এক কাঠুরের তিন ছেলে৷ তাদের মধ্যে ছোটো ছেলেটি একটু বোকা; তাই তাকে সকলে হাঁদারাম বলে ডাকে৷ একদিন কাঠুরে তার বড়ো ছেলেকে বলল, আজ আমার অসুখ করেছে, আমি কাঠ কাটতে বনে যেতে পারব না, তুমি যাও৷
তা শুনে কাঠুরের বড়ো ছেলে কাঠ কাটতে বনে চলল৷ তার মা তার সঙ্গে রুটি আর দুধ দিয়ে বলে দিল, বন তো ঢের দূরে, সেখানে গিয়ে তোমার বড্ড খিদে পাবে৷ তখন এই রুটি আর দুধ খেয়ো৷
বনের ধারে এক বুড়ো বসে ছিল৷ সে কাঠুরের ছেলেকে দেখে বলল, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে৷ আমাকে একটু কিছু খেতে দেবে? বড়ো ছেলে বলল, যা আছে তাতে আমার নিজেরই পেট ভরবে না৷ তোকে কোত্থেকে দেব; পালা! এই বলে সে কাঠ কাটতে গেল৷ গিয়ে যেই একটা গাছ কাটতে
কুড়ুল উঠিয়েছে অমনি সেই কুড়ুল ফসকে তার হাতের উপর পড়ে গেল৷ হাত কেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল৷ কাজেই কাঠ কাটা আর হল না৷
পরদিন মেজো ছেলে কাঠ কাটতে গেল৷ তার সঙ্গে তার মা রুটি আর দুধ দিল৷ সেদিনও সেই বুড়ো বনের ধারে বসে ছিল, আর কাঠুরের ছেলের কাছে খেতে চাইল৷ তার মেজো ছেলে বলল, নিজে না খেয়ে তোমাকে খেতে দিই আর কি!বয়ে গেছে! তারপর সে বনের ভিতর গিয়ে কাঠ কাটবার জন্য যেমনি কুড়ুল উঠিয়েছে, অমনি ধপাস করে কুড়ুলটা তার
পায়ের উপর পড়ে গেল, কাজেই সেদিন আর সে হেঁটে বাড়ি যেতে পারল না৷
তারপর কাঠুরের ছোটো ছেলে গেল কাঠ কাটতে৷ সে বেচারা বোকা বলে তাকে কেউ ভালোবাসে না৷ তার সঙ্গে তার মা খাবার দিল, খালি বাসি রুটি আর জল৷ সেদিনও বনের ধারে সেই বুড়ো বসে৷ হাঁদারামকে দেখে, বড়ো খিদে পেয়েছে বাবা৷ কিছু খেতে দেবে? বলল বুড়ো৷ হাঁদারাম বলল, তাই তো কী করি? আমার কাছে তো কিছু নেই৷ শুধু বাসি রুটি আর জল আছে, তাতে কি তোমার পেট ভরবে?
তারা দু-জনে মিলে সেই রুটি আর জল ভাগ করে খেল৷ খেয়েদেয়ে, বুড়ো ভারি খুশি হয়ে বলল, তুমি আজ প্রথমেই যে গাছটা কাটবে, তার নীচে একটা খুব ভালো জিনিস পাবে৷ তারপর হাঁদারাম গেল কাঠ কাটতে৷ গিয়ে সে একটা গাছ কাটতেই গাছের ভিতর থেকে বার হল সুন্দর একটি সোনার হাঁস৷
সমস্ত দিন কাঠ কেটে, সন্ধ্যার সময়ে, কাঠ আর সেই হাঁসটি নিয়ে হাঁদারাম বাড়ি চলেছে, আর খানিক দূরে যেতেই রাত হয়ে গিয়েছে৷ তখন সে ভাবল, রাত্রে আর কোথায় যাব? একটা সরাইয়ে আজ থাকি৷ এই ভেবে সে এক সরাইখানাতে গিয়ে উঠল৷ সরাইওয়ালার দুই মেয়ে৷ সোনার হাঁস দেখে তাদের ভারি লোভ হয়েছে৷ দু-জনেই মনে করছে, ওর একটা পালক নিয়ে খোঁপায় পরব৷
রাত্রে যখন সকলে ঘুমিয়েছে, কেউ জেগে নেই, তখন সরাইওয়ালার বড়ো মেয়ে পা টিপে টিপে হাঁসের কাছে গেল৷ হাঁসের কাছে গিয়ে যেই সে তার একটা পালক ধরে আস্তে আস্তে টেনেছে, অমনি সর্বনাশ৷ পালক তো ছিঁড়ল না, লাভের মধ্যে তার হাতখানা হাঁসের গায়ে আটকে গেল৷ কিছুতেই সে হাত খুলল না৷ কাজেই সেখানে বসে থাকতে হল৷ খানিক পরে তার বোনও পালক চুরি করতে এসেছে৷ এসে দেখে তার দিদি হাঁস নিয়ে কী করছে, অমনি সে তার কাছে গিয়ে
হাত ধরে বলল, বাঃ৷ তুমি একলা নেবে নাকি? আমাকে দাও? বলে, আর সে তার হাত টেনে আনতে পারে না৷ সে তার দিদির হাতের সঙ্গে একেবারে জুড়ে গিয়েছে৷ কাজেই সেইরকম হয়ে দু-বোনকে সমস্ত রাত সেইখানে থাকতে হল৷
সকালে উঠে হাঁদারাম তার হাঁস নিয়ে বাড়ি চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে সরাইওয়ালার দুই মেয়েই ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলেছে৷ তাই দেখে সরাইওয়ালা ব্যস্ত হয়ে দৌড়ে এল, আরে, কোথায় যাচ্ছিস? বুড়ো বুড়ো মেয়েরা এমনি করে চলেছিস, লজ্জা করে না? বলে যেই তার ছোটো মেয়ের হাত ধরেছে, অমনি সেও তাদের সঙ্গে আটকে গেছে৷ হাঁদারাম কিন্তু সেদিকে চেয়েও দেখে না৷ সে তাঁর হাঁস নিয়ে, আর হাঁসের সঙ্গে তাদের তিনজনকে নিয়ে, মনের সুখে বাড়ি চলেছে৷ সেইখান দিয়ে তখন এক গোয়ালা যাচ্ছিল৷ সে সরাইওয়ালাকে দেখে দৌড়ে এসে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ? গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছ নাকি? আমার দুধের দাম দিয়ে গেলে না! আর দুধের দাম! গোয়ালা তখন হাত নিয়েই ব্যস্ত; তার হাত সরাইওয়ালার কাঁধে আটকে হাঁদারামের সঙ্গে চলেছে৷ গোয়ালার যে গোয়ালিনি ছিল, তার মেজাজ ভারি কড়া৷ সে ঘরের জানালা দিয়ে দেখলে, দুটি লোকের সঙ্গে দুটি মেয়ে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে তার গোয়ালাও চলে যাচ্ছে৷ অমনি সে ঝাঁটা হাতে দৌড়ে বেরিয়ে এল, কিন্তু কিছু না বলে একেবারে গিয়ে গোয়ালার পিঠে দিয়েছে ঝাঁটা বসিয়ে আর অমনি গোয়ালার পিঠে ঝাঁটা আর ঝাঁটায় গোয়ালিনির হাত আটকে গিয়ে, সেও হাঁদারামের সঙ্গে চলেছে৷
সে দেশের যে রাজা, তার মেয়ে কখনো হাসত না৷ তাই রাজা ঢোল পিটিয়ে দিয়েছিলেন, যে তাঁর মেয়েকে হাসাতে পারবে সে-ই তাকে বিয়ে করবে৷
এই কথা শুনে হাঁদারাম তার হাঁস ঘাড়ে করে আর তার পিছনে সরাইওয়ালার বড়ো মেয়ে, তার পিছনে সরাইওয়ালার ছোটো মেয়ে, তার পিছনে সরাইওয়ালা, তার পিছনে গোয়ালা, তার পিছনে ঝাঁটা হাতে গোয়ালিনিকে নিয়ে, একেবারে রাজার সভায় গিয়ে উপস্থিত হল৷ তাদের সেই চমৎকার তামাশা দেখে সকলে, রাজামশাই নিজে, রানি আর তাঁর সখীরা সকলে একেবারে মাটিতে লুটোপুটি করে হাসতে লাগলেন৷ আর, সকলের চেয়ে বেশি হাসল রাজার সেই মেয়ে৷
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances