ্য ত্যাগ করে মলয় পর্বতে বাস করছেন। আমার খুব ইচ্ছা তুমি জীমূতকেতুর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বল। 
     মিত্রাবসু জীমূতকেতুর সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বললে তিনি রাজি হয়ে জীমূতবাহনকে তাঁর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। মলয়কেতু শুভদিন দেখে কন্যা মলয়বতীর সঙ্গে জীমূতবাহনের বিয়ে দিলেন।
     এর কিছুদিন পর একদিন মিত্রাবসুর সঙ্গে একটা প্রকাণ্ড সাদা টিবি দেখে কৌতুহলী হয়ে বললেন, ওটা কি ? 
     মিত্রাবসু বললেন, একসময় গরুড়ের সঙ্গে নাগদের ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল। নাগরা পরাজিত হয়ে সন্ধি প্রার্থনা করলে গরুড় বললেন, যদি তোমরা আমার আহারের জন্য প্রতিদিন একটা করে সাপ দিতে পার তবে তোমাদের অন্য কাউকে আমি খাব না। উপায় না দেখে নাগরা গরুড়ের এই প্রস্তাবে রাজি হলো। তারপর থেকে প্রতিদিন একটি করে নাগ সেখানে উপস্থিত থাকে। গরুড় যথাসময় এসে ঐ নাগকে খেয়ে চলে যায়। দীর্ঘদিন ধরে নাগদের হাড় জমে জমে ঐ সাদা পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে। 
     জীমূতবাহন এই কথা শুনে মনে বড় ব্যথা পেলেন। মিত্রাবসুকে বিদায় দিয়ে তিনি সেইদিকে রওনা হলেন। কিছুদূর গিয়েই কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন এবং তাড়াতাড়ি সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখলেন এক বুড়ি নাগিনী কপাল চাপড়ে কাঁদছে। জীমূতবাহন তাঁকে বললেন, মা, তুমি কাঁদছ কেন? 
     সে তখন সকল কথা বলে বললো, আজ আমার পুত্র শঙ্খচূড়ের পালা, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গরুড় এসে তাকে আহার করবে। 
     জীমূতবাহন বললেন, মা, তুমি আর কেঁদ না, আমি নিজের প্রাণ দিয়ে তোমার ছেলেকে বাঁচাবো। বুড়ি বললো, তুমি কেন পরের জন্য প্রাণ দেবে। তাহলে আমার পাপ হবে।
     দু'জনের মধ্যে কথা হচ্ছে এমন সময় শঙ্খচূড় সেখানে এসে উপস্থিত হলো। জীমূতবাহনের পরিচয় জেনে সে বললো, মহারাজ, আমার মত সামান্য প্রাণীকে বাঁচাতে আপনার মত মহৎ প্রাণ বিনষ্ট হওয়া ঠিক নয়। আপনি বেঁচে থাকলে অনেক প্রাণীর উপকার হবে।
     জীমূতবাহন বললেন, শোন শঙ্খচূর, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, নিজের জীবন দিয়ে তোমার প্রাণ বাঁচাব। আমি ক্ষত্রিয় হয়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারব না। তুমি এখান থেকে চলে যাও। এই বলে শঙ্খচূড়কে বিদায় দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গরুড়ের আসার অপেক্ষায় রইলেন।

     নিদারুণ দুঃখে শঙ্খচূড় দেবী কাত্যায়নীর মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করতে লাগল, যাতে জীমূতবাহনের প্রাণ রক্ষা হয়।
  যথাসময়ে গরুড় এসে  জীমূতবাহনকে  ঠোঁটে তুলে আকাশে উঠে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। কিছুক্ষণ পর জীমূতবাহনের ডান হাতের নাম লেখা মণিময় কেয়ুর রক্তে মাখামাখি হয়ে মলয়বতীর সামনে এসে পড়ল। তিনি সেটি দেখেই চিনতে পেরে কেঁদে উঠলেন। রাজবাড়ির সকলেই এই দৃশ্য দেখে হাহাকার করে উঠলো।
     নিজেও জীমূতবাহনকে খুঁজতে বেরলেন। শঙ্খচূড় জীমূতবাহনের ভয়াবহ অবস্থার কথা শুনে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, হে পক্ষিরাজ, তুমি যাকে খাবে বলে নিয়ে গিয়েছ, তিনি ধর্মপ্রাণ জীমূতবাহন। তুমি তাঁকে ত্যাগ করে আমাকে আহার করে তোমার ক্ষুধা মেটাও। যদি তুমি তাঁকে খাও তবে অধর্মের কাজ করবে। 
    এই কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গরুড় দেখলেন, তাই তো! এতো কোন নাগ নয়, এ আমি কাকে খাচ্ছি! জীমূতবাহন তখন মৃতপ্রায়। গরুড় তাঁর মুখ থেকে সব কথা শুনে আনন্দিত হয়ে বললেন, সকলেই নিজের জীবন বাঁচাতে চায় আর তুমি পরের জীবন বাঁচাবার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলে? তোমার মত আর একজন ধর্মপ্রাণ এই পৃথিবীতে আছেন কিনা সন্দেহ, তুমি বর প্রার্থনা কর। 
    জীমূতবাহন বললেন, যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে প্রতিজ্ঞা করুন আজ থেকে আর কোন সাপকে খাবেন না আর যেসব সাপদের ইতিপূর্বে খেয়েছেন এই মুহুর্তে তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিন। 
     গরুড় রাজি হয়ে পাতালে গিয়ে অমৃত এনে সেই অমৃত জড়ো করা হাড়ের উপর ছিটিয়ে দিতেই সমস্ত সাপরা বেঁচে উঠলো। তারপর জীমূতবাহনকে বললেন, রাজকুমার, আমার কৃপায় তুমি আবার তোমার রাজ্য ফিরে পাবে।
     এই সুখবর শুনে মলয়রাজের প্রাসাদেও আনন্দের সীমা রইল না। প্রজারাও এসে রাজা জীমূতকেতুর কাছে ক্ষমা চাইল এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করে রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। 
     বেতাল জিজ্ঞাসা করল, মহারাজ, জীমূতবাহন ও শঙ্খচূড়, এই দু'জনের মধ্যে কে বেশী মহৎ । 
     বিক্রমাদিত্য বললেন, শঙ্খচূড়। 
     বেতাল বললো, কেন? 
    বিক্রমাদিত্য বললেন, শঙ্খচূড় প্রথমে জীমূতবাহনের কথায় রাজি হয় নি। যখন কিছুতেই তাঁকে নিরস্ত করা গেল না তখন শঙ্খচূড় দেবী কাত্যায়নীর কাছে তাঁর মঙ্গল প্রার্থনা করল এবং পুনরায় গরুড়ের কাছে এসে নিজের প্রাণের বিনিময়ে জীমূতবাহনের জীবন বাঁচাতে চাইল। 
    বেতাল বললো, যে পরের জন্য জীবন দিতে গেল সে কেন মহৎ হলো না? 
    রাজা বললেন, জীমূতবাহন জাতিতে ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়দের কাছে প্রাণ অতি তুচ্ছ জিনিস। তাই জীমূতবাহন যা করেছে তা যে কোন ক্ষত্ৰিয়ই করতে পারত।
     উত্তর শুনে বেতাল আর কোন কথা না বলে রাজার কাঁধ থেকে নেমে গাছে গিয়ে উঠল আর রাজাও তাকে পুনরায় কাঁধে তুলে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলেন। বেতালও ষোড়শ গল্প বলতে আরম্ভ করল।

কুসুমবতী নগরে সুবিচার নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর কন্যা চন্দ্রপ্রভা রাজধানীর কাছেই উপবনে সখীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁরা উপবনে যাওয়ার আগ...

কুসুমবতী নগরে সুবিচার নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর কন্যা চন্দ্রপ্রভা রাজধানীর কাছেই উপবনে সখীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁরা উপবনে যাওয়ার আগেই মনস্বী নামে একজন রূপবান ব্রাহ্মণকুমার ঐ পথ দিয়ে যেতে যেতে পরিশ্রান্ত হয়ে গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ।
রাজকুমারী ও তাঁর সখীদের পায়ের শব্দে ও কথায় ব্রাহ্মণকুমারের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চন্দ্রপ্রভাকে দেখে মুগ্ধ হলেন যুবক। এমন সুন্দরী মেয়ে তিনি আগে কখনও দেখেন নি।
রাজকুমারীও এমন রূপবান যুবক কখনও দেখেন নি। মনস্বীকে তাঁর খুব ভাল লাগল। সখীরা রাজকুমারীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে রাজধানীতে চলে গেল।
ব্ৰাহ্মণকুমার নিদারুণ হতাশায় সেইখানেই মুচ্ছিত হয়ে পড়লেন ।
সেই সময় শশী ও ভূদেব নামে দু'জন পথিক সেখানে পৌঁছলেন। তাঁরাও পথশ্রমে ক্রান্ত । কামরূপ থেকে বিদ্যাশিক্ষা করে তাঁরা দেশে ফিরছিলেন। মনস্বীকে ঐ অবস্থায় দেখে তাঁরা চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরাল।
তারপর কারণ জিজ্ঞাসা করতে মনস্বী তাদের সব কথা খুলে বললেন। আরও বললেন, তাঁকে না পেলে আমি বাঁচব না ;
ভূদেব বললেন, তুমি কিছুমাত্র চিন্তা করো না, এখন আমার সঙ্গে চল । তুমি যাতে তাকে পাও তার সব ব্যবস্থা আমি করছি।

নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভূদেব তাঁকে এক অক্ষরের মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বললেন, এই মন্ত্রের এমন গুণ, এই মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তুমি এক ষোল বছরের যুবতীতে পরিণত হবে, আবার ইচ্ছা করলেই নিজের চেহারা ফিরে পাবে।
তখন মনস্বী মন্ত্রপ্রয়োগে ষোল বছরের এক সুন্দরী কন্যা হয়ে গেলেন। ভূদেব হলেন আশী বছরের এক বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ। মনস্বীকে বধূর বেশে সাজিয়ে রাজা সুবিচারের কাছে উপস্থিত হলেন।

রাজা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দেখে সিংহাসন থেকে উঠে এসে তাঁকে প্ৰণাম করে সম্মানের সঙ্গে বসতে বললেন। ব্রাহ্মণ রাজাকে আশীর্বাদ করে আসন গ্রহণ করলেন।
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণবেশী ভূদেব বললেন, মহারাজ, আমার সঙ্গে যাকে দেখছেন এ আমার পুত্রবধূ একে তার বাপের বাড়ি থেকে আনতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি গ্রামে ওলাওঠা দেখা দেওয়ায় আমার ব্ৰাহ্মণী ও ছেলে গ্রাম ছেড়ে কোথায় চলে গেছে। তাদের খুঁজতে দেশে দেশে ঘুরতে চাই। তাই আমার বিনীত অনুরোধ, আমার এই পুত্রবধূকে আপনি আশ্রয় দিয়ে আপনার কন্যার সাথে অন্তঃপুরে রাখুন। ফিরে এসে আমার বৌমাকে নিয়ে যাব।
রাজা এই প্রস্তাব শুনে মনে মনে ভাবলেন, পরের মেয়ে ঘরে রাখা সহজ কাজ নয়। কিন্তু অস্বীকার করলে ব্ৰাহ্মণ মনে কষ্ট পাবেন। তাই ঠিক করলেন কন্যা চন্দ্রপ্রভার সখী হিসেবে তাকে অন্তঃপুরে রাখা যেতে পারে।
তারপর বললেন, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম। রাজা হিসাবে এটা পালন করা অবশ্যকর্তব্য।
রাজকন্যা একজন সমবয়স্ক সঙ্গী পেয়ে খুশি হলেন । অল্প সময়ের মধ্যে দু’জনের খুব ভাব হলো ।
একদিন রাজকন্যার মনের ভাব বুঝবার জন্য বউটি কথাপ্রসঙ্গে বললো, ভাই, তুমি সব সময় কি চিন্তা কর বলতো, চিন্তায় চিন্তায় তুমি ক্রমেই রোগা হয়ে যাচ্ছ ।
তখন রাজকন্যা প্রাণের কথা খুলে বললেন, কিছুদিন আগে উপবনে বেড়াতে গিয়ে এক সুন্দর যুবকের সাথে আমার দেখা হয়। কিন্তু তার নাম ঠিকানা কিছুই জানি না। তাকে বিয়ে না করতে পারলে আমার কোন সুখ নেই।
মনস্বী রাজকন্যার কথা শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, আমি সেই ব্রাহ্মণকুমারের সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিতে পারি।

তারপর মন্ত্রবলে আপন শরীরে আবির্ভূত হলে রাজকন্যা বিস্মিত হযে সমস্ত বিষয় জানতে চাইলেন। ব্রাহ্মণযুবক মনস্বী তখন তাঁকে সমস্ত খুলে বললে গন্ধৰ্ব্ব মতে তাঁদের বিয়ে হলো ।
একদিন রাজা সুবিচার মন্ত্রীর বাড়ি সপরিবারে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেন। রাজকন্যা,
ব্রাহ্মণপুত্রবধুরূপী মনস্বীকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
মন্ত্রীপুত্র ব্রাহ্মণবধূর রূপলাবণ্যে এমনই মোহিত হলেন যে তিনি তার বন্ধুকে বললেন, যদি ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে না পারি তবে আত্মহত্যা করব। বন্ধু অন্য উপায় না দেখে মন্ত্রীকে সমস্ত বিষয় জানালেন। মন্ত্রীও ছেলের কথা চিন্তা করে রাজাকে তাঁর পুত্রের অবস্থা বললেন।
রাজা শুনে খুবই রেগে বললেন, এ আপনি কি কথা বলছেন? এক ব্রাহ্মণ তাঁর পুত্রবধূকে বিশ্বাস করে আমার কাছে রেখে গিয়েছেন, তার অনুমতি না নিয়ে -- এমন অন্যায় কাজ করা কিভাবে সম্ভব? আপনার এ অন্যায় অনুরোধ প্রাণ গেলেও আমি রাখতে পারব না।
মন্ত্রী নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন এবং পুত্রের অবস্থা দেখে তিনিও আহার নিদ্রা ত্যাগ করলেন। মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে রাজকার্য ঠিকমত চলছে না দেখে অন্যান্য রাজপুরুষের রাজকে বললেন, মহারাজ, মন্ত্রীপুত্রের যা অবস্থা তাতে তিনি প্রাণে বাঁচবেন বলে মনে হয় না। যদি পুত্রের মৃত্যু হয় তবে মন্ত্রীও বাঁচবেন না। আপনার মন্ত্রীর মত জ্ঞানী ও বিচক্ষণ
দ্বিতীয় কেউ নেই, এই মন্ত্রী না থাকলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। আমাদের অনুরোধ, ব্রাহ্মণপুত্রবধূকে মন্ত্রীর ছেলের সাথে বিয়ে দিন। ব্ৰাহ্মণ হয়তো আর না ফিরতেও পারেন। যদি ফিরে আসেন তখন যথেষ্ট অর্থের লোভ দেখালে তিনি আর আপত্তি করবেন না ! যদি অর্থে কাজ না হয় তবে ব্রাহ্মণপুত্রের অন্য কোন কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিলেই ব্যাপারটা মিটে যাবে।
রাজা অনেক ভাবনা চিন্তা করে ব্রাহ্মণপুত্রবধূর কাছে গিয়ে সব বললেন।
ব্রাহ্মণপুত্রবধুরূপী মনস্বী বললেন, মহারাজ, আপনি একটু চিন্তা করে দেখুন, আমার স্বামী এখনও বেঁচে আছেন। প্রাণ গেলেও আপনার আদেশ পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব না !
মনমরা হয়ে রাজা অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এলেন। মনস্বী ভাবলেন, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এখানে থাকা আর ঠিক হবে না। এই ভেবে মন্ত্রবলে পুরুষবেশে রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে সোজা উপস্থিত হলেন ভূদেবের বাড়ি । সমস্ত শুনে ভূদেব খুব খুশি হলেন। মনে মনে ভাবলেন ব্যাপারটা বেশ জমে উঠেছে।
বন্ধু শশীকে যুবক সাজিয়ে ভূদেব নিজে সেই বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণের বেশ ধরে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন। রাজা আসন থেকে উঠে এসে ভক্তিসহকারে প্রণাম করে ব্রাহ্মণকে বসতে অনুরোধ করে বললেন, আপনার ফিরতে এত দেরী হলো কেন?

ভূদেব বললেন, অনেক কষ্টে পুত্রকে ফিরে পেয়েছি, এখন পুত্রবধূসহ নিজের বাড়ি ফিরে যাব। রাজা তখন কোন কথা না লুকিয়ে সব কথা সবিস্তারে ব্রাহ্মণকে বললেন ।
ব্ৰাহ্মণ শুনে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, এই কি রাজার কাজ হয়েছে? এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করা কি কোন মানুষের উচিত কাজ ?

রাজা অনেক অনুনয় বিনয় করে বললেন,আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার যে ক্ষতি আমি করেছি তা যে কোন মূল্যে পরিশোধ করতে আমি প্রস্তুত।
ভূদেব বললেন, বেশ, আপনার কন্যার সঙ্গে আমার পুত্রের যদি বিয়ে দেন তবেই আপনার প্রতিজ্ঞা পালন করা হবে ।
রাজা নিরুপায় হয়ে এই প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং শুভদিনে বিয়ে হয়ে গেল।
ভূদেব রাজকন্যা নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হলে শশী এবং মনস্বী দু’জনেই রাজকন্যাকে নিজ স্ত্রীরূপে দাবী করলেন এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে লাগলেন ।
গল্প এখানেই শেষ করে বেতাল বললো, এখন বল মহারাজ, শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে কার স্ত্রী হওয়া উচিত এই রাজকন্যার?
বিক্রমাদিত্য বললেন, মনস্বীর স্ত্রী হবে এই রাজকন্যা ।
বেতাল বললো, কিন্তু রাজা সকলের সামনে ধর্ম সাক্ষী রেখে শশীকে কন্যা দান করেছেন । মনস্বী কি ভাবে দাবী করতে পারে ?
রাজা বললেন, তুমি যা বলছ তা আমি অস্বীকার করছি না ; কিন্তু মনস্বী এই কন্যাকে আগেই বিয়ে করেছে। সুতরাং তার অন্য কোথাও বিয়ে হতে পারে না |
বেতাল খুশি হয়ে রাজার কাঁধ থেকে নেমে সেই গাছে গিয়ে উঠলো আর রাজাও আবার তাকে কাঁধে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলেন । বেতালও তার পঞ্চদশ গল্প বলতে আরম্ভ করল।

চন্দ্রহৃদয় নগরে রাজা রণধীর নামে এক প্রতাপশালী রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর মত সৎ ও দয়ালু রাজা খুব কমই দেখা যায় । তাঁর রাজ্যের প্রজারা সুখেই দি...

চন্দ্রহৃদয় নগরে রাজা রণধীর নামে এক প্রতাপশালী রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর মত সৎ ও দয়ালু রাজা খুব কমই দেখা যায় । তাঁর রাজ্যের প্রজারা সুখেই দিন কাটাতো। কিন্তু হঠাৎ চোরের উপদ্রব শুরু হলো। তখন প্রজার রাজার কাছে গিয়ে নিজের নিজের দুঃখের কথা বললো।
রাজা সব কথা শুনে বললেন, আর যাতে চুরি না হয় তার জন্য আমি সব ব্যবস্থা করছি।
তিনি প্রহরীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন। নগরের বিভিন্ন স্থানে তাদের নিযুক্ত করে জানিয়ে দিলেন,চোর চুরি করে যদি পালিয়ে যায় তবে সেই অঞ্চলে নিযুক্ত প্রহরীর প্রাণদণ্ড হবে।
প্রহরীরা এই কঠোর শাস্তির কথা শুনে খুবই সতর্ক হলো কিন্তু চুরি না কমে বরং আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেল।
রাজা ঠিক করলেন চোর ধরার জন্য তিনি নিজে রাত্রে বের হবেন ।
রাত্রির প্রথম প্রহরের পর রাজা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নগর প্রহরায় বের হলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন অপরিচিত লোককে দেখে তিনি বললেন, তোমার পরিচয় কি বল, এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?
লোকটি বললো, এত রাতে যখন বের হয়েছি তখন বুঝতেই পারছ আমি চোর। চুরি করাই আমার কাজ। তা তুমি কে হে বাপুঃ তোমার পরিচয়টা এবার দাও ।
রাজা বললেন, বুঝতে পারছ না আমি কে? আমিও তোমারই মত একজন চোর।
তখন চোর খুশি হয়ে বললো, তবে চল একসঙ্গেই চুরি করতে যাই।
রাজা চোরের কথায় রাজি হলেন। সেইদিনই দু’জনে এক ধনীর বাড়িতে ঢুকে অনেক টাকাকড়ি চুরি করল। তারপর নগর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে এক সুড়ঙ্গপথের সামনে এসে দাঁড়াল। চোর রাজাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
এই সময় এক দাসী এসে কথায় কথায় রাজার পরিচয় পেয়ে বললো, মহারাজ, যদি প্রাণে বাঁচতে চান তবে এখনই এখান থেকে চলে যান, এই চোর এক দুর্দান্ত দস্যু। খুব খারাপ লোক।

রাজা এই কথা শুনে বললেন, আমি তো বাইরে যাবার পথ চিনি না, যদি তুমি আমাকে দয়া করে পথটা দেখিয়ে দাও তবে বড় উপকার হয়।
তখন সেই দাসীর সাহায্যে রাজা প্রাসাদে ফিরে এলেন ।
পরদিন রাজা রণধীর অনেক সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সেই পাতালে প্রবেশ করে চোরের বাড়ি চারদিক থেকে ঘিরে ফেললেন ।
এক রাক্ষস এই পাতাল নগরীকে রক্ষা করতো।
চোর বিপদ বুঝে সেই রাক্ষসের শরণাপন্ন হয়ে জানাল, এই বিপদে যদি আমাকে সাহায্য না কর তবে আমায় এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। - এই কথা বলে চোর রাক্ষসকে অনেক মূল্যবান উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করলো।
রাক্ষস খুশি হয়ে বললো, তোমার কোন ভয় নেই, এখনই আমি রাজার সব সৈন্য-সামন্ত খেয়ে শেষ করছি।
এই বলে রাক্ষস সেখানে উপস্থিত হয়ে রাজার সৈন্য-সামন্ত, হাতি, ঘোড়া সব খেতে লাগল। এই অবস্থা দেখে সৈন্যরা প্রাণভয়ে পালাতে লাগল।
তাই দেখে রাজাও পালাতে আরম্ভ করলেন । রাক্ষসের সহায়তায় সাহসী হয়ে চোর রাজার পিছু ধাওয়া করল । রাজার কাছে এসে চোর রাজাকে তিরস্কার করে বলতে লাগল, রাজা হয়ে যুদ্ধ না করে কাপুরুষের মত পালাচ্ছিস ?
রাজা এই অপমানজনক কথা সহ্য করতে না পেরে প্রাণভয় তুচ্ছ করে চোরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। ভীষণ যুদ্ধ চললো দু'জনের মধ্যে। অবশেষ রাজা চোরকে পরাজিত করে তাকে প্রাণে না মেরে বেঁধে নিয়ে এলেন রাজধানীতে।
বিচার করে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন রাজা। চোরকে গাধার পিঠে চড়িয়ে নগর ঘোরাতে লাগল প্রজারা।
কিন্তু ধর্মধ্বজ বণিকের কন্যা শোভনার ঐ চোরকে দেখে খুব ভাল লাগল। সে গিয়ে তার বাবাকে জানাল, যেমন করে হোক ঐ চোরকে মুক্ত করে আমার সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা কর ।

বণিক বললো, এ প্রস্তাবে রাজা কিছুতেই রাজি হবেন না। কারণ এই চোরকে ধরার জন্য রাজার অনেক সৈন্য বিনষ্ট হয়েছে, এমন কি রাজার প্রাণও চলে যেতে পারত।
শোভনা বললো, যদি ওকে ছাড়িয়ে আনতে না পার তবে তোমার সামনে আমি আত্মঘাতি হব ।
একান্ত নিরুপায় হয়ে ধর্মধ্বজ রাজার কাছে আবেদন করল, মহারাজ, আমার একান্ত অনুরোধ, আমার সব সম্পত্তি নিয়ে ঐ চোরকে মুক্ত করে দিন ।

এই অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে রাজা বললেন, এই চোর আমার প্রজাদের অনেক ক্ষতি করেছে, আমারও প্রাণ নিতে চেষ্টা করেছে। আমি কিছুতেই একে ছেড়ে দেব না।
যথাসময়ে চোরকে শূলস্তম্ভের কাছে এনে দাঁড় করানো হলো । ইতিমধ্যে শোভনার বিষয় নগর মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেছে। চোরও সব শুনে প্রথমে হাসল, তারপর হাসি থামিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। এই সময় রাজপুরুষরা তাকে শূলে চড়িয়ে দিলেন। শোভনা চোরের মৃত্যুসংবাদ শুনে বধ্যভূমিতে উপস্থিত হয়ে চিতা সাজিয়ে চোরের মৃতদেহের সাখে আত্মাহুতি দিতে গেল।

এই চিতার পাশেই দেবী কাত্যায়নীর মন্দির ছিল। শোভনার নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে দেবী দেখা দিয়ে বললেন, তোমার নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়েছি, বর চাও।
শোভনা বললো, দেবী, যদি আমায় কৃপা কর তবে এই চোরকে বাঁচিয়ে দাও।
দেবী তাই করলেন। অমৃত পান করিয়ে চোরকে বাঁচিয়ে দিলেন ।

বেতাল জিজ্ঞাসা করল, মহারাজ, চোর কেন প্রথমে হেসেছিল এবং পরে কেঁদেছিল?
বিক্রমাদিত্য বললেন, হেসেছিল কারণ তার মনে হয়েছিল আমি যখন মরতে যাচ্ছি তখন এই মেয়েটি আমাকে বিয়ে করতে চাইছে। তারপর কেঁদেছিল কারণ চোর ভাবল আমার জন্য এই মেয়েটি তার সর্বস্ব দেত চেয়েছিল অথচ আমি তার জন্য কিছুই করতে পারতাম না, এমনই হতভাগা আমি।

আবার ঠিক উত্তর পেয়ে বেতাল শ্মশানের সেই গাছে গিয়ে ঝুলে পড়ল আর রাজাও তাকে তখনই নামিয়ে কাঁধে নিয়ে আবার রওনা হলেন। বেতালও চতুর্দশ গল্প বলতে আরম্ভ করল।

সেকালে চূড়াপুরে দেবস্বামী নামে এক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন। রূপে গুণে তিনি ছিলেন অসাধারণ আর তাঁর ধনসম্পত্তিও ছিল প্রচুর। স্ত্রী লাবণ্যবতীও সবদিক ...

সেকালে চূড়াপুরে দেবস্বামী নামে এক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন। রূপে গুণে তিনি ছিলেন অসাধারণ আর তাঁর ধনসম্পত্তিও ছিল প্রচুর। স্ত্রী লাবণ্যবতীও সবদিক দিয়েই তাঁর উপযুক্ত ছিলেন। সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন তাঁরা।
একদিন দারুণ গ্রীষ্মের রাতে ঘরের মধ্যে টিকতে না পেরে তাঁরা ছাদে বিছানা করে ঘুমাচ্ছিলেন। সেই সময় এক গন্ধৰ্ব রথে করে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। সুন্দরী লাবণ্যবতীকে দেখে সেই গন্ধৰ্ব তাঁকে রথে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর দেবস্বামীর ঘুম ভাঙলে পাশে স্ত্রীকে না দেখতে পেয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাড়িময় অনেক খুঁজেও লাবণ্যবতীকে না পেয়ে মনের দুঃখে সে রাত্রিটা কাটিয়ে দিলেন।
সকাল হতেই চারদিক ভাল করে খুঁজলেন কিন্তু স্ত্রীকে না পেয়ে পাগলের মত হয়ে গেলেন। তারপর সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ঘুরতে লাগলেন ।
একদিন দুপুরবেলা তিনি এক গ্রামে এসে উপস্থিত হলেন। কাছেই এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে গিয়ে বললেন, ক্ষুধা তৃষ্ণায় আমি বড়ই কাতর হয়ে পড়েছি, আমাকে জল ও আহার দিয়ে প্রাণ বাঁচান।
গৃহস্থব্রাহ্মণ এই কথা শুনে এক বাটি দুধ এনে তাঁকে দিলেন ।
এদিকে কিছুক্ষণ আগেই এক বিষধর সাপ দুধে মুখ দেওয়ায় ঐ দুধ বিষাক্ত হয়ে ছিল। দেবস্বামী ঐ দুধ খাওয়ামাত্র বিষের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে ব্রাহ্মণকে বললেন, আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করি নি, তবে কেন আমাকে বিষ খাইয়ে মারলেন ? এই বলে ব্রাহ্মণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা গেলেন।
ব্রাহ্মণ এই ঘটনায় খুবই দুঃখ পেলেন এবং বাড়ির মধ্যে গিয়ে নির্দোষ স্ত্রীকে অনেক গালাগালি করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

গল্প শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ, এদের মধ্যে কে দোষী?
রাজা বললেন, সাপের মুখে বিষ থাকে এবং সে তার স্বভাবকর্মই করেছে, এতে তাকে দায়ী করা যায় না। ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণীও সেই দুধ যে বিষাক্ত তা জানতেন না, সেই কারণে তাঁরাও দায়ী হতে পারেন না। অতিথি ক্ষুধার্ত ব্ৰাহ্মণের পক্ষেও সরল বিশ্বাসে তা পান করা ছাড়া উপায় ছিল না। তবে দোষী যদি কেউ হন তবে ঐ ব্রাহ্মণ । যিনি সবকিছু না জেনেই নিজের স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

ঠিক উত্তর পেয়ে বেতাল রাজার কাঁধ থেকে নেমে গাছে গিয়ে উঠলো আর রাজাও তাঁর যা কাজ তাই করলেন। বেতালও তার ত্রয়োদশ গল্প বলতে আরম্ভ করল।

পুণ্যপুর নগরে বল্লভ নামে এক রাজা ছিলেন। প্রজারা তাঁকে দেবতার মত ভক্তি করত । দান ও সৎ কাজেই তাঁর দিন কাটত । তিনি একদিন মন্ত্ৰী সত্যপ্রকাশকে ড...

পুণ্যপুর নগরে বল্লভ নামে এক রাজা ছিলেন। প্রজারা তাঁকে দেবতার মত ভক্তি করত । দান ও সৎ কাজেই তাঁর দিন কাটত ।
তিনি একদিন মন্ত্ৰী সত্যপ্রকাশকে ডেকে বললেন, দেখ, ভেবে দেখলাম রাজা হয়েও যদি কেবল পরের জন্যই খেটে মরি তবে রাজা হয়ে লাভ কি? আমার সব রকম ভোগ সুখ করবার ক্ষমতা আছে। এই পৃথিবীতে এসে আমোদ আহ্লাদই যদি না করলাম তবে আর রাজা হওয়া কেন? তাই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে শুধু ফূর্তি করব আর আমার সব কাজ করবে তুমি ।
মন্ত্রী খুবই চিন্তায় পড়লেনঃ আমার পক্ষে কি রাজকার্য পরিচালনা করা সম্ভব! রাজার যে বিচারবুদ্ধি ও ধৈর্য আছে তা কি আমার আছে!

যাই হোক, একান্ত বাধ্য হয়েই তিনি রাজকার্য চালাতে লাগলেন কিন্তু অতি অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ।
একদিন বাড়িতে বসে তিনি একমনে এই সবই
চিন্তা করছিলেন। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী বললেন, তোমার কি হয়েছে বল তো! সব সময় দেখি এক মনে কি যেন ভাবছ। আগে তো তুমি এমন ছিলে না?
মন্ত্রী সত্যপ্রকাশ তখন বললেন, তুমি তো জান, রাজা সব রাজকার্যের ভর আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন, রাজ্যে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই দেখছেন না। কিন্তু আমার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
স্ত্রী বললেন, দেখ, রাজকাৰ্য চালানো তোমার কম্ম নয়। বরং এক কাজ কর, এসব ছেড়ে কিছুদিন তীর্থে ঘুরে এস, শরীব মন দুই-ই ভাল হবে।
সত্যপ্রকাশ স্ত্রীর কথামত রাজার অনুমতি নিয়ে তীর্থ করতে বেরলেন। অনেক দেশ ঘুরে দক্ষিণে রামেশ্বরে পৌঁছলেন । সেখানে রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশ করে ভক্তিভরে পূজা নিবেদন করে বেরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেলেন।
সমুদ্রের ঢেউ থেকে বিশাল এক সোনার গাছ বেরল আর সেই গাছের মাথায় সুন্দর দেখতে একটি মেয়ে বীণা বাজিয়ে
গান করছেন। সত্যপ্রকাশ তন্ময় হয়ে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে লাগলেন। পরে সেই গাছটা আস্তে আস্তে জলের নীচে তলিয়ে গেল।
এই দেখে তিনি আর থাকতে পারলেন না, তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে রাজার সঙ্গে দেখা করে সমস্ত কথা বললেন।
রাজা সত্যপ্রকাশকে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি আর দেরী না করে সত্যপ্রকাশের হাতে রাজ্যভার দিয়ে রামেশ্বরে গিয়ে উপস্থিত হলেন । সেখানে গিয়ে মন্ত্রী সত্যপ্রকাশের কাছে যা যা শুনেছিলেন সবই দেখলেন। তবে রাজা সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি নৌকোয় করে সেখানে গিয়ে সেই সোনার গাছে উঠে বসলেন এবং গাছটি রাজাকে নিয়ে তখনই পাতালে চলে গেল।
 পাতালে গিয়ে সেউ সুন্দরী রাজার দিকে চেয়ে বললেন, তোমার বীরত্ব ও সাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি, তুমি এখানে কেন এসেছ? আর তোমার পরিচয়ই বা কি ?
রাজা বললেন, আমি পুণ্যপুরের রাজা-বল্লভ। তোমার রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়ে আমি এখানে এসেছি।

মেয়েটি বললেন, তোমাকে দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি আমি তোমার রাণী হতে পারি তবে একটি শর্তে, অমাবস্যার দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না।

রাজা তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলেন। তখন গন্ধৰ্বমতে তুমি দু’জনের বিয়ে হলো। দু’জনে মনের আনন্দে দিন কাটাতে লাগলেন।
তারপর অমাবস্যা এল। রাজা অন্দরমহল থেকে চলে গেলেন। কিন্তু এর কারণ জানবার জন্য বিশেষ কৌতুহলী হয়ে অন্ধকার রাত্রে হাতে তরবারি নিয়ে লুকিয়ে থেকে সব দেখতে লাগলেন। তিনি দেখলেন ঠিক মাঝরাতে একটা রাক্ষস এসে রাণীকে ধরতে গেল। রাজা আর নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে রাক্ষসের সামনে উপস্থিত হয়ে হাতের তরবারি দিয়ে রাক্ষসের মাথা কেটে ফেললেন।

রাণীর তখন আনন্দে চোখে জল এসে গেছে। জলভরা চোখে বললেন, তুমি আমাকে বাঁচালে।এতদিন কি যন্ত্রণা ভোগ করেছি তা তোমাকে বলে  বোঝাতে পারব না ।
 রাজা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন  এতদিন এই যন্ত্রণ সহ্য করেছ? আর তোমার প্রকৃত পরিচয়ই বা কি?
 রাণী তখন বললেন, শোন তবে আমার সেই  দুঃখের কথা। আমি গন্ধৰ্বরাজ বিদ্যাধরের মেয়ে, নাম রত্নমঞ্জরী। আমি বাবার আদরের মেয়ে  ছিলাম। বাবা যখন খেতে বসতেন আমি কাছে না  থাকলে তার খাওয়া হতো না। একদিন সখীদের  সঙ্গে খেলায় এতই মেতে ছিলাম যে কখন বাবার  খাওয়ার সময় হয়েছে তা একদম ভুলে গিয়েছিলাম ।  এতে বাবা আমার উপর এতই রেগে গেলেন যে আমাকে অভিশাপ দিলেন ; আজ থেকে তোর বাসস্থান হবে পাতালে আর প্রতি অমাবসাতে এক রাক্ষস এসে তোকে নানাভাবে কষ্ট দেবে। 
এই ভয়ঙ্কর অভিশাপ শুনে আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবার পায়ে মাথা কুটতে কুটতে বললাম, বাবা, সামান্য ভুলের জন্য আমায় এমন কঠোর শান্তি দিও না।

বাবা আমার কাতর আবেদনে সাড়া দিলেন এবং নিজেও বুঝলেন তাঁর স্নেহের কন্যার প্রতি কি অবিচার করেছেন। বললেন, তবে জেনে রাখ, মহাবলশালী এক রাজা যেদিন ঐ রাক্ষসকে বধ করবেন সেই দিন তুমি শাপমুক্ত হবে। আজ আমি শাপমুক্ত হলাম। এখন তোমার অনুমতি পেলে বাবার কাছে ফিরে যাই।
রাজা বললেন, আগে আমার রাজধানীতে চল, পরে তোমার বাবার কাছে যাবে।
রত্নমঞ্জরী রাজী হলেন এবং রাজা তাঁকে নিয়ে রাজধানীতে গিয়ে বেশ কিছুদিন কাটাবার পর রাণীকে তাঁর বাবার কাছে যেতে অনুমতি দিলেন।
তখন রত্নমঞ্জরী বললেন, মহারাজ, দীর্ঘদিন মানুষের সঙ্গে বাস করে আমার গন্ধৰ্বত্ব চলে গেছে, আমি এখন মানুষের মত হয়ে গেছি। আমার বাবা গন্ধবদের রাজা। আমার মনে হয় আমি আর বাবার কাছে ফিরে গিয়ে সেই স্নেহ-ভালবাসা পাব না; তাই আমার ইচ্ছা আমি এখানেই থেকে যাই ।

রাজা এই কথা শুনে খুবই খুশি হলেন, তিনিও চাইছিলেন না রাণী তার বাবার কাছে ফিরে যাক । মন্ত্রীর হাতে রাজ্যভার দিয়ে তিনি আবার আমোদ আহ্লাদে দিন কাটাতে লাগলেন। মন্ত্রী সত্যপ্রকাশ এই সব দেখে শুনে মনের দুঃখে মারা গেলেন। 
গল্প শেষ করে বেতাল বললো, বল মহারাজ, মন্ত্রী মরলো কেন ? 
বিক্রমাদিত্য বললেন, রাজা আবার আনন্দসাগরে ডুবে যাওয়ায় মনের দুঃখে মন্ত্রী সত্যপ্রকাশ মারা গেলেন। তিনি দেখলেন প্রজারা রাজা হারা হয়ে অনাথ হলো। প্রজাদের সুখ সুবিধা দেখার আর কেউ রইল না। রাজ্যে কোন অঘটন ঘটলে সব দোষ পড়বে মন্ত্রীর উপর। এভাবে বাঁচার চেয়ে মরাই ভাল। 
মনের মত উত্তর পেয়ে বেতাল আবার সেই গাছে গিয়ে ঝুলে রইলো আর রাজা বিক্রমাদিত্যও তাকে গাছ থেকে নামিয়ে কাঁধে নিয়ে চলতে লাগলেন। বেতালও দ্বাদশ গল্প বলতে আরম্ভ করল।


গৌর দেশে বর্ধমান নামে এক নগর ছিল। সেখানে গুণশেখর নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর গুণের কথা বলে শেষ করা যায় না। তাঁর প্রধানমন্ত্রীর নাম অভয়চন্দ্র।...

গৌর দেশে বর্ধমান নামে এক নগর ছিল। সেখানে গুণশেখর নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর গুণের কথা বলে শেষ করা যায় না। তাঁর প্রধানমন্ত্রীর নাম অভয়চন্দ্র। এই মন্ত্রী বৌদ্ধ ছিলেন। মন্ত্রীর মুখ থেকে বৌদ্ধের বাণী শুনে শুনে রাজাও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন ।
বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেই রাজা পূজা এবং হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী সকল কাজ বন্ধ করে দিলেন এবং রাজ্যমধ্যে ঘোষণা করে দিলেন—আমার রাজ্যমধ্যে ঐসব কাজ করা চলবে না । কেউ ওসব করলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে ।
প্রজারা এতদিনের অনুষ্ঠান মন থেকে ত্যাগ করতে না চাইলেও শাস্তির ভয়ে ত্যাগ করল। যে সব প্রজা লুকিয়ে লুকিয়ে দেবদেবীর পূজা করল তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হলো।
অভয়চন্দ্র রাজাকে বলতেন, মহারাজ, ধর্মশাস্ত্রের মূল কথা হলো অহিংসা পরমধর্ম। সব ধর্মের উপরে অহিংসা ধর্ম। হাতির মত বিরাট দেহধারী প্রাণী থেকে আরম্ভ করে ক্ষুদ্র পোকামাকড় সকল প্রাণেরই সমান মূল্য, তাই তাকে বিনাশ করা মহাপাপ। প্রতিটি প্রাণীর প্রাণ রক্ষা করা মহৎ কাজ। পরের মাংস খেয়ে যারা নিজেদের দেহের মাংস বৃদ্ধি করে তাদের মত পাপী এ জগতে আর নেই। যারা এই কাজ করে তারা মৃত্যুর পর নরকে যায়। মাংসের ন্যায় মদ খাওয়াও মহা পাপ মদ এবং মাংস ত্যাগ করলে আয়ু , বিদ্যা, বল, ধন সবকিছু বাড়বে।

এইভাবে উপদেশ দিয়ে অভয়চন্দ্র রাজাকে এমনভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করলেন যে কোন লোক তার কাছে বৌদ্ধধর্মের গুণগান করলে তিনি তাকে পুরস্কৃত করতেন এবং সে রাজার প্রিয়পত্র হতো ।
তারপর একদিন রাজার মৃত্যু হলো। তাঁর ছেলে ধৰ্মধ্বজ কিন্তু ছিলেন হিন্দুধর্মের প্রতি আস্থাবান। তিনি রাজা হয়েই বৌদ্ধদের শাস্তি দিতে লাগলেন । মন্ত্রী অভয়চন্দ্রকে কঠোর শাস্তি দিলেন। তাঁর মাথা মুড়িয়ে, গাধায় চাপিয়ে সমস্ত নগর ঘুরিয়ে রাজ্যের বাইরে বের করে দিলেন। প্রজারা এতদিনে তাদের সনাতন হিন্দুধর্ম ফিরে পেল।
বসন্তোৎসবের দিন রাজা ধৰ্মধ্বজ তাঁর তিন রাণীকে নিয়ে উপবনে বেড়াতে গেলেন। সেই উপবনে সুন্দর একটি সরোবর ছিল। সরোবরে অনেক পদ্মফুল ফুটে ছিল। রাজা নিজে সরোবরে নেমে পদ্মফুল তুলে এনে রাণীদের দিলেন কিন্তু একটি ফুল এক রাণীর পায়ের উপর পড়ে গেলে তিনি এমন আঘাত পেলেন যে তাঁর পা ভেঙ্গে গেল।
রাণী বেদনায় কেঁদে উঠলেন । রাজা নানাভাবে তাঁর ব্যথা দূর করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। উপবন জ্যোৎস্নায় থৈ থৈ করছে। চাঁদের আলো লেগে দ্বিতীয় রাণীর গায়ে ফোস্কা পড়ে গেল। তিনিও ব্যথায় ছটফট করতে লাগলেন।

সেই সময় কোন গৃহস্থের বাড়িতে হালাম দিস্তার শব্দে তৃতীয় বাণী মূচ্ছ গেলেন। এইসব দেখে রাজা সেখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন।

এই অদ্ভুত গল্প শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ, তোমাকে বলতে হবে এই তিন রাণীর মধ্যে কার শরীর সবচেয়ে কোমল ?
রাজা বললেন, এর উত্তর খুবই সহজ। চাঁদের আলো গায়ে লাগলে যার ফোসক পড়ে, আমার মতে তাঁর শরীরই সবচেয়ে বেশি কোমল।
বেতাল রাজার বুদ্ধির প্রশংসা করে তাড়াতাড়ি আবার শিরীষ গাছে গিয়ে উঠে পড়ল। রাজাও তাকে গাছ থেকে নামিয়ে চলতে আরম্ভ করলেন। বেতালও একাদশ গল্প আরম্ভ করল ।

     সেকালে মগধপুর নামক এক রাজ্যের রাজার নাম ছিল বীরবর। বীরবরের অনেক প্রজার মধ্যে হিরণ্যদত্ত নামে এক ঐশ্বর্যশালী বণিক ছিলেন। ঐ বণিকের মদনসেন...

     সেকালে মগধপুর নামক এক রাজ্যের রাজার নাম ছিল বীরবর। বীরবরের অনেক প্রজার মধ্যে হিরণ্যদত্ত নামে এক ঐশ্বর্যশালী বণিক ছিলেন। ঐ বণিকের মদনসেনা নামে পরমাসুন্দরী এক কন্যা ছিল।
     বসন্ত উৎসবের দিনে মদনসেনা সুন্দর সাজে সেজে তার সখীদের সঙ্গে মনের আনন্দে উপবনে বেড়াচ্ছিল। সেই সময় ধর্মদত্ত বণিকের ছেলে সোমদত্তও বসন্ত উৎসবে যোগ দিতে সেখানে উপস্থিত হয় ।
     সে দূর থেকে পরমাসুন্দরী মদনসেনাকে দেখে মুগ্ধ হলো। তার খুব ইচ্ছা তাকে বিয়ে করার ।

     সোমদত্ত মদনসেনার কাছে গিয়ে তার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করল।
     মদনসেনা বললো, পাঁচদিন পর আমার বিয়ে।
     তবে কথা দিলাম শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাব।
     নির্দিষ্ট দিনে মদনসেনার বিয়ে হলো। রাতে আত্মীয়েরা চলে গেলে মদনসেনা কাপড়ে সবাঙ্গ ঢেকে খাটের একপাশে চুপ করে বসে রইল । তারপর স্বামীকে সোমদত্তর ঘটনা খুলে বললো ।

     একথা শুনে মদনসেনার স্বামী প্রথমে আপত্তি করলেও পরে মত দিল। বললো, না যেয়ে যখন ছাড়বে না, তখন যাও। কথা যখন দিয়েছ তখন তা রাখাই উচিত।
     মদনসেন স্বামীর অনুমতি পেয়ে সেই মাঝরাত্রেই বিয়ের এক-গা-গয়না পরে সমস্ত গা কাপড়ে ঢেকে সোমদত্তর বাড়ির পথে চলল ।
     এক চোর তার সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো, তোমার কি ভয়ডর নেই? একগা গয়না পরে একা এই অন্ধকার রাতে পথে বেরিয়েছ? এখনই গয়নাগুলো খুলে আমাকে দাও।
     মদনসেনা ভয় পেয়েছে কিন্তু সে ভাব বাইরে প্রকাশ না করে বললো, বণিক হিরণ্যদত্তের মেয়ে আমি। স্বামীর অনুমতি নিয়ে সোমদত্তের সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়ি যাচ্ছি প্রতিজ্ঞা পালন করতে। ভাই, এই সব গয়না আমি তোমাকেই দেব প্রতিজ্ঞা করছি, তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, আমি ফিরে আসি তারপর ।
     মদনসেনার কথায় বিশ্বাস করে চোর তাকে ছেড়ে দিয়ে তার ফিরে আসার অপেক্ষায় সেখানে বসে রইল ।
     মদনসেনা সোমদত্তের বাড়ি গিয়ে দেখে সে ঘুমিয়ে আছে। তাকে জাগিয়ে দিতেই সোমদত্ত এই গভীর রাতে তার ঘরে      মদনসেনাকে দেখে খুবই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এত রাতে কি ভাবে এলে?
     মদনসেনা মৃদু হেসে বললো, তোমাকে যে কথা দিয়েছিলাম সেই কথা রাখতেই আমার স্বামীর অনুমতি নিয়ে এসেছি।
     সোমদত্ত কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, তুমি যে প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য এতখানি কষ্ট স্বীকার করেছ এ জন্য আমি খুবই      খুশি। সব জেনেও তোমার স্বামী যে আসতে দিয়েছে এতে তার মহত্বেরই পরিচয় পাওয়া যায়। তুমি নিরাপদে ফিরে যাও।
     ফিরবার পথে মদনসেনার সাথে চোরের দেখা হলো।  চোর জিজ্ঞাসা করল এত তাড়াতাড়ি সে ফিরল কিভাবে। সব      শুনে চোর বললো, আমি আর তোমার গয়না নেব না। তোমার মতো ভাল মেয়ের জিনিস নিলে আমার খুব পাপ হবে। তুমি নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে যাও।
     মদনসেনার স্বামী কিন্তু মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি তার এই ব্যবহারে। তাই মদনসেনা তার স্বামীর কাছে ফিরে এলে স্বামী আর আগের মত তার সঙ্গে কোন কথা না বলে চুপ শুয়ে রইল।
     গল্প শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ, তোমাকে বলতে হবে এই চারজনের মধ্যে  কে সবচেয়ে হৃদয়বান এবং ভালমানুষ?
     রাজা বললেন, চোরকেই আমি ভালমানুষ বলব।
     বেতাল বলল, কেন মহারাজ?
   রাজা বললেন, কারন মদনসেনার স্বামী খুশি মনে তাকে অনুমতি দেননি, পরে খুব বিরক্তি দেখিয়েছিলেন। সোমদত্তের উচিত হয়নি এতেরাত্রে  মদনসেনাকে এক যেতে দেওয়া, মদনসেনা যদিও কথা রাখতে বেরিয়েছিল কিন্তু অত গয়না পরে স্বামীকে অসন্তুষ্ট করে ওভাবে বেরিয়ে যাওয়া তার উচিত হয়নি। কিন্তু চোরের কাজ সুযোগ পেলেই চুরি করা। সেই গভীর রাতে মদনসেনাকে একা পেয়ে সে তার অলঙ্কার অনায়াসেই নিতে পারত, কিন্তু সে শ্রদ্ধা দেখিয়ে এবং তাকে বিশ্বাস করে কিছুই করেনি। এমন উদারতা সামান্য একজন  চোরের কাছে থেকে আশা করা যায় না।
     সঠিক উত্তর পেয়ে বেতাল আবার শ্মশানে গিয়ে সেই গাছে ঝুলে রইল আর বিক্রমাদিত্যও তাঁর যা কাজ তাই করল। বেতালও দশম গল্প আরম্ভ করল।

     সেকালে মিথিলায় গুণাধীপ নামে এক রাজা ছিলেন। চিরঞ্জীব নামে এক রাজপুত যুবক রাজার কাছে চাকরির আশায় মিথিলায় এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু দুঃখের ব...

     সেকালে মিথিলায় গুণাধীপ নামে এক রাজা ছিলেন। চিরঞ্জীব নামে এক রাজপুত যুবক রাজার কাছে চাকরির আশায় মিথিলায় এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজা তখন অন্তঃপুরেই আমোদ-আহ্লাদে দিন কাটাচ্ছিলেন। রাজার সঙ্গে দেখা করার জন্য সেখানে চিরঞ্জীব রয়ে গেল কিন্তু রাজার দেখা পেল না।
     এদিকে তার সব টাকাকড়ি ফুরিয়ে এল। চিরঞ্জীব মনে মনে ভাবতে লাগল, রাজা কতদিনে বাইরে আসবেন তার ঠিক নেই। এরপর ভিক্ষা করে খেতে হবে। কিন্তু ভিক্ষা করে খাবার চেয়ে মৃত্যুও ভাল। রাজা ছাড়া অন্য কেই বা আমাকে চাকরি দেবে। কিন্তু রাজার উপর নির্ভর করে কতদিনই বা এখানে থাকা সম্ভব। তার চেয়ে বরে গিয়ে ভগবানের আরাধনা করা অনেক ভাল। এই ভেবে সে মিথিলা ত্যাগ করে বনে চলে গেল।
    এই ঘটনার কিছুদিন পর রাজা গুণাধিপের আমোদ-আহ্লাদের শখ মিটে যাওয়ায় অন্তঃপুর ত্যাগ করে আবার রাজকার্যে মন দিলেন।

     এরপর একদিন দলবল সঙ্গে নিয়ে রাজা শিকার করতে ঐ বরে গেলেন। নানা স্থান ঘুরে একটা হরিণের পিছু ধাওয়া করে বনের গভীরে প্রবেশ করলেন। সঙ্গীসাথীরা পেছনে পড়ে গেল।
     এদিকে সন্ধ্যা  হয়ে এসেছে। সারাদিন বনে বনে ঘুরে রাজা খিদেয় তেষ্টায় কাতর হয়ে পড়লেন। শরীর আর বইছে না। অথচ কাছে কোথাও জলাশয় নেই। কিছুটা চলার পর বনের মধ্যে এক কুটির দেখে তিনি খুব খুশি হলেন, তাঁর আশা হলো নিশ্চয় ওখানে গেলে মানুষের দেখা পাওয়া যাবে।
     কুটিরের সামনে গিয়ে দেখলেন একজন লোক ধ্যান করছে। রাজা হাত জোড় করে তার কাছে জল চাইলেন। লোকটি আর কেউ নয়, সেই রাজপুত বীর চিরঞ্জীব। চিরঞ্জাব রাজাকে সাদরে বসতে দিয়ে জল ও ফলমূল এনে দিল খিদে মেটাবার জন্য। রাজা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলেন।
     তিনি চিরঞ্জীবকে বললেন, আপনি আজ আমার প্রাণ বাঁচালেন । আমি আপনার কাছে চিরগুণী হয়ে রইলাম। আপনার ব্যবহার দেখে আপনাকে তপস্বী মনে হলেও আপনার চেহারা এবং স্বভাব দেখে অন্যরকম মনে হয় । দয়া করে বলুন, কে আপনি ? কেন এই গভীর বনে একা একা তপস্যায় দিন কাটাচ্ছেন?
     চিরঞ্জীব রাজার অনুরোধ ফেলতে না পেরে সব খুলে বললো। শুনে রাজা বড়ই লজ্জা পেলেন । কিন্তু তখনই নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে সেই রাতটি সেখানে সেই কুটিরেই কাটালেন।
     চিরঞ্জীবকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলেন। তিনি চিরঞ্জীবকে প্রিয়পাত্র হিসাবে নিজের কাছে রাখলেন। চিরঞ্জীব রাজার খুবই অনুগত ও বিশ্বাসী হয়ে উঠল।
     একবার রাজা বিশেষ দরকারে চিরঞ্জীবকে বিদেশে পাঠালেন। সে রাজার প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ফেরবার পথে সমুদ্রের ধারে একটি অপূর্ব মন্দির দেখে সেই মন্দিরে প্রবেশ করলো। দেবীকে প্রণাম করে ফেরার মুখে একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে চিরঞ্জীব মুগ্ধ হয়ে গেল।
     মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো, হে বীর, তোমার এখানে আসার কারন কি?
     উত্তরে চিরঞ্জীব তাকে সমস্ত ঘটনা বলল।

     মেয়েটি বলল, তুমি এই সমুদ্রে ডুব দিয়ে ওঠার পর আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব।
     চিরঞ্জাব মেয়েটির কথামত ডুব দিল । উঠেই দেখে --আশ্চর্য। কোথায় মন্দির আর কোথায় সেই সুন্দরী সে যে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
     যাই হোক, সে ভিজে কাপড় ছেড়ে রাজার সামনে উপস্থিত হয়ে সমস্ত ঘটনা বললো।
     এই অলৌকিক গল্প শুনে রাজার নিজের চোখে দেখার খুব ইচ্ছা হলো !
     যথাসময়ে দু’জনে সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই মন্দিরে প্রবেশ করে দেবীকে ভক্তিসহকারে পূজা দিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে সেই একই দৃশ্য দেখলেন।
     রাজা গুণাধিপ সুপুরুষ ছিলেন। সেই মেয়েটি রাজাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে এসে বললো, মহারাজ, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি তাই করব।
     রাজা বললেন, তুমি যদি আমার কথা শোন তবে আমার প্রিয়পাত্র চিরঞ্জীবকে বিয়ে কর ।
     এই কথা শুনে মেয়েটি বললো, মহারাজ, আমি আপনার রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়েছি, অন্যকে বিয়ে করব কি করে ?
     রাজা বললেন, তুমি কথা দিয়েছ, আমার আদেশ মেনে চলবে । 
     তখন মেয়েটি রাজি হলো এবং রাজা তাদের গন্ধৰ্ব মতে বিয়ে দিয়ে রাজধানীতে নিয়ে এলেন । 
     গল্প শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ, রাজা  আর চিরঞ্জীব-এদের মধ্যে কে বেশী মহত্ব আর উদারতার পরিচয় দিয়েছে?
     বিক্রমাদিত্য বললেন, চিরঞ্জীবই বেশী মহত্বের পরিচয় দিয়েছে।
বেতাল বললো, কিভাবে বল? 
     বিক্রমাদিত্য বললেন, যদিও রাজা গুণাধিপ শেষের দিকে চিরঞ্জীবের উপকার করেছেন কিন্তু চিরঞ্জীৰ সেই শিকারের দিনে তাঁকে জল, আহার ও  আশ্রয় দিয়ে যে উপকার করেছিল তার তুলনা হয় না।
     ঠিক উত্তর পেয়ে বেতাল আবার চলে গেল গাছে ঝুলতে, রাজা বিক্রমাদিত্যও তাকে গাছ থেকে  নামিয়ে কাঁধে তুলে সন্ন্যাসীর আশ্রমের দিকে চললেন । বেতালও নবম গল্প আরম্ভ করল ।

      চম্পা নগরে চন্দ্রাপীড় নামে এক রাজা ছিলেন । তাঁর মেয়ের নাম ত্রিভুবনসুন্দরী। মেয়ের বিয়ের বয়স হলে রাজা মেয়েকে উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে...

      চম্পা নগরে চন্দ্রাপীড় নামে এক রাজা ছিলেন । তাঁর মেয়ের নাম ত্রিভুবনসুন্দরী। মেয়ের বিয়ের বয়স হলে রাজা মেয়েকে উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । ত্রিভুবনসুন্দরীর রূপ ও গুণের প্রশংসা চারদিকে প্রচার হলে নানা দেশের রাজারা সম্বন্ধের প্রস্তাব করে চিত্রকর দিয়ে নিজ নিজ ছবি আঁকিয়ে পাঠাতে লাগলেন । কিন্তু রাজকন্যার একজনকেও পছন্দ হলো না।


      রাজা চন্দ্রাপীড় তখন অন্য উপায় না দেখে ঠিক করলেন, মেয়ের স্বয়ংবরের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু মেয়ে তাতেও অমত প্রকাশ করল । সে বাবাকে বললো, ওসবের কোন প্রয়োজন নেই, বিদ্যা, বৃদ্ধি ও শক্তি-- এই তিনটি গুণের অধিকারী যিনি হবেন তাঁকেই আমি বিয়ে করব ।
      অনেক খোঁজাখুঁজির পর দূরদেশ থেকে চারজন যুবক রাজপ্রাসাদে এসে উপস্থিত হলো। রাজা তাদের নিজ নিজ গুণের পরিচয় দিতে বললেন ।
      প্রথমজন বললো, মহারাজ, ছোটবেলা থেকে বহু যত্ন ও পরিশ্রমে সকল বিদ্যায় পারদর্শী হয়েছি আমি । তাছাড়া আমার একটি বিশেষ গুণ জানা আছে যার সাহায্যে প্রতিদিন একখানি কারুকার্য করা অপূর্ব কাপড় বুনে পাঁচটি রত্বের বদলে বিক্রি করি। একটি রত্ন ব্রাহ্মণকে দিই, একটি দিই দেবতাকে, একটি আমি গয়না করে নিজের গায়ে পরি, আর একটি যত্ন করে রেখে দিই - আমার সঙ্গে যার বিয়ে হবে তার জন্য । আর শেযটি খরচ করে আমার বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। এমন গুণ আর কারো আছে বলে আমার মনে হয় না।
      দ্বিতীয়জন বললো, আমি সমস্ত পশুপাখিদের ভাষা জানি। তাছাড়া আমার মত শক্তিশালী আর কেউ নেই।
      তৃতীয়জন বললো, আমার মত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত আর একজনও নেই। এমন কোন শাস্ত্র নেই যা আমার জানা নেই ।
চতুৰ্থজন বললে, আমি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত আর আমার একটি বিশেষ গুণ - আমি শব্দভেদী বাণ মারতে পারি। এমন গুণের অধিকারী আর কাউকে পাবেন না।

      চারজনের গুণের কথা শুনে রাজা চন্দ্রাপীড় মনে মনে চিন্তা করলেন, পাত্র হিসাবে চারজনই তাঁর মেয়ের উপযুক্ত কিন্তু এদের মধ্যে সেই একজন কাকে নিবাচন করি যার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়।
      অবশেষে রাজা নিজে কিছু ঠিক করতে না পেরে ত্রিভুবনসুন্দরীর কাছে গিয়ে চারজন পাত্রের বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। সব শুনে ত্রিভুবনসুন্দরী লজ্জায় মাথা নীচু করে রইলো, কোন জবাব দিল না।
      গল্প এখানেই শেষ করে বেতাল বললো, মহারাজ, তোমাকে যুক্তি দিয়ে বলতে হবে কে ত্রিভুবনসুন্দরীর স্বামী হবার যোগ্য?
      রাজা বললেন, যে কাপড় তৈরি করে বিক্রি করে, সে তাঁতী। যে পশুপাখির ভাষা শিখেছে, সে বৈশ্য। যে শাস্ত্রজ্ঞ হয়েছে, সে ব্রাহ্মণ। কিন্তু যে শব্দভেদী বাণ মারতে শিখেছে সে রাজার স্বজাতীয়। শাস্ত্র এবং যুক্তি দিয়ে বিচার করলে এই পাত্রই রাজকন্যার উপযুক্ত।
      রাজার যুক্তি শুনে বেতাল তাঁর কাঁধ থেকে নেমে আবার সেই গাছে গিয়ে উঠলো, আর রাজাও নাছোড়বান্দা, তিনি তাকে গাছ থেকে নামিয়ে কাঁধে তুলে আবার চলতে আরম্ভ করলেন। বেতালও অষ্টম গল্প আরম্ভ করল ।