Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

রাজশেখর বসু লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

      কেদার চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন— ‘আজকাল তোমরা সামান্য একটু বিদ্যে শিখে নাস্তিক হয়েছ, কিছুই মানতে চাও না। যখন আর একটু শিখবে তখন বুঝবে যে আ...

      কেদার চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন— ‘আজকাল তোমরা সামান্য একটু বিদ্যে শিখে নাস্তিক হয়েছ, কিছুই মানতে চাও না। যখন আর একটু শিখবে তখন বুঝবে যে আত্মা আছেন। ভূত, পেতনি—এঁরাও আছেন। বেম্মদত্যি, স্কন্ধকাটা— এঁনারাও আছেন।”
      বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানায় গল্প চলিতেছিল। তাহার শালা নগেন বলিল— আচ্ছা বিনোদ-দা, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?
      বিনোদ বলিলেন—‘যখন প্রত্যক্ষ দেখব তখন বিশ্বাস করব। তার আগে হা-না কিছুই বলতে পারি না।’
      চাটুজ্যে বলিলেন—‘এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি ওকালতি কর! বলি, তোমার প্রপিতামহকে প্রত্যক্ষ করেছ? ম্যাকডোনাল্ড, চাৰ্চিল আর বালডুইনকে দেখেছ? তবে তাদের কথা নিয়ে অত মাতামাতি কর কেন?’ 
      ‘আচ্ছা আচ্ছা, হার মানছি চাটুজ্যে মশায়।’ 
      ‘আপ্তবাক্য মানতে হয়। আরে, প্রত্যক্ষ করা কি যার তার কৰ্ম্ম? শ্রীভগবান কখনও কখনও তার ভক্তদের বলেন—দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ। সেই দিব্যদৃষ্টি পেলে তবে সব দেখতে পাওয়া যায়।’
      নগেন জিজ্ঞাসা করিল—‘আপনি দেখতে পেয়েছেন চাটুজ্যে মশায়?’ 
      ‘জ্যাঠাম করিসনি। এই কলকাতা শহরে রাস্তায় যারা চলাফেরা করে— কেউ কেরানি, কেউ দোকানি, কেউ মজুর, কেউ আর কিছু—তোমরা ভাব সবাই বুঝি মানুষ। তা মোটেই নয়। তাদের ভেতর সর্বদাই দু'দশটা ভূত পাওয়া যায়। তবে চিনতে পারা দুস্কর। এই রকম ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন মহেশ মিত্তির।’
      ‘কে তিনি?’ 
      ‘জান না? আমাদের মজিলপুরের চরণ ঘোষের মামার শালা। এককালে তিনি কিছুই মানতেন না, কিন্তু শেষ দশায় তাকেও স্বীকার করতে হয়েছিল।’ 
      সকলে একবাক্যে বলিলেন—‘কী হয়েছিল বলুন না চাটুজ্যে মশায়।’ 
     চাটুজ্যে মহাশয় হুকাটি হাতে তুলে বলতে আরম্ভ করলেন। 
     ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর আগেকার কথা। মহেশ মিত্তির তখন শ্যামবাজারের শিবচন্দ্র কলেজে প্রফেসারি করতেন। অঙ্কের প্রফেসর, অসাধারণ বিদ্যে, কিন্তু প্রচণ্ড নাস্তিক। ভগবান আত্মা পরলোক কিছুই মানতেন না। এমন কি, স্ত্রী মারা গেলে আর বিবাহ পর্যন্ত করেননি। খাদ্যাখাদ্যের বিচার ছিল না, বলতেন— শুয়োর না খেলে হিন্দুর উন্নতির আশা নেই, ওটা বাদ দিয়ে কোনও জাত বড় হতে পারেনি। মহেশের চালচলনের জন্য আত্মীয়স্বজন তাকে একঘরে করেছিল। কিন্তু যতই অনাচার করুন, তার স্বভাবটা ছিল অকপট, পারতপক্ষে মিথ্যা কথা কইতেন না। তার পরম বন্ধু ছিলেন হরিনাথ কুণ্ডু, তিনিও ঐ কলেজের প্রফেসর, ফিলসফি পড়াতেন। কিন্তু বন্ধু হলে কি হয়, দু’জনে হরদম ঝগড়া হত, কারণ হরিনাথ আর কিছু মানুন না-মানুন ভূত মানতেন। তা ছাড়া মহেশবাবু অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, কেউ তাকে হাসতে দেখেনি, আর হরিনাথ ছিলেন আমুদে লোক, কথায় কথায় ঠাট্টা করে বন্ধুকে উদ্রব্যস্ত করতেন। তবু মোটের ওপর তাদের পরস্পরের প্রতি খুব একটা টান ছিল।
      তখন রাজনীতি চর্চার এত রেওয়াজ ছিল না, আর ভদ্রলোকের ছেলের অন্নচিন্তাও এমন চমৎকার হয়নি, দু-একটা পাস করতে পারলে যেমন-তেমন চাকরি জুটে যেত। লোকের তাই উঁচুদরের বিষয় আলোচনা করবার সময় ছিল। ছোকরারা চিন্তা করত—বউ ভালবাসে কি বাসে না। যাদের সে সন্দেহ মিটে গেছে, তারা মাথা ঘামাত—ভগবান আছেন কি নেই। একদিন কলেজে কাজ ছিল না, অধ্যাপকেরা সকলে মিলে গল্প করছিলেন। গল্পের আরম্ভ যা নিয়েই হোক, মহেশ আর হরিনাথ কথাটা টেনে নিয়ে ভূতে আর ভগবানে হাজির করতেন, কারণ এই নিয়ে তর্ক করাই তাদের অভ্যাস। এদিনও তাই হয়েছিল।
      আলোচনা শুরু হয় ঝি-চাকরের মাইনে নিয়ে। কলেজের পণ্ডিত দীনবন্ধু বাচস্পতি মশায় দুঃখ করছিলেন– ছোটলোকের লোভ এত বেড়ে গেছে যে আর পেরে ওঠা যায় না। মহেশবাবু বললেন– লোভ সকলেরই বেড়েছে, আর বাড়াই উচিত, নইলে মনুষ্যত্বের বিকাশ হবে কিসে।’ পন্ডিতমশায় উত্তর দিলেন—‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। মহেশবাবু পালটা জবাব দিলেন— লোভ ত্যাগ করলেও মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না।’
      তর্কটা তেমন জুতসই হচ্ছে না দেখে হরিনাথবাবু একটু উসকে দেবার জন্য বললেন—আমাদের মতন লোকের লোভ হওয়া উচিত মৃত্যুর পর। মাইনে তো পাই মোটে পৌনে দুশো, তাতে ইহকালের ক’টা শখই বা মিটবে। তাইতো পরকালের আশায় বসে আছি, আত্মাটা যদি স্বর্গে গিয়ে একটু ফুর্তি করতে পারে।’
      দীনবন্ধু পণ্ডিত বললেন— কে বললে তুমি স্বর্গে যাবে? আর স্বর্গের তুমি জানই বা কী?’
    সমস্তই জানি পণ্ডিত মশায়। খাসা জায়গা, না গরম না ঠাণ্ডা। মন্দাকিনী কুলুকুলু বইছে, তার ধারে ধারে পারিজাতের ঝোপ। সবুজ মাঠের মধ্যিখানে কল্পতরু গাছে আঙ্গুর বেদানা আম রসগোল্লা কাটলেট সব রকম ফলে আছে, ছেড় আর খাও। জন-কতক ছোকরা-দেবদূত গোলাপী উড়নি গায়ে দিয়ে সুধার বোতল সাজিয়ে বসে রয়েছে, চাইলেই ফটাফট খুলে দেবে। ওই হেথা কুঞ্জবনে ঝাঁকে ঝাঁকে অন্সরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, দুদণ্ড রসালাপ কর, কেউ কিছু বলবে না। যত খুশি নাচ দেখ, গান শোন। আর কালোয়াতি চাও তো নারদ মুনির আস্তানায় যাও?
      মহেশবাবু বললেন—সমস্ত গাঁজা। পরলোক আত্মা ভূত ভগবান কিছুই নেই। ক্ষমতা থাকে তো প্রমান কর।’
     তর্ক জমে উঠল। প্রফেসররা কেউ এক পক্ষে কেউ অপর পক্ষে দাঁড়ালেন। পণ্ডিত মশায় দারুণ অবজ্ঞায় ঠোঁট উলটে বসে রইলেন। বৃদ্ধ প্রিন্সিপাল যদু সাণ্ডেল রফা করে বললেন—ভূতের তেমন দরকার দেখি না, কিন্তু আত্মা আর ভগবান বাদ দিলে চলে না। মহেশ মিত্তির বললেন—“ কেউ-উ নেই, আমি দশ মিনিটের মধ্যে প্রমাণ করে দিচ্ছি। হরিনাথ কুণ্ডু মহা উৎসাহে বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বললেন—‘লেগে যাও।”
      তারপর মহেশবাবু ফুলস্কেপ কাগজ আর পেনসিল নিয়ে একটি বিরাট অঙ্ক কষতে লেগে গেলেন। ঈশ্বর আত্মা আর ভূত—এই তিন রাশি নিয়ে অতি জটিল অঙ্ক তার গতি বোঝে কার সাধ্য। বিস্তর যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করে হাতির শুড়ের মতন বড় বড় চিহ্ন টেনে অবশেষে সমাধান করলেন—ঈশ্বর =0 আত্মা =ভুত =0।
      বাচস্পতি বললেন—“বদ্ধ উন্মাদ।’ 
      মহেশবাবু বললেন—উন্মাদ বললেই হয় না। এ হল গিয়ে দস্তুরমতো ইণ্টিগ্রাল ক্যালকুলাশ। সাধ্য থাকে তো আমার অঙ্কের ভুল বার করুন।’
      হরিনাথ বললেন—‘অঙ্ক-টঙ্ক আমার আসে না। বাচস্পতি মশায় যদি ভগবান দেখাবার ভার নেন তো আমি মহেশকে ভূত দেখাতে পারি।
      বাচস্পতি বললেন—“আমার বয়ে গেছে।’ 
      মহেশবাবু বললেন— বেশ তো হরিনাথ, তুমি ভূতই দেখাও না। একটার প্রমাণ পেলে আর সমস্তই মেনে নিতে রাজী আছি।”
      হরিনাথবাবু বললেন—‘এই কথা? আচ্ছা আসছে হপ্তায় শিব চতুর্দশী পড়ছে। সেদিন তুমি আমার সঙ্গে রাত বারোটায় মানিকতলায় নতুন খালের ধারে চল, পষ্টাপষ্টি ভূত দেখিয়ে দেব। কিন্তু যদি কোনও বিপদ ঘটে তো আমাকে দুষতে পারবে না।’ 
      ‘যদি দেখাতে না পার ?’ 
      ‘আমার নাক কান কেটে দিও। আর যদি দেখাতে পারি তো তোমার নাক কাটব ।’
      প্রিন্সিপাল যদু সাণ্ডেল বললেন—‘কাটাকাটির দরকার কি, সত্যের নির্ণয় হলেই হল।’
     শিবচতুর্দশীর রাত্ৰে মহেশ মিত্তির আর হরিনাথ কুণ্ডু মানিকতলায় গেলেন। জায়গাটা তখন বড়ই ভীষণ ছিল, রাস্তায় আলো নেই, দু’ধারে বাবলা গাছে আরও অন্ধকার করেছে। সমস্ত নিস্তব্ধ, দুজনে নতুন খালের ধারে পৌছিলেন। বছর-দুই আগে ওখানে প্লেগের হাসপাতাল ছিল, এখনও তার গোটাকতক খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে।
      মহেশ মিত্তির অবিশ্বাসী সাহসী লোক, কিন্তু তারও গা করতে লাগল।
       হরিনাথ সারা রাস্তা কেবল ভূতের কথাই কয়েছেন—তারা দেখতে কেমন, কেউ তাদের না মানলেও বড়-একটা কেয়ার করেন না। কিন্তু অপদেবতারা পদবীতে খাটো বলে তাদের আত্মসম্মানবোধ বড়ই উগ্র, না মানলে ঘাড় ধরে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা আদায় করেন। এই সব কথা।
      হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ শোনা গেল, যেন কোনও অশরীরী বেড়াল তার পলাতকা প্রণয়িনীকে আকুল আহ্বান করছে। একটু পরেই মহেশবাবু রোমাঞ্চিত হয়ে দেখলেন, একটা লম্বা রোগা কুচকুচে কাল মূর্তি দু’হাত তুলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে একটু দূরে ঐ রকম আরও দুটো।
      হরিনাথবাবু থরথর করে কাপতে কাপতে বললেন—‘রাম রাম সীতারাম! ও মহেশ, দেখছ কি, তুমিও বল না!
      আর একটু হলেই মহেশবাবু রামনাম উচ্চারণ করেই ফেলতেন, কিন্তু তার কনশেন্স বাধা দিয়ে বললে—“উহু, একটু সবুর কর, যদি ঘাড় মটকাবার লক্ষণ দেখ তখন না-হয় রামনাম করা যাবে।’
      এঁরা একটা পাকুড় গাছের নিচে ছিলেন। হঠাৎ ওপর থেকে খানিকটা কাদাগোলা জল মহেশের মাথায় এসে পড়ল।
তখন সামনের সেই কাল মূর্তিটা নাকী সুরে বললে—মহেশবাবু, আপনি নাকি ভূত মানেন না?
      এ অবস্থায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রেই বলে থাকেন—আজ্ঞে হা, মানি বই কি। কিন্তু মহেশ মিত্তির বেয়াড়া লোক, হঠাৎ তাঁর কেমন খেয়াল হল, ধাঁ করে এগিয়ে গিয়ে ভূতের কাঁধ খামচে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন—‘কোন ক্লাস?’
      ভূত থতমতো খেয়ে জবাব দিলে—‘সেকেণ্ড ইয়ার সার!’ 
     ‘রোল নম্বর কত?’ 
      ভূত করুণ নয়নে হরিনাথের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে—‘বলি সার?’ 
      হরিনাথের মুখে রাম রাম ভিন্ন কথা নেই। পিছনের দুটো ভূত অদৃশ্য হয়ে গেল। পাকুড় গাছে যে ছিল সে টুপ করে নেমে এসে পালিয়ে গেল। তখন বেগতিক দেখে সামনের ভূতটা ঝাকুনি দিয়ে মহেশের হাত ছাড়িয়ে চোঁচা দৌড় মারলে |
মহেশ মিত্তির হরিনাথের পিঠে একটা প্রচণ্ড কিল মেরে বললেন— ‘জোচ্চোর!”
       হরিনাথও পালটা কিল মেরে বললেন—আহাম্মক? 
     নিজের নিজের পিঠে হাত বুলতে বুলতে দুই বন্ধু বাড়িমুখো হলেন। আসল ভূত যারা আশেপাশে লুকিয়ে ছিল তারা মনে মনে বললে—আজি রজনীতে হয়নি সময়?
      পরদিন কলেজে হুলস্থূল বেধে গেল। সমস্ত ব্যাপার শুনে প্রিন্সিপাল ভয়ংকর রাগ করে বললেন—অত্যন্ত শেমফুল কাণ্ড। দুজন নামজাদা অধ্যাপক একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হাতাহাতি ! হরিনাথ, তোমার লজ্জা নেই?’
      হরিনাথবাবু ঘাড় চুলকে বললেন—“আজ্ঞে আমার উদ্দেশ্যটা ভালই ছিল। মহেশকে রিফর্ম করবার জন্য যদি একটু ইয়ে করেই থাকি তাতে দোষটা কি— হাজার হোক আমার বন্ধু তো?
      মহেশবাবু গর্জন করে বললেন—‘কে তোমার বন্ধু?’ 
      প্রিন্সিপাল বললেন—মহেশ, তুমি চুপ কর। উদ্দেশ্য যাই হোক, কলেজের ছেলেদের এর ভেতর জড়ানো একেবারে আমার্জনীয় অপরাধ। হরিনাথ তুমি বাড়ি যাও, তোমায় সাসপেণ্ড করলুম। আর মহেশ, তোমাকেও সাবধান করে দিচ্ছি—আমার কলেজে ভূতুড়ে তর্ক তুলতে পারবে না।’
      মহেশবাবু উত্তর দিলেন—‘সে প্রতিশ্রুতি দেওয়া শক্ত। সকল রকম কুসংস্কার দূর করাই আমার জীবনের ব্রত।’
     তবে তোমাকেও সাসপেণ্ড করলুম। অন্যান্য অধ্যাপকরা চুপ করে সমস্ত শুনছিলেন। তারা প্রিন্সিপালের হুকুম শুনে কোনও প্রতিবাদ করলেন না, কারণ সকলেই জানতেন যে তাদের কর্তার রাগ বেশি দিন থাকে না।
      মহেশবাবু তাঁর বাসায় ফিরে এলেন। হরিনাথের ওপর প্রচণ্ড রাগ—হতভাগা একটা গভীর তত্ত্বের মীমাংসা করতে চায় জুয়াচুরির দ্বারা! সে আবার ফিলসপি পড়ায়! এমন অপ্রত্যাশিত আঘাত মহেশবাবু কখনও পাননি।
      মানুষের মন যখন নিদারুণ ধাক্কা খায় তখন সে তার ভাব ব্যক্ত করবার জন্য উপায় খোঁজে। কেউ কাদে, কেউ তর্জন-গর্জন করে, কেউ কবিতা লেখে। একটা তুচ্ছ কোঁচবকের হত্যাকাণ্ড দেখে মহর্ষি বাল্মীকির মনে যে ঘা লেগেছিল তাই প্রকাশ করবার জন্য তিনি হঠাৎ দু'ছত্র শ্লোক রচনা করে ফেলেন—মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্মম্‌ ইত্যাদি। তার পর সাতকাণ্ড রামায়ণ লিখে তার ভাবের বোঝা নামাতে পেরেছিলেন। আমাদের মহেশ মিত্তির চিরকাল নীরস অঙ্কশাস্ত্রের চর্চা করে এসেছেন, কাব্যের কিছুই জানতেন না। কিন্তু আজ তারও মনে সহসা একটা কবিতার অঙ্কুর গজগজ করতে লাগল। তিনি আর বেগ সামলাতে পারলেন না, কলেজের পোশাক না ছেড়েই বড় একখানা আলজেবরা খুলে তার প্রথম পাতায় লিখলেন—
হরিনাথ কুণ্ডু
খাই তোর মুণ্ডু।
      কবিতাটি লিখে বার বার ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে আদি কবি বাল্মীকির মতন ভাবলেন, হাঁ, উত্তম হয়েছে।
কিন্তু একটা খটকা বাঁধল। কুণ্ডুর সঙ্গে মুণ্ডর মিল আবহমান কাল থেকে চলে আসছে, এতে মহেশের কৃতিত্ব কোথায়? কালিদাসই হন, আর রবীন্দ্রনাথই হন, কুণ্ডুর সঙ্গে মুণ্ডু মেলাতেই হবে—এ হল প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। মহেশ একটু ভেবে ফের লিখলেন—
কুণ্ডু হরিনাথ,
মুণ্ডু করি পাত।
      হাঁ, এইবার মৌলিক রচনা বলা যেতে পারে। মহেশের মনটা একটু শান্ত হল। কিন্তু কাব্যসরস্বতী একবার যদি কাঁধে ভর করেন তবে সহজে নামতে চান না। মহেশবাবু লিখতে লাগলেন—
হরিনাথ ওরে,
হবি তুই মরে
নরকের পোকা
অতিশয় বোকা ।
      উহু, নরকই নেই তার আবার পোকা! মহেশবাবু স্থির করলেন—কাব্যে কুসংস্কার নাম দিয়ে তিনি শীঘ্রই একটা প্রবন্ধ রচনা করবেন, তাতে মাইকেল রবীন্দ্রনাথ কাকেও রেহাই দেবেন না। তার পর তার কবিতার শেষের চার লাইন কেটে ফের লিখলেন
ওরে হরিনাথ,
তোর করি কাত,
পিঠে মারি চড়—
এমন সময় মহেশের চাকরটা এসে বললে--"বাবু, চা হবে কি দিয়ে? দুধ তো ছিঁড়ে গেছে।’
      মহেশবাবু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন— সেলাই করে নে।’
পিঠে মারি চড়,
মুখে গুঁজি খড়।
জ্বেলে দেশলাই
আগুন লাগাই।
      কিন্তু আবার এক আপত্তি। হরিনাথকে পুড়িয়ে ফেললে জগতের কোনও লাভ হবে না, অনর্থক খানিকটা জান্তব পদার্থ বরবাদ হবে। বরং তার চাইতে—
হরিনাথ ওরে
পোড়াব না তোরে।
নিয়ে যাব ধাপা
দেব মাটি চাপা।
সার হয়ে যাবি
ঢ্যাঁড়স ফলাবি।
      মহেশবাবু আরও অনেক লাইন রচনা করেছিলেন, তা আমার মনে নেই। কবিতা লিখে খানিকটা উচ্ছাস বেরিয়ে যাওয়ায় তার হৃদয়টা বেশ হালকা হল, তিনি কাপড়-চোপড় ছেড়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন।
      তিন দিন যেতে না যেতে প্রিনসিপাল মহেশ আর হরিনাথকে ডেকে পাঠালেন। তারা আবার নিজের নিজের কাজে বহাল হলেন, কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব ভেঙে গেল। সহকর্মীরা মিলনের অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না। হরিনাথ বরং একটু সন্ধির আগ্রহ দেখিয়েছিলেন,কিন্তু মহেশ একেবারে পাথরের মতন শক্ত হয়ে রইলেন।
      কিছুদিন পরে মহেশবাবুর খেয়াল হল---প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধে একতরফা বিচার করাটা ন্যায়সঙ্গত নয়, এর অনুকূল প্রমাণ কে কি দিয়েছেন তাও জানা উচিত। তিনি দেশি বিলাতি বিস্তর বই সংগ্রহ করে পড়তে লাগলেন, কিন্তু তাতে তাঁর অবিশ্বাস আরও প্রবল হল। প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছুই নেই, কেবল আছে—অমুক ব্যক্তি কি বলেছেন আর কি দেখেছেন। বাঘের অস্তিত্বে মহেশের সন্দেহ নেই, কারণ জন্তু বাগানে গেলেই দেখা যায়। ভূত যদি থাকেই তবে খাঁচায় পুরে দেখ না বাপু। তা নয়, শুধু ধাপ্পাবাজি। প্রেততত্ত্ব চর্চা করে মহেশবাবু বেজায় চটে উঠলেন। শেষটায় এমন হল যে ভূতের গুষ্টিকে গালাগাল না দিয়ে তিনি জলগ্ৰহণ করতেন না।
      পড়ে পড়ে মহেশের মাথা গরম হয়ে উঠল। রাত্রে ঘুম হয় না, কেবল স্বপ্ন দেখেন ভূতে তাকে ভেংচাচ্ছে। এমন স্বপ্ন দেখেন বলে নিজের উপরও তার রাগ হতে লাগল। ডাক্তার বললে—পড়াশুনা বন্ধ করুন, বিশেষ করে ঐ ভুতুড়ে বইগুলো—যা মানেন না তার চর্চা করেন কেন। কিন্তু ঐ সব পড়া মহেশের এখন একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পড়লেই রাগ হয়, আর সেই রাগই তার অসুখ।
      অবশেষে মহেশ মিত্তির কঠিন রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। দিন দিন শরীর ক্ষয়ে যেতে লাগল, কিন্তু রোগটা ঠিক নির্ণয় হল না। সহকর্মীরা প্রায়ই এসে তার খবর নিতেন। হরিনাথও একদিন এসেছিলেন, কিন্তু মহেশ তার মুখদর্শন করলেন না।
      সাত-আট মাস কেটে গেল। শীতকাল, রাত দশটা। হরিনাথবাবু শোবার উদ্দ্যোগ করছেন এমন সময় মহেশের চাকর এসে খবর দিলে যে তার বাবু ডেকে পাঠিয়েছেন, অবস্থা বড় খারাপ। হরিনাথ তখনই হাতিবাগানে মহেশের বাসায় ছুটলেন।
      মহেশের আর দেরি নেই, মৃত্যুর ভয় নেই। বললেন—‘হরিনাথ, তোমায় ক্ষমা করলুম। কিন্তু ভেবো না যে আমার মত কিছুমাত্র বদলেছে। এই রইল আমার উইল, তোমাকে অছি নিযুক্ত করেছি। আমার পৈতৃক দশ হাজার টাকার কাগজ ইউনিভার্সিটিকে দান করেছি, তার সুদ থেকে প্রতি বৎসর একটা পুরস্কার দেওয়া হবে। যে ছাত্র ভূতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ লিখবে সে ঐ পুরস্কার পাবে। আর দেখ —খবরদার, শ্রাদ্ধ-ট্রাদ্ধ করো না। ফুলের মালা চন্দন-কাঠ ঘি এসব দিও না, একদম বাজে খরচ। তবে হা, দু-চার বোতল কেরোসিন ঢালতে পার। দেড় সের গন্ধক আর পাঁচ সের শোরা আনানো আছে, তাও দিতে পার, চটপট কাজ শেষ হয়ে যাবে। আচ্ছা, চললুম তা হলে।’
      রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। মহেশের আত্মীয়স্বজন কেউ কলকাতায় নেই, থাকলেও বোধ হয় তারা আসত না। বড়দিনের বন্ধ, কলেজের সহকর্মীরা প্রায় সকলেই অন্যত্র গেছেন। হরিনাথ মহা বিপদে পড়লেন। মহেশবাবুর চাকরকে বললেন পাড়ার জনকতক লোক ডেকে আনতে ।
      অনেক্ষণ পরে দু'জন মাতব্বর প্রতিবেশী এলেন। ঘরে ঢুকলেন না, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—চুপ করে বসে আছেন যে বড়? সৎকারের ব্যবস্থা কি করলেন?’
      হরিনাথ বললেন—‘আমি একলা মানুষ,আপনাদের ওপরেই ভরসা।’ 
      ‘ওই বেলেল্লা হতভাগার লাশ আমরা বইব? ইয়ারকি পেয়েছেন নাকি!’ এই কথা বলেই তারা সরে পড়লেন।
    হরিনাথের তখন মনে পড়ল, বড় রাস্তার মোড়ে একটা মটকোঠায় সাইনবোর্ড দেখেছেন—বৈতরণী সমিতি, ভদ্রমহোদয়গণের দিবারাত্র সস্তায় সৎকার। চাকরকে বসিয়ে রেখে তখনই সেই সমিতির খোঁজে গেলেন।
      অনেক চেষ্টায় সমিতি থেকে তিনজন লোক যোগাড় হল। পনেরো টাকা পারিশ্রমিক, আর শীতের ওষুধ বাবদ ন’ সিকে। সমস্ত আয়োজন শেষ হলে হরিনাথ আর তার তিন সঙ্গী খাট কাঁধে নিয়ে রাত আড়াইটার সময় নিমতলায় রওনা হলেন।
      অমাবস্যার রাত্রি, তার ওপর আবার কুয়াশা। হরিনাথের দল কর্নওয়ালিশ স্ট্রীট দিয়ে চললেন। গ্যাসের আলো মিঠমিট করছে, পথে জনমানব নেই। কাঁধের বোঝা ক্রমেই ভারী বোধ হতে লাগল, হরিনাথ হাঁপিয়ে পড়লেন।বৈতরণী সমিতির সর্দার ত্রিলোচন পাকড়াশী বুজিয়ে দিলেন—িএম হয়েই থাকে, মানুষ মরে গেলে তার ওপর জননী বসুন্ধরার টান বাড়ে।
      হরিনাথ একলা নয়, তার সঙ্গীর সকলেই সেই শীতে গলদঘর্ম হয়ে উঠল। খাট নামিয়ে খানিক জিরিয়ে আবার যাত্রা।
      কিন্তু মহেশ মিত্তিরের ভার ক্রমশই বাড়ছে, পা আর এগোয় না। পাকড়াশী বললেন– ঢের ঢের বয়েছি মশাই, এমন জগদ্দল মড়া কখনও কাঁধে করিনি। দেহটা তো শুকনো, লোহা খেতেন বুঝি? পনেরো টাকায় হবে না মশায়, আরো পাঁচ টাকা চাই। ’
      হরিনাথ তাতেই রাজী, কিন্তু সকলে এমন কাবু হয়ে পড়েছে যে দু’পা গিয়ে আবার খাট নামাতে হল। হরিনাথ ফুটপাথে এলিয়ে পড়লেন, বৈতরণীর তিনজন হাঁপাতে হাঁপাতে টানতে লাগল।
      ওঠবার উপক্রম করছেন, এমন সময় হরিনাথের নজর পড়ল—কুয়াশার ভিতর দিয়ে একটা আবছায়া তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এলে দেখলেন-—কালো র‌্যাপার  মুড়ি দেওয়া একটা লোক। লোকটি বললে—‘এঃ, আপনারা হাঁপিয়ে পড়েছেন দেখছি। বলেন তো আমি কাঁধ দিই।’
       হরিনাথ ভদ্রতার খাতিরে দু-একবার আপত্তি জানালেন, কিন্তু শেষটায় রাজী হলেন। লোকটি কোন জাত তা আর জিজ্ঞাসা করলেন না, কারণ মহেশ মিত্তির ও বিষয়ে চিরকাল সমদর্শী, এখন তো কথাই নেই। তা ছাড়া যে লোক উপযাচক হয়ে শ্মশানযাত্রার সঙ্গী হয় সে তো বান্ধব বটেই।
      ত্রিলোচন পাকড়াশী বললেন—“কাঁধ দিতে চাও দাও, কিন্তু বখরা পাবে না, তা বলে রাখছি।’
     আগন্তুক বললে—‘বখরা চাই না।’ 
     এবার হরিনাথকে কাঁধ দিতে হল না, তার জায়গায় নতুন লোকটি দাঁড়াল। আগের চেয়ে যাত্রাটা একটু দ্রুত হল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আর পা চলে না, ফের খাট নামিয়ে বিশ্রাম।
      পাকড়াশী বললেন—‘কুড়ি টাকার কাজ নয় বাবু, এ হল মোষের গাড়ির বোঝা। আরও পাঁচ টাকা চাই।’
      এমন সময় আবার একজন পথিক এসে উপস্থিত—ঠিক প্রথম লোকটির মতন কালো র‌্যাপার গায়ে। এও খাট বইতে প্রস্তুত । হরিনাথ দ্বিরুক্তি না করে তার সাহায্য নিলেন। এবার পাকড়াশী মশায় রেহাই পেলেন।
      খাট চলেছে, আর একটু জোরে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার ক্লান্তি। মহেশের ভার অসহ্য হয়ে উঠেছে, তার দেহে কিছু ঢোকেনি তো? খাট নামিয়ে আবার সবাই দম নিতে লাগল।
      কে বলে শহুরে লোক স্বার্থপর? আবার একজন সহায় এসে হাজির, সেই কালো র‌্যাপার গায়ে । হরিনাথের ভাববার অবসর নেই, বললেন চল চল ।
      আবার যাত্রা, আরও একটু জোরে। তারপর ফের খাট নামাতে হল। এই যে চতুর্থ বাহক এসে হাজির, সেই কালো র‌্যাপার। এরা কি মহেশকে বইবার জন্যই এই তিন প্রহর রাতে পথে বেরিয়েছে? হরিনাথের আশ্চর্য হবার শক্তি নেই, বললেন—‘ওঠাও খাট, চল জলদি।’
      চারজন অচেনা বাহকের কাঁধে মহেশের খাট চলেছে, পিছনে হরিনাথ আর বৈতরণী সমিতির তিনজন। এইবার গতি বাড়ছে, খাট হনহন করে চলেছে। হরিনাথ আর তার সঙ্গীদের ছুটতে হল।
      আরে অত তাড়াতাড়ি কেন, আস্তে চল। কেই বা কথা শোনে। ছুট-ছুট। আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, থাম থাম, বীডন স্ট্রট ছাড়িয়ে গেল যে। লোকগুলো কি শুনতে পায় না? ওহে পাকড়াশী, থামাও না ওদের? কোথায় পাকড়াশী? তিনি বিচক্ষণ লোক, ব্যাপারটা বুঝে টাকার মায়া ত্যাগ করে সদলে পালিয়েছেন। মহেশের খাট তখন তীর বেগে ছুটছে, হরিনাথ পাগলের মতন পিছু পিছু দৌড়চ্ছেন। কর্নওয়ালিস স্ট্রীট গোলদিঘি, বউবাজারের মোড়—সব পার হয়ে গেল। কুয়াশা ভেদ করে সামনের সমস্ত পথ ফুটে উঠেছে—এ পথের কি শেষ নেই? রাস্তা কি ওপরে উঠছে না নিচে নেমেছে? একি আলো না অন্ধকার? দূরে ও কি দেখা যাচ্ছে—সমুদ্রের ঢেউ, না চোখের ভুল?
      হরিনাথ ছুটতে ছুটতে নিরন্তর চিৎকার করছেন—“থাম, থাম। ও কি, খাটের ওপর উঠে বসেছে কে? মহেশ? মহেশই তো। কি ভয়ানক। দাঁড়িয়েছে, ছুটন্ত খাটের উপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিছন ফিরে লেকচারের ভঙ্গীতে হাত নেড়ে বলছে?
      দূর দূরান্তর থেকে মহেশের গলার আওয়াজ এল—‘হরিনাথ—ও হরিনাথ— ওহে হরিনাথ—’
    ‘কি, কি? এই যে আমি।’ 
    ‘ও হরিনাথ—আছে, আছে, সব আছে, সব সত্যি—’ মহেশের খাট অগোচর হয়ে এল, তখনও তার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে—
      হরিনাথ মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে ওয়েলসলি স্ত্রীটের পুলিশ তাকে দেখতে পেয়ে বহু কষ্টে তাকে উদ্ধার করেন।
      বংশলোচনবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘গয়ায় পিণ্ডি দেওয়া হয়েছিল কি?’ 
      শুধু গয়ায়! পিণ্ডিদাদনখাঁ-এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোন ফল হয়নি, পিণ্ডি ছিটকে ফিরে এল।’
      ‘তার মানে?’
      ‘মানে—মহেশ পিণ্ডি নিলেন না, কিংবা তাকে নিতে দিলে না।’ 
     ‘আশ্চর্য। মহেশ মিত্তিরের টাকাটা?’ 
     ‘সেটা ইউনিভার্সিটিতে গচ্ছিত আছে। কিন্তু কাজ কিছুই হয়নি, ভূতের বিপক্ষে প্রবন্ধ লিখতে কোনও ছাত্রের সাহস নেই। এখন সেই টাকা সুদেআসলে প্রায় পঁচিশ হাজার হয়েছে। একবার সেনেটে প্রস্তাব ওঠে টাকাটা প্রত্নবিভাগের জন্য খরচ হোক। কিন্তু ছাদের ওপর এমন দুপদাপ শুরু হল যে সব্বাই ভয়ে পালালেন। সেই থেকে মহেশফাণ্ডের নাম কেউ করে না।’

ডাউনলোড PDF : ডাউনলোড

ক্যালকাটা ফিজিসার্জিক ক্লাবের সাপ্তাহিক সান্ধ্য বৈঠক বসেছে। আজ বক্তৃতা দিলেন ডাক্তার হরিশ চাকলাদার, এম ডি, এল আর সি পি, এম এম আর সি এস। মৃত্...

ক্যালকাটা ফিজিসার্জিক ক্লাবের সাপ্তাহিক সান্ধ্য বৈঠক বসেছে। আজ বক্তৃতা দিলেন ডাক্তার হরিশ চাকলাদার, এম ডি, এল আর সি পি, এম এম আর সি এস। মৃত্যুর লক্ষণ সম্বন্ধে তিনি অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বললেন। চার পাঁচ ঘণ্টা শ্বাস রোধের পরেও আবার নিশ্বাস পড়ে, ফাঁসির পরেও কিছুক্ষণ হৃৎস্পন্দন চলতে থাকে, দুই হাত দুই পা কাটা গেলেও এবং দেহের অর্ধেক রক্ত বেরিয়ে গেলেও মানুষ বাঁচতে পারে, ইত্যাদি। অতেব রাইগার মর্টিস না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রলালের ভাষায় কুঁকড়ে আড়ষ্ট হয়ে না গেলে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না।
বক্তৃতা শেষ হলে যথারীতি ধন্যবাদ দেওয়া হল, কেউ কেউ নানা রকম মন্তব্যও করলেন। বক্তার সহপাঠী ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, ওহে হরিশ, তুমি বড্ড হাতে রেখে বলছ। আসল কথা হচ্ছে, ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা না হলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। শিবপুরের দশরথ কুণ্ডুর কথা শোন নি বুঝি? বুড়ো হাড় কঞ্জুস, অগাধ টাকা, মরবার নামটি নেই। ছেলে রামচাঁদ হতাশ হয়ে পড়ল। অবশেষে একদিন বুড়ো মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, নিশ্বাস বন্ধ হল, নাড়ী থামল, শরীর হিম হয়ে সিঁটকে গেল। ডাক্তার বললে, আর ভাবনা নেই রামচাঁদ, তোমার বাবা নিতান্তই মরেছেন। রামচাঁদ ঘটা করে বাপকে ঘাটে নিয়ে গেল, বিস্তর চন্দন কাঠ দিয়ে চিতা সাজালে, তার পর যেমন খড়ের নুড়ো জ্বেলে মুখাগ্নি করতে যাবে অমনি বুড়ো উঠে বসল। অ্যাঁ, এসব কি? বলেই ছেলের গালে এক চড়।

সবাই ভয়ে পালাল। বুড়ো গটগট করে বাড়ি ফিরে এসে ঘটককে ডাকিয়ে এনে বললে, রেমোকে ত্যাজ্যপুত্তুর করলুম, আমার জন্যে একটা পাত্রী দেখ।

সভাপতি ডাক্তার যদুনন্দন গড়গড়ি একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। এঁর বয়স এখন নব্বই, শরীর ভালই আছে, তবে কানে একটু কম শোনেন আর মাঝে মাঝে খেয়াল দেখে আবোল তাবোল বকেন। ইনি কোথায় ডাক্তারি শিখেছিলেন, কলকাতায় কি বোম্বাইয়ে কি রেঙ্গুনে, তা লোকে জানে না। কেউ বলে, ইনি সেকেলে ভি এল এম এস। কেউ বলে, ওসব কিছু নন, ইনি হচ্ছেন খাঁটি হ্যামার ব্র্যাণ্ড, অর্থাৎ হাতুড়ে। নিন্দুকেরা যাই বলুক, এককালে এঁর অসংখ্য পেশেণ্ট ছিল, সাধারণ লোকে এঁকে খুব বড় সার্জেন মনে করত। প্রায় পঁচিশ বৎসর প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে ইনি এখন ধর্মকর্ম সাধুসঙ্গ আর শাস্ত্রচর্চা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ক্লাবের বাড়িটি ইনিই করে দিয়েছেন। সেজন্য কৃতজ্ঞ সদস্যগণ এঁকে আজীবন সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। সকলেই এঁকে শ্রদ্ধা করেন, আবার আড়ালে ঠাট্টাও করেন।

হাসির শব্দে ডাক্তার যদু গড়গড়ির ঘুম ভেঙে গেল। মিটমিট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপারটা কি?
হরিশ চাকলাদার বললেন, আজ্ঞে বেণী বলছে, ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা না হলে মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না।
যদু ডাক্তার বললেন, এই বেণীটা চিরকেলে মুখখু, বিলেত থেকে ফিরে এসে মনে করেছে ও সবজান্তা হয়ে গেছে। জীবনমৃত্যুর তুমি কতটুকু জান হে ছোকরা?
ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত ছোকরা নন, বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। হাতজোড় করে বললেন, কিছুই জানি না সার, আমি তামাশা করে বলেছিলুম।
-- তামাশা! মরণ বাঁচন নিয়ে তামাশা!

যদু ডাক্তার চিরকালই দুর্মুখ, তাঁর অত পসার হওয়ার এও একটা কারণ। লোকে মনে করত, রোগী আর তার আত্মীয়দের যে ডাক্তার ধমক দেয় সে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। বয়স বৃদ্ধির ফলে তাঁর মেজাজ আরও খিটখিটে হয়েছে, কিন্তু তাঁর কটুবাক্যে কেউ রাগ করে না। তাঁকে শান্ত করবার জন্য ডাক্তার অশ্বিনীকুমার সেন এম বি বি এস, কবিরত্ন, বৈদ্যশাস্ত্রী বললেন, সার, আজকের সাবজেক্ট সম্বন্ধে আপনি কিছু বলুন।
যদু ডাক্তার বললেন, আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করবে কেন, আমার তো এখন ডোটেজ, যাকে বলে ভীমরতি।
অশ্বিনী সেন বললেন, সে তো মহা ভাগ্যের কথা। সাতাত্তর বৎসরের সপ্তম মাসের সপ্তম রাত্রির নাম ভীমরথী। আপনি তা বহুকাল পার হয়েছেন। আমাদের শাস্ত্রে বলে, এই দুস্তরা রাত্রি অতিক্রম করে যিনি বেঁচে থাকেন তাঁর প্রতিদিনই যজ্ঞ, তাঁর চলা ফেরা বিষ্ণুপ্রদক্ষিণের সমান, তাঁর বাক্যই মন্ত্র, নিদ্রাই ধ্যান, যে অন্ন খান তাই সুধা। আপনার কথা বিশ্বাস করব না -- সে কি একটা কথা হল?
-- কিন্তু ঐ বেণী কাপ্তেন? ও বিশ্বাস করবে?
বেণী দত্ত আবার হাতজোড় করে বললেন, নিশ্চয় করব সার, যা বলবেন তা বেদবাক্য বলে মেনে নেব।
যদু ডাক্তার প্রসন্ন হয়ে বললেন, নেহাত যদি শুনতে চাও তো শোন। কিন্তু তোমরা হয়তো ভয় পাবে।
বেণী দত্ত বললেন, যদি ভুতুড়ে কাণ্ড না হয় তবে ভয় পাব কেন সার?
-- না না, ভুতুড়ে নয়। কিন্তু যে কেস হিস্টরি বলছি, তা অতি ভীষণ; অথচ এতে শুধু সার্জারির ক্লাইম্যাক্স নয়, প্রেমের পরাকাষ্ঠা পাবে।
-- বাঃ, বিভীষিকা সার্জারি আর প্রেম, এর চাইতে ভাল কমবিনেশন হতেই পারে না। আপনি আরম্ভ করুন সার, আমরা শোনবার জন্য ছটফট করছি।

ডাক্তার যদুনন্দন গড়গড়ি বলতে লাগলেন। -- প্রায় পঁচিশ বৎসর আগেকার কথা। তখন তোমাদের সালফা পেনিসিলিন আর স্ট্রেপ্টো ক্লোরো না টেরা কি বলে গিয়ে -- এ সব রেওয়াজ হয় নি। কারও বাড়িতে অপারেশন হলে আয়োডোফর্মের খোশবায়ে পাড়া সুদ্ধ মাত হয়ে যেত, লোকে বুঝত, হ্যাঁ, চিকিৎসা হচ্ছে বটে। আমি তখন কালীঘাটে বাস করতুম। আমার বাড়ির কাছে এক তান্ত্রিক সিদ্ধপুরুষ থাকতেন, নাম বিঘোরানন্দ, তিনি কামরূপ কামাখ্যায় আর তিব্বতে বহু বৎসর সাধনা করেছিলেন। ভক্তরা তাঁকে বিঘোর বাবা বা শুধু বাবাঠাকুর বলত। বয়স ষাট পঁয়ষট্টি, লম্বা চওড়া চেহারা, ঘোর কাল রং, একমুখ দাড়ি গোঁফ দেখলেই ভক্তিতে মাথা নিচু হয়ে আসে। আমি তাঁর কার্বংকল অপারেশন করেছিলুম। একটু চাঙ্গা হবার পর একগোছা নোট আমার হাতে দেবার চেষ্টা করলেন। হাত টেনে নিয়ে আমি বললুম, করেন কি, আপনার কাছে কি আমি ফী নিতে পারি? বিঘোর বাবা একটু হেসে বললেন, তুমি না নিলেও ও টাকা তোমার হয়ে গেছে। কথাটার মানে তখন বুঝতে পারি নি, তাঁকে নমস্কার করে বিদায় নিলুম।

বাড়ি ফিরে এসে পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটা ভুর্জপত্রের মোড়কে দশটা গিনি রয়েছে। বুঝলুম বিঘোর বাবার দান তাঁর অলৌকিক শক্তিতে আমার পকেটে চলে এসেছে। তার পর থেকে মাঝে মাঝে তাঁর কাছে যেতুম, নানা রকম আশ্চর্য তত্ত্বকথা শুনতুম। বছর খানিক পরে তিনি কালীঘাট থেকে চলে গেলেন, তাঁর একজন বড়লোক ভক্ত ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গার ধারে একটি আশ্রম বানিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানেই গিয়ে রইলেন। একাই থাকতেন, তবে ভক্তরা মাঝে মাঝে তাঁকে দেখতে যেত।

তার পর দু বৎসর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, খবরও কিছু পাই নি। একদিন বেলা বারোটায় বাড়ি ফিরে এসেছি, একটা হার্নিয়া, দুটো অ্যাপেন্ডিক্স, তিনটে টিউমার, চারটে টনসিল, আর গোটা পাঁচেক হাইড্রোসিল অপারেশন করে অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছি। নাওয়া খাওয়ার পর স্ত্রীকে বললুম, আমি বিকেল চারটে পর্যন্ত ঘুমুব, খবরদার কেউ যেন না ডাকে। কিন্তু ঘুমুবার জো কি! ঘণ্টা খানিক পরেই ঠেলা দিয়ে গিন্নী বললেন, ওগো শুনছ, জরুরী তার এসেছে। বলুম ছিঁড়ে ফেলে দাও। গিন্নী বললেন, এ যে বিঘোর বাবার তার। অগত্যা টেলিগ্রামটা পড়তে হয়, লিখছেন -- এখনই চলে এস, মোষ্ট আর্জেণ্ট কেস।

তখনই মোটরে রওনা হলুম। ব্যাগটা সঙ্গে নিলুম, তাতে শুধু মামুলী সরঞ্জাম ছিল, কি রকম কেস কিছুই জানা নেই, সেই জন্য বিশেষ কোনও ওষুধপত্র নিতে পারলুম না। শীতকাল, পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিঘোর বাবার আশ্রমটি ত্রিবেণীর কাছে কাগমারি গ্রামের গঙ্গার ধারে। খুব নির্জন স্থান, কাছাকাছি লোকালয় নেই। গাড়ি থেকে নেমে আশ্রমের আগড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বিঘোর বাবার সাঙ্গে দেখা। পরনে লাল চেলির জোড়, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, পায়ে খড়ম, হুঁকো হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাক খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, এস ডাক্তার। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, এঁর কোনও ফ্যাসাদ হয় নি। প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলুম, পেশেণ্ট কে? কি হয়েছে? বললেন, ঘরের ভেতর এস, স্বচক্ষে দেখলেই বুঝবে।

ঘড়টি বেশ বড়, কিন্তু আলো অতি কম, এক কোণে পিলসুজের মাথায় পিদিম জ্বলছে, তাতে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে দৃষ্টি খুললে নজরে পড়ল -- ঘরের এক পাশে একটা তক্তপোশ, বোধ হয় বিঘোর বাবা তাতেই শোন। আর এ পাশে মেঝেতে একটা মাদুরের ওপর দুজন পাশাপাশি চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে, একখানা কম্বল দিয়ে সমস্ত শরীর ঢাকা, শুধু মুখ দুটো বেরিয়ে আছে। একজন পুরুষ, জোয়ান বয়স, বোধ হয় পঁচিশ, মুখে দাড়ি, গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আর একজন মেয়ে, বয়স আন্দাজ কুড়ি, কালো কিন্তু সুশ্রী, ঝুঁটি বাঁধা খোঁপা, সিঁথিতে সিঁদুর। জিজ্ঞাসা করলুম, স্বামী-স্ত্রী?
বিঘোর বাবা উত্তর দিলেন, উঁহু, প্রেমিক প্রেমিকা।
-- কি হয়েছে।
-- নিজেই দেখ না।
স্টেথোস্কোপটি গলায় ঝুলিয়ে হেঁট হযে কম্বলখানা আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেললুম। তার পরেই এক লাফে পিছনে ছিটকে এলুম। কম্বলের নিচে কিচ্ছু নেই শুধু দুটো মুণ্ডু পাশাপাশি পড়ে আছে।
ভয়ও হল রাগও হল। বিঘোর বাবাকে বললুম, আমাকে এরকম বিভীষিকা দেখাবার মানে কি? এ তো ক্রিমিন্যাল কেস, যা করতে হয় পুলিশ করবে, আমার কিছু করবার নেই। কিন্তু আপনি যে মহাবিপদে পড়বেন। বাবা শুধু একটু হাসলেন। তারপর দেখলুম, পুরুষ-মুণ্ডুটা পিটপিট করে তাকিয়ে চিঁ চিঁ করে বলছে, মরি নি ডাক্তারবাবু। মেয়ে মুণ্ডুটাও ডাইনে বাঁয়ে একটু নড়ে উঠল।

ডিসেকশন রুমে বিস্তর মড়া ঘেঁটেছি, হরেক রকম বীভৎস লাশ দেখেছি, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর পিলে চমকানো ব্যাপার কখনও দৃষ্টিগোচর হয় নি। আমি আঁতকে উঠে পড়ে যচ্ছিলুম, বিঘোর বাবা আমাকে ধরে ফেলে বললেন, ওহে গড়গড়ি ডাক্তার, ভয় নেই, ভয় নেই, মুণ্ডু কাটা গেছে কিন্তু আমি এদের বাঁচিয়ে রেখেছি। মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শুনেছ? তার প্রভাবে এরা এখনও বেঁচে আছে।

সেই শীতে আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, এদের ধড় কোথায় গেল?
-- ঐ যে, ঐ কোণটায় কম্বলের নিচে পাশাপাশি শুয়ে আছে।
বিঘোর বাবা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই ধড় দুটোও বাঁচিয়ে রেখেছি, দেখ না তোমার চোঙা লাগিয়ে।
স্টেথোস্কোপের দরকার হল না। বুকে হাত দিয়ে দেখলুম হার্ট আর লংস ঠিক চলছে, তবে একটু ঢিমে। বিঘোর বাবাকে বললুম, ধন্য আপনার সাধনা, বিলিতী বিজ্ঞানের মুখে আপনি জুতো মেরেছেন। কিন্তু এতই যদি পারেন তবে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা রেখেছেন কেন? জুড়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
বিঘোর বাবা বললেন, তা আমার কাজ নয়। আমি মৃতসঞ্জীবনী জানি, কিন্তু খণ্ডযোজনী বিদ্যা আমার আয়ত্ত নয়। ও হল মুচী বা ডাক্তারের কাজ। মুচী আবার লাশ ছোঁবে না, তার মোটরও নেই যে এই অবলায় এতদূরে আসবে, তাই তোমাকে ডেকেছি। তুমি ধড়ের সঙ্গে মুণ্ডু সেলাই করে দাও।

আমি নিবেদন করলুম,, বাইরের চামড়া সেলাই করলেই তো গলার হাড় আর নলী জুড়বে না। সার্কুলেশন রেস্পিরেশন এবং স্পাইন্যাল কর্ডের সঙ্গে ব্রেনের যোগ কি করে হবে? সেরিব্রেশন অর্থাৎ মস্তিষ্কের ক্রিয়া চলবে কি করে?
-- কেন চলবে না? দুই ভুরুর মধ্যে আজ্ঞাচক্র ঘুরছে, তাতেই পঞ্চেন্দ্রিয় আর মনের ক্রিয়া চলছে। কাটা মুণ্ডু কথা কয়েছে তা তো তুমি স্বকর্ণে শুনেছ। কোনও চিন্তা নেই তুমি সেলাই করে ফেল।
আমি বললুম, সেলাইয়ের উপযুক্ত বাঁকা ছুঁচ আর ক্যাটগট তো আমার সঙ্গে নেই, আর সেপসিস অর্থাৎ পচন বন্ধ করব কি করে?
-- তোমাকে একটা গুনছুঁচ আর সুতলি দড়ি দিচ্ছি। পচবার ভয় নেই, দেখছ না, কাটা জায়গায় গঙ্গামৃত্তিকা লেপন করে দিয়েছি। ঐ কাদা সুদ্ধ সেলাই করে দাও।

বড়ই মুশকিলে পড়া গেল। আয়োজন কিছুই নেই, অ্যাসিস্টান্ট নেই নার্স নেই, অপারেশন টেবল নেই, আলো পর্যন্ত নেই, অথচ বিঘোরানন্দ আমাকে এমন সার্জারি করতে বলছেন, যা কস্মিন কালে কোথাও হয় নি --

ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, হয়েছিল সার -- গজানন গণেশ আর অজানন দক্ষ।
-- আরে তারা হলেন দেবতা। আচ্ছা বেণী, আজকাল বড় অপারেশনের আগে তোমরা নাকি হরেক রকম টেস্ট করাও?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ। ব্লাড-প্রেশার, ব্লাড-কাউণ্ট, ব্লাড-সুগার, এক্স-রে ফোটো, কার্ডিওগ্রাম, প্রভৃতি মামুলী রুটিন টেস্ট তো আছেই, তা ছাড়া নন প্রোটিন নাইট্রোজেন, টোটাল হেভি হাইড্রোজেন, বডিফ্যাটের আয়োডিন ভ্যালু, হাড়ের ইলাস্টিসিটি, দাঁতের রেডিও অ্যাকটিভিটি, চামড়ার স্পেকট্রোগ্রাম -- এসবও দেখা দরকার। অধিকন্তু রোগী আর তার আত্মীয়দের ইনটেলিজেন্স কোশন্ট টেস্ট করালে খুব ভাল হয়। শাঁসালো পেশেন্ট হলে অন্তত বিশজন স্পেশ্যালিষ্টের রিপোর্ট নেওয়া চাই। আর গরীব পেশেণ্টকে বলে দিই, উঁচু দরের চিকিৎসা তোমার সাধ্য নয় বাবু, দাতব্য হোমিওপ্যাথিক খাও গিয়ে, না হয় পাঁচ সিকের মাদুলি ধারণ কর।

যদু ডাক্তার বললেন, আমাদের আমলে অত সব ছিল না, জিব আর নাড়ী, থার্মমিটার আর স্টেথোস্কোপ, এতেই যা করে। আর এই দুই পেশেন্টের তো চূড়ান্ত অপারেশন মুণ্ডচ্ছেদ আগেই হয়ে গেছে, এখন টেষ্ট করা বৃথা। যাক, তার পর যা হয়েছিল শোন। আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে বিঘোরানন্দ আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, অত মাথা ঘামিও না ডাক্তার, শুধু সেলাই করে দাও, বাকীটুকু কুলকুণ্ডলিনী নিজেই করে নেবেন।
আমি বললুম, বাবাঠাকুর, ধড়ের সঙ্গে মুণ্ডু সেলাই করা সার্জনের কাজ নয়, থিয়েটারের বাবা মুস্তাফার কাজ। বেশ, আপনার আজ্ঞা পালন করব, কিন্তু এই দুজনের হিস্টরি তো বললেন না, এদের এমন দশা হল কি করে?

বিঘোরানন্দ এই ইতিহাস বললেন। -- মেয়েটার নাম পঞ্চী, ওর বাপ হরি কামার বাঁশবেড়েতে থাকে। পঞ্চীর বিয়ে হয়েছে এই কাগমারি গ্রামের রমাকান্ত কামারের সঙ্গে। রমাকান্ত লোকটা অতি দুর্দান্ত, দেখতে যমদূতের মতন, বদরাগী আর মাতাল। সে জমিদার বাড়িতে প্রতি বৎসর নবমী পুজোয় এক'শ আটটা পাঁঠা, দশটা ভেড়া, আর গোটা দুই মোষ এনে এক কোপে কাটে। পঞ্চী তাকে বিয়ে করতে চায় নি, তার বাপ টাকার লোভে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। রমাকান্ত বজ্জাত হলেও আমাকে খুব ভক্তি করে, আমার অনেক ফরমাশও খাটে। সে পঞ্চীর ওপর অকথ্য অত্যাচার করত, আমি ধমক দিয়েও কিছু করতে পারি নি। এ রকম ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে তাই হল। এই যে পুরুষটার মুণ্ডু দেখছ, ওর নাম জটিরাম বৈরাগী -- তোর দেশের লোক, নয় রে পঞ্চী?
পঞ্চীর মাথা ওপর নিচে একটু নড়ে উঠে সায় দিলে।
-- এই জটি ছোকরা কীর্তন গায় ভাল, তার জন্য নানা জায়গা থেকে ওর ডাক আসত। জটিরাম মাঝে মাঝে এই গাঁয়ে এলে পঞ্চীর সঙ্গে দেখা করত, শেষটায় দুজনের প্রেম হল। 
পঞ্চীর ভুরু আর ঠোঁট একটু কুঁচকে উঠল।

বিঘোরানন্দ বলতে লাগলেন -- রমাকান্ত টের পেয়ে একদিন পঞ্চীকে বেদম মারলে, কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। তার পর গত কাল রাত একটার সময় আমি ঘুমিয়ে আছি এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। উঠে দরজা খুলে দেখি, রাম দা হাতে রমাকান্ত। আমার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সর্বনাশ করেছি বাবাঠাকুর, এক কোপে দুটো সাবাড় করেছি, বাঁচান আমাকে।

ব্যাপারটা এই। -- আগের দিন রমাকান্ত পঞ্চীকে বলেছিল, আমি ভদ্রেশ্বর যাচ্ছি, চৌধুরী বাবুদের লোহার গেট তৈরি করতে হবে, চার পাঁচ দিন পরে ফিরব, তুই সাবধানে থাকিস। সব মিথ্যে কথা। রাত দুপুরে রমাকান্ত চুপি চুপি তার বাড়িতে এল এবং আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে দেখলে পঞ্চী আর জটিরাম পাশাপাশি শুয়ে ঘুমুচ্ছে। দেখেই রাম দায়ের এক কোপে দুজনের মুণ্ডু কেটে ফেললে। তার পর ভয় পেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে।

আমি তখনই রমাকান্তর সঙ্গে তার বাড়ি গেলুম। প্রথমেই মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে পঞ্চী আর জটিরামের সূক্ষ্মশরীর আটকে ফেললুম। তার পর রমাকান্তকে বললুম, তুই ধড় দুটো কাঁধে করে আশ্রমে নিয়ে চল, মুণ্ডু দুটো আমি নিয়ে যচ্ছি। আশ্রমে এসে রমাকান্ত আমার উপদেশ মত ধড় এক জায়গায় আর মুণ্ডু আর এক জায়গায় শুইয়ে দিলে। খণ্ডযোজনের আগে পর্যন্ত এই রকম তফাৎ রাখাই তান্ত্রোক্ত পদ্ধতি।

হরিশ চাকলাদার প্রশ্ন করলেন, সূক্ষ্মশরীরেরও কি দু ভাগ হয়েছিল মুণ্ডু আর ধড় দুটোই আলাদা হয়ে বেঁচে রইল কি করে?
যদু গড়গড়ি বললেন, তোমরা দেখছি কিছুই জান না। সূক্ষ্মশরীর ভাগ হয় না, নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি। তার অ্যানাটমি অন্য রকম। কতকটা অ্যামিবার মতন, কিন্তু ঢের বেশি ইলাস্টিক। ধড় আর মুণ্ডু তফাতে থাকলেও সূক্ষ্মশরীর চিটে গুড়ের মতন বেড়ে গিয়ে দুটোতেই ভর করতে পারে। তার পর বিঘোর বাবা যা বলছিলেন শোন।

রমাকান্ত আবার আমার পায়ে পড়ে বললে, দোহাই বাবাঠাকুর, ফাঁসি যেতে পারব না, আমাকে বাঁচান। আমি বললুম, তুই এক্ষুণি তোর বাড়ি গিয়ে সব রক্ত ধুয়ে সাফ করে ফেলবি, তোর রাম দা গঙ্গায় ফেলে দিবি, তার পর গায়েব হয়ে থাকবি। এক বৎসর পরে গাঁয়ে ফিরতে পারিস। রমাকান্ত বললে, কিন্তু লাশের গতি কি করবেন? পুলিশ টের পেলেই তদারক করতে আসবে, আপনাকেই আসামী বলে চালান দেবে। আমি বললুম, তোকে তা ভাবতে হবে না, যা বলছি তাই করবি। রমাকান্ত যে আজ্ঞে বলে চলে গেল। আমার সেই টেলিগ্রাম পেয়ে তুমি এসেছ। এখন আর দেরি নয়, রাত আটটায় অশ্লেষা পড়বে, আত আগেই সেলাই করে ফেল, নইলে জোড়া লাগবে না।

গুন ছুঁচ আর সুতলি নিয়ে আমি সেলাই করতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলুম মুণ্ডু দুটো ফিসফিস করে আপনের মধ্যে কথা বলছে। ক্রমশ পঞ্চীর কণ্ঠস্বর চড়া হয়ে উঠল। বিঘোর বাবা ধমক দিয়ে বললেন, এই পঞ্চী, চেঁচাস নি। আরে গেল যা, এখনও ঘাড়ের ওপর মুণ্ডু বসে নি, এর মধ্যেই গলাবাজি শুরু করেছে।
পঞ্চী ডাকল, অ বাবাঠাকুর, একবারটি শুনুন তো।
বিঘোর বাবা উবু হয়ে অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে পঞ্চী আর জটিরামের কথা শুনলেন। তার পর আমাকে বললেন, ওহে ডাক্তার, এরা বলছে যে জটির ধড়ে পঞ্চীর মুণ্ডু আর পঞ্চীর ধড়ে জটির মুণ্ডু লাগাতে হবে। আমিও ভেবে দেখলুম এই ব্যবস্থাই ভাল।

স্তম্ভিত হয়ে আমি বললুম, এ কি রকম কথা বাবাঠাকুর! মুণ্ডু বদল হতেই পারে না, ভিয়েনা কনভেনশানে তার কোনও স্যাংশন নেই। এ রকম অপারেশন মোটেই এথিক্যাল নয়, আমাদের প্রোফেশনাল কোডের একদম বাইরে।
বিঘোর বাবা বললেন, আরে রেখে দাও তোমার কোড। পঞ্চী যদি নিজের ধড় আর মুণ্ডু নিয়ে বেঁচে ওঠে তবে যে আবার রমাকান্তর কবলে পড়বে। মুণ্ডু বদল করলে এদের নব কলেবর হবে, কোনও গোলযোগের ভয় থাকবে না। আর একটা মস্ত লাভ এই হবে যে কখনও এদের ছাড়াছাড়ি হবে না। জটিরাম যদি আগে মরে তবে তার ধড় নিয়ে পঞ্চীর মুণ্ডু বেঁচে থাকবে। পঞ্চী যদি আগে মরে তবে তার ধড়টা জটির মুণ্ডু নিয়ে বেঁচে থাকবে। এই পঞ্চীটা অত্যন্ত চালাক, এর মাথা থেকেই এই বুদ্ধি বেরিয়েছে। জটিরাম হচ্ছে হাঁদারাম। কালই আমি ভৈরব মতে এদের বিয়ে দেব, আমার আশ্রমেই এরা বাস করবে।
আমি প্রশ্ন করলুম, ধড় আর মুণ্ডু বদল হলে কে পঞ্চী কে জটিরাম তার স্থির হবে কি করে?
বিঘোর বাবা বললেন, মাথা হল উত্তমাঙ্গ। মাথা অনুসারেই লোকের নাম হয় ধড় যারই হোক।

ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত জনান্তিকে বললেন, কিন্তু গণেশ আর দক্ষের বেলায় তা হয় নি।
যদু ডাক্তার বলতে লাগলেন, এর পর আর আপত্তি করা চলে না, অগত্যা খণ্ডযোজনের জন্য প্রস্তুত হলুম। অ্যানাস্থেটিক দরকার হল না, বিঘোর বাবা মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে অসাড় করে দিলেন। কিন্তু ভোঁতা গুণ ছুঁচ আর খসখসে পাটের সুতলি দিয়ে চামড়া ফোঁড়া গেল না। বিঘোর বাবা বললেন, এই পিদিম থেকে রেড়ির তেল নিয়ে ছুঁচ আর সুতোয় বেশ করে মাখিয়ে নাও। তাই নিলুম। লুব্রিকেট করার পর কাজ সহজ হল, আধ ঘণ্টার মধ্যে মুণ্ডুর সঙ্গে ধড় সেলাই করে ফেললুম।

এবার বিঘোর বাবাকে বললুম, এখন এদের শরীরে কিছু তাজা রক্ত পুরে দেওয়া দরকার, অভাবে পাঁচ শ সিসি গ্লুকোজ স্যালাইন। কিন্তু এই পাড়াগাঁয়ে যোগাড় হবে কি করে? যদি নেহাতই বেঁচে থাকে তবে এর পর কিছুদিন লিভার এক্সট্রাক্ট, ব্লডস পিল আর ভিগারোজেন খাওয়াতে হবে, নইলে গায়ে জোর পাবে না।
বিঘোর বাবা বললেন, ওসব ছাই ভস্ম চলবে না বাপু। এখন এরা সমস্ত রাত ঘুমুবে। কাল সকালে জেগে উঠলে ঝোলা গুড় দিয়ে খানকতক রুটি পথ্য করবে। তার পর বেলা হলে পঞ্চী ভাত চড়িয়ে দেবে আর লঙ্কাবাটা দিয়ে কাঁকড়া চচ্চড়ি রাঁধবে। তাতেই বলবান হবে। জটিরাম আবার গাঁজা খায়। নয় রে জটে? জটিরাম দাঁত বার করে বললে, হাঁ।
বিঘোর বাবা বললেন, বেশ তো, কাল সকালে আমার প্রসাদী ছিলিমে দু এক টান দিস। এখন খাওয়া চলবে না, গলার জোড় পোক্ত হতে চার পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে। এখন খেলে সেলাইয়ের ফাঁক দিযে সব ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে। দেখ ডাক্তার, তোমাকে ফী কিছু দেব না, আজ তুমি যা দেখলে তারই দাম লাখ টাকা।
আমি উত্তর দিলুম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই বাবা। আমার চক্ষু কর্ণ সার্থক হয়েছে, অহংকার চূর্ণ হয়েছে, গা দিয়ে ঘাম ছুটছে, আগাপাস্তলা রোমাঞ্চিত হচ্ছে। আমি ধন্য হয়ে গেছি। এখন অনুমতি দিন, আমি বাড়ি ফিরে যাই, দু ডোজ ব্রোমাইড খেয়ে নার্ভ ঠাণ্ডা করে শুয়ে পড়ি। এই বলে প্রণাম করে সেই রাত্রেই কলকাতায় ফিরে এলুম।

ডাক্তার অশ্বিনী সেন বললেন, কিমাশ্চর্যমতঃপরম।
ডাক্তার হরিশ চাকলাদার বললেন, ফ্ল্যাবারগাস্টীং মিরাকল।
ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, অতি খাসা। পরকীয়া প্রেমের এমন পারফেক্ট পরিণাম বৈষ্ণব সাহিত্যেও নেই, আর সিমবায়োসিসের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত বায়োলজির কেতাবেও পাওয়া যায় না। আচ্ছা সার, নায়ক নায়িকার তো একটা হিল্লে লাগিয়ে দিলেন, কিন্তু রমাকান্তর কি হল?

ডাক্তার যদু গড়গড়ি বললেন, শুনেছি এক বছর পর সে চুপি চুপি বিঘোর বাবার আশ্রমে এসেছিল, কিন্তু জটি আর পঞ্চীকে দেখে ভূত পেত্নী মনে করে তখনই ভয়ে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে সে নিরুদ্দেশ।
-- আহা, তার জন্য দুঃখ হয়, বেচারা খুন করেও বউকে শায়েস্তা করতে পারল না। নামটাই যে অপয়া, ডাইনে বাঁয়ে যে দিক থেকে পড়ুন পাবেন রমাকান্ত কামার। আমাদের সুবল বসুও তার দুমুখো নামের জন্য উন্নতি করতে পারছেন না। আচ্ছা তার পর আর কখনও আপনি পঞ্চী আর জটিরামকে দেখেছিলেন?
-- দেখেছিলুম। দু বছর পরে বিঘোর বাবা চিঠি লিখলেন, মাঘ সংক্রান্তির দিন জটি পঞ্চীর ছেলের অন্নপ্রাশন, তুমি অবশ্যই আসবে। বাবার যখন আদেশ তখন যেতেই হল।
-- কি দেখলেন গিয়ে?
-- দেখলুম, বিঘোর বাবা ঠিক আগের মতন লাল চেলির জোড় পরে দাঁড়িয়ে হুঁকো টানছেন, পঞ্চী তার মাস্ক্যুলার মদ্দা হতে একটা মস্ত কুড়ুল নিয়ে কাঠ চেলা করছে, জটিরাম রোয়াকে বসে একটা পিঁড়িতে আলপনা দিচ্ছে আর কোলের ছেলেকে মাই খাওয়াচ্ছে।