Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

মুক্তিযুদ্ধের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

    আমার নাম কপোত। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কখনো ভাবি, আমি যদি পাখি হতাম ! কোন এক সফেদ সকালে উঠে মনে মনে বলি, পৃথিবীর সবটুকু রং আমি শুষে নেবো...

    আমার নাম কপোত। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কখনো ভাবি, আমি যদি পাখি হতাম ! কোন এক সফেদ সকালে উঠে মনে মনে বলি, পৃথিবীর সবটুকু রং আমি শুষে নেবো। শৈশবের কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি আমার হৃদয়ে জাগরুক। স্মৃতিভূক দুপুরে চিলেকোঠায় বই পড়তে পড়তে মন চলে যায় তেপান্তরে। 'তিমুর ও তার দলবল’ বইটা পড়েছি। আমার একটা বাগান আছে। প্রতি বছর শীতে আমি সেখানে রক্তগোলাপ লাগাই। লাল টকটকে ফুলে ছেয়ে থাকে বাগান। সেই ফুল আমার খুব প্রিয়।
    বাবার হাত ধরে একবার একটা সিনেমা দেখি। যুদ্ধে যায় এক কিশোর। একের পর এক শত্ৰুপক্ষের ট্যাংক ধ্বংস করে। মা'র টানে ঘরে ফিরতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতার যুদ্ধ তার কাছে এখন মায়ের চেয়েও বেশি প্রিয়। দেশের মাকে মুক্ত করতে হবে। লালচে মেটে রঙের সেই ছবি মনে পড়লেই আমার বুকটা হু হু করে। মনে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। একাত্তরের সেই টালমাটাল দিন। আকাশে শকুনের আনাগোনা। রাস্তায় টহলদার কনভয়। খাকী পোশাকের লোকজন। হঠাৎ করে জংগী প্লেনের চিৎকার। কুড়িয়ে পাওয়া গুলির খোলস। বাবা মা'র মুখে গাঢ় চিন্তার ছাপ।
    সেই যুদ্ধ, যখন আমার বয়স দশ, টানা নয় মাস চললো। শহর ছেড়ে ভাগছে সবাই। বাবা অনড়। তিনি যাবেন না। রাতে ঘুমোতে পারতেন না। রাত গভীরে বারান্দায় পায়চারি করতেন। ফিসফিস করে কথা বলতেন মায়ের সঙ্গে। আমার ভাইয়া তখন কলেজে পড়ে। অসম্ভব জেদী আর একগুঁয়ে। স্বদেশীরা তার আদর্শ–পরে তা বুঝেছি। যে কোন মিছিলের আগে থাকত। রাত জেগে পোস্টার লিখতো। কখনো কখনো ঘাড় গুঁজে বই পড়তো। এক চিলতে উঠোনে একটা বাগান করেছিলো ভাইয়া। লালগোলাপ.ভাইয়ার খুব প্রিয়। বাগান জুড়ে টকটকে লাল গোলাপ খুবই সুন্দর লাগতো!
    এক বিকেলে বাবা মা আর আপা বসে চা খাচ্ছিলো। তিন চাকার সাইকেল নিয়ে খেলা করেছিলাম আমি। আপার দিকে হাত বাড়িয়ে বাবা বললেন, ‘একটু টিপে দে’তো মা।’
    আপা বাবার খুব ভক্ত। হাত টিপতে টিপতে আমার সঙ্গে চোখে চোখে দুষ্টুমি করছিলো। ঝড়ের বেগে এমন সময় এলো ভাইয়া। উবু হয়ে সাত তাড়াতাড়ি বাবার পায়ে সালাম করলো। আপার বেণী ধরে টান দিলো। একছুটে চলে গেলো ভেতরবাগে। মাকে জাপটে ধরে আদর কুড়িয়ে নিলো। ব্যাপার কিরে, ব্যাপার কিরে—কেউ কিছুই জানতে পারলো না। ভাইয়া একটা হ্যাভারসাকে প্রয়োজনীয় জিনিশপত্তর ভরে নিলো। গোর্কীর ‘মা’ উপন্যাসটা ভাইয়া নিতে ভোলেনি। কারো মানা শুনলো না। ঝটিতে বেরিয়ে গেলো। কিছুদিন পরে আমি বুঝলাম—-ভাইয়া যুদ্ধে গেছে। বাবা চোখের জল মুছলেন---
    পাগলটা শেষ পর্যন্ত চলেই গেলো।
    মা কিন্তু সেই বিকেলে খুব কেঁদেছিলেন। কান্না দেখলেই কান্না আসে। দেখাদেখি আমি আর আপাও খুব কেঁদেছিলাম।
    এরপরই আমাদের বাসায় লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষ আসতো। পরে শুনেছি, ওরা মুক্তিযোদ্ধা। ভাইয়ার খবর নিয়ে আসে। আমার মন আনন্দে নাচতো। ভাইয়ার কী মজা! সেই ছবিতে দেখা লোকটার মতো ভাইয়া বনে জংগলে, পাহাড়ে যুদ্ধ করে। মা কিছুতেই কিছু বুঝতে পারে না। মায়ের চেয়ে যুদ্ধ বড়ো—কে বোঝাবে এই কথা। একদিন শুনলাম—ভাইয়া ওপার বাংলায় চলে গেছে। গোটা গোটা অক্ষরে আমাকে এক লাইন চিঠি লিখেছে—লালগোলাপের যত্ব নিস। আমি শিগগির ফিরবো ।
    দ্বিগুণ উৎসাহে বাগানের যত্ন নেই। আমার সেই শৈশব চপলতায় মুখর হয়ে ওঠে সারা বাড়ি। কিন্তু বাবার চোখে আষাঢ়ের কালো মেঘ। মায়ের মনে অশান্তির ঢেউ।
    দিন গড়িয়ে চলে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে তোড়জোড়ে। খুব উন্মাতাল দিন। চারিদিকে বিপদের ঘনঘটা। বাবা জমানো পয়সা ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। অবসর সময়ে আপার সঙ্গে দাবা খেলেন। মন ভরা চিন্তা। তাই অমনোযোগের কারণে প্রায় হেরে যান। আপা খুব খুশি হয়। জয়ী হয় বলে আমার গালে টুসকি মারে। কান মলে ফুসফুস করে কথা বলে—
    তুই লক্ষ্মী সোনা ভাই! কত্তো ভালোবাসি  তোকে।
    মিথ্যে কথা। আপা কখনোই আইসক্রীমের ভাগ দেয় না আমাকে। কালিকলম নিয়ে ঘষাঘষি করলে রাগ করে। শখ করে নেলপালিশ মাখলে কান মলে দেয়।
    ফুর্তিতে থাকলে দাদা ডাকে। আর বলে,
    দাদা, আমাকে দিদি ডাকবি কিন্তু! কিছুদিন পর'আপা আর আমি মিলে নতুন একটা খেলা তৈরি করলাম। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই। তাহলে চলবে কী করে। বাধ্য হয়ে টস করি। বারবার হেরে যাই। পাকবাহিনী সাজতে আমার একটুও ইচ্ছে করে না। স্কুল বন্ধ। হাতে অফুরন্ত সময়। বাবা আমাকে দশটা করে ইংরাজিতে শব্দ শিখতে বলেছেন। সন্ধেরাতে নীরস ওয়ার্ডবুক নিয়ে বসি। বাবা তখন কানের কাছে রেডিও নিয়ে কী সব শোনেন। বাসা থেকে বেরুনো নিষেধ।
    টিমে তেতালা ছন্দে আমার সময় কাটে। হঠাৎ করে ভাইয়ার খবর আসা বন্ধ হয়ে গেলো। সেই সময়েই বাবা মা জরীফ বুড়ো হয়ে গেলেন। কান্নাকাটি করতে করতে মায়ের চোখের জ্যোতি কমে গেলো। বাবা কথা বলা কমিয়ে দিলেন। পাড়ার কাকুরা বাসায় এলেও বাবা মুখচোরা থাকেন। আমাদের সেই উজ্জ্বল বাড়িতে নেমে এলো থকথকে নীরবতা।
    সেই আমি তখন এসবের কিছু কিছু বুঝেছিলাম। বাকিটা অনেক পরে। নয়মাস যুদ্ধের পর স্বাধীনতা আসে। লাখো মানুষের রক্তস্রোত। সবুজ দেশে উঠছে লাল সূর্য। দিকে দিকে সবার বিজয় উল্লাস। বুকে বুক মেলাবার দিন। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল। রাইফেলের গুলির শব্দে মুখর হচ্ছে স্বাধীনতার চেতনা।
    আমার মন ভালো নেই। যুদ্ধ শেষে ভাইয়া আর ফেরেনি। আপাও আর যখন তখন সাজগোজ করে না। বেণী বাঁধে না এলোচুলে।
    আমার বোধে স্বাধীনতা দীপ্ত নয়। তবু আমি বুঝতে পারি—সবাই আজ মুক্ত। আবার আমি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাবো। বাবা অফিস থেকে ফিরবেন হাসিমুখে। সঙ্গে থাকবে ঠোঙাভর্তি মুখরোচক খাবার। ভাইয়ারা যুদ্ধ শেষে কেন ফিরবে? কোটি কোটি মানুষের জন্য ভাইয়ারা লড়াই করেছে। মৃত্যুর মধ্যেই সেই লড়াইয়ের আসল আনন্দ।
    একদিন ভাইয়ার এক বন্ধু এসে হস্তদন্ত হয়ে খবর দেয়—ও নেই। ছদিন আগে মারা গেছে। তিনদিন আমাদের বাসায় হাড়ি চড়েনি। মা আর আপা কেঁদেকেটে কাঁপিয়ে তুলেছে পুরো বাড়ি। বাবা চুপচাপ, নিরুত্তর। আমি কেঁদেছিলাম। ডিসেম্বরের সেই দুই তারিখ আমাদের হৃদয়ে খচিত উজ্জ্বল দিন। বছরের সুরুতেই নতুন ক্যালেন্ডারে আমি দাগ দিয়ে রাখি।
    সতেরো তারিখ ভাইয়ার বন্ধু পামেল আসে। কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে। যুদ্ধ ফেরত খাটি যোদ্ধা মনে হয় না পামেল ভাইয়াকে। যুদ্ধে গেলে আবার ফিরে আসা কী? পামেল ভাইয়া এসে একটা ডাইরি দিয়ে যায় বাবার হাতে। বারান্দার ওপর বসে তৃপ্তি ভরে ভাত খায়। পাড়ার সবাই এসে আমাদের উঠোনে ভীড় করে। একজন মুক্তিযোদ্ধার দিকে তাকিয়ে আশ মেটে না কারো।
    পামেল ভাইয়ার হাতে সময় কম।আমি সুযোগ বুঝে স্টেনগানটা একটু নাড়াচাড়া কবে দেখি। পাশের ঘর থেকে আপা ডাক দেয়—
    কপোত শুনে যা একটু, শিগগির—
    আপা আমার কানে কানে বলে দেয়,
    যন্ত্রটা একটু নিয়ে আয়।
    তারপর দু’ভাইবোন মিলে সেটা উল্টাই পাল্টাই।
    ভাইয়ার আরেকবন্ধু ইসমাইল আর্ট কলেজে পড়ত। ভাইয়ার একটা তেল রং-এ পোট্রেট এঁকে দেয় সে। সেটা আজো সযত্নে আমাদের ঘরে টাঙানো আছে। বাবা কখনো কখনো লাল মলাটের ডাইরি বের করে পড়েন। আর টপটপ করে চোখের পানি ফেলেন। ভাইয়ার মৃত্যুদিনে আমি ফুলের মালা দিয়ে ছবিটা সাজিয়ে দেই।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি অনেক কিছু জানতে পারি। একদিন লুকিয়ে পড়ে ফেলি ডাইরিটা। কিছুকিছু অংশ আমার হৃদয়ে চিরদিনের জন্য গেঁথে থাকে।
    ....আজকে আমরা বেনাপোল বর্ডারে পৌছেছি। পাকবাহিনীর ঘাটির ওপর কাল ভোরবেলা আক্রমণ চালাতে হবে। আমরা চৌদ্দজন। সঙ্গে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নেই। তবু চালিয়ে যেতে হবে। বনগাঁ রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার মায়ের কথা মনে পড়লো। ইচ্ছে হলো, হাতে শান্তির রুমাল উড়িয়ে মার কাছে ফিরে যাই। দুহাত আঁকড়ে ধরে বলি মা, তোমার ছেলে ফিরে এসেছে। তোমাকে মুক্ত করেছে।
    তুমি প্রাণ খুলে হাসো না।.....
    ...গত কদিন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। অপারেশনে মারা পড়েছে পাচজন। মেরেছি সাতাশজন। বাবা যদি জানতেন—আ.ম মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরার জন্য উন্মুখ! মুখ টিপে লাজুক হাসতেন। হয়তো বলতেন, ওগো, দেখো পাগল ছেলের কাণ্ড দেখো!
    যারা মারা পড়েছে ওদের দায়সারাভাবে কবর দিতে হয়েছে। আশপাশের লোকদের সাহায্য কোনদিন ভুলবার নয়। ইসমাইল এক ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থেকে তিনদিন উপোস করে কাটিয়েছে। ডান হাতে গুলি খেয়ে পুরো একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। পরে গ্রামের লোকেরাই উদ্ধার করে। বাঁচিয়ে তোলে।
    আমি সূর্যসেনের জীবনী পড়তে বসেছি।
    ...বাড়ির কথা মনে পড়ছে খুব বেশী। আমার লক্ষ্মী বোনটাকে আদর করি না কতোদিন। ভাবুক ছেলে কপোতই বা কেমন আছে। ও নিশ্চয়ই এখনো খুব সকালে উঠতে চায় না। গল্প শোনার জন্য কার কাছে আবদার করে? বাড়ি ফিরে কপোতকে রাইফেল চালানো শিখিয়ে দেব। ও খুব খুশি হবে। বোনের জন্য আমার ভালোবাসার ঘাটতি নেই। কিছুদিন আগে টেনিদার সিরিজ পড়তে চেয়েছে। আমি মার্ক টোয়েনের বইগুলো ওকে কিনে দেব। বোনটির ফ্রকের আঁচল চিবুনো অভ্যেস। এখনো কিসে অভ্যেস আছে তার। অনেকদিন বাসার খবর পাই না। চার মাস যুদ্ধে এসে মনে হচ্ছে, যুগ যুগান্তর ধরে এখানে পড়ে গেছি। যেন কোনদিন আমি বাবা-মায়ের কাছে থাকিনি। আমার কোন ভাইবোন নেই।
    সেই আদিম যুগের মানুষের মতো শুধু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। আর কতদিন খেলতে হবে।
    ....খুব ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। আমরা যশোরে পৌছেছি। পাকবাহিনীর বুদ্ধি ভোঁতা। সেই সুযোগে আমরা বিজয়ের স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি। গত বিকেলে পাপ্পু, তপন আর লিটু মারা গেছে। পাপ্পুর কপালের খুলি উড়ে গেছে। কী বীভৎস সে চেহারা। কিন্তু ঠোঁটের হাসিটুকু লেগে রয়েছে। আমাদের ক্যাম্পের সামনে কবর দিলাম। আমি কবরের ওপর একটা রক্তগোলাপ পুতে দিলাম। ফুলটা হাতে নিতেই বাড়ির কথা মনে পড়লো। একা থাকা পৃথিবীতে অনেক সুখের। বাবা মা ভাইবোনদের নিয়ে যে অখণ্ড পরিবার তাতে আমরা লতায় পাতায় জড়িয়ে পড়ি। বাইরের বাতাসে বেরিয়ে এলেই হৃদয়ে টান লাগে।
    আমি ফিরে যাব। এক বুক স্বাধীনতা নিয়ে আমার সেই চিলতে উঠোনে দাঁড়াব। সবাইকে বলবো, আমি এসেছি। কপোত কি বাগানের যত্ব নিচ্ছে? বাবা কি চেহারা ভার করে অনাগত দিনের কথা ভাবছেন? আদুরে বোনটা কি গলে গলে পড়ছে ভালোবাসায়? মা তার দুরন্ত, পাগল ছেলেটার জন্যে এখনো কি কান্নাকাটি করে? কে জানে কে বলতে পারে এখন কেমন আছে ১৯৮ জগন্নাথ সাহা রোডের সেই বাড়িটি?
    ....আমার বাগানে নিশ্চয়ই শীতের সুরুতে অনেক রক্তগোলাপ ধরেছে। লাল টকটকে রঙের মধ্যে এক ধরনের উগ্রতা আছে। জেদী, দামাল, সাহসীজনের প্রিয় রং লাল। সূর্যে লাল স্নিগ্ধতা থাকলেও কখনো কখনো তা ভয়ংকর। অনেকগুলো রক্তগোলাপের দরকার আমার। খুব তাড়াতাড়ি কাছের মানুষরা চলে যাচ্ছে। কাল যার সঙ্গে এক পাতে ভাত খেলাম আজ সে পৃথিবীর সব মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। রিটন, হেলাল, বাচ্চু, পলু সবাই আছে শান্তিতে। যাদের ছাড়া এই বিরাট যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারি না তারাও হারিয়ে যায়। আসলে তাই-ই শুধু আসা যাওয়া।
    এই আসা যাওয়ার মাঝখানে দুএকটি স্মৃতি, কিছু টুকরো ঘটনা। ছেড়া ছেড়া কথা। ওদের কবরে গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছে আমার। কিন্তু হাতের কাছে একটা রক্তগোলাপও পেলাম না। সময় ও সুযোগ পেলে সবাইকে রক্তগোলাপের ওপর শুইয়ে রাখতাম। কিছুদিন আগে কপোতকে তাই এক লাইনে লিখে দিয়েছি—বাগানের যত্ন নিস।
    বাবা আমার জন্য দোয়া করো। মা, তোমার ছেলে নিরুদ্দেশ নয়, ফিরে আসবে। শুধু দোয়া করো। . . . . .
    আমি সেই কপোত। বারো বছর আগে আমার ভাইয়া যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। আপা শ্বশুর বাড়ি থাকে। বাবা বুড়ো হয়ে গেছেন। মায়েরও বয়স হয়েছে অনেক।

    ভাইয়ার ডাইরিটা পুরো অংশই আমার মুখস্থ। ভাইয়ার জন্য আমি গর্ব করি। ছব্বিশে মার্চ আমার চেতরা জুড়ে থাকে ভাইয়া। ষোলই ডিসেম্বর ঢাকা শহরময় ছড়িয়ে পড়ে ভাইয়া অস্তিত্ব। .
    আজতক আমার উঠোনে বাগান রয়েছে। গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তগোলাপের সমারোহ। বাবা মাঝে মাঝে আমার খেয়াল দেখে হাসেন—
    ও ফিরে আসবে না কোনদিন। অযথা বুকে কষ্ট বাড়াস ফুল লাগিয়ে।


    আপা বাসায় এলেই ফুল ছিড়ে নিয়ে যায়। আর আমি অপেক্ষায় থাকি—ভাইয়া হয়তো আসবে। লাল রক্তগোলাপের পাপড়ি মাড়িয়ে বলবে—
    কপোত, তুই ভালো আছিস। দেশতো এখন স্বাধীন। তোরা সবাই বড় হয়ে গেছিস। কতো সুখে আছিস। আমাকে কিছু রক্তগোলাপের পাপড়ি দে। একটা একটা করে আমি সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেব। কেন না—ওদের জন্যে কেউ কিছুই করেনি।
    কিন্তু ভাইয়া ফিরে আসে না। কোনদিন আসবে না। আমি কপোত তবু অপেক্ষায় থাকি।


গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

      দক্ষিণের শহর আর গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে আসছিলো। খবরটা শুনে মে মাসের প্রথম থেকেই গ্রামের...

      দক্ষিণের শহর আর গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে আসছিলো। খবরটা শুনে মে মাসের প্রথম থেকেই গ্রামের লোক আরো উত্তরে শালবনের দিকে সরে যেতে লাগলো। অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে কুচবিহার আর পশ্চিম দিনাজপুরে চলে গেলো।
      সীমান্ত বেশি দূরে নয়। অনেকে ওপারে গিয়েও নিয়মিত যাওয়াি আসা করছিলো। জুনের মাঝামাঝি যখন সবাই নদীর ওপারের ছোট্ট শহরটিকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখলো, তখন যার যাবার তারা একেবারেই চলে গেলো! থেমে গেলো জামাত, মুসলীম লীগের কিছু দালাল আর কয়েকজন বুড়ো। গির্জার ঘণ্টা টানতো বুড়ো ডেসমন ডি রোজারিও। সে ছিলো থেকে যাওয়া বুড়োদের একজন।
      এতোদিন ফাদার মার্টিন ছিলেন গির্জায়। যশোরে পাঞ্জাবীরা মিশনারীদের মেরেছে—এই খবর শুনে তিনিও কিছুদিন আগে শহরে চলে গেছেন। বুড়ো ডেসমনকে ডেকে বলেছিলেন, উহারা মিশনারীদিগকেও হত্যা করিতেছে। আমি শহরে যাইতেছি। তুমি বিপদ দেখিলে ইণ্ডিয়া চলিয়া যাইও। ইণ্ডিয়ার মানুষ আমাদের অসহায় মানুষদিগকে আশ্রয় দিয়াছে। ঈশ্বর উহাদের মঙ্গল করিবেন। এই বলে ফাদার বুকে ক্রস এঁকেছিলেন।
      বুড়ো ডেসমন মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে কাটতে জবাব দিয়েছিলো ‘মুই আর কুষ্ঠে যাবেক ফাদার।’
      অনেক ভেবেছিলো ডেসমন বুড়ো। আসলে সে যাবেইবা কোথায়! তার স্বজাতি সাঁওতালরা যখন যেখানে খুশি অনায়াসে চলে যেতে পারে। ওদের রক্তের সকল অণুতে মহুয়ার মতো মিশে আছে যাযাবরের নেশা। কিন্তু ডেসমনের সেই নেশা কেটে গেছে বহু বছর আগে।
       গ্রামে যখন এই গির্জা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হলো, ডেসমন তখন বারো বছরের বালক। পাদ্রী ছিলেন ফাদার নিকোলাস। তিনিই ডেসমনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—‘প্রভুর স্থান ছাড়িয়া কোথাও যাইওনা। প্ৰভু তোমাকে রক্ষা করিবেন।
      সেই থেকে ডেসমন এই গির্জায় পড়ে আছে। গির্জার পাশে সবুজ ঘাসের আঙিনা। দেয়ালের ওপাশে সারি সারি কবর। সবুজ আঙিনা আর কবরের মাঝে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের গায়ে লাগানো ছোট্ট দু'টো ঘর। ছাদটা লাল টালির। দেয়ালগুলো সাদা চুনকাম করা। এই ঘর দু’টো ডেসমনের। সারাদিন ডেসমন এখানেই থাকে, আর গির্জার ঘণ্টা বাজায়। ওর মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র কাজের দায়িত্ব প্রভু ওকেই দিয়েছেন।
      আগে ডেসমন সকালে গির্জার বাগানে কাজ করতো। গির্জার ভেতরের ঝাড়ামোছাগুলো শেষ করে রাখতো। বিকেলে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতো। প্রভু ছোটদের ভালোবাসতেন। বহুদিন বাইবেল থেকে ফাদাররা পড়ে শুনিয়েছেন, ‘যীশু কহিলেন, শিশুদিগকে আমার নিকট আসিতে দাও। বারণ করিও না। কারণ স্বৰ্গরাজ্য এইমত লোকদেরই।’
      প্রায় জনশূন্য গ্রামগুলোতে মানুষের সাড়াশব্দ একেবারেই নেই। দু’একজন বুড়ো , যারা এখনো গ্রামে আছে, তারা ছোটদের মতো সারা গ্রাম মাতিয়ে রাখতে পারে না। বুড়ো ডেসমনের বুকে শুধু যন্ত্রণার ঢেউ উত্তাল হয়। নিবির দাদু, হরিপদর খুড়ো যখন এসে শহরে শত্রু সৈন্যদের অত্যাচারের কথা বলে, ডেসমন তখন বুকে জমে থাকা কান্না থামিয়ে রাখতে পারে না।
      সারা জুলাই মাসটা বুড়ো ডেসমন একা একা কাটালো। বাগানের কাজে আগের মতো উৎসাহ পেতো না। তবু সকালটা গির্জার কাজে ব্যস্ত থাকতো। বিকেলগুলো ওর কাছে ভয়াবহ মনে হতো। গ্রামের সেই উচ্ছল ঝর্ণার মতো ছেলেমেয়েগুলো কোন এক শয়তানের যাদুবলে কোথায় কিভাবে যে হারিয়ে গেলো—ডেসমন যতো ভাবে ততো তার বুকে দুঃখের পাহাড় জমে। গির্জার প্রাঙ্গণে কতগুলো শিরিষ গাছ ছিলো। অন্য সময়ে গাছগুলোতে রঙবেরঙের পাখির মেলা বসতো। এখন পাখিরা আর শিরিষের ডালে গান গেয়ে ছুটোছুটি করে না। আঙ্গিনার সবুজ ঘাসের কার্পেটে প্রজাপতিরা নানা রঙের নকশা আঁকে না। শিরিষের পাতা গলিয়ে বিকেলের মরা রোদ গির্জার গায়ে জড়িয়ে থাকে। বিশাল এক শূন্যতা সারা গ্রাম জুড়ে হা হা করে কাঁদতে থাকে। বাতাসকে মনে হয় কোন ডাইনীর অভিশাপের নিঃশ্বাস। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বুড়ো ডেসমন শুধু ছটফট করে। ভাবে ঈশ্বর কেন ওকে এই নরকে ঠেলে দিলেন!
      যখন সময়গুলো একেবারেই অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন ডেসমন জানালার তাকের ওপর থেকে, ফাদার গাঙ্গুলীর দেয়া ‘মথি লিখিত সু-সমাচার’ খানা নামিয়ে আনে। ভালো মতো পড়তে পারে না ডেসমন। চোখে ঝাপসা দেখে। তবু কোন রকমে বানান করে জোরে জোরে পড়ে—‘ইতিমধ্যে পিতর বাহিরের প্রাঙ্গণে বসিয়াছিলেন। আর একজন দাসী তাহার নিকটে আসিয়া কহিল, তুমিও সেই গালীলীয় যীশুর সঙ্গে ছিলে? কিন্তু তিনি সকলের সাক্ষাতে অস্বীকার করিয়া কহিলেন, তুমি কি বলিতেছ আমি বুঝিতে পারিলাম না। তিনি ফটকের নিকট গেলে আরেক দাসী তাহাকে দেখিয়া সেস্থানের লোকদিগকে কহিল, এ ব্যক্তি সেই নাযারথীর যীশুর সঙ্গে ছিল। তিনি আবার অস্বীকার করিলেন, দিব্য করিয়া কহিলেন, আমি সে ব্যক্তিকে চিনিনা। আর অল্পক্ষণ পরে যাহারা নিকট দাঁড়াইয়াছিল তাহারা আসিয়া পিতরকে কহিল, সত্যিই তুমি তাহদের একজন। কেননা তোমার ভাষা তোমার পরিচয় দিতেছে। তখন তিনি অভিশাপপূর্বক শপথ করিয়া বলিতে লাগিলেন আমি সে ব্যক্তিকে চিনিনা। তখনই কুকুড়া ডাকিয়া উঠিল। তাহাতে যীশু এই যে কথা বলিয়াছিলেন, 'কুকুড়া ডাকিবার পূর্বে তুমি তিনবার আমাকে অস্বীকার করিবে, তাহা পিতরের মনে পড়িল। এবং তিনি বাহিরে গিয়া অত্যন্ত রোদন করিলেন।’
      ডেসমন যতোবার বাইবেল পড়ে যীশুখৃষ্টের ক্রসবিদ্ধ হবার ঘটনার কথা ভাবে ততোবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। তবু সে জোরে জোরে বাইবেল পড়ে। ওর মনে হতো বাইবেলের পবিত্র শব্দগুলো, শয়তানের মতো ভয়ঙ্কর নীরবতাকে তাড়া করে ফিরছে। গির্জার প্রাঙ্গণে অন্ধকার নামা পর্যন্ত ডেসমন বাইবেল পড়ে। নীরবতাকে ডেসমন ভয করে একই সঙ্গে ঘৃণাও করে।
      আগস্টের শেষে এক বৃষ্টিভেজা রাতে ওরা কয়েকজন এলো বুড়ো ডেসমনের ঘরে। হারিকেনের স্নান আলোয় ডেসমন তখন গির্জার আইকন পরিষ্কার করছিলো। দরজায় হালকা পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো। দেখলো তিনটি ছেলে, বৃষ্টিতে ভেজা সারা শরীর, চুলের ডগা বেয়ে মুক্তোর দানার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। ওদের উজ্জ্বল চোখগুলো হারিকেনের ম্লান আলোতেও চকচক করছিলো। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ডেসমনের মনে হলো, ওরা যেন তিনজন দেবদূত, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। তারপর সে এতো বেশি অভিভূত হয়ে গেলো যে, আর কোন কথাই বলতে পারলো না।
      ওরা তিনজন একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। একজন একটু হেসে বললো, ‘আমরা আজ রাতে তোমার এখানে থাকবো ডেসমন দাদু।
      আরেকজন বললো, ‘তোমাদের গাঁয়ের দাশু খুড়ো বলেছে, তুমি খুব ভালো লোক। 
      স্বর্গের দেবদূত ওর কাছে এসেছে, ওর ঘরে থাকতে চাইছে—ডেসমন কি বলবে সহসা কিছুই ভেবে পেলো না। তারপর এলোমেলো ভাবে বললো, “হায় হায়, থাকতি কেনে দিবেক নেই। তোমাদের কষ্ট হতিছে বাছা। আগুনের ধারে বস। সব ভিজ্যে গেছে।’
      হাতের ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রেখে ওরা ছোট্ট উনুনটির পাশে গিয়ে বসলো। বললো, ‘দাশু খুড়ো তোমার কথা অনেক বলেছে ডেসমন দাদু। বলেছে তুমিই আমাদের সাহায্য করতে পারো। তোমার মতো ভালো লোক এ গাঁয়ে আর নেই।'
      বিরাশী বছরের বুড়ো ডেসমন লজ্জায় লাল হলো। স্বর্গের দেবদূত ওকে একি কথা শোনাচ্ছে! মাথা নেড়ে বললো, 'না না, সেটি ঠিক বুলে নাই। সাহাইয্য লিচ্চয়ই করিব। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করিবেন।
      অনেক রাত অবধি বুড়ো ডেসমনের সঙ্গে ওদের কথা হলো। ডেসমনের মনে হলো, দেবদূতরা ওর জন্যে স্বর্গের বাণী বয়ে এনেছে। ওরা জানে, শিরিষ গাছে পাখিরা কেন গান গায় না, ঘাসফুলের প্রজাপতিরা কেন আর আসে না, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দের শব্দ আর রঙ কোথায় হারিয়ে গেছে। ওরা আনন্দে হারিয়ে যাওয়া শব্দকে ফিরিয়ে আনবে। শয়তানের বিষাক্ত যন্ত্রণার ছায়া পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দেবে। শিরিষের ডালে আবার পাখিরা গান গাইবে। মুগ্ধ হয়ে ডেসমন ওদের কথা শোনে। ওর ঘোলাটে চোখে আনন্দ নেচে বেড়ায়। বার বার বলে, ঈশ্বর তুমাদের মঙ্গল করিবেন।
      স্বর্গের দেবদূত হাসতে হাসতে ডেসমনকে বলে, ‘তোমাকে আমরা শিখিয়ে দেবো কি করে গ্রেনেড মারতে হয়, আর রাইফেল চালাতে হয়।’
      আনন্দে উত্তেজনায় ডেসমন শুধু বলে, ‘লিচ্চয়ই, লিচ্চয়ই।’ এরপর দিনগুলো যে কিভাবে কাটলো ডেসমন বুড়ো আর হিসেব বাখতে পারলে না। স্বচ্ছ সরোবর হাঁসের মতো তরতর করে সময় বয়ে যেতে লাগলো। সকালে লাঠিতে ভর দিয়ে ডেসমন নদীর তীর অবধি চলে যায়। কোনদিন আবার একেবারে শহরে ঘুরে ঘুরে সব দেখে আসে। পাহারারত পাঞ্জাবী সৈন্যরা কেউ ওকে উপেক্ষা করে, কেউ রসিকতা করে। রাতে দেবদূতের দল আসে ওর কাছে। সারা ঘর আলো হয়ে যায়। ডেসমনের কানে গির্জার প্রার্থনা সঙ্গীত বাজতে থাকে। ওদের সঙ্গে ওর কথা হয়। তারপর গভীর রাতে ওরা চলে যায়। দূরে শহরে বিস্ফোরণের শব্দ হয়। মেশিনগান গর্জন করে, আবার কোথাও গ্রেনেড ফাটে। ডেসমনের চোখে আর ঘুম নামে না। শেষ রাতে ওরা এসে বলে, ‘আমরা যাচ্ছি। ভালো থেকে ডেসমন দাদু। আবার দেখা হবে।’
      ওরা চলে যাবার পর আবার শয়তানের মতো কদাকার সেই নীরবতা ডেসমনকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়। লাঠিতে ভর দিয়ে ডেসমন গ্রামের ভেতরে যায়। তালা বন্ধ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘হরিপদর খুড়ো ঘরে আছে? ও হরিপদর খুড়ো? কেউ কোন সাড়া দেয় না।
      আরেকটা শেকল তোলা দরজার সামনে গিয়ে ডেসমন ডাকে,‘নিবির দাদু? ও নিবির দাদু? উঠোনের কোণ থেকে হাড় বের করা একটা লোমঝরা কুকুর শুধু একবার মাথা তুলে ডেসমনকে দেখে। গ্রামের সবাই চলে গেছে। ভীষণ ভয় পায় ডেসমন। লাঠিতে ভর দিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে আবার গির্জায় ফিরে আসে। অসময়ে গির্জার ঘণ্টা বাজায়। ডেসমনের মনে হয়, শব্দের অভাবে ও বুঝি পাগল হয়ে যাবে।
      অবশেষে একদিন সেই ভয়ঙ্কর সময়ের মুখোমুখি হলো ডেসমন বুড়ো। শেষ রাতে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ও গভীর আনন্দে ঘুমিয়েছিলো। তখন আকাশের অন্ধকার সবেমাত্র ফ্যাকাশে হতে সুরু করেছে—গির্জার বড় ফটকের বাইরে শব্দ শুনে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কিছু উত্তেজিত আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর—কথা বোঝা যাচ্ছে না।
      লাঠি হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ডেসমন। ততোক্ষণে ফটকে করাঘাত পড়েছে। ভারি ফটকটা ধীরে ধীরে খুলে বাইরে তাকিয়ে যা দেখলে তাতে ওর সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেলো। কয়েকজন হিংস্র মানুষ ওদের ঘিরে পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ওরা তিনজন, স্বর্গের সেই দেবদূত—হাতগুলো বাঁধা, সারা শরীরে ধুলো আর রক্তের দাগ নিয়ে একদল ভয়াল নেকড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলো।
      একজন নেকড়ে ধারালো গলায় বললো, “এই বুড়ো, এগুলোকে চিনিস? তোদের গির্জার পাশে ঘুরছিলো।’
      ডেসমন আবার দেখলো ওর প্রিয় দেবদূতদের। যারা ওর জন্যে স্বর্গের বাণী বয়ে আনতো। ডেসমন অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো, ওদের চোখে এখনো স্বর্গের আলো খেলা করছে। বিড় বিড় করে বললো ‘ওরা স্বর্গের দেবদূত।"
      নেকড়েরা আবার গর্জন করে উঠলো, ‘কিরে কথা বলছিস না কেন? আগে কখনো দেখিসনি এগুলোকে?”
     ডেসমনের গলাটা কেঁপে গেলো। বললো না। তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হেঁটে ওর ঘরে চলে গেলো। পবিত্র বাইবেলে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বার বার বললো,না, প্ৰভু না—’
      বাইবেলের ভেতর থেকে ক্রসবিদ্ধ যীশুর অস্তিম বাণী শুনতে পেলো ডেসমন। প্রভু ক্রসের উপর থেকে বলছেন, “ঈশ্বর, আমার ঈশ্বর! তুমি কি আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছ?’ এতটুকু শব্দ না করে ডেসমন অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
      বেশীক্ষণ ঘরে থাকতে পারলো না ডেসমন বুড়ো। বাইরের কোলাহল আরও কাছে মনে হলো। তাকিয়ে দেখলো নেকড়ের দল পাঁচিলের ধারে পড়ে থাকা কবরের কাঠগুলো নিয়ে ছুটোছুটি করে কি যেন বানাচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ডেসমন। সহসা ওর বুকের ভেতরটা কে যেন এক অদৃশ্য মেসিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিলো। একি করছে ওরা? ডেসমন দেখলো অল্প সময়ের মধ্যে শয়তানের দল তিনটি ক্রস বানিয়ে উঁচু ঢিবিটার ওপর পুতে দিয়েছে। আর তিনজন দেবদূত—হায় ঈশ্বর—ছুটে যেতে গিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ডেসমন।
      তিনজন দেবদূত এতটুকু শব্দ করেনি। ওদের মুখে শুধু যন্ত্রণার নীল ছায়া গাঢ় হলো। ডেসমন মাটি থেকে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশের ঘন কালো মেঘের গায়ে তিনটি বিশাল ক্রস। গির্জার প্রাঙ্গণে যীশুখৃষ্টের ক্রসবিদ্ধ মূর্তি দেখেই শয়তানের দল এই নিৰ্মম মৃত্যুর কথা ভেবেছিলো।
      তিনজন মুক্তিযোদ্ধা, যারা গতরাতেও শত্রুর শিবিরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, সকালে তারা তিনজন যীশুখৃষ্ট হয়ে গেছে।
      ডেসমন মেঘের গায়ে ক্রসবিদ্ধ যীশুকে দেখতে পেলো। ঠিক এই রকম ক্রঙ্গের উপর থেকেই তিনি বলেছিলেন, “এলী এলী লামা শবক্তানী। ঈশ্বর আমার ঈশ্বর” ... ।
      নেকড়ের দল হল্লা করে বেরিয়ে গেলো। ডেসমন দেখলো কি যেন বিড় বিড় করে বলছে ওরা। হাত থেকে রক্ত ঝরছে। সারা শরীর বেয়ে রক্তের ধারা নেমে এসেছে। মাথা একপাশে কাত হয়ে ঝুলে পড়েছে। ডেসমন ছুটে গেলো ক্রসের নিচে। আবার মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। তবু সে শুনতে পেলো। একবার, দুবার, তিনবার। পরপর তিনবার শুনলো সেই কথা। ডেসমনের বুকের ভেতর গেঁথে গেলো—‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা। আর ঠিক সেই সময় আকাশ আর মাটি কাঁপিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো।
      তিনদিন পর বুড়ো ডেসমন ঘরে বসে গুন গুন করে বাইবেল থেকে যীশুর পুনরুত্থানের অধ্যায় পড়ছিলো। দরজায় পায়ের শব্দ শুনে চমকে তাকালো। দেখলো তিনজন দেবদূত। হাসি মুখ, উজ্জ্বল চোখ, মুক্তোর মত ঘাম। আগের মতো তিনজন মুক্তিযোদ্ধা।
      ডেসমনের চোখের সামনে তখন মথি লিখিত সু-সমাচারের শেষ কথাটা নেচে বেড়াতে লাগলো—“আর দেখ, আমিই যুগান্ত পর্যন্ত প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছি।”-শব্দগুলো ধীরে ধীরে লক্ষ লক্ষ ক্রসবিদ্ধ যীশুখৃষ্ট হয়ে গেলো।
      ওদের একজন একটু হেসে বললো, ‘আমরা এসেছি।’ 
      বুড়ো ডেসমন কয়েক লক্ষ যীশুখৃষ্ট দেখতে দেখতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

      রোকনপুর গাঁয়ের পূবপ্রান্তে অনেক দিনের পুরনো একটা বটগাছ। ডাইনীবুডির জটার মতো তার পাকানো ঝুরি নেমে এসেছে মাটির ওপর। বুড়ো বটের অজস্র ডা...

      রোকনপুর গাঁয়ের পূবপ্রান্তে অনেক দিনের পুরনো একটা বটগাছ। ডাইনীবুডির জটার মতো তার পাকানো ঝুরি নেমে এসেছে মাটির ওপর। বুড়ো বটের অজস্র ডালপাতার ফাঁকে ফাঁকে হাজারো পাখি দিনভর কিচির মিচির করে। রাত্রে আবার কিন্তু টু-শব্দটিও নেই। যখন বটফল পেকে ওঠে—তখন যেন শুরু হয়ে যায় পাখিদের মহোৎসব। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সুইট-বলের মতো লাল লাল বটফলে মস্ত গাছের ছড়ানো ছায়াটা রংচঙে হয়ে ওঠে। জায়গাটা খুবই নিরিবিলি। দিন-দুপুরেও এদিকটায় কেউ সহজে পা বাড়ায় না। রোকনপুরের প্রকাণ্ড মাঠ পেরিয়ে, যদি কেউ কখনো এ পথে আসেই, তবে নিবিড় বটের ঠাণ্ডা ছায়ায় বসে একটুখানি জিরিয়ে না নিয়ে সে পারে না।

      বারো বছর হয়ে গেলো। কিন্তু এই প্রকাণ্ড বটগাছের ঢেউ ওঠা শরীরের ওপর অনেকগুলো কালো কালো ফুটো এখনও মিলিয়ে যায়নি। বারো বছর আগে ওই গাছের ছাল-বাকলের ওপর শুকনো রক্তের দাগ ছিলো বেশ স্পষ্ট। কিন্তু গুড়ির ওপরকার ফুটোগুলো অ্যাদিনে মিইয়ে এলেও একেবারে মিলিয়ে যায়নি। ফুটোগুলোর দিকে একবার চোখ পড়লেই বারো বছর আগেকার সেই অঘটনটির কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে, ছোট নামের ছোট্ট একটি ছেলের কথা, যার বুকে পিঠে ওই রকম এক ঝাঁক ফুটে হয়েছিলো। আহা, বছর-বারো বয়সের সেই ছোট আজ বেঁচে থাকলে চব্বিশ বছরের যুবক হতো। বারো বছর কি কম সময় !
      মিলিটারীরা ছোটকে হুড-খোলা জীপে তুলে এইখানটায় এনে বলেছিলো, আভি যাও, ভাগো হিয়াসে। ছোট প্রথমটায় কেমন যেন একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলো। চমক ভাঙ্গতেই এক লাফে জীপ থেকে নেমে দৌড় দিয়েছিলো বটগাছটার নিচ দিয়ে। ভেবেছিলো, মাঠ পেরিয়ে নদীর দিকটায় চলে যাবে; কিন্তু জীপ থেকে সে গজ পনেরো যেতেই একটা কর্কশ শব্দে চমকে উঠলো গাছের ঝিমিয়ে পড়া পাখিরা। শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট একটা লাফ দিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলো ছেলেটা। দরকার ছিলো না। তবু স্টেনগানের পুরো ম্যাগাজিনটা এক নিমেষে খালি করে ফেলেছিলো আর্মিরা। অস্ফুট শব্দ করে দুমিনিটে স্থির হয়ে গেলো ছোটর ছোট্ট শরীর। তার পিঠের ওপর অনেকগুলো ফুটো—বুকের দিকে ক্ষতগুলো বড়ো।
      পাখিরা স্তব্ধ হয়ে গেছে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে বটতলার ঠাণ্ডা মাটি। ফোয়ারার ধারার মতো টুকটুকে লাল শিশুর রক্ত ফিনকি দিয়ে উঠে বোবা বটের বুড়ো চামড়ায় আলপনা আঁকলো। রক্তমাখা বেশ কটা বুলেট গাছের গুড়িতেই ঢুকে পড়েছে। চরাচর স্তব্ধ। যেন কিছুই ঘটেনি, এরকম সহজভাবে শিস দিয়ে বাজখাই গলায় কথা বলতে বলতে দুটি হুডখোলা জীপ নিয়ে জনাবারো দখলদার সৈন্য শহরের দিকে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ছোটর রক্তমাখা নিথর শরীরটার দিকে দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো অগুনতি লাল পিঁপড়ে। খুনীরা অবশ্য পরক্ষণেই বিপদে পড়েছিলো শহরে যাবার পথের ওপর। তাহলে, গোড়া থেকেই বলতে হয়।
      মায়ের নিষেধ ছোট মানেনি। এই তুলকালাম তাণ্ডবের মধ্যে ও রোজকার মতো খেলতে গিয়েছিলো সেই পূবের মাঠে। নদীর ওপারে গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে দুদিন ধরে। পাকি সৈন্যরা শহর ছেড়ে ঢুকে পড়েছে এমন পাণ্ডববর্জিত গায়ে গঞ্জেও। ভয়ে দুশ্চিন্তায় সারা রোকনপুর তটস্থ। কখন ওরা এপারে এসেও হানা দেয়, কে বলবে। গ্রাম অবশ্য এর মধ্যেই প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। বেশির ভাগ পরিবার তাদের গাটরি-বোছকা গরু-ছাগল নিয়ে পশ্চিমের দিকে সরে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার গোলাম রসুল সাহেব দো-টানায় পড়ে কি করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। ঢাকার কোনো সঠিক খবর পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় নেতারা ক'দিন আগেও হাটখোলায় এসে বক্তৃতা দিলেন। বললেন—কাজ একটাই, রুখে দাঁড়াতে হবে। জানালেন, ঢাকার রাস্তাঘাটে জোর লড়াই চলেছে—পাঞ্জাবীরা পিছু হটতে হটতে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
      এইরকম খবর পেয়ে গাঁয়ের মানুষ, বিশেষ করে কম বয়েসী ছেলেগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। কেউ কেউ দুএকটা পাখি-মারা বন্দুক আর লাঠি-বল্লম যোগাড় করে কাছের জেলা-সদর আক্রমণ করারও পরিকল্পনা নিয়েছিলো। গোলাম রসুল অনেক কষ্টে জঙ্গী-যুবকদের হাত থেকে গাঁয়ের মধু মেম্বারকে রক্ষা করেছেন। পাকিস্তানের দালালী করছে বলে মারমুখো ছাত্ররা মধু মেম্বারকে এই মারে তো সেই মারে। কিন্তু নদীর ওপারে মিলিটারী আসবার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। গ্রামবাসী এমন ঘাবড়ে গেছে যে তারা ঘরোয়া কথাও ফিস ফিস করে বলে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে শোনা গেলো, জঙ্গী-ছাত্রদের নিয়ে নেতারা সীমান্তের দিকে রওয়ানা হয়ে গেছেন।
      আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে গোলাম রসূলও সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রাম থেকে সরে যেতে হবে। সেদিন দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর সামান্য বাধাছাদা শেষ হলে দেখা গেলো, ছোট নেই। কী ব্যাপার? না, সঙ্গী-সাথী নিয়ে রোজকার মতো সে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতে নদীর ধারে গেছে। বিরক্ত হলেন গোলাম রসূল। এটা একটা কথা হলো? এমন দুর্বিপাকের মধ্যেও ছেলেপিলেরা খেলতে যাবে? বাধাছাদা শেষ। এবার ঘরের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়াই কেবল বাকি। ছোটর মা রাগে বিড়বিড় করছেন। বকাঝকা করছেন দুই মেয়ে রুমকি-ঝুমকিকে। ওদের অপরাধ, ওরা ছোটকে আটকে রাখেনি, আগলে রাখেনি।
      এতো দুঃখের মধ্যেও বেদনার হাসি ফুটে উঠলো গোলাম রসূলের মুখে। ছেলেটা শার্প। খুবই মেধাবী। লেখায় পড়ায় খেলার মাঠে ওর জুড়ি সারাটা ইস্কুলে নেই। কিন্তু ওই এক দোষ—বড়ো দুরন্ত, বড়ো ছটফটে। দেশ জুডে ধুন্ধুমার শুরু হবার পর থেকেই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার হিড়িক লেগেছে ওদের ভেতর। একদল হয় মুক্তি বাহিনী—অন্য দল সাজে পাকিস্তানী সৈন্য! নদীর পারে ঝাউবনের মধ্যে দূর্গ বানিয়ে গাছের ডালের বন্দুক-কামান নিয়ে সেকি যুদ্ধ! বেলা আর একটু পড়লে নদীর ওপারে সারাটা গ্রাম জুড়ে কালো ধোয়ার কুণ্ডলী জেগে উঠলো। গোলাগুলির শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ির সামনে, কাঁচা রাস্তায় তিনটে মালপত্র-বোঝাই গরুর গাড়িতে সপরিবারে যেতে যেতে আলতাফ পেশকার অবাক হয়ে তাকালেন গোলাম রসূলের মুখের দিকে ! লোকটা পাগল নাকি? লটবহর নিয়ে দাওয়ার ওপর বসে ভাবছেটা কি? চেঁচিয়েই উঠলেন পেশকার সাহেব—কী ব্যাপার হেডমাস্টার। মনস্থির করতে পারছে না বুঝি? আরে,যদি বাঁচতে চাও তো চলে এসো। ভাইরে, জানে বাঁচলে বাড়ি ঘর দোর আবার হবে।
      স্নান হেসে গোলাম রসুল বললেন—হাঁ আলতাফ ভাই, এখুনি সব বেরিয়ে পড়বো। এতোক্ষণ রওয়ানা হয়ে যেতাম। গোল বাঁধালো পাঁজিছেলেটা।ও ফিরে এলেই—তার মুখের কথা শেষ হতে না-হতেই ব্যস্তভাবে পেশকার বলে উঠলেন--হাঁ হাঁ আর দেরী করা ঠিক হবে না। অবস্থা খুব খারাপ। শীগগির চলে এসো তোমরা। আমরা তাহলে এগোই।—বাঁশঝাড় পেরিয়ে আঁধার আঁধার তেঁতুল তলা দিয়ে গরুর গাড়িগুলো এগিয়ে গেলো জেলা বোর্ডের রাস্তার দিকে।
      ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে বেরিয়েই পড়লেন গোলাম রসূল। রাগত গলায় বললেন—তোমরা বসো। আমি পাজিটার ঘাড় ধরে নিয়ে আসি গিয়ে। তিনি পথে নামলেন। বেলা এখন আরো হেলে পড়েছে। নিকারি পাড়ায় পালিয়ে যাবার তাড়া নেই। মধু মেম্বারের বাড়ির কামলারা বেগুন ক্ষেতে কঞ্চির বেড়া দিচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলো গোলাম রসুলের কাছে। এদের কি কোনো চিন্তাভাবনা নেই? এমন দুর্বিপাকে এরকম ঠাণ্ডা মাথায় কাজকাম করছে কিভাবে? একি সাহস, না কি নির্লিপ্ততা? তিনি জোর পায়ে হাঁটা দিলেন মাঠের ওপর দিয়ে। মাথাটা যেন দপ দপ করছে। গলা শুকিয়ে খাঁ খাঁ । এরকম অবস্থার কথা সত্যি কেউ কল্পনাও করেনি। আলোচনা ভেঙ্গে গেলেই স্বাধীনতা-যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আন্দোলন চলছে তো কতোকাল ধরেই। কিন্তু এবার এমন কি হলো যে আন্দোলন ঢাকা ছাড়িয়ে সারাটা দেশে ছড়িয়ে পড়লো এতো তাড়াতাড়ি ! বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন প্রায় সবাই সরে পড়েছে রোকনপুর থেকে। প্রবীণ শিক্ষক বীরেন পাঠক গতকাল গ্রাম ছাড়লেন। সদর দরজায় তালা দেবার সময় ভদ্রলোকের সে কি কান্না। ধরা গলায় উচ্চারণ করলেন–জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী! মেয়েরা তুলসীতলায় মাথা খুঁড়তে লাগলো। বীরেন বাবু বাড়ির আঙ্গিনার একমুঠো মাটি দামী স্বর্ণরেণুর মতো পাঞ্জাবীর পকেটে ভবতে ভরতে বললেন—মা, আবার কি তোমার কোলে ফিরে আসতে পারবো?
      গোলাম রসুল নিজে গিয়ে বীরেন বাবুকে হিজলী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছেন। অনেকেই গেছে। কিন্তু কয়েকটি দুর্দান্ত ছেলে এখনো গ্রাম ছাড়েনি। শহর থেকে পালিয়ে আসা পুলিশ-কনস্টেবলদের দুটি থ্রী-নট-গ্রী রাইফেল যোগাড় করেছে ওরা ! জেলা শহর অবশ্য ফল করেছে। নেতা ও কর্মীরা নেই। ডিস্ট্রিক্ট হাই-কমাণ্ডের বাড়িটা হানাদাররা বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। শহরে মারা গেছে অনেক মানুষ। সারাটা শহর এখন মিলিটারীদের কবজায়। ওদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সক্ষম বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধে সামিল হবার আহ্বান শোনা যাচ্ছে ঘন ঘন। কিন্তু কোথায় গিয়ে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তা স্পষ্ট বোঝার উপায় নেই।
      মধু মেম্বার বাল্যবন্ধু হলেও বর্তমান অবস্থায় তাকে খুব একটা বিশ্বাস করেন না গোলাম রসুল! তাল তলার মজে-আসা দীঘি আর তারই লাগোয়া অনাবাদী জমিটুকুর ওপর লোভ আছে মধুর। অনেক দিনের লোভ। অবশ্য ন্যায্য দাম দিয়েই জমি আর দীঘিটা সে কিনে নিতে চায়। গোলাম রসুল একদিন কথায় কথায় বলেছিলেনঃ জমিটা অবশ্য পড়েই থাকে। তুমি লাঙ্গল দেওয়াতে চাও—দাওগে। কিন্তু দীঘিটা আমি পরিষ্কার করাবো। জমিটাও সাফকবালা করে দিতে চাইনা মধু—চষতে চাও চষো—আমাকে কিছু ধান দিও, তাহলেই হবে। ইকো টানতে টানতে মধু মেম্বার তখন বললোঃ শুনলাম, বেঁচে দিচ্ছে। দক্ষিণ পাড়ার আইনুদ্দিন মণ্ডল বলছিলো সেদিন। তা বেঁচবেই যখন ... আমি কি দোষ করলাম হেডমাস্টর !
      গোলাম রসুল একটু সতর্ক হলেন। গলা ঝেড়ে বললেনঃ আইনুদ্দিন একেবারে বানিয়ে বলেনি হে মধু। তবে কিনা—একটু ফাড়া ছিলো—কেটেও গেলো হঠাৎ। তাই বিক্রিবাটার কোনো কথাই ওঠেনা। তবে হা—কখনো যদি বিক্রি করতেই হয়—তোমাকে না জানিয়ে কিছু করবো না |
      কিন্তু এখন? হেলে পড়া সূর্যের স্নান আলো নিজের বিষন্ন মুখটায় মেখে নদীর ওপারে পাক খেয়ে ওঠা ধোয়া দেখতে দেখতে মনে মনে হাসলেন গোলাম রসুল। ভালোই হয়েছে। এবার আর টাকা দিয়ে জমি কেনার ঝামেলা থাকবে না মধুর। যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে হেডমাস্টারের নিজের আর ক’বিঘে,—পাঠক বাড়ির দোতলা দালান সুদ্ধু গাঁয়ের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি আর জমিজমা এবার মধুর হবে। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নদীর ধারে ঝাউগাছগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন গোলাম রসূল। এখানে, নদীর এই খাড়িতেই পাড়ার ছেলেরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে। নিকারীদের ছেলেরা খুঁজতে আসে মাছরাঙার ডিম। কিন্তু কোথায় কি! নির্জন নদীতটে কাক পক্ষিটি নেই। এক অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা দুলে উঠলো গোলাম রসুলের। কোথায় গেলো পাড়ার ছেলেরা? কোথায় গেলো ছোট? কী করবেন তিনি এখন ! গলা ছেড়ে কয়েকবার ডাকলেন—ছোট, ছোট,—ছোটন রে— ! গেলি কোথায় তোরা? কিন্তু আঁকাবাকা নদীর খাড়িতে কারো সাড়া শব্দই পাওয়া গেলো না। কেবল প্রতিধ্বনি ফিরে এলো কাঁপতে কাঁপতে—ছোটন—কোথায় গেলি তোরা !
      আবির-রাঙা হয়ে উঠেছে পশ্চিমের আকাশ। বেলা যেতে আর কতোক্ষণ ! ওরা কি তবে খালের ধার দিয়ে গাঁয়ে ফিরে গেছে! চিন্তিতভাবে ফিরে চললেন গোলাম রসূল। সারা গ্রাম নীরব নিঝুম। কেবল নিকারী পাড়ায় টেমির আলো জ্বলছে। আলো দেখা যায় দূরে—মধু মেম্বারের বাড়িতেও । আর প্রায় সব দিকেই কাঁচা সন্ধ্যার আবছা আধার। আশ্চর্য—এমন দিনেও ঝি ঝিঁ ডাকে,জোনাক জ্বলে! গোলাম রসুলের মনটা ছেয়ে যাচ্ছে বিষন্নতায়। কতো প্রিয়, কতো পরিচিত এ পথ। আজ যেন অচেনা, অন্য রকম লাগছে সবকিছুই। মনে হয়, এ রাস্তা, এই গাছপালা কিছুই আর তার নয়।
      গোলাম রসুল নানা কথা চিন্তা করতে করতে কখন নিজের বাড়ির সামনে এসে পড়েছেন, ঠাহর করতে পারেন নি।
হঠাৎ চমকে উঠে থমকে দাড়ালেন তিনি। এ কি? ওরা কোথায়? বৈঠকখানার দাওয়ার ওপর তো কেউ নেই। একটা আলো পর্যন্ত জ্বালানো হয়নি। বাধাছাদা শেষ করে ছোটর মা আর রুমকি-ঝুমকিকে এখানেই তো বসিয়ে রেখে গেছেন ; কিন্তু গেলো কোথায় সব! নাঃ সারা বাড়ির আনাচে-কানাচে খুঁজে কোথাও কাউকে দেখতে পেলেন না গোলাম রসুল। বিবি ডাকা আঙ্গিনার ওপর দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি ডাক দিলেন—রুমকি! ..ঝুমকি! ডাকলেন—ছোট, ছোটন, ফিরে এসেছিস, বাবা? যেন মাটি ফুড়েই দুটি ছায়ামূর্তি তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো। চমকে উঠে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই দুলালের চাপা গলা শোনা গেলোঃ আস্তে কথা বলুন চাচা, আস্তে কথা বলুন। চাচীরা নিরাপদেই আছেন। একটু আগেই গাঁয়ে চুপে চুপে ঢুকেছে দুটাে আর্মি-জিপ। শহরের দিক থেকে দক্ষিণ-পাড়ার জঙ্গলে রাস্তা দিয়ে এসেছে ওরা ! আমরা মোকাবেলা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা দলে ভারী। বেশ কখানা অটোম্যাটিন রাইফেল আর স্টেনগান আছে ওদের সঙ্গে। আমাদের সম্বল দু’টো থ্রী নট গ্রী। তা-ও আবাল অ্যামুনিশান নেই।
      একদমে এতোগুলো কথা বলে হাঁফাতে লাগলো দুলাল। ঠাহর করে গোলাম রসুল বুঝলেন, দুলালের পেছনে আরো একটি রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আলতাফ পেশকারের মেজো ছেলে আসলাম। চাপা ক্রোধে, যেন ছায়াছন্ন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে।
      ওরা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন গোলাম রসূল। 
      দুলাল বললোঃ আলতাফ চাচাদের সঙ্গে ওদের সবাইকে চর-হিজলীর মাঝি-পাড়ার দিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। অবশ্য চাচী বারবার ছোট আর আপনার কথা ভেবে আপত্তি করছিলেন যেতে। জায়গাটা সেফ। খুবই দুর্গম। খালবিল ভেঙ্গে জীপটিপ যেতে পারবে না ওদিকে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
      হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়েই উঠলেন গোলাম রসুলঃ কিন্তু আমাদের ছোট কোথায়। ওকে তো কোথাও খুঁজে পেলাম না!
      নিজের ঠোঁঠের ওপর তর্জনি চেপে দুলাল শব্দ করলোঃ শ-শ-শ! চাপা গলায় আসলাম বললোঃ ছোট আছে মধু মেম্বারের বাডিতে। ওই বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে খেলা শেষে ফিরে এসে ও দেখে, ঘরদোর তালাবন্ধ। কেউ কোথাও নেই। দাওয়ার ওপর বসে ফুঁপিয়ে তাই কাদছিলো। আপনার খোঁজে এদিকে এসে আমরা কেবল ছোটকে পেলাম। আমাদের দেখে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছিলো। আমরা ওকে সব কথা খুলে বলবার আগেই কানে এলো জীপের আওয়াজ। তখন বাড়ির পেছনের জঙ্গলে-পথে ওকে মধু মেম্বারের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েই আমরা সরে পড়েছিলাম। ছোট আমাদের সঙ্গে ছুটে পারবে না। আর আমাদেরই বা কখন কি ঘটে। এইসব ভেবে আপাতত ওকে মধু মেম্বারের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছি। অপেক্ষা করছি আপনার জন্যে। কিন্তু ওদিকে—আসলাম কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলো।
      হারানো কথার খেই ধরলেন গোলাম রসুলঃ ওদিকে কি ! ওদিককার কথা কী বলছে? দুলাল বললোঃ আর্মিরা মেম্বারের বাড়িতে চা খাচ্ছে। মহা হৈ হল্লা সারা বাড়ি জুড়ে। যেন খুশির তুফান ছুটছে। ব্যাটা দালাল। আর ওই কামলাগুলোও মহা উজবুক। হুঁকোটানতে টানতে বলাবলি করছেঃ গাঁ-টা পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। মেম্বর সাব ছিলেন বলে রক্ষা। মেম্বর সাবই বাঁচালেন। সে যাই হোক, এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। আপদগুলো বিদায় হলেই ছোটকে ডেকে নিয়ে আমরা চর হিজলীর দিকে রওয়ানা হয়ে যেতে পারি। গঞ্জের মোড়ে রিকশাটিক্সা এখন বোধহয় আর নেই! হেঁটেই যেতে হবে আমাদের।
      আসলাম ভরসা দিলোঃ সঙ্গে টর্চ আছে। কাদাপানি ভেঙ্গে ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে চলে যেতে কোনো অসুবিধা হবে না। একটু থেমে সে আবার বললোঃ আপনারা দুজন দাঁড়ান একটু। আমি ছোটকে নিয়েই আসি গিয়ে। 
      আসলাম ওর হ্যাণ্ডব্যাগ আর রাইফেলটা উঠোনের শিউলি গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
     আসলাম ততোক্ষণে বোধহয় অর্ধেক পথও যায়নি—দূরে জীপের ইঞ্জিন গর্জে উঠলো। চমকে উঠলেন গোলাম রসুল। আঁধারে নড়ে উঠলো দুলালের ছায়া-শরীর। সে আশ্বস্তের মতো বললোঃ যাক। ব্যাটারা ফিরে যাচ্ছে এবার। গাঁ-টা আগুনের হাত থেকে বেঁচেও যেতে পারে হয়তো!—গোলাম রসুল দেখলেন—সত্যি, হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় মেম্বারবাড়ির গাছ-গাছালি আর ঝোপঝাড়গুলোকে যেন ঝলসে দিয়ে আঁকাবাকা মেঠো-রাস্তায় নেমে গেলো জীপ দুটি। তারপর গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে উঁচু নিচু রাস্তায় এগিয়ে শহরের দিকে না গিয়ে উল্টো দিককার মাঠ-বরাবর ছুটলো। আশ্চর্য! গোলাম রসুল বুঝতে পারলেন না, ওদিকে ওরা যাচ্ছে কোথায়। ওদিকে তো বিরাণ প্রান্তর-পান্তরের মাঠ। মাঠের পরে নদী। তাইতো, ওরা ওদিকে যাচ্ছে কেন? নিচু স্বরে দুলাল বললোঃ কী ব্যাপার। ব্যাটাদের মতলব কি? জবাবে গোলাম রসুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মুখের ওপর তীব্র আলোর ঝলকানিতে চমকে উঠে থেমে গেলেন। দুলাল বললোঃ চাচা সর্বনাশ। আমিরা এই দিকেই এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ হ্যাঁ এই বাড়ির দিকেই। ওই তো গাড়ির মুখ ঘুরেছে। শিউলী গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা আসলামের রাইফেল আর ব্যাগটা এক ঝপকায় তুলে গোলাম রসুলের হাতে দিয়ে দুলাল এক দৌড়ে বাড়ির পেছনকার জংলা জায়গাটায় চলে এলো। গোলাম রসুলও বিব্রত অবস্থায় অনুসরণ করলেন দুলালকে। যা ভেবেছেন, তাই। ঝুপসি আমগাছের নিবিড় জঙ্গলে, কচু ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখা গেলো, জীপ দুটো তারই বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। হেডলাইট নিভে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দপ দপ করে জ্বলে উঠলো কয়েকটা টর্চ ! শক্তিশালী
      বিজলী-মশালের চড়া আলোয় ফালা ফালা হচ্ছে ঘনায়মান অন্ধকার। এতো দূর থেকে এদের কথাবার্তা কিছুই শোনা যায় না। টর্চের চঞ্চল আলোয় দশ বারোজন খাকি ইউনিফর্ম পরা সৈন্যকে দেখা গেলো দ্রুতপায়ে ছোটাছুটি করতে। সবার হাতেই রাইফেল আর স্টেনগান।
      হঠাৎ দখিনা-হাওয়ায় ভেসে এলো কাঁচা পেট্রোলের তীব্র ঘ্রাণ! শির শির করে উঠলো গোলাম রসুলের সারাটা শরীর। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে মিলিটারীরা তাদের বড়ো দুশমনের আস্তানাটির খোঁজ পেয়েছে। বিপদজনক রাজনৈতিক দলের স্থানীয় সদস্যের বাড়ি হাজার মাইল দূর থেকে আসা সৈন্যদের চেনার কথা নয়। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে—তা বুঝতে কি আর দেরী হয়? মধু মেম্বারের লোভাতুর মুখ আর হিংসাকুটিল চোখ দুটি মনে পড়ে গেলো গোলাম রসুলের। মনে পড়লো, মাত্র ক'দিন আগে জঙ্গী-ছাত্রদের রোষ থেকে তিনিই রক্ষা করেছেন মধু মেম্বারকে। তার প্রতিদান এই? সারা বাড়িটায় প্রায় একসঙ্গে আগুন জ্বলে উঠলে দু'চোখে ঝরঝর করে পানি এসে গেলো গোলাম রসুলের। তিন পুরুষের ভিটেবাড়ি। বাপদাদার কতো শ্রম আর যত্ন দিয়ে গড়া। দাউ দাউ করে জ্বলছে। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে মজবুত টিনের ঘরগুলো। কেমন যেন মোহাচ্ছন্নের মতো, ভূতগ্রস্তের মতো পিছিয়ে এলেন গোলাম রসূল, দুলালের হাত ধরে, প্রায় টলতে টলতে। আসলামের রেখে-যাওয়া রাইফেল আর ব্যাগটা তার কাছে এতো ভারি মনে হচ্ছে, যেন হাত দু’টো ছিড়ে পড়বে !
      অন্ধকার খালপাড়ে আসতে না-আসতেই আসলামের দেখা পেয়ে গেলেন ওঁরা। আসলাম খুব দ্রুত, অথচ নিঃশব্দে ছুটে এসেছে। খুব হাফাচ্ছে এখন সে। বললোঃ মধু মেম্বার বেঈমানী করেছে। কেবল আপনার বাড়িটাই দেখিয়ে দেয়নি আরো এক সর্বনাশ করেছে সে।
      আসলাম—। —প্রায় অভিভূতের মতো বলে উঠলেন গোলাম রসুল—বাড়ি গেছে যাক ; কিন্তু ছোট? ছোটকে যে নিয়ে এলে না— ?
      আসলাম গোলাম রসুলের কাঁপা কাঁপা হাত দু'টি সজোরে চেপে ধরে বললোঃ চাচা, আপনি ঘাবড়াবেন না। আপনি কিন্তু একটুও ঘাবড়াবেন না। ছোটকে চিনিয়ে দিয়েছে মধু মেম্বার। ওরা ছোটকে নিয়ে এসেছে কেবল বাড়িটা দেখিয়ে দিতে। মেম্বারের এক বুড়ো কামলার কাছে চুপে চুপে গিয়ে তো তাই-ই শুনে এলাম। এই দুধের বাচ্চাকে আর কি করবে ওরা? দোহাই চাচা আপনি চিন্তা করবেন না।
      কিন্তু কোনো কথা না-বলে, একটুও শব্দ না করে গোলাম রসুল দুহাতে মাথা চেপে মাটিতে বসে পড়লেন। দুরে বাড়িটা পুড়ছে। ঠাস ঠাস শব্দে ফাটছে জ্বলন্ত কাঠকুটো—ছিপি আঁটা শিশি বোতল। আগুনের লকলকে জিহ্বা সম্পূর্ণ বাড়িটা খেয়ে ফেলে এখন যেন একটু স্তিমিত, নিস্তেজ। আরো দূরে নদীর ওপারেও কোনো অগ্নিশিখা আর চোখে পড়ে না! হয়তো ধোঁয়া সেখানে এখনও উঠছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তো ধোঁয়া দেখা যায় না। বাড়িটা প্রায় ভস্মস্তুপে পরিণত হবার পর আর্মিরা আবার জীপে উঠে পড়লো টপাটপ। এতোটা তফাৎ থেকে ওদের ভালোভাবে দেখাও যায় না। সঙ্গে ছোট আছে কিনা—তা-ও বোঝবার উপায় নেই। বোধহয় গাড়ির ওপর বসে রয়েছে। কাদছে অথবা ছটফট করছে।
      এদের তিন জনকে আরো বিমূঢ় করে দিয়ে জীপ দুটো শহর-মুখো না-হয়ে মধু মেম্বারের বাড়ির দিকেও না-গিয়ে মাঠের মাঝখানে, যেন লাফ দিয়ে নামলো।
      তারপর কি হলো? না, পরের ঘটনা খুব বিস্তারিতভাবে বলার দরকার নেই। রোকনপুর গায়ের পূব-প্রান্তের পুরনো বটগাছের নিচে এসে মিলিটারীরা ছোটকে জীপ থেকে নামিয়ে দিয়েছিলো। বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিলো একজন—দুশমান কা আওলাদ। আভি যাও। ভাগো হিয়াসে। ঘর খতম হো চুকা। আভি বাংলাদেশ মে চলা যা—ভাগ!—
      ছোট কিন্তু এসব কথা বুঝতে পারলো না। কেবল বাংলাদেশ শব্দটাই বুঝলো। আরো অনুমান করলো, এরা তাকে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে বলছে। সে ভয়ে ভয়ে চারদিকের নিশিছদ্র অন্ধকার দেখলো। তারপর জীপের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে অনেক দিনের চেনা বটগাছের নিচ দিয়ে ছোট ছোট পায়ে দৌড় দিলো। কিন্তু পনেরো ষোলো গজ ছুটে যেতেই বিদঘুটে—ডারা—রা-রা শব্দে চমকে উঠলো দশদিক। সঙ্গে সঙ্গে ভিজে স্যাতসেঁতে মাটির ওপর নেতিয়ে পড়লো হাফপ্যান্ট পরা, গেঞ্জি গায়ে ছোট্ট ছেলেটির দেহ। তার ছোট্ট পকেট থেকে ছিটকে পড়লো একটা গুলতি আর তিনটে ম্লান মার্বেল।
      বটগাছের অজস্র পাতার ভীড়ে পাখিরা তখন নিশ্চুপ। বিঝিরা নীরব। জোনাকিরাও ফেরার। তীক্ষ একটা শিসের শব্দ বেজে উঠলো হঠাৎ। হাসির হররা উঠলো দু'তিনবার। তারপর মৃদু যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলে দুটি আততায়ী জীপ কাঁচা রাস্তায় গিয়ে উঠলো।
      বলা দরকার, জীপ দুটো জেলা বোর্ডের রাস্তার ওপর আচমকাই আক্রান্ত হয়েছিলো। রাইফেলের চোরাগোপ্তা গুলিতে টায়ার ফেটে উল্টেও গিয়েছিলো একটা জীপ। হতভম্ব এবং ভীত সন্ত্রস্থ সৈন্যরা হতাহত সঙ্গীদেরকে টেনে হিচরে অন্য জীবটায় তুলে বৃষ্টিধারার মতো ব্রাশ-ফায়ার করতে করতে পিছু হটে গিয়েছিলো। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় আর কিছু করার ছিলোনা দুলাল এবং আসলামের। অর্ধমূৰ্ছিত গোলাম রসূলকে ধরাধরি করে দ্রুত পায়ে নদীর দিকটাতে পিছিয়ে যেতে হয়েছিলো ওদের ।
      তোমরা যদি কখনো রোকনপুর যাও—সেই গুলিবিদ্ধ বটগাছটা এখনো দেখতে পাবে। কিন্তু ছোট্ট ছেলে ছোটর ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীর থেকে ছিটকে পড়া রক্ত আজ আর দেখতে পাবে না। আঁতিপতি করেও খুঁজে পাবে না একটি বিষন্ন গুলতি কিংবা তিনটে রাঙা মার্বেল। বারোটা বছর তো কম সময় নয়— ! রক্তের দাগ কি এতোদিন থাকে?

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

      পিপুল পাতা তুলতে এসেছে নিশান। সকাল থেকে গাঙ্গে আজ নলা মাছ গাবিয়েছে। ঘরের কাজ, মাঠের কাজ ফেলে, কমিয়ে যে যতোটা পেরেছে মাছ ধরেছে।      ...

      পিপুল পাতা তুলতে এসেছে নিশান। সকাল থেকে গাঙ্গে আজ নলা মাছ গাবিয়েছে। ঘরের কাজ, মাঠের কাজ ফেলে, কমিয়ে যে যতোটা পেরেছে মাছ ধরেছে।
      নিশান এক কোচরের বেশী ধরতে পারেনি। বাবা গেছে ধলাখালীর হাটে। নইলে চান্দারী ভরে যেতো। তে-কোন জাল আর কোচ দিয়ে বাবা এতো অতো মাছ ধরতে পারে। মা বাসন ভর্তি করে ভাজে। গুনা তারে গেঁথে সুটকি দেয়।
      আজ শুধু চড়চড়ি। পিপুল পাতা দিয়ে। ঝাল ঝাল করে। বাবার খুব পছন্দ। 
     হাটবার বলে অন্য ভিটের চাচীদের সংগে সকাল সকাল গাংগ থেকে গোশল করে এসেছে মা। রোদে একটু রং ধরলো কি নদীতে ঢল নামলো ভিন গায়ের নৌকার ধলাখালী হাট বারে এমনি হয়। বেজায় বড়ো হাট। সাত গ্রামের লোক ছোটে সকাল থেকে। যে যে দিক থেকেই আসুক যেতে আসতে ময়ুর মুখীর মোড় পেরুতেই হবে।
      মা মাছ কুটতে বসেই নিশানকে বলল পিপুল পাতার কথা। রতনদের ছাই গাদার পাশে লতানো জংগল। কালচে সবুজ, পান পাতা গড়নের পাতা তুলতে তুলতে নিশান তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। ইস সূর্য যেন, মাথার ওপর থেকে গড়াবেন আজ। সারা দিনের বেচা কেনা সেরে বাবার ফিরতে  ফিরতে সন্ধে। কখন যে বেলা পড়বে?
      এবারে আখের ফলন খুব ভালো হয়েছে। কোষা বোঝাই করে আখ নিয়ে গেছে বাবা। বলে গেছে, সামনে শীত, ছিট কাপড়ের রংগিন সার্ট নিয়ে আসবে ফেরার সময়। সেই সার্ট পরে এবার মাঘ মাসে সে যাবে নানীর বাড়ী ভেজানো রসের পিঠা খেতে।
      কথাটা মাকে বলতে মা মিষ্টি হেসেছে। রোদ উঠেছে নারকেল গাছের মাথায়। দাওয়ায় একটি দিক এরই মধ্যে ভরে গেছে ধোঁয়া ধোঁয়া আঁধারে। পা ছড়িয়ে বসে মা পলতে পাকাচ্ছে বাতির জন্য। ঘরের পেছনে বাতাবী লেবুর ঝোপের তলায় দাদার কবর। মগরেবের আজানের আগে আগে মা দুটো প্রদীপ জ্বালে। একটা থাকে ঘরে। আর একটা দাদার ওখানে।
      তার আগে নিশানকে আর একটি কাজ করতে হয়। উত্তর ভিটের চাচীর দো-আখা থেকে পাট খড়িতে করে আগুন আনতে হয়। সে সময় চাচীও দু একটি কাজ দেয়। যেমন ছোটো খুকী বড়ো বিরক্ত করছে, ওকে একটু নিয়ে যা। কিংবা দুটো পেয়াজ দিয়ে যা তোর মার কাছ থেকে।
      শেষ বেলায় খেয়ে রাতে খাবার গরজ সাধারণত থাকে না। এশার নামাজের পর পরই নীরব হয়ে আসে পাড়া। হাটের দিন একটু অন্য রকম। বাবা চাচারা না ফেরা অব্দি নিশানের বয়সী ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছুটোছুটি করে। মা চাচীরা গোল হয়ে বসে। পুথি পড়া শোনে চাচী-চাচার কাছে। বাচ্চারা ঘুমায়। ছাড়াবাড়ীর জংলা ভিটে থেকে ভেসে আসে শেয়ালের ডাক ।
      এরই কোনও সময় ঘাটে কোষা লাগার শব্দ শোনা যায়। মা লণ্ঠন হাতে পথ দেখাতে যায়। পিছু পিছু আসে নিশানরা। হাটুরে বাবা চাচাদের পকেটে থাকে ঢাকা শহরের লবেনচুশ। সুবাসী বিস্কুট বা পাতলা কাগজে পেঁচানো, চাক চাক করে কাটা পাউরুটি।
      আজ সন্ধের পর সময় যেনো থেমে রইলো। নবী দাদা তারা দেখে রাতের প্রহর বলতে পারেন। ঝড় তুফানের দিন বাতাস শুকে বলতে পারেন মওসুমী হাল। উঠোনে হাটাহাটি করছিলেন তিনি। এতো দেরী তো হবার কথা নয় হাটুরেদের।
      নালার এক বাঁশের সাকো পার হয়ে এ সময় এলো জমির চাচা। বেচা কেনার কিছু ছিলোনা বলে হাটে যায়নি। নিশানকে সামনে পেয়ে বলল, কিরে তর বাজানও ফিরে নাই। নিশান বললো, না। আইজ হাটে কি হইচে চাচা।
      জমির চাচা বললো, কিছু বুঝবার পারতাছি না। 
     তিন ভিটের চাচীরা, মা, নবী দাদা ঘিরে দাড়ালো জমির চাচাকে। সন্ধে থেকে জমির চাচা নদীর ধারে। একটি নৌকাও ফিরতে না দেখে অবাক হয়েছিলো। গত কিছু দিন থেকে তো হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিলো নানা রকম খারাপ খবর। মুক্তিযুদ্ধের হাট বাজারে গণ্ডোগোলের। মানুষ মারার।
      ময়ূর মুখীর বাঁক ঘুরে ফিরতি নৌকো যাও কিছু গেছে, সেগুলো এতো জোরে চলে গেছে, মনে হয়েছে পেছনে বাঘ ভালুক তাড়া করছে। একজন হাটুরে শুধু পাড় ঘেঁষে যাবার সময় চেঁচিয়ে বলে গেছিলো, ভাইরা সাবধান। বাতাস বড়ো গরম। ধলাখালীর হাটে দুষমুনগো জাহাজ লাগছে। মাইনষের খুনে ভাইসা গেছে জামিন। নওগুলা ডুবছে উথাল পাথাল পদ্মার ঢেউয়ে। হেরা ডুবাইছে ইচ্ছা কইরা। আপনেরা জান মালনিয়া সাবধান হনগো মিয়া ভাইওরা।
      জমির চাচারা খবরটা পাড়ায় ঢুকতে দেয়নি। গাংগের পাড়ে থেকে আরও ফিরতি নৌকোর অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা করেছে আরও খবরের জন্য।
      রাজধানী ঢাকা থেকে লঞ্চের লোকের মুখে মুখে কতো রকম খবরই তো আসছিলো। খবরগুলো মিথ্যে নয় গ্রামের মানুষ একবার তার প্রমাণ পেয়েছিলো। সেই চৈত্র মাসে পিলপিল করে শহরের লোক ফিরছিলো গ্রামে। তাদের সংগে জিনিষপত্র ছিল না। ছিল শুধু ভয়।
      শহুরে মানুষের পায়ে কাদা, এলোমেলো পোশাক, চোখ ভরা ক্লান্তি, এ যেনো ভাবাই যায় না। নিশান বরাবরই দেখেছে তারা যখনই গ্রামে আসে, কাপড় চোপর থাকে ঝকঝকে। ঘোরা ফেরায় আমীর আমীর ভাব। সেই তাদের একি চেহারা।কতো জনম যেনো খায়নি। ঘুমোয়নি।
      নিশানদের মতো কিশোররাই তখন ওদের দেখাশোনা করেছে। শুনেছে ভয়ংকর, অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। দেশে যুদ্ধ লেগেছে। অবাঙালীরা এক রাতে কামান দেগে, বন্দুক ছুড়ে ঢাকা শহরকে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে ওরা ছিল বাঙালীদের পড়শী সেজে। চেষ্টা করেছিল দেশী মানুষের ভাষা, সাহস, সংস্কৃতি সব একসঙ্গে কেড়ে নিতে। না পেরে ধ্বংস করে দিতে চাইছে পুরো জাতটাকে।
      রাজধানী থেকে, জেলা শহর থেকে সব লোক পালাচ্ছে গ্রামের দিকে। ওরা নাকি নদীকে খুব ভয় করে। পাগড়ীর প্যাঁচের মতো নদী নালা পেরিয়ে গাও গঞ্জে কখনো আসবেনা।
      নিশান ভেবেছিলো হবেও বা । বুড়ীগঙ্গা সে কখনো দেখেনি। বাবার সঙ্গে আরুল বিলের ওপারের হাটে গিয়ে ইছামতী ধলেশ্বরী দেখেছে। জমির চাচার সঙ্গে ইলশে মাছ ধরতে গিয়ে দেখেছে পদ্মা। বর্ষায় ওরা নাকি ভয়ংকর রূপ ধরে। এপারে ওপারে নজর চলে না। শুধু পানি আর পানি। চার চারটা বড়ো নদীর পরও আছে খাল, বিল, নালা। উড়ে না এলে শয়তানেরও সাধ্য নেই চট করে গ্রামে চলে আসা।
      শহর থেকে পালানো সেই মানুষেরা থাকেনি খুব বেশী দিন। ফিরে গেছিলো কিংবা সরে গেছিলো আর কোথাও।
     ময়ুর মুখী গ্রামের লোক ভেবেছিলো তারা নিরাপদ। যুদ্ধের কোনও ধাক্কা তাদের জন্য আসবেনা। যুদ্ধের তারা কি জানে। বাপ দাদার আমল থেকে চাষ আবাদ নিয়ে আছে। লড়াই করার জন্য মানুষের মধ্যেই আলাদা একটি শ্রেণী আছে। দেশের জন্য, দশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করে, প্রাণ দেয়, জয়ী হয়।
      ধারনা ভাঙলো শহরের মানুষের ফিরে যাবার মাস কয়েকের মধ্যে। গ্রামের উঠতি বয়সের যে ছেলেরা হাইস্কুলে পড়তো, বাজারে দোকানদারী করতো, কিংবা কাজ করতো ক্ষেত খামারে, রাতারাতি তারা যেন কোথায় চলে গেল। নবী দাদার পুঁথির সেই রূপনগরীর মতো ছেলেরা সব বনে চলে গেছে চারমুখো দেওএর জন্য। ফিরে যখন এলো তখন তাদের ঘাড়ে তীর ধনুক। মুখে শপথ। দেওকে তারা বধ করবে।
      ময়ুর মুখী থেকে যারা গেলো তারা যদিও ফিরলো না, কিন্তু রাতের ছায়ায় আপন শরীর মিশিয়ে গ্রামে এলো আর একদল ছেলে। বনের গভীরে তারা শিবির তৈরী করেছে।
      মাঝেমাঝে তারা আসতো। গায়ের মাতব্বর মেম্বরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতো। চলে যেতো। একদিন তাদের একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। খালি গা। লুংগি পরা। কোমরে বাধা গামছা। নিশান বলেছিলো, আমারে লইবেন আপনেগো লগে।
      সে হেসে বলেছিলো, তুমি কি করো খোকা। 
      নিশান বলেছিলো, আগে ইস্কুলে পড়তাম। অখন বাজানের লগে আউখ ক্ষাতে কাম করি। 
      সে বলেছিলো, তাই করো। 
      নিশান অবাক গলায় প্রশ্ন করেছিলো, ক্যান? 
      সে জবাব দিয়েছিলো, সবাই একসঙ্গে যুদ্ধে এলে চলবে কি করে। আমরা ক্যাম্পে আটা রুটি আর আখের গুড় খাই। তুমি আমাদের জন্য গুড় তৈরী করো।
      গাজী বাড়ির তালাগ ধরে, বাঁশ ঝাড়ের তলা দিয়ে চলে গেছিলো সে। কথাটা পছন্দ হয়নি নিশানের। সে ক্লাশ ফাইভে পড়ে। মুক্তি যুদ্ধে তার মতো কতো ছেলেই নাকি গেছে। সরাসরি বাবাকেই এক বিকেলে সে বললো মনের কথা। শুনে বাবা প্রথম দিকে জবাব দেয়নি। আবার বলতে একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে জবাব দিয়েছিলো, যুদ্ধে যাইবার চাও যাইবা। দরকার মনে করলে বাপ ব্যাটায় একলগে যামু। অখন একটু তামুক সাজো দেখিন বাজান।
      সেই বাবা জান দিলো ধলাখালীর হাটে। লাশ এলো তিন দিন পর। শরীর ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। শুধু বাবা নয়, দক্ষিণ-ভিটির মামু, পূর্ব পাড়ার নুরুর ফুপা, দুনির বাবা, সবার এক অবস্থা। একসঙ্গে অনেক লোক ছেড়ে গেলো গ্রামের মায়া।
      লাশ এসেছিলো শেষ বেলায়। ঘরে ঘরে কান্না। উঠোনে উঠোনে কাফন দাফনের ব্যস্ততা। গ্রামের সব চেয়ে বুড়ো মানুষটিও একসঙ্গে এতো লোকের মাতন দেখেনি। বোবা গাছপালার ডাল চুইয়ে চুইয়েও যেনো ঝরছিলো চোখের পানি।
পুরো গ্রাম বলতে গেলে জেগে রইলো সারা রাত। সকালে পিলে চমকানো এক খবর। কান্নাটান্না বন্ধ করো। এসব এখন বিলাপ। শিগগীর তৈরী হও অথবা পালাও । দুষমনদের সৈন্য ঘোরা ফেরা করছে আশপাশের গ্রামের কাছাকাছি।
      গ্রামের সবাই যেনো কথা বলতে ভুলে গেলো। পালাবে কোথায়? ধলাখালীর হাট হয়েছে গোরস্তান। বিলের ওপারের গাঁ-গুলোতে গেলো রাতে দেখা গেছে আগুন আর ধোয়া। তবু দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গেলো কেউ কেউ। কেউ পিতল কাসার বাসন কোসন পুঁতে ফেললো মাটির তলায়। কেউ ধার দিতে লেগে গেলো দা, বটি, সাবল, সরকি।
      নিশান তাকিয়ে আছে বেড়ার খাঁজে গোজা বাবার বড়ো গুলতিটার দিকে। বাবার সখ ছিলো শীতের সময় পাখী শিকারে যাওয়া। মাটির গুলির ঝালা নিয়ে সে যেতো পিছু পিছু। মাথায় নতুন গামছা বেঁধে, কাছা মেরে লুংগি পরে বাবা বিলে নামতো। হাতের সই ছিলো দারুন। নিশানের কাঁধের ছালা ভরে যেতো বক, ঘুঘু, ডাহুক, বন পায়রায়। বাড়ী ফিরে সেগুলোর ছেড়া ছেলার কাজ বাবাই করতো। পরদিন সেসবের একটি বড়ো ভাগ নতুন মাটির হাড়িতে করে নিশান দিয়ে আসতো বুজীর বাড়ী। দুলাভাই শিকারের মাংস খেতে খুব ভালো বাসতেন।
      নিশানের বুক থেকে উঠে আসে গরম নিঃশ্বাস। কি যে হলো দিনের হাল। দুলাভাইয়েরও কোন খবর নেই। ওদের গ্রাম সীমান্ত ঘেঁষে। ওরা নাকি ওপার চলে গেছে।
      মা এলো কাসার বাটিতে করে মুড়ি নিয়ে। নিশান বললো, মাও আমি যুদ্ধে যামু। বাটি নামিয়ে দিয়ে মা চোখ মুছছিলো। কাল থেকে কেঁদে কেঁদে মার চোখ লাল। টকটকে চোখ নিয়ে মা শুধু তাকিয়ে রইলো। নিশান ডান হাতের মুঠিতে বুকে চাপড় মেরে, গলায় আর একটু জোর দিয়ে বললো, যুদ্ধে যামু। এই তুফান আলীর পোলা নিশান আলী যুদ্ধে যাইবো। বাপের পক্ষী শিকারের গুলাই দিয়া দুষমুন শিকার করবো।
      মা দুপা সরে এসে ওকে বুকের কাছে নিয়ে বললো, তুই বাজান যুদ্ধে গেলে আমি বাচুম কারে লইয়া? একে একে হগগলেই তো ছাইড়া গেলো আমারে।
      নিশান জবাব দিলো, আমি ছাইড়া যামু না। এই যুদ্ধে যাওন মাইনে মাঠে ময়দানে গিয়া লড়াই দেওন নারে মা। ঘর থনই যুদ্ধ করুম। খালি আমি না। তুমিও।
      মা যেনো নিশ্চিন্ত হলো। দাওয়া থেকে নেমেই আবার কেঁদে উঠলো নতুন করে। নিশান চমকালো, আবার কোন মুসিবত এলো? না কিছুনা। অবসর সময় বাবা দাওয়ার একদিকে ছোটো কেবিন ঘর তৈরী করছিলো। তার পড়ার সুবিধার জন্য। বাবার খুব আশা ছিলো সে লেখা পড়া জানা জ্ঞানী মানুষ হবে। গোলমালে ঘরের কাজ আর এগোয়নি। কতো শেষ না করা কাজই না যাবার আগে ফেলে যেতে হয় মানুষকে।
      নিশানের মনে হলো গত চারদিনে সে যেনো অনেক বড়ো হয়ে গেছে। অনেক বেশী বুঝতে পারছে।
     মুড়ির কিছু খেয়ে, বাকিটা মুরগীর খোয়াড়ের কাছে ফেলে দিয়ে সে এলো পঞ্চবটির জঙ্গলে। ক্যাম্প করা ভাইরা এবার দলে নিলো। কাজ-শেখালো। কাজ দিলো। কালো কাসুন্দির ঝোপের আড়ালে থেকে খালের দিকে চোখ রাখতে হবে। ওখান থেকে বড়ো নদীর বাঁক দেখা যায়। দৃষ্টির সবটুকু আলো জ্বালিয়ে দিয়ে, সে পথ পাহাবা দেয় নিশান। ভুলে যায় বাবার কথা। চাচাদের কথা। মনকে জাগিয়ে রাখে একটা ধাতব রাক্ষসের জন্য। কবে সেটা খালে ঢুকবে।
      বিকেল হলেই বাতাসে ভাসে বন তুলসীর সুবাস। খুব সামান্য সময়ের জন্য আনমনা হয়ে যায় সে। এমনি ছায়া ছায়া বিকেলে নদীর ধারে কপাটি খেলতো স্কুল থেকে ফিরে । একবার দম দেবার মুখে রতন বললো, ঐ নিশান তর বুজীর নাও যায়রে।
      বুজীকে নিয়ে খালের পানিতে সত্যি যাচ্ছিলো এক মালাই নৌকো। দুলাভাই দাঁড়িয়ে বাইরে। বুজীর ঝকঝকে চোখ দেখা যাচ্ছিলো গলুই-এর কাছে, খাটো ঘোমটার ভেতর।
      খেলা মাথায় উঠলো। পাড় ধরে নৌকোর সঙ্গে দৌড়াতে সুরু করলো সে। দুলাভাই চেঁচিয়ে বললো; নাও ভিড়ামু। উঠবা নায়ে।
      ছুটতে ছুটতেই নিশান জবাব দিলো, না না। আপনেগো মায়ের আগে আমি বাড়ীতে পৌছা মাওরে খবর দিমু।
     যে গাংগ বর্ষায় বুজীকে নিয়ে আসতো, শুকনোর সময় সেই যোগাতো রসালো ফল। নামে গাংগ আসলে শাখা নদী। ভূগোলের স্যার বলেছিলেন গোটা বিক্রমপুরের সবচেয়ে বড়ো নদী ছিলো ইছামতী। রাজা বাদশাহদের বড়ো বড়া নৌকোর বহর ভাসতো তার বুকে। সে নদী মরে গিয়ে জন্ম হয়েছে ধলেশ্বরীর। আর এই ক্ষীণ শরীর মধুমতীর। শীতে এ নদী একেবারে শুকিয়ে যায়। পুরা বালির ওপর কারা যেনো বুনে দিয়ে যায় বাংগি, তরমুজ। সবুজ সতেজ লতাগুলোয় কতো যে ফল ধরে। কি সোয়াদ সেগুলো খেতে।
      বন্ধুর মতো, আপন জনের মতো সেই নদী আজ সে পাহারা দিচ্ছে। কখনো নিজেকে মনে হয় পুঁথির সেই শাহজাদার মতো। রাজ্যের শেষ সীমায় সে অপেক্ষা করে থাকতো রোজ মানুষ খেকো এক সমুদ্র দানবের জন্য। পানির রাক্ষসটাকে সে হত্যা করেছিলো। কেটে দিয়েছিলো লাল চোখ শয়তানের হাতীর খুঁড়ের মতো আটটি শুঁড়কে।
      ঝিকঝিক, থিকথিক শব্দ বাতাসে। সজাগ হলো নিশান। রতন ছিলো পাকুড় গাছের মগডালে। চেঁচিয়ে বললো, ঐ আয়া পড়ছে। বাইসুত কি আলীসান জাহাজের। শিগগীর ক্যাম্পে খবর দে। আনু ভাইরে। গোবিন্দ দাদারে।
      সন্ধের দিকে দোতলা লঞ্চ ঢুকে গেলো গাংগে। পাড়ের দিকে এলোনা। থমকে রইলো মাঝ নদীতে। খোল ভর্তি খাকী পোষাকের মানুষ। ছাদের উপর সাজানো হলো কামান। গ্রামের দিকে তাক করা। সবার মাঝে জ্বলছে একটা লাল আলো। পুঁথির সেই সমুদ্র দানবের চোখের মতো। এটা আরও সাংঘাতিক। ঘুরে ঘুরে আলো ফেলছে চারদিকে।
      গোপন বৈঠকে ঠিক হলো রাতের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া হবে এটাকে। সবার আগে একজনকে গ্রেনেড ছুড়ে অন্ধ করে দিতে হবে সার্চ লাইটের আগুনে চোখ। কে যাবে। নিশান এগিয়ে এলো ।
      কমাণ্ডার ভাই ঘাড় নেড়ে বললেন, আমিও তোর কথাই ভাবছিলাম। সব রকম সাঁতার তুই খুব ভাল জানিস। তুই আলোটা নষ্ট করে দিলেই, দুপার থেকে আমরা আক্রমণ চালাতে পারবো ।
      সন্ধে রাতে নিশান এলো ভাত খেতে। মা বললো, বাজান শরীরটা আইজ জুইত লাগতাছেনা। পাহারাদারী থন আইজ একটু জলদি ঘরে ফিরিস।
      নিশান ঘাড় দুলিয়ে ছোট্ট জবাব দিলো, আইচ্ছা। রাত নিঝুম হলে, থমথমে হলে নিশান বেরুলো। রেকি করা জায়গা থেকে খুব সাবধানে নামলো খালের পানিতে। গ্রেনেড ধরা হাতটাকে মাথার ওপর দিকে রেখে লঞ্চের দিকে এগুলো আরও সাবধানে।
      সার্চ লাইটটা যেনো ইবলিশের জ্যান্ত চোখ। ক্লান্তি নেই। ভুল নেই। ব্যর্থতা নেই। তা হোক। নিশান মনে মনে ভাবলো, দরকার হলে সারা রাত, সারা জীবন সে সুযোগের অপেক্ষা করবে। তবু ওটাকে শেষ করা চাই। নইলে পাশের গাঁয়ের মতো তাদের গ্রামটাও পুড়ে ছারখার হবে। দলেদলে মানুষ মরবে বেয়োনেটের খোচায়। শিশুদের শূন্যে ছুড়ে দিয়ে চলবে বন্দুকের কিরিচে গেঁথে ফেলার প্রতিযোগিতা। যেনো হাসি ঠাট্টার খেলা একটা। এমনি করে বাচ্চাদের জীবন নিয়ে খেলে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যগুলো। আর মেয়েদের নাকি জোর করে ধরে নিয়ে যায় জাহাজে ।
      নিশান মাথা ঝাকানি দিলো। তাদের গ্রামেও তেমনি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। হেলমেট পরা লোকগুলো জাহাজের ছাদে ঘোরাফেরা করছে। কমাণ্ডার আন্দাজ করছেন রাতে নামার প্ল্যান ওদের নেই। ভোর ভোরে ঘিরে ফেলবে গোটা গ্রাম।       রাতের আঁধারে গ্রামবাসীরা যাতে পালাতে না পারে তার জন্য নদীর বাঁকে পাহারা দিয়ে আছে আরও পাঁচ ছটা লঞ্চ। হয়তো সেগুলোও যোগ দেবে সকালের তাণ্ডব কাণ্ড-কারখানায়। তার আগে এটার ব্যবস্থা করতে হবে। শয়তানের চোখের মতো, দানবের চোখের মতো দগদগে লাল আলোটার খতম তারাবী পড়াতে হবে। শূন্যে তোলা হাতের মুঠিতে গ্রেনেডের গোলা। অন্য হাতে সাবধানে সাঁতার কাটা।
      শয়তানের জাহাজ দাঁড় করানো মাঝ নদীতে সার্চ লাইট খোয়ার বিরাম নেই। সেই সঙ্গে পিলে চমকানো ফাঁকা গুলির আওয়াজ। জাহান্নামের বাসিন্দাগুলোর চোখে কি নিশি রাতেও ঘুম থাকে না। না থাক। নিশানের চোখের উপর এখন কোনও সার্চ লাইট নাই। আছে বাবার আধখোলা লাল একটা চোখ, বাকী চোখটি উড়ে গেছিলো গোলার ঘায়ে। জমির চাচা খোলা চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মুর্দার চোখ নাকি খোলা অবস্থায় কবরে যেতে নেই। কিন্তু নিশান স্পষ্ট দেখছে বাবা তাকিয়ে আছে। সাদা জমিনের ওপর ছোপ ছোপ রক্তের ফোটা। নানা ছোপ ছোপ নয়, জমাট বাধা রক্তের চাপ। টকটকে লাল।
      মাঝরাতে সমস্ত গ্রাম কেঁপে উঠলো ভয়ঙ্কর বিকট আওয়াজে। দানোর ঘুরন্ত চোখ আচমকা নিভলো। কয়েক মুহুর্তে আকাশ মাটি নদী মিশে গেলো একদম অন্ধকারে। তারপর দশ দিক ভরে এলো গর্জন আর গর্জনে।
      ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে জোনাকীর আলোর শব্দে জ্বললো আর এক ধরনের তেজী নীল আলো। ঝাঁকে ঝাঁকে অবিরাম। লঞ্চ ডুবলো। সকাল হলো। বড় নদীর বাঁকে অপেক্ষা করছিলো যে দুটো সাজোয়া লঞ্চ, রাতের গোলাগুলির শব্দে তারা আর সাহস পেলো না গ্রামে ঢোকার। ঘুরিয়ে নিলো গতিমুখ।
      একটু বেলা করে গাঁয়ের ছেলেরা, ক্যাম্পের যুবকর ফিরে এলো। এলো না শুধু নিশান। গাংগের কোথাও সে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে থাক।