এক ছিল মেয়ে । দেখতে ভারি সুন্দর। একেবারে পুতুলের মতো। ঠিক যেন এক রাজকন্যে। কিন্তু মেয়েটি ছিল কুঁড়ের হদ্দ । সে কোনোই কাজ করত না ।
তার বাবা-মা ছিল তাঁতি । -
সারাদিন তারা চরকা ঘুরিয়ে সুতো কাটত। তারপর সেই সুতো নিয়ে হাটে বেচত ।
সুতো থেকে কাপড় বানানো হয়। কাপড় দিয়ে তৈরি হয় নানারকমের পোশাক । কিন্তু মেয়েটি তো ভীষণ কুঁড়ে! সে একেবারেই সুতো কাটত না । মা-বাবা তাকে কত করে বলত। সে কোনো কথাতেই কান দিত না। শুয়ে-বসে ঘুমিয়ে সময় কাটাত। কাজকর্ম তার একেবারেই ভালো লাগত না ।
মেয়ের অলসতা দেখে মা-বাবা মহাবিরক্ত। আদর করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোনো কাজ হয় না। একদিন সুতো না কাটার জন্য মা তাকে খুব করে বকাঝকা করলেন ।
‘তুই কেন এত অলস মুখপুড়ি। কেন তুই কাজ করতে চাস না।’ মায়ের বকুনি শুনে মেয়েটি ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল । তারপর সে কী তার চিৎকার! গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করল মেয়েটি। ঠিক অমনি সময় ওই পথ ধরেই সাত ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে রাণীমা যাচ্ছিলেন। রাণীমা মানে একেবারে সত্যিকারের রাণী । তার কানে গিয়ে আঘাত করল মেয়েটির কান্না ।
রাণীমা কান পাতলেন। তারপর গাড়োয়ানদের বললেন, ‘গাড়ি থামাও ।
রাণীমা গাড়ি থামিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন । ঢুকতেই দেখা হল, মেয়েটির মায়ের সঙ্গে। কী ব্যাপার? এই বাড়িতে কান্নার শব্দ কেন?’
রাণীকে দেখে মা তো অবাক!
‘আমার মেয়ে কাঁদছে রাণীমা ।”
‘কেন তোমার মেয়ে কাঁদে?’
মা এখন কী জবাব দেবে? মেয়ে যে তার বেজায় কুঁড়ে— এই কথা কি রাণীকে বলা যায়? হাজার হলেও সে যে মা ; মা কি কখনো মেয়ের বদনাম করতে পারে! রাণীকে তাই মা বলল, রাণীমা, আমার মেয়ে খুব গুণী মেয়ে। চরকায় সারাদিন সে সুতো কাটতে পারে। রাতদিন সুতো কাটতে চায়। কিন্তু অত সুতো কাটবার মতো তুলো আমরা কোথায় পাব? আমরা বড্ড গরিব । অত পয়সা কোথায় আমাদের? তাই ওকে বকা দিয়েছি।”
রাণী সব শুনে বললেন, ‘বাহ, তোমার মেয়ে তো দারুণ কাজের মেয়ে। আমিও সুতো কাটতে খুবই ভালোবাসি। কাজের মেয়েদের আমি খুবই ভালোবাসি। তোমার মেয়েকে আমি রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেতে চাই। এ রকম কাজের মেয়েই
তো আমার দরকার। ওকে অনেক সুতো দেব। একটা ভালো চরকা দেব। মনের আনন্দে মেয়েটি সুতো কাটবে।
মেয়ের মা মনে মনে খুব খুশি । যাক রাজবাড়িতে গিয়ে মেয়ে যদি কাজের হয়! মেয়েটি কিন্তু রাণীর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। তার মুখচোখ শুকিয়ে একেবারে সাদা চুন।
রাণীমা মেয়েটির ওজর-আপত্তি কিছুই শুনলেন না। মেয়েটিকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন রাজপ্রাসাদে। তাকে একটা বিরাট ঘরের মধ্যে রাখা হল। এত বড় ঘর যে, এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত কিছুই দেখা যায় না। ঘরে শুধু পাঁজা পাঁজা তুলো। আর রয়েছে চমৎকার একটা চরকা । হাতল ধরলেই ঘরঘর করে ঘুরতে থাকে। রাণী বললেন, ‘এই যে কাজের মেয়ে, তুমি মনের খুশিতে যত পার সুতো কাট । এই রইল তুলো, এই রইল চরকা। এই তুলো দিয়ে সব সুতো তুমি যদি তিনদিনের মধ্যে কেটে ফেলতে পার তবে মেনে নেব যে তোমার মতো গুণী মেয়ে এই রাজ্যে নেই। আমার ছেলের জন্য একটা গুণী মেয়েই খুঁজছিলাম। সুতো কাটা হয়ে গেলে তোমার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দেব মহা-ধুমধামে । আমার ছেলে কে জান তো? এই রাজ্যের যুবরাজ !
সেই বিশাল ঘরে মেয়েটিকে একলা রেখে রাণীমা চলে গেলেন । মেয়েটি তখন হাপুস নয়নে একা একা কান্না শুরু করল । কারণ সুতো কাটা তার একেবারেই অপছন্দ। এত সুতো সে কোনোদিনই কেটে শেষ করতে পারবে না। এ কথা সে খুব ভালোমতোই জানে।
কাঁদতে কাঁদতে তার একদিন গেল। দু-দিন গেল। না খেল খাবার, না খেল পানি। কাঁদতে কাঁদতে বেচারা নাজেহাল । চোখ ফুলে ঢোল। মুখ একদম ফ্যাকাসে ।
তিনদিনের দিন কাঁদতেও আর ভালো লাগছে না বেচারার। বন্দি ঘরে গভীর হতাশায় ভরে গেল তার মন । জানালা খুলে তাকাল খানিক বাইরে । আলোয় ঝকমক করছে বাইরটা। রাজপ্রাসাদ বলে খুবই নিরিবিলি। কোথাও যেন জনমনিষ্যির সাড়া নেই।
হঠাৎ করেই মেয়েটি দেখল, তিনটে বুড়ি যেন রাস্তা দিয়ে ঠকঠক করে হেঁটে আসছে। আকারে তারা ছোটখাটো । তোবড়ানো গাল আর হোদল কুতকুতে চোখ। দেখতে-শুনতে একেবারেই ভালো নয়। তারা ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়াল জানালার সামনেই । মেয়েটি অবাক হয়ে দেখল, তিনজনের মধ্যে একজনের ঠোঁট ঝুলে পড়েছে গলা পর্যন্ত। আরেকজনের হাত দুটো একেবারে মাটি ছুঁইছুঁই। মুখে তাদের খুনখুনে হাসি ।
মেয়েটিকে দেখে তারা একসঙ্গে তিনজনে বলে উঠল, ওগো লক্ষ্মী মেয়ে, কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?’
মেয়েটি বুড়িদের কথা শুনে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। কী হয়েছে মেয়ে তোমার? আমাদের খুলে বল। এইভাবে কাঁদছ কেন? মেয়েটি তখন চোখের পানি মুছতে মুছতে সব বলল। তাই শুনে তিন বুড়ি হেসে ফেলল। বড় বড় বেঢপ হাত-পা নাচাতে নাচাতে তারা বলল, “এই কথা । এটা কোনো বিপদ হল? এ ব্যাপার নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। আমরা তোমাকে সাহায্য করব । দেখবে, কত দ্রুত কী সুন্দর সুতো কেটে দিতে পারি আমরা। তবে একটি শর্ত আছে।’ মেয়েটি ভয়ে ভয়ে শুধাল, কী সেই শর্ত?’
‘তোমার যখন বিয়ে হবে তখন আমাদের নেমন্তন করতে হবে। আর সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে এই বলে যে, আমরা তোমার দূরসম্পৰ্কীয় বোন। অন্য সবার সঙ্গে যে রকম হেসে ভালো ব্যবহার করবে আমাদের সঙ্গেও সেরকম ব্যবহার করতে হবে । কি? শর্তে রাজি আছ?”
মেয়েটি মাথা নেড়ে জানাল, রাজি। বুড়িরা খুনখুন করতে করতে বলল, ঠিক তো?”
ঠিক, ঠিক, ঠিক ? ‘বাহ। তাহলে দরজা খুলে দাও । আমরা তিনজন ভেতরে আসব।' মেয়েটি কপাট খুলে দিল । তিন বুড়ি ঢুকল সেই বিরাট বড় ঘরে ।
তারপর তুলো নিয়ে তারা নাড়াচাড়া করতে লাগল। আর নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে হাসতে লাগল। অবাক ব্যাপার!
কিুঁক্ষণের মধ্যেই সব সুতো কাটা হয়ে গেল । সুন্দর সরু ফিনফিনে সুতো । তিনদিন পরে রানি এলেন ঘরে। কেমন সুতো কাটা হচ্ছে তাই দেখতে । মেয়েটি ঝটপট তিন বুড়িকে লুকিয়ে রাখল সুতোর আড়ালে। রাণীমাকে স্বাগত জানাল হাসিমুখে ।
মিহি সুতোর বুনন দেখে রাণীমা তো মহাখুশি। বারবার নেড়েচেড়ে মসৃণ সুতোগুলো দেখতে লাগলেন। দারুণ। সত্যিই তুমি অপূর্ব সুতো কাটতে পার। তোমার গুণের প্রশংসা না করে উপায় নেই। তোমার সঙ্গেই আমার বড় ছেলের বিয়ে হবে।’
বিয়ের ঢাকঢোল বেজে উঠল। রাজ্য জুড়ে সাজো সাজো রব । বিয়ের আয়োজন চলতে লাগল। যুবরাজ একদিন দেখা করতে এলেন সেই মেয়েটির সঙ্গে। রূপ দেখে যুবরাজ মহাখুশি । এমন রূপবতী মেয়েকেই তিনি রাজরাণী বানাতে চেয়েছিলেন ।
মেয়েটি যুবরাজকে বলল,‘আমার বিয়েতে আমার দূরসম্পর্কীয় তিনবোনকে আমন্ত্রন জানাতে পারি নি?’
নিশ্চয়ই।’ শুভক্ষণে মেয়েটির সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে হয়ে গেল। রাজ্যের সকলেই নেমন্তন খেতে এল । মন ভরে দোয়া করল বর-কনেকে। রাজরাণীর রূপ দেখে সকলেই ধন্য ধন্য করতে লাগল। আর আজব রঙচঙে পোশাক পরে সেই তিন বুড়িও এল বিয়ের অনুষ্ঠানে ।
নতুন বউ অতিথিদের সঙ্গে তিন বুড়ির পরিচয় করিয়ে দিল । ‘এরা হচ্ছেন আমার বোন। খুব উপকারী বোন। এদের ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না ।"
মেয়ের কথা শুনে তিন বুড়ি তো দারুণ খুশি ।
যুবরাজ নতুন বউকে চুপিচুপি জিগ্যেস করল, আচ্ছা তুমি এত সুন্দরী । কিন্তু তোমার বোনরা দেখতে এত কুৎসিত কেন?
‘ওরাও এককালে আমার মতো সুন্দরী ছিল। চরকায় সুতো কাটতে কাটতে আজ ওদের এই অবস্থা।
তাই নাকি? তাহলে তো সুন্দরী বউ আমার, তোমাকে তো সুতো কাটতে দেয়া যাবে না ?
যুবরাজ তারপর গেল তিন বুড়ির সামনে । প্রথমজনকে জিগ্যেস করল, ওগো বুড়ি, তোমার পা এত বড় আর মোটা কেন? কী করে হল?
“দুঃখের কথা কী আর বলব যুবরাজ। চরকার চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে আমার পায়ের এই বেকায়দা অবস্থা। সুতো কাটা কি কম কঠিন কাজ?
যুবরাজ দ্বিতীয় জনকে শুধাল, তোমার নিচের ঠোঁটটা এমন গলা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে কেন?
“ঠোঁট কি আর একদিনে ঝুলে পড়েছে। সারাজীবন ধরে ঠোঁট দিয়ে সুতো আঁকড়ে ধরেছি। সুতো টানতে টানতেই ঠোটের আমার এই অবস্থা।'
এবারে যুবরাজ তৃতীয় জনকে বলল, তোমার হাতের অবস্থা এত ভয়ংকর কেন? হাত দুটো একেবারে ঝুলে পড়েছে।’
সারাজীবন এই হাত সুতো পাকাতে হয়েছে। আর সুতো পাকাতে প্রচণ্ড কষ্ট । মনে হয়— হাত যেন ছিড়ে যাচ্ছে ।
যুবরাজ তো তিন বুড়ির কথা শুনে একেবারে হতভম্ব। চোখ তার কপালে উঠল। সুতো কাটা হয়তো একটা গুণ। তাই বলে এত কষ্ট রাজরাণীকে মানাবে না।
তারপর বুড়ি তিনজন বলল, যুবরাজ বললে এখন হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে এককালে আমরা সুন্দরী ছিলাম। আমাদের রূপেও আলো জ্বলত। জীবনভর সুতো কেটে কেটে আজ আমাদের বেহাল অবস্থা। আজ আমরা হতকুচ্ছিত। আপনার সুন্দর বউও যদি সারাদিন সুতো কাটতে থাকে তারও একদিন আমাদের মতো অবস্থা হবে।’
যুবরাজ তখন কঠোর কণ্ঠে বললেন, না, আমার সুন্দরী বউ কোনোদিন চরকার সামনেই যাবে না। চিরদিন ওকে সুন্দরী থাকতে হবে।
এই কথা-না শুনে নতুন বউ মনে মনে খুব খুশি । সারাদিন বসে বসে সুতো কাটার মতো বিরক্তিকর কাজ করা তাকে দিয়ে একদম সম্ভব নয়। এই কাজ করতে তার একেবারেই ভালো লাগে না ।
নতুন রাণী আর সুতো কাটেননি। যুবরাজকে সঙ্গে নিয়ে পরম সুখে তার দিন কেটেছে।
ডাউনলোড করো ইপাব (Epub) ফাইল। আর ইন্টারনেট ছাড়াই মোবাইলে কিংবা ট্যাবলেটে বই পড়ো।
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances