উত্তর মেরুর কাছাকাছি আমেরিকার যে অংশটা রয়েছে, সেখানে আলাস্কা নামে একটি দেশ আছে। সেখানকার অধিবাসীদের বলা হয় ইনুইট। এদেরই একটা গ্রামের গল্প তোমাদের আজ শোনাই।
ইনুইট কথাটার অর্থ অনেক লোক। আটলান্টিক মহাসাগরের তীর ঘেঁসে এই গ্রামটিতে কিন্তু অল্প কয়েকজন লোকেরই বাস ছিল। এদেরই একজন ছিল একটি বৃদ্ধা মহিলা, একটি ভাঙ্গা ঘরে তার বাস। সে এত দুর্বল ছিল যে নিজের খাবার জন্য একটা মাছ বা কিছু শিকার করে আনা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে সে গ্রামের নিয়ম ছিল যে কেউ যদি ভাল শিকার পায়, তবে সে সেটা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে। তাই বুড়ির রোজই কিছু না কিছু খাবার জুটে যেত।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে বুড়ি দেখল, সামনের বিস্তৃত বরফের প্রান্তরে একটা ছোট্ট ভালুকছানা খেলা করছে। বরফের দেশে যে বিরাট সাদা মেরু-ভল্লুক দেখতে পাওয়া যায়, যাদের তোমরা টিভির পর্দায় ন্যাট-জিওতে দেখে থাকো, ছানাটা তাদেরই কারোর হবে। বুড়ি একটু অবাক হল একলা বাচ্চাটাকে দেখে, কারণ সাধারণতঃ এত ছোট বাচ্চা তো মা ছাড়া থাকে না। সে একটুক্ষণ অপেক্ষা করল যদি মা-ভালুকটাকে দেখতে পাওয়া যায়। তারপর বুঝতে পারল, নিশ্চয় এই বাচ্চাটার মা-টা কারোর হাতে মারা গেছে। মাথা নেড়ে আক্ষেপ করে বলল, " ইস্,এত ছোট বাচ্চার মাকে কেউ মারে? শরীরে একটু দয়া-মায়া নেই গো? " বাচ্চাটার তখন খিদে পেয়েছিল আর তাই সে নানারকম শব্দ করছিল। বুড়ি এগিয়ে এসে তাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এল। কিন্তু তারও তো ঘরে খাবার বাড়ন্ত। কি করে? খুঁজে পেতে দেখল, আগের দিন একটু দুধ আর এক টুকরো সীলের চর্বি দিয়েছিল কেউ, খানিকটা বাকি রয়ে গিয়েছে। সেটাই এনে ভালুকছানাটার মুখের সামনে ধরল, যত্ন করে ধীরে ধীরে সবটাই খাইয়ে দিল তাকে।বুড়ি ভালুকছানাটার নাম রেখেছে কুনিকজুয়াক। এই নামে সে আজকাল বেশ সাড়া দেয়। সে এখন একটু বড় হয়েছে, শিকার করতে শিখেছে, সমুদ্র থেকে সীল, স্যামন মাছ - এগুলো শিকার করতে পারে। যাই পায়, সবই এনে দেয় বুড়ির কাছে। তাই আজকাল বুড়ির খাওয়ার কষ্ট ঘুচেছে। শুধু তাই নয়, প্রথা অনুযায়ী সেও আজকাল উদ্বৃত্ত খাবারের ভাগ অন্য গ্রামবাসীদের কাছে পাঠাতে পারে। এজন্য তাকে বেশ গর্বিত লাগে।
কুনিকজুয়াককে গ্রামের শিশুরা খুব ভালবাসে। শিকারের সময় বাদে সে ওদের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে। আনন্দে সে যখন বরফের উপর ডিগবাজি খায়, তখন মনে হয় যেন ঠিক একটা সাদা বরফের বল গড়িয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আনন্দ বেশিদিন থাকে না। কুনিকজুয়াক যে এত ভাল শিকার করতে পারে সেই ব্যাপারটা গ্রামের অনেকের কাছেই ভাল লাগছিল না। ঈর্ষায় জর্জর হয়ে তারা কুনিকজুয়াককে মেরে ফেলবার জন্য ফন্দী আঁটল। এই খবরটা আবার গ্রামের ছোটরা আড়াল থেকে শুনে ফেলেছে। তারা তো ভালুকছানাটাকে খুব ভালবাসে, তাই ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে এই সাংঘাতিক খবরটা বুড়িকে জানিয়ে দিল। " ঠাম্মি, ঠাম্মি, তুমি কুনিকজুয়াককে বাঁচাও। দাদারা ওকে মেরে ফেলার মতলব করছে। "
বুড়ি তো কেঁদে আকুল। এত হিংসা মানুষের মনে! একটা ছোট ভালুকছানাকেও তারা রেহাই দেবে না? সে প্রথমে পাড়ার মানুষজনের কাছে মিনতি করল, তার আদরের ছানাটার প্রাণ ভিক্ষা করল। তাতে যখন কিছুই হলনা, তখন দৌড়ে ঘরে এসে কুনিকজুয়াককে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, " বাছা তুই এখুনি এখান থেকে পালা। নইলে তোকে ওরা মেরে ফেলবে যে।" বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। ছোট ছানাটাকে জড়িয়ে ধরে সে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু সে বিপদের কথা ভুলল না। ভালুকছানাটাকে পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিয়ে সে বলল, " আর কখনও এখানে ফিরে আসিস না সোনা।" এই কথা বলতে তার গলা ভেঙে গেল; সে আবার কাঁদতে লাগল। তার চোখের সামনে কুনিকজুয়াক দৌড়াতে দৌড়াতে বরফের প্রান্তরে মিলিয়ে গেল। তার জন্য গ্রামের ছোট্ট বন্ধুরাও কেঁদে আকুল হল।
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে, ভালুকছানার আর কোন খোঁজ নেই। বুড়ির অবস্থা আবার আগের মত হয়েছে। খাবার জোগাড় নেই, কেউ দেখেও না। মনের কষ্টে আর খিদের কষ্টে একদিন সে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ল ছানাটার খোঁজে। কে জানে সে এখন কত বড় হয়ে গেছে।
বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বরফের প্রান্তরে হাঁটতে হাঁটতে সে কুনিকজুয়াকের নাম ধরে বারবার ডাকতে লাগল। হঠাৎ দেখে দূর থেকে একটা বিশাল সাদা ভালুক দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। ঘন লোমে ঢাকা মোটাসোটা বিশালাকৃতি ধবধবে সাদা একটা ভালুক বুড়ির পায়ের সামনে এসে ঝুপ করে পড়ে লুটোপুটি খেতে লাগল। এই আমাদের কুনিকজুয়াক; তবে সে এখন আর ছোট্টটি নেই। পূর্ণবয়স্ক এক সাদ মেরু ভল্লুক, ইচ্ছামত ঘুরে বেড়ায়, কারো পরোয়া করেনা। তবে সে যে বুড়িকে ভোলেনি, তার প্রমান তো সে দেখিয়েই দিল। বুড়িও তাকে অনেক কেঁদে গায়ে, বারবার হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল। তারপর তাকে নিজের অবস্থার কথা বলে তার কাছে খাবার চাইল। কুনিকজুয়াক সঙ্গে সঙ্গে তাকে অনেক স্যামন মাছ এনে দিল। বুড়ি কিছু তাকে নিজে হাতে খাইয়ে দিল, কিছু নিজে খেল। বাদবাকি সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
সেই থেকে বুড়ি যতদিন বেঁচে ছিল, এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। বুড়ি মাঝে মাঝে তার আদরের ছানার সঙ্গে দেখা করতে যেত আর খাবার দাবার নিয়ে ফিরে আসত। শেষ পর্যন্ত বুড়ি যখন আর পারেনা, তখন কুনিকজুয়াক তাকে রাত্রিবেলা খাবার দিয়ে গেছে। লোকে জানত ভালুকটা কে, কিন্তু এত বড় ভালুকের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে উঠবে না বলে ভয়ে চুপ করে যেত। তবে বুড়ি মারা যাবার পর কেউ আর তাকে সে গ্রামে দেখেনি।
এত বছর কেটে গেছে, কিন্তু ইনুইটরা বুড়ি বা তার ভালুকছানাকে ভুলে যায়নি। আজও বরফের উপর যখন ম্লান সূর্য বা চাঁদের আলো পিছলে পড়ে, ফোকলা মুখে ইনুইট বুড়িরা তাদের নাতিপুতিদের এই গল্প বলে খুশিতে ভরিয়ে রাখে।
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances