বইটা প্রথমে দেখে ফেলেন পিন্টুর মাস্টারমশাই। পিন্টুকে গোটা-বারো অঙ্ক কষতে দিয়ে মাস্টারমশাই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে একটু চোখ বুজে ঝিমিয়ে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল, ছাত্রটি যেন বড় বেশী চুপচাপ। অনেক কষ্টে চোখের পাতা দুটো আধখোলা কবে চেয়ে দেখলেন, পিন্টু চোখ গোল গোল করে অঙ্কের বইয়ের ওপর উপুড় হয়ে কী যেন পড়ছে।
অ্যাঁ, অঙ্ক পড়ছে! মাস্টারমশাইয়ের সন্দেহ হল।
হাঁক ছাড়লেন, “পিন্টু, বইটা দেখি।"
পিন্টু চমকে উঠল। তার হাত থেকে পেনসিলটা ছিটকে পড়ল মেঝেয়। তারপর সে তাড়াহুড়োয় অঙ্কের বইয়ের বদলে মাস্টারমশাইয়ের সামনে এগিয়ে দিল সেই বইটা। বইটা হাতে পাওয়া মাত্র ঝট করে মাস্টারমশাইয়ের ঘুম কেটে গেল। চটি একখানা বই। মলাটের ওপর ছোবা হাতে মুখোশ পরা একটা বিদঘুটে লোকের ছবি। বড় বড় অক্ষরে নাম লেখা—‘জীবন্ত মৃত্যু’।
ধাঁ করে বাঁ হাত বাড়িয়ে, পিন্টুর কান পাকড়ে কাছে টেনে এনে, ডান হাতে গোটা চারেক জ্বালাময়ী গাঁট্টা লাগিয়ে, মাস্টারমশাই চোখ রাঙিযে বললেন, "বটে, এই বুঝি অঙ্ক হচ্ছে? গতবারের রেজাল্ট কি ভুলে গেছ? কাল রোববারে একটা বাংলা রচনা, পঁচিশটা অঙ্ক আর একপাতা ইংরিজী ট্রানস্লেশন যদি না-করে রাখ তা সোমবার তোমার কপালে দুঃখু আছে বলে রাখছি।"


এই বলে তখনকার মতে অঙ্কগুলো শেষ করার আদেশ দিয়ে তিনি বইটা খুলে উল্টোতে লাগলেন।
“ইস, এই রকম যাচ্ছেতাই বই আজকালকার ছেলেরা কেন যে পড়ে !" বলতে বলতে, মাস্টারমশাই বইয়ের প্রথম পাতাটা পড়তে শুরু করলেন। ক্রমশ তিনি খাড়া হয়ে বসলেন, তারপর ঝুঁকে পড়ে পড়তে লাগলেন। পিন্টু বার দুই অঙ্ক জিজ্ঞেস করে কড়া ধমক খেয়ে চুপ মেরে গেল। ঝাড়া পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে বই শেয করে তবে তিনি উঠলেন। যাবার সময় পিন্টুর মায়ের হাতে বইখানা দিয়ে বললেন, "স্টুডেন্ট লাইফে এই সব আজেবাজে ডিটেকটিভ বই পড়া মোটেই উচিত নয়।" অতঃপর পিন্টুকে তার হোমটাস্কের কথা আরেক দফা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।
পিন্টুর মা তো বিরাট হই-চই জুড়ে দিলেন বই নিয়ে। “কোথা থেকে আনা হয়েছে এ বই? বল শিগগিরি।”
পিন্টু জবাব দেয়, “খুকু এনেছে।”
“অ্যাঁ, খুকু ! এই সব বই আনছে। কোথায় খুকু ?”
খুকু কাছেই ছিল। মাত্র কয়েক পাতা পড়ার পর ছোড়দা জোর করে বইটা কেড়ে নেওয়ায় বেচারা খুবই চটে ছিল। কিন্তু নালিশের উপায় ছিল না। তাই আপাতত পিন্টুর বেকায়দা অবস্থা দরজার আড়াল থেকে দেখে বেজায় মজা পাচ্ছিল। মায়ের ডাকে ভয়ে-ভয়ে বেরিয়ে এসে জানাল, “ওপরের গুদোমঘরে পেয়েছি। আমি কিন্তু পড়িনি। ছোড়দা নিয়ে নিল।”
মা বললেন, "হুঁ, নিশ্চয় বাবলু এনেছিল।”
বাবলু পিন্টুর মাসতুতো দাদা। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে এ-বাডিতে এসে মাস খানেক ছিল। সে যত রাজ্যের গল্পের বই এনে গিলত। পিন্টু এবং খুকুরও সেই সব বই পড়ার ঝোঁক চাপায় দুই ভাইবোন খুব বকুনি খায়। বাবলু তারপর থেকে বই লুকিয়ে রাখত। গুদামঘরে আছে গাদা গাদা পুরনো পত্রিকা, খালি টিনের কোটো, শিশি বোতল ইত্যাদি জিনিস। খুকু তার পুতুলের কাপড় রাখার জন্যে একটা পছন্দসই বাক্সের সন্ধানে ওই ঘরে ঢুকে বইখানা আবিষ্কার করে।
"রোস, উনি আজ আপিস থেকে আসুন। তোমাদের একচোট হবে । লুকিযে-লুকিয়ে পড়া হচ্ছে!” মা তর্জন করতে থাকেন।
পিন্টুর বড়দা কলেজ থেকে ফিরে, খেয়ে দেয়ে ক্লাবে ব্যাডমিণ্টন খেলতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। বইয়ের ব্যাপার কানে যেতে এসে বলল, “দেখি কী বই? ইস, এইসব রাবিশ পড়ার জন্যেই তোদের জেনারেল নলেজ এত পুওর " এই বলে সে বইটা মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আবার ঘরে ঢুকে পড়ল।
পিন্টু মনে মনে গজরায়। ওঃ, উনি আবার জেনারেল নলেজ শেখাচ্ছেন। ইদিকে তো নিজে সেদিন, কোন এক দেশের রাজধানীর নাম বলতে না-পেরে, বাবার কাছে জেনারেল নলেজ নেই বলে বকুনি খেলে। আমি সব শুনেছি। দাঁড়াও না, তোমার ব্যাডমিণ্টন র্যাকেটের তার কাল সকালে দেখবে ইঁদুরে কেটে দিয়েছে।
পিন্টুর বড়দার সেদিন আর ক্লাবে খেলতে যাওয়া হল না। আগাপাশতলা চুটিয়ে পড়ে খাবার আগে মায়ের হাতে বইখানা সমর্পণ করল। সেই সঙ্গে বইটার এক প্রস্থ শ্রাদ্ধ করতেও কসুর করল না।
পরের দিন রবিবার সকালটা পিন্টুর যে কী-রকম বিশ্রী কাটল তা পিন্টুই জানে, আর জানে তার প্রিয় বন্ধু ভজা। “ছাত্রজীবনের কর্তব্য” রচনাটা লিখতে গিযে পিন্টু ইচ্ছে করেই ওই গুরুজনের প্রতি ভক্তি টক্তির কথাগুলো স্রেফ বাদ দিযে দিল । উঃ, আর মাত্র দশ-বারো পাতা বাকী ছিল। ডিটেকটিভ পঞ্চ তরফদারের সঙ্গে দস্যু “সবুজ শার্দল"-এর শেষ সংগ্রাম ঘনিয়ে এসেছে। কী হবে কে জানে! পঞ্চ তরফদার কি পারবে জিততে? ক্ষোভে পিন্টুর নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। দেওয়াল-আলমারির ভিতরে রাখা বইটাকে সে বারবার অসহায় চোখে দেখে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মা পান চিবুতে চিবুতে বইটা বের করলেন। একটার ওপর আর একটা বালিশ চাপিয়ে জুত করে শুয়ে খুকুকে এক ধমক দিয়ে দিলেন,“খবরদার বেরুবি না দুপুরে ঘুমুতে হবে বলে রাখছি। দিনভোর টই-টই করে মেয়ের কী ছিরিই না হচ্চে।” তারপর তিনি বইখানা খুললেন।
খুকু বইটার দিকে একবার করুণ চোখে চেয়ে মটকা মেরে পড়ে রইল। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে বই শেষ করে, “ধুৎ, যত্ত সব আজগুবি কাণ্ড" বলে, মা বইটা খুকুর উল্টো দিকে রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।
খুকু সাবধানে উঠে বসল। হ্যাঁ, মা ঘুমিয়েছে। সে আ—স্তে হাত বাড়িয়ে বইখানা নিল এবং একটুও শব্দ না-করে পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগল।
প্রায় অর্ধেকটা পড়েছে, এমন সময় মা হঠাৎ পাশ ফিরলেন। ভয় পেয়ে খুকু টপ করে বই ঠিক জায়গায় রেখেচোখ বুজে শুয়ে পড়ল। মা বরকতক এ-পাশ ও-পাশ করলেন। আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর খুকুকে ঠেলা দিয়ে বললেন,"এই ওঠ। আর ঘুমায় না। দেখ তো পাঁচুরম উনুনে আঁচ দিয়েছে কি না।”
খুকু দেখে এসে বলল, “হ্যা, দিয়েছে।"
বইটা আলমারিতে তুলে রেখে মা চা বানাতে গেলেন।
রাত্তিরে সবাই খেতে বসেছে। সবাই চুপচাপ। হুসহস কচমচ শব্দ হচ্ছে। পিন্টুর মন তো আজ সারা দিনই খিঁচড়ে আছে। আর খুকু? সে যে কোনটার পর কী খাচ্ছে তা ঠাওরই করতে পারছে না। সারা বিকেল তার মন মৃত্যু গুহা’র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সেই যেখানে পঞ্চু তরফদার নির্জন পাহাড়ে গুহার মধ্যে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। বাইরে একটা যমদূতের মতো দস্যু পাহারা দিচ্ছে। সবুজ শার্দুল গেছে বিখ্যাত রক্ত-হীরা চুরি করতে। যাবার সময় সে হুঙ্কার দিয়ে শাসিয়ে গেছে, ফিরে এসে তার বিচার করবে। সবুজ শার্দুলের পিছনে লাগার ফল টিকটিকি পঞ্চু তরফদারকে এবার হাতে-নাতে ভোগ করতে হবে। নিষ্ঠুর দস্যু-সর্দার সবুজ শার্দুলের বিচার মানে তো ভয়ঙ্কর মৃত্যুদণ্ড। আর থাকতে না পেরে খুকু পিন্টুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “আচ্ছা ছোড়দা, পঞ্চ তরফদার কি মৃত্যু-গুহা থেকে রক্ষা পাবে?”
কথাটায় পিন্টুর কাটা ঘায়ে যেন নুন পড়ল। খুকুকে এক কনুইয়ের গুতো মেরে বলে উঠল একটু জোরেই “জানি না।”
বাবা চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন। মায়ের কানেও কথাগুলো গিয়েছিল। ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “ফের সেই বই নিয়ে আরম্ভ করেছ। দেখ, কোথেকে এক রদ্দি ডিটেকটিভ বই জুটিয়েছে, তাই নিয়ে দুই ভাই-বোনের আর নাওয়া খাওয়া নেই। আহা, কী আমার বই রে। কেবল পাতায়-পাতায় খুন আর খুঁষোধুষি। আর নামের কী ঘটা—জীবন্ত মৃত্যু।”
বাবা কড়া গলায় বললেন, “পিন্টু, তোমার আগের বারের অঙ্কের রেজাল্ট মনে আছে তো? বেশ, বই পড়তে হলে ভাল বই পড়। জীবনী, জাতকের গল্প, ভ্রমণকাহিনী। না, কেবল বাজে বই পড়ে সময় নষ্ট ! কোথায় রেখেছ বইটা?”
মা বললেন, “আলমারিতে তুলে রেখেছি। ওদের বারণ করে দিয়েছি, খবরদার, কেউ ছোবে না ।”
“হুম।” বাবা গম্ভীর মুখে খেতে লাগলেন। রাত্তিরে অন্ধকার ঘরে শুয়ে খুকুর আর ঘুম আসছে না। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বাড়ির সবাই তার শত্রু। মা এখনও শুতে আসেনি। একা-একা শুয়ে তার মন অভিমানে গুমরে গুমরে উঠতে লাগল।
হঠাৎ ঘরের মধ্যে খসখস আওয়াজ। একটা ছায়ামূর্তি মশারির পাশ দিয়ে আলমারির কাছে এগিয়ে গেল। কে ? মা? কিন্তু মা তো এত লম্বা নয়। তক্ষুনি খুকুর মনে পড়ে গেল দস্যু ‘সবুজ শার্দুল'-এর বর্ণনা। দীর্ঘদেহী, ছায়ামূর্তি, নিঃশব্দচরণ। নিশ্চয় এ কোনো দস্যু। একবার খুকু চেঁচিয়ে ডাকতে চেষ্টা করল বাবাকে। কিন্তু গলা কাঠ, আওয়াজ বেরুল না। এদিকে সে বুঝতে পারল, ছায়ামূর্তি খুলল। কী সব খুটখাট শব্দ। নির্ঘাত ও মায়ের নতুন সোনার হারটা নিচ্ছে। মা বিকেলে ওই হার পরে পাশের বাড়িতে বিনি-মাসীর কাছে বেড়াতে গেছিল। ফিরে এসে আলমারিতে রেখেছে। লোকটা এবার দরজার দিকে ফিরে চলল। ও দরজার বাইরে গেলেই খুকু চেঁচাবে ঠিক করেছে। দরজার পরদার বাইরে বারান্দার আলো দেখা যাচ্ছে। ছায়ামূতি পর্দা সরিয়ে বারান্দায় পা দিল। এক ঝলক আলো পড়ল তার গায়ে।
একী ! এ যে বাবা! আর তার হাতে সেই বইটা !!
খুকুর আর চিৎকার করা হল না।
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances