Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

ভূতের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

আর একটু হলেই বুলুটা বাস চাপা পড়ত। এমন অসাবধানে রাস্তা পার হয়— কথাটা বলল আমার ভাইঝি রীণা। বুলু ওর ক্লাসফ্রেন্ড। রীণার কাকু, কাজেই বুলুরও ...

আর একটু হলেই বুলুটা বাস চাপা পড়ত। এমন অসাবধানে রাস্তা পার হয়—

কথাটা বলল আমার ভাইঝি রীণা। বুলু ওর ক্লাসফ্রেন্ড। রীণার কাকু, কাজেই বুলুরও আমি কাকু। সম্প্রতি নেপাল ঘুরে এল। এখানে এসে এতক্ষণ বাড়ির সকলের কাছে নেপালের গল্প করছিল। আমি ছিলাম না। তাই আমার জন্যে একটুকরো স্লিপ রেখে গেছে।

স্লিপটা আমার হাতে দিতে দিতে রীণা গজগজ করল—এত অসাবধান মেয়েটা—এখুনি যে কী সর্বনাশ হত!

সে কথার উত্তর না দিয়ে আমি স্লিপটা পড়তে লাগলাম।

 

শ্ৰীচরণেষু কাকু,

নেপালে গিয়ে দুটো মজার জিনিস পেয়েছি। শিগগির একদিন চলে আসুন।…

সেদিনই বিকেলে অফিস-ফেরত বুলুদের বাড়ি গেলাম। বাইরে-ঘরেই ওকে পাওয়া গেল। ও তখন নেপালের ওপর লেখা কয়েকটা বই থেকে কী সব নোট করছিল, আমায় দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

তারপর একটুও দেরি না করে আমায় টেনে নিয়ে গিয়ে ওর কাচের আলমারির মধ্যে রাখা দুটো মজার জিনিসের একটা দেখাল।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম—এই তোমার মজার জিনিস?

ও খুব হাসতে লাগল।

মজার জিনিস নয়? এমন জিনিস ভূ-ভারতে কোথাও আর পাবেন?

তা বটে। জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা মড়ার খুলি। মড়ার খুলি তো অনেক দেখেছি কিন্তু এত ছোটো খুলি কখনো চোখে পড়েনি। খুলিটা স্বচ্ছন্দে হাতের মুঠোয় ধরা যায়।

কেমন? মজার জিনিস নয় ? বলে বুলু আবার হাসতে লাগল।

মজার কিনা জানি না, তবে অদ্ভুত।

এমনি সময়ে বুলুর মা চা-জলখাবার নিয়ে ঢুকলেন।

দেখুন দিকি মেয়ের কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড! শাড়ি গেল, ইম্পোরটেড ছাতা গেল, ক্যামেরা গেল— শেষ পর্যন্ত এই মড়ার খুলিটা ফুটপাথ থেকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনে আনল। আর তারপরেই কী বিপদ শুনেছেন তো? কাঠমাণ্ডু থেকে দক্ষিণাকালী দেখতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে একেবারে খাদে পড়ে যাচ্ছিল!

বুলুকে জিগ্যেস করলাম—এটা তো তোমার এক নম্বর মজার জিনিস, দু’নম্বরটি?

বুলু মুচকে একটু হাসল। বলল, সেটা আজ দেখানো যাবে না, যে কোনো মঙ্গল কি শুক্কুরবারে আসবেন।

বুলুর এই দুনম্বর মজার জিনিসটি যে আরো কত অদ্ভুত হতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না।

মঙ্গল কি শুক্কুরবার মনে নেই। একদিন সন্ধের সময়ে বুলুদের বাড়ি গিয়ে দরজায় কলিংবেল টিপলাম। কিন্তু তখনই কেউ দরজা খুলে দিল না। এরকম বড়ো একটা হয় না। শেষে বার তিনেক বেল টেপার পর—ওদের বাড়ি যে বুড়িমানুষটি কাজ করে—সে দরজা খুলে দিল।

কিন্তু ভেতরে ঢুকেই হতাশ হয়ে গেলাম। বুঝলাম বুলু নেই, বুলুর মাও নেই।

বুড়িকে জিগ্যেস করলাম—কেউ নেই?

ও মাথা দুলিয়ে জানাল আছে। বলে বাইরে-ঘরের পর্দাফেলা দরজাটা দেখিয়ে দিল।

যাক, বুলু তা হলে আছে। মনে করে পর্দা সরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই থমকে গেলাম। না, বুলু নয়। কেউ একজন কোচে গা এলিয়ে সামনের সেন্টার টেবিলের ওপর দু’পা তুলে বসে আছেন। পরনে ধবধবে পা-জামা, গায়ে গিলে করা আদির পাঞ্জাবি।

ইনি যে কে তা বোঝার উপায় নেই। কেননা তিনি একখানা খবরের কাগজ মুখের ওপর আড়াল করে রয়েছেন।

কি করব ভেবে না পেয়ে জুতোর শব্দ করে সামনের কোচটা একটু টেনে নিয়ে বসলাম। কিন্তু ভদ্রলোক কাগজ সরিয়ে একবার দেখলেনও না। এমনকি শ্রীচরণ দুখানিও আমার মুখের সামনে থেকে নামালেন না।

খুবই বিশ্ৰী লাগছিল। একবার ভাবলাম উঠে চলে যাই। কিন্তু এই অতি অদ্ভুত, অদৃষ্টপূর্ব অভদ্র লোকটিকে ভালো করে না জেনেও যেতে ইচ্ছে করছিল না। অগত্যা একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।

এমনি কতক্ষণ গেল, হঠাৎ চমকে উঠলাম।

আরে! ওটা কি ?

ভদ্রলোকের কোচের একপাশে কোনোরকমে একটা ম্যাগাজিন চাপা দেওয়া সেই মড়ার খুলিটা না?

ভালো করে দেখতে গিয়ে সেন্টার টেবিলটা নড়ে গেল। একটা বই পড়ে গেল। আর ঠিক তখনই—আঃ! কী সৌভাগ্য আমার! ভদ্রলোক কাগজখানি মুখের সামনে থেকে সরালেন। অমনি তার শ্রীচরণের মতো শ্ৰীমুখখানিও দেখতে পেলাম। ছুঁচলো মুখ। মাথাটা মুখের তুলনায় বড়ো। অনেকটা নারকেলের মতো। রুক্ষু চুলগুলো সেই মাথার ওপর ফেঁপে ফুলে উঠেছে। কিন্তু সরু গোপজোড়ার ভারী বাহার!

এও সহ্য করা যায়—কিন্তু এই রাত্তিরে কেউ যে কালো সানগ্লাস পরে থাকতে পারে তা যেন ভাবাই যায় না।

যাই হোক, ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তার গলায় যে রুদ্রাক্ষের মালা ছিল এটা এতক্ষণ নজরে আসেনি। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সামনে যে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন, সেদিকে লক্ষ্যমাত্র না করে ম্যাগাজিনের তলা থেকে খুলিটা নিয়ে বুলুর সেই আলমারিতে রেখে এলেন। যেন তিনি খুলিটা ভালো করে দেখতে নিয়েছিলেন, দেখার পর রেখে দিলেন আর কি।

বুলু কি আলমারিতে চাবি লাগিয়ে যায়নি? নাকি ওটা খোলাই থাকে?

জানি না।

ভদ্রলোক আবার নিজের জায়গায় গিয়ে মুখের ওপর কাগজ আড়াল করে বসলেন।

আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না। জিগ্যেস করলাম—বুলু কখন আসবে বলতে পারেন?

উত্তরে একটা গম্ভীর স্বর গলার মধ্যে ঘড় ঘড় করে উঠল—মিনিট তেরোর মধ্যে।

ও বাবা! ইনি যে আবার মিনিট-সেকেন্ড ধরে কথা বলেন! দশ মিনিটও নয়, পনেরো মিনিটও নয়—একেবারে তেরো মিনিট!

জিগ্যেস করলাম—ওর সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?

না।

দেখা হয়নি, বুলু কোথায় গেছে তাও বোধহয় জানেন না। অথচ তিনি বলতে পারেন—তেরো মিনিট পরে আসবে!

কত রকমের স্ক্রু-ঢিলে মানুষই না আছে!

একটু পরে উনিই আবার কথা বললেন—হ্যাঁ, আর আট মিনিটের মধ্যেই ওর এসে পড়া উচিত যদি না কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়।

অ্যাকসিডেন্ট !

হ্যাঁ। মানে দুর্ঘটনা।

আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনি অ্যাকসিডেন্টের ভয় পাচ্ছেন কেন?

উনি তেমনি করেই উত্তর দিলেন, অ্যাকসিডেন্টকে ও ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে এনেছে।

কিন্তু বুঝতে না পারলেও রীণার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে নাকি বাস চাপা পড়ছিল।

এমনি সময়ে কলিংবেল বাজল। তারপর আধ মিনিটের মধ্যে বুলু হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল।— ও মা, কাকু! কতক্ষণ এসেছেন?

আমি উত্তর দেবার আগেই ভদ্রলোক হঠাৎই উঠে পড়লেন।

বুলু বললে, এ কি মামা, এখুনি উঠছেন?

হ্যাঁ। তুমি একটু শুনে যেও।

বলে সামান্যতম ভদ্রতাটুকুও না দেখিয়ে প্রায় আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলেন।

বুলু ওকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল। মুখটা থমথম করছে। একটু চুপ করে থেকে বলল, উনি হঠাৎ অমন করে চলে গেলেন কেন বুঝলাম না। আপনার সঙ্গে বোধহয় ভালো করে কথাও বলেননি?

আমি একটু হাসলাম।

যাবার সময়ে আমাকে বললেন কি জানেন? বললেন, হয় ঐ খুলিটা এ ঘর থেকে সরাও, নয় যার-তার এ ঘরে ঢোকা বন্ধ করো। কথার মানে বুঝেছেন তো কাকু?

আমি আবার শুধু হাসলাম।

 

এই হচ্ছে নাকি বুলুর দু-নম্বর মজার জিনিস—বুলুর নতুন পাতানো মামা!

মামাটির সঙ্গে বুলুর আলাপ হয় নেপালের কাঠমাণ্ডুর একটা হোটেলে। তিনি বাঙালি। কলকাতাতেও যেমন তাঁর একটা আস্তানা আছে তেমনি আছে কাঠমাণ্ডুতেও। কিন্তু কাঠমাণ্ডুতে কোথায় যে পাকাপাকিভাবে থাকেন, কি করেন তা কেউ জানে না। মাঝে মাঝে এই হোটেলে তার দেখা পাওয়া যায়। এখানে তার পরিচয় একজন জ্যোতিষী বলে। মুখ দেখেই তিনি ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান বলে দিতে পারেন।

এই সূত্রেই বুলুর সঙ্গে তার আলাপ। হোটেলের সবাই ভিড় করে আসে তার ঘরে। শুধু বুলুই যায় না। সে এসব মোটে বিশ্বাস করে না। কিন্তু বুলু না গেলে কি হবে—ভদ্রলোক নিজেই একদিন ডাকলেন—ও মামণি! শোনো শোনো।

অগত্যা বুলুকে ঢুকতে হয়েছিল ওঁর ঘরে।

সবাই আসে, শুধু তুমিই আস না।

বুলু হেসে বলেছিল—আমি ওসব বিশ্বাস করি না।

ভদ্রলোক একটু হেসেছিলেন।

সেদিন ঐ পর্যন্ত ।

এরপর একদিন ভদ্রলোক বুলুকে একেবারে তাজ্জব করে দিলেন যখন বললেন, তোমার বাবার জন্যে কিছু ভেব না। তিনি ভালো আছেন। এই মাসের শেষেই তিনি ফিরে আসছেন।

বুলুর বাবা লিবিয়াতে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। অবাক কাণ্ড—নেপালে আসার ঠিক আগের দিনই বুলুরা চিঠি পেয়েছিল—তিনি ফিরছেন।

এত বড়ো ভবিষ্যৎবাণীর পর আর কি ঠিক থাকা যায়? বরফ গলল। বুলু দারুণ বিশ্বাসী হয়ে গেল। ভদ্রলোককে ‘মামা’ বলে ডাকতে লাগল।

কিন্তু অবাক হবার ব্যাপার তখনো বাকি ছিল।

নেপাল থেকে ফেরার আগের দিন।

সন্ধের পর বুলুরা দক্ষিণাকালী দেখে হোটেলে ফিরল। দক্ষিণাকালী মন্দির কাঠমাণ্ডু থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। অনেক পাহাড়, খাদ পেরিয়ে তবে যেতে হয়। মন্দিরটা একটা পাহাড়ের নীচে। নামতে হয় অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে। ঐরকম পরিবেশেই বুঝি কালীকে মানায়। প্রকৃতির কোলে নিস্তব্ধ, নিঝুম পরিবেশটি।

যাই হোক, বুলু ফিরেই তার এই নতুন মামাটির সঙ্গে দেখা করল। হাসতে হাসতে ব্যাগ খুলে কাগজে মোড়া একটা জিনিস বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, দেখুন তো মামা, জিনিসটা কেমন হল?

জিনিস দেখে তো মামা হতভম্ব! এটা তুমি কোথায় পেলে?

বুলু বলল, একজন পাহাড়ির কাছ থেকে কিনলাম দক্ষিণাকালীর মন্দিরের কাছে।

মামা অনেকক্ষণ ধরে সেই ছোট্ট খুলিটা পরীক্ষা করে দেখলেন। তারপর বললেন, এ যে বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস। এ নিয়ে তুমি কি করবে মা?

বুলু তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে খুলিটা নিয়ে বলল, আলমারিতে সাজিয়ে রাখব।

মামা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ বুলুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, কাজটা কি ভালো হবে? ও যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত।

এই পর্যন্ত বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর বললেন, আমি শিগগিরই ওখানে যাব। ইচ্ছে করলে আমায় দিতে পার। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেব। দামটা না হয় এখুনি তোমায় দিয়ে দিচ্ছি।

কিন্তু বুলু রাজি হয়নি।

তখন উনি বললেন, আমার কথা তোমার মাকে বোলো। তিনি কী বলেন আমায় জানিও।

বুলু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিগ্যেস করল—কেন? এটা যদি রাখি তা হলে কি হবে?

বিপদ অনিবার্য। কেন? আজ ওটা কেনার পর তোমার কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি?

এবার বুলুর মুখ শুকিয়ে গেল। মনে পড়ল দক্ষিণাকালী দেখতে যাবার সময়ে তিনতলা সমান উঁচু সিঁড়ি থেকে পা স্লিপ করে খাদে পড়ে যাচ্ছিল! খুব বেঁচে গেছে।

এই বিচিত্র মাথাটির সম্বন্ধে বুলু আগে কিছু খবর পেয়েছিল কাঠমাণ্ডু থেকে চলে আসার দিন হোটেলের নেপালি চাকরটির কাছ থেকে। তাকে খাবার সময়ে বখশিস দিতে কথায় কথায় ও হিন্দিতে জানায় যে ঐ লোকটি ভয়ঙ্কর দেবতা আছেন। তিনি নাকি নেপালের জাগ্রত দেবতা কালভৈরবের সাধক। কালভৈরব হচ্ছেন মৃত্যুর দেবতা। বিকট চেহারা। কুচকুচে কালো রঙ। তার গলায় মুণ্ডমালা— বীভৎস মুখের হায়ের মধ্যে দিয়ে তার হিংস্র জন্তুর মতো ধারালো দাঁত বেরিয়ে এসেছে।

নেপালিটা জানাল, ঐ দেবতাকে খুশি করে ইনি প্রচণ্ড ক্ষমতা পেয়েছেন। ইচ্ছে করলেই যে কোনো লোকের ক্ষতি করে দিতে পারেন। ভয়ে হোটেলের ম্যানেজার ওঁর কাছ থেকে একটি টাকাও নেন না। উপরন্তু খাতির করেন।

এই হল বুলুর মামার পরিচয়। বুলুরা তো কলকাতা চলে এল। তারপর হঠাৎই একদিন সন্ধেবেলা সেই মামা বুলুদের বাড়ি এসে হাজির।

জিগ্যেস করলাম—ঠিকানা দিয়েছিলে?

বুলু একটু ভেবে বলল, ঠিক মনে নেই। নিশ্চয় দিয়েছিলাম। নইলে উনি এলেন কি করে?

তারপর থেকে প্রায় সপ্তাহে দুদিন করে আসেন। গল্প করেন, চলে যান।

কোথায় যান?

ঠাকুরপুকুরের কাছে কবরডাঙা বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে ওঁদের পুরোনো বাড়ি। কলকাতায় এলে একাই থাকেন। সবই কেমন রহস্যময়। বলি বটে, এই মামাটি মজার জিনিস। কিন্তু সত্যি বলছি কাকু, মাঝে মাঝে কেমন ভয়ও করে। লোকটার কাছ থেকে রেহাই পেলে বাঁচি ।

খুলিটার কথা উনি জিগ্যেস করেন?

বুলু মাথা নাড়ল।—না। এখানে এসে পর্যন্ত খুলির কথা বলেননি।

এই পর্যন্ত বলে বুলু ভুল শুধরে বললে—হ্যাঁ, একদিনই বলেছিলেন। সেই যে সাবধান করে দিয়েছিলেন।

আমি হাসলাম। বললাম, হ্যাঁ, পাছে আমি চুরি করে নিই!

বুলু লজ্জায় জিব কাটল –ইস্!

তবু সেদিন যে খুলিটা তিনি আলমারি থেকে বের করে আমার পায়ের শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি ম্যাগাজিন চাপা দিয়ে রেখেছিলেন সে কথাটা বুলুকে আর বললাম না।

এই মামা লোকটিকে প্রথম দিন থেকেই আমার ভালো লাগেনি। শুধু অভদ্র বলেই নয়, লোকটি মতলববাজ। নেপালে না গেলেও জানি—এইরকম এক ধরনের তান্ত্রিক আছে যারা নিজের সিদ্ধির জন্যে সবরকম অপকর্ম করতে পারে। এ বাড়িতে তাঁর আসার উদ্দেশ্য অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার! সেই সঙ্গে বুলুও যে কী মারাত্মক ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে তাও আমার জানা। শুধু বুলুই নয়, আমিও লোকটির বিষনজরে পড়েছি। তাই বুলুর মনে আমাকে চোর বলে সন্দেহ ধরিয়ে দিতেও চেষ্টা করেছে। এরপর হয় তো আমার জীবনও বিপন্ন হতে পারে।

অপরাধ? অপরাধ—খুলি চুরি করার ওঁর চেষ্টা আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে।

সে যাই হোক, বুলুকে এখন ঐ ভদ্রবেশী তান্ত্রিকের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

কিন্তু—কি করে? আমি যা ভাবছি তা যদি বুলুকে বলি তাহলে সে বিশ্বাস নাও করতে পারে। উল্টে আমার ওপর ধারণা খারাপ হবে।

আর যদি বিশ্বাস করেও, একজন ভদ্রলোককে কি সরাসরি বাড়ি আসতে বারণ করতে পারে? বারণ করলেই কি উনি শুনবেন? ঐ খুলিটা যে ওঁর চাইই।

 

দিন পনেরো পর।

অফিস থেকে সবে ফিরেছি। হঠাৎ বুলু এসে হাজির। তার উদভ্ৰান্ত ভাব দেখে চমকে উঠলাম।— কী হয়েছে?

আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল। আমরা কেউ ছিলাম না। আর সেই সময়ে—

কেন ? সেই বুড়ি কাজের লোকটি?

বলছি দাঁড়ান, আগে একটু বসি। ইতিমধ্যে রীণা, রীণার মাও এসে পড়েছেন।

রীণা, একটু জল দে তো!

রীণা তাড়াতাড়ি জল এনে দিল। জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছে বুলু বলল, অন্য দিনের মতোই বুড়িটা দুপুরে ঘুমোচ্ছিল। আজ আবার দুপুরে এদিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই আরামেই ঘুমোচ্ছিল। কখন থেকে যে কলিংবেলটা বেজে যাচ্ছিল তা সে শুনতে পায়নি। যখন শুনল ধড়মড় করে উঠে দরজা খুলে দিল। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। তখন বুড়ি আবার গিয়ে শুল। একটু পরে আবার বেল বাজল, বুড়ি আবার উঠে দরজা খুলল। কিন্তু এবারও কাউকে দেখতে পেল না। এমনি করে তিন তিনবার। বুড়ি বুঝল এ নিশ্চয় কোনো দুষ্টু ছেলের কাজ। তাই চারবারের বার বুড়ি রেগে রাস্তায় নেমে দুষ্টু ছেলে ধরবার জন্যে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। কিন্তু কারো টিকিটুকুও দেখতে পেল না। তখন ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ল।

এই পর্যন্ত বলে বুলু থামল।

বললাম, কিন্তু চোর এসেছিল কি করে বুঝলে? দুষ্টু ছেলের কাজও তো হতে পারে।

তা হতে পারে। তবু—

বুলু কি ভাবতে লাগল।

তারপর যেন আপন মনেই বলল, আমার কেমন ভালো ঠেকছে না। চোর এসেছিল বলেই আমার সন্দেহ। তাছাড়া—

বললাম—থামলে কেন ?

না, তেমন কিছু নয়, তবু বলছি, বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে দেখি চৌকাঠে জুতোর কাদা।

আমি চমকে উঠলাম। সে ভাব গোপন করে বললাম, কাদা আগে ছিল না ?

বুলু মনে করবার চেষ্টা করে বলল—তা হলে নিশ্চয় আমার চোখে পড়ত। তাছাড়া কাদা আসবে কোত্থেকে? বৃষ্টি তো হল দুপুরে।

রাইট! বলে বুলুর পিঠ চাপড়ালাম।

যাই হোক, কিছু চুরি যায়নি তো?

না! এইটুকুই রেহাই।

ঠিক জান কিছু চুরি যায়নি?

বুলু হেসে বলল, ঘরে ঢুকে এক নজর দেখে কিছু চুরি গেছে বলে তো মনে হল না।

চলো, এখনি তোমার বাড়ি যাব।

বলে তখনই গায়ে হাওয়াই শার্টটা চড়িয়ে বুলুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ওদের বাড়ি ঢুকেই চলে এলাম ওদের বাইরে-ঘরে। বুলুকে বললাম, তোমার আলমারিটা খোলো।

বুলু চাবি বের করে লাগাতে গেল কিন্তু তার দরকার ছিল না। আলমারিটা খোলাই ছিল। ভেতরে সেই খুলিটা নেই।

সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়লাম।

বুলু ব্যাকুল হয়ে পিছু ডাকল—কোথায় যাচ্ছেন?

বললাম, কবরডাঙায় তোমার ঐ ভণ্ড মামার আস্তানায়।

ও প্রায় কেঁদে উঠল—না-না, এই সন্ধেবেলা যাবেন না।

কিন্তু আমার তখন জেদ—ওটা উদ্ধার করে লোকটাকে পুলিশে দিতেই হবে।

ঠাকুরপুকুরের এদিকটায় কখনো আসিনি। দু’ধারে মাঠ, কোথাও বা রীতিমতো জঙ্গল। কবরডাঙা জায়গাটা রীতিমতো গ্রাম। তবু রাস্তাটা পিচঢালা। বাস চলে। মাঝে মাঝে লরিও যায়। এখানে পুরোনো বাড়ি কি আছে জিগ্যেস করতেই একটা লোক মাঠের ওপর বিরাট দোতলা ভাঙা বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ভূতের বাড়ি তো?

হ্যাঁ, বলে মাঠে নেমে পড়লাম। লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দূর থেকে বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন প্রেতপুরী। ইট খসে পড়ছে। আলসের মধ্যে দিয়ে উঠেছে অশ্বখের চারা। ঢুকে পড়লাম সেই বাড়িতে। অন্ধকার। চারিদিক থমথম করছে। তারই মধ্যে—হঠাৎ মনে হল যেন দুটো জ্বলজ্বলে চোখ! থমকে গেলাম।

না, একটা কুকুর। কুকুরটা আমায় দেখে পালাল। সামনেই সিঁড়ি। টর্চও সঙ্গে করে আনিনি। দেশলাই জ্বালতে জ্বালতে দোতলায় উঠে এলাম। একটা ঘর। বোধহয় একটি মাত্র ঘরেই দরজাজানলা আছে। ঢুকে পড়লাম। দড়িতে ঝুলছে একটা লুঙ্গি, একটা ফর্সা পাজামা, একটা পাঞ্জাবি। সামনে কালো কাপড় ঢাকা-ওটা কি?

ভালো করে দেখলাম। ওটা একটা তে-পায়া। চমকে উঠলাম। এইরকম তে-পায়াতেই তো প্রেতাত্মা নামানো হয়। মামা কি তা হলে—

কিন্তু—আসল জিনিসটি কোথায়? মামাই বা কোথায়?

আবার দেশলাই জ্বাললাম। লক্ষ্য পড়ল কুলুঙ্গিতে। একটি তামার পাত্রে সেই ছোট্ট মড়ার খুলিটি!

আমি মরিয়া হয়ে খুলিটা তুলে নিয়ে পকেটে পুরলাম। তারপর একছুটে নীচে। সামনেই সেই মাঠ। মাঠের পরেই পিচঢালা রাস্তা। পাছে দৌড়লে কারো নজরে পড়ি তাই জোরে হাঁটতে লাগলাম। নিশ্বাস বন্ধ করে হাঁটছি। চারিদিকে অন্ধকার—শুধু অন্ধকার!

হঠাৎ আমার মনে হল, এই নির্জন মাঠে আমি আর এক নই। কেউ যেন পিছনে রয়েছে। ...হ্যাঁ, স্পষ্ট বুঝতে পারছি পিছনের মানুষটি এসে পড়েছে।...আমি দৌড়তে লাগলাম। কিন্তু পারলাম না। পিছনের লোকটা ঝাপিয়ে পড়ল আমার ওপর। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সে অমনি আমাকে জাপটে ধরল। উঃ, কী কঠিন সে হাত দুটো। সে স্বচ্ছন্দে আমার পকেট থেকে খুলিটা বের করে নিল। তারপর আমার গলা টিপে ধরল।...মৃত্যু নিশ্চিত জেনে আমি প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করলাম। এক মুহুর্তের জন্যে ওর হাতটা ঢিলে হয়ে গেল। অমনি কোনোরকমে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ছুটলাম রাস্তার দিকে। সেও ছুটে আসছে আমার পিছনে।

রাস্তায় লরির হেডলাইট...তবু আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম রাস্তায়। লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিল। লরিটা দুরন্ত গতিতে বেরিয়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম—নাঃ, আমি বেঁচে আছি। কিন্তু—রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে ওটা কি?

কিন্তু সেদিকে মন দেবার মতো অবস্থা তখন ছিল না। হাঁটতে লাগলাম ডায়মন্ডহারবার রোডের দিকে।

 

পরের দিন সকালে বুলুদের বাড়ি চা খেতে খেতে সমস্ত ঘটনা বললাম। কাগজেও ঐ অঞ্চলে লরিচাপা পড়ে একটি মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে।

বুলু বলল, আপনি খুব বেঁচে গেছেন কাকু! ভাগ্যি খুলিটা তখন আপনার কাছে ছিল না।

আমি হেসে বললাম, আর লরির চাকার নীচে খুলিটারও সদব্যবহার হয়ে গেল।

বুলু একটু হাসল। তারপর বলল, কিন্তু আশ্চর্য এই যে—লোকটার যে বর্ণনা কাগজে রয়েছে তার সঙ্গে মামার চেহারা মেলে না।

আমি বললাম, তা জানি। ওটি মামার শাগরেদ। মামা কিন্তু রইলেন বহাল তবিয়তে। হয়তো আবার আসবেন।

বুলু শিউরে উঠল।

 

অ-      অ+ সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে জমজমাট অন্ধকার। দেবকুমার বুঝতে পারল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে—বন্ধু রজতের...


অ-     অ+

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে জমজমাট অন্ধকার। দেবকুমার বুঝতে পারল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে—বন্ধু রজতের বাড়ি খুঁজে বার করা একেবারেই অসাধ্য। কত চেষ্টাই তো করল সে! কিন্তু রজতের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথ সে খুঁজে বার করতে পারল না ।

মনে মনে জেগে ওঠে তার শত অনুতাপ। রজত তাকে বারণ করেছিল। সে বলেছিল বারবারই, “শোনো দেবকুমার, এসব পাহাড়ে জায়গা একেবারেই ভালো নয়, এখানে-সেখানে কত বিপদ ওৎ পেতে বসে আছে! কাজেই বিকেল পাঁচটা না বাজতেই ফিরে এসো !”

সে তখন হেসেছিল বিদ্রুপের হাসি! একটা শক্ত-সমর্থ জোয়ান ছেলে সে, পাহাড়ে পথ বলেই কি তার বিপদ হবে? সে কি পাঁচ বছরের কচি ছেলে যে তাকে সহজেই কেউ বিপদে ফেলতে পারে?

তখন এমনি কত কথাই তার মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন ? এখন যে বাচ্চা ছেলের মতোই সে পথ হারিয়ে ফেলল ? এখন কোথায় সে যাবে? কেই বা তাকে আশ্রয় দেবে?

হ্যাঁ, ঐ যে দূরে একটা আলো দেখা যায় না?

দেবকুমারের আশা হল, নিশ্চয়ই ঐখানে কোনো বসতি আছে, ওখানে গেলে সে নিশ্চয়ই একটু আশ্রয় পেতে পারে।

দেবকুমার জোরে পা চালিয়ে দিল। মিনিট দশেক পরেই দেখা গেল, এক প্রকাণ্ড বাড়ি তার সুমুখে দাঁড়িয়ে। বাড়িটি জীর্ণ পুরাতন হলেও বুঝতে কষ্ট হয় না যে এককালে এর পেছনে ছিল বিরাট ধনীর কোনো ইতিহাস!

বিরাট সিংহ-দরজা—লৌহ-ফটক। তারই মাথায় মিট্‌মিট্‌ করে একটা আলো জ্বলছে। অর্ধ-উন্মুক্ত ফটকের এক কোণে একখানি চেয়ারে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উপবিষ্ট। পরম নিশ্চিন্ত মনে তিনি হুকো হাতে ধূমপানে ব্যস্ত।

দেবকুমারের পায়ের শব্দে চমকিত হয়ে তিনি তার আধখোলা চোখ দুটি ভালো করে খুললেন ও একটু সোজা হয়ে বসলেন।

“দেখুন, আমি বড় বিপন্ন। পথ হারিয়ে ফেলেছি। আজ রাতের মতো আপনার এখানে একটু আশ্রয় প্রার্থনা করি।”

দেবকুমারের কথায় অসহায় মিনতি ঝরে পড়ে।

ভদ্রলোক একবার দেবকুমারের আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর কোনো কথা না বলে পাশের একটি ছোট বোতামে চাপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে কোথাও ঝন্‌ঝন্‌ করে ঘণ্টা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবয়সী এক পরিচারিকা সেখানে উপস্থিত হল।

ভদ্রলোক ঠিক তেমনিভাবে তামাক খেতে খেতেই নীরবে দেবকুমারকে দেখিয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন। দেবকুমার পরম কৃতজ্ঞভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিচারিকার পেছনে পেছনে ওপরে যাওয়ার সিঁড়িপথে অন্তর্হিত হয়ে গেল।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ দেবকুমার বুঝতে পারে না তার ঘুম ভাঙল কেন! নিশুতি অন্ধকার রাত, কিন্তু কেমন একটা থমথমে ভাব!

সে তার বালিশের তলা হতে টর্চটি টেনে বার করতে যায়। কিন্তু মনে হল তার খাটসুন্ধু গোটা বিছানাই যেন মেজে হতে উঁচু হয়ে উঠেছে! কি এ?

দেবকুমার বসতে চেষ্টা করল বিছানার ওপর। কিন্তু বসতে গেলেই পড়ে যায়, আবার সে লুটিয়ে পড়ে বিছানার ওপরেই। কারণ, সমস্ত খাটখনি তখন প্রায় তিন হাত উঁচুতে শূন্যে উঠে গেছে!

দেবকুমার ভীত-সন্ত্রস্ত ভাবে শেষ পরিণতি লক্ষ করতে লাগল! সহসা ধপ করে খাটখানি পড়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দে দোতলার মেজে থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল, কোনো মত্ত হস্তী বুঝি তার মাথা দিয়ে খাটখানা ঠেলে ফেলে দিলে!

পরক্ষণেই একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া! মুহুর্তে শীতে কেঁপে ওঠে দেবকুমার! হঠাৎ কার একটা মৰ্মভেদী নিঃশ্বাস তার মুখে এসে লাগে! কিন্তু এত ঠান্ডা। নিঃশ্বাস কি কখনো কারো এত ঠান্ডা হয়? এ যেন বরফের ছুরি।

দেবকুমার না-জানি কোন এক অজানা ভয়ে কখন তার চোখ অনেকটা বন্ধ করেই ফেলেছিল! কিন্তু আসলে সে তো ভীরু নয়। সাহসী বলে তার রীতিমতো সুনামই ছিল। কাজেই তার সমস্ত জড়তা ও ভয় সে এইবার দূরে ঠেলে ফেলে দেয়, পূর্ণ বিস্ফারিত চোখে তাকায় সে। কিন্তু চাইতেই—ও কি? খোলা জানলায় একখানা বীভৎস মুখ, সে মুখে এক তিলও মাংস নেই, সাদা ধবধবে হাড়ের মুখ..নাক-চোখের জায়গায় তিন-তিনটে গর্ত, দুঠোঁটের জায়গায় দুসারি দাঁত বেরিয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্যে দেবকুমারের মাথাটা ঘুরে গেল, তার চোখ দুটি আপনা হতে বন্ধ হয়ে গেল।

হঠাৎ একটা বিশ্ৰী হাসির শব্দে চমকে ওঠে দেবকুমার...কিন্তু এ কি? কোথায় সে বীভৎস মুখ? এত বড় বিস্ময়কর ঘটনাকেও ছাপিয়ে আর একটা বিভীষিকা ফুটে উঠল তার চোখের সামনে।

সে দেখে, দুটি করুণ চোখ—সুন্দরীর চোখই তাকে বলা যায়—একান্ত মিনতি-মাখা,— দেবকুমারের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে আছে!

দেবকুমারের বুকের রক্ত মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়! কে যেন একরাশ বরফের ছোপ তার দেহমনে বুলিয়ে গেল!

চোখ তার বন্ধ করে দেবকুমার—ভয়ে বা বিস্ময়ে। পরক্ষণেই আবার সে চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু তখনো সেই চোখ—ঠিক তেমনিভাবে—তারই মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। তার এক ঝলক ঠান্ডা নিঃশ্বাস দেবকুমারের কপালে এসে বুঝি কাঁপুনি জাগিয়ে তোলে।

সহসা—একটা প্রচণ্ড শব্দ! সজোরে দরজাটা কে খুলে ফেলল। পরক্ষণেই একটা প্রকাণ্ড জোয়ান লোক ঝড়ের বেগে ঘরে ঢোকে। ঢুকেই সে এক লাফে মহিলার দিকে এগিয়ে এল। তারপর মুহুর্তমধ্যে তার চুল ধরে টেনে তাকে মাটিতে ফেলে দিল!

আর্তনাদ করে উঠল সেই বিপন্ন মহিলা। কিন্তু পরক্ষণেই সেই জোয়ান লোকটার হাতে চক্‌চক্‌ করে ওঠে একখানি শাণিত ছুরি আর সহসা স্তব্ধ হয়ে গেল মহিলার কণ্ঠস্বর।

দেবকুমারের চোখের সম্মুখে রক্তের নদী বয়ে যায়! মহিলার রক্তাক্ত দেহ তার মাঝখানে। দেবকুমার সে দৃশ্য আর দেখতে পারে না—ভয়ে সে চোখ বন্ধ করল!

কতক্ষণ সে এইভাবে ছিল বলা যায় না—কিন্তু কি এক বিচিত্র শব্দে চমকিত হয়ে আবার সে

চোখ মেলে চায় !—

ওঃ! কি ভয়ঙ্কর! নিহত মহিলার চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। কি তার উত্তাপ আর কি তার জ্যোতি! সমস্ত ঘরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে! আর সেই আগুনের মাঝখানে রক্ত-সমুদ্রে সেই সুন্দরী মহিলা! তার সর্বদেহ রক্তমাখা, বুকের একপাশ দিয়ে তখনো বয়ে চলে ফুটন্ত রক্তস্রোত! দেবকুমার স্তব্ধ, হতবাক! কিন্তু কিসের আকর্ষণে সে চোখ তার ফেরাতে পারল না, মন্ত্ৰমুগ্ধ শিকারের মতো সে যেন শিকারির চোখে চোখ মিলিয়ে ঠিক তেমনি ভাবেই তাকিয়ে রইল!

মহিলা হিংস্র দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকায়, ঠোঁট তার কেঁপে ওঠে। না-জানি কোন অভিসম্পাত সে বিলিয়ে দেয় অত্যাচারী পৃথিবীর বুকে!

সহসা দূরে কেন অসংখ্য পদশব্দ?—দূর হতে কাছে, ক্রমশই আরো কাছে, কে জানে কত লোকজনের পদশব্দ নৈশ স্তব্ধতা ভারী করে তোলে!

দেবকুমার বুঝতে পারে, একজন দুজন নয়, অসংখ্য লোক—হিংস্র শিকারির মতো বাড়িতে ঢুকে পড়েছে! তাদের হৈ-হল্লা ও অস্ত্রের ঝঞ্জনায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, সমস্ত পৃথিবী যেন দারুণ ভয়ে তার চোখ বন্ধ করে ফেলল!

বুক কেঁপে ওঠে দেবকুমারের! কিন্তু সে বুঝি চিৎকার করবার শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে! হঠাৎ কিসের বিজয়-উল্লাসে সমস্ত আকাশ-বাতাস ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল! সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে ঝড়ের মতো ঘরে ঢোকে একপাল যমদূত—সকলেই সশস্ত্র ভয়ঙ্কর! কিন্তু তাদের পুরোভাগে সেই মহিলার হত্যাকারী নৃশংস ব্যক্তি।

হিড়্‌ হিড়্‌ করে টেনে তাকে ঘরে নিয়ে এল যমদূতের দল। তারপর তার দেহের সর্বত্র এলোপাথাড়ি চলে অসংখ্য অস্ত্রাঘাত। ছোরা, তলোয়ার, শড়কি-বল্লম তাকে প্রায় ভূমিতলে গেঁথে ফেলে। মহিলার ফুটন্ত রক্তের সঙ্গে তার সদ্যোনিঃসৃত রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেল!

“হাঃ! হাঃ! হাঃ! হাঃ!”—একটা বীভৎস অট্টহাসিতে মহিলা উল্লসিত হয়ে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে কোথা হতে বুঝি বা ছাদ ফুঁড়ে টুপটাপ ঝরে ঝরে পড়তে লাগল কতকগুলি কচিকাচা ছেলেমেয়েদের রক্তমাখা ছিন্নশির ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।

আর্তনাদ ও উল্লাসের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যায়, আর ঠিক সেই মুহুর্তে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সেই বিশাল বাড়িখানির ভিত পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।

প্ৰলয়-দোলায় কেঁপে ওঠে দেবকুমারের সমস্ত খাটখানি, টগবগে ফুটন্ত রক্ত তার কপালে ও মুখে ছিটকে এসে লাগে! কয়েকটা ভয়ঙ্কর হিংস্র যমদূত গোটাকয়েক বীভৎস কঙ্কাল সহ অবশেষে দেবকুমারের দিকেও তেড়ে এল!

ভয়ে শিউরে উঠল দেবকুমার! দু’হাত মাথায় তুলে সে প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে, “বাঁচাও ! বাচাও!”—

 

জ্ঞান যখন হল, তখন সে দেখে, তার বন্ধু রজত ও একজন ডাক্তার তার পাশে বসে! ভাবতে চেষ্টা করে সে, কোথায় সে আছে আর কেমন করে এল ? চোখ চাইতে পারে না সে। অবশেষে ধীরে ধীরে মনে আসে তার সব কিছু। কিন্তু বুঝতে পারে না, নিশীথের সেই ভয়ঙ্কর প্রাসাদে ওরা দুজনই বা এল কখন আর কেমন করে এল!

“কেমন করে এল?”—সম্ভবত তার বুকের ভাষা মুখে ফুটে বেরিয়েছিল একটু জোরেই।

রজত বলে, “হ্যাঁ ভাই, এ প্রশ্ন তোমার মনে জেগে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। সংক্ষেপে বলছি শোনো—

অনেক রাতে তুমি যখন ফিরলে না, তখন আমার এই ডাক্তার বন্ধুটিকে নিয়ে তোমায় খুঁজতে বেরেই। এ বাড়িটা আমার বাড়ি হতে প্রায় মাইল তিনেক দূর।

এর কাছাকাছি আসতেই তোমার একটা আর্তনাদ আমাদের কানে আসে। আমরা তখুনি টর্চ হাতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি। এসে যা দেখলুম, তাতে আর আশা হয়নি যে তোমাকে জীবন্ত ফিরে পাব। দেখি, তুমি এই খাটের ওপর পড়ে আছ, কিন্তু মাথা তোমার মাটিতে ঝুলছে! আর তোমার নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে!—”

বাধা দিয়ে দেবকুমার বলে, “কিন্তু ওরা সব গেল কোথায়? সেই নিহত মহিলা, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাটা মাথাগুলি—সেই রক্তনদী—রক্তস্রোত—”

“থামুন,” বাধা দিয়ে বলেন ডাক্তারবাবু, “ওকথা আর ভাববেন না দেবকুমারবাবু। এ বাড়িটা ভূতের বাড়ি, যা-কিছু আপনি দেখেছেন, সবই ভৌতিক ব্যাপার দেখেছেন। আসলে কিছুই সত্য নয় —”

“কিন্তু মিছামিছি এমন একটা—”

দেবকুমারের কথায় বাধা দিয়ে বলে রজত, “মিছামিছি কিছুই নয় দেবকুমার। অনেক দিন আগে এক ধনী জমিদার তার স্ত্রীর ওপর বিরক্ত হয়ে অতি নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও হাতে হাতে তার সাজা পেয়ে গেছেন। মহিলার আত্মীয়-স্বজন যারা, তারা একদল ভাড়াটে গুন্ডা লেলিয়ে এবাড়ির সবাইকে কচুকাটা করে গেছেন। সেই থেকে এবাড়ি পোড়ো বাড়ি বলেই বিখ্যাত। কেউ এখানে থাকে না। মাঝে মাঝে দু'একটা অপরিচিত ব্যক্তির মৃতদেহ এখানে আবিষ্কার হয়। সম্ভবত তোমারই মতো দৈবাৎ যারা এখানে রাতের অতিথি হয়, ভোরবেলা তাদেরই শব হয়তো পাওয়া গেছে। তোমার ভাগ্যি ভালো যে, আমরা বোধহয় খুব সময়মতোই এসে পড়েছিলাম।”

দেবকুমার নীরবে ভাবতে থাকে; বিস্ময়ে ও ভয়ে তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোয় না। কিন্তু সেদিন সে তাদের সঙ্গে রজতের বাড়ি ফিরে গেলেও, কয়েকদিন পরে একদল মিস্ত্রি নিয়ে আবার সে ফিরে এসেছিল সেইখানে।

রজতকে বলল সে, “ভাই, খাটের তলাটা ওদের খুঁড়তে বলো। আমার খাটখানি সেদিন বড্ড দুলে উঠেছিল, উঁচু হয়ে উঠেছিল অনেকটা। তার কারণ কি বলতে পারো ?”

“তা কেমন করে বলব ভাই? তুমি বলছ খুঁড়তে, বেশ খুঁড়েই দেখা যাক।”

ঘণ্টাকয়েক পরিশ্রমের পর, মেজের সিমেন্ট ফাটিয়ে যখন আগাগোড়া খুঁড়ে ফেলা হল, তখন দেখা গেল—রক্তমাংসহীন কার এক কঙ্কাল। আর সেই কঙ্কালের আশেপাশে কিছু হার ও ব্রেসলেট তখনো সেই নিহত মহিলার পরিচয় ঘোষণা করছে।

সমবেত সকলেই স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর রজত বললে, “রহস্য তাহলে পরিষ্কার হয়ে গেল দেবকুমার! সম্ভবত প্রত্যহ গভীর রাতে মহিলার অতৃপ্ত আত্মা তার গোপন আবাস হতে বেরিয়ে আসে। আর তারপর যা হয়ে থাকে, সে সম্ভবত বাস্তবের পুনরাভিনয় । জীবনে একদিন যা হয়েছিল, এবাড়ির ভৌতিক অধিবাসীরা আজও তার রিহার্সেল দিয়ে যাচ্ছে!

যাহোক দিন তো প্রায় শেষ হয়ে এল। আর দু’এক ঘণ্টা এখানে থাকতে পারলে এবাড়ির আরো কিছু গোপন রহস্য হয়তো উদ্ধার করা যেত, কিন্তু সে কি সঙ্গত হবে ভাই?—”

“ও কি?” চিৎকার করে ওঠেন ডাক্তারবাবু। সেদিকে তাকিয়ে তারা দেখে, একপাল সাদা ও কালো বাদুড় হঠাৎ জানালার সার্সিতে এসে মাথা ঠুকে মরছে! তাদের কুৎকুতে রক্তচোখে হিংস্র ঝলক!

জোরে চিৎকার করে ওঠে রজত, “না আর নয়। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো দেবকুমার! বেরিয়ে পড়ো ডাক্তার। নইলে সমস্ত আত্মা আজ আবার প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসবে—”

মুহুর্তে ছুটে বেরিয়ে যায় সবাই। মনে হল কারা যেন তাদের পিছু পিছু বেগে ছুটে আসছে! নাগাল পেলেই বুঝি বা ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

 

        হারানো একটা পুঁথিতে নিশি কবরেজ একটা ভারী জব্বর নিদান পেয়েছেন। গাঁটের ব্যথার যম। তবে মুশকিল হলো পাঁচনটা তৈরি করতে যে পাঁচরকম জিনিস ...

        হারানো একটা পুঁথিতে নিশি কবরেজ একটা ভারী জব্বর নিদান পেয়েছেন। গাঁটের ব্যথার যম। তবে মুশকিল হলো পাঁচনটা তৈরি করতে যে পাঁচরকম জিনিস লাগে তার চারটে যোগাড় করা যায়। কিন্তু পাঁচ নম্বরটাই গোলমেলে। পাঁচ নম্বর জিনিসটা হচ্ছে আধ ছটাক ভূত।
        নিশি কবরেজ রাতে খাওয়ার পর দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আচমন করছিলেন। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার রাত্রি। চারদিক নিঃঝুম। শীতকালের কুয়াশা আর ঠাণ্ডাটাও জেঁকে পড়েছে। আঁচাতে আঁচাতে নিশি কবরেজ পাঁচনটার কথাই ভাবছিলেন। রাজবল্লভবাবু বিরাট বড়লোক! কিন্তু গাঁটের ব্যথায় শয্যাশায়ী। ব্যথাটা আরাম করতে পারলে রাজবল্লভবাবু হাজার টাকা অবধি দিতে রাজি বলে নিজে মুখে কবুল করেছেন। কিন্তু ভূতটাই সব মাটি করলে। আধ ছটাক ভূত এখন পান কোথায়? হঠাৎ নিশি কবরেজের মনে হলো, উঠোনের ওপাশটায় হাঁসের ঘরের পাশটায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

        লালু আর ভুলুর কোনও কাজ নেই। তারা সারাদিন গল্প করে কাটায়। সবই নিজেদের জীবনের নানা সুখ-দুঃখের কথা। কথা বলতে-বলতে যখন আর কথা কইতে ভাল...

        লালু আর ভুলুর কোনও কাজ নেই। তারা সারাদিন গল্প করে কাটায়। সবই নিজেদের জীবনের নানা সুখ-দুঃখের কথা। কথা বলতে-বলতে যখন আর কথা কইতে ভালো লাগে না তখন দুজনে খানিক কুস্তি লড়ে। তাদের কুস্তিও খুব একঘেঁয়ে—কেউ হারে না। কেউ জেতে না। কুস্তি করে তাদের ক্লান্তিও আসে না, ঘামও ঝরে না। তার কারণ লালু আর ভুলু দুজনেই ভূত। প্রায় চোদ্দো বছর আগে দুই বন্ধু মনুষ্য জন্ম শেষ করে ভূত হয়ে লালগঞ্জের লাগোয়া বৈরাগী দিঘির ধারে আশ-শ্যাওড়ার জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে আছে। মামলা-মোকদ্দমা থেকেই বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয়, বুড়ো বয়সে মাত্র সাত দিনের তফাতে লালু আর ভুলু পটল তোলে। ভূত হয়ে যখন দুজনের দেখা হল তখন দুজনের মনে হল পুরোনো ঝগড়া জিইয়ে রাখার আর কোনও মানেই হয় না। তাই দুজনের বেশ ভালো ভাব হয়ে গেল। সময় কাটানোর জন্য তারা মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করেও দেখেছে। কিন্তু দেখা গেল ঝগড়াটা তেমন জমে না, আরও একটা আশ্চর্যের বিষয় হল তারা ভূত হয়ে ইস্তক এ তল্লাটে কোথাও কখনও আর কোনও ভূতের দেখা পায়নি।

        পালোয়ান কিশোরী সিং-এর যে ভূতের ভয় আছে তা কাক পক্ষিতেও জানে না। কিশোরী সিং নিজেও যে খুব ভাল জানত এমন নয়।         আসলে কিশোরী ছে...

        পালোয়ান কিশোরী সিং-এর যে ভূতের ভয় আছে তা কাক পক্ষিতেও জানে না। কিশোরী সিং নিজেও যে খুব ভাল জানত এমন নয়।
        আসলে কিশোরী ছেলেবেলা থেকেই বিখ্যাত লোক। সর্বদাই চেলাচামুণ্ডারা তাকে ঘিরে থাকে। একা থাকার কোন সুযোগই নেই তার। আর একথা কে না জানে যে একা না হলে ভূতেরা ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারে না। জো পায় না।
        সকালে উঠে কিশোররী তার সাবরেদ আর সঙ্গীদের নিয়ে হাজার খানেক বুকডন আর বৈঠক দেয়। তারপর দঙ্গলে নেমে পড়ে। কোস্তাকুস্তি করে বিস্তর ঘাম ঝরিয়ে দুপুরে একটু বিশ্রাম। বিকেলে প্রায়ই কারও না কারও সঙ্গে লড়াইতে নামতে হয়। সন্ধ্যের পর একটু গানবাজনা শুনতে ভালবাসে কিশোরী। রাতে সে পাথরের মতো পড়ে এক ঘুমে রাত কাবার করে। তখন তার গা হাত পা দাবিয়ে দেয় তার সাকরেদরা। এই নিশ্ছিন্দ্র রুটিনের মধ্যে ভূতেরা ঢুকবার কোনও ফাঁকই পায় না।

        প্রায় চৌদ্দ পুরুষের বসতবাড়িটা দারুব্রহ্মবাবুকে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। একে তো এত বড় বাড়ি কেনার খদ...

        প্রায় চৌদ্দ পুরুষের বসতবাড়িটা দারুব্রহ্মবাবুকে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। একে তো এত বড় বাড়ি কেনার খদ্দের নেই, তার ওপর যদি বা খদ্দের জোটে তারা ভাল দাম দিতে চায় না। বলে, এই অজ পাড়াগাঁয়ে ও বাড়ি কিনে হবেটা কী? কথাটা সত্যি। তবে বহুকাল আগে এ গ্রাম ছিল পুরোদস্তুর একখানা শহর। এই বাড়িতে দারুব্রহ্মের যে উধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ বাস করতেন তিনিই ছিলেন এই অঞ্চলের রাজা। তখনকার আস্তাবল, দ্বাদশ শিবের মন্দির, পদ্মদিঘি, দেওয়ান ই আম, দেওয়ান ই খাস, নহবতখানা, শিশমহল সবই এখনো ভগ্নদশায় আছে। ফটকের দুধারে মরচে পড়া দু’দুটো কামানও। এতদিনে খদ্দের পাওয়া গেছে।

        টেলিফোন তুললেই একটা গম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছে, “সিক্স ফোর নাইন ওয়ান.সিক্স ফোর নাইন ওয়ান...সিক্স ফোর নাইন ওয়ান... ”         সকাল থ...

        টেলিফোন তুললেই একটা গম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছে, “সিক্স ফোর নাইন ওয়ান.সিক্স ফোর নাইন ওয়ান...সিক্স ফোর নাইন ওয়ান... ”
        সকাল থেকে ডায়াল-টোন নেই। টেলিফোনের হরেক গণ্ডগোল থাকে বটে, কিন্তু এ-অভিজ্ঞতা নূতন। গলাটা খুবই যান্ত্রিক এবং গম্ভীর। খুব উদাসীনও।
        প্রদীপের কয়েকটা জরুরি টেলিফোন করার ছিল। করতে পারল না। কিন্তু কথা হল, একটা অদ্ভুত কণ্ঠস্বর কেবল বারবার চারটে সংখ্যা উচ্চারণ করে যাচ্ছে কেন? এর কারণ কী? ঘড়ির সময় জানার জন্য বিশেষ নম্বর ডায়াল করলে একটা যান্ত্রিক কষ্ঠে সময়ের ঘোষণা শোনা যায় বটে, কিন্তু এ তো তা নয়। মিনিটে-মিনিটে সময়ের ঘোষণা বদলে যায়, কিন্তু এই ঘোষণা বদলাচ্ছে না।

        ভূতনাথবাবু অনেক ধার-দেনা করে, কষ্টে জমানো যা-কিছু টাকা-পয়সা ছিল সব দিয়ে যে পুরোনো বাড়িখানা কিনলেন তা তার বাড়ির কারোর পছন্দ হল ন...

        ভূতনাথবাবু অনেক ধার-দেনা করে, কষ্টে জমানো যা-কিছু টাকা-পয়সা ছিল সব দিয়ে যে পুরোনো বাড়িখানা কিনলেন তা তার বাড়ির কারোর পছন্দ হল না। পছন্দ হওয়ার মতো বাড়িও নয়, তিন-চারখানা ঘর আছে বটে কিন্তু সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। দেয়ালে শ্যাওলা, অশ্বত্থের চারা জন্মেছে। দেয়ালের চাপড়া বেশির ভাগই খসে পড়েছে, ছাদে বিস্তর ফুটো-টুটো। মেঝের অবস্থাও ভালো নয়, অজস্র ফাটল। ভূতনাথবাবুর গিন্নি নাক সিঁটকে বলেই ফেললেন, "এ তো মানুষের বাসযোগ্য নয়।’ ভূতনাথবাবুর দুই ছেলে আর তিন মেয়েরও মুখ বেশ ভার-ভার। ভূতনাথবাবু সবই বুঝলেন। দুঃখ করে বললেন, আমার সামান্য মাস্টারির চাকরি থেকে যা আয় হয় তাতে তো এটাই আমার তাজমহল। তাও গঙ্গারামবাবুর ছেলেকে প্রাইভেট পড়াই বলে তিনি দাম একটু কম করেই নিলেন। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় এ বাজারে কি বাড়ি কেনা যায়! তবে তোমরা যতটা খারাপ ভাবছ ততটা হয়তো নয়। এ বাড়িতে বহুদিন ধরে কেউ বাস করত না বলে অযত্নে এরকম দুরবস্থা, টুকটাক মেরামত করে নিলে খারাপ হবে না। শত হলেও নিজেদের বাড়ি।’

        সেবার আমার দিদিমা পড়লেন ভারী বিপদে।         দাদামশাই রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সে আজ পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। আমার মা তখনও ছোট্ট...

        সেবার আমার দিদিমা পড়লেন ভারী বিপদে।
        দাদামশাই রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সে আজ পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। আমার মা তখনও ছোট্ট ইজের-পরা খুকী। তখন এত সব শহর নগর ছিল না, লোকজনও এত দেখা যেত না। চারধারে কিছু গাছগাছালি জঙ্গল টঙ্গল ছিল। সেই রকমই এক নির্জন জঙ্গুলে জায়গায় দাদামশাই বদলি হলেন। উত্তর বাংলার দোমোহানীতে। মালগাড়ির গার্ড ছিলেন, তাই প্রায় সময়েই তাঁকে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। কখনো একনাগাড়ে তিন চার কিম্বা সাতদিন। তারপর ফিরে এসে হয়তো একদিন মাত্র বাসায থাকতেন, ফের মালগাড়ি করে চলে যেতেন। আমার মায়েরা পাঁচ বোন আর চার ভাই। দিদিমা এই মোট ন’জন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসায় থাকতেন। ছেলেমেয়েরা সবাই তখন ছোটোছোটো, কাজেই দিদিমার ঝামেলার অন্ত নেই।

        জয়তিলকবাবু যখনই আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে আসতেন তখনই আমরা, অর্থাৎ ছোটরা ভারি খুশিয়াল হয়ে উঠতুম।         তখনকার, অর্থাৎ প্রায় ত্র...

        জয়তিলকবাবু যখনই আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে আসতেন তখনই আমরা, অর্থাৎ ছোটরা ভারি খুশিয়াল হয়ে উঠতুম।
        তখনকার, অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ বছর আগের পূর্ববঙ্গের গাঁ-গঞ্জ ছিল আলাদা রকম, মাঠ-ঘাট খাল-বিল, বন-জঙ্গল মিলে এক আদিম আরণ্যক পৃথিবী। সাপখোপ জন্তু-জানোয়ার তো ছিলই, ভূত-প্রেতেরও অভাব ছিল না। আর ছিল নির্জনতা।
        তবে আমাদের বিশাল যৌথ পরিবারে মেলা লোকজন, মেলা কাচ্চাবাচ্চা। মেয়ের সংখ্যাই অবশ্য বেশি। কারণ বাড়ির পুরুষেরা বেশির ভাগই শহরে চাকরি করত, আসত কালেভদ্রে। বাড়ি সামাল দিত দাদুটাদু গোছের বয়স্করা। বাবা-কাকা-দাদাদের সঙ্গে বলতে কি আমাদের ভাল পরিচয়ই ছিল না, তারা প্রবাসে থাকার দরুন।

        বিপদে পড়লে লোকে বলে ‘ত্ৰাহি মধুসূদন’। তা কোগ্রামের লোকেরাও তাই বলত। কিন্তু তারা কথাটা বলত মধুসূদন পণ্ডিতকে। বাস্তবিক মধুসূদন ছিল ক...

        বিপদে পড়লে লোকে বলে ‘ত্ৰাহি মধুসূদন’। তা কোগ্রামের লোকেরাও তাই বলত। কিন্তু তারা কথাটা বলত মধুসূদন পণ্ডিতকে। বাস্তবিক মধুসূদন ছিল কোগ্রামের মানুষদের কাছে সাক্ষাৎ দেবতা। যেমনি বামনাই তেজ, তেমনি সর্ববিদ্যা বিশারদ। চিকিৎসা জানতেন, বিজ্ঞান জানতেন, চাষাবাস চানতেন, মারণ উচাটন জানতেন, তাঁর আমলে গাঁয়ের লোক মরত না।
        সাঁঝের বেলা একদিন কোষ্ঠকাঠিন্যের রুগী কালাবাবু মধুসূদনের বাড়িতে পাঁচন আনতে গেছেন। গিয়ে দেখেন গোটা চারেক মুশকো চেহারার গোঁফওয়ালা লোক উঠানে হ্যারিকেনের আলোয় খেতে বসেছে আর মধুগিনী তাদের পরিবেশন করছে। লোকগুলোর চেহারা ডাকাতের মতো, চোখ চারদিকে ঘুরছে, পাশে পেল্লায় পেল্লায় চারটে কাঁটাওলা মুগুর রাখা।

        কালীচরণ লোকটা একটু খ্যাপা গোছের। কখন যে কী করে বসবে, তার কোনও ঠিক নেই। কখনও সে জাহাজ কিনতে ছোটে, কখনও আদার ব্যবসায় নেমে পড়ে। আবার আ...

        কালীচরণ লোকটা একটু খ্যাপা গোছের। কখন যে কী করে বসবে, তার কোনও ঠিক নেই। কখনও সে জাহাজ কিনতে ছোটে, কখনও আদার ব্যবসায় নেমে পড়ে। আবার আদার ব্যবসা ছেড়ে কাঁচকলার কারবারে নেমে পড়তেও তার দ্বিধা হয় না। লোকে বলে, কালীচরণের মাথায় ভূত আছে। সেকথা অবশ্য তার বউও বলে। রাত তিনটের সময় যদি কালীচরণের পোলাও খাওয়ার ইচ্ছে হয় তো, তা সে খাবেই।
        তা, সেই কালীচরণের একবার বাই চাপল, শহরের ধুলো-ধোয়া ছেড়ে দেশের বাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশে গিয়ে বসবাস করবে। শহরের পরিবেশ ক্রমে দূষিত হয়ে যাচ্ছে বলে রোজ খবরের কাগজে লেখা হচ্ছে। কলেরা, ম্যালেরিয়া, জণ্ডিস, যক্ষ্মা—শহরে কী নেই!

        নবীনবাবু গরিব মানুষ। পোস্ট অফিসের সামান্য চাকরি। প্রায়ই এখানে-সেখানে বদলি যেতে হয়। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভাবসাব নেই। প্রায়ই ধারকর্...

        নবীনবাবু গরিব মানুষ। পোস্ট অফিসের সামান্য চাকরি। প্রায়ই এখানে-সেখানে বদলি যেতে হয়। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভাবসাব নেই। প্রায়ই ধারকর্জ হয়ে যায়। ঋণ শোধ দিতে নাভিশ্বাস ওঠে। নবীনবাবুর গিন্নি স্বামীর ওপর হাড়ে চটা। একে তো নবীনবাবুর ট্যাকের জোর নেই, তার ওপর লোকটা বড্ড মেনিমুখো আর মিনমিনে। এই যে যখন-তখন যেখানে-সেখানে বদলি করে দিচ্ছে, নবীনবাবু যদি রোখাচোখা মানুষ হতেন তবে পারত ওরকম বদলি করতে? বদলির ফলে ছেলেপুলেগুলোর লেখাপড়ার বারোটা বাজছে। আজ এ স্কুল কাল অন্য স্কুল করে বেড়ালে লেখাপড়া হবেই বা কী করে?
        এবার নবীনবাবু নিত্যানন্দপুর বলে একটা জায়গায় বদলি হলেন। খবরটা পেয়েই গিন্নি বললেন, আমি যাব না, তুমি যাও। আমি এখানে বাসাভাড়া করে থাকব। আর বদলি আমার পোষাচ্ছে না বাবু!

        কদম্ববাবু মানুষটা যতটা না গরিব তার চেয়ে ঢের বেশি কৃপণ। তিনি চণ্ডীপাঠ করেন কিনা কে জানে, তবে জুতো সেলাই যে করেন সবাই জানে। আর করেন ...

        কদম্ববাবু মানুষটা যতটা না গরিব তার চেয়ে ঢের বেশি কৃপণ। তিনি চণ্ডীপাঠ করেন কিনা কে জানে, তবে জুতো সেলাই যে করেন সবাই জানে। আর করেন মুচির পয়সা বাঁচাতে। তবে আরও একটা কারণ আছে। একবার এক মুচি তার জুতো সেলাই করতে নারাজ হয়ে বলেছিল, ‘এটা তো জুতো নয়, জুতোর ভূত। ফেলে দিন গে। বাস্তবিকই জুতো এত ছেড়া আর তাপ্পি মারা যে সেলাই করার আর জায়গাও ছিল না। কিন্তু কদম্ববাবু দমলেন না। একটা গুণছুঁচ আর খানিকটা সুতো জোগাড় করে নিজেই লেগে গেলেন সেলাই করতে।
        জুতো সেলাই থেকেই তাঁর ঝোঁক গেল অন্যান্য দিকে। জুতো যদি পারা যায় তাহলে ছাতাই বা পারা যাবে না কেন? সুতরাং ছেড়া ভাঙা ছাতাটাও নিজেই সারাতে বসে গেলেন। এরপর ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ, ছুতোরের কাজ, ছুরি-কাচি ধার দেওয়া, শিল কাটানো, ফুটো কলসি ঝালাই করা, ছোটখাটো দর্জির কাজ সবই নিজে করতে লাগলেন। এর ফলে যে উনি বাড়ির লোকের কাছে খুব বাহবা পান তা মোটেই নয়। বরং তার বউ আর ছেলেমেয়েরা তার এই কৃপণতায় খুবই লজ্জায় থাকে। বাইরের লোকের কাছে তাদের মুখ দেখানো ভার হয়।

        গাঁয়ে একটা মাত্র ভাল জলের ইদারা। জল যেমন পরিষ্কার, তেমনি সুন্দর মিষ্টি স্বাদ, আর সেই জল খেলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়।        ...

        গাঁয়ে একটা মাত্র ভাল জলের ইদারা। জল যেমন পরিষ্কার, তেমনি সুন্দর মিষ্টি স্বাদ, আর সেই জল খেলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়।
        লোহা হজম হওয়ার কথাটা কিন্তু গল্প নয়। রামু বাজিকর সেবার গোবিন্দপুরের হাটে বাজি দেখাচ্ছিল। সে জলজ্যান্ত পেরেক খেয়ে ফেলত, আবার উগরে ফেলত। আসলে কী আর খেত! ছোট ছোট পেরেক মুখে নিয়ে গেলার ভান করে জিভের তলায় কি গালে হাপিশ করে রেখে দিত।
        তা রামুর আর সেদিন নেই। বয়স হয়েছে। দাঁত কিছু পড়েছে, কিছু নড়েছে। কয়েকটা দাঁত শহর থেকে বাঁধিয়ে এনেছে। তো সেই পড়া, নড়া, আর বাঁধানো দাঁতে তার মুখের ভিতর এখন বিস্তর ঠোকাঠুকি, গণ্ডগোল। কোন দাঁতের সঙ্গে কোন দাঁতের বনে না। খাওয়ার সময়ে মাংসের হাড় মনে করে, নিজের বাঁধানো দাঁতও চিবিয়ে ফেলেছিল রামু। সে অন্য ঘটনা! থাকগে।

    এবার শীতে পুপসিদের মধুপুরের বাড়ি সরগরম। কে না এসেছে! বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, মাসতুতো দিদি মুনা, মামাতো বোন কঙ্কা, টুকটুকি, এমনকি চ...

    এবার শীতে পুপসিদের মধুপুরের বাড়ি সরগরম। কে না এসেছে! বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, মাসতুতো দিদি মুনা, মামাতো বোন কঙ্কা, টুকটুকি, এমনকি চরম কাজের মানুষ ভানুমামাও। এত লোকজন দেখে বাড়ির কেয়ারটেকার ত্রিভুবনের মুখে হাসি আর ধরে না।
    আসেনি শুধু পুপসির দিদি খুকু। সদ্য খবরের কাগজের অফিসে চাকরি পেয়েছে সে, বেজায় ব্যস্ত থাকে দিনরাত। এই ফিচার, ওই রিপোর্টিং, এখানে যাওয়া, সেখানে ছোটা...। মধুপুর যাওয়ার প্রস্তাব শুনে নাক কুঁচকেছিল খুকু, অফিসের রোমাঞ্চকর কাজকর্ম ছেড়ে পাণ্ডববর্জিত পুরীতে বেড়াতে আসার তার কোনও বাসনাই নেই।

    পাহাড়ের ছায়াকে আরো কালো করে রাত্রি ঘনিয়ে এল।     আঁক-বাকাঁ পথ দিয়ে একদল যাত্রী এগিয়ে চলেছে। গরম পোশাকে সকলের আপাদমস্তক মোড়া,—কারণ ...

    পাহাড়ের ছায়াকে আরো কালো করে রাত্রি ঘনিয়ে এল।
    আঁক-বাকাঁ পথ দিয়ে একদল যাত্রী এগিয়ে চলেছে। গরম পোশাকে সকলের আপাদমস্তক মোড়া,—কারণ কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস হু-হু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে।
    একে ঘন কুয়াশা, তার উপরে আবার রাতের অন্ধকার। তবু তারই ভিতরে কোনরকমে চোখ চালিয়ে দূরের সরাইখানার মিটমিটে আলো দেখে পথিকদের ক্লান্ত, শীতার্ত মন খুসি হয়ে উঠল।
    খানিক পরেই সকলে সরাইখানার দরজার সামনে এসে হাজির হল।
    যার সরাই সে বেরিয়ে এল। পথিকদের কথা শুনে বললে, বড়ই মুস্কিলের কথা। আমার সরাইয়ের সব ঘরই যে আজ ভরতি হয়ে গেছে ...তবে হ্যাঁ, আপনার যদি আমার ঢেঁকিশালায় শুয়ে আজকের রাতটা কাটাতে রাজি হন, তাহলে আমি সে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

    পথিকরা পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখলে। হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কোনও উপায় তো নেই ! এই রাতে এই শীতে এই আঁধারে, বাইরের জনমানবশূণ্য মাঠ বা জঙ্গলের চেয়ে সরাইয়ের ঢেঁকিশালাও ঢের ভালো।
    সরাইয়ের কর্তা তাদের সকলকে নিয়ে ঢেঁকিশালায় গিয়ে ঢুকল। মস্ত ঘর—একদিকে একখানা বড় পর্দা ঝুলছে।
    সকলে মিলে খেয়ে-দেয়ে হাসি আমোদ করে যে যার লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
    যাত্রীদের ভিতরে একজন ছিল, তার নাম ওয়াংফো।
    সঙ্গীদের বিষম নাক-ডাকুনি ও ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুরের হুটোপুটি ওয়াংফোর চোখ থেকে আজ ঘুম কেড়ে নিলে।
    নাচার হয়ে শেষটা সে উঠে বসল। লণ্ঠন জ্বেলে একখানা বই বার করে পড়াশুনায় আজকের রাতটা সে কাটিয়ে দেবে বলে স্থির করলে।
    কিন্তু পড়াতেও তার মন বসল না। নিশুত রাত, বাইরের গাছপালার ভিতরে বাতাসও যেন নিবিড় অন্ধকারে ভয় পেয়ে স্তব্ধ ও স্তস্তিত হয়ে আছে।
    অত বড় ঘরে ওয়াংফোর ছোট্ট লণ্ঠনটা, টিমটিম করে জ্বলছে—সে যেন তার অালো দিয়ে অন্ধকারকেই আরো ভালো করে দেখাতে চায়!
    ক্রমে ওয়াংফোর গা যেন ছমছম করতে লাগল। তার মনে হল, ঘরের ওদিককার অন্ধকার যেন কি একটা ভীষণ আকার ধারণ করবার চেষ্টা করছে। অন্ধকার যেন পাক খাচ্ছে। ধড়ফড় করে নড়ছে।
    হঠাৎ ওয়াংফোর আবার মনে হল, পর্দার পিছনে যেন কাঠের কি একটা মড়মড় করে ভেঙে গেল। তারপরেই পর্দাখানা একটু দুলে উঠল। তারপরেই আবার সব নিসাড়।
    এসব কী কাণ্ড! ওয়াংফো আর বই পড়বার চেষ্টা করলে না। আড়ষ্ট হয়ে পর্দার পানে চেয়ে রইল, খালি চেয়েই রইল—তার চোখে আর পলক পড়ল না।
    পর্দাখানা আস্তে আস্তে একটু উপরে উঠল এবং তার পাশ থেকে বেরিয়ে এল একখানা রক্ত হীন হলদে হাত! তারপর কি যেন ছায়ার মত একটা-কিছু বাইরে এসে দাঁড়াল-সে যেন বাতাস-দিয়ে গড়া কোন মূর্তি।
    ওয়াংফোর গায়ে তখন কাঁটা দিয়েছে, মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে ! সে চ্যাঁচাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু পারলে না—কিন্তু তার হয়ে বাইরে থেকে একটা প্যাঁচা চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে রাতের আঁধারকে চিরে যেন ফালাফালা করে দিলে।
ধীরে ধীরে সেই বাতাস-দিয়ে-গড়া মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল ! ওয়াংফে তখন দেখলে, পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে অাছে একটা স্ত্রীলোকের মূর্তি !
    মূর্তিটা ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে। যাত্রীরা পাশাপাশি শুয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে, কে যে এখন তাদের ক্ষুধিত দৃষ্টি দিয়ে দেখছে, সেটা তারা টেরও পেলে না।
    মূর্তি পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। তারপর একজন যাত্রীর মুখের কাছে হেঁট হয়ে পড়ে কি যে করলে, তা কিছুই বোঝা গেল না।
    মূর্তি দ্বিতীয় যাত্রীর কাছে এসে দাঁড়াল। তার চোখ দুটো দপ, দপ করে জ্বলছে এবং মুখখানা এক ভয়ানক হাসিতে ভরা !
    মূর্তি আবার হেঁট হয়ে পড়ল এবং দ্বিতীয় যাত্রীর টুঁটি কামড়ে ধরল। ওয়াংফো আর পারলে না, বিকট চীৎকার করে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁরবেগে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল।
    পথ দিয়ে ওয়াংফো চীৎকারের পর চীৎকার করতে করতে ছুটতে লাগল—তার সেই কান-ফাটানো চ্যাঁচানির চোটে গাঁয়ের ঘরে ঘরে সকলকার ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু এ রাতে বাইরে এসে কেউ যে তাকে সাহায্য করবে, গাঁয়ের ভিতরে এমন সাহসী লোক কেউ ছিল না।
    ছুটতে ছুটতে এবং চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ওয়াংফো একেবারে গাঁয়ের শেষে গিয়ে পড়ল। তারপরেই মাঠ আর জঙ্গল।
    দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাপাতে সে একবার পিছন ফিরে চাইলে। দূরের গাঢ় অন্ধকার ফুড়ে দুটো জ্বল-জ্বলে আগুনের ভাটা তীর বেগে এগিয়ে আসছে, ক্রমেই তার দিকে এগিয়ে আসছে !
    ওয়াংফো অার একবার খুব জোরে অর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গেল।
    চীনদেশে নিয়ম আছে, কেউ মরলে পর ভালো দিন-ক্ষণ না দেখে তার দেহকে কবর দেওয়া হয় না।
    গাঁয়ের মোড়লের এক মেয়ে মারা পড়েছিল। কিন্তু ভালো দিন-ক্ষণের অপেক্ষায় তার দেহকে কফিনে পুরে সরাইখানার ঢেঁকিশালে রাখা হয়েছিল। আজ ছয়মাসের ভিতরে ভালো দিন পাওয়া যায়নি।
    সরাইখানার কর্তা সকালে উঠে যাত্রীদের খোঁজে ঢেঁকিশালায় গিয়ে দেখে, দুজন যাত্রী মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। তাদের গলায় এক-একটা গর্ত, তাদের দেহে এক ফোটা রক্ত নেই।
    পর্দা তুলে সভয়ে সে দেখলে, যে-কফিনে গাঁয়ের মোড়লের মেয়ের মড়া ছিল, তার তালা খোলা, তার ভিতরে মড়া নেই।
    তারপর গোলমাল শুনে গাঁয়ের প্রান্তে গিয়ে সে দেখলে, ওয়াংফোর মৃতদেহের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে—মোড়লের মেয়ের মড়া! ওয়াংফোর গলায় একটা গর্ত আর মড়ার মুখে লেগে আছে চাপ চাপ রক্ত!

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

    মা বললেন, ওরে আজ অগস্ত্য যাত্রা। আজকে বিদেশে যেতে নেই।     সুটকেশটা গোছাতে গোছাতে আমি বললুম, কেন বল দেখি? আজ বিদেশে গেলে কি হয়?     মা ...

    মা বললেন, ওরে আজ অগস্ত্য যাত্রা। আজকে বিদেশে যেতে নেই।
    সুটকেশটা গোছাতে গোছাতে আমি বললুম, কেন বল দেখি? আজ বিদেশে গেলে কি হয়?
    মা বললেন, ‘আজকে যাত্রা করে অগস্ত্যমুনি আর ফিরে আসেননি।
    আমি বললুম, অগস্ত্যমুনির বৌ ভারি কোঁদল করত। তার ভয়েই “এই অাসি” বলে তিনি পিঠটান দিয়েছিলেন।
    মা প্রতিবাদ করে বললেন, কৈ, শাস্তরে তো সে কথা লেখে না!
    আমি বললুম, শাস্ত্রে সে কথা লিখলে অগস্ত্যমুনির বউ মানহানির মামলা এনে শাস্ত্রকারকে জব্দ করে দিতেন যে! কাজেই শাস্ত্রকাররা সে কথা চেপে গিয়েছেন।

    মা বললেন, না রে, না। বিন্ধ্য-পাহাড় —
    আমি বাধা দিয়ে বললুম, থাক মা, ও-গল্প আমিও জানি। তোমার কোন ভয় নেই মা, মাসখানেক ভারতবর্ষের বুকে বেড়িয়ে আবার আমি ঠিক ফিরে আসবই। তোমার মত মাকে ছেড়ে কোন ছেলে কি ঘর ভুলে থাকতে পারে? এই নাও, একটা প্রণাম নিয়ে হাসিমুখে আমাকে আশীৰ্বাদ কর।
    মা খুঁৎ খুঁৎ করতে করতে আমাকে আশীৰ্বাদ করলেন।
    যতীন আর আমি, দুই বন্ধুতে দেশ বেড়াতে বেরিয়েছি। যতীন পড়ে ল-কলেজে, আর আমি মেডিকেল কলেজে।
    হাওড়া ইষ্টিশানে গিয়ে একটা সেকেণ্ড কেলাস কামরায় ঢুকলুম। এ-সময়ে কেউ বেড়াতে যায় না বলেই আমরা বেড়াতে বেরিয়েছি। গাড়ীতে ভিড় থাকবে না, দিব্যি ধীরে-সুস্থে শুয়ে-বসে হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে যেতে পারব। পূজোর সময়ে আর বড়দিনে বেড়াতে যাওয়ার পায়ে নমস্কার। সে কি বেড়াতে যাওয়া, না নরক যন্ত্রণা ভোগ করা?
    প্রথমেই আমাদের বেনারসে যাবার কথা,—সেখানে গিয়ে পৌছাব, কাল প্রায় দুপুরে। সারা রাত ট্রেনেই কাটাতে হবে। কাজেই আমাদের কামরায় লোক নেই দেখে ভারি আনন্দ হল। বাইরের কোন লোক আসবার আগেই তাড়াতাড়ি দুখানা বেঞ্চে দুটে বিছানা বিছিয়ে আমরা দুজনেই শুয়ে পড়লুম।
    শুয়ে শুয়ে দুই বন্ধুতে অনেক গল্প হল। তারপর ট্রেন যখন বর্ধমান পার হল, যতীন উঠে আলো নিবিয়ে দিলে। খানিকক্ষণ পরে অন্ধকারেই যতীনের নাক-ডাকার আওয়াজ শুনতে শুনতে আমারও চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল।
    কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, আচমকা আমার ঘুম ভেঙে গেল। কে আমার গা ধরে নাড়া দিচ্ছে। ধীরে ধীরে উঠে বসলুম—সঙ্গে সঙ্গে সামনের বেঞ্চ থেকে যতীনও ধড় মড় করে উঠে বসল। আমি বললুম, যতীন, আমার ঘুম ভাঙালে কেন?
    যতীন বললে, আমিও তোমাকে ঠিক ঐ কথাই জিজ্ঞাসা করতে চাই।
    —তার মানে?
    —তুমি তো আমার গা ধরে নাড়া দিচ্ছিলে?
    আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সে কি হে, আমি তো দিব্যি আরামে ঘুমিয়েছিলুম, তুমিই তো আমার গা-নাড়া দিয়ে আমাকে তুলে দিলে!
    যতীন হেসে বললে, বাঃ, বেশ লোক যাহোক। নিজে আমাকে ধাক্কা মেরে তুলে দিয়ে আবার আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে?
    আমি বললুম, না ভাই, সত্যি বলছি, আমি এখান থেকে এক পা নড়িনি। তোমাকে আমি ধাক্কা তো মারিইনি বরং আমাকেই তুমি ধাক্কা মেরেছ। আমার সঙ্গে ঠাট্ট হচ্ছে বুঝি?
    যতীন গম্ভীর স্বরে বললে, গাড়ীতে আর জনপ্রাণী নেই, আমাদের দুজনকে তবে ধাক্কা মারলে কে? চোর-টোর আসেনি তো?
    শুনেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে আমি আবার আলো জ্বেলে দিলুম। এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে দেখলুম কামরায় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই এবং আমাদের মোটমাটগুলোর একটাও অদৃশ্য হয়নি।
    যতীন বললে, নিশ্চয়ই চোর এসেছিল। ভাগ্যে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল, তাই চুরি করবার আগেই তাকে সরে পড়তে হয়েছে। বড় বেঁচে যাওয়া গেছে হে।
    আমি বললুম, জানলাগুলো সব বন্ধ করে দাও, আর আলো নিবিয়েও কাজ নেই। আচ্ছা জ্বালাতন!
    আবার খানিকক্ষণ বসে বসে গল্প হল। তারপর আবার দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লুম।

    কিন্তু আবার ঘুম গেল ভেঙে।
    এবারে কেউ আর আমাকে ধাক্কা মারছিল না, এবারে কামরার ভিতর থেকে পরিত্রাহি স্বরে একটা কুকুর আর্তনাদ করছিল।
    আলো জ্বালিয়ে শুয়েছিলুম, কিন্তু উঠে দেখি, কামরার ভিতরে ঘুটবুট করছে অন্ধকার।
    অন্ধকারে যতীনের গলা পেলুম, সে বললে, এ আবার কি ব্যাপার। আজ কি রাজ্যের আপদ এইখানেই এসে জুটেছে?
    কুকুরটা যেভাবে চ্যাঁচাচ্ছে তাতে মনে হল, সে যেন ভয়ানক জখম হয়েছে। কিন্তু কামরার জানলা-দরজা সব বন্ধ, সে ভিতরে এলই বা কেমন করে?
    কুকুরটা হঠাৎ একবার খুব জোরে কেঁউ-কেঁউ করে চেঁচিয়েই একেবারে চুপ মেরে গেল।
    আমি বললুম, যতীন, আলো নেবালে কে?
    যতীন বললে, জানি না তো! আমি ভাবছিলুম, তুমিই নিবিয়েছ?
    —কুকুরটা ভিতরেই আছে। বেঞ্চি থেকে পা নামানো হবে না, ব্যাটা যদি খ্যাক্ করে কামড়ে দেয়! তোমার টর্চটা কোথায়?
    —আমার পাশে ই আছে।
    — জ্বলে দেখ তো, কুকুরটা কোথায় আছে?
    যতীন টর্চ জ্বেলে দেখতে লাগলো, আর আমি আমার মোটা লাঠিগাছটা মাথায় তুলে প্রস্তুত হয়ে রইলুম, কুকুরটা যদি তেড়ে আসে তাহলে তখনি তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেব।
    কিন্তু কামরার কোথাও কুকুরটাকে আবিষ্কার করা গেল না। এখানে কুকুর-টুকুর কিছুই নেই।
    ‘সুইচে' র কাছে গিয়ে দেখি, সুইচ টেপাই আছে। আমি বললুম, সম্ভব। কিন্তু এই যে এখনি কুকুরটা চ্যাঁচাচ্ছিল সে এলই বা কেমন করে আর গেলই বা কেমন করে?
    যতীন বললে, কুকুরটা বোধহয় পাশের কামরা থেকে চ্যাঁচাচ্ছিল। আমরা ঘুমের ঘোরে ভুল শুনেছি।
    আমি বললুম, ঠিক বলেছ। কিন্তু আজকে ঘুমের দফায় ইতি। এস, বসে বসে গল্প করা যাক ৷—এই বলে আমি বসে পড়লুম—
    এবং মনে হল, সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশেই ঠিক যেন আর একজন কে বসে পড়ল।
    নিবিড় অন্ধকারে কামরার ভিতরে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বললুম, নিজের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উঠে এলে যে যতীন?
    ওপাশের বেঞ্চি থেকে যতীন বললে, কৈ, আমি তো এখান থেকে উঠিনি!
    আমার পাশে হাত বাড়িয়ে দেখলুম, কৈ, কেউ তো সেখানে নেই!
    তারপরেই শুনতে পেলুম, আমার কানে কি ফিসফিস করে কথা কইছে। কি যে বলছে, তা বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু কথা যে কেউ কইছে, সে-বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই!
    হঠাৎ যতীন বললে, মোহন, তুমি কোথায়?
    আমি আড়ষ্টভাবে বললুম, আমার বিছানায়।
    যতীন সভয়ে বললে, তবে আমার কানে কানে কথা কইছে কে?
    জবাব না দিয়ে দু-পাশে হু-হাত বাড়িয়ে দিলুম, কিন্তু কারুর গায়ে হাত লাগল না। অথচ তখনো আমার কানের কাছে মুখ এনে কে ফিসফিস করছে।
    ডাক্তারি পড়ি, রোজ দু-হাতে টাটকা বা পচা মড়ার দেহে হাসিমুখে ছুরি চালাই, গভীর রাত্রে একলা মড়ার পাশে আম্লানবদনে বসে থাকি, স্বপ্নেও কখনো ভূত দেখিনি, তবু কেন জানি না, আজকে এই অন্ধকারে আমার সর্বাঙ্গ কি একটা অজানা ভয়ে পাথরের মূর্তির মত স্থির ও ঠাণ্ডা হয়ে গেল,—একখানা হাত নাড়বার শক্তিও আর রইল না।
    যতীনেরও বোধহয় সেই অবস্থা। সে প্রায় কান্নার স্বরে বললে, ‘মোহন, মোহন, কামরার ভেতরে কারা সব এসেছে, কে আমার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা কইছে,—ঐ শোনো, কে আবার চলে বেড়াচ্ছে!
    সত্যি কথা! ঘরময় কে চলে বেড়াচ্ছে, খট, খট, খট, খট, খড়মড়, খড়মড়, খড়মড়! এ যেন কোন মাংসহীন হাড়ের আওয়াজ!
    এ ভীষণ আওয়াজ আমি জানি, কঙ্কালকে নাড়লে ঠিক এমনি অস্থিঝঙ্কার জেগে ওঠে।
    কিন্তু তখন আর আমার নড়বার শক্তি নেই, কে যেন কি যাদু মন্ত্র পড়ে আমার সমস্ত দেহকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিয়েছে। আচম্বিতে আর এক ব্যাপার! কামরার এক কোণ থেকে মেয়ে-গলায় কে উ-উ-উ-উ করে কাঁদতে লাগল!
+++++++++++++++++++
    কানের কাছে সেই ফিসফিস কথা, ঘরময় কঙ্কালের সেই চলা ফেরার খট্‌খটানি, এককোণ থেকে মেয়ে-গলায় সেই উ-উ-উ-উ করে কান্না—গাঢ় অন্ধকারে ডুবে, আড়ষ্টভাবে বসে বসে একসঙ্গে এইসব শুনতে লাগলুম। যতীনের কোন সাড়া নেই, সে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়নি তো?
    ও আবার কি? মার্বেলের গুলির মত দুটো জ্বলন্ত রক্তের মত কি চারিদিকে ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছে ! কী ও-দুটো? অন্ধকারের অগ্নিময় চক্ষু?
    চোখ দুটো ভাসতে ভাসতে আমার কাছ থেকে হাত তিনেক তফাতে এসে শূণ্যে স্থির হয়ে রইল। যেন আমাকে খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করছে। দেখতে দেখতে সেই আগুন-চোখ ফুটোর রং নীল হয়ে এল। রক্ত-রঙে যে চোখ দুটোকে দেখাচ্ছিল ক্রুদ্ধ, নীলরঙে তাদের দেখাতে লাগল বিষাক্ত।
    হঠাৎ কেমন-একটা বিদ্যুৎ-প্রবাহ এসে আমাকে চাঙ্গা করে দিলে। এক মুহূর্তে আমার সব মোহ কেটে গেল—আমি একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে, অন্ধকারের ভিতরেই দু-হাতে দুদ্দাড় ঘুসি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাগলের মত চেঁচিয়ে উঠলুম—আমি তোদের ভয় করি না, আমি তোদের ভয় করি না, আমি তোদের কারুকে ভয় করি না, সরে যা, সরে যা সব-আমি তোদের কারুকে ভয় করি না।
    তৎক্ষণাৎ কামরার ইলেকট্রিক লাইট আবার দপ করে জ্বলে উঠল।
    নিজের বিছানায় বসে যতীন ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে। তারও অবস্থা আমার চেয়ে ভালো নয়।
    কামরার ভিতরে আর সেই আগুন-চোখ দেখা গেল না—কোনরকম শব্দ বা কান্নার আওয়াজও কানে এল না। আমরা দুজন ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই।
    হাঁপাতে হাঁপাতে যতীনের পাশে গিয়ে বসে পড়লুম। যতীন অফুট স্বরে বললে, আমি কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলুম?
    আমি বললুম, আমারও তাই মনে হচ্ছে। একদিকে তাকিয়ে যতীন তীব্র স্বরে বলে উঠল, না, স্বপ্ন নয়,— ঐ দেখ।
    ঠিক যেন শূন্যকে বিদীর্ণ করে ফিনকি দিয়ে কামরার মেঝের উপরে রক্ত ছিটকে পড়ছে। তাজা, রাঙা রক্ত , রক্তে রক্তে ঘর বুঝি ভেসে যায় ! শূন্য যেন রক্ত প্রসব করছে ! ;
    আমি আর সইতে পারলুম না—‘অ্যালার্ম-কর্ড' ধরে একেবারে ঝুলে পড়লুম।
    পরমুহূর্তে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকানি দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেমে গেল।
    আমি আর যতীন এক এক লাফে ট্রেন ছেড়ে বাইরে গিয়ে পড়লুম।
    গার্ড এসে জিজ্ঞাসা করলে, তোমরা ট্রেন থামিয়েছ?
    আমি বললুম, হ্যাঁ।
    —কেন?
    —গাড়ীর ভেতরে আমাদের জীবন বিপন্ন হয়েছিল। আসল ব্যাপারটা কি, তা আমি বলতে চাই না। কিন্তু ও-কামরার ভেতরে আমরা যদি আর কিছুক্ষণ থাকতুম, তাহলে হয় পাগল হয়ে যেতুম, নয় মারা পড়তুম।
    গার্ড খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইল । তারপর বললে, বাবু, তোমার অসংলগ্ন কথার অর্থ আমি বুঝতে পারলুম না। তুমি কি বলতে চাও, ভালো করে বুঝিয়ে বল।
    যতীন বললে, ও-কামরায় ভূত আছে?
    গার্ড হো হে করে হেসে বললে, কামরায় ভূত? এ একটা নতুন কথা বটে। বাঙালী-বাবুদের মাথা খুব সাফ, ট্রেনের কামরাতেও তারা ভূত আবিষ্কার করে।
    আমি বললুম, ভূত কিনা জানি না, কিন্তু ও-কামরার ভেতরে আমরা এমন সব বিভীষিকা দেখেছি, যা স্বাভাবিক নয়।
    গার্ড বললে, ‘অ্যালার্ম-কর্ড টেনে, বাজে কথা বলে তোমরা এখন আইনকে ফাঁকি দিতে চাও? ওসব চালাকি আমার কাছে চলবে না, তোমাদের জরিমান দিতে হবে।
    আমি বললুম, সাহেব, আমরা জরিমান দিতে রাজি আছি, তবু ও-কামরায় আর ঢুকতে রাজি নই।
    আমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেল! কামরার ভিতর থেকে আমাদের জিনিসপত্তরগুলো সবেগে বাইরে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল—ট্রাঙ্ক, সুট কেশ, ব্যাগ ও পোঁটলা পুঁটলী প্রভৃতি। ঠিক যেন কে সেগুলোকে বাইরে ছুড়ে দিচ্ছে! গার্ড-সাহেব মাথা হেঁট করে তাড়াতাড়ি মাটির উপরে বসে পড়ল— নইলে যতীনের স্টীলট্রাঙ্কটা নিশ্চয়ই তার মাথা চূৰ্ণ করে দিত।
    গার্ড চ্যাঁচাতে লাগল, এই, পাকড়ো—পাকড়ো!
    একদল রেল-পুলিশ ও কুলি হুড়মুড় করে কামরার ভিতরে গিয়ে ঢুকল এবং বলা বাহুল্য, সেখানে জনপ্রাণীর আধখানা টিকি পর্যন্ত দেখা গেল না।
    গার্ড উত্তেজিত, ভীত কণ্ঠে আমাদের বললে, বাবু, ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। ট্রেন লেট হয়ে যাচ্ছে, এখন আর বোঝবার সময়ও নেই—তবে তোমাদের কথাই সত্যি বলে মনে হচ্ছে। আপাততঃ তোমরা অন্য কোন কামরায় উঠে পড়, আমি ট্রেন চালাবার হুকুম দেব।
    পাশের যে ইন্টার-কেলাসে গিয়ে আমরা উঠলুম, তার মধ্যে অনেক লোক,—সকলেই আমাদের কথা শোনবার জন্যে ব্যগ্ৰ।
    যতটা সংক্ষেপে পারা যায়, তাদের কাছে আমাদের বিপদের কাহিনী বর্ণনা করলুম।
    একটি আধ-বুড়ো ভদ্রলোক, পোশাক দেখে তাকে রেলকর্মচারী বলে চেনা গেল, আমাদের কাছে এসে বললেন, মশাই, গেল বৎসরে এই ট্রেনের এক কামরায় একটা ভীষণ হত্যাকাণ্ড হয়েছিল।
    আমি বললুম, তার সঙ্গে এ-ব্যাপারের কি সম্পর্ক?
    —সম্পর্ক? সম্পর্ক হয়তো কিছুই নেই, তবু শুনুন না। রাণীগঞ্জে গাড়ী থামলে পর দেখা গেল, একটা সেকেণ্ড কেলাস কামরার ভিতরে দুজন পুরুষ, একজন স্ত্রীলোক, একটি শিশু আর একটা কুকুরের মৃতদেহ রক্তের মধ্যে প্রায় ডুবে আছে। কিন্তু কে বা কারা এতগুলো প্রাণীকে খুন করলে, তার কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না।
    আমি রুদ্ধশ্বাসে বললুম, একটা কুকুরও ছিল?.
    তারপর?
    —তার কিছুদিন পরে ঐ কামরাতেই তিনজন সায়েব হাওড়া থেকে আসছিল। কিন্তু রাণীগঞ্জেই তারা গাড়ী থেকে নেমে পড়ে স্টেশন-মাষ্টারের কাছে অভিযোগ করে যে, কামরার অালো নিবিয়ে দিয়ে কারা তাদের ভয়ানক ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও যারা ভয় দেখিয়েছিল তাদের পাত্তা পাওয়া গেল না।
    যতীন বললে, ভূতকে কখনো খুজে পাওয়া যায়? মানুষকেই ভূতেরা খুজে বার করে।
    তিনি বললেন, তারপর প্রায়ই ঐরকম সব অভিযোগ হতে লাগল। আর লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, অভিযোগ হয়েছে প্রত্যেকবারই রাণীগঞ্জ স্টেশনে,—কেবল আপনারাই রাণীগঞ্জ পার হতে পেরেছেন।
    যতীন বললে, ‘হ্যাঁ, রাণীগঞ্জ কেন, আর-একটু হলেই আমাদের ভবনদীর পারে যেতে হত।
    আমি বললুম, যতীন, মায়ের কথা আর কখনো ঠেলব না। সত্যিসত্যিই আজকের যাত্রা অশুভ।

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

    নেড়াদের বেলতলায় ছিল ভূতের মস্ত বড় আড্ডা। গেছো ভূত, মেছো ভূত, মামদো ভূত, সিটকে ভূত, শাকচুন্নী—সব কিছু কায়েমিভাবে বাসা বেঁধেছিল ঐ বে...

    নেড়াদের বেলতলায় ছিল ভূতের মস্ত বড় আড্ডা। গেছো ভূত, মেছো ভূত, মামদো ভূত, সিটকে ভূত, শাকচুন্নী—সব কিছু কায়েমিভাবে বাসা বেঁধেছিল ঐ বেলগাছটার তলায়।
    নামেই ওটা বেলতলা, কিন্তু হিজল, তেঁতুল, তাল, তমাল—অনেকরকম গাছের মিলন ঘটেছে সেখানে। অর্থাৎ ভূতপ্ৰেতরা যে সব গাছে থাকতে ভালোবাসে সে সব গাছের মোটেই অভাব নেই। কাজেই ভূতদের ওখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
    দিনের বেলাই ওপথ দিয়ে যেতে বুক ধড়ফড় করে। আর রাতের বেলা...একা গেলে কাউকে আর প্রাণ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে না।

    এই তো সেদিন হরু ঠাকুরের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল তার ভাগনে চেতন ঠাকুর। ঠিক দুক্কুর বেলা। নেড়াদের বেলতলার কাছাকাছি যেই এসেছে অমনি তিনটে ভূত সুড়সুড় করে গাছ থেকে নেমে এসে বলল—পেন্নাম হই ঠাকুর। আপনি বুঝি এ গাঁয়ে নতুন এলেন?
    চেতন ঠাকুর তো চমকে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দিনের বেলায় ভূত—এ যেন সে বিশ্বাস করতেই চাইল না। কিন্তু না বিশ্বাস করেই বা উপায় কি? চোখের সামনে জলজ্যান্ত ভূত। তাই তার মাথা গেল ঘুলিয়ে।
    ভূতরা খ্যানখেনে গলায় বলল—কি, আমাদের কথা বুঝি মশাইর কানেই যাচ্ছে না? বলি এ গাঁয়ে কি নতুন এলেন?
    চেতন ঠাকুরের তো চেতনা হারাবার যোগাড়। চোখ ছানাবড়া করে আমতা আমতা করে বলল— অ্যাঁ, অ্যাঁ হ্যাঁ—নতুন এসেছি।
    হাতে ওটা কি? ইলিশ মাছ বুঝি? একটি ভূত চেতন ঠাকুরের হাতে ঝুলানো মুখবাঁধা হাড়িটা দেখিয়ে জিগ্যেস করলে।
    অ্যাঁ—অ্যাঁ...হ্যাঁ, হ্যাঁ...চেতন ঠাকুরের এবার চেতনা হল—সত্যি হাতে হাড়ির ভেতর ইলিশ মাছ। মামা হরু ঠাকুর ইলিশ মাছ খেতে ভালোবাসেন বলে তার মা ইলিশ মাছ কুটে, নুন মাখিয়ে দিয়েছে।
    হেঁ—হেঁ—হেঁ...আমরা গাছের ডাল থেকেই গন্ধ পেয়েছি..আমাদের সঙ্গে চালাকি! কিন্তু মামার জন্য নিয়ে আসা ইলিশ মাছে ভাগ বসাবে এই ভূতেরা? সেটা কি প্রাণে সইবে? তাই সে বলল—না না, ইলিশ মাছ নয়!
    তবু মনে তার বড় ভয়। তাই ভূত তাড়াবার মন্ত্র আওড়াতে লাগল—
    ভূত আমার পুত
    পেত্নী আমার ঝি,
    রা-রা--রা...
    আর বলতে পারল না কিছু! সব কিছু যেন গুলিয়ে যেতে লাগল। ভূতেরা নাচতে লাগল ধেই ধেই করে।
    দাও দাও ইলিশ মাছ..
    খাব খাব ইলিশ মাছ.
    দাও দাও...
    খাব...খাব...
    চেতন ঠাকুর মাছের হাড়িটা আড়াল করতে চাইল। কিন্তু এবার ভূত তিনটি তার চারদিকে ঘিরে শুরু করল প্রলয় নাচ।
    তোর ঘাড় মটকে খাব!
    তোর পেটটি চিরে খাব!!
    তোর হাড় চিবিয়ে খাব!!!
    চেতন ঠাকুর দেখল ব্যাপারটা সুবিধের নয়। আগে নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তাই মাছের হাড়িটা ছুড়ে ফেলেই দে ছুট। ছুটতে ছুটতে চেতন ঠাকুর একেবারে মামার বাড়িতে। আর এসেই একেবারে অচৈতন্য। মাথায় একুশ কলস জল ঢালবার পর নাকি চেতন ঠাকুরের চেতনা ফিরেছিল।
    চেতনা ফেরার পর হরু ঠাকুর ভাগনের মুখে শুনতে পেলেন সব কাহিনি। শুনেই তো চটে একেবারে আগুন। কি, ভূতের এত আম্পর্ধা! হরু ঠাকুরের ইলিশ মাছ খাবে ভূতেরা! আচ্ছা, রসো!
    হরু ঠাকুর ঝাড়ফুক মন্ত্র জানতেন অনেক। সেদিনই এক মুঠো সরষে মন্ত্র পড়ে ছড়িয়ে দিলেন বেলতলার সামনে। আর যায় কোথায়! হুড় হুড় করে গাছ থেকে নেমে এল ভূতের দল। আর কি নাচন-কুঁদন!
    হরু ঠাকুর বললেন—আমার ইলিশ মাছ নিয়েছিস কেন?
    ভূতেরা বলল—আপনার ইলিশ মাছ নেব কেন ঠাকুর? সে তো একটা উটকো লোকের মাছ!
    হরু ঠাকুর বললেন—আমার ভাগ্নের মাছ। আমার জন্যই তো এনেছিল।
    ভূতেরা বলল—দোহাই ঠাকুর। তোমার মাছ জানলে নিতাম না। এখনো সে মাছ খাইনি। নিয়ে যাও তোমার মাছ।
    একটি ভূত গাছের ডাল থেকে নিয়ে এল সেই হাড়ি। হরু ঠাকুর বললেন—দে, আমার এত সাধের ইলিশ মাছ! তবে তোরাও যখন আশা করেছিস, নে এর থেকে দু’চার টুকরো।
    হরু ঠাকুর নিজেই ল্যাজার আর মাথার কাছ থেকে দু’এক টুকরো পাতলা কাটাওয়ালা মাছ বেছে দিলেন।
    তবে আমাদের ছেড়ে দাও ঠাকুর। ভূতেরা কাকুতি-মিনতি করতে লাগল।
    হরু ঠাকুর আবার সরষেতে মন্ত্র ফুকে ভূতদের মুক্ত করে দিলেন। তারপর হনহন করে ইলিশ মাছের হাড়িটা নিয়ে ছুটে চললেন বাড়ির দিকে।
    ভূতেরা মুক্তি পেল বটে—কিন্তু হরু ঠাকুরের উপর মনে মনে চটে রইল। ভাবল—বাগে পেলেই তারা হরু ঠাকুরের ঘাড় মটকাবে।
    এইভাবে কেটে যায় দু’মাস—এক বছর।
    একদিন সন্ধ্যাবেলায় হরু ঠাকুর ফিরছেন কাজলগাঁয়ের হাট থেকে। হাতে ঝোলাভরতি হাটের সওদা—মাছ, তরিতরকারি আর ফলফলাদি। ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে—তাই পথে আজ লোকজন নেই।
    বেলতলার কাছ দিয়ে যেতেই একটা যেন দমকা হাওয়া বয়ে গেল। গাটা ছমছম করে উঠল হরু ঠাকুরের। হঠাৎ দুম করে একটা শব্দ হল। হরু ঠাকুর চমকে উঠেই দেখলেন—একটা ভূত লাফ দিয়ে গাছ থেকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা দুম শব্দ। দেখলেন—আরও একটা ভূত লাফিয়ে তার সামনে পড়েছে।
    হরু ঠাকুর অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন–কিরে, ব্যাপার কি?
    প্রথম ভূত হাতজোড় করে বলল—আজ্ঞে ঠাকুর মশাই, আমরা বড় বিপদে পড়েছি।
    হরু ঠাকুর জিগ্যেস করলেন—কি বিপদ?
    ভূত বলল—আজ্ঞে আমাদের বাবা গত হয়েছেন।
    কবে?
    এই মঙ্গলবারে অমাবস্যার দিন।
    কি হয়েছিল?
    ঐ বাগদীপাড়ায় হাতিমাথাওলা বাগদীর উপর ভর করতে গিয়ে—
    হাতিমাথাওলা বাগদী? সে আবার কে?
    ঐ যে গো—তোমরা আবার ঠাকুর-দেবতার নাম রাখো কিনা—সে সব নাম যে আমাদের নিতে নেই—ঐ যে সেই গাঁজাখোর দেবতার ছেলের নাম—
    ওঃ, সেই গণেশের কথা বলছিস? গণেশ বাগদী?
    হ্যাঁ গো হ্যাঁ। ওর উপর ভর করতে গিয়েই তো এমন পেট খারাপ হল যে সেদিন রাত্রেই একেবারে অক্কা।
    হরু ঠাকুর মৌখিক শোক প্রকাশ করে বললেন—আহা, তোর বাবা মরে গেল! বড় ভালো লোক ছিল রে!
    ভূত গদগদ স্বরে বলল—হ্যাঁ কর্তা, বাবা তো আপনাকে খুব ভালোবাসত। তাই বলছি কি, তার সৎকাজটাও আপনি করে দিন।
    হরু ঠাকুর অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন—মানে? কি করতে বলিস আমাকে?
    আজ্ঞে বাবার শ্রাদ্ধটা শুদ্ধ ভাবে করতে চাই। আমরা তো আর তত্তর-মস্তর জানি না। কাজেই পুরোতগিরির কাজটা আপনাকেই করতে হবে।
    একথা শুনে হরু ঠাকুরের বুকটা টিপটিপ করতে লাগল। সর্বনাশ! মানুষ হয়ে করবেন ভূতের পুরোতগিরি!
    চোখে তিনি আকাশ-পাতাল দেখতে লাগলেন। এদিকে দুমদাম শব্দ করে আরও কয়েকটি ভূত গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ল। সবাই ঘিরে ধরল হরু ঠাকুরকে। বলল—ঠাকুর মশাই! রাজি হতেই হবে—নইলে পথ ছাড়ব না।
    হরু ঠাকুর দেখলেন—এ এক বিষম সংকট! এখন স্বীকার না হয়েও কোনো উপায় নেই। তাছাড়া পথে-ঘাটে রাত-বিরেতে কতরকম বিপদ ঘটতে পারে। কাজেই এদের মন খুশি না করলেও চলে না। তাছাড়া একটা বুদ্ধি করে বাঁচতে হবে। তাই জিগ্যেস করলেন—তোদের বাবার শ্রাদ্ধ কবে?
    আজকেই। সে কি রে! সন্ধ্যা তো হয়ে এল। সন্ধ্যাবেলা কি শ্রাদ্ধ হয়? দিনের বেলা তো শ্ৰাদ্ধ
করতে হয়।
    আপনাদের মানুষদের শ্রাদ্ধ হয় দিনের বেলা। আমাদের শ্রাদ্ধ রাত্তির বেলাতেই হয় কর্তা! হরু ঠাকুর দেখলেন মহা বিপদ। স্বীকার না হয়েও উপায় নেই। তাই বললেন—শ্ৰাদ্ধ করা তো মুখের কথা নয়। যোগাড়যন্তর সব করতে হবে—তবে তো—
    ভূতেরা বলল—আমাদের যোগাড়যন্তর সব ঠিক আছে কর্তা। আপনি বসে গেলেই হল। খাবারদাবারও সব তৈরি।
    হরু ঠাকুর দেখলেন—সত্যি গাছের তলায় বড় বড় মানকচুর পাতায়, মরা মানুষের মাথার খুলিতে কত সব জিনিসপত্তর সাজানো। কেঁচোর চড়চড়ি, মরা ইঁদুরের ঘণ্ট, শুকনো মরা কাকের কাবাব, আরো কত কিছু—
    হরু ঠাকুর ওসব দেখে বললেন—সত্যি তোরা পেল্লায় আয়োজন করেছিস্ রে! গাছের তলায় টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। একটু পরেই হরু ঠাকুর বুঝলেন—ওটা বাতি নয়। কতগুলো জোনাকি পোকা ধরে গোবরের মধ্যে গুজে রাখা হয়েছে—তার মধ্য থেকেই ঠিকরে বেরুচ্ছে সেই আলো ।
    একটা জায়গা নিকিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। একটা খড়ের আসনও পাতা হয়েছে সেখানে। একটি ভূত বলল—এখানে বসুন কর্তা।
    হরু ঠাকুর সেখানে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেছে। আজ বুঝি ভূতের হাতেই বেঘোরে প্রাণটা যায়!
    হঠাৎ হরু ঠাকুরের মাথায় একটা বুদ্ধি গজাল। তিনি বললেন—আরও একটা আসন লাগবে যে ! যে পিণ্ডি দেবে তাকেও তো এখানে বসতে হবে।
    সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল হল। একটা ভূত হাত বাড়িয়ে দিল—সেই হাতটা লম্বা হতে হতে গিয়ে ঠেকল জলার ধারের কাশবনে—সেখান থেকে এক মুঠো কাশ ছিড়ে আনল। চোখের নিমেষে আসন তৈরি হয়ে গেল। চোখ ছানাবড়া করে হরু ঠাকুর ব্যাপারটা দেখলেন।
    পাশেই আসন পাতা হয়ে গেল। হরু ঠাকুর বললেন—তোরা একজন এখানে বোস, মন্ত্র পড়তে হবে।
    একটা ভূত এগিয়ে এসে জিগ্যেস করল—পিণ্ডি দেবার সময় ঐ আকাশের ওপরে যারা থাকে তেনাদের নাম বলতে হবে না তো?
    হরু ঠাকুর বললেন—কাদের নাম? ওঃ, সেই দেবতাদের নাম? না না, তা বলতে হবে না।
    হরু ঠাকুরের হাতে যে ঝোলাটা ছিল তাতে ছিল অনেক খাবার-দাবার। সেটার উপর দৃষ্টি সব ভূতেরই পড়েছিল—আর লোভও ছিল সকলেরই। তারা ভেবেছিল ঠাকুরমশাই যেই মন্ত্র পড়তে আসনে গিয়ে বসবেন তখনই ঐসব জিনিসের সদগতি করবে। কাজেই হরু ঠাকুর ঝোলাটা পাশে রেখে আসনে বসতেই কয়েকটি ভূত উঁকিঝুকি মারতে লাগল।
    হরু ঠাকুর তা বুঝতে পেরে বললেন—শোন সবাই তোরা উপূস করে আছিস তো? শ্ৰাদ্ধ শেষ না হওয়া অবধি উপুস থাকতে হয়।
    এবার আর কোনো ভূতের মুখে রা নেই।
    হরু ঠাকুর বললেন—আমার ঝোলায় আছে সন্দেশ, মিহিদানা, গজ আর দরবেশ। তোদের শ্রাদ্ধের জন্যই এনেছি। যে উপুস থেকে শ্রাদ্ধের মন্তর পড়বে সে-ই শুধু ওগুলো খাবে। অন্য কারুর আজ ওসব খেতে একেবারে নিষেধ।
    কথা শেষ করতে না করতে একটি সিটকে ভূত আসনের উপর গিয়ে বসে পড়ল। বলল— আমি মন্তর পড়ব।
    সঙ্গে সঙ্গে আর একটি মামদো ভূত তাকে টেনে তুলে ফেলল। বলল—কি, তুই পড়বি মস্তর? তুই উপুস করেছিস?
    করিনি?
    হুম, গয়লাবাড়ির গরুর বাচ্চাটাকে আজ খেল কে? ওঠ ওঠ, আমি মস্তর পড়ব। বলেই দুপ করে মামদো ভূত আসনে বসে পড়ল।
    অমনি পাশ থেকে একটা মেছে ভূত তার গালে বসিয়ে দিল একটা থাপ্পড়। বলল—কি, তুই পড়বি মস্তর? তুই আবার উপুস করলি কখন? পচা ডোবা থেকে পচা শামুকগুলো তুলে খেয়েছিস না? যা যা—আমি পড়ব মস্তর!
    হঠাৎ গাছ থেকে আর একটা গেছে ভূত লাফ দিয়ে ওর ঘাড়ের উপর পড়ে বলল—ফের মিছে কথা বলছিস গোবরা? তুই আবার কোথাকার উপোসী? আজ সকাল বেলাতেই তো গোসাইদের আঁস্তাকুড় ঘেটে কত কিছু খেয়ে এলি। মন্তর যদি পড়ি তো আমিই পড়ব।
    গোবরাও ছাড়বার পাত্র নয়। সে বিরাশি সিন্ধা ওজনের এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল গেছে ভূত নন্টের গালে। বলল—আমার উপর কর্তালি করতে আসিস কোন সাহসে রে? তুই কি খেয়েছিস আমি দেখিনি?
    কি খেয়েছি?
    ব্যাঙ খেয়েছিস। ওদিকে আগের ভূতগুলোও হাতাহাতি শুরু করে দিয়েছে। তুমুল হাতাহাতি। যে আসনে বসতে চায় তাকেই মারে। চোখের নিমেষে এক প্রলয় কাণ্ড বেঁধে গেল।
    হরু ঠাকুর বুঝলেন, এই সুযোগ। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে ঝোলাটা হাতে নিয়েই সেখান থেকে ছুট্‌। মুখে মুখে রামনাম আওড়াতে লাগলেন। যত দূরে যান ততই জোরে জোরে রাম রাম বলে চেঁচান। ভয় যেন আর কাটে না। শেষ অবধি বাড়িতে এসে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

    আমি যতই বলি ভূত নেই, ও-সব স্রেফ গাঁজার কলকে, কেষ্টা ততই চেঁচাতে থাকে।     —যেদিন ঘাড় মটকে দেবে, সেদিন টের পাবি, বুঝলি?     —আরে যাঃ যাঃ...

    আমি যতই বলি ভূত নেই, ও-সব স্রেফ গাঁজার কলকে, কেষ্টা ততই চেঁচাতে থাকে।
    —যেদিন ঘাড় মটকে দেবে, সেদিন টের পাবি, বুঝলি?
    —আরে যাঃ যাঃ ...একটা চীনেবাদামের খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে আমি বললাম—রেখে দে তোর ভূত। আমার কাছে এসেই দেখুক না বাছাধন, আমি নিজেই তার ঘাড় মটকে দেব।

    কেষ্টা চেঁচাতে লাগল—দেখা যাবে—দেখা যাবে। যেদিন আমগাছে এক ঠাং আর দূরের তালগাছের মাথায় আর-একটা ঠ্যাং চাপিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে, সেদিন আর চ্যাঁ-ভাঁ করতে হবে না, বুঝলি? এখন ঘুঘু দেখেছিস, তখন ফাঁদ দেখবি।
    —ওসব নওগাঁ ব্র্যান্ড শিকেয় তুলে রাখ। ..আমি সংক্ষেপে মন্তব্য করলাম।
    কেষ্টা বললে—তুই পাষণ্ড, তুই নাস্তিক।
    আমি বললাম—হতে পারে। তাই বলে তুই অমন ষণ্ডের মত চাঁচাবি, এর মানে কী?
    কেষ্টা রাগে ভোঁ-ভোঁ করতে করতে উঠে যাচ্ছিল, এমন সময় বাঞ্ছা কোত্থেকে এসে তার হাত চেপে ধরলে। বললে—আহাহা চটছিস কেন? সবাই তো প্যালা হতভাগার মত নাস্তিক নয়। আমি নিজে বলছি, স্বচক্ষে ভূত দেখেছি আমি।
    —সত্যি?
    —কেষ্টার হাসি গাল ছাপিয়ে কান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুল।
    আমি বললাম—বাজে।
    —বাজে। তবে শোন। শুনে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন কর। কিন্তু কেষ্টা, তার আগে কিছু খাওয়াতে হবে মাইরি। বড্ড খিদে পেয়েছে।
    এমনিতে কেষ্ট হাড়-কেপ্লন। কাউকে এক পয়সা খাওয়ানো তো দূরের কথা, সব সময়েই পরস্মৈপদীর তালে আছে। কিন্তু ভূতের মহিমাই আলাদা। সঙ্গে সঙ্গে এক টাকার ফুলকপির সিঙাড়া আর জলযোগ’-এর সন্দেশ চলে এল। সেগুলোর অদ্ধেকের ওপর একাই সাবাড় করে, বড় গোছের একটা ঢেকুর তুলে বাঞ্ছা বললে—তবে শোন :
    বছর তিনেক আগের কথা। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছি। গ্রামটা হল কালনার কাছাকাছি, একেবারে গঙ্গার ধারে। খাসা জায়গা। যেমন খাওয়া-দাওয়া, তেমনি আরাম। দু মাসের মধ্যেই আমি মুটিয়ে গেলাম।
    বেশ আছি, আরামে দিন কাটছে। এমন সময় এক অঘটন। পাশের বাড়ির হরিশ হালদার এক বর্ষার রাত্রিতে পটল তুলল।
    লোকটা যতদিন বেঁচে ছিল, গ্রামসুদ্ধ লোকের হাড়-মাংস একেবারে ভাজা ভাজা করে রেখেছে। বাজখাই গলা, খিটখিটে মেজাজ। বাড়িতে কাক বসলে হার্টফেল করত, বেড়ালে কুকুরে পর্যন্ত বাড়ির ত্রি-সীমানায় ঘেঁষত না। বউটা আগেই মরেছিল, ছেলেটা কোথায় জব্বলপুরে না জামালপুরে যুদ্ধের চাকরি নিয়ে চম্পট দিয়েছিল। বাড়িতে বুড়ো একা থাকত। তার মস্ত একটা ফলের বাগান ছিল—সেইটাই পাহারা দিত।
    এমন বিতিকিচ্ছি লোক যে বিতিকিচ্ছি সময়ে মারা যাবে তাতে সন্দেহ কী! সেদিন বেশ মিঠে মিঠে বৃষ্টি নেমেছে ঝিমঝিম করে, পেট ভরে মুগের ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে বিছানা নিয়েছি—এমন সময় ডাক এল মড়া পোড়াতে যেতে হবে।
    আমি খপ করে বাঞ্ছার কথায় বাধা দিয়ে বললাম—ওসব পুরনো গল্প। পত্রিকার পাতায় গণ্ডা গণ্ডা ওরকম গল্প বেরিয়ে গেছে।
    বাঞ্ছা ভ্রুকুটি করে বললে—আরে আগে শোন না বাপু ! পরে যত খুশি বকর বকর রস।
    কেষ্টা বললে—ঠিক .তারপর এমন চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকাল যে বামুন হলে নির্ঘাত ভস্ম করে ফেলত।
    বাঞ্ছা বলে চলল—কী আর করি। বেরুতেই হল। পাশের বাড়িতে একটা লোক মরে পড়ে থাকবে এটা তো কোনও কাজের কথা নয়। যতই খিটখিটে বদখত লোক হোক না কেন, মানুষ হিসাবে একটা কর্তব্য আছে তো!
    বেরিয়ে দেখি, আমরা মাত্র চারজন। ডাকাডাকি করেও কারও সাড়া মেলেনি—কেউ কাঁপা গলায় বলেছে জ্বর হয়েছে, কেউ কাতরাতে কাতরাতে জবাব দিয়েছে, কান কটকট করছে। কাজেই আমাদের চারজনকেই কাঁধ দিতে হল। দুজনের দুহাতে দুটাে লণ্ঠন ঝুলতে ঝুলতে চলল, আর কাঁধে দুলতে দুলতে চলল মড়া ।
    মুখুজ্যেদের নরেশ আক্ষেপ করে বললে, জ্যান্তে বুড়ো জ্বালিয়ে মেরেছে, মরেও একখানা খেল দেখিয়ে গেল।
    কিন্তু কী আর করা যাবে, উপায় তো নেই। সেই টিপিটিপি বৃষ্টি আর শনশনে হাওয়ায় বর্ষা-পিছল রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। চারদিকে কালির মতো অন্ধকার—গাছপালাগুলো সেই অন্ধকারে এক-একটা অতিকায় দৈত্য-দানার মতো মাথা নাড়ছে। বিদ্যুতের চমকানিতে চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পথ ভুল করে পাশের খানার মধ্যে গিয়ে পড়ছি আমরা। বৃষ্টির ছাটে চট-চট করে ফাটছে লণ্ঠনের চিমনি। পা পিছলে যেতে চাইছে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটা লেগে চোখ জ্বালা করছে। ভোগান্তি আর কাকে বলে?
    ‘বল হরি, হরি বল'-চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে চললাম চারজনে। কাঁধের ওপর বুড়ো যেন পরম আনন্দে দোল খাচ্ছে। আমার সন্দেহ হল, এখন হয়তো মড়ার মুখের কাপড় সরালে দেখা যাবে, আমাদের দুৰ্গতিতে মিটিমিটি হাসছে হাড়-জ্বালানো লোকটা। মনে মনে অভিসম্পাত করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম।
    হাঁ—বলতে ভুলে গেছি, শুধু আমরা চারজনেই নই ; বুড়োর দুটাে বাগদী প্রজাও ছিল।
    তারা তো আর বামুনের মড়াকে কাঁধ দিতে পারবে না, তাই তারা কুডুল কাঁধে আসছিল পিছনে পিছনে—কাঠ কেটে আনবে।
    সে যাই হোক, শ্মশানে তো পৌছানো গেল। শ্মশান ঠিক গাঁয়ের নীচে নয়—বেশ খানিকটা দূরে। আশেপাশে বাড়ি-ঘর কিছু নেই—অনেকটা পর্যন্ত ন্যাড়া মাঠের ভেতরে এলোমেলো বাবলার বন। সেখানে একখানা টিনের চালাঘর—অবশ্য চারদিকে তার দেওয়াল-ফেয়ালের কোনও বালাই নেই—একেবারে ফাঁকা। এইটেই শ্মশান-যাত্রীদের বসবার জায়গা।
    ঠিক তারই নীচে একটা বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গার জলে। মস্ত সিঁড়ি, প্রায় খান পনেরো পৈঠে, এখন বর্ষার জলে তিন-চারখানা মাত্র জেগে রয়েছে। ভাঙচুরো অবস্থা—যেখানে সেখানে বড় বড় ফাটল, ইট বেরিয়ে পড়েছে। আমরা ওই সিড়ির ওপরেই মড়াটাকে নামালাম। এমনভাবে রাখলাম যাতে মড়ার পা দুটাে ডুবানো থাকে গঙ্গার জলে। বুড়োর গঙ্গাযাত্রাও হবে, তা ছাড়া এ-সুবিধেও আছে যে কাউকে আর ছুয়ে বসে থাকতে হবে না।
    মড়া নামিয়ে আমরা গিয়ে বসলাম চালাটার নীচে। বাগদীরা কাঠের ব্যবস্থা করুক, তারপর চিতা সাজানো যাবে বসে বসে গল্প জুড়ে দিলাম আমরা।
    চারদিকে ঘন অন্ধকার। হাওয়ায় হাওয়ায় বাবলা-বনের মাতামাতি। এখানে ওখানে শেয়ালের চোখ ঝলমল করছে সবুজ রঙের হিংস্র আলোর মতো। সে-চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কখনও বা ভয় ধরে যাচ্ছিল আমাদের—ভূত নয় তো!
    লণ্ঠন দুটাের গায়ে কালি পড়েছে, অল্প অল্প আলো গিয়ে পড়েছে ঘাটে নামানো মড়াটার ওপরে। কথার ফাঁকে ফাঁকে মড়ার দিকে নজর রাখছি আমরা। শেয়ালে-টেয়ালে এসে টেনে না নেয় সে-সম্পর্কে হুশিয়ার থাকা দরকার।
    কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল ছিল না, হঠাৎ ভীতস্বরে নরেশ বললে, মড়াটা একটু নড়ল না? আমরা বললাম, ধ্যাৎ—তোর চোখের ভুল। খানিক পরে আবার পটলা বললে, মড়াটা সত্যিই কিন্তু নড়ে উঠেছে। আমাদের ভেতরে সবচেয়ে সাহসী ছিল কানু। যেমন বুকের ছতি তেমনি বেপরোয়া। কানু আশ্বাস দিয়ে বললে, ও কিছু না—জলের ঢেউয়ে নড়ে থাকবে।
    আবার মিনিট কয়েক কাটতে না কাটতে আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর যেন ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল। কোনও ভুল নেই—লষ্ঠনের অল্প অল্প আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মড়াটা সত্যি সত্যিই একটু একটু করে জলের দিকে নেমে যাচ্ছে।
    —ও কী! ও কী!
    আমি, নরেশ আর পটলা একসঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠলাম। কানু সোজা দাঁড়িয়ে উঠল। ধমক দিয়ে বললে, দুৰ্ত্তোর, ভিতুর ডিম সব। পেছল সিঁড়ি, তাই গড়িয়ে পড়ছে নীচের দিকে। দাঁড়া, আমি তুলে নিয়ে আসি।
    মড়া তখনও নামছে, হাঁটু পর্যন্ত তার নেমে গেছে গঙ্গায়। কানু গিয়ে বাঁশের মাচাটা ধরে টান দিলে। কিন্তু কী সাংঘাতিক ! কানুর টানকে অস্বীকার করেও মড়াটা আরও নীচে নেমে গেল!
    গোঁয়ার-গোবিন্দ কানু এবার দুহাতে মড়াটাকে জাপটে ধরলে। কিন্তু আশ্চর্য—কানু রাখতে পারলে না ! দুধাপ পিছলে সে-সুদ্ধ গিয়ে কোমর-জলে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সাহস উবে গেল তার। এবার কানু আকুল হয়ে চিৎকার করে উঠল, ওরে তোরা ছুটে আয়, মড়া আমাকে সুদ্ধ নিয়ে যাচ্ছে!
    ততক্ষণে বুকে আমাদের আর রক্ত নেই, তা জল হয়ে গেছে। আমরা চিৎকার করে বললাম, মড়া ছেড়ে দাও—
    কানু বললে, পারছি না—
    আমরা ছুটে গেলাম—চেপে ধরলাম কানুকে।
    তারপরে যা শুরু হল, সে-কথা ভাবতে আজও আতঙ্কে মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে।
    ওই হাড্ডিসার মড়াটার গায়ে সে কী অমানুষিক শক্তি! একদিকে আমরা চারজন, অন্যদিকে মড়া একা—আমাদের সকলকে অনায়াসে তুচ্ছ করে সে জলের মধ্যে টেনে নিয়ে চলল। ঠাণ্ডাজল আমাদের কোমর ছাপিয়ে পেট পর্যন্ত উঠল, তারপর এসে পৌঁছুল বুক পর্যন্ত। তারপর—তারপর আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি—আর আমাদের আশা নেই—এই মড়া আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে, চলেছে গঙ্গার অতল জলে, সেখানে—
    আশ্চর্য একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা ! সমস্ত জ্ঞানগম্য যেন লোপ পেয়ে গেছে আমাদের। একটা আচ্ছন্নতার ঘোরে, যেন মরিয়া হয়ে মড়ার সঙ্গে টাগ-অব-ওয়ার চালিয়ে চলেছি আমরা। অথচ বেশ বুঝতে পারছি, আমাদের জয়ের কোনও আশা নেই, অপদেবতার অমানুষিক শক্তির কাছে আমাদের সমস্ত চেষ্টাই নিরর্থক।
    আর সব-চাইতে ভয়ানক—মড়া ছেড়ে দিয়ে যে উঠে আসব সে-ক্ষমতা আমাদের নেই ! কানু মড়াকে ছাড়তে পারছে না—আমরা ছাড়তে পারছি না কানুকে। যেন কী একটা মন্ত্রবলে সে আমাদের তার শরীরের সঙ্গে আটকে নিয়েছে—যেন হিপনোটাইজ করে ফেলেছে সকলকে।
    বুক-জল ক্রমশ গলা-জলে পৌঁছেছে, আর দেরি নেই মৃত্যুর। চারদিকে গঙ্গার অন্ধকার কালো জলে যেন শুনতে পাচ্ছি শয়তানের হাসির খিল-খিল শব্দ। গঙ্গার অতল জল—সেখান থেকে প্রেতপুরীর অন্ধকার জগৎ। এই মড়াটা তারই দিকে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে !
    শেষবারের মতো আমরা সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠলাম।
    ঠিক এমন সময়—কাঠের বোঝা নিয়ে আসছিল বাগদীরা। আমাদের চিৎকার শুনে তারা এসে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল৷ ছিলাম চারজন, হলাম ছয়জন। পুণোদ্যমে চলতে লাগল সে অমানুষিক টাগ-অব-ওয়ার!
    তারপর—
    তারপর আস্তে আস্তে থেমে দাঁড়াল মড়া। আস্তে আস্তে আমরা জয়লাভ করতে লাগলাম। ক্রমশ মড়া আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এসে পৌঁছতে লাগল। তখনও তার প্রচণ্ড টান আছে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম ঘাটের দিকে। পলা-জল থেকে বুক-জলে, সেখান থেকে কোমর-জলে, সেখান থেকে হাঁটু-জলে, তারপর—
    ওদিকের টানটা ঝড়াং করে ছেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ছিটকে এল ওপরে আর আমরা ছয়জন হুড়মুড় করে এ ওর ঘাড়ে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেলাম।
    আর ভুস্—স্-স্‌
    ঠিক তৎক্ষণাৎ ঘাটের ওপর জলের মধ্যে দেখা দিলে—
    বাঞ্ছা থামল।
    আমরা রুদ্ধশ্বাসে শুনে যাচ্ছি এই অতি ভয়ঙ্কর কাহিনী। একসঙ্গে বলে উঠলাম-কী ভেসে উঠল?
    ধীরে সুস্থে বাঞ্ছা বললে—আর কী? প্রায় দেড়মন।
    —কী দেড়মন?—আকুল স্বরে কেষ্টা প্রশ্ন করলে।
    —আমাদের কালনার গঙ্গার বিখ্যাত অতিকায় কচ্ছপ। সেই ব্যাটাই—
    আমি হো-হো করে হেসে উঠলাম। .
    কেষ্টা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল ; মিথ্যেবাদী—জোচ্চোর!
    বাঞ্ছা বললে—হতে পারি। কিন্তু আজ বেড়ে খাইয়েছিস কেষ্টা, ভূতের জয় জয়কার হোক তোর।
    নিরুত্তরে কেষ্ট হন-হন করে নেমে গেল রাস্তায়।

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF