আসন্ন লিপদের আশঙ্কায় জমে গেলেন রয় হেলভিন! যদিও তার সতর্কবাণী আয়োমকে মৃত্যুর কবল থেকে ছিনিয়ে আনতে পারত না, কিন্তু সেটুকু আওয়াজও তার গলা দিয়ে বেরুল না। সুদানের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে নিরন্ত্র, অসহায় হেলভিনকে প্রত্যক্ষ করতে হল, উপকথার জগৎ থেকে নেমে আসা এক বিচিত্র প্রাণীর ভয়াবহ আক্রমণে সঙ্গী আয়োমের মর্মান্তিক মৃত্যু।
স্থানীয় সুদানীদের দৈহিক পটুতা অসাধারণ। আয়োমের ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম ছিল না। এক ঝলক কালো বিদ্যুতের মত সে দৌড়ে চলেছিল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক থেকে একটা রাইফেল সংগ্রহ করে আনতে। অপেক্ষমান লরিটির কাছে তার আর পৌছনো হল না। কি ঘটতে চলেছে তা বোঝাবার আগেই পিছন থেকে প্রচণ্ড আঘাতে দুটাে শিং তার দেহটাকে গেঁথে ফেলল। পরক্ষণেই দুটো শিকে গাঁথা ঝলসানো মাংসপিণ্ডের মত শূন্যে ঝুলতে লাগল আয়োমের দেহ। আতঙ্কিত হেলভিন দেখলেন, পাঁজরের ঠিক নীচে দিয়ে দু-দুটে শিং-ই দেহটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে গেঁথে ফেলেছে। আয়োমের তীব্র যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ ক্রমে স্তিমিত হয়ে এল। তারপর একসময় স্তব্ধ হয়ে গেল। সব শেষ। হেলভিন বুঝলেন, ফুসফুসে রক্ত প্রবেশ করেছে।
তবে কেবল হেলভিন নয়, আয়োমের হত্যাকারীও বুঝতে পেরেছিল সে কথা। তার ঘাড় ও গলার শক্তিশালী পেশীর একটিমাত্র সঞ্চালনে শিং-এ বিদ্ধ আয়োমের প্রাণহীন দেহ প্রায় ফুট বারো দূরের মাটির উপর গিয়ে আছড়ে পড়ল। হত্যার উন্মাদনা তখনও জন্তুটার সম্পূর্ণ মেটে নি। স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে হেলভিন দেখলেন, দুটি বিশাল বর্শাফলকের মত শিং-এর ক্রমাগত আঘাতে কেমন করে কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে আয়োমের মৃতদেহ পরিণত হল একটি রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে।
পাঠক-পাঠিকাকে আপাততঃ এইখানে রেখে আমরা চলে যাব কাহিনীর প্রারম্ভে--
মাত্র মিনিট কয়েক আগের ঘটনা। শিকারী বয় হেলভিন এবং তার স্থানীয় সুদানী অনুচর আয়োম তাঁবু থেকে মাত্র শ-খানেক গজ দূরে প্রবহমান ক্ষীণ জলধারটির পাড়ে, ঘোর বাদামী রঙের একটা সুদৃশ্য অ্যান্টিলোপের মৃতদেহ থেকে চামড়া সংগ্রহ করার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। এই ধরনের কাজগুলো সম্প্রতি একটি লেপার্ডের চামড়া ছাড়াতে গিয়ে তারা অত্যন্ত কাচা হাতের কাজ দেখায়। ছাড়ানো চামড়াটার মধ্যে লেপার্ডের চোখ এবং ঠোঁটের অংশে খুঁত থেকে যায়। অপূর্ব চামড়াটার ক্ষতি হওয়ার ফলে, হেলভিন ঠিক করেন যে এর পর থেকে তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে ঐ কাজের তত্ত্বাবধান করবেন, এমনকি দুয়েক দিনের মধ্যেই খুঁজেপেতে তিনি নতুন একটি দক্ষ ব্যক্তিকে ঐ কাজের জন্য সংগ্রহ করেন। সেই হল আয়োম। পূর্বপরিকল্পনামত, হেলভিন এবং আয়োম যে মৃতদেহটি থেকে চামড়া সংগ্রহ করছিলেন, সেটি প্রায় চার ফুট উঁচু একটা ঘোর বাদামী রঙের অ্যান্টিলোপ। জন্তুটার প্রত্যেকটা শিং-এর দৈর্ঘ্য প্রায় দু-ফুট করে। শিকারীর সংগৃহীত স্মারক হিসাবে অপূর্ব, সন্দেহ নেই।
ছ-জন ভৃত্যের সাহায্যে প্রায় পাঁচশ পাউন্ড ওজনের মৃতদেহটা যখন স্রোতস্বিনীর পাড়ে এনে রাখা হল তখনই সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এসেছে। নদীর পাড়ে কাজটা সারবারও একটা কারণ ছিল। প্রথমতঃ পরিত্যক্ত শবদেহটা যাতে জলের স্রোতে বহুদূরে চলে যায়, এবং দ্বিতীয়তঃ মাংসের লোভে তাবুর আশেপাশে রাত্রে যেন কোন “অবাঞ্ছিত অতিথির" আবির্ভাব না ঘটে। একটু পরেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসবে। হেলভিন এবং আয়োম উভয়েই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দ্রুত কাজ সারছিলেন।
হঠাৎ হেলভিন আবিষ্কার করলেন যে তাদের পায়ের তলার মাটি কাঁপছে এবং দূর থেকে সমুদ্র গর্জনের মত ভেসে আসছে অস্ফুট শব্দের তরঙ্গ। প্রথমে দুজনের কেউই বিশেষ গা দিলেন না ব্যাপারটায়, কিন্তু তরঙ্গধ্বনি ক্রমশঃ স্পষ্ট এবং নিকটবর্তী হতে, কৌতুহল নিরসনের জন্য হেলভিনই প্রথম উঠে দাঁড়ালেন।
সম্মুখবর্তী লম্বা ঘাসের জঙ্গল। তার উপর দিয়ে চোখ চালিয়ে নজরে পড়ল দুরন্তু গতিতে ছুটে আসা একদল শৃঙ্গ প্রাণী। আফ্রিকার অরণ্যে শিং-এর বাহকের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু কালোমাটি তার ঘাসজঙ্গলের পটভূমিতে প্রায় মিশে যাওয়া জন্তুগুলো নিকটবর্তী হলে, হেলভিন দেখলেন তাদের প্রত্যেকের মুখমণ্ডল বেষ্টন করে চলে গেছে একটা কালো দাগ। দুটি শিং যেন দুটি বিরাট সমান্তরাল সরলরেখা-অরিক্স! চিনতে ভুল হল না হেলভিনের, সংখ্যায় প্রায় গোটা চব্বিশ। আফ্রিকার বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকে সারি সারি শিং-এর সঙিন উঁচিয়ে ছুটে চলেছে শরীর সৌন্দর্যের এক বিচিত্র তরঙ্গ। অপূর্ব ত! মুগ্ধ বিস্ময়ে রয় হেলভিন নিরীক্ষণ করছিলেন সেই সৌন্দর্যপ্রবাহ, আয়োমও ততক্ষণে তার পাশে দাঁড়িয়ে উঠেছে। সঙ্গীর চাপা কণ্ঠস্বরেই চমক ভাঙলো হেলভিনের।
—“সিংহ" চোখ ফেরাতেই নজরে পড়ল, উর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান আরিক্সের দলটির বেশ খানিকটা পিছনে ক্রমশঃ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে একটি উড়ন্ত ধূলোর মেঘ। আর সেই ধূলোর আস্তরণের মধ্যে হাল্কা বাদামী রঙের একটি পরিচিত অবয়ব আবিষ্কার করলেন হেলভিন-হ্যাঁ সিংহই বটে!
“রাইফেল! শীগগির" মাত্র দুটি শব্দ নির্গত হল আয়োমের গলা দিয়ে। ততক্ষণে সে দৌড় শুরু করছে অদূরে অপেক্ষমান "সাফারী ট্রাক"-এর দিকে। উদ্দেশ্য একটা রাইফেল সংগ্রহ করে আনা। কিন্তু হেলভিন তাকে ডেকে ফিরিয়ে আনলেন। কারণ, প্রথমতঃ সিংহের মনোযোগ পলায়নে তৎপর অরিক্সের দলটির উপরই নিবন্ধ এবং দ্বিতীয়তঃ নিজের কোনরকম দৌড়ঝাঁপ করে সিংহের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সদিচ্ছা হেলভিনের ছিল না। অরণ্য নাটকের এই বিরল মুহূর্তগুলি নিরীক্ষণ করার সৌভাগ্য থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করতে চান না।
ততক্ষণে মাত্র দেড়শ গজ দূরে এসে পড়েছে দলটি। রাইফেল সংগ্রহ ইস্তফা দিয়ে আয়োম এসে দাড়ালো হেলভিনের পাশে।
সম্মুখে দুটি মনুষ্যমূর্তির অবস্থিতি। নতুন বিপদের আশংকায় তৎক্ষণাৎ গোটা দলটা গতির সমতা বজায় রেখে বাঁ দিকে মোড় নিল। কেবল দলের শেষভাগে একটা অ্যান্টিলোপের কাছে চকমটা একটু বেশী হয়ে থাকবে। আকস্মিক বিস্ময়ে লোমহর্ষক শিকার কাহিনী।
সে সামনের দুটো পা ঘাসজমির উপর আটকে কোনক্রমে তার দুরন্ত গতি রুদ্ধ করল। দেহভার ন্যস্ত হল পিছনের দুটি পায়ের উপর। একটা অপূর্ত পুরুষ হরিণ। কিন্তু জঙ্গলের প্রাণীদের বেশীক্ষণ বিস্মিত হওয়ার অবকাশ মেলে না। নাগালের মধ্যে শিকার-কালো ঘাসজমির উপর চমকে উঠল ধূসর বিদ্যুৎ। পশুরাজ আক্রমণ করল --
প্রসঙ্গতঃ, এখানে জানিয়ে রাখা ভাল যে, সিংহ শিকার ধরবার জন্য একটি বিশেষ পন্থা অবলম্বন করে। শিকারের পিছনে তাড়া করতে করতে সে হঠাৎ শিকারের পিঠে লাফিয়ে ওঠে এবং তার ঘাড় প্রচণ্ড দংশনে চেপে ধরে মাটির উপর ঝেড়ে ফেলে। তারপরই স-নখ থাবার একটিমাত্র চপেটাঘাতে হতভাগ্য প্রাণীটির কণ্ঠনালী ছিন্ন হয়ে যায়।
কিন্তু এইক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটল।
প্রাণভরে মরীয়া হয়ে, আক্রমণে উদ্যত সিংহের দিকে রুখে দাঁড়াল বিপুলবপু অরিক্স। সিংহ এই অভাবনীয় পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না, ফলে চার-ফুট করে লম্বা দু-টো ক্ষুরধান সিঙ্গনের মারাত্মক সন্নিধ্য এড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষে বহু চেষ্টা করেও সম্ভব হল না। পশুরাজের গতিরুদ্ধ হওয়ার আগেই একটা শিং তার কণ্ঠদেশ বিদ্ধ করে ঘাড় ও গলায় সন্ধিস্থল দিয়ে নির্গত হল, এবং অপরটি প্রায় আমূল প্রবিষ্ঠ হল তার বুকে। ঘাড় ও মাথার দ্রুত সঞ্চালনে অরিক্স তার শিং দুটো মুক্তি করে নিল, তারপর পুনরায় আঘাত হানল শত্রুর দেহে। চরম আঘাত--সিংহের নরম উদরে বিদ্ধ হল দুটি বিশাল শৃঙ্গ। পশুরাজের প্রাণহীন দেহ গড়িয়ে পড়ল বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকে।
ঘটনা প্রবাহের নাটকীয়তা রয় হেলভিন ও তার সঙ্গী আয়োমকে সম্মোহিত করে দিয়েছিল। নির্বাক দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন দুজনে।
অরিক্স শিকারের আশা হেলভিনের বহুদিন লালিত। কিন্তু শিকার করা তো দূরের কথা, অধিকাংশ সময়েই সদাসতর্ক এই প্রাণীগুলিকে রাইফেলের পাল্লার বাইরে, বাইনোকুলারের কাছে পর্যবেক্ষণ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাকে। কিন্তু আজকের দিনটির কথা স্বতন্ত্র। সিংহদমন অরিক্সের এ এক বিচিত্র রূপ—সিংহের মত তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল এবং প্রান্তদেশের রোমগুচ্ছ আন্দোলিত হচ্ছে অধীর উন্মাদনায়, পরিশ্রম এবং অবরুদ্ধ ক্রোধে বাদামী হলুদ চামড়ার উপর ফুটে উঠছে সুগঠিত পাজরের তরঙ্গ; বুনো ঘোড়ার মত বলিষ্ঠ পেশীবহুল কাঁধ। একটি মাত্র সরলরেখায় স্থাপিত দু-দুটো বিরাট শিং, পাশ থেকে অন্ততঃ সেরকমই মনে হল হেলভিনের।
খুব চেনা ঐ মুখ-কোথায় যেন একই রকম মুখের প্রতিচ্ছবি দেখেছেন তিনি মনে পড়ল, মধ্যযুগের নাইট যোদ্ধাদের ঢালের উপর উৎকীর্ণ একশৃঙ্গ মৃগ "ইউনিকর্ণের" মুখ। ইউনিকর্ণ তাহলে উপকথা নয়, বাস্তব। আর সেইসঙ্গে ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়িয়ে আর একটি রূপকথার ছবি ভেসে উঠল হেলভিনের মানসপটে। সিংহের সাথে যুদ্ধরত ইউনিকর্ণের ছবি। কি অদ্ভুত মিল!
কিন্তু খুব বেশীক্ষণ রূপকথার জগতে বাস করা সম্ভব হল না রয় হেলভিনের পক্ষে। আতঙ্কিত হেলভিন আবিস্কার করলেন যে উন্মত্ত অরিক্সের দৃষ্টি তাদের প্রতি নিবদ্ধ হয়েছে। স্ফীত নাসারন্ধ্র, জ্বলন্ত চক্ষু এবং মাথা পিছনের হেলিয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে তিনি বুঝলেন গতিক সুবিধার নয়। হত্যার উম্মাদনা পেয়ে বসেছে ঐ “নিরীহ" জন্তুটাকে। সম্মুখে দুটি মানুষের উপস্থিতি এখন আর তার কাছে ভীতিপ্রদ নয়, বরং তার উন্মত্ত হত্যালীলার আগামী শিকার।
---“শিগ্গীর রাইফেল আনো, ততক্ষণ আমি এটাকে দেখছি " আয়োমকে নির্দেশ দিলেন হেলভিন। বিগত কয়েকটি মুহুর্তের ঘটনাপ্রবাহ রয় হেলভিনের স্নায়ুযন্ত্রের উপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, তার প্রভাবে তিনি স্থাণুরমত প্রান্তরের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়োম প্রাণপণে দৌড়াল ট্রাকের দিকে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ধাবমান আয়োমের দেহ লক্ষ্য করে দুরন্ত গতিতে ছুটে গেল প্রকাণ্ড অ্যান্টিলোপ। মুহুর্তের মধ্যে কর্তব্য স্থির করে ফেললেন হেলভিন। অরিক্সের দৃষ্টি এড়িয়ে যে করে হোক আয়োমকে ট্রাকে পৌছনো সুযোগ করে দিতে হবে তাকে। আয়োম এবং হরিণটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে জন্তুটার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। মারাত্মক ঝুঁকি! কিন্তু এছাড়া আর কোন সহজ উপায় নেই। শেষ মুহূর্তে যদি অ্যান্টিলোপের গতিপথ থেকে হেলভিন সরে যেতে না পারেন তাহলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু দুর্ভাগ্য আয়োমের। উন্মত্ত অরিক্স হেলভিনের দিকে মনোযোগ দিল না, ঝড়ের মত তার ডানদিক দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল অদূরে ধাবমান হতভাগ্য সুদানীটিকে লক্ষ্য করে।
পরবর্তী ঘটনা আমরা জানি। দুটি নিষ্ঠুর শিং-এর ক্রমগাত আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল আয়োমের দেহ। বীভৎস দৃশ্য! হেলভিন বুঝলেন যে, এবার তার পালা। দৌড়ে পরিত্রাণ পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র, অন্ততঃ হতভাগ্য আয়োমের পরিণাম তাকে সেই শিক্ষাই দেয়।
একটু দূরে পড়ে আছে গাঢ় বাদামী রঙের হরিণটার মৃতদেহ, অর্ধেক চামড় ছাড়ানো। আর তার পাশে মাটির উপর ছাল-ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত বড় ছুড়িটা হেলভিনের নজরে পড়ল। নীচু হয়ে ছুরিটা তুলে নিলেন হেলভিন, যদিও তিনি বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে অরিক্সের জোড়া সঙ্গিনের বিরুদ্ধে সেটা তাকে কতটুকু সাহায্য করতে পারে। ছোরা হতে উঠে দাঁড়াতেই ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন হেলভিন। তার সামান্য নড়াচড়া জন্তুটার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। অরিক্সের রক্তচক্ষু তার উপর স্থির। হাতে সময় খুবই অল্প। এক আশ্চর্য পরিকল্পনা নিলেন রয় হেলভিন।
ততক্ষনে খুব কাছে এসে পড়েছে ধাবমান অরিক্স। ঝটিতি মাটিতে শুয়ে পড়ে গুঁড়ি মেরে হেলভিন আশ্রয় নিলেন হরিণের মৃতদেহটার আড়ালে। ঝড়ের বেগে ছুটে এল শৃঙ্গধারী শয়তান। দুটি বিশাল ছুরিকার আঘাত বিভক্ত হয়ে গেল মৃত হরিণের উদর। শুধু অল্পের জন্য হেলভিন বেঁচে গেলেন সে যাত্রায়। তীব্ৰগতি এবং ভরবেগের প্রাবল্যে অরিক্স হেলভিনকে অতিক্রম করে তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। এই ক্ষীণ সুযোগটুকু হাতছাড়া করতে চাইলেন না শ্বেতাঙ্গ শিকারী। তৎক্ষণাৎ আড়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়ালেন অদূরবর্তী গাড়ীর উদ্দেশ্যে।
আয়োম ট্রাক-এ পৌছতে পারেনি । হেলভিন কি পারবেন! পিছনে ছুটে আসছে শরীর মৃত্যু, রক্তলোলুপ হিংস্র অ্যান্টিলোপ।
গাড়ীটা ক্রমশঃ হেলভিনের নিকটবর্তী হচ্ছে। কাছে! আরও কাছে! আর মাত্র কয়েক ফুট--তাহলেই নিরাপদ তিনি। একবার মনে হল প্রাণপণে সমস্ত শরীরটা নিয়ে লরির চারটি চাকার মধ্যবর্তী জমির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই চেষ্টা থেকে বিরত হলেন হেলভিন। প্রায় গাড়ীর কাছে এসে পড়েছেন আতঙ্কিত শিকারী, একবার মুহুর্তের জন্য মাথাটা ঘুরিয়ে পিছনে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন তিনি।
দশ থেকে বারফুটের মধ্যে এস পড়েছে আনতশৃঙ্গ উন্মত্ত অ্যান্টিলোপ! শেষ মুহুর্তে জন্তুটার গতিপথ থেকে কোনক্রমে নিজেকে সরিয়ে আনলেন হেলভিন, কিন্তু ভুল করলেন শিং দুটোকে ধরে আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে। একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় তার দেহ শূণ্যপথে উৎক্ষিপ্ত হয়ে ছিটকে পড়ল মাটির উপর।
পতনের আঘাতে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল হেলভিনের চোখের সামনে, হাত এবং কাঁধের সন্ধিস্থলে অনুভব করলেন তীব্র যন্ত্রণা! চোখের সামনে ঝাপসা একটা বিরাট কাঠামোর অস্তিত্ব বুঝতে পারলেন তিনি। ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি পরিষ্কার হয়ে আসতে কাঠামোটার সঠিক স্বরূপ নির্ধারণ করলেন হেলভিন,—“সাফারী ট্রাক"। মস্তিষ্কের কোষগুলি পুনরায় কার্যক্ষম হয়ে উঠলে হেলভিন আরও বুঝলেন যে উন্মত্ত অ্যান্টিলোপের শিং তাকে গাড়ীর একপাশ থেকে অন্যপাশে চালান করে দিয়েছে, অর্থাৎ, তিনি শূন্যপথে গোটা গাড়ীটাই টপকে এসে মাটিতে ছিটকে পড়েছেন। তৎক্ষণাৎ, লাফিয়ে উঠে পড়ে হেলভিন দৌড়ে গাড়ীর মধ্যে আশ্রয় নিলেন । শেষ পর্যন্ত তিনি নিরাপদ। হেলভিনের মনে হল তিনি বোধহয় আনন্দে পাগল হয়ে যাবেন। কিন্তু অরিক্সটা গেল কোথায়! লরির অপর দিকে জানালা দিয়ে দেখলেন হেলভিন। ঐ তো অদূরে আয়োমের তালগোল পাকানো রক্তাক্ত মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে শয়তান খুনীটা। রয় হেলভিন গাড়ীর মধ্যে রাখা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিলেন। রাইফেলের ভারী বুলেট অরিক্সের কাঁধের ঠিক নীচে মৃত্যুচুম্বন এঁকে দিল।
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances