Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

নরওয়ের রূপকথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

এক যে ছিল ছাগল ছানা। খুব ভীতু। সবসময় সে তার ঘরের আশেপাশেই থাকত। বাইরে যেত কম। বন্ধুরা একদিন খোঁচা দিল— ঘরের বাইরে বেরিয়ে কিছু দেখে এস। জানা...

এক যে ছিল ছাগল ছানা। খুব ভীতু। সবসময় সে তার ঘরের আশেপাশেই থাকত। বাইরে যেত কম। বন্ধুরা একদিন খোঁচা দিল— ঘরের বাইরে বেরিয়ে কিছু দেখে এস। জানার আছে অনেক কিছু!
ছাগলছানার মাথাতে ভূত চাপল। ঠিক করল— দূরে, বহুদূরে যাবে সে । মা-বাবা কাউকে কিছু বলল না। এক বিকেলে বেরিয়ে পড়ল। আকাশ মেঘলা । জোরে বাতাস বইছে। একা একা হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা মাথায় করে বনে ঢুকল সে । কী অন্ধকার ভেতরে! লম্বা লম্বা দেবদারু গাছের মাথা কাঁপছে বাতাসে । আকাশ জুড়ে কালো কালো মেঘের পরত। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। কড়..কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ছে।
ছাগলছানা ভয়েই দিশেহারা। এদিক-ওদিক এলোমেলো খানিক ছুটোছুটি করল। সে ভাবল— এবার নির্ঘাত মরণ। খানিক পরেই শুরু হল অঝোর বৃষ্টি । বৃষ্টির তোড়ে যেন ভেসে যাচ্ছে সব। ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে গেল ছাগলছানা।
মনের সব সাহস জড়ো করে ছোটা শুরু করল । বন-জঙ্গল ঝেঁটিয়ে এল এক নদীর পাড়ে। মরণ হবে ভেবেই সে উঁচুমতো একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব।
তারপর? তারপর শান্ত হল চারপাশ। রাত পুইয়ে সকাল হল। বৃষ্টিধোঁয়া আকাশ ভেঙে উঁকি দিল রোদুর। ছাগলছানা দেখল চারদিকে শুধু পানি আর পানি। সে ছোট্টমতো একটা দ্বীপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সব ভেসে গেছে পানির তোড়ে। অনেক দূরে শুকনো ডাঙা।
ছাগলছানা সাঁতার জানে না। কোনোকিছু করার নেই তার। সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে। তাই চুপচাপ বসে রইল সে। ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে। তক্ষুনি দেখতে পেল একটা গোবদা ভেড়া নৌকো চালিয়ে যাচ্ছে। ছাগলছানা চেঁচিয়ে উঠল—
'আমাকে বাঁচাও, ভেড়া ভাই।’
‘নৌকায় আমার একদম জায়গা নেই।”
গোবদা ভেড়া কথা ক’টি বলে চলে গেল তার নৌকো নিয়ে। ছাগলছানা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। কী আশ্চর্য পড়শি হয়ে ভেড়াটা এমন করল! আবার একা একা বসে থাকা— বসে থাকা ।
বদ্ধ পানিতে ভাসছিল দুটো গাছের গুড়ি। তার উপর বসে রক্তখেকো এক নেকড়ে আর তার বউ খানিকটা দূরে খেলা করছিল। হঠাৎ তাদের নজরে পড়ল— দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভয়কাতুরে ছাগলছানাকে ।
‘বাহ! এ রকম একটা কচি ছাগল পেলে ভোজনটা তোফা জমত ’ নেকড়ে জিভ চাটতে লাগল। ওখানে গিয়ে ধরা যায় কীভাবে? নেকড়ে-গিন্নি জানতে চাইল ।
‘সাঁতরে গিয়ে ধরতে হবে।’ ‘আমি কিন্তু সাঁতরে যেতে পারব না। তার চেয়ে বরং ডেরায় ফিরে যাই। সবাই মিলে যুক্তি এঁটে তারপর একটি উপায় বের করা যাবে।’
নেকড়ে ও তার গিন্নি তাড়াতাড়ি ফিরে গেল আপন ডেরায় । ছাগলছানা একা-একা বসেই আছে। লতাপাতার ঝোপঝাড় ভেসে যাচ্ছে বেশ খানিকটা দূর দিয়ে। এ রকম একটা ঝোপঝাড়ে চড়ে বসার বুদ্ধি আটল সে। কিন্তু পোড়া কপাল! সামনে দিয়ে যায় না একটাও ।
দুপুর গড়িয়ে চলল। কেউ এল না তাকে উদ্ধার করতে । ‘কোয়াক ! কোয়াক!’ কে যেন মাথার উপরে ডেকে উঠল। ছাগলছানা তাকাল। একটা বাচ্চা হাঁস উড়ছে। কী করছ এখানে? বাচ্চা হাঁসটা শুধাল ।
‘দেখতে পাচ্ছ না!" ছাগলছানা বলল, ‘কেউ আমাকে রক্ষা করবে, এই আশাতেই বসে আছি। আমি উড়তে জানি না, সাঁতারও জানি না।’
ভয় পেয়ো না বন্ধু । বাচ্চা হাঁস জানাল। ধৈর্য ধর। আমরা তোমাকে রক্ষা করব ।”
বেলাবেলি নদীর তীরে তীরে ছড়িয়ে পড়ল ছাগলছানার খবর। দয়ালু পশুপাখিরা ছুটে এল । খরগোশ এল লাফাতে লাফাতে, হামাগুড়ি দিয়ে এল সারস। বেলেহাঁস এল পেলিক্যানদের সঙ্গে নিয়ে। গাধা এল, এল বানর। বাচ্চা হাঁস পুরো ঘটনাটা শোনাল সবাইকে ।
রাজি হল সবাই ।
আমি অবশ্যই রক্ষা করব, বলল খরগোশ । সবাই মিলে সাহায্য করব ওদের । পেলিক্যানদের দিকে তাকিয়ে কথা ছুড়ল বেলেহাঁস ।
সারস জানাল, কিন্তু কীভাবে।
আমরা সবাই মিলে ভেলা তৈরি করব । শিগগির গাছ কাটার কাজে লেগে যাও।”
সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বনের ভেতর তারা কলাগাছ খুঁজে বের করল । শুয়োর এল ধারাল দাঁত নিয়ে। কলাগাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ে সে আলগা করে দিতে লাগল। গাছগুলোকে গাধা এসে লাগাল পিঠ দিয়ে ধাক্কা । আর সেই ধাক্কায় কলাগাছ একটা একটা করে উপড়ে পড়তে লাগল। চারটি কলাগাছ দিয়ে দিব্যি তৈরি হল একটা ভেলা । বানর নিয়ে এল লতা । কষে বাঁধল সেই ভেলা ।
হঠাৎ করে চড়ুই এল উড়তে উড়তে । "এইমাত্র দেখে এলাম ছাগলছানাকে । জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে চড়ুই বলল, সে কাঁদছে। খুব খিদে তার পেটে । কী করা যায়?
ভাবনায় পড়ল খরগোশরা। সারস বলল, কিছু খাবার পাঠিয়ে দেয়া যাক । বেলেহাঁস জানাল, ‘পেলিক্যান থাকতে চিন্তা কী?
খরগোশ কিছু শালগম, গাজর নিয়ে এল। পেলিক্যান ফাঁক করে ধরল তার বিরাট দুটো ঠোঁট । সেই ঠোঁটে খাবার নিয়ে উড়াল দিল সে ।
এদিকে বুলবুলি এসে খবর দিল, তিনটে রক্তচোষা নেকড়ে ছাগলছানাকে ধরার জন্য রওনা দিয়েছে ?
কী করা যায়? কী করা যায়? পাখিরা সবাই সমস্বরে বলল, আমরা চল যাই । উপর থেকে পাথর ছুড়ব । নিচে নেমে ঠোকর মারব। দেখি ওদের ঘায়েল করা যায় কিনা ?
তারা তাড়াতাড়ি যে যার কাজ ঠিক করে নিল। বানর দল ভেলা ভাসাল। আকাশপথে দ্রুতবেগে চলল পাখিরা।
নেকড়ে তিনটে গাছের গুড়িতে চেপে চলেছে। মনে তাদের আনন্দ । সেই ছোট্ট দ্বীপের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। একজন আরেকজনকে বলছে : ‘প্রায় এসেই গেলাম নাকি? ছাগলছানা প্রথম ধাক্কায় আমাদের পেয়ে ভাববে— বুঝি উদ্ধার করতে যাচ্ছি তাকে । কিন্তু বেচারাকে ধরব আর খাব।”
চুকচুক করে তিনজনে জিভ চাটল । এমন সময় মাথার উপর ঝাঁক বেঁধে এল পাখিরা। মুখে তাদের পাথর। ঝুরঝুর করে পড়তে লাগল সে পাথর। বাজ আর ঈগল এসে ঠোকর মারছে নেকড়েদের । কিছু বোঝার আগেই হেলেদুলে নেকড়েরা পড়ে গেল পানিতে । পেলিক্যানরা এল আস্তে-ধীরে। বড় বড় পাথর ওদের ঠোঁটে । টুপ করে ছেড়ে দিল এক-একটি পাথর নেকড়েগুলোর ঘাড়ে। ওদের অবস্থা তখন— ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি । সাঁতরে ওরা গিয়ে উঠল নদীর পাড়ে । ঠোকর খেয়ে চামড়া ছিড়ে গেছে জায়গায় জায়গায় ।
এমন সময় দ্বীপে গিয়ে পৌছল সেই ভেলা। ছাগলছানা তো অবাক । ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জড়িয়ে ধরল সে বানর আর খরগোশদের । তারপর আনন্দে-খুশিতে লুটোপুটি করতে করতে ফিরে এল সবাই। ছাগলছানাকে ওরা পৌছে দিল বাবা-মা'র কাছে। বাবা-মা তো খুঁজতে খুঁজতে সারা । তারা সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাল। তারপর নেমন্তন দিল।
পরদিন নেমন্তন খেতে এল পশুপাখিরা। সেই যে গোবদা ভেড়া— সে-ও এল । ছাগলছানাকে রক্ষা করেনি বলে কেউ ওকে পাত্তাই দিল না। এ রকম স্বার্থপর পড়শিকে কারো দরকার নেই। লজ্জা পেয়ে ভেড়া একা-একা চলে গেল ।
সে কী গানবাজনা আর হইহুল্লোড়! সারারাত মাতোয়ারা রইল পশুপাখিরা। খেয়ে খেয়ে ঢেঁকুর তুলল আয়েশে। শেষে সবাই যখন যার-যার ঘরে ফিরে গেল, ছাগলছানা তখন ভাবল আগের দিনের কথা। সেই বিপদের কথা। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। কিন্তু তার বুকে যে এত বিপদ বাধা লুকিয়ে আছে, কে জানত। আসলে বাবা-মাকে জানিয়ে গেলে হয়তো এমনটি আর ঘটত না ।

এক ছিল অহংকারী খরগোশ। দেখতে বেশ নাদুস-নুদুস। কচি কচি মুলো খেত। বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। আর ধেইধেই করে নেচে নেচে গান গাইত। লাফিয়ে লাফিয়ে খুব ...

এক ছিল অহংকারী খরগোশ। দেখতে বেশ নাদুস-নুদুস। কচি কচি মুলো খেত। বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। আর ধেইধেই করে নেচে নেচে গান গাইত। লাফিয়ে লাফিয়ে খুব বেগে ছুটতে পারত সে। তাই তার মনে ভারি অহংকার। অন্য খরগোশদের সে গণায় ধরত না। যাকে-তাকে সে শুধুশুধু খোচা দিত। ঘোড়াকে গিয়ে বলত, কী তোমার ঠ্যাঙের ছিরি! দাঁড়িয়ে ঘুমাতে হয়।’ গাধাকে দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল খরগোশ, ‘গাধারে গাধা । তুই এখনো হাঁদাই রয়ে গেলি |’
লম্বা গলা জিরাফকে দেখেও হাসি থামত না খরগোশের । 
হাতি তোর গোদা পায়ে লাথি’, এই বলে সে হাতি বেচারাকে খেপাত । 
গরু, ভেড়া, শজারু, বানর সবাই খরগোশের কথা শুনেছে। 
কাউকে খরগোশ পাত্তাই দিত না । সুযোগ পেলেই খরগোশ নিজের গুনগান করত, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হত। আর তার চলনে-বলনে ফুটে উঠত অহংকার।
একদিন বনের মাথায় মেঘ কালো করে বৃষ্টি নামল। গাছে গাছে ফুটল বর্ষার ফুল। বনের পাশে শুরু হল ব্যাঙের গান। খরগোশ থাকত সেই নদীর ধারেই।
ব্যাঙের গান শুনে তার মেজাজ গেল বিগড়ে । কারা এমন বিশ্রীভাবে চিৎকার করছে? ওরা কি জানে না— খরগোশ থাকে আশেপাশেই? মূর্খদের যদি একটু বুদ্ধি থাকত!
অহংকারী খরগোশের ভারি রাগ হল । কেউ তাকে কোনোদিন অসম্মান করেনি। আর আজ সারারাত কতকগুলো পুঁচকে তাকে হেস্তনেস্ত করে ছাড়ছে। বৃষ্টির রাতে কোথায় আরাম করে ঘুমুবে তা নয়, কানের কাছে টিন পেটানো গান বাজছে!
পরদিন ঘুম ভাঙতেই খরগোশ গেল নদীর ধারে । কচি ঘাসের ডগা চিবুতে চিবুতে সে গিয়ে দাঁড়াল উঁচু একটা ঢিবির উপর। এদিক-ওদিক তাকাল। খানিকদূরেই গানের জলসা বসিয়েছে কয়েকশো ব্যাঙ। কী কোলাহল তাদের! আনন্দে তারা হাবুডুবু খাচ্ছে ।
রাতে ঘুম হয়নি বলে খরগোশের মেজাজ এমনিতে তিরিক্ষি। ব্যাঙদের লাফালাফি দেখে সে আর ঠিক থাকতে পারল না। খরগোশের মনে তখন অহংকার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার আশেপাশেই ছিল পাথরের টুকরো। তাই তুলে নিয়ে সে ছুড়ে মারতে লাগল ব্যাঙদের জলসায়।
ব্যাঙরা প্রথমে হতভম্ব। কী ব্যাপার! অনবরত কে যেন পাথরের টুকরো ছুড়ে মারছে। বেশ কয়েকটা ব্যাঙ সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল। ব্যাঙদের তল্লাটে হুলুস্থুল পড়ে গেল। যে যেদিকে পারল ভাগতে চাইল ।
ব্যাঙের রাজা তখন দিশেহারা। নিজেদের আবাস ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু কেন? কী তাদের অপরাধ? আমনি সবার চোখ গিয়ে পড়ল সেই ছোট্ট টিলাটার ওপর। ওখানে দু-ঠ্যাঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নাদুস-নুদুস খরগোশ। এখনও তার বাঁ হাতে রয়েছে একটা লম্বা মুলো ।
ব্যাঙদের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। এ রকম দেখতে-শুনতে সুন্দর এক খরগোশ কেন অযথা তাদের ঢিল মারছে।
ব্যাঙের রাজা আলাপ করে নিল অন্যদের সঙ্গে। খুব তাড়াতাড়ি এর একটা বিহিত করতে হবে । ইতিমধ্যে প্রায় একশো ব্যাঙ মরে গিয়েছে।
ব্যাঙের রাজা বলল, আমিই যাব খরগোশের কাছে। গিয়ে জানব কী কারণ, কী বিত্তান্ত? কেন উনি নির্মমভাবে আমাদের মারছেন।”
মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে একদম টিলার সামনে এসে দাঁড়াল ব্যাঙের রাজা । খরগোশ আবার যেই একটুকরো পাথর তুলে মারতে গেছে অমনি করজোড়ে মিনতি করল ব্যাঙের রাজা, বন্ধ করুন আপনার নিষ্ঠুর পাথর-ছোড়া। কেন মারছেন আমাদের?
হো হো করে হেসে উঠল খরগোশ। এই পুঁচকে ব্যাঙ নিশ্চয়ই কিছুই জানে না তার সম্বন্ধে। খরগোশ কচি মুলোর ডগা চিবোতে চিবোতে বলল, ওহে পচা ডোবার ব্যাঙ, আমি কে জানিস?
অবাক হল ব্যাঙের রাজা। কী বোকার মতো কথা বলছে খরগোশ! বনের রাজা সিংহকেই এখন কেউ চিনতে চায় না! এই খরগোশকে চিনে তার কী লাভ ।
ব্যাঙের রাজা বলল, না চিনলেও এখন চিনতে পেরেছি।’ খরগোশ ছাইরঙা লেজটা পেছনে একপাক ঘুরিয়ে নিল ।
বলল, আমি হচ্ছি এই বনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী। আমার নাক, চোখ, মুখ গায়ের রং– সবই সত্যি চমৎকার। আমি যত সুন্দর করে ছুটতে পারি অন্য কেউ তা পারে না। এসব ভাবলে অহংকারে আমার বুক ফুলে ওঠে। সেই আমি কিনা গতরাতে ঘুমাতে পারিনি। ঝিরঝির করে কাল বৃষ্টি পড়ছিল। ইচ্ছেমতো ঘুমাব এই ছিল ইচ্ছা। কিন্তু সারারাত্রি তোমাদের ঘ্যাঙোর ঘ্যাং, ঘ্যাঙোর ঘ্যাং-এর জন্যে ঘুম আমার আসেনি।’
ব্যাঙের রাজা বুঝল সব। কিন্তু এর একটা সুরাহা করা দরকার। খরগোশের কথায় বোঝা গেল— খুব অহংকারী সে। ব্যাঙদের এই তল্লাট থেকে ভাগিয়ে সে নিশ্চিন্ত হতে চায়।
ব্যাঙদের রাজা হাতজোড় করে বলল, খরগোশ ভাই, আমি একটু ক্ষণের জন্য অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে আসি । তারপরেই ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করব ? খরগোশ খুশি হল, না বেজার হল, বোঝা গেল না। ব্যাঙের রাজা ফিরে এসে সবাইকে জানাল সবকিছু। সবার মাথায় হাত ।
শেষে ব্যাঙ বলল, যা হোক একটা কিছু বলে আসি খরগোশকে । পরে আবার আলাপ করা যাবে। কিন্তু আমরা কিছুতেই এ তল্লাট ছাড়ব না। বর্ষা শুরুর গানও আমরা বন্ধ করতে পারি না।’
সবাই হাত তুলে বলল, তাই, তাই, আমরা সইব না এ অন্যায়।’ ব্যাঙের রাজা ফের গেল অহংকারী খরগোশের কাছে। মিনতি করেই খরগোশকে বলল, “এ নদীর তীর ছেড়ে আমাদের অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আর আমাদের মুখের ভাষা আমরা বন্ধ রাখতে পারব না। কী করব এখন বলুন? 
লাল হয়ে গেল খরগোশের মুখ । এতবড় সাহস পুচকে ব্যাঙগুলোর! চেঁচিয়ে উঠল সে, “তোমাদের সবাইকে পাথর ছুড়ে ছুড়ে মারব আমি ?
ব্যাঙের রাজার বুক কেঁপে উঠল। তবু সে নরম সুরে জীবন-মরণ বাজি ধরল: আচ্ছা খরগোশ ভাই, আমরা তো আর এমনি এমনি নদী ছেড়ে চলে যেতে পারি না। আপনি নাকি খুব সুন্দর ছুটতে পারেন। তাহলে আপনার সঙ্গে আমার বাজি হোক। আগামীকাল আমরা দুজন দৌড় শুরু করব। নদীর বাঁকে যে বটবৃক্ষটা আছে সেখানেই দৌড় শেষ হবে। যে আগে পৌছাতে পারবে সেই জিতবে।’
খরগোশ জানতে চাইল, “যে বাজি জিতবে তার কী হবে? ব্যাঙের রাজা জানাল, আমি হেরে গেলে আমরা সবাই এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাব। আর আপনি হেরে গেলে আপনার মাথায় চড়ে পালা করে আমরা সারা বন ঘুরব। রাজি আছেন আপনি?’
খরগোশ মুচকি হেসে রাজি হল ।
ব্যাঙের রাজা বড় মুখে বলে এল দৌড়ের কথা। খরগোশ দৌড়াবে নদীর পার দিয়ে । ব্যাঙ লাফাবে নদীর তীরঘেষা পানির মধ্যে দিয়ে । খরগোশ চোখ-কান বন্ধ করেই জিতে যাবে।
শেষে ব্যাঙের রাজাই এক বুদ্ধি বের করল । বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলেই ঘায়েল করতে হবে খরগোশকে ৷ খরগোশ ব্যাঙদের চিনতে পারবে না আলাদা করে । তাই ব্যাঙদের নদীর ধারে বিশ হাত দূরে দূরে লুকিয়ে বসে থাকতে হবে। আর ব্যাঙের রাজা গিয়ে একদম সেই বটগাছের গোড়ায় বসে ঘ্যাঙোর ঘ্যাং ঘ্যাঙোর ঘ্যাং গান গাইবে । খরগোশ নদীর পার দিয়ে দৌড়াবে। সে কিছু বললেই কাছাকাছি ব্যাঙটি জবাব দিয়ে দেবে। এভাবেই কেল্লা ফতে হবে। যা বুদ্ধি তাই কাজ ।
সারারাত ব্যাঙরা নদীর তীর ঘেঁষে লুকিয়ে রইল। আর ব্যাঙের রাজা চলে গেল বটগাছটার গোড়ায় । ওখানেই দৌড়ের বাজি শেষ হবে । ব্যাঙের রাজার ছোটভাই দাঁড়িয়ে রইল দৌড় শুরু করার জন্য। এমন সময় হেলেদুলে এল অহংকারী খরগোশ। পায়ের উপর পা উঠিয়ে বলল, কিহে ব্যাঙাচি, বাজির কথা মনে আছে তো?”
ব্যাঙরাজার ছোটভাই মাথা ঝাকাল— হ্যাঁ তার মনে আছে। খরগোশ কোনো ব্যাঙকে আলাদা করে চিনতে পারবে না। এই এক বাড়তি সুবিধা । কথা আর বাড়াল না। -
শুরু হল দৌড় প্রতিযোগিতা। খরগোশ ছোটে পাগলের মতো । বাতাস কেটে সে যেন উড়ে চলেছে। মাঝেমধ্যে খরগোশ চিৎকার করে ওঠে, "ওহে ব্যাঙরাজা, পেছন পেছন আছ তো, নাকি বেমালুম হারিয়ে গেছ?
তখন লুকিয়ে থাকা কোনো একটা ব্যাঙ তড়াক করে দু-কদম লাফিয়ে বলে, হারিয়ে যাব কেন? তোমার সামনেই আছি। আরও জোরে ছুটতে হবে খরগোশ তোমাকে |
খরগোশ আরও জোরে প্রাণপণ ছোটে । কিন্তু ছুটলে কী হবে, বটগাছের সামনে এসে চক্ষু তার চড়কগাছ। গান গাইছে আর ধেইধেই করে নাচছে সেই ব্যাঙের রাজা । কীভাবে সে খরগোশের আগে পৌছল? অহংকারী খরগোশের সব তালগোল পাকিয়ে গেল ।
এখন বাজি জিতেছে ব্যাঙের রাজা । খরগোশের মাথায় চড়ে ব্যাঙরা এখন বনে বনে ঘুরে বেড়াবে। লজ্জায় মাথা কাটা গেল খরগোশের। সব অহংকার তার ধুয়েমুছে গেছে। মাথা নামিয়ে রইল খরগোশ। একটি কথাও সে বলল না।
খরগোশের মাথায় চড়ে দুই দিন দুই রাত বনের এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে বেড়াল ব্যাঙরা ।
পরদিন আবার তোড়েজোড়ে বৃষ্টি নামল। ফুলেফেঁপে উঠল নদীর পানি আর ব্যাঙরা মনের সুখে বর্ষার গান ধরল।

রাজকন্যের মন ভালো নেই। খায় না, দায় না, নিশিরাতে ঘুমোয় না। মুখ তার গোমড়া। চোখে জল টলমল । রাজা পড়েছেন ভাবনায় । রানি করেন চিন্তা । ব্যাপা...

রাজকন্যের মন ভালো নেই। খায় না, দায় না, নিশিরাতে ঘুমোয় না। মুখ তার গোমড়া। চোখে জল টলমল । রাজা পড়েছেন ভাবনায় । রানি করেন চিন্তা ।
ব্যাপার কী? ব্যাপার কী? ভেবে ভেবে হন প্রাণান্ত ।মন্ত্রীরাও পায় না কোনো কূলকিনারা ।
রাজ্য জুড়ে অশান্তি । রাজকন্যের মুখে হাসি নেই। রাজারও তাই মন খারাপ । রাজকাজে মন বসে না তার। রাজকন্যে রাজপ্রাসাদের আলো । তার মুখে হাসি থাকলে পুরী করে গমগম। বৃষ্টি নামে ঝমঝম। বাগানে ফুল ফোটে। পাখি গান গায়। চাঁদ ঢালে আলো । আর সেই রাজকন্যা সারাক্ষণ থাকে কিনা চুপচাপ । কারো সাথে কথা বলে না। রাজার মনে শান্তি থাকে কীভাবে?
ঘোষণা দিলেন তিনি---
কন্যার মুখে হাসি ফোটাতে পারবে যে তার সঙ্গে হবে তার বিয়ে । তাকে করা হবে এই রাজ্যের রাজা ?
দেশে দেশে জানানো হল সেই ঘোষণা ।
সেই ঘোষণা গিয়ে পৌছাল এক গাঁয়ে, এক চাষির ছেলের কানে। ফুটফুটে তার চেহারা। মায়াভরা তার চাউনি। মুখে কথার খই ফোটে। যেমন তার শরীর তেমনই তার শক্তি ।
রাজার ঘোষণা শুনে মন হল তার উতলা। চাষিকে বলল সে, বাবা, আমি রাজার মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আমাকে যেতে দাও।”
বাবা অবাক হলেন । ‘এই কাজ তুই পারবি কী করে? কেউ যা পারছে না— তুই সে সাহস করিস কী করে?”
চাষির ছেলে নাছোড়বান্দা । বাবা দিলেন অনুমতি । চাষির ছেলে চলল, রাজপ্রাসাদে যাবে সে । সঙ্গে নিল তার পোষা ঘোড়া । সেই ঘোড়ার পিঠে চাপলে সে থোড়াই কেয়ার করে অন্য কিছু।
শুভদিনে, শুভক্ষণে, মেঘভাঙা রোদ মাথায় নিয়ে রওনা দিল চাষির ছেলে । ছুট ছুট ছুট... ধু ধু মাঠ পেরিয়ে, বরফের পাহাড় পেরিয়ে ছুটিয়ে দিল ঘোড়া। মা তাকিয়ে রইল পথের পানে । বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আপন মনে ।
টগবগ, টগবগ ছুটছে ঘোড়া । রাজকন্যের মুখে যেভাবেই হোক হাসি ফোটাবে সে । এই ঘোড়ার ছিল অনেক গুণ । ঘোড়া যখন ছুটতে থাকে তখন কারো যদি স্পর্শ লাগে তবে সে আটকে যাবে ঘোড়ার সঙ্গে। ঘোড়া ছুটবে, সে-ও ছুটবে।
ঘোড়ার প্রভু হল চাষির ছেলে। সে যতক্ষণ না হাত বুলিয়ে দেবে ততক্ষণ ঘোড়াও ছাড়বে না কাউকে ।
চলতি পথে দেখা হল আজব রকম একপেয়ে একজন লোকের সঙ্গে ! একটা ঠ্যাং কাঁধে চাপিয়ে লোকটা দিব্যি লেংচে লেংচে হটছে । চাষির ছেলে তাকে দেখে অবাক হল ।
কী ব্যাপার! এইভাবে হাঁটছ কেন তুমি?
একপেয়ে লোকটা মুচকি হাসল। আমায় দেখে অবাক হয়াঁ না। দুই-পা মাটিতে থাকলে সেকেন্ডে আমি যাই একশো মাইল।
বলে কী লোকটা!
শুনে থ হয়ে যায় চাষির ছেলে । সঙ্গী করে নেয় লোকটাকে ।
আবার তাদের যাত্রা শুরু ।
যেতে যেতে এবার দেখে, পথের মধ্যিখানে একজন লোক চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে। আরেকটু হলে ঘোড়া তাকে মাড়িয়েই দিত আর কী!
ব্যাপার কী গো? ব্যাপার কী?”
দুঃখের কথা বলব কি ভাই– খোলা চোখে কাছের জিনিস দেখতে পাই না মোটেই। চোখ খুললেই একশো মাইল দূরের জিনিস দেখি ।
এ লোকটাকেও সঙ্গী করে নেয় ওরা । একপেয়ে, চোখ-বন্ধ আর চাষির ছেলে— তিনজনে চলল রাজপ্রাসাদের দিকে। সূর্য ডুবে রাত নামে। রাত পুইয়ে সকাল হয়।
যেতে যেতে দেখা হল আরেক অদ্ভুত লোকের সঙ্গে। পানিভরা বোতলের মুখ আঙুলে চেপে রাস্তার মধ্যে তিড়িং বিড়িং করে নাচছে সে।
“এমনভাবে নাচছ কেন ভায়া? প্রশ্ন শুনে উত্তর দিল বোতলঅলা, আঙুল খুললেই একশো মাইল বেগে ছুটবে পানি। বোতলের পানি অফুরন্ত। নিমেষে মরুভূমিকে বানিয়ে দিতে পারে সাগর। তাই না শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চাষির ছেলে একপেয়ে আর অন্ধের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বোতলঅ'লা আপনা আপনি সফরসঙ্গী হয়ে গেল । মুখগোমড়া রাজকন্যের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। এ আর এমন কী ব্যাপার! সবাই মিলে রওনা দিল রাজপ্রাসাদের দিকে ।
ইতিমধ্যে হয়েছে এক কাণ্ড! চলতি পথের লোকজন, গাছপালা, জীবজানোয়ার আটকে যাচ্ছে ঘোড়ার গায়ে । যাকে দেখে তাকেই টেনে নেয় ঘোড়া । খোড়া, কানা, ল্যাংড়া, লম্বা, ট্যাঙা— নানা ধরনের লোকজন, নানা ধরনের জীবজন্তু আটকে রয়েছে ঘোড়ার সঙ্গে। কেউ কাঁদছে, কেউ গোঙাচ্ছে, কেউ-বা চেঁচাচ্ছে প্রাণপণ ।
সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। যে দেখবে তারই হাসি পাবে। সদলবলে চলল এই বাহিনী । আর ওদিকে— শীত পেরিয়ে বসন্ত এসেছে। ডালে ডালে গজাল নতুন পাতা। বনে বনে গান গাইছে পাখিরা। তবু রাজকন্যের মুখে হাসি নেই। মুখ তার ছাইবরণ, চোখ তার টলোমলো | এমন সময় খবর এল প্রাসাদে দলেবলে হাজির হয়েছে একজন। রাজকন্যের মুখে হাসি ফোটাবে সে । সে রাজার দর্শন পেতে চায় ।
বুড়ো রাজা তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন । অদ্ভুত এই দলটাকে দেখেই অবাক হয়ে গেলেন রাজা । ঘোড়ার গায়ে লেপ্টে-থাকা লোকজন ও জন্তুজানোয়ারের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি দেখে রাজা হেসে ফেললেন ফিক করে। রাণী এলেন । তিনিও হাসলেন ফিক করে।
এ আবার কীরকম কাণ্ড বাপু ঘোড়ার গায়ে লেগে থাকে মানুষ! এ কোন চিড়িয়া বাবা!
রাজকন্যাকে নিয়ে আসা হল সামনে । রাজা হাসছেন । রাণী হাসছেন। মিষ্টি হাসির ঝিলিক খেলে গেল রাজকন্যের মুখেও ।
ভেঁপু বেজে উঠল। রাজ্য জুড়ে হেসে উঠল সবাই। গাছে গাছে পাখিরা গাইল গান। ফুল ফুটল। রাজ্যের লোকের আনন্দ আর ধরে না। রাজ্যের ওপর দিয়ে বয়ে গেল খুশির ঢেউ।
তারপরে সবাই খোঁজ লাগাল, কে সেই সৌভাগ্যবান যে রাজকন্যের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তাকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকজন। কে যেন বলল, আরে, এ যে চাষির ছেলে!’
এক কান, দুই কান— এই খবর ছড়িয়ে পড়ল সবখানে । রাজা ভঙ্গ করলেন নিজের ঘোষণা । অসম্ভব । চাষির ছেলের সঙ্গে রাজকন্যের বিয়ে হতে পারে না । এই না শুনে চাষির ছেলের মাথায় জ্বলল আগুন। কী? এতবড় অপমান? গেল সে মন্ত্রীর কাছে । আমি তো আমার কাজ করেছি। এবারে আপনাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন। মন্ত্রীর পেটে পেটে কূটবুদ্ধি। রাজার সঙ্গে পরামর্শ করল, কী করে চাষির ছেলেকে বিদায় করা যায়!
মন্ত্রী বলল, একশো মাইল দূরে আছে এক ঝরনা। একঘণ্টার মধ্যে সেই ঝরনার পানি এনে দিতে পারলে রাজসিংহাসনের যোগ্য বলে মনে করব তোমায় ।”
চাষির ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছিল একপেয়ে। চোখ কচলে হাই তুলে বলল, সে, “এ আবার এক কাজ হল? এই আমি চললাম। যেতে এক সেকেন্ড, ফিরতে এক সেকেন্ড!”
বলেই একপেয়ে কাঁধ থেকে নামিয়ে নিল এক-পা । চোখের পলকে সে হাওয়া । রাজা মন্ত্রী আর ‘জি হুজুরের দল’ সবাই ভাবল— এই অসম্ভব কাজ কীভাবে করবে চাষির ছেলে? যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল ।
এদিকে এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড যায়। কিন্তু কোনো পাত্তা নেই একপেয়ের । চোখ-বন্ধ তখন উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমি তো সারাক্ষণ বেগার বসে আছি । আমিই তবে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি।”
বলেই সে চোখ মেলল। দেখতে পেল, একশো মাইল দূরে ঝরনাতলায় চোখ মুদে শুয়ে আছে একপেয়ে । সময় এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত ।
কী করা যায়? কী করা যায়?
আর কোনো কথা নেই—
বোতলঅলা আঙুল খুলে ফেলল। বোতল থেকে একশো মাইল বেগে পানি গিয়ে আছড়ে পড়ল একপেয়ের গায়ে । চোখ মেলে চাইল সে । ঝটপট পানি নিয়ে একপেয়ে হাজির হল রাজপ্রাসাদে ।
ধন্য ধন্য পড়ে গেল চাষির ছেলের নামে ।
রাজার চক্ষু চড়কগাছ! বুড়ো মন্ত্রী ভাবল, এ বড় গুণী ছেলে । তবু তার মন সায় দেয় না। মন্ত্রী এবার বুদ্ধি দিল, চাষির ছেলেকে মেরে ফেলতে হবে। মন্ত্রী বলল, ‘ওগো চাষির ছেলে, সুদূর ঝরনার জল এনেছ তুমি নিমিষে। কী বলে যে জানাই তোমায় ধন্যবাদ। রাজপ্রাসাদের নিজস্ব মাঠে তোমায় দেয়া হবে অভিষেক ।
সবাই মিলে চলল ওরা মাঠে। গিয়ে দেখে এ কী! না আছে শামিয়ানা । না আছে ফুলের মালা। না আছে তোরণ। শুধু রাজার সৈন্যরা কসরত করছে। চাষির ছেলে বুঝে ফেলল, তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। বোতলঅলা আর দেরি করল না। হুউশ করে ছাড়া শুরু করল সে বোতলের পানি। সেকেন্ডে একশো মাইল বেগে ছুটছে পানি। যেন বান ডেকে যাবে দেশে। সৈন্যরা যে যেদিকে পারল দিল দৌড়। পানির তোড়ে কেউকেউ একশো মাইল দূরে ভেসে গেল।
রাজা আর মন্ত্রী তড়িঘড়ি ছুটে গেল।
বাঁচাও! বাঁচাও!! রক্ষা কর আমাদের '।বোতলঅলা মুখ বন্ধ করল ।
অমনি রাজ্য জুড়ে আনন্দের ঢল বইল ।
রাজকন্যে খুশিতে ডগমগ । সাত-সাত চোদ্দদিন বয়ে গেল খানাপিনার ঢল ।
চাষির ছেলে বসল সিংহাসনে। ওর সারাক্ষণের সঙ্গী— একপেয়ে, চোখ-বন্ধ আর বোতলঅলা ।
এখন, রাজকন্যে যখন-তখন হাসে আর সেই হাসিতে রাজপ্রাসাদ করে আলো ঝলমল ।

বনের ধারে ছোট্ট একটি ঘর । সেখানে থাকে সাতটি ছাগলছানা আর তাদের মা। ছাগলছানারা নেচে গেয়ে ঘুরে বেড়ায় । গান গায় চিকন সুরে । যা পায় তাই খায়...

বনের ধারে ছোট্ট একটি ঘর ।
সেখানে থাকে সাতটি ছাগলছানা আর তাদের মা। ছাগলছানারা নেচে গেয়ে ঘুরে বেড়ায় । গান গায় চিকন সুরে । যা পায় তাই খায়। মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে যায় দূরের বনে ।
একদিন ছাগল-মা বলল, আমি আজ কাজে বের হচ্ছি। যাব বেশ দূরেই। ফেরার সময় তোমাদের জন্য নিয়ে আসব ভালো ভালো খাবার |
তাই না শুনে ছাগলছানারা খুব খুশি ।
মা বলল, কিন্তু বাছারা— একটা কথা । দিনকাল ভালো নেই। তোমরা কিন্তু ঘর থেকে বেরুবে না একদম । কোথায় কোন বিপদ ঘটবে কেউ তা বলতে পারে না।’
‘তা হলে আমরা কী করব? জানতে চাইল ছাগলছানারা ।
দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে খেলাধুলা করবে। আমি ছাড়া অন্য কেউ এলে ভুলেও দরজা খুলবে না।’
এই না বলে ছাগল-মা রওনা দিল নিজের কাজে ।
কিন্তু সেই বনে ছিল দুষ্ট পাজি বদমেজাজি এক নেকড়ে। যেমন তার হাঁকডাক তেমন তার তেজ । সারাক্ষণ হুমহুম, সবার ওপর করে জুলুম । নেকড়ে অনেকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিল, কী করে ছাগলছানাদের সাবাড় করা যায়।
ছাগল-মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই নেকড়ে বুঝল, এইতো সুযোগ । নেকড়ে পা টিপে টিপে এল ছোট্ট ঘরের সামনে । দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নাক উচু করে শ্বাস টানল ।
আহা, চনমনিয়ে উঠল নেকড়ের খিদে ৷
তখন সে ছাগল-মা'র মতো গলার স্বর নকল করে ডাক দিতে লাগল। তবু তা শুনেই ছাগলছানারা বুঝে গেল, এটা তাদের মায়ের ডাক নয়।
তুমি আমাদের মা নও। আমাদের মায়ের ডাক আরও মিষ্টি । আরও চিকন । নেকড়ে টের পেল, সে ধরা পড়ে গিয়েছে। মন খারাপ করে সে গেল এক বুড়ো ভালুকের কাছে ।
ভালুক ভায়া, ভালুক ভায়া— আমায় একটু মধু দেবে? ভালুকের মধু খেয়ে, গলাটাকে আরও নরম করে নেকড়ে গেল আবার ছাগলছানাদের কাছে। এবার তার কণ্ঠটা ভারি নরম, ভারি চিকন ।
বাছারা, দরজা খোল, আমি তোমাদের মা এসেছি।’ ছাগলছানারা বুঝল, সত্যি বুঝি ওদের মা এসেছে। বড় জন জানালার খড়খড়ি তুলে যেই না তাকিয়েছে বাইরে, অমনি দেখে কালো কালো লোমশ দুটি থাবা। জলদি করে বন্ধ করে দিল সে জানালা । তারপর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘তুমি আমাদের মা নও। আমাদের মায়ের পায়ে বড় বড় লোম নেই।’
এই না শুনে নেকড়ে একেবারে চুপ মেরে গেল। তাই বলে নিরাশ হলে চলবে না। আবার সে নতুন ফন্দি আঁটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে গেল সে এক নাপিতের বাড়ি । ---
নাপিত ভায়া, নাপিত ভায়া— ক্ষুর দিয়ে আমার পায়ের লোমগুলো একটু চেছে দাও না ভাই ।”
নাপিত বেচারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে খুব তাড়াতাড়ি নেকড়ের লোম সাফ করে দিল ।
এইবারে নেকড়ে খুব মনের আনন্দে হেলেদুলে এল সেই ছোট্ট ঘরের সামনে । খুব ধীরে ধীরে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তারপর নরম সুরে বলল, বাছারা, শিগগির দরজা খোল । আমি তোমাদের মা এসেছি।’
ছাগলছানারা ভাবল, সত্যি তাদের মা এসেছে। জানালা খুলে পায়ের দিকে দেখল, এই পা ওদের মায়ের পা । তারপর দরজা খুলল তারা । নেকড়ে তখন হুংকার দিয়ে ঢুকল ভেতরে। ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার শুরু করল ছাগলছানারা । 'বাঁচাও! বাচাও!” কেউ লুকাল টেবিলের তলায়। কেউ লুকাল চেয়ারের পাশে । কেউ গেল চুলোর ধারে । কেউ লুকাল খাটের তলায়। কেউ গেল বালিশের পাশে । নেকড়ের চোখে তখন লোভের আগুন জ্বলছে জ্বলজ্বল করে।
এক-একজনকে ধরে, আর কপাত করে গিলে খায় । মনের আনন্দে টেকুর তোলে। এইভাবে ঝটপট ছয়জনকে সাবাড় করে ফেলল নিমেষে। সবচেয়ে ছোট্ট যে ছাগলছানাটি সে লুকিয়ে ছিল বালিশের পাশে । নেকড়ে তাকে আর
খুঁজে পেল না।
ছয়জনকে সাবাড় করে নেকড়ের তখন ভরাপেট । প্রাণ করে আইঢাই, কোথায়
যাই কোথায় যাই। কিছুদূর হাটতেই নেকড়ে টের পেল শরীর যেন আর চলে না। চোখ জুড়ে নেমে আসছে ঘুম ।
নেকড়ে একটা বটগাছের ছায়ায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপরই সে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
ওদিকে বিকেলবেলা ছাগল-মা ফিরল কাজ সেরে । দরজা খোলা দেখেই আঁতকে উঠল। সর্বনাশ! বিপদ ঘটে গেছে। ঘরে ঢুকেই ছাগল-মা পাগলের মতো এদিকে ছোটে, ওদিকে ছোটে। নেই, কোথাও কেউ নেই। তখন কুইকুই করে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এল ছোট্ট ছাগলছানা ।
মা-কে খুলে বলল সব ঘটনা। আর মায়ের কোলের পাশে বসে তিরতির করে কাঁপতে লাগল ভয়ে। ছাগল-মা খুব বুদ্ধিমতী । মাথা ঠাণ্ডা রেখে সে ঘর থেকে বেরুল নেকড়ের খোঁজে। কিছুদূর গিয়েই দেখল, চিৎপটাং হয়ে মনের সুখে গাছের তলায় ঘুমুচ্ছে নেকড়ে শয়তানটা। ছাগল-মা তার পাশে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। নেকড়ের পেটের মধ্যে কান দিতেই ছাগল-মা শুনতে পেল ছাগলছানাদের নড়াচড়ার শব্দ । মায়ের মন তখন খুশি হয়ে উঠল। তখনই ঘরে ফিরে সে ছুরি আর সুই সুতো নিয়ে আবার গেল নেকড়ের কাছে। ছুরি দিয়ে নেকড়ের পেট চিরল ধীরে ধীরে। পেটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল ছয়টি ছাগলছানা। ওরা কেউ মরেনি। কারণ নেকড়ে ওদের গিলে খেয়েছিল। ছাগলছানারা নতুন জীবন ফিরে পেয়েই নাচতে লাগল তিড়িং বিড়িং।
ছাগল-মা বলল, শিগগির তোরা পাথরের টুকরো নিয়ে আয়।’
তারপর তারা সবাই মিলে পাথরের টুকরো ভরল নেকড়ের পেটে । ছাগল-মা খুব সুন্দরভাবে পেটটা সেলাই করে দিল। নেকড়ের কিছুই বুঝবার কোনো উপায়ই রইল না ।
ছাগল-মা ফিরে এল আপন ঘরে । ছানাদের নিয়ে একসঙ্গে খেতে বসল মনের আনন্দে |
আর নেকড়ের সেই ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। হাই তুলে নেকড়ে যখন চোখ মেলেছে, দেখে চারদিকে কেমন অন্ধকার। আর পিপাসায় যেন কলজে ফেটে যাচ্ছে। কোনোমতে সে উঠে দাঁড়াল। পেট যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভারী মনে হচ্ছে। কোনোমতে টলতে টলতে নেকড়ে গেল নদীর ধারে ।
আর যেই না সে নেমেছে পানিতে আমনি পেটের পাথরের ওজনের তাল সামলাতে পারল না বেচারা । অত ওজন নিয়ে তলিয়ে গেল পানির গভীরে ।
ছাগলছানারা তারপরে, লতাপাতা খেয়ে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বড় হতে লাগল নিশ্চিন্ত মনে ।

ভালুকের সঙ্গে দেখা হল এক ছোট্ট খরগোশের । কোনোকিছু না বলেই খরগোশের কান মলে দিল ভালুক । আহ' বলে চেঁচিয়ে উঠল খরগোশ । দু-গালে দুটো থাপ্পড় ...

ভালুকের সঙ্গে দেখা হল এক ছোট্ট খরগোশের । কোনোকিছু না বলেই খরগোশের কান মলে দিল ভালুক ।
আহ' বলে চেঁচিয়ে উঠল খরগোশ । দু-গালে দুটো থাপ্পড় মেরে চলে গেল ভালুক। শক্তির বড়াই তার উপচে পড়ছে। খরগোশ কাঁদছে আর কাঁদছে। কানের ব্যথা মিলিয়ে গেল। তবু তার কান্না থামে না। এখন সে কী করবে? কেন সে ভালুকের সামনে পড়ল? তার কান বুঝি নষ্টই হয়ে গেছে! সাহায্যের জন্য কার কাছে সে যাবে? ভালুক অনেক শক্তিশালী। নেকড়ে আর শেয়ালও ভালুকের বন্ধু ।
আপন মনেই খরগোশ বলে ফেলল, ‘কে আমাকে সাহায্য করবে?’
কে একজন জবাবও দিল, “আমি করব।” বাঁ চোখের পানি মুছতে মুছতে খরগোশ দেখল, একটা মশা ।
‘তুমি কীভাবে সাহায্য করবে? ভালুককে কিছুই করতে পারবে না। সে অনেক বড়, তুমি অনেক ছোট। তোমার তেমন শক্তিও নেই।’
মশা জবাব দিল, দেখই না।’ ভালুক সারাদিন গহন বনের এমাথা-ওমাথা ঘুরে বেড়াল। সে খুব ক্লান্ত । সন্ধেবেলায় তার দু-চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম । গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে ঝোপঝাড়ে আরাম করে শুয়ে পড়ল সে। যেই না তার চোখ বুজে এসেছে আমনি কানের পাশে বেজে উঠল পুন... পুন... ।
ভালুক জানে, এটা মশার গান। শ্বাস বন্ধ করে ভালুক চুপচাপ পড়ে রইল । মশা নাকের ডগায় বসলেই মজা দেখাবে। মাথার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মশা ঠিকই নাকের ডগায় বসল। থাবা দিয়ে ভালুক নিজের নাকে নিজেই থাপ্পড় মারল । মশা ততক্ষণে পালিয়ে গেছে ভো করে। ভালুক ডানদিকে কাত হয়ে আবার চোখ বুজল। সবে ঘুম এসেছে, আবার সেই পুনপুনানি । সময়মতো মশা এসে হাজির হয়েছে। ভালুক আবারও শ্বাস বন্ধ করল। ভাব দেখাল যেন সে ঘুমুচ্ছে । কান খাড়া করে মশার পুনপুন শুনছে ভালুক । কখন এসে মশা তার নাকে বসবে এই তার চিন্তা ।

মশার পুনপুন শব্দ হঠাৎ থেমে গেল। যাক বাচা গেল, ভাবল ভালুক। কিন্তু ততক্ষণে মশাটা ধীরে ধীরে ভালুকের কানে গিয়ে বসেছে। সর্বশক্তি দিয়ে বসিয়েছে এক কামড়। ভালুক লাফিয়ে উঠল। দু-থাবা দিয়ে ঘষতে লাগল কান। চোখে সরষে ফুল দেখল।
কান চুলকিয়ে চোখেমুখে হাঁচি দিয়ে ফের আরাম করে শুল সে । ঘুমঘুম আবেশে দু-চোখ তার বুজে এসেছে। কিন্তু সেই সময়ই কানের কাছে বেজে উঠল সেই একই গান, পুন... পুন। ভালুক গা ঝেড়ে উঠে বসল। অসহ্য এই যন্ত্রণা। চারদিকে মশা যেন ফাঁদ পেতে রেখেছে। আর সময় নষ্ট নয় । হাটতে শুরু করল ভালুক । ঝোপঝাড় পেরিয়ে চলল সে। কিন্তু পোড়া কপাল, মশা তার পিছু ছাড়ল না।
ভালুক দৌডুতে শুরু করল এবার। যতক্ষণ না সে ক্লান্ত হল, ততক্ষণ দৌডুল। তারপর এক ঝোপের ধারে বসল। জোরে শ্বাস দিতে নিতে কান চুলকাল বার কয়েক ।
জায়গাটা খুব নিরিবিলি। অন্ধকার । সব পশুপাখি ঘুমুচ্ছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। জোছনায় ভাসছে বন । শুধু একা জেগে রয়েছে ভালুক। খুব খারাপ লাগছে তার। কী যে হল!
নিজে নিজেই গজগজ করল সে । বেয়াদব মশাটা একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ল দেখছি। আগে একটু ঘুমিয়ে নিই। তারপর ধরব মশাটা।
ভালুক এক দেবদারু গাছে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমোল। চোখ বেয়ে নেমে এল রাজ্যের অন্ধকার। স্বপ্ন দেখতে শুরু করল সে : সারা বনে সে একা। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পেল এক মৌচাক । মধুতে ভরা। হাতের মুঠোয় সবে সে মৌচাক ধরেছে। অমনি পুন... পুন... সেই গান ভেসে এল ।
আবার ছোট্ট মশা এসে আরামের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল। জেগে উঠে ভারি রাগ হল ভালুকের। মাথার উপর চক্কর দিয়ে গান গাইছে তখন সেই মশা। কখনো কাছে, কখনো দূরে।
গানের সুরে সুরে মশা উপরে উঠতে লাগল। একসময় থামল সেই গান। ভালুক ভাবল, যাক রেহাই পেলাম। সে সরে গিয়ে ঝোপে ঢুকে ঘুমের সুযোগ খুঁজল ।
তক্ষুনি শুরু হল অনবরত কামড়। নাকে চোখে মুখে সে কী যন্ত্রনা। কামড়ে কামড়ে জ্বলে উঠেছে ভালুকের পা। অসহ্য জ্বালা। ‘বাঁচাও, বাঁচাও, চিৎকার করে কাঁদতে লাগল বেচারা ভালুক। সারা রাত দু’চোখের পাতা একবারও এক করতে পারল না সে।
‘হে মশা, কী অপরাধ আমার? তোমার কামড়ানো দয়াকরে বন্ধ কর। একমুহূর্তে আমার আর বেঁচে থাকতে মন চাচ্ছে না।’
সূর্য না ওঠা পর্যন্ত মশা জ্বালাতন করল।
একমুহূর্তে ঘুমোতে পারল না ভালুক। মুখচোখ তার ফুলে উঠেছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।
সূর্য উঠল। সারারাত আরামে ঘুমিয়ে জেগে উঠল বনের পশুপাখি। তারা সবাই গান গাইছে আনন্দে। সারা বনে কিচিরমিচির। ভালুক শুধু একা এই নতুন দিনের আনন্দে যোগ দিতে পারছে না।

সাত সকালে সেই খরগোশের সঙ্গে ভালুকের দেখা। একা একা হাঁটছে ভালুক, পা টলছে তার। কুব কষ্ট করে সে চোখের পাতা খুলে রখেছে। না ঘুমিয়ে শরীর তার ভারী হয়ে রয়েছে।

খরগোশ তাই দেখে মিটিমিটি হাসল। শক্তি বেড়াই দেখিয়েছিল ভালুক। উচিৎ সাজা পেয়েছে এখন। এমন সময় এল সেই মশা।
খরগোশ বলল, “ধন্যবাদ মশা ভাই, কী দিয়ে যে আপ্যায়ন করব!”
মশা মুখ টিপে হাসল, “ভালুকের অবস্থা তো দেখলে। আহা বেচারা!”
“দেখছি। কী যে হাসি পাচ্ছে আমার।” খরগোশ হাসতে হাসতে এলিয়ে পড়ল।
‘দেখলে তো? ছোট আর দুর্বল হয়েছি বলে কী হবে, বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে কীরকম নাস্তানাবুদ করলাম ভালুককে!’
বলেই মশা উড়ে গেল। আর ছড়িয়ে দিল তার গানের রেশ, পুন্‌... পুন্‌...।

খেঁকশেয়াল দেখেছ? কেমন ছাই ছাই বাদামি রঙের একটা লেজ রয়েছে ওদের । চোখ দুটো জুলজুলে, ইতিউতি তাকায়। যেন সব বোঝে। ভারি চালাক । কিন্তু খেকশেয়া...

খেঁকশেয়াল দেখেছ?
কেমন ছাই ছাই বাদামি রঙের একটা লেজ রয়েছে ওদের । চোখ দুটো জুলজুলে, ইতিউতি তাকায়। যেন সব বোঝে। ভারি চালাক ।
কিন্তু খেকশেয়ালের লেজ একসময় বাদামি ছিল না। ছিল একেবারে টকটকে লাল । কী করে লেজের রং পাল্টে গেল সে গল্পটাই শোনাই তোমাদের ।
ছিল একটা গহিন বন । দিনের সূর্যের আলো পৌছায় না সেই বনে। ঘন সবুজ পাতায় ছাওয়া গাছপালা সেখানে | বাতাস বইলে শিরশির শব্দ শোনা যায় । সেই বনের ধারে থাকত এক বুড়ি । খুনখুনে সত্তুরে বুড়ি । সাত কুলে কেউ নেই তার । কারো সাত-পাঁচে থাকত না সে । তার ছিল সাতটা শুওরছানা আর সাতটা মুরগি । আদর দিয়ে, যত্ন দিয়ে লালন-পালন করত সে তাদের। বুড়ির বয়স যত বাড়ে কাজের শক্তিও তত কমে। শুওরছানা আর মুরগিদের তেমনভাবে লালন-পালনও করতে পারে না ।
লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়ি তাই একদিন গেল একজন জোয়ান তাগড়া লোকের কাছে। তাকে বলল, ভাইরে, পোষা মুরগি আর শুওরছানাদের দেখাশোনা করতে পারি না। তুমি কি আমার সাহায্য করবে?
লোকটা বলল, কিন্তু আমার হাতে যে একেবারে সময় নেই। অনেক যে কাজ আমার | কী করে তা করব??
বুড়ি মন খারাপ করে গেল আরেক জনের কাছে। সে-ও একই কথা বলল । শেষে কী আর করবে বুড়ি? গেল সে ভালুকভায়ার কাছে। নাদুস-নুদুস বাদামি রঙের ভালুকভায়া। চোখ দুটো পিটপিটে । যেন সে খুবই নিরীহ আর গোবেচারা। বুড়ি বলল, ভালুকভায়া, তুমি কি এদের ভার নেবে?’
ভালুকভায়া তো এক কথাতেই রাজি । শুওর আর মুরগি– দুটোই তার প্রিয় খাবার। মনের আনন্দে সে রাজি। বুড়ি তখন বলল, কিন্তু তুমি কি ওদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে?
‘কেন করব না? নিশ্চয়ই করব । আমি গরব... গরব... বলে ওদের ডাকব ।’ 
'নাহে ভাই, তোমার ওই গুরুগম্ভীর ডাক শুনে আমার আদরের ছানারা একেবারে ভড়কে যাবে। তোমার কাছে রাখা যাবে না ওদের ' বলেই বুড়ি কেটে পড়ল ভালুকের কাছে।
এবারে বুড়ি গেল নেকড়ে বাঘের কাছে। প্রস্তাব শুনে নেকড়ের জিব দিয়ে পানি গড়াতে লাগল। এ তো একেবারে মেঘ না চাইতেই জল ।
লোভে তার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতে লাগল। সে-ও এক কথাতেই রাজি ।
বুড়ি নেকড়ের কাছেও জানতে চাইল, ‘তুমি কীভাবে দেখাশোনা করবে আমার আদরের শুওরছানা আর মুরগিদের?
নেকড়ে বলল, আমি ওদের আদর করব । সময়মতো খাবার দেব। আর ওঁউ ওঁউ ওঁউ বলে ডাকব ।’
নাহে এমনটি করলে চলবে না। তাতে আমার আদরের পশুপাখিরা ভয় পেয়ে যাবে। আর ওরা যদি ভয়ই পেয়ে যায় তবে তোমার কাছে ওদের রেখে যাব কেন?’
বিদায় নিল বুড়ি। এবারে সে গেল খেঁকশেয়ালের কাছে। খেঁকশেয়াল কিন্তু দারুণ বুদ্ধিমান। সে মন দিয়ে বুড়ির সব কথা শুনল। ভালো-মন্দ মন্তব্য করল না কোনো !
বুড়ি শুধাল, ‘তুমি আমার পশুদের আদর-যত্ন করবে তো ভাই?’ নিশ্চয়ই আদর করব।” 
কী বলে ডাকবে তুমি ওদের?
খেঁকশেয়াল তখন জানাল, খুবই আদর করে ডাকব । বলব আমার ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা কাছে আস। তোমাদের জন্য অনেক অনেক খাবার এনে রেখেছি।
খেঁকশেয়ালের কথায় ভারি খুশি হল বুড়ি। একেবারে মনের মতো সঙ্গী পাওয়া গেছে। বুড়ি খেঁকশেয়ালকে নিয়ে এল নিজের বাড়িতে। তার প্রিয় মুরগি আর শুওরছানার দেখাশোনার ভার দিল তাকে ।
দিন যায়। রাত আসে ।
রাত পেরিয়ে আবার আসে দিন ।
খেঁকশেয়াল প্রতিদিন মুরগি আর শুওরছানাদের সময়মতো খাবার দেয়। পানি দেয়। যত্ন-আত্তিরে কোনো ক্রটি করে না। রাতে ঠিকমতো খোয়াড়ে শোয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এতে ধীরে ধীরে মুরগি আর শুওরছানাদের গায়ে-গতরে চেকনাই বাড়তে লাগল।
বুড়ি তো দারুণ খুশি ।
সত্যি খেঁকশেয়ালের প্রশংসা না করে উপায় নেই ।
একদিন হঠাৎ করেই বুড়ি কালো শুওরছানাটার খোজ করল । না, ওকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ।
‘ওগো খেঁকশেয়াল, কোথায় গেল আমার কালো শুওরছানাটা?’
‘কোথাও না, বুড়িমা। ছানাটা দূরের বনে ঘুরতে গেছে। তবে চিন্তার কিছু নেই। খুব তাড়াতাড়ি ও ফিরে আসবে।’
কিন্তু শুওরছানাটা আর ফিরে এল না ।
এইভাবে আরেকদিন । বুড়ির আদরের লাল বুটিঅলা মোরগটাকেও পাওয়া গেল না |
এই কথা খেঁকশেয়ালকে জিগ্যেস করতেই সে চটপট জবাব দিল, “মোরগটা নদীর ওপারে বেড়াতে গেছে। এখুনি ফিরে আসবে।
কিন্তু সেই মোরগটাও ফিরে এল না।
বুড়ি তখন মহা ভাবনায় পড়ে গেল ।
চিন্তায় চিন্তায় তার রাতে আর ঘুম আসে না । সে তাই মুরগির ঘরে গেল রাতদুপুরে। সঙ্গে নিল একবাটি দুধ।
ঘরের পাশে আসতেই বুড়ির চক্ষু চড়কগাছ। মুরগিগুলো চিৎকার, চেঁচামেচি করছে। ঘরের চারদিকে তারা ছটফট করে ছুটে বেড়াচ্ছে। ভয়ানক শব্দ শোনা যাচ্ছে— কোঁকর কোঁ , কোঁকর কোঁ ।
খোয়াড়ের জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখে– খেঁকশিয়াল একটা মুরগিকে মুখে পুরে বেশ হেলতে দুলতে হেলতে দুলতে ফিরে আসছে। বুড়ির কাছে তখন সব পরিষ্কার হয়ে গেল— কীভাবে তার শুওরছানা আর মোরগটা হারিয়ে গেছে । রাগে বুড়ির তখন মাথা গরম হয়ে গেল। কি? এত বড় দুঃসাহস!
হাতের গরম দুধের পাত্রটা বুড়ি ছুড়ে মারল খেঁকশেয়ালের দিকে । গরম দুধের ছ্যাকা লেগে খেঁকশেয়াল তখন মুরগি রেখেই দে চম্পট | একদৌড়ে প্রাণের ভয়ে
তারপর শুরু হল লেজের জুলুনি। দুধ গিয়ে পড়েছিল তার লেজে। এতে তার লাল লেজের গোড়াটা ধূসর, ছাই-ছাই রঙা হয়ে গিয়েছিল এরই মধ্যেই।
এই ঘটনার পর থেকে খেঁকশেয়ালের লেজটি হয়ে গেল ছাইরঙা । অন্যেরা তার লেজ দেখিয়ে তখন বলতে শুরু করছে :
"দেখ, দেখ, দুষ্টু খেঁকশেয়ালের কাণ্ড দেখ! লেজের অবস্থা কী হয়েছে। যেমন দুষ্টু ঠিক তেমনই সাজা!"

কতদিন আগের গল্প এটা তা ঠিকমতো আমিও জানি না। তবে অনেক দিন আগের কাহিনী। যখন জাদু করত লোকে, পশুপাখিরা কথা বলত, আর আজগুবি আজগুবি ঘটনা ঘটত গল্পে—...

কতদিন আগের গল্প এটা তা ঠিকমতো আমিও জানি না। তবে অনেক দিন আগের কাহিনী। যখন জাদু করত লোকে, পশুপাখিরা কথা বলত, আর আজগুবি আজগুবি ঘটনা ঘটত গল্পে— সে যুগের গল্প এটা।
এক গ্রামে বাস করত এক বুড়ো-বুড়ি। ভারি গরিব তারা। একবেলা খায় তো, আরেকবেলা উপোস থাকে। পরনে তাদের শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়। তাদের ছিল তিন ছেলে। তারা কাজ খুঁজে খুঁজে হয়রান। কাজ পেত না তাই অভাবও ঘুচত না ।
বড় ছেলেটি প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়ে যেত। সারাদিন কাজ খুঁজত । সন্ধ্যাবেলা নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরত । মেজো ছেলেটি বনে যেত। পাখি শিকারের জন্য হাওরে-বাওড়ে ঘুরে বেড়াত সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত । কাজ হত না কিছুই ।
ছোটটি ছিল বেশ ছোট। সে সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকত। আর চুলোর সামনে বসে বসে আগুন নিয়ে খেলা করত। আগুনের উত্তাপ ভালোবাসত সে ।
এইভাবে কষ্টে কষ্টে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে । একদিন সকালের নাশতা খেতে না পেয়ে বড়ভাইয়ের মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেল। এইভাবে জীবন চলতে পারে না ।
জেদ করে বুড়োবুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে । কাজের সন্ধান তাকে করতেই হবে। নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়ে নিতে হবে ।
ঘুরতে ঘুরতে গ্রাম ছাড়িয়ে সে এসে পৌছাল শহরে। খুঁজে বের করল সে রাজপ্রাসাদ । তারপর দেখা করল রাজার সঙ্গে | রাজা তাকে জিগ্যেস করলেন :
‘কী চাই তোমার?
আমরা খুব গরিব । একটা কাজের দরকার আমার । যে কোনো ধরনের একটা কাজ হলেই চলবে ।’
রাজা বললেন, আমার সাতটা সুন্দর ঘোড়া আছে। তুমি যদি একদিন আমার ঘোড়াদের সাথে থাকতে পার, ঘোড়াগুলো কোথায় যায়, কী করে, কী খায় এসব দেখতে পার তাহলেই তোমার চাকরি হয়ে যাবে রাজপ্রাসাদে। যদি সারাদিনের সঠিক তথ্য সন্ধ্যাবেলায় আমাকে দিতে পার তবে তবে আমি রাজকন্যের সঙ্গে বিয়ে দেব তোমার। আর অর্ধেক রাজত্ব পাবে তুমি । আর যদি কাজটা না পার তবে চাবুক মেরে তোমার পিঠের চামড়া তুলে নেয়া হবে। এতে কি তুমি রাজি?
বড় ছেলেটি ভাবল, এ আর এমন কঠিন কী কাজ? সে রাজি হল । পরদিন সকালবেলা তার কাজের শুরু । আস্তাবল থেকে সাতটি ঘোড়াকে ছেড়ে দেয়া হল । যেই না ছেড়ে দেয়া অমনি ঘোড়া সাতটা টগবগ টগবগ করে
ছুটতে শুরু করল।
হায় রে ছোটা!
ধুলো উড়িয়ে নিমেষেই ওরা শহর ছাড়িয়ে ছুটতে লাগল ফাঁকা মাঠ ধরে। ছেলেটিও ছোটা শুরু করল ঘোড়াদের সঙ্গে। ছুটে কি পারা যায়! কিছুক্ষণ পরেই ছেলেটি হাঁপিয়ে উঠল। ক্লান্তিতে জিভ বেরিয়ে গেল তার। আমনি দেখে, সামনে এক পাহাড়। সেখানে এক গুহায় বসে রয়েছে শনের মতো সাদা চুলের এক বুড়ি । গায়ের চামড়া কুঞ্চিত । কোটরে বসা দু-চোখ বুড়ি হাত নেড়ে নেড়ে ছেলেটিকে ডাকল ।
আহা আমার সোনার ছেলে, ছুটতে ছুটতে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে। এস ভাই, এস। আমার এখানে বসে একটু জিরিয়ে নাও । পানি খাও । আর ওইভাবে ঘোড়ার পিছনে ছোটার কী দরকার! সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে বসে জিরোও । ঘোড়াগুলো ফিরবে যখন এই পথ দিয়ে তখন তুমি না হয় ওদের সঙ্গেই ফিরে যাবে '

ছেলেটি বলল, কিন্তু ঘোড়াদের সঙ্গে আমার কাজ রয়েছে যে! 
‘কী আর এমন কাজ? 
‘আমাকে জানাতে হবে ঘোড়াগুলো সারাদিন কী খায়।’ 
বুড়ি ফোকলা মুখে হাসতে হাসতে বলল, “এ আর এমন কঠিন কী কাজ! সে আমি বলে দেব ?
ছেলেটি ভাবল, তাহলে আর মিছামিছি কষ্ট করা কেন! সে গিয়ে গুহার এককোণে আরাম করে বসল। ছুটতে ছুটতে তার জান পেরেশান হয়ে গেছে। 
বুড়ি বলল, তুমি নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নিতে থাক। সন্ধ্যাবেলা ঘোড়াগুলো এই পথ দিয়েই ফিরবে। তখন তুমিও ওদের সঙ্গে ফিরে যাবে।'
‘তোমাকে কিন্তু বলে দিতে হবে ঘোড়াগুলো সারাদিনে কী খায়! নইলে কিন্তু আমার পিঠের চামড়া তুলে নেয়া হবে।’
‘সে ভাবনা তোমার নয়। আমি ঠিকঠিক তোমাকে বলে দেব | ছেলেটি মহাখুশি । শরীর এলিয়ে দিয়ে সে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ল। সন্ধ্যার আবিরমাখা আকাশ যখন লাল হয়ে উঠল তখন ঘোড়াগুলো ফিরে এল। 
বুড়ি জানাল, ‘এখন তুমি ফিরে যাও । রাজা যখন জিগ্যেস করবেন ঘোড়াগুলো কী খেয়েছে তখন তুমি বলবে, সারাদিন ওরা শ্যাওলা আর পানি খেয়েছে।”
ঘোড়াগুলোর সঙ্গে আবার ছুটতে ছুটতে ছেলেটি ফিরে এল রাজপ্রাসাদে । রাজা জিগ্যেস করলেন, "ওহে যুবক, সারাদিন ঠিকমতো দেখাশুনা করেছিলে তো ঘোড়াগুলো?
জি, জাঁহাপনা।’ বল দেখি, ওরা সারাদিন কী খেয়েছে? 
‘রাজামশাই, ওরা শ্যাওলা খেয়েছে।’ 
রাজা বুঝতে পারলেন, ছেলেটি মিথ্যে বলছে। কারণ এই ঘোড়ারা কখনই শ্যাওলা খাবে না । -
রাজা হুকুম দিলেন, ‘এই মিথ্যুকটার পিঠে চাবুক মার।’ পিঠে চাবুকের দগদগে ঘা নিয়ে ছেলেটি মাথা নিচু করে ফিরে গেল নিজের বাড়িতে |
সব ঘটনা মেজো ছেলে শুনে বলল, “আমি যাব রাজপ্রাসাদে । তার বুড়ো বাবা-মা রাজি হতে চান না। কিন্তু ছেলেটি নাছোড় । সে যাবেই । রাজপ্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা করল । রাজা তাকেও সেই ঘোড়া দেখাশুনার কাজ দিলেন ।

সাতটা ঘোড়াকে মাত্র একদিন দেখাশুনা করতে হবে। সারাদিন তারা কী কী খায় বলতে পারলে অর্ধেক রাজত্ব দেয়া হবে আর রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে হবে। যদি না পার তবে চাবুকের বাড়ি।’
মেজো ছেলে সানন্দে রাজি হল এই প্রস্তাবে । পরদিন সকালে। আকাশ আলো করে যখন সূর্য উঠল তখন সাতটা অবাধ্য ঘোড়ার পিছনে ছুটতে লাগল মেজো ছেলে। ছুটতে ছুটতে তারও যায় যায় অবস্থা । হাট পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে শহর ছাড়িয়ে সেই পাহাড়ের পাশে গিয়ে যখন ঘোড়াগুলো যাচ্ছে তখন দেখা হল সেই ফোকলা দাঁতের থুথুরে বুড়ির সঙ্গে ।ক্লান্ত-শ্রান্ত মেজো ছেলে বিশ্রাম নেয়ার লোভে বুড়ির কাছেই কাটিয়ে দিল সারাদিন। সন্ধ্যাবেলায় ঘোড়াগুলো যখন ফিরে এল বুড়ি তখন একমুঠো শ্যাওলা দিয়ে বলল, রাজা যখন জিগ্যেস করবেন ঘোড়াগুলো কী খেয়েছে তখন তুমি এগুলো দেখিও ’
মেজো ছেলে আনন্দে ফিরে এল। কিন্তু রাজামশাই দু-একটা প্রশ্ন করেই বুঝে গেলেন এই ছেলেটাও মিথ্যে বলছে। বড় ভাইয়ের মতো তাকেও বরাদ্দ করা হল চাবুকের তিন ঘা ৷
পিঠে চাবুকের দাগ নিয়ে মেজো ছেলেও ফিরে এল ব্যর্থ হয়ে । কাজ জুটল না। সংসারের অভাবও ঘুচল না। তখন ছোট্ট ছেলেটি বলল, সে একবার চেষ্টা করে দেখতে চায় |
বুড়ো-বুড়ি বললেন, না, আর কোনো দরকার নেই। শুধু শুধু তুমি গিয়ে কষ্ট করবে কেন?’
বড় দুইভাইও রাজি নয়। ছোটভাইয়ের যাওয়ার কোনো মানেই নেই। তারা হাসতে হাসতে বলল, হাতি ঘোড়া গেল তল; মশা বলে কত জল । আমরাই কিছু করতে পারলাম না। আর তুমি তো কোন ছার! তার চেয়ে বরং খেলাধুলা কর গে, তাতেই তোমাকে মানাবে ভালো।’
কিন্তু ছোটভাই নাছোড়বান্দা। তার জেদ চেপে গেল। কাউকে কিছু না বলে একদিন সে চুপিচুপি রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে যাত্রা করল।
রাজার সঙ্গে দেখাও হল তার। রাজা যখন শুনলেন আগের দু-জনের ছোটভাই সে, তখন কিছুতেই তার চাকরি হয় না। বড় দুইজনই পারেনি। ছোটটা পারবে কী করে? কিন্তু ছেলেটি খুবই একগুঁয়ে আর নাছোড়বান্দা। রাজার কাছে সে বারবার মিনতি করল, আমি একবারের জন্য চেষ্টা করতে চাই। আমাকে যদি একটু সুযোগ দেয়া হয় তবেই নিজেকে ধন্য মনে করব।”

রাজা রাজি হলেন কিন্তু শর্তগুলো বুঝিয়ে দিলেন বারবার। পরদিন ভোরে সূর্য যখন উঠিউঠি— ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দেয়া হল আস্তাবল থেকে। অমনি ঘোড়াগুলো দারুণ বেগে টগবগিয়ে ছুটতে শুরু করল। জেদি ছোটভাইও জানপ্রাণ দিয়ে ছুটতে লাগল ঘোড়ার পেছনে পেছনে। ঘোড়াগুলো যেন তার চোখের আড়াল না হয় এই তার ব্ৰত ।
ঘোড়া ছুটছে। ছেলেটিও ছুটছে। ছুটতে ছুটতে একসময় এল সেই পাহাড়ের পাশে, গুহায় বসে বুড়ি তখনও চরকা কাটছে। বুড়ি ছেলেটিকে দেখতে পেয়েই আদর করে কাছে ডাকল। কিন্তু ছোটভাইয়ের সে সব শোনার সময় কোথায়? ক্লান্তিতে পা জড়িয়ে এলেও থামল না সে একমুহূর্ত।
বুড়ির কথা কানেই ধরল না তার। বরং সে একটা ঘোড়ার লেজ ধরে ছুটতেই লাগল।
কিন্তু এই ছোটার কি শেষ হবে না? কত পথ মাঠ ঘাট পেরিয়ে, পাহাড়-বন অরণ্য ছাড়িয়ে ঘোড়াগুলো ছুটেই চলেছে। বড় একটা পাহাড় পেরিয়ে যেতেই সবচেয়ে ছোট্ট ঘোড়াটা ছেলেটিকে বলল, আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর কত ছুটবে? এরচেয়ে বরং এস আমার পিঠে বস ’ ছোটভাই খুশি হয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল। এখন আর ভাবনা কী! সাতটি ঘোড়া ছুটে চলেছে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে। চিলচিলে নদীর মতো বিছানো সরু পথ পথ যেন আর ফুরায় না। যেতে যেতে যেতে—
ছোট্ট ঘোড়াটি ছোটভাইকে শুধাল, সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছ? ছোটভাই বলল, 'না, তেমন কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না!
হ্যাঁ, বিরাট একটা গাছ দেখতে পাচ্ছি।’ ঠিক । সেই গাছটার ভেতরেই এবার আমরা ঢুকব।' গাছটার সামনে এসে বড় ঘোড়াটা দাঁড়াল। তারপর চিঁহি চিঁহি করে দুটো ডাক দিতেই গাছটা নড়েচড়ে উঠল । কী আশ্চর্য! দেখা গেল, গাছের ভেতরে ঢোকার একটা দরজা রয়েছে। কারুকাজ করা সুন্দর একটি দরজা। সেই দরজা দিয়ে ঘোড়াগুলো অনায়াসে ভেতরে ঢুকে গেল ! ঢুকতেই দেখল, একটা বিরাট বড় ঘর। সেই ঘরের এককোণে পড়ে আছে একটা ঝা চকচকে তলোয়ার আর একটা সোনার কলসি।

ছোট্ট ঘোড়াটা ছোটভাইকে তখন বলল, মাটি থেকে এই তলোয়ারটা তুলে তোমার কাছে রাখ ।
ছোটভাই তলোয়ারটা তোলার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু কাজ হল না। তলোয়ারটা ভীষণ ভারী। তখন ঘোড়াটা বলল, ‘সোনার কলসিতে পানি আছে, তুমি সেই পানি খেয়ে নাও। তাহলে অনেক শক্তি হবে, তখন অনায়াসে তলোয়ারটা ওঠাতে পারবে।’
সত্যি সত্যি তাই হল । ছোটভাই তলোয়ারটা নিজের কাছে রাখল। তখন সবচেয়ে বড় ঘোড়াটা বলল, তুমিই পারবে আমাদের উদ্ধার করতে। এই তলোয়ারটা খুব যত্নে রাখবে নিজের কাছে। তোমার সঙ্গে যখন রাজকন্যার বিয়ে হবে তখন তুমি আমাদের সাতটি ঘোড়ার মাথা কেটে ফেলবে। তারপর সাতটি মাথাই আবার সাতজনের গলার পাশে ঠিক ঠিক রেখে দিতে হবে। তবেই আমরা মুক্তি পাব জাদুকরের মায়াজাল থেকে। আমরা আসলে কিন্তু ঘোড়া নই। আমরা সাতজন রাজপুত্র। এক জাদুকরের অভিশাপে আমাদের এই অবস্থা। চল এবার, আমরা কী খাই সেটা তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি ৷”
তারপর সাতটা ঘোড়াই ছুটতে লাগল বেদম বেগে । ছুটতে ছুটতে তারা এল পাহাড়ঘেড়া ছোট্ট গির্জার কাছে। গির্জার ভেতরে ঢুকতেই ঘোড়াগুলো মিলিয়ে গেল। পরিণত হল সাতটি সুন্দর রাজপুত্রে।
ছোট ভাইটিও ওদের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল। একজন বৃদ্ধ পাদ্রি এলেন। হাতে তার রুটি আর মদ । তিনি রাজপুত্রদেরকে তাই খেতে দিলেন। ছোটভাইও একটুকরো রুটি আর একপাত্র মদ নিয়ে রাজপুত্রদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করল। তারা একটু-আধটু গল্পগুজবও করল।
এখন ফেরার সময় | রাজপুত্ররা গির্জার সীমানা পেরুতেই আবার রূপান্তরিত হল সাতটি ঘোড়ায়। ছোটভাই সবচেয়ে ছোট্ট ঘোড়ার পিঠে চাপল । এবার সাতটি ঘোড়া ছুটে চলল বাতাসের বেগে ৷ পাহাড়-নদী-বন পেরিয়ে ঘোড়াগুলো নিমেষেই যেন সেই পাহাড়ের গুহার কাছে এসে পড়ল। ফোকলাবুড়ি তখনও সেখানে চরকা কাটছে। ছোটভাইটিকে দেখে বুড়ি রাগ করে কী যেন বলল। কিন্তু সেদিকে কান দেবার কোনোই সময় নেই কারও ৷
রাজপ্রাসাদে ফিরতেই রাজা ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘোড়াগুলো সারাদিন কী কী খেয়েছে?’
ছোট ভাই তখন একটুকরো রুটি আর মদের পাত্র দেখাল ।
রাজা টের পেলেন, এই সেই যোগ্য ছেলে । তিনি তখন খুশিতে আত্মহারা।
ধুমধামে বিয়ে হল তার। কিন্তু ছোটভাইটি ভুলে যায়নি ঘোড়াদের কথা। বিয়ের রাতেই তলোয়ার হাতে নিয়ে সে গেল আস্তাবলে । তারপর একেক কোপে ঘোড়াগুলোর মাথা কেটে ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখল প্রত্যেকের শরীরের পাশে । কিছুক্ষণেই ঘোড়াগুলোর বদলে সাতজন অনিন্দ্যসুন্দর রাজপুত্র তাদের রূপ ফিরে পেল। সাত ছেলেকে ফিরে পেয়ে রাজা-রাণী খুশিতে প্রায় আত্মহারা হয়ে গেলেন। রাজ্য জুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। রাজকন্যাও ভাইদের ফিরে পেয়ে মহাখুশি । আনন্দে সে একবার হাসে। একবার কাঁদে । আর ছোট ছেলেটিকে সে মহা ভালোবেসে ফেলল।
রাজা অর্ধেক রাজত্ব দিলেন ছেলেটিকে ।
ছেলেটি তখন খুশিতে প্রায় মূৰ্ছা যায়। তার বুড়ো বাবা-মা আর দুইভাইকে নিয়ে এল রাজপ্রাসাদে ।
তারপর শুরু হল সুখের জীবন।

এক ছিল গ্রাম । ছায়াঘেরা, মায়াঘেরা পাহাড়ের কোলে ছোট্ট সেই গ্রামটি একেবারে ছবির মতো । সেই গ্রামে থাকে এক দুঃখী বুড়ি-মা আর তার আদরের ধন ছোট্ট ...

এক ছিল গ্রাম ।
ছায়াঘেরা, মায়াঘেরা পাহাড়ের কোলে ছোট্ট সেই গ্রামটি একেবারে ছবির মতো । সেই গ্রামে থাকে এক দুঃখী বুড়ি-মা আর তার আদরের ধন ছোট্ট একটি ছেলে। মা-ছেলেতে কাজ করে। টেনেটুনে সংসার চলে। এক. বেলা ভালো খায় তো আরেক বেলা উপোস থাকে ।
একদিন মা বলল, বাছা, ঘরে একটুখানি আটা আছে। তাই নিয়ে এস। রুটি তৈরি করব ?
ছেলেটি মায়ের কথা শুনে ভারি খুশি হয়ে উঠল । গরম গরম রুটি খেতে ভারি মজা । সে দৌড়ে গেল ভেতরের ঘরে । একটি বড়বাটিতে করে আটা নিয়ে যেই না ছুটে আসতে লাগল মায়ের কাছে অমনি উঠোনের মধ্যে শো করে তেড়ে এল দুষ্টু বাতাস । হালকা ঝড়ের মতো সেই বাতাস এক ফুয়ে সব আটা উড়িয়ে নিয়ে গেল। তাই দেখে ছেলেটি হতভম্ব ।
আবার সে গেল ভেতরের ঘরে ।
নিয়ে এল আরেক বাটি আটা। ঝড়ো বাতাস আবার শো করে উড়ে এসে এক ফুয়ে সবটুকু আটা উড়িয়ে নিয়ে গেল ।
ঘরে আর কোনো আটা ছিল না।
ছেলেটির ভারি মন খারাপ হয়ে গেল। রুটি বানানো আর হল না। রাগে-কষ্টে সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। মাকে বলল, মা, দেখলে তো কী কাণ্ডটা ঘটল । ঝড়ো বাতাস আমাদের সবটুকু আটাই উড়িয়ে নিয়ে গেল । ঝড়ো বাতাসকে আমি ছেড়ে দেব না। ওকে আমি দেখে নেব।”
রাগে গটমট করতে করতে ছেলেটি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ঝড়ো বাতাসকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে । একমনে সে হাঁটতে লাগল। দিন পেরিয়ে রাত এল । রাত পেরিয়ে সকাল এল। হাট পেরুল, মাঠ পেরুল। পাহাড়-নদী-বন পেরিয়ে শেষমেষ ছেলেটির সঙ্গে দেখা হল ঝড়ো বাতাসের ।
ঝড়ো বাতাস সারাক্ষণই মাতোয়ারা। একমুহূর্তও সুস্থির থাকতে পারে না বেচারা। ফোস ফোস করে কথা বলে। আর একটু পরপর প্রবল বেগে গর্জন করে।
ছেলেটিকে দেখেই রাগে জ্বলে উঠল ঝড়ো বাতাস। শো শো শব্দ করতে করতে বলল, “কোথেকে এসেছ তুমি? কী চাই তোমার? 
ছেলেটি বলল, কিছুই চাই না আমি । আমি শুধু আমার আটা ফেরত চাই।’ 
‘আটা মানে, কিসের আটা? যে আটা তুমি হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়েছ সেই আটা।’ ছেলেটির কথা শুনে ঝড়ো বাতাস হো হো করে হেসে উঠল। তোমার আটা কোথায় উড়ে গেছে, সে কি আর আমিই ঠিকমতো জানি। সেই আটা ফেরত পাবে কী করে?”
তাহলে আমি রুটি খাব কোথেকে? আমার যে খুব খিদে পায়। আটা না থাকলে রুটি বানাব কেমন করে?
‘তোমার কি রুটি খাওয়ার খুব ইচ্ছে? 
‘হ্যাঁ।’ 
‘তা হলে এই নাও একটা থালা । তোমাকে দিলাম।” 
‘থালা নিয়ে আমি কী করব?’ 
"সেটাই তো মজা। থালাটা নিয়ে সামনে রাখবে। তারপর মনে মনে বলবে :

থালা থালা জাদুর থালা 
দিলাম তোমায় ছুটি 
খেতে আমার ইচ্ছে করে 
গরম গরম রুটি ।

অমনি দেখবে তোমার সামনে থালাভর্তি রুটি এসে হাজির হবে। তখন তুমি মনের সুখে রুটি খাবে। যতবার ইচ্ছা ততবার তুমি রুটি খেতে পারবে।’
এ রকম একটা জাদুর থালা পেয়ে ছেলেটা মহাখুশি । আনন্দে বাকুমবুকুম। ছুটল সে বাড়ির দিকে । মাকে গিয়ে এক্ষুনি এই জাদুর থালার তেলেসমাতি দেখাতে হবে । ছুটতে ছুটতে পথে ঘন রাত্রি নেমে এল । চারপাশে অন্ধকার ।
ঠিকমতো কিছুই দেখা যায় না। সামনেই সে দেখতে পেল ভাঙাচোরা একটা বাড়ি। দেয়াল জুড়ে বড় বড় বট-বৃক্ষের ডালপালা। বিজন বনের এই বাড়িতে কোনো মানুষ থাকে কি? রাতটুকু কোনোমতে কাটিয়ে দেবে ভেবে ছেলেটি সেই পোড়োবাড়িতে প্রবেশ করল । ভেতরে ঢুকতেই দেখা হল এক লোকের সঙ্গে। ভয়ানক চেহারা তার। মাথায় জটাবাঁধা চুল। লাল দুটো চোখ । আর একেবারে পেটানো শরীর। লোকটা আসলে খুব ভালো লোক নয়। সে ছিল ডাকাত ।
ছেলেটি তাকে বলল, ভাই বিপদে পড়ে এখানে এসেছি। রাতটুকু কাটাবার জন্য আমি একটু আশ্রয় চাচ্ছি।
‘এখানে থাকতে পার তুমি । তবে ভাই খেতে-টেতে দিতে পারব না।’ 
‘সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। নিজের খাবার আমি নিজেই জোগাড় করে নিতে পারি ?
ছেলেটি তখন থালাটা বের করল তার থলে থেকে । মনে মনে বলতে লাগল :

থালা থালা জাদুর থালা 
দিলাম তোমায় ছুটি 
খেতে আমার ইচ্ছে করে 
গরম গরম রুটি ।

অমনি থালাভর্তি খাবার এসে হাজির । শুধু রুটি নয়, রুটির সঙ্গে খাওয়ার মতো হালুয়া, ফলমূল, মিষ্টি কত কী খেয়ে আর শেষ হয় না।
দুজনেই পেট ভরে খেল । তারপর মনের সুখে ঘুমিয়ে পড়ল। ডাকাত কিন্তু চোখ বন্ধ করে রইল। সে ঘুমাল না। থালার জাদুকরি ক্ষমতা দেখে তার চোখ কপালে উঠেছে। কী করে থালাটা চুরি করা যায়– এই চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে লাগল। ভোরবেলা সে আসল থালাটা চুরি করে একই রকম আরেকটা থালা ছেলেটির থলের মধ্যে রেখে দিল ।
পরদিন মনের আনন্দে ছেলেটি বাড়িতে পৌছল। তার মনে আনন্দ আর ধরে না। মাকে বলল, মা, মা, এই দেখ জাদুর থালা নিয়ে এসেছি আমি । ঝড়ো বাতাস আমাকে এই থালাটা দিয়েছে। এই থালার কাছে যা খেতে চাইবে তাই-ই পাবে।'
মা বললেন, না দেখলে বিশ্বাস করি কী করে বাবা?” ছেলেটি থালাটা সামনে নিয়ে মনে মনে মন্ত্র পড়তে লাগল।
কিন্তু নকল থালায় খানা আসবে কী করে? যতই মন্ত্র পড়ে কাজ হয় না কিছুই। ছেলেটি রাগে কাঁপতে লাগল ।
ঝড়ো বাতাস আমাকে ঠকিয়েছে। ঝড়ো বাতাস আমাকে ঠকিয়েছে। এবারে ঝড়ো বাতাসকে দেখে নেব।”
আবার দিনরাত হেঁটে, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে, পাহাড়-নদী পেরিয়ে ছেলেটি গিয়ে পৌছল ঝড়ো বাতাসের কাছে ।
আবার কী চাও তুমি?
‘একখানা অকেজো থালা দিয়ে ঠকিয়েছ তুমি । এই থালায় একদানা খাবারও পাওয়া যায় না । আমার আটাই আমাকে ফেরত দাও।”
ঝড়ো বাতাস বলল, আটা তো পড়ে গেছে। সেই আটা তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। তার বদলে একটা ছাগল দিলাম তোমাকে ছাগলের সামনে
শুধু মনে মনে বলবে :

ছাগলছানা ছাগলছানা 
তাক ধিনা ধিন তানা তানা 
বুদ্ধি তোমার টন টন 
টাকা ঝরুক ঝন ঝন ।

অমনি ছাগলের মুখ দিয়ে ঝনঝন করে টাকা ঝরবে। সেই টাকা দিয়ে যা খুশি তাই কিনে খেয়ো তুমি ।
ছেলেটি মহাখুশি হয়ে ছাগলটাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। এবারও রাত হয়ে এলে সে ডাকাতের বাড়ি গেল রাতটুকু কাটাবার জন্যে ।
ডাকাত এবার বলল,— রাত কাটাতে হলে আমাকে টাকা দিতে হবে। টাকা দাও, রাত কাটাও ’
ছেলেটি জবাবে বলল, টাকা কোনো ব্যাপার নয়।’
ছাগলটাকে সামনে এনে সে মনে মনে বলতে লাগল :

তাক ধিনা ধিন তানা তানা
ছাগলছানা ছাগলছানা 
বুদ্ধি তোমার টন টন 
টাকা ঝরুক ঝনঝন ।

অমনি ঝনঝন করে টাকা ঝরতে লাগল। তাই না দেখে ডাকাত খুবই খুশি ।
ছেলেটি ক্লান্ত শরীরে ধুপ করে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দু-চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম । ডাকাত কিন্তু ঘুমাল না। সে বুদ্ধি বের করতে লাগল— কী করে ছাগলটাকে চুরি করা যায়।
সে আগের মতোই গভীর রাতে অন্য একটি ছাগল রেখে দিল ছেলেটির পাশে । আসল ছাগলটাকে সে চুরি করে নিল ।
পরদিন বাড়ি পৌঁছেই ছেলেটি মাকে ডেকে আনল। আনন্দে-উচ্ছাসে তার আকুপাকু অবস্থা।
মা, মা । এই দেখ ঝড়ো বাতাস দারুণ একটা ছাগল উপহার দিয়েছে আমাকে । এর কাছে টাকা চাইলেই টাকা পাওয়া যায়। তাই দিয়ে যত খুশি খাবার কিনে খাব |’
মা মৃদুস্বরে বললেন, কোনো কিছুই সহজে বিশ্বাস করতে পারি না বাবা। না দেখলে বিশ্বাস করি কীভাবে?’
ছেলেটি বলল “এই দেখই না মজা ।" যতই মন্ত্র পড়ে কাজ হয় না। নকল ছাগল টাকা দেবে কী করে? তার মুখ দিয়ে একটা টাকাও পড়ল না। ছেলেটি রাগে গরগর করতে লাগল।
ঝড়ো বাতাস এবারও ঠকিয়েছে আমাকে । আমি আবার যাব তার কাছে। গিয়ে বলব, কী এমন দোষ করেছি আমি যে, আমায় তুমি ঠকাচ্ছ?
পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে ছেলেটি গেল ঝড়ো বাতাসের কাছে। বাতাস তো তাকে দেখেই ভয়ংকর রেগে উঠল।
‘আবার এসেছ তুমি? কী চাই তোমার? 
কিছু চাই না আমি । বারবার তুমি আমায় ঠকাচ্ছ। তুমি আমায় পচা ছাগল দিয়েছ। একটা ফুটো পয়সাও পাওয়া যায় না তার কাছে।’
ঝড়ো বাতাস তখন কাতরভাবে বলল, কিন্তু তোমাকে দেয়ার মতো কিছুই যে নেই আমার । একটা শুধু লাঠি আছে। সেটাই তুমি নিয়ে যাও । আর মন্ত্রটা হচ্ছে :

তাক কুড় কুড় তাক 
তাক কুড় কুড় তাক
মুণ্ডুটা দুই ফাঁক ।

ব্যস্– অমনি চোর-ডাকাতের মাথায় বেদম লাঠির আঘাত পড়তে থাকবে। আর যখন বলা হবে :

আয় রে লাঠি ফিরে আয় 
দুষ্ট লোকে শাস্তি পায়।

তখন লাঠির আঘাত বন্ধ হবে । লাঠি আবার ফিরে আসবে তোমার হাতে ।
ছেলেটি মনের আনন্দে লাঠি নিয়ে বাড়ির পথে চলল। পথ চলতে চলতে আবার সন্ধ্যা নেমে এল । ছেলেটি এবারও ডাকাতের বাড়িতে আশ্রয় নিল । হাতে একটা সুন্দর লাঠি দেখে ডাকাতের খুব লোভ হল। ভাবল, বোকাটার কাছ থেকে থালা আর ছাগলছানা হাতিয়ে নেয়া গেছে। এখন লাঠিটা নিতে পারলেই হয়। ডাকাত মোলায়েম সুরে বলল,— ‘এস, এস বন্ধু। তুমি তো আমার চেনা অতিথি । যখন ইচ্ছে তুমি আসবে। খাবে, ঘুমাবে।'
ভরপেট খাওয়াদাওয়া করল দু-জনে। তারপর ঘুমাতে গেল ঢেঁকুর তুলতে তুলতে। এবার ছেলেটি কিন্তু ঘুমাল না। ঘুমের ভান করে পড়ে রইল চুপচাপ ।
ডাকাত গভীর রাতে পা টিপে টিপে এগিয়ে এল ছেলেটির পাশে । তারপর চোরের মতো সে হাত বাড়াল লাঠিটার দিকে । আমনি ছেলেটি বলল :

তাক কুড় কুড় তাক 
তাক কুড় কুড় তাক 
লাঠির ঘায়ে চোর ডাকাতের 
মুণ্ডুটা দুই ফাঁক ।

বনবন করে লাঠি ঘুরতে লাগল। লাঠির আঘাত পড়তে লাগল ডাকাতের মাথায় । মাথা ফেটে দুই ফাঁক। ডাকাত বেচারা তখন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগল ।
‘বাবাগো, মাগো, বাঁচাও, বাঁচাও । তোমার পায়ে পড়ি। আমি মরে গেলাম গো । বাঁচাও আমাকে '
ছেলেটি তখন বলল, তুমি আমার লাঠি চুরি করেছ। নিশ্চয়ই তুমি আমার থালা আর ছাগলছানাও চুরি করেছ, শিগগির ওগুলো ফেরত দাও।”
“এখুনি, এখুনি আমি সব ফেরত দিচ্ছি। বাবাগো, বাঁচাও আমায় । মেরে ফেল না আমাকে ৷”
ছেলেটির তখন লাঠির আঘাত থামানোর মন্ত্র পড়ল :

আয় রে লাঠি ফিরে আয় 
দুষ্ট লোকে শাস্তি পায়।

অমনি লাঠি ফিরে এল ছেলেটির হাতে। ডাকাত তখন প্রাণের ভয়ে থালা আর ছাগলটাকে এনে হাজির করল ছেলেটির সামনে ।
ছেলেটি তখন মহাখুশি। খুশিতে ডগমগ হয়ে রওনা দিল বাড়ির পথে । হাতে লাঠি, সাথে ছাগল আর থালা ।
সবকিছু পেয়ে মায়ের মুখে হাসি ফুটল । সবচেয়ে বড় কথা, মা আর ছেলের জীবন ভরে উঠল অনেক অনেক সুখ আর শান্তিতে |

এক ছিল মেয়ে । দেখতে ভারি সুন্দর। একেবারে পুতুলের মতো। ঠিক যেন এক রাজকন্যে। কিন্তু মেয়েটি ছিল কুঁড়ের হদ্দ । সে কোনোই কাজ করত না । তার বাবা...

এক ছিল মেয়ে । দেখতে ভারি সুন্দর। একেবারে পুতুলের মতো। ঠিক যেন এক রাজকন্যে। কিন্তু মেয়েটি ছিল কুঁড়ের হদ্দ । সে কোনোই কাজ করত না ।
তার বাবা-মা ছিল তাঁতি । -
সারাদিন তারা চরকা ঘুরিয়ে সুতো কাটত। তারপর সেই সুতো নিয়ে হাটে বেচত ।
সুতো থেকে কাপড় বানানো হয়। কাপড় দিয়ে তৈরি হয় নানারকমের পোশাক । কিন্তু মেয়েটি তো ভীষণ কুঁড়ে! সে একেবারেই সুতো কাটত না । মা-বাবা তাকে কত করে বলত। সে কোনো কথাতেই কান দিত না। শুয়ে-বসে ঘুমিয়ে সময় কাটাত। কাজকর্ম তার একেবারেই ভালো লাগত না ।
মেয়ের অলসতা দেখে মা-বাবা মহাবিরক্ত। আদর করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোনো কাজ হয় না। একদিন সুতো না কাটার জন্য মা তাকে খুব করে বকাঝকা করলেন ।
‘তুই কেন এত অলস মুখপুড়ি। কেন তুই কাজ করতে চাস না।’ মায়ের বকুনি শুনে মেয়েটি ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল । তারপর সে কী তার চিৎকার! গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করল মেয়েটি। ঠিক অমনি সময় ওই পথ ধরেই সাত ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে রাণীমা যাচ্ছিলেন। রাণীমা মানে একেবারে সত্যিকারের রাণী । তার কানে গিয়ে আঘাত করল মেয়েটির কান্না ।
রাণীমা কান পাতলেন। তারপর গাড়োয়ানদের বললেন, ‘গাড়ি থামাও ।
রাণীমা গাড়ি থামিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন । ঢুকতেই দেখা হল, মেয়েটির মায়ের সঙ্গে। কী ব্যাপার? এই বাড়িতে কান্নার শব্দ কেন?’
রাণীকে দেখে মা তো অবাক!
‘আমার মেয়ে কাঁদছে রাণীমা ।”
‘কেন তোমার মেয়ে কাঁদে?’
মা এখন কী জবাব দেবে? মেয়ে যে তার বেজায় কুঁড়ে— এই কথা কি রাণীকে বলা যায়? হাজার হলেও সে যে মা ; মা কি কখনো মেয়ের বদনাম করতে পারে! রাণীকে তাই মা বলল, রাণীমা, আমার মেয়ে খুব গুণী মেয়ে। চরকায় সারাদিন সে সুতো কাটতে পারে। রাতদিন সুতো কাটতে চায়। কিন্তু অত সুতো কাটবার মতো তুলো আমরা কোথায় পাব? আমরা বড্ড গরিব । অত পয়সা কোথায় আমাদের? তাই ওকে বকা দিয়েছি।”
রাণী সব শুনে বললেন, ‘বাহ, তোমার মেয়ে তো দারুণ কাজের মেয়ে। আমিও সুতো কাটতে খুবই ভালোবাসি। কাজের মেয়েদের আমি খুবই ভালোবাসি। তোমার মেয়েকে আমি রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেতে চাই। এ রকম কাজের মেয়েই
তো আমার দরকার। ওকে অনেক সুতো দেব। একটা ভালো চরকা দেব। মনের আনন্দে মেয়েটি সুতো কাটবে।
মেয়ের মা মনে মনে খুব খুশি । যাক রাজবাড়িতে গিয়ে মেয়ে যদি কাজের হয়! মেয়েটি কিন্তু রাণীর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। তার মুখচোখ শুকিয়ে একেবারে সাদা চুন।
রাণীমা মেয়েটির ওজর-আপত্তি কিছুই শুনলেন না। মেয়েটিকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন রাজপ্রাসাদে। তাকে একটা বিরাট ঘরের মধ্যে রাখা হল। এত বড় ঘর যে, এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত কিছুই দেখা যায় না। ঘরে শুধু পাঁজা পাঁজা তুলো। আর রয়েছে চমৎকার একটা চরকা । হাতল ধরলেই ঘরঘর করে ঘুরতে থাকে। রাণী বললেন, ‘এই যে কাজের মেয়ে, তুমি মনের খুশিতে যত পার সুতো কাট । এই রইল তুলো, এই রইল চরকা। এই তুলো দিয়ে সব সুতো তুমি যদি তিনদিনের মধ্যে কেটে ফেলতে পার তবে মেনে নেব যে তোমার মতো গুণী মেয়ে এই রাজ্যে নেই। আমার ছেলের জন্য একটা গুণী মেয়েই খুঁজছিলাম। সুতো কাটা হয়ে গেলে তোমার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দেব মহা-ধুমধামে । আমার ছেলে কে জান তো? এই রাজ্যের যুবরাজ !
সেই বিশাল ঘরে মেয়েটিকে একলা রেখে রাণীমা চলে গেলেন । মেয়েটি তখন হাপুস নয়নে একা একা কান্না শুরু করল । কারণ সুতো কাটা তার একেবারেই অপছন্দ। এত সুতো সে কোনোদিনই কেটে শেষ করতে পারবে না। এ কথা সে খুব ভালোমতোই জানে।
কাঁদতে কাঁদতে তার একদিন গেল। দু-দিন গেল। না খেল খাবার, না খেল পানি। কাঁদতে কাঁদতে বেচারা নাজেহাল । চোখ ফুলে ঢোল। মুখ একদম ফ্যাকাসে ।
তিনদিনের দিন কাঁদতেও আর ভালো লাগছে না বেচারার। বন্দি ঘরে গভীর হতাশায় ভরে গেল তার মন । জানালা খুলে তাকাল খানিক বাইরে । আলোয় ঝকমক করছে বাইরটা। রাজপ্রাসাদ বলে খুবই নিরিবিলি। কোথাও যেন জনমনিষ্যির সাড়া নেই।
হঠাৎ করেই মেয়েটি দেখল, তিনটে বুড়ি যেন রাস্তা দিয়ে ঠকঠক করে হেঁটে আসছে। আকারে তারা ছোটখাটো । তোবড়ানো গাল আর হোদল কুতকুতে চোখ। দেখতে-শুনতে একেবারেই ভালো নয়। তারা ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়াল জানালার সামনেই । মেয়েটি অবাক হয়ে দেখল, তিনজনের মধ্যে একজনের ঠোঁট ঝুলে পড়েছে গলা পর্যন্ত। আরেকজনের হাত দুটো একেবারে মাটি ছুঁইছুঁই। মুখে তাদের খুনখুনে হাসি ।
মেয়েটিকে দেখে তারা একসঙ্গে তিনজনে বলে উঠল, ওগো লক্ষ্মী মেয়ে, কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?’
মেয়েটি বুড়িদের কথা শুনে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। কী হয়েছে মেয়ে তোমার? আমাদের খুলে বল। এইভাবে কাঁদছ কেন? মেয়েটি তখন চোখের পানি মুছতে মুছতে সব বলল। তাই শুনে তিন বুড়ি হেসে ফেলল। বড় বড় বেঢপ হাত-পা নাচাতে নাচাতে তারা বলল, “এই কথা । এটা কোনো বিপদ হল? এ ব্যাপার নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। আমরা তোমাকে সাহায্য করব । দেখবে, কত দ্রুত কী সুন্দর সুতো কেটে দিতে পারি আমরা। তবে একটি শর্ত আছে।’ মেয়েটি ভয়ে ভয়ে শুধাল, কী সেই শর্ত?’
‘তোমার যখন বিয়ে হবে তখন আমাদের নেমন্তন করতে হবে। আর সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে এই বলে যে, আমরা তোমার দূরসম্পৰ্কীয় বোন। অন্য সবার সঙ্গে যে রকম হেসে ভালো ব্যবহার করবে আমাদের সঙ্গেও সেরকম ব্যবহার করতে হবে । কি? শর্তে রাজি আছ?”

মেয়েটি মাথা নেড়ে জানাল, রাজি। বুড়িরা খুনখুন করতে করতে বলল, ঠিক তো?”
ঠিক, ঠিক, ঠিক ? ‘বাহ। তাহলে দরজা খুলে দাও । আমরা তিনজন ভেতরে আসব।' মেয়েটি কপাট খুলে দিল । তিন বুড়ি ঢুকল সেই বিরাট বড় ঘরে ।
তারপর তুলো নিয়ে তারা নাড়াচাড়া করতে লাগল। আর নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে হাসতে লাগল। অবাক ব্যাপার!
কিুঁক্ষণের মধ্যেই সব সুতো কাটা হয়ে গেল । সুন্দর সরু ফিনফিনে সুতো । তিনদিন পরে রানি এলেন ঘরে। কেমন সুতো কাটা হচ্ছে তাই দেখতে । মেয়েটি ঝটপট তিন বুড়িকে লুকিয়ে রাখল সুতোর আড়ালে। রাণীমাকে স্বাগত জানাল হাসিমুখে ।
মিহি সুতোর বুনন দেখে রাণীমা তো মহাখুশি। বারবার নেড়েচেড়ে মসৃণ সুতোগুলো দেখতে লাগলেন। দারুণ। সত্যিই তুমি অপূর্ব সুতো কাটতে পার। তোমার গুণের প্রশংসা না করে উপায় নেই। তোমার সঙ্গেই আমার বড় ছেলের বিয়ে হবে।’
বিয়ের ঢাকঢোল বেজে উঠল। রাজ্য জুড়ে সাজো সাজো রব । বিয়ের আয়োজন চলতে লাগল। যুবরাজ একদিন দেখা করতে এলেন সেই মেয়েটির সঙ্গে। রূপ দেখে যুবরাজ মহাখুশি । এমন রূপবতী মেয়েকেই তিনি রাজরাণী বানাতে চেয়েছিলেন ।
মেয়েটি যুবরাজকে বলল,‘আমার বিয়েতে আমার দূরসম্পর্কীয় তিনবোনকে আমন্ত্রন জানাতে পারি নি?’
নিশ্চয়ই।’ শুভক্ষণে মেয়েটির সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে হয়ে গেল। রাজ্যের সকলেই নেমন্তন খেতে এল । মন ভরে দোয়া করল বর-কনেকে। রাজরাণীর রূপ দেখে সকলেই ধন্য ধন্য করতে লাগল। আর আজব রঙচঙে পোশাক পরে সেই তিন বুড়িও এল বিয়ের অনুষ্ঠানে ।
নতুন বউ অতিথিদের সঙ্গে তিন বুড়ির পরিচয় করিয়ে দিল । ‘এরা হচ্ছেন আমার বোন। খুব উপকারী বোন। এদের ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না ।"
মেয়ের কথা শুনে তিন বুড়ি তো দারুণ খুশি ।
যুবরাজ নতুন বউকে চুপিচুপি জিগ্যেস করল, আচ্ছা তুমি এত সুন্দরী । কিন্তু তোমার বোনরা দেখতে এত কুৎসিত কেন?
‘ওরাও এককালে আমার মতো সুন্দরী ছিল। চরকায় সুতো কাটতে কাটতে আজ ওদের এই অবস্থা।
তাই নাকি? তাহলে তো সুন্দরী বউ আমার, তোমাকে তো সুতো কাটতে দেয়া যাবে না ?
যুবরাজ তারপর গেল তিন বুড়ির সামনে । প্রথমজনকে জিগ্যেস করল, ওগো বুড়ি, তোমার পা এত বড় আর মোটা কেন? কী করে হল?
“দুঃখের কথা কী আর বলব যুবরাজ। চরকার চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে আমার পায়ের এই বেকায়দা অবস্থা। সুতো কাটা কি কম কঠিন কাজ?
যুবরাজ দ্বিতীয় জনকে শুধাল, তোমার নিচের ঠোঁটটা এমন গলা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে কেন?
“ঠোঁট কি আর একদিনে ঝুলে পড়েছে। সারাজীবন ধরে ঠোঁট দিয়ে সুতো আঁকড়ে ধরেছি। সুতো টানতে টানতেই ঠোটের আমার এই অবস্থা।'
এবারে যুবরাজ তৃতীয় জনকে বলল, তোমার হাতের অবস্থা এত ভয়ংকর কেন? হাত দুটো একেবারে ঝুলে পড়েছে।’
সারাজীবন এই হাত সুতো পাকাতে হয়েছে। আর সুতো পাকাতে প্রচণ্ড কষ্ট । মনে হয়— হাত যেন ছিড়ে যাচ্ছে ।
যুবরাজ তো তিন বুড়ির কথা শুনে একেবারে হতভম্ব। চোখ তার কপালে উঠল। সুতো কাটা হয়তো একটা গুণ। তাই বলে এত কষ্ট রাজরাণীকে মানাবে না।
তারপর বুড়ি তিনজন বলল, যুবরাজ বললে এখন হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে এককালে আমরা সুন্দরী ছিলাম। আমাদের রূপেও আলো জ্বলত। জীবনভর সুতো কেটে কেটে আজ আমাদের বেহাল অবস্থা। আজ আমরা হতকুচ্ছিত। আপনার সুন্দর বউও যদি সারাদিন সুতো কাটতে থাকে তারও একদিন আমাদের মতো অবস্থা হবে।’
যুবরাজ তখন কঠোর কণ্ঠে বললেন, না, আমার সুন্দরী বউ কোনোদিন চরকার সামনেই যাবে না। চিরদিন ওকে সুন্দরী থাকতে হবে।
এই কথা-না শুনে নতুন বউ মনে মনে খুব খুশি । সারাদিন বসে বসে সুতো কাটার মতো বিরক্তিকর কাজ করা তাকে দিয়ে একদম সম্ভব নয়। এই কাজ করতে তার একেবারেই ভালো লাগে না ।
নতুন রাণী আর সুতো কাটেননি। যুবরাজকে সঙ্গে নিয়ে পরম সুখে তার দিন কেটেছে।

ডাউনলোড করো ইপাব (Epub) ফাইল। আর ইন্টারনেট ছাড়াই মোবাইলে কিংবা ট্যাবলেটে বই পড়ো।