Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

জাতকের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

এককালে কাশীতে এক বিরাট ধনী বণিক ছিল। তার সিন্দুকে ছিল গাদ গাদা সোনা। কালে ঐ বণিকের বংশ একে একে শেষ হয়ে গেল। বণিক বউয়ের টাকাকড়ির ব্যাপারে খ...

এককালে কাশীতে এক বিরাট ধনী বণিক ছিল। তার সিন্দুকে ছিল গাদ গাদা সোনা। কালে ঐ বণিকের বংশ একে একে শেষ হয়ে গেল। বণিক বউয়ের টাকাকড়ির ব্যাপারে খুবই দুর্বলতা ছিল। সে ইঁদুর হয়ে জন্মাল। সে সেই সোনার গাদার ওপর থাকত। ঐ গ্রামে তখন আর কেউ বেঁচে নেই।
সেই সময়ে বোধিসত্ত্ব ঐ গ্রামে পাথর কাটতেন। সোনার গাদার পাহারাদার ইঁদুর বারবার বোধিসত্ত্বকে দেখে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ে। ইঁদুর একদিন ভাবল, “আমার তো এতো সোনাদানা, এই লোকটার সঙ্গে ভাব করে সম্পত্তি ভাগ করলে মন্দ হয়না।’ এই ভেবে সে একদিন এক টুকরো সোনা মুখে করে নিয়ে বোধিসত্ত্বের কাছে গেল। 
বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি সোনা নিয়ে এলে কেন ?
এটা দিয়ে তুমি নিজের খাবার কিনে আন আমার জন্যও একটু মাংস এনে '
তারপর থেকে বোধিসত্ত্ব তাই করতে লাগলেন। রোজই তিনি খাবার কিনে আনেন। ইঁদুরের জন্য মাংস কেনেন। একদিন হল কি, এক বিড়াল ইঁদুরকে চেপে ধরল। ইঁদুর খুব মিনতি কবে বলল, প্রভু, আমাকে মেরো না। বিড়াল বলল, কেন মারব না, খিদেয় আমার পেটজলে যাচ্ছে। মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। ইঁদুর তখন বলল, তোমার কি একদিন মাংস খেলেই চলবে, নাকি রোজই মাংস খেতে চাও? বিড়াল বলল, রোজ পেলে তবে তো ? ইঁদুর তখন বলল, “আমাকে ছেড়ে দিলে রোজ তোমাকে মাংস দেব। বিড়াল বলল, ঠিক তো? ইঁদুর বলল,হ্যাঁ তুমি দেখতেই পাবে। এরপর থেকে ইঁদুর তাকে নিজের মাংসের আধখানা দিয়ে দিত।
ইঁদুরের  কপালে মুখ নেই। কদিন পওর তাকে আরেক বিড়াল ধরল। ইঁদুর তার সঙ্গেও একই রকম বন্দোবস্ত করল। নিজের " খাবার এখন তাকে তিন ভাগ করতে হচ্ছে। এতেও রেহাই নেই। আরও দুটে বিড়াল তাকে ধরল। ফলে মাংস পাঁচ ভাগ করে সে নিজে মোটে এক ভাগ খেতে লাগল।

কম খেযে ইঁদুর শুকিয়ে যেতে লাগল। বোধিসত্ত্ব দেখলেনেইঁদুর বেচাবার শরীর অর্ধেক হয়ে গেছে। তিনি এখন তাকে জিজ্ঞেস করে সব কিছু জানতে পারলেন। ইঁদুরকে বললেন, এর জন্য তুমি মরতে বসেছ ? দেখ, একদিনে সব কটা বিড়ালকে জব্দ করব।'
বোধিসত্ত্ব তখন কাঁচের মত স্বচ্ছ পথ দিয়ে একটা গুহা বানিয়ে দিলেন।ইঁদুরকে বললেন, তুমি এৰ মধ্যে ঢুকে বসে থাক, বিড়ালরা এলে ওদের গালাগালি করবে। ইঁদুর গুহার ভেতর ঢুকে বসে রইল। প্রথম বিড়াল আসতেই ইঁদুর  বলল, আজ থেকে মাংস বন্ধ, খেতে হলে নিজের মাংস খা। রাগে গবগব করে বিড়াল্ ইঁদুরকে ধরার জন্য লাফ দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্ফটিক পাথরে ধাক্কা খেযে বিড়ালের মাথা ভাঙল। বিড়ালটা মরে গেল। এইভাবে চারটে বিড়ালই শেষ হল। বিড়ালের দল শেষ হলে ইঁদুর আর বোধিসত্ত্ব সেই সোনা খরচ করে আরামে দিন কাটাতে লাগলেন।

এই জাতকের শিক্ষা হল : সবাইকে সন্তুষ্ট করা যায় না।

বোধিসত্ত্ব একবাৰ পাখি হযে জন্মান। বড় হযে তিনি পাখিদের বাজা হলেন। হাজার হাজার পাখি তাকে সব সমযঘিরে থাকত। একবার তিনি কয়েক হাজার পাখিকে সঙ্গে ...

বোধিসত্ত্ব একবাৰ পাখি হযে জন্মান। বড় হযে তিনি পাখিদের বাজা হলেন। হাজার হাজার পাখি তাকে সব সমযঘিরে থাকত। একবার তিনি কয়েক হাজার পাখিকে সঙ্গে নিয়ে হিমালয় পর্বত এলাকায় ঘুরতে যান।
তখন একটি মেয়ে পাখি খাবারের লোভে রাজপথে চলতে শুরু করেছিল। রাস্তায় গাড়ি থেকে ধান, মুগ পড়ে যেত। পাখিটি সেসব দানা খুটে খেত। সে মনে মনে ভাবল, বাস্তায় খাবার পাওয়া ঢ়ের সোজা। কিন্তু আর সব পাখি এসে পড়লে আমার খাবার কমে যাবে। তাই এমন একটা ফন্দি বের করতে হবে যাতে আর কেউ এখানে চরতে না আসে।"
এইসব সাত-পাঁচ ভেবে সে পাখিদের সাবধান করে দিল, 'খবরদার, রাজপথে কখনও চরতে যেও না। দিন রাত ঘোড়াগুলো গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যখন তখন উড়ে গিয়ে বাঁচাও সহজ নয়। যে কোন সময় চাকার তলায় চাপা পড়ে প্রাণ খোয়াতে হবে। তার চেযে না যাওযাই ভালো।’

রোজই সে এভাবে সাবধান করত বলে পাখিরা তাৰ নাম  দিয়েছিল অনুশাসিকা। একদিন সে রাজপথে চলছিল এমন সময শব্দ শুনে বুঝল ঝডেৰ বেগে একটা গাড়ি আসছে। সে ভাবল, গাডি এসে পড়াব আগেই আমি উড়ে যাব। ততক্ষণ খাওয়া যাক।
এদিকে গাড়িটা নিমেষের মধ্যে এসে পড়ল। সে আর উড়ে যাওয়াব সুযোগ পেল না। গাড়িটা তাকে দুটুকরো করে রেখে গেল। এবপর বোধিসত্ত্ব দেখলেন, সব পাখি ফিরে এসেছে, কিন্তু অনুশাসিকার দেখা নেই। পাখিরা তখন তার খোঁজে উড়ে গেল। একটু পরেই খবর পাওয়া গেল সে মারা গিযেছে। 
সব শুনে বোধিসত্ত্ব বললেন, সত্যি খুব আফশেষের কথা, যে সবাইকে সাবধান করত, সে নিজেই ঐ বিপদের মধ্যে গিয়ে মারা গেল।’ 

এই জাতকের শিক্ষা : নিজে সাবধান না হযে অন্যকে সাবধান করা কোন কাজের কথা নয়।


বোধিসত্ত্ব একবার সমুদ্র দেবতা হন। একদিন এক কাক আর তার বউ খাবার খুঁজতে খুঁজতে সমুদ্রেব তীরে চলে আসে। তখন অনেকে সমূদ্র পুজো করছিল। ক্ষীর, পায়ে...

বোধিসত্ত্ব একবার সমুদ্র দেবতা হন। একদিন এক কাক আর তার বউ খাবার খুঁজতে খুঁজতে সমুদ্রেব তীরে চলে আসে। তখন অনেকে সমূদ্র পুজো করছিল। ক্ষীর, পায়েস, মাছ, মাংস আর মদ সমুদ্রেব তীরে ঢেলে দিচ্ছিল। কাক আর কাকের বউ পূজোর মাছ-মংস-মিঠাই আশ মিটয়ে খেল। এমনকি অনেকটা মদও খেয়ে ফেলল। 
কাক তখন তাৰ বউকে বলল, চল, সমুদ্রে স্নান করি। 
বউ বলল, হ্যা, চল। খুব মজা হবে তাহলে ?
নেশার ফূর্তিতেতাৰা জলে নেমে খুব খেলতে লাগল। ডুব দিয়ে স্নান করতে লাগল। হঠাৎ এক মস্ত ঢেউ এসে কাকের বউকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তখন বড় একটা মাছ খপ কবে তাকে ধরে ফেলল। কাকের বউ গেল মাছেৰ পেটে ।
বেচারা কাক বউকে খুঁজে না পেয়ে সুর করে কাঁদতে শুরু করল। কাকের কান্না শুনে যেখানে যত কাক ছিল ছুটে এল। তারা কাককে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ভাই ?
কাক বলল, পাজি সমুদ্র আমার বউকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
শুনে তারা বলল, ঠিক আছে, আমরা সবাই মিলে সমুদ্র সেঁচে ফেলব। সত্যি সত্যি তারা কাজে লেগে পড়ল। ঠোঁটে করে একেকজন জল এনে তীরে ফেলতে লাগল। নুনে মুখ পুড়ে যাচ্ছিল, চোখ লাল হযে উঠল। মাঝে মাঝে তারা একটু জিবিয়ে নেয়, আবার জল সেচে ফেলে। এভাবে অনেকক্ষণ কাজ করে গেল । কিন্তু জল এক বিন্দুও কমে না। শেষে তারা হতাশ হয়ে বলল, ঘন জলে মুখপোডালে কি হবে, জল কমার নাম নেই। এভাবে কিছু হবে না ভাই।'

তখন তারা কাকে বউয়ের কথা বলে বলিাপ করতে লাগল। তার লেজ কত সুন্দৰ ছিল, সে কি মিষ্টি স্বরে ডাকত—এইসব বলে কাঁদতে লাগল। তারপর তারা সমুদ্রকে গালমন্দ করতে লাগল। সমুদ্রদেবতা তখন ভীষণ রূপ ধাৰণ করে কাকদেবের সামনে এলেন। ঐ রূপ দেখে কাকরা ভয়ে পালিযে গেল। আৰ ঠিক তখনি এক বিশাল ঢেউ সেখানে আছড়ে পড়ল। ভাগ্যিস কাকরা পালিয়েছিল, নইলে একটা কাকও প্রাণে বাঁচত না। 

এই জাতকেৰ শিক্ষা হল: খুব বড়র সঙ্গে লড়াই করা যায় না।

বোধিসত্ত্ব একবার এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম নেন।এক সময় তাঁর বিয়ের বয়স হল। বিয়ের পর বোধিসত্ত্ব পরপর দিনটি মেয়ের বাবা হলেন। নন্দা, নন্দবতী ও সুন্দর...

বোধিসত্ত্ব একবার এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম নেন।এক সময় তাঁর বিয়ের বয়স হল। বিয়ের পর বোধিসত্ত্ব পরপর দিনটি মেয়ের বাবা হলেন। নন্দা, নন্দবতী ও সুন্দরীনন্দা তাদের নাম। বোধিসত্ত্বের অকালে মৃত্যু হল। ফলে তাঁর তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে পরের বাড়িতে কাজ করে খেতে হচ্ছিল।

ওদিকে মৃত্যুর পরে বোধিসত্ত্ব সোনার হাঁস হয়ে জন্মালেন। তিনি জাতিস্মর বলে আগের জন্মের সব কথাই জানতে পারলেন। তখন তিনি ভাববার চেষ্টা করলেন, ‘এখন আমার স্ত্রী আর মেয়েরা কি করে সংসার চালাচ্ছে।’ ভাববার চেষ্টা করতেই তিনি পরিষ্কার দেখতে পেলেন, তারা কত কষ্টে বেঁচে আছে।
সোনার হাঁসের সমস্ত পালকগুলোই পেটা সোনার। তাই তিনি ভাবলেন, ‘আমি যদি একটা করে পালক দেই, তাহলে ওদের সংসারের হাল ফিরে যাবে।’ এই ভেবে তিনি তাদের কুঁড়ে ঘরের পাশে উড়ে গিয়ে বসলেন। বোধিসত্ত্বকে দেখে তাঁর মেয়েরা জিজ্ঞেস করল,‘প্রভু, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’ বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘আমি তোমাদের বাবা, মৃত্যুর পর সোনার হাঁস হয়ে জন্মেছি। রোজ আমি তোমাদের একটা করে সোনার পালক দেব। সেটা বিক্রি করে তোমরা আরামে থাকতে পারবে। লোকের বাড়িতে গিয়ে আর তোমাদের কাজ করতে হবে না।’ এই বলে তিনি তাদের একটা সোনার পালক দিয়ে উড়ে চলে গেলেন।

তারপর থেকে বোধিসত্ত্ব মাঝে মাঝে এসে ওদের একটা করে সোনার পলক দিয়ে যেতে লাগলেন। ফলে মা আর তিন মেয়ের অবস্থা ফিরে গেল। একদিন মা মেয়েদের ডেকে বলল. ‘দেখ, তোদের বাবা তো এখন পশুপাখির নামান্তর। এদের স্বভাব বোঝা কঠিন। হয়ত আসাই বন্ধ করে দিল। তার চেয়ে এক কাজ কর, এবার এল আমরা তার সমস্ত পালক ছিঁড়ে নেব।’

পরে বোধিসত্ত্ব এল তাঁর বৌ তাঁকে বললেন, ‘প্রভু, আমার কাছে আসুন।’ বোধিসত্ত্ব যাওয়া মাত্র সে বোধিসত্ত্বের সব পালক ছিঁড়ে নিল। কিন্তু বোধিসত্ত্বের অনিচ্ছায় নেওয়া হল বলে পালকগুলো এক মুহূর্তের মধ্যে বকের পালকের মতই সাদা হয়ে গেল।
বোধিসত্ত্ব তখন উড়ে যাবার জন্য ডানা ছড়িয়ে দিলেন। কিন্তু উড়তে পারলেন না। তাঁর আগের জন্মের স্ত্রী তখন তাঁকে একটা জালার মধ্যে রেখে দিল। রোজ সেখানে তাকে খাবার দাবারও দিত। কয়েকদিন পরে বোধিসত্ত্বের পালক গজাল। কিন্তু সব পালকই সাদা। একদিন তিনি উড়ে চলে গেলেন। আর কখনই তিনি তাঁর মেয়ে বৌকে দেখতে আসেন নি।

এই জাতকের মর্মকথা: বেশি লোভ করলে সব হারাতে হয়।

একবার মগধের রাজগৃহ নহরে বোধিসত্ত্ব বণিককুলে জন্ম নেন। তিনি তখন মগধ রাজের শ্রেষ্ঠী ছিলেন। বোধিসত্ত্বের প্রচুর সোনারূপা ধনদৌলত ছিল বলে তাঁর না...

একবার মগধের রাজগৃহ নহরে বোধিসত্ত্ব বণিককুলে জন্ম নেন। তিনি তখন মগধ রাজের শ্রেষ্ঠী ছিলেন। বোধিসত্ত্বের প্রচুর সোনারূপা ধনদৌলত ছিল বলে তাঁর নাম হয় ‘শঙ্খ শ্রেষ্ঠী’। বারাণসীতে তখন বোধিসত্ত্বের মতই ধনবান আরেক বণিক ছিল। তার নাম পিলয় শ্রেষ্ঠী। দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। একদির পিলয় তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বারাণসী থেকে পায়ে হেঁটে মগধে এল। হঠাৎ তার সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পিলয় মহা সমস্যায় পড়ে বন্ধুর কাছে এসেছে। শঙ্খ তাকে মহা সমাদরে রাখলেন। তারপর একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার এই হঠাৎ আমার কারণ কি বল।”
‘আমি খুব বিপদে পড়েছি।’
‘খুলে বল’
‘বাণিজ্যে এমন ক্ষতি হয়েছে যে আমি এখন সর্বস্বান্ত।’
‘অত দুশ্চিন্তা করো না।’
‘এখন তুমি সাহায্য না করলে আর দাঁড়াতে পারব না।’
‘নিশ্চয় করব।’

শঙ্খ তখন তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দাসদাসী সমান দুই ভাগে ভাগ করে একভাগ পিলয়কে দিলেন। পিলয় সেই সম্পত্তি নিয়ে বারাণসীতে ফিরে গেল। সুখে দিন কাটাতে লাগল।

কিছুদিন পরে শঙ্খের খুব বিপদ দেখা দির। হঠাৎ বাণিজ্যে এমন লোকসান হল যে, শঙ্খশ্রেষ্ঠীর পরনের কাপড়টুকু ছাড়া নিজের বলতে আর কিছুই রইল না। অনেক ভেবে তিনি ঠিক করলেন বন্ধুর কাছে যাবেন। বন্ধুর বিপদে তিনি তাকে দেখেছেন, বন্ধু কি আর তাঁকে দেখবে না।

স্ত্রী আর সঙ্গীদের নিয়ে শঙ্খ বারাণসীর দিকে রওনা হলেন। বারাণসীতে পৌছে ভাবলেন স্ত্রীকে এভাবে হাঁটিয়ে না নিয়ে গিয়ে পান্থশালায় রেখে যাই। তারপর বন্ধু পাল্কী পাল্কী পাঠিয়ে তাঁর স্ত্রীকে প্রাসাদে আনাবেন। এই ভেবে স্ত্রীকে পান্থশালায় রেখে লোকজন নিয়ে তিনি রওনা হলেন।

পিলয় শঙ্খকে দেখে মোটেই খুশি হলেন না। সে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ কি মনে করে?’
‘তোমাকে দেখতে এলাম।’
‘উঠেছ কোথায়?’
‘বাসা ঠিক হয়নি এখনও, স্ত্রীকে ধর্মশালায় রেখে এসেছি।’
‘এখানে তো ভাই জায়গা নেই, তুমি বাসার ব্যবস্থা কর আগে। তারপর রেঁধে বেড়ে খাও। ঘোরাঘুরি করে চলে যাও। তবে, আমার কাছে একদম এস না।’
এই বলে পিলিয় তার কর্মচারীকে ডেকে বলল,‘ওরে, একে এক বাটি আটার ভূসি নিয়ে দে।’ শঙ্খ তখন ভাবলেন, এই বন্ধুর ব্যবহার! এক বাটি আটা চাইছে। না নিলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। শঙ্খ তা করতে চান না। ফলে কাপড়ের খুঁটে এক বাটি আটা নিয়ে ফিরে এলেন।

শঙ্খর স্ত্রী সব কিছু শুনে কাঁদতে লাহলেন। তখন শঙ্খর এক  পুরনো চাকর, যে পিলিয়র কাছে ছিল, সে দেখতে এল ব্যাপার কি। সব শুনে তার খুব কষ্ট হল। শঙ্খ ও তাঁর স্ত্রীকে সে নিজের বাসায় নিয়ে গেল। শঙ্খর আগেরকার চাকরদের ডেকে জানাল কি ঘটেছে। তারপর আগেরকার মনিব-মনিবপত্নির যত্ন-আত্তি করল। তারপর রাজার কাছে শঙ্খকে নিয়ে গেল।

রাজার কাছে নালিশ করায় রাজা পিলিয়কে ডেকে পাঠালেন। পিলিয় শঙ্খের অভিযোগ অস্বীকার করতে পারল না। রাজা তখন হুকুম দিলেন পিলিয়র সমস্ত সম্পত্তি শঙ্খ পাবে। কিন্তু শঙ্খ বললেন, ‘না মহারাজ, আমি আমার পাওনা টাকা পেলেই খুশি হব।’

রাজার আদেশে বোধিসত্ত্ব তাঁর আগেরকার সম্পত্তি ফিরে পেলেন। মগধে গিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগলেন।

এই জাতক থেকে যা শিখলাম: বন্ধু চেনা যায় বিপদে।

বোধিসত্ত্ব ্রকেবার ইঁদুর হয়ে জন্মান। তবে সচারচর ইঁদুররা যত ছোট হয় দেখতে বোধিসত্ত্ব মোটেই তা ছিলেন না। বেরং বেশ বড়সড় ছিল। সব সময় শত শত ইঁদুর ...

বোধিসত্ত্ব ্রকেবার ইঁদুর হয়ে জন্মান। তবে সচারচর ইঁদুররা যত ছোট হয় দেখতে বোধিসত্ত্ব মোটেই তা ছিলেন না। বেরং বেশ বড়সড় ছিল। সব সময় শত শত ইঁদুর নিয়ে তিনি বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন।
ইঁদুরের দল একবার এক লোভী শেয়ালের নজরে পড়ে গেল। শেয়াল মনে মনে ভাবল, ‘যে করেই হোক এদের খেতে হবে।’ শেয়াল ইঁদুরের গর্তের পাশে সূর্যের দিক মুখ করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে বাতাস গিলতে লাগল।

বোধিসত্ত্ব খাবারের খোঁজে বেরিয়ে শেয়ালকে দেখে ভাবলেন, ‘মনে হচ্ছে এই শিয়াল বেশি সাত্ত্বিক।’ তিনি শিয়ালকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মশাই, আপনার নাম কি?’
‘ধার্মিক!’
‘মাটিতে চার পা না দিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
‘আমি চার পা দিয়ে দাঁড়ালে সেই ভার পৃথিবী বইতে পারবে না।’
‘মুখটা ফাঁক করে রেখেছেন কেন?’
‘আমি ভাত খাইনা, শুধু বাতাস খাই, সে জন্য হা করে আছি।’
‘সূর্যের দিকে মুখ করে আছেন কেন?’
‘সূর্যকে নমস্কার করার জন্য।’

বোধিসত্ত্বের আর কোন সন্দেহ রইল না। ইতি নিশ্চয়ই একজন মহান ধার্মিক। তারপর থেকে বোধিসত্ত্ব ইঁদুরদের নিয়ে রোজ শিয়ালকে প্রণাম করতে যেতেন। ইঁদুররা শিয়ালকে প্রণাম করে যখন ফিরত তখন শেষের ইঁদুরটাকে খেয়ে ফেলত।
এভাবেই চলতে লাগল। ইঁদুররা একদিন দেখল গর্তটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তাদের সন্দেহ হল। আগে এই গর্তে তারা গাদাগাদি করে থাকত। আর এখন এক ফাঁকা লাগছে কেন। তারা বোধিসত্ত্বকে ব্যাপারটা জানাল। বোধিসত্ত্বের তখন ঐ শিয়ালের উপর সন্দেহ হল।

পরের দিন প্রণাম করতে যাওয়ার সময় বোধিসত্ত্ব সকলের মেষে রইলেন। তিনি সতর্ক ছিলেন। শিয়াল যেই তাঁকে ধরতে গেল তিনি এক লাফে শিয়ালের গলা কামড়ে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালের ভবলীলা শেষ হল।

বোধিসত্ত্ব একবার বণিক হয়ে জন্ম নেন। যথেষ্ট বিত্ত এবং প্রভাব ছিল তাঁর। সেই সময় বোধিসত্ত্বের একটি ছেলে জন্মায়। একই দিনে তাঁর চাকরেরও একটি ছেলে...

বোধিসত্ত্ব একবার বণিক হয়ে জন্ম নেন। যথেষ্ট বিত্ত এবং প্রভাব ছিল তাঁর। সেই সময় বোধিসত্ত্বের একটি ছেলে জন্মায়। একই দিনে তাঁর চাকরেরও একটি ছেলে জন্মায়।
দুটি শিশু একসঙ্গে বড় হতে থাকে। বোধিসসেত্ত্বর ছেলে যখন পড়তে যেত, চাকরের ছেলেও তার সঙ্গে যেত। দুজনে একসঙ্গে খেলাধুলা করতো। এভাবে চাকরের ছেলে নেহাৎ মূর্খ না হয়ে বেশি কিছুটা লেখাপড়া শিখল। কালে কালে সে বেশ বলিয়ে কইয়ে হল। দেখতেও মন্দ নয়। তাকে কটাহক নামে ডাকা হত। বণিকের ভাড়ার দেখার কাজে তাকে লাগান হল।
কটাহকের মনে খুবই চিন্তা। সে কেবল ভাবে, জীবনটা ভাড়ার সামলাতেই কেটে যাবে। সারাটা জীবন তাকে চাকর হয়ে থাকতে হবে। ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সে তখন এক ফন্দি বের করল। সীমান্তে বোধিসত্ত্বের এক বন্ধু থাকে। সে-ও বড় বণিক। তার একটি মেয়ে আছে। কটাহক ভাবল, ‘প্রভুর সই জাল করে একটা চিঠি তৈরী করতে হবে।’
সে করলও তাই। নিজের একটা চিঠি লিখল: ‘আমার ছেলে অমুক তোমার কাছে যাচ্ছে। তোমার আমার পরিবারকে এক সুতোয় বাঁধতে চাই। দুই পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সম্বন্ধ হলেই তা সম্ভব। আমার ইচ্ছা, আমার ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দাও। তারপর তারা তোমার কাছে থাকুক। সব সুযোগ বুঝে আমি যাব।’

কটাহক চিঠিটার শীলমোহর নকল করে ছাপ দিল। বোধিসত্ত্বের সই জাল করল। তারপর ভাঁড়ার তেকে যত খুশি জিনিসপত্র নিয়ে একদিন রওনা দিল।

সীমান্তের গ্রামে দিয়ে কটাহক সেখানকার বণিককে প্রণাম করল। বণিক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ বাছা।’
‘বারাণসী থেকে।’
‘তুমি কার ছেলে?’
বারাণসীর বণিকের।’
‘কি জন্য এসেছ বাছা?’
‘এই চিঠিটা পড়লেওই সব জানতে পারবেন।’
বণিক চিঠি পড়ে মহা খুশি। সে কটাহকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। কটাহকের নিজের মূর্তি কিন্তু গোপন রইল না। সে যা খায, যা পরে সব কিছুকেই বলে খারাপ। সব সময় সব কিছুরই খুঁত  ধরত সে।

ওদিকে অনেকদিন কটাহককে দেখতে না পেয়ে বোধিসত্ত্বের দুশ্চিন্তা হল। তিনি চারিদিকে কটাহকের খোঁজে লেঅক পাঠালেন। একজন সীমান্ত অঞ্চলে গিয়েছিল। সে ফিরে এসে বোধিসত্ত্বকে কটাহকের কুকীর্তি জানাল।

সব শুনে বোধিসত্ত্ব গেলেন রেগে। কটাহককে শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি সীমান্তের দিকে চললেন। বোধিসত্ত্বের সীমান্ত যাত্রার কথা পাঁচ কান হয়ে কটাহকের কানে এল। সে তখন বেশ ঘাবড়ে গেল।

মনে মনে সে অনেক ফন্দি আঁটল। প্রথমে দিনকতক সে শুধু বলে বেড়াতে লাগল, আজকালকার ছেলেরা বাপ-মা দেখে না। তাদের যত্ন-আত্তি করে না। হাত-মুখ ধোয়ার জল এগিয়ে দেয় না। খেতে দিয়ে বাতাস করে না। পা টিপে দেয় না ইত্যাদি। চাকররা যেসব কাজ করে সে সেগুলোই বেশি করে বলত।

একদিন সে শুনল বোধিসত্ত্ব কাছাকাছি এসে গিয়েছেন। তখন সে বণিকের অনুমতি নিয়ে নিজেই এগিয়ে গেল বোধিসত্ত্বকে সম্বর্ধনা জানিয়ে নিয়ে আসতে। আসার পথে চাকর হিসেবে তাঁর খুব খিদমত করল। আর প্রার্থনা করল, ‘প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। এখানে আমার যেটুকু মান সম্মান রয়েছে দেখবেন তা যেন থাকে।’ বোধিসত্ত্ব তখন তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না।’

বন্ধুর বাড়িতে বোধিসত্ত্ব যে কদিন ছিলেন ঘূণাক্ষরেও প্রকাশ করলেন না যে, কটাহক তাঁর ছেলে নয়। ফিরে যাওয়ার সময় বোধিসত্ত্ব বন্ধুর মেয়েকে ডেকে গোপনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার ছেলে তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে তো?’ এর জবাবে মেয়েটি বলে, ‘ওর সবই ভালো, কিন্তু খাবার দাবার নিয়ে বড্ড বায়নাক্কা, সব কিছুই খারাপ বলে।’ বোধিসত্ত্ব তখন তাকে একটি ছড়া শিখিয়ে দিলেন।

বোধিসত্ত্ব চলে যাবার পর কটাহকের গুমোর গেল আরো বেড়ে। এখন তার আর কোন ভয় নেই। একদিন বণিকের মেয়ে তোকে খেতে দিলে সে আবার বলতে শুরু করল, ‘কি ছিরি রান্নার, এ জিনিস মুখে দেওয়া যায়?’ বণিকের মেয়ে তখন বিড়বিড় করে সেই ছাড়াটি বলে গেলঃ

বিদেশি, গুমোর কত বোঝা যাবে
মনিব যদি আসে আবার দেখা যাবে।
কটাহক, অত দেমাক কিসের তোমার,
যা দিচ্ছি চুপ করে খাও সোনার আমার।

কটাহক বুঝতে পারল বোধিসত্ত্ব তাকে সবই বলে দিয়েছেন। সেই থেকে সে আর টুঁ শব্দটি করত না।

বোধিসত্ত্ব একবার বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের ছেলে হয়ে জন্মান। অবম্য রাজার ছেলে ছিল একশটি। বোধিসত্ত্ব সকলের ছোট। আস্তে আস্তে তিনি বড় হলেন। তাঁর ব...

বোধিসত্ত্ব একবার বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের ছেলে হয়ে জন্মান। অবম্য রাজার ছেলে ছিল একশটি। বোধিসত্ত্ব সকলের ছোট। আস্তে আস্তে তিনি বড় হলেন। তাঁর বিচারবুদ্ধিও প্রখর হল।
বোধিসত্ত্ব একদিনমনে মনে ভাবলেন, ‘আমার এত ভাই, ফলে এদেশে আমার রাজা হবার বোধ হয় কোন সম্ভাবনাই নেই। তবু  একবার ভিক্ষুকদের জিজ্ঞাসা করে দেখি।’ পরের দিন ভিক্ষুকরা রাজ বাড়িতে এলেন। হাত-পা ধুয়ে খেতে বসলেন তাঁরা। খাওয়ার পর যখন বিশ্রাম করছেন বোধিসত্ত্ব তখন তাঁদের কাছে গেলেন। পাশে বসে কথাটা জিজ্ঞাসা করলেন।

ভিক্ষুরা বললেন, ‘দেখ, রাজকুমার, সত্যি কথা বলতে কি এখানে তুমি কোনদিনই রাজা হতে পারবে না। তবে এখান থেকে দুহাজার যোজন দূরে তক্ষশিলা। তুমি যদি সাত দিনের মধ্যে ওখানে যেতে পার তাহলে সাত দিনের মাথায় তুমি সেখানকার রাজা হবে।

ভিক্ষুরা তারপর বোধিসত্ত্বকে সতর্ক করার জন্য আরো খুলে বলেলেন: ‘রাস্তায় এক ঘোর বন আছে। সে বন বড় মারাত্মক। তবে ঘুরপথেও যাওয়া যায় কিন্তু তাতে বেশি সময় লাগবে। ঐ বনে যক্ষদের আড্ডা। যক্ষিনীরা রাস্তার ধারে মায়াবলে গ্রাম বানিয়ে রেখেছে। পথিকদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাদের খুন করে রক্ত খেয়ে ফেলে। তাদের হাত এড়িয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। মানুষ যা যা ভালোবাসে, মায়া দিয়ে তারা সে সবই তৈরী করতে পারে। যাই হোক যদি তাদের দিকে না তাকাও তাহলেই বাঁচতে পারবে।’

বোধিসত্ত্ব বললেন‘ নিশ্চয়ই পারব। তবু আপনারা এমন মন্ত্র পড়া আমাকে দিন যাতে মনের জোর ধরে রাখতে পারি।’ ভিক্ষুরা তাঁকে মন্ত্রপূত বালি আর সূত দিলেন। বোধিসত্ত্ব বাবা-মাকে প্রণাম করলেন। তারপর সঙ্গী আর অনুচরদের বললেন, ‘রাজ্য পাওয়ার জন্য আমি এখন তক্ষশিলায় যাচ্ছি। তোমরা এখানেই থাক।; সে কথা শুনে তাঁর পাঁচজন অনুচর বলল, ‘রাজকুমার, আমরাও যাব।’
বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘তোমরা পারবে না।’
অনুচরেরা জবাব দিল, ‘কেন প্রভু?’
বোধিসত্ত্ব যক্ষিনীদের ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে বললেন। কিন্তু তাতেও তাদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ল না। তখন বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘বেশ চল, তবে ভুল করলেই মারা যাবে মনে থাকে যেন।’

রাস্তায় যক্ষিনীদের মায়া গ্রাম। তারা বোধিসত্ত্বের সঙ্গীদের একে একে লোভের ফাঁদে ফেলল। বোধিসত্ত্ব এখন একা। সঙ্গীরা যক্ষিনীদের মোহে প্রাণ হারিয়েছে। এক যক্ষিনী কিন্তু বোধিসত্ত্বকে ছাড়ল না। সে তাঁর পিছু পিছু যেতে লাগল। একদল কাঠুরে সুন্দরী যক্ষিনীকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঐ লোকটা তোমার কে?’ যক্ষিনী বলল, ‘উনি আমার স্বামী।’ কাঠুরেরা তখন বোধিসত্ত্বকে ডেকে বলল, ‘তুমি কেমন লোক হে, পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে ফেলে ঘোড়ার মত ছুটছ!’ বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘এ মোটেই আমার স্ত্রী নয়, এ রাক্ষুসী, আমার পাঁচ বন্ধুকে খেয়েছে, এখন আমাকে খেতে চায়।’ শুনে তারা বলল ‘সত্যি, পুরুষের  রাগ বড় সাংঘাতিক না হলে নিজের বৌকে রাক্ষুুসী বলে!’

যেতে যেতে যক্ষিনী মায়াবলে মা হল।  কোলে কচি শিশু নিয়ে সে বোধিসত্ত্বের পিছু পিছু চলল। রাস্তায় আরোও কয়েকজন লোক বোধিসত্ত্বকে একই প্রশ্ন করল। আর তিনি সেই এক জবাবই দিলেন। এভাবে তক্ষশিলায় পৌছে বোধিসত্ত্ব এক পান্থশালায় উঠলেন। বোধিসত্ত্বের শক্তিকে অমান্য করতে না পারায় যক্ষিনী ভেতরে ঢুকতে পারল না। সে ছেলে কোলে করে বাইরে বসে রইল।

তক্ষশিলার রাজা তখন বাগান বিহারে যাচ্ছিলেন। যক্ষিনীকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিলেন তার স্বামী আছে কি না। যক্ষিনী বলল, ‘ঐ যে আমার স্বামী।’ কিন্তু বোধিসত্ত্ব বললেন ,‘ এ যক্ষিনী, আমার পাঁচ সঙ্গীকে কেয়েছে।’ যক্ষিনী তখন বলল, ‘হায়, রাগের মাথায় পুুরুষ কি না বলে।’ রাজা লোক মারফৎ সব শুনে বললেন, ‘তাহলে ওকে নিয়ে এস।’

যক্ষিনী রাজার পাটবাণী হল। আর রাতে যক্ষপুরে গিয়ে সমস্ত যক্ষদের ডেকে আনল। পরের দিন সকাল কেটে যাওয়া পরও রাজপ্রাসাদের দরজা খোলে না। প্রজারা তখন দরজা ভেঙ্গে ফেলল। ভেতরে ঢুকে শুধু হাড়ের স্তুপ দেখতে পেল। তখন তাদের বোধিসত্ত্বের কথা মনে পড়ল। ‘তাহলে তো সে ঠিকই বলেছিল। রাজা রূপের মোহে রাক্ষুসীকে এনে সব শেষ করল, ‘নিজেও শেষ হল’।

সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করল, ঐ নির্লোভ মানুষটিই আমাদের রাজা হওযার উপযুক্ত। পান্থশালায় গিয়ে তারা বলল, ‘প্রভু, আপনিই আমাদের রাজ্যের রাজা হোন।’

এক গ্রামে এক ধূর্ত সাধু থাকত। ঐ গ্রামের জমিদার সাধুর ভেলকি দেখে ভুলে যায়। সে সাধুর জন্য একটি কুটির বানিয়ে দেয়। সাধু যাতে রোজ পেট ভরে ভালোমন্...

এক গ্রামে এক ধূর্ত সাধু থাকত। ঐ গ্রামের জমিদার সাধুর ভেলকি দেখে ভুলে যায়। সে সাধুর জন্য একটি কুটির বানিয়ে দেয়। সাধু যাতে রোজ পেট ভরে ভালোমন্দ খেতে পারে জমিদার তার পাকা ব্যবস্থা করে রেখেছিল। জমিদারের বাড়ি থেকে সাধুর জন্য রোজ খাবার দাবার পাঠান হত।

সাধুর ওপর জমিদারের ছিল অগাধ বিশ্বাস। আশপাশের গ্রামে একবার খুব দস্যুর উৎপাত শুরু হল। জমিদার তখন একশ সোনার মোহর এনে সাধুর কুটিরের মধ্যে গর্ত করে পুঁতে রাখল।
সাধুকে বলল, ‘প্রভু, আপনি একটু নজর রাখবেন।’ শুনে সাধু বলল, ‘দেখ বাছা, আমরা তপস্বী, আমাদের এসব কথা বলতে হয় না। পরের জিনিসে আমাদের কক্ষনো লোভ হয় না।’ জমিদার সাধুর কথায় আরও ভরসা পেল। সাধুকে ভূয়সী প্রশংসা করে নিশ্চিন্তে মনে বাড়ি ফিরে গেল।
ধূর্ত সাধু তখন মনে মনে হিসেব দেখল, ‘এই মোহরগুলো দিয়ে একজনের সারাটা জীবন আরামে আয়েসে কাটতে পারে।’ দিনকতক মনে মনে ভেবে একদিন সে গর্ত খুঁড়ে মোহরগুলো তুলে নিল। পরে রাস্তার ধারে এক জায়গায় আবার মোহরগুলো পুঁতে রাখল। কয়েকদিন চুপচাপ সেই কুটিরেই থেকে গেল।

কদিন ধরে জমিদারের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া সারল। তারপর জমিদারকে বলল, ‘বাছা, অনেকদিন ধরে তোমার অন্ন ধ্বংস করছি। এক জায়গায় অনেকদিন থাকলে তপস্বীদের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। অথচ তপস্বীদের পক্ষে তা করা ঠিক নয়। ঠিক করেছি এবার অন্য জায়গায় চলে যাব।’ জমিদার তাকে বহু অনুরোধ করল। কিন্তু সাধু সঙ্কল্পে অটল। তখন জমিদার বলল, ‘আপনি যদি একান্তই থাকতে চান, তাহলে আর কি-বা বলব। বেশ, যেখানে যেতে চাইছেন যা।’ এই বলে জমিদার তাকে গ্রামের সীমানা পর্যন্তে এগিয়ে দিয়ে এল।

কিছুদূর যাওয়ার রপ সাধু ভাবল, ‘এই জমিদারটাকে একটু ঠকানো যাক।’ তখন যে জটার মধ্যে এক টুকরো খড় গুঁজে নিয়ে আবার জমিদারের কাছে ফিরে এল। জমিদার তাকে দেখে বলল, ‘এ কি বাবা, আপনি ফিরে এলন যে!’ তখন সাধু বলল, ‘দেখ বাবা, তপস্বীরা যা দান হিসেবে পায়নি তা তারা নিয়ে যেতে পারে না। তাই এই খড়গাছা তোমাকে ফেরৎ দিতে এসেছি।’ জমিদার বলল,‘আপনি খড়গাছা ফেলে দিন।’ আর ভাবল, ‘সত্যি কি মাহাপুরুষ! পরের কুটোটি পর্যন্ত নিতে চান না!’ সাধুর গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে প্রণাম করল। ভক্তি গদগদভাবে বিদায় দিল।

বোধিসত্ত্ব তখন বাণিজ্য করতে করতে ঐ গ্রামে এসে উঠেছেন। তাঁর কানে এই মহত্বের বিবরণ এর। তখন তাঁর কেমন সন্দেহ হল। তিনি জমিদারের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা মশাই, আপনি ঐ সাধুর কাছে কখনও কিছু গচ্ছিত রেখেছেন কি?’
‘হ্যাঁ। আমি ওঁর কাছে একশ সোনার মোহর গচ্ছিত রেখেছিলাম।’
‘তাহলে তাড়াতাড়ি গচ্ছিত ধন নিয়ে আসুন।’
জমিদার কুটিরে ছুটে গেলেন। শত খোঁড়ুখুঁড়ির করে সে একটিও মোহর পেল না। ফিরে এসে বোধিসত্ত্বকে বলল, ‘না, মশাই, পেলাম না। বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘আপনার মোহর ঐ সাধুই নিয়ে পালিয়েছে। চলুন তাকে ধরি।’

সাধু বেশিদূর যেতে পারে না। তল্লাসি করতেই মোহর বেরিয়ে পড়ল। ভন্ড সাধু খেল বেধড়ক মার।

এই জাতকের মর্মকথা: ভেলকি দেখিয়ে চিরকাল কেউকে বোকা বানানো যায় না।

ব্রহ্মদত্ত তখন বারাণসীর রাজা। আর বোধিসত্ত্ব তার পুরহিত। বোধিসত্ত্ব দান ধ্যান করতেন, নানা রকম সৎকাজে তিনি দিন কাটাতেন। এই কারণে ব্রহ্মদত্ত তা...

ব্রহ্মদত্ত তখন বারাণসীর রাজা। আর বোধিসত্ত্ব তার পুরহিত। বোধিসত্ত্ব দান ধ্যান করতেন, নানা রকম সৎকাজে তিনি দিন কাটাতেন। এই কারণে ব্রহ্মদত্ত তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। অন্য সব ব্রাহ্মণ ও পন্ডিতদের থেকে বোধিসত্ত্বকে একটু বেশিই খাতির করতেন। যাই হোক, বোধিসত্ত্ব একবার রাজভান্ডার থেকে টাকা চুরির অপরাধে ধরা পড়েন। রাজার সেপাইরা তাকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় তখন একদল ছেলে বিষধর সাপ নিয়ে খেলা করছিল। সাপের মুখটি গলায় জড়াচ্ছিল। সাপের লেজ ধরে খেলছিল।

ছেলেদের এই বিপজ্জনক খেলা দেখে বোধিসত্ত্ব ভয পেলেন। তাদের সতর্ক করাবার জন্য বললেন, ‘দেখ বাবা, এভাবে সাপ নিয়ে খেলা করো না। সাপ খুব ভয়ঙ্কর। কামড়ালে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে।’
তারা এ কথা শুনে মোটেই ভয় পেল না। বরং হাসতে হাসতে বলল, ‘ঠাকুর, আমাদের এই সাপটা খুব সভ্য। পোষা সাপ। খারাপ কাজ ভুলেও করে না। তুমি রাজার পুরহিত হয়ে রাজার টাকা চুরি করেছ বলে সেপাইরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই সাপটা তোমার চেয়ে অনেক ভালো।’

বোধিসত্ত্ব এ কথা শুনে ভাবলেন, ‘সাপকেও লোকে ভদ্র শান্ত বলে যদি সে না কামড়ায়। মানুষের তো কথাই নেই। মানুষ হয়ে জন্মেও আমি গুণ হারিয়েছি। পৃথিবীতে দেখছি শীলতাই শ্রেষ্ঠ গুণ।’

বোধিসত্তকে রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হলে রাজা সেপাইদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কাকে ধরে এনেছ?’ সিপাইরা বলল, মহারাজ, এই ব্রাহ্মণ রাজভান্ডার থেকে টাকা চুরি করেছে।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে একে নিয়ে গিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দাও।’ বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমি যে সম্মান পেয়ে আসছি তার কারন কি। সে কি আমার বংশ গৌরবের জন্য, নাকি নিজেরই কোন গুণের জন্য। আজ বুঝলাম শীলতার জন্যই আমি সম্মান পেয়েছি।’

এরপর বোধিসত্ত্ব রাজাকে জানালেন যে তিনি আর রাজ্যে থাকতে চান না। বিষয় বাসনার বাইরে যেতে চান। তারপর বোধিসত্ত্ব প্রব্রজ্যা নিলেন।

এই জাতকের মর্মকথা: শীলতাই শ্রেষ্ঠ গুণ।

বোধিসত্ত্ব একবার ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নেন। বড় হয়ে তক্ষশিলায় এক পন্ডিতের কাছে বেদ শেখেন। শুধু তাই নয়, ধনুর্বিদ্যায় সুপন্ডিত হন। সেজন্য লোকে তা...

বোধিসত্ত্ব একবার ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নেন। বড় হয়ে তক্ষশিলায় এক পন্ডিতের কাছে বেদ শেখেন। শুধু তাই নয়, ধনুর্বিদ্যায় সুপন্ডিত হন। সেজন্য লোকে তাঁকে বলত চুল্ল ধনুর্গ্রহ পন্ডিত।
এই জন্মে বোধিসত্ত্ব বেশ বেঁটে আর কুঁজো ছিলেন। শিক্ষা শেষ করার পর রোজগারের রাস্তা দেখতে হবে। নিজের চেহারা নিয়ে বোধিসত্ত্ব তখন একটু মুশকিলে পড়ে গেলেন। ভাবলেন, ‘রাজার কাছে কাজ চাইতে গেলে রাজা আমাকে দূর করে দেবেন।’ রাজা হয়তো বলবেন, ‘তোমার মতো বামন কখনও বীর তীরন্দাজ হতে পারে?’  এইসব সাঁত পাঁচ ভেবে, বোধিসত্ত্ব লম্বা চওড়া একটা লোকের খোঁজ করতে লাগলেন। তাঁতী পড়ায় ঐ রকম একজনের খোঁজ পেলেন। বোধিসত্ত্ব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই, তোমার নাম কি?’
সে বলল, ‘আমার নাম ভীমসেন।’
বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘এত সুপুরুষ হয়ে কেন তুমি তাঁতী হয়ে আছ?’
সে বলল, ‘ কি করব দাদা, উপায় নেই।’
বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘উপায় আছে, তোমাকে আর তাঁতীর কাজ করতে হবে না।’
তারপর বোধিসত্ত্ব তাকে বোঝালেন যে দুজন মিলে রাজার কাছে যাবেন। ভীমসেন রাজাকে বলবে যে তার মত তীরন্দাজ জম্বুদ্বীপে নেই। রাজা তখন তাকে কাজে বহাল করবেন। বোধিসত্ত্ব ভীমসেনের চাকর হিসেবে থাকবে। যখন সত্যিকারের কাজ আসবে বোধিসত্ত্ব সে কাজ উদ্ধার করবেন।

বোধিসত্ত্ব যেমন যেমন বললেন ভীমসেন ঠিক সেইভাবে চলল। রাজা তাকে দু হাজার টাকা মাস মাইনের চাকরি দিলেন। যখন যেমন কাজ পড়ে তখন বোধিসত্ত্ব তা করে দেন।
তিছুদিন পরে বনের একটা বাঘ মানুষখেকো হয়ে উঠল। তার অত্যাচারে সবাই অস্থির। রাজা ভীমসেনকে বাঘ মারতে বললেন। ভীমসেন বোধিসত্ত্বকে বলল। বোধিসত্ত্ব তাকে বুদ্ধি দিলেন, ‘দখে আমি যাব না। কিন্তু একটা ফন্দি বলে দিচ্ছি। দু হাজার তীরন্দাজকে তুমি বাঘের গুহার সামনে পাঠাও। নিজে গভরি বনে ঢ়ুকবে না। পাশে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে। বাঘটা বেরোলে লোকে তাকে পিটিয়ে মেরে পেলবে। তুমি তখন ঝোপের ভেতর থেকে একটা লতা নিয়ে বেরিযে এসে বলবে, ‘কে মারল রে! আমি ভেবেছি লতা দিয়ে বেঁধে বাঘটাকে গরুর মতো টানতে টানতে নিয়ে যাব, আর তোরা কি না বাঘটাকে মেরে ফেললি। বল কে মেরেছিস।’ তখন সবাই ভয় পেয়ে যাবে। তোমাকে বলবে, ‘প্রভু, দয়া করে রাজাকে এ কথা বলবেন না।’ এদিকে রাজা জানবে তুমিই বাঘ মেরেছ।’
বোধিসত্ত্বের পরামর্শে ভালো ফল হল। ভীমসেন বিস্তর টাকাকড়িও পেল। কিছুদিন পরে বুনো মোষ মারার পালা এল। সে যাত্রাও ভীমসেন বোধিসত্ত্বের বুদ্ধিতে সফল হল। কিন্তু টাকাকড়ি আর মান সম্মান পেয়ে ভমিসেনের মাথা বিগড়ে গেল। সে বোধিসত্ত্বকে অবহেলা করতে লাগল। তাকে খারাপ খারাপ কথা বলল।

কিছুদিন পর বারাণসী আক্রমন করল এক শত্রু রাজা।  রাজা আবার ভীমসেনকে তলব করলেন। ভীমসেন ভাল, আমি নিজেই শত্রু শেষ করব।’ কিন্তু বোধিসত্ত্ব পের পেলেন ভীমসেন একা গেলে মারা পড়বে। কাজও হাসিল হবে না। তখন বোধিসত্ত্বও রথের পিছনে উঠলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকে ভমিসেনর বীরত্ব কর্পুরের মতো উড়ে গেল। ভয়ে সে যায় যায়। বোধিসত্ত্ব তখন তাকে হাতির পিঠ থেকে নামিযে বাড়িতে ফেরৎ পাটিযে দিলেন। আর বীর বীক্রমে শত্রুরাজাকে আক্রমন করলেন। শেষে তাকে বন্দী করে নিয়ে এলেন। এবার সকলে বোধিসত্ত্বের নামে জয়ধ্বনি করতে লাগল্ রাজাও জানলেন প্রকৃত বীর করে।

এই জাতকের মর্মকথা হলঃ নিজের গরিমা মূর্খে প্রচার করে।

বোধিসত্ত্ব একবার হিমবন্ত প্রদেশে হাতি হয়ে জন্ম নেন। রুপোর মত সাদা শরীর। মুখটি রক্ত কম্বলের মতো লাল। এছাড়া তার পা দেখলে মনে হত যেন লঙ্কা দিযে...

বোধিসত্ত্ব একবার হিমবন্ত প্রদেশে হাতি হয়ে জন্ম নেন। রুপোর মত সাদা শরীর। মুখটি রক্ত কম্বলের মতো লাল। এছাড়া তার পা দেখলে মনে হত যেন লঙ্কা দিযে পা রাঙানো হয়েছে। বড় হলে হিমালয় অঞ্চলের সব হাতি তাঁকে দলপতি করল। ষাট হাজার হাতির তিনি নেতা হলেন। তবু যখন দেখলেন দলের মধ্যে পাপ ঢুকেছে তখন দল ছেড়ে বনের মধ্যে একা থাকতে লাগলেন।

একবার বারাণসীর এক কাঠুরে বনে কাঠ কাটতে এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলে। শেষে হতাশ হয়ে দু হাত ওপরে তুলে কাঁদতে শুরু  করে। তার কান্না শুনে বোধিসত্ত্ব তার কাছে এলেন। কিন্তু কাঠুরে তাঁকে দেখে পালাতে শুরু করল। বোধিসত্ত্ব তখন থমকে দাঁড়ালেন। কাঠুরে খানিক দুরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন বোধিসত্ত্ব আবার তার দিকে এগোতে লাগলেন। তা দেখে কাঠুরে আবার দৌড়তে লাগল।
বারকয়েক এরকম হওয়ার পর কাঠুরে বুঝল, এই হাতিটি তাকে আক্রমন করতে চাইছে না। হয়ত উপকারই করতে চায়। তখন সে সাহস করে দাঁড়িয়ে থাকল। বোধিসত্ত্ব তাঁর কাছে এগিয়ে গেলেন।
‘তুমি কাঁদছিলে কেন?’
‘প্রভু, আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, প্রাণের ভয়ে কাঁদছিলাম।’
বোধিসত্ত্ব তাকে তার ডেরায় নিয়ে গেলেন। নানারকম ফল খেতে দিলেন তাকে। তরপর বললেন, ‘ভয় নেই, আমি তোমাকে বনের বাইরে পৌছে দিয়ে আসব।’ বোধিসত্ত্ব যখন তাকে পিঠে করে লোকালয়ের দিকে যাচ্ছিল। কাঠুরে তখন রাস্তাঘাট খুঁটিযে দেখে নিতে লাগল। বন শেষ হলে বোধিসত্ত্ব তাকে বললেন, ‘এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যাও, সামনেই আছে গ্রাম, তবে আমার ডেরার কথা কাউকে বল না।’ বিদায় নিয়ে বোধিসত্ত্ব ফিরে গেলেন।

সেই কাঠুরে একদিন হাড়ের কারিগরদের পাড়ায় ঢুকে পড়ে। সে যখন দেখল মরা হাতির দাঁত থেকে তারা নানারকম জিনিস বানাচ্ছে, তখন একটু অবাক হল।
‘আচ্ছা, জ্যান্ত হাতি কেনো তোমরা?’
‘কিনি বৈকি, মরা হাতির চেয়ে জ্যান্ত হাতির দাঁতের দামও বেশি।’
‘ঠিক আছে, আমি জ্যান্ত হাতির দাঁত এনে দেব।’
এই বলে সে একটা করাত আর খানিকটা খাবার নিয়ে জঙ্গলের দিকে রওনা হল। খুঁজে খুঁজে ঠিক বোধিসত্ত্বের কাছে উপস্থিত।
বোধিসত্ত্ব তাকে দেখে বললেন,‘ ফিরে এলে কেন ভাই?’
সে বলল, ‘প্রভু, আমি খুব গরিব, আপনার কাছে আপনার দাঁতের খানিকটা টুকরো ভিক্ষে চাইছি। যদি তা বেচে খাওয়া- পরার একটা ব্যবস্থা করতে পারি।

বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘তোমার কাছে করাত আছে?’
কাঠুরে বলল, ‘হ্যাঁ প্রভু।’
বোধিসত্ত্ব তখন পা মুড়ে মাটিতে বসে বললেন, ‘বেশ, তাহলে দুটো দাঁত থেকেই কেটে নিয়ে যাও।’
কাটা শেষ হলে বোধিসত্ত্ব শুঁড় দিয়ে টুকরো দুটো তুলে নিয়ে একটু দেখলেন। তারপর বললেন, ‘দেখ ভাই, দাঁত দুটোর ওপর আমার কোন মমতা নেই ভেব না। তবে সর্বজ্ঞতার জন্য আমি এটুকু ছাড়তে রাজি।’
কাঠুরে তা নিয়ে চলে গেল। বিক্রি করে সে টাকা কড়ি ভালোই পেল। একদিন সে টাকাও ফুরিয়ে গেল। তখন সে আমার বোধিসত্ত্বের কাছে  গেল।  কান্নাকাটি করে আবার দাঁতের খানিকটা চাইল। বোধিসত্ত্ব এবারও ফিরিয়ে দিলেন না। এখন তাঁর দাঁত বলতে রইল স্রেফ গোড়াটুকু। দিনকতক পরে সে আবার ফিরে এল। এবার সে ঐ গোড়াটুকুও কেটে নিতে চাইল।

বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘বেশ নাও।’ এবার কেটে নেওয়ার কাজটা একটু কষ্টকর। লোভী কাঠুরে বোধিসত্ত্বের মুখের ভেতরে এক পা রেখে, মাংসের টুকরো সমেত হাড়টুকু ছিঁড়ে নিল।

ফিরতি পথে এক মহা দুর্যোগ দেখা দিল্ বোধিসত্ত্ব দেখতে পেলেন কাঠুরের পাপে পৃথিবী দু টুকরো হল। সেই ফাটল থেকে আগুন উঠে আসছিল। লাল কম্বলের মতো সেই আগুন কাঠুরেকে পেঁচিয়ে নিয়ে তলিয়ে গেল।

এই জাতকের শিক্ষা: অকৃতজ্ঞ লোভী লোককে কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যায় না।

একবার বনের মাঝখানে এক পদ্মসরোবরের পাশে বৃক্ষদেবতা হয়ে জন্মেছিলেন বোধিসত্ত্ব। পাশে একটি ছোট পুকুর ছিল। গরমকালে সেই পুকুরের জল শুকিয়ে যেত। সেই...

একবার বনের মাঝখানে এক পদ্মসরোবরের পাশে বৃক্ষদেবতা হয়ে জন্মেছিলেন বোধিসত্ত্ব। পাশে একটি ছোট পুকুর ছিল। গরমকালে সেই পুকুরের জল শুকিয়ে যেত। সেই পুকুরের মাছেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একদিন এক বক ভাবল, ‘ কি করে এদের ঠকিয়ে খাওয়া যায়।’ তারপর খুব দুঃখী দুঃখী ভাব করে সে পুকুরের ধারে বসে রইল।

মাছরা তাকে ঐ রকমভাবে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হল। মাছেরা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এরকম মুখ শুকনো করে বসে আছেন কেন?’
‘চিন্তা করছি ভাই।’
কিসের চিন্তা?’
‘তোমাদের কথা ভাবছি।’
‘আমাদের জন্য আবার কিসের চিন্তা?’
‘পুকুরের জল তো ফুরিয়ে এল, এখন তোমাদের কি হবে।’
‘কি করা উচিৎ চলুন তো?’
‘আমার কথা যদি বিশ্বাস কর, তাহলে বলি রাস্তা একটা আছে। দূরে এ পদ্মসরোবর আছে, সেখানে প্রচুর জল। যদি রাজি থাক তাহলে তোমাদের সবাইকে এক এক করে আমি সেখানে রেখে আসতে পারি।’
‘অদ্ভুত কথা শোনালেন আজ। মাছের দুর্গতি নিয়ে বক চিন্তিত, এইটি কিন্তু আগে কখনো শোনা যায় নি।’
‘তোমরা যদি বিশ্বাস না কর তাহলে যে কোন একজন আমার সঙ্গে চল। যে ফিরে এসে যদি বলে যে সত্যি এ রকম সরোবর আছে তখন বিশ্বাস করো।’
মাছেরা ভাবল এ পরামর্শ খারাপ না। তখন তারা একটা বুড়ো কানা মাছকে বলল দেখে আসতে। বক তাকে ঠোঁটে করে নিযে গলে। মাছটি ফিরে এসে বলল, ‘হ্যাঁ সত্যি, খুব সুন্দর এক সরোবর দেখে এলাম।’ এখন সব মাছ বক কে বলল, ‘আপনি খুব মহৎ দেখছি। এখন আমাদের সবাইকে নিযে চলুন।’

বক প্রথমে কানা মাছকে ঠোঁটে নিয়ে উড়ল। সরোবরের কাছাকাছি এক গাছে বসে সে কানা মাছকে খেয়ে ফেলল। কাঁটাগুলো মাটিতে পড়ে রইর। এইভাবে সে একের পর এক সব মাছ খেয়ে শেষ করে ফেলল।

শেষে ঐ মজা পুকুরে একটা কাঁকড়া পড়ে রইল। বকের ইচ্ছে, কাঁকড়াকেও খেয়ে ফেলা। কাঁকড়া বকের ঠোঁটে করে যেতে চাইল না। সে বলল, ‘আমার দাঁড়া দিয়ে যদি তুমি তোমার গলা ধরতে দাও তাহলে যাব।’ বক তাতেই রাজি।

উড়ে যেতে যেতে তারা সেই সরোবরের কাছে এসে পড়ল। বক তখন সেই গাছটার দিকে উড়ে যাচ্ছে। কাঁকড়া বলল, ‘ ভাই, তুমি সরোবর ফেলে চলে যাচ্ছ কেন? বক তাকে বলল, ‘আমি কি তোর চোদ্দপুরুষের চাকর যে তোকে সরোবরে পৌছে দেব? এক্ষুণি ধরাধাম ছেড়ে স্বর্গে যাবি।’ কাঁকড়া দাঁড়া একটু শিথিল করল বটে, কিন্তু সরোবরে নামার আগের মুহূর্তে এমন মোক্ষম কামড় দিল যে বকের মাথা আর ধর আলাদা হয়ে গেল।

বোধিসত্ত্ব সব দেখে শুনে মধুর স্বরে বলে উঠলেন, ‘ঠগীদের একবার না একবার বিপদে পড়তেই হবে।’

বোধিসত্ত্ব একবার বণিক বংশে জন্ম নেন। ব্যবসা করে তিনি রোজগার করতেন। তখন তিনি কাশীর  সীমান্তের একটি গ্রামে অনেক ছুতোর থাকত। এক বৃদ্ধ ছুতোর আর ...

বোধিসত্ত্ব একবার বণিক বংশে জন্ম নেন। ব্যবসা করে তিনি রোজগার করতেন।
তখন তিনি কাশীর  সীমান্তের একটি গ্রামে অনেক ছুতোর থাকত। এক বৃদ্ধ ছুতোর আর তার ছেলে ছুতোরের কাজ করত। বুড়ো ছুতোরের মাথার সব চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল। চামড়া কুঁচকে গিয়েছির বয়সের ভারে।

বুড়ো ছুতোর বকেদিন একটা কাঠ ফালা করে তারপর কাঠটাকে সমান করছিল। এমন সময় একটা মশা এসে তার তামার মত চকচকে টাকে বসল। শুঁড়দুটো ছুঁচের মতো ঢুকিয়ে দিল সেই টাকে। ছুতোরের ছেলে সামনেই বসে ছিল। বুড়ো ছেলেকে ডেকে বলল, ‘মাথার উপরে একটা মশা বসে হুল ফোটাচ্ছে। তাড়িয়ে দে না বাবা।’
ছেলে বলল, ‘বাবা, আপনি একদম নড়বেন না, এক আঘাতে আমি মশার দফা শেষ করছি।’
ঠিক তখন বোধিসত্ত্ব মালপত্র বিক্রি করতে ঐ গ্রামে এসেছেন। ছুতোরের বাড়ির উঠোনে। ছুতোর তার ছেলেকে আবার বলল, দেনা বাবা মশাটা তাড়িয়ে।’ ছুতোরের ছেলে তখন ‘তাড়াচ্ছি’ বলে কুঠার তুলল।

তারপর এক আঘাতে বাবার মাথা দু টুকরো করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ছুতোর মারা গেল।

কান্ড দেখে বোধিসত্ত্ব থ। মনে মনে ভাবলেন, ‘মূর্খ বন্ধুর থেকে বুদ্ধিমান শত্রু ভালো। আর কিছু না হোক অন্তত সে ফাঁসির ভয়ে মানুষ  খুন করবে না।’

বোধিসত্ত্ব একবার রাজমহর্ষির গর্ভে জন্ম নেন। তাঁর নাম রাখা হয় ‘শীলবান কুমার।’ ষোল বছর বয়সের মধ্যেই তিনি সর্ব বিদ্যায় শিক্ষিত হন। তারপর বাবার ...

বোধিসত্ত্ব একবার রাজমহর্ষির গর্ভে জন্ম নেন। তাঁর নাম রাখা হয় ‘শীলবান কুমার।’ ষোল বছর বয়সের মধ্যেই তিনি সর্ব বিদ্যায় শিক্ষিত হন। তারপর বাবার মৃত্যুর পর রাজা হলেন। রাজ্য পরিচালনায ধর্ম বুদ্ধির জন্য লোকে তাঁকে মহাশালবান রাজা বলত।
রাজা মহাশীলবানের এক মন্ত্রী অন্তঃপুরের এক যুবতীর সঙ্গে খারাপ আচারন করে। সেই ঘটনা পাঁচ কান হয়ে রাজার কানেও এল। শীলবান রাজা তখন তাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

সেই মন্ত্রী তখন কাশী ছেড়ে কোশল রাজ্যে গেল। সেখানকার রাজার বেশ প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল।  একদিন সে কোশল রাজাকে বলল, ‘মহারাজ, কাশী হল এমন এক রাজ্য যার তুলনা করা চলে মৌমাছি হীন মৌচাকের সঙ্গে। ওখানকার রাজা খুব ভিতু, সামান্য সৈন্য নিয়েও কাশী দখল করা সহজ।
শুনে কোশলরাজ ভাবল, ‘লোকটা নিশ্চয়ই শত্রুর চর। নইলে কাশী এত বড় রাজ্য, আর এ বলে কিনা সামান্য সৈন্য নিয়ে কাশী দখল করা সম্ভব।’ তখন কোশল রাজ তাকে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তুমি কাশীরাজের গুপ্তচর।’
‘না, মহারাজ। আমার কথা বিশ্বাস না করেন তাহলে আপনি সীমান্তের গ্রামে অত্যাচারের জন্য দু’চার জন লোক পাঠান। দেখবেন তারা অত্যাচার করা স্বর্তেও কাশীরাজ তাদের কোন শাস্তি দেবেন না।’

তার কথা শুনে কোশল রাজ মনে হল হয়তো ও ঠিক বলেছে। পরীক্ষা করার জন্য সে প্রথমে কাশীরাজের সীমান্তের গ্রামে হামলা করা জন্য কয়েকজন লোককে পাঠাল। হামলাকারীরা ধরা পড়ল। কাশীরাজের কাছে তাদের নিয়ে গেলে তিনি বললেন, ‘তোমরা অহেতুক গ্রামের লোকগুলোকে মারতে গেলে কেন?’
তারা বলল,‘মহারাজ, আমরা পেটের জন্য ডাকাতি করি।’
তখন কাশীরাজ বললেন, ‘অযথা প্রাণীবধ না করে আমার কাছে এলেই তো পারতে। যা গে, যা হবার হয়েছে। এই নাও টাকা, এবার থেকে সৎভাবে বাঁচতে চেষ্টা করবে।

সেই লোকগুলি ফিরে এসে কোশল রাজাকে ঘটনার বিবরণ দিল। কিন্তু কোমল রাজের সন্দেহ দূর হল না। সে আবার এক দল পাঠাল রাজপথে ডাকাতি করতে। এবারও সেই একই ঘটনা ঘটল। কোশল রাজ এবার নিশ্চিত হয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে কাশী আক্রমণ করল।

কাশীরাজের এক হাজার বীর যোদ্ধা ছিল যাদের সঙ্গে লড়াই করে জেতা প্রায় অসম্ভব। মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়লেও তারা পালিয়ে আসার পাত্র ছিল না। শীলবান রাজা আদেশ দিলে চোখের নিমেষে তারা কোশলরাজকে বন্দী করে আনতে পারত কিন্তু কাশীরাজ প্রাণহানি চান না। তিনি বরলেন, ‘যুদ্ধের দরকার নেই। আমার জন্য মপ্রাণহানি হোক আমি চাই না। যার রাজ্য লোভ আছে সে রাজ্য দখল করুক।’

বিনা বাধায় কোশল রাজসভায় ডুকে পড়ল। রাজা আর তাঁর মন্ত্রীদের বন্দী করে আদেশ দিল, ‘শ্মশানে গর্ত খুঁড়ে এদের পুঁতে ফেল। শুধু এদের মাথা যেন বাইরে থাকে। রাতে শেয়ালকুকুরে এদের খাবে।

কাশীরাজের মনে এতেও রাগ দেখা দিল না। মন্ত্রীরাও শীলবান রাজার অনুগত। তারা কেউ কোন কথা বলল না। যাই হোক, কাশরিাজ ও তাঁর মন্ত্রীদের তো পুঁতে রেখে গেল কোশল রাজের চাকররা। এদিকে রাত হয়েছে। শিয়ালের দল এল। তখন রাজা আর মন্ত্রীরা চিৎকার করে তাদের তাড়িয়ে দিল। পরপর তিনবার তাড়ানোর পর শিয়ালদের ভয় ভেঙ্গে গেল। তারা বুঝতে পারল চিৎকার করা ছাড়া এদের আর কোন ক্ষমতা নেই। তখন একটা শিয়াল কাশীরাজকে খেতে এল। কাশীরাজ শিয়ালের গলা কামড়ে ধরলেন। শিয়াল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। তার নখের খোঁচায় মাটি আলগা হতে লাগল। এক সময় কাশীরাজ গর্ত থেকে উঠে এলেন। মন্ত্রীদেরও উদ্ধার করলেন।

তখন ঐ শ্মশানে দুটি যক্ষ মরার ভাগ নিয়ে ঝগড়া করছিল। তারা কাশীরাজের কাছে বিচার চাইল। রাজা বললেন, ‘আমি সমান ভাগ করে দেব ঠিকই, তবে অশুচি হয়ে আছি, আগে আমাকে স্নান করাও।’ কোশলরাজের সুগন্ধি জল যক্ষবাই এনে দিল। রাজা তাতে স্নান করলেন। তারপর রাজাকে তারা কোশল রাজের কাপড়-চোপড়, সুগন্ধি আর ফুল এনে সাজিয়ে দিল। কোশলরাজের খাবার এনে খেতে দিল। কেননা রাজা খিদেয় কাতর ছিল। এবার যক্ষরা বলল, ‘আর কি করতে হবে বলুন।’ রাজা তখন প্রাসাদ থেকে মঙ্গল খড়গ আনতে বললেন। যক্ষরা তা আনা মাত্র মরাটিকে এ কোপে সমান দু টুকরো করে দিলেন। যক্ষরা মাংস খেয়ে খুশি হল। রাজাকে বলল, ‘আদেশ করুন মহারাজ, কি করতে হবে।’

রাজা তখন বললেন, ‘কোশল রাজের শোওয়ার ঘরে আমাকে নিযে চল।’ কোশল রাজ তখন অকাতরে ঘুমাচ্ছে। কাশীরাজ তার পেট মঙ্গল খড়গের উল্টো দিক দিয়ে খোঁচা মারলেন। ভয়ে কোশররাজ জেগে উঠল। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞস করল,‘মহারাজ, চারদিকে সৈন্য, দরজা বন্ধ। একটা পিঁপড়েও গরতে পারবে না। এখানে আপনি এই সুন্দর পোশাকে খড়গ হাতে এলন কি করে।
 কাশীরাজ তখন শিয়াল ও যক্ষের ঘটনা বললেন। বললেন, কিভাবে এখানে এসেছেন।
সব শুনে কোশলরাজের খুব অনুতাপ হল। সে কাশীরাজকে বলল, ‘নিষ্ঠুর রাক্ষসরা পর্যন্ত আপনার বশ।আপনার গুণ বুঝতে পারে। আর আমি মানুষ হয়েও কিছুই বুঝতে পারলাম না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’ তারপর সে খড়গ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করল, আর এরকম খারাপ কাজ করবে না। কাশীরাজের কাছে ক্ষমা চাইল। তারপর কাশরিাজকে  রাজশস্যায় শুইয়ে নিজে মাটিতে শুলেন।

পরের দিন কোমলরাজ রাজসভায এসে কাশীরাজের কাচে আবার ক্ষমা চাইলেন। বলল, ‘মহারাজ, এবার থেকে আপনিই প্রজাপালন করবেন, শুধু রাজ্য রক্ষার ভার আমি নিলাম। কোশলরাজ সেই কুচক্রী লোকটাকে শাস্তি দিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে গের।

কাশারাজ সিংহাসনে বসে মনে মনে বাবলেন, ‘সত্যি উৎসাহ বড়ায় রাখতে পেরেছিলাম বলেই না আবার সব ফিরে পাওয়া গেল। আশায় বুক বেঁধে উৎসাহ রাখাই মানুষের কর্তব্য।’

ব্রহ্মদত্তের আমলে বারাণসীতে এক ব্রাহ্মণ বাস করত। ব্রাহ্মণ ‘বেদব্ভ’ মন্ত্রে সিদ্ধ ছিল। এই মন্ত্রের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।। তিথি নক্ষত্র দেখে একট...

ব্রহ্মদত্তের আমলে বারাণসীতে এক ব্রাহ্মণ বাস করত। ব্রাহ্মণ ‘বেদব্ভ’ মন্ত্রে সিদ্ধ ছিল। এই মন্ত্রের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।। তিথি নক্ষত্র দেখে একটি বিশেষ যোগে এই মন্ত্র পাঠ করে আকাশের দকে তাকালে সাত রকম রত্নের বৃষ্টি হত। বোধিসত্ত্ব লেখাপড়া শেখার জন্য এই ব্রাহ্মণের শিষ্য হন।

একবার বিশেষ দরকারে ব্রাহ্মণকে চেতিচ রাজ্যে যেতে হবে। বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে নিয়ে সে রওনা হল। পথে আছে এক গভীর বন। যেতে হলে সেই বনের মধ্য দিয়েিই যেতে হবে। অথচ বনটি মোটেই নিরাপদ নয়। যেখানে ‘প্রেষণক’ নামে একদল ডাকাত থাকে। ডাকাতেরা দলেও ভারি, পাঁচশ। তাদের হামলায় পথিককুলের বিপদের অন্ত ছিল না।
এই ডাকাতদের ‘প্রেষণক’ বলা হত, কারণ তারা দুজন পথিককে ধরলে একজনকে ছেড়ে দিত বাড়ি থেকে মুক্তিপনের টাকা নিয়ে আসতে। বাবা আর ছেলেকে ধরলে তারা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য বাবাকে পাঠাত। মা আর মেয়েকে ধরলে পাঠাত মাকে। দু ভাইকে ধরলে মুক্তিপণ আনার ভার পড়ত বড় ভাইয়ের ওপর। গুরু শিষ্যকে ধরলে শিষ্যকে পাঠাত।

ডাকাতের দল ব্রাহ্মণ আর বোধিসত্ত্বকে ধরে ফেলল। নিয়ম অনুসারে তারা বোধিসত্ত্বকে ছেড়ে দিল টাকা আনার জন্য। বোধিসত্ত্ব গুরুকে প্রণাম করে বললেন, ‘দু-একদিনের মধ্যেই আমি ফিরে আসব। আমি যা বলেছি আপনি যদি সেভাবে দুদিন থাকেন তাহলে কোন ভয় নেই। আজ রত্ন বর্ষণের যোগ আছে। কিন্তু সাবধান, ভুলেও এ কাজ করতে যাবেন না। যদি করেন তাহলে আপনি তো মরবেনই, এই পাঁচশ ডাকাতও মারা যাবে।’ ‍গুরুকে প্রণাম করে দিয়ে বোধিসত্ত্ব মুক্তিপণ আনতে রওনা দিলেন।


এদিকে সন্ধা হল। ডাকাতেরা ব্রাহ্মণের হাত পা বেঁধে ফেলে রেখেছে। বনের মাথায় তখন পূর্ণিমার চাঁদ। ব্রাহ্মণ নক্ষত্র দেখে বুঝতে পারল ‘মহাযোগ’ এসে গিয়েছে। সে তখন মনে মনে ভাবল, ‘খামোখা এত কষ্ট করছি কেন? ডাকাতেরা রত্ন পেলেই তো আমাদের ছেড়ে দেবে। মন্ত্র পড়লেই রত্ন পাওয়া যাবে। ডাকাতদের মুক্তিপণ চুকিযে দিয়ে যেখানে খুশি যেতে পারব।’ এই ভেবে সে ডাকাতদের ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা আমাকে বেঁধে রেখেছ কেন?’
‘টাকার জন্য’
‘যদি টাকা পেতে চাও তাহলে এক্ষুণি বাঁধন খুলে দাও। আমাকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পড়াও। চন্দন আর মালায় আমাকে সাজিয়ে দাও। তারপর কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও।’

ডাকাতেরা ব্রাহ্মণের কথা শুনল। ব্রাহ্মণ যা যা বলল তারা ঠিক সেভাবে সব কাজই করল। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পড়ে আকাশের দিকে তাকাতেই রত্নবৃষ্টি শুরু হল। ডাকাতেরা পুঁটলিতে রত্ন বেঁধে নিয়ে রওনা দিল। ব্রাহ্মণকেও তাদের সঙ্গে নিল।

অবশ্য তাদের বেশি দুরে যেতে হল না। আরেক দল ডাকাত, সংখ্যায় তারাও পাঁচশ, এসে প্রেষণকদের ঘিরে ধরল। প্রথম ডাকাত দল দ্বিতীয় ডাকাত দলকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা আমাদের বন্দী করছ কেন?’
তারা জবাব দিল, ‘টাকার জন্য।’
তখন প্রথম ডাকাত দল বলল, ‘তাহলে এ ব্রাহ্মণকে ধর, উনি আকাশের দিকে তাকালেই রত্ন বৃষ্টি হয়। আমাদের সঙ্গে যেসব রত্ন দেখছ সব উনিই দিয়েছেন।’
দ্বিতীয় ডাকাত দল তখন ব্রাহ্মণকে ধরল, ‘ আমাদের এক্ষুণি রত্ন দাও।’
ব্রাহ্মণ বলল, ‘দেখ ভাই, রত্ন বৃষ্টি সব সময় হয় না, তার জন্য বিশেষ যোগ আছে। যে যোগে রত্ন বর্ষণ হয় তা ফিরে আসতে আবার এক বছর লাগবে। তোমাদের রত্ন দিতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।’

শুনে ডাকাতদল বেজায় রেগে গিযে বলল, ‘চালাকি করছ! এক্ষুণি তুমি প্রেষণকদের রত্ন দিলে, আর আমাদের বেলায় এক বছর অপেক্ষা করতে বলছ?’ সঙ্গে সঙ্গে তারা ব্রাহ্মণকে দু টুকরো করে ফেলল। তারপর আক্রমণ করল  প্রেষণকদের। প্রেষণকরা মারা গেলে রত্ন নিযে তাদের নিজেদেরই মধ্যেই যুদ্ধ লাগল। মারামারি কাটাকাটি করে দুজন ছাড়া সবাই মারা গেল।

ঐ দুজন ডাকাত তখন গ্রামের কাছাকাছি এক জঙ্গলে রত্নগুলো লুকিয়ে রাখল। দুজনরেই খুব খিদে পেয়েছে। এক ডাকাত রত্ন পাহারা দিতে লাগল। আরেক ডাকাত চাল কিনে এনে রান্না চাপাল। রত্ন পাহারা দিচ্ছিল যে সে ভাবল আরেকজনকে শেষ করলে সে অনেক টাকার মালিক হবে। তািই তলোয়ার হাতে নিয়ে তৈরী থাকল, দ্বিতীয় জন ভাত রান্না করে আসা মাত্র তাকে মেরে ফেলবে। দ্বিতীয় ডাকাতও একই কথা ভাবছিল। সে নিজের খাওয়া শেষ করে অপর জনের ভাতে বিষ মিশিয়ে এল্ ফল যা হবার তাই হল। দুজনেই মরে পড়ে রইল।

বোধিসত্ত্ব ফিরে এসে সব কিছু দেখলেন। গুরুকে দাহ করলেন। আর মনে মানে ভাবলেন, ‘নিজের স্বার্থে যা খুশি তাই করলে এ রকমটাই হয়।’

বোধিসত্ত্ব একবার পায়রা হয়ে জন্মান। বারাণসীর নাগরিকদের মধ্যে তখন পায়রা ও নানা রকম পাখির প্রতি প্রবল প্রীতি ছিল। তারা মনে করত পাখিদের যত্নআত্ত...

বোধিসত্ত্ব একবার পায়রা হয়ে জন্মান। বারাণসীর নাগরিকদের মধ্যে তখন পায়রা ও নানা রকম পাখির প্রতি প্রবল প্রীতি ছিল। তারা মনে করত পাখিদের যত্নআত্তি করলে নিজেদেরই মঙ্গল হবে। পাখিদের থাকার সুবিধের জন্য তারা খড় দিয়ে ঝুড়ি বানিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখত। বারাণসীর প্রধান বণিকের রাঁধুনিও রান্নাঘরে এরকম একটি ঝুড়ি ঝুলিয়ে রেখেছিল। বোধিসত্ত্ব সেই ঝুড়িতেই থাকতেন। রোজ তকালে তিনি খাবারের খোঁজে বেরিয়ে যেতেন। ফিরতেন সন্ধায়।

একটি কাক একদিন সেই রান্নাঘরের চালের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। উড়ে যাওয়ার সময় রান্নাঘরের মাংসের সুগন্ধ পেয়ে তার খুব লোভ হল। কি করে মাংস খাওয়া যায় ভাবতে লাগল। পাশের একটা গাছে বসে রইল। আর ভেবে চলল। সন্ধা হলে বোধিসত্ত্ব ফিরে এলেন। বোধিসত্ত্ব রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। তা দেখে কাক ভাবল এই পায়রাটাই আমার ভরসা। ওর ওপরে ভর করলেই আমার মনের আশ মিটবে।
পরের দিন ভোরে রান্নাঘরের কাছে কাকটা অপেক্ষা করছিল। বোধিসত্ত্ব খাবারের খোঁজে উড়তে শুরু  করলে সে-ও পিছু পিছু উড়ে চলল। বোধিসত্ত্ব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে আসছ কে ভাই?’

কাকা বলল, ‘আপনাকে আমার খুব মনে ধরেছে, এখন থেকে আপনার চেলা হয়ে থাকতে চাই।’
বোধিসত্ত্ব বলল, ‘সে কি কথা। তুমি এক জিনিস খাও, আমি আরেক জিনিস খাই। আমার চেলা হলে তোমার অনেক কষ্ট হবে।’
কাকের মনে তো অনেক বুদ্ধি। সে বলল, ‘খাবারের ব্যাপারটা সত্যিই আলাদ। যখন আপনি আপনার খাবারের খোঁজে থাকবেন সেই ফাঁকে আমি খাবারটা জুটিয়ে নেব। শুধু আপনার সঙ্গে থাকার অনুমতি দিন।’
বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘বেশ তাই হোক। তবে তোমাকে সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।’

কাককে সাবধান করে দিয়ে বোধিসত্ত্ব ঘাসের বীজ খুঁটে খেতে লাগলেন। কাকও তখন পোকামাকড় ধরে খেতে লাগল। নিজের পেটটি ভরার পর সে বোধিসত্ত্বের কাছে এসে বলল, ‘প্রভু, আপনি অনেকক্ষণ ধরে খেয়ে যাচ্ছেন। বেশি খাওয়া ভাল নয়।’ যাই হোক এপর সন্ধাবেলা বোধিসত্ত্ব বাসায় ফিরছেন। সঙ্গে সেই অনুগত কাকটিও আছে।

তারা রান্নাঘরে ঢুকলে রাঁধুনি ভাবল, ‘পায়রাটা দেখছি একটা সঙ্গী জুটিয়েছে। তাহলে এর জন্যও একটা ঝুড়ি ঝুলিয়ে দেই।’ এই ভেবে সে আর একটি ঝুড়ি ঝুলিয়ে দিল। তারপর থেকে দুজনে ওখানেই রয়ে গেল।

একদিন বণিকের বাড়িতে মস্ত ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। রাঁধুনি রান্নাঘরের জায়গায় প্রচুর মাংস ঝুলিয়ে রেখেছিল। দেখে কাকের দারুণ লোভ হল। ‘যেভাবেই হোক এই মাংস খেতেই হবে,’ মনে মনে সে ঠিক করল।

তারপর সে সারারাত অসুখের ভান করে কাতরাতে লাগল। ভোরবেলা বোধিসত্ত্ব বরলেন,‘চল ভাই, এবার চরতে যাই।’ শুনে কাক বলল, ‘আজ আপনি একাই যান, আমার কাঁধে বড় ব্যাথা হয়েছে।’ শুনে বোধিসত্ত্ব বললেন,‘ভাই, কাকের যে কাঁধে ব্যাথা হয়, কোনদিন শুনিনি। মনে হচ্ছে রান্নাঘরের মাংসের লোভেই তুমি এসব বলছ। এসব বাদ দাও, মানুষের খাবার তোমার খাবার হতে পারে না। আমার সঙ্গে চল, নিজের খাবার খুঁটে খাবে।’

কাক বলল, ‘না প্রভু, আমার সত্যি চলার শক্তি নেই।’ তখন বোধিসত্ত্ব বলেলেন,‘ঠিক আছে, তোমার কাজেই তোমার পরিচয় পাওয়া যাবে। তবে লোভে পড়ে কিছু করতে যেও না।’

বোধিসত্ত্ব চলে গেলেন। রাঁধুনি মাংস রান্না করতে লাগল। ভাপ বের করে দেওয়ার জন্য কড়াইয়ের ডালাটা একটু ফাঁক করে দির। তারপর কড়াইতে ঝাঁঝড়ি বসিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে একটু বাইরে গেল। কাকাও তখন ঝুড়ি থেকে মাথা বের করে দেখল রাঁধুনি বাইরে গিয়েছে।

কাকা ভাবল, মাংস খাওয়ার এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ। বেশ বড় দেখে একটা মাংসের টুকরো খাওয়াই ভাল। এই ভেবে সে ঝাঁঝরির কাছে বসতে যেতেই ঝাঁঝরির শব্দ হল। রাঁধুনিও ছুটে এল সঙ্গে সঙ্গে।

কাকের কান্ড দেখে সে বেজায় রেগে গেল। কাকের সমস্ত পাল ছাড়িযে নিল সে। তারপর নূন-লঙ্কা বাটা তার সারা শরীরে মাখিয়ে ঝুড়ির মধ্যে ফেলে দিল।

বোধিসত্ত্ব ফিরে এসে দেখলেন কাক ছটফট করছে। কাছে গিয়ে তার হাল দেখে বুঝলেন, ‘অতি লোভেই কাকের এই অবস্থা।’তারপর ভাবলেন, ‘আমারও আর এইখানে থাকা উচিত নয়।’
বোধিসত্ত্ব চলে গেলেন। রাঁধুনি কাককে ঝুড়িসমেত ময়লার গাদায় ফেলে দিল।

এই জাতকের মর্মকথা: বেশি লোভ করলে তার ফল পেতেই হবে।

ব্রহ্মদত্তের আমলে বোধিসত্ত্ব একবার গরু হয়ে জন্মালেন। যে গেরস্থের গোয়োলে তাঁর জন্ম হয় তাদের অবস্থা খুব ভাল ছিল না। তারা এক বৃদ্ধার বাড়িতে ভাড়...

ব্রহ্মদত্তের আমলে বোধিসত্ত্ব একবার গরু হয়ে জন্মালেন। যে গেরস্থের গোয়োলে তাঁর জন্ম হয় তাদের অবস্থা খুব ভাল ছিল না। তারা এক বৃদ্ধার বাড়িতে ভাড়া থাকত। পরে ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়ার বদলে বৃদ্ধার হাতে বোধিসত্ত্বকে তুলে দেয়। বৃদ্ধা তাঁকে ছেলের মতো ভালোবাসতো। ভাত, ফ্যান ছাড়াও ভালো ভালো জিনিস খেতে দিত।

বোধিসত্ত্ব একটু ডাগর হতেই গায়ের রং হল কাজল কালো। গাঁয়ের গরুদের সঙ্গে বোধিসত্ত্বও মাঠে চরতে যেতেন। তাঁর মেজাজ ছিল খুব ঠান্ডা। বাচ্চারা তার শিং ধরে টানত, কান ধরে টানত, গলা ধরে ঝুলে পড়ত। কিন্তু তিনি কখনো তাদের আঘাত করতেন না।

বোধিসত্ত্বের সঙ্গে ঐ বৃদ্ধার সম্পর্কটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মা ছেলেন। একদিন বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, ‘আমার মা কত কষ্ট করে। আমি ছেলে হয়ে কিছুই করতে পারছি না। যদি টাকা রোজগার করতে পারি, মার দুঃখ কমে যাবে।’ এই ভেবে তিনি কাজের খোঁজ করতে লাগলেন।
একদিন বোধিসত্ত্ব দেখলেন নদীর ধারে পাঁচশ গোরুর গাড়ি নিয়ে একজন লোক হিমসিম খাচ্ছে।
বোধিসত্ত্ব তখন মাঠে চরছিলেন। নদী পর্যন্ত এসে গাড়িগুলো আর নড়ছে না। হাজার গোরু একসঙ্গে যুতেও কোন লাভ হচ্ছে না। সবাই মিলে টেনেও একখানা গাড়ি অবধি নড়াতে পারছে না। আশপাশ যেসব গরু চরে বেড়াচ্ছিল লোকটা তাদের খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সে গরু চিনত। এক নজর দেখেই বুঝতে পারল কোন গরুটা ভাল জাতের, কোনটা খারাপ জাতের।

বোধিসত্ত্বকে দেখেই বুঝতে পারল, ‘এ বেশ ভাল জাতের গরু। গায়ে জোর আছে। একে দিয়েই আমার কাজ হবে।’ তখন সে রাখালকে জিজ্ঞেস করলঃ ‘এই গরুটা কার? একে গাড়িতে যুতে গাড়ি পার করতে পারলে ভাল মজুরি দেব।’

রাখাল বলল, ‘গরুর মালিক এখানে নেই। আপনি ইচ্ছা করলেই একে গাড়িতে যুতে দিতে পারেন।’
কিন্তু লোকটা যখন বোধিসত্ত্বকে নাকে দড়ি লাগিয়ে তাঁকে টানতে গেল, সে এক পা-ও নড়ল না। বোধিসত্ত্ব মনে মনে ঠিক করেছিলেন, ‘মজুরি ঠিক না হলে নড়ছি না।’ লোকটি তাঁর মনের ভাব বুঝে বলল, ‘আপনি এই পাঁচশ গাড়ি পার করে দিলে গাড়ি প্রতি ২ টাকা করে দেব। মানে সবশুদ্ধ হাজার টাকা দেব।’ বোধিসত্ত্ব তখন নিজে থেকেই গাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে একেবার একেকটা গাড়ির সঙ্গে যুতে দেওয়া হতে লাগল আর তিনি টেনে টেনে সেগুলো পার করে দিতে লাগলেন। এভাবে পাঁচশ গাড়িই পার করা হযে গেল।

লোকটি বণিক। সে ভাবল দু টাকার একটাকা করে দিলে পাঁচশ টাকা বাঁচে। তাই সে পাঁচশ টাকা একটা ছোট থলেয় পুরে বোধিসত্ত্বের গলায় ঝুলিয়ে দিল। তখন বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, লোকটা দেখছি এক নম্বরের ঠগ, চুক্তিমত মজুরি দিচ্ছে না। তাহলে আমিও একে যেতে দেব না।’ যেমন ভাবা তেমন কাজ। বোধিসত্ত্ব গাড়িগুলো আগলে দাঁড়ালেন। তাঁকে এক চুলও নড়ানো গেল না।

বণিক বুঝতে পারলেন, ‘আমি যে চুক্তিমত টাকা দেই নি সেটা বোধ হয় গরুটি টের পেয়েছে।’ তখন সে বোধিসত্ত্বকে থলেটিতে আরো পাঁচশ টাকা দিয়ে বলল, ‘এই নিন, আপনার মজুরির পুরো টাকা দিয়ে দিলাম।’

বোধিসত্ত্ব হাজার টাকা তার মাকে দিলেন। বৃদ্ধা টাকা পেয়ে অবাক। ‘কোথায় পেলি বাবা’ বলে সে বোধিসত্ত্বের দিকে তাকাল। অত কষ্ট করে বোধিসত্ত্ব তখন বেশ কাহিল। রাখালের মুখে সব শুনে বৃদ্ধা বলল, ‘আহারে বাছা, তোর রোজগার খাব। আমি কোন দিন তো তাকে কিছু বলিনি, কেন তুই অত খাটতে গেলি।’ তারপর সে বোধিসত্ত্বের শরীরে হাত বোলাতে লাগল। গরম জলে তাঁকে স্নান করাল। খেতে দিল।

এই গল্পের নীতিকথা: মায়ের সেবার করা সকল সন্তানের ধর্ম।

বোধিসত্ত্ব এক সময় রাজা ব্রহ্মদত্তের মন্ত্রী ছিলেন। তখন রাজার হাতিশালে সুলক্ষণযুক্ত একটি হাতি ছিল। তার নাম মহিলামুখ। হাতিটি এত শান্ত ও ভব্য ছ...

বোধিসত্ত্ব এক সময় রাজা ব্রহ্মদত্তের মন্ত্রী ছিলেন। তখন রাজার হাতিশালে সুলক্ষণযুক্ত একটি হাতি ছিল। তার নাম মহিলামুখ। হাতিটি এত শান্ত ও ভব্য ছিল যে রাজা তাকে মঙ্গলহস্তী করেন।
রাক রাতে হাতিশালার পাশে কয়েকটি চোর এসে আলাপ করতে বসে। চুরি-চামারির ব্যাপারে তারা শলা পরামর্শ শুরু করল। তারা এই সব কথা বলাবলি করতে লাগল:
‘সিঁদ কাটতে হবে ঠিক এই খানটায়। পাঁচিলের এই জায়গায় ফোকর বানিয়ে ঢুকতে হবে। চুরির মাল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফোকরটা আরো বড় করে নিতে হবে। চুরি করার সময় যদি দরকার হয় তাহলে খুন পর্যন্ত করতে হবে। তাহলে আর কারো সাধ্যি হবে না বাধা দেওয়ার। চোরের অত ভদ্র শান্ত হলে চলে না। তাদের হতে হবে দয়ামায়াহীন।

এইসব পরামর্শ করে সে রাতের মত তারা চলে গেল। তারপর আবার পরের রাতে  এল। কথাবার্তা সেই এক। ভোর হওয়ার আগে আবার চলে গেল। এভাবে রাতে পর রাত চলতে লাগল।
রোজ রাতেই এইসব পরামর্শ শেুনে মহিলামুখ হাতির মাথা গেল বিগড়ে। সে ভাবল, ‘এরা আমাকেই উপদেশ দিচ্ছে। আমাকে দয়ামায়া ছাড়তে হবে। খুনটুন করতে হবে।’ পরের দিন সকালেই সে একেবারে ভিন্নমূর্তি ধারণ করল। প্রথমে ভোরবেলা মাহুত আসা মাত্র তাকে শুঁড়ে জড়িয়ে তুলে এক আছাড় মারল। সে বেচারার ভবলীলা সাঙ্গ হল। তারপর যে এল হাতি তাকেই আছড়ে মারতে লাগল।

মহিলামুথ পাগল হয়ে গেছে শুনে ব্রহ্মদত্ত খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। মন্ত্রী বোধিসত্ত্বকে বললেন, ‘আপনি একার দেখে আসুন না হাতিটার কি হল, হঠাৎ কেন মাথাটা বিগড়ে গেল।’

বোধিসত্ত্ব নানাভাবে মহিলামুখকে খুঁটিয়ে দেখলেন। শরীরে রোগের কোন চিহ্ন পেলেন না। তখন ভাবতে লাগলেন হঠাৎ এমন কি হল যে, শান্ত সুন্দর মহিলামুখ এমন দুর্দান্ত হয়ে উঠল। বোধিসত্ত্ব জানতেন হাতি খুব অনুকরণপপ্রিয় জীব। ফলে তাঁর মনে হল, নিশ্চয়ই বদমায়েশ লোকজন এর ধারেকাছে বসে খারাপ কথা আলোচনা করেছে। হাতি ভেবেছে তাকেই ঐসব করতে বলা হচ্ছে।

হাতিশালের লোকটিকে যেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইদানিং হাতিশালের কাছে কোন বদমায়েশ লোকদেরকে ঘুরঘুর করতে দেখেছ কি?’
সে বলল, ‘হ্যাঁ কর্তা, কদিন ধরেই কয়েকটা চোর এসে কিসব ফিসফিস করত।’
বোধিসত্ত্ব তখন রাজাকে বললেন, “মহারাজ হাতির শরীরে কোন রোগ নেই। চোরের কথা শুনে তার মাথা বিগড়েছে।’
শুনে রাজা বললেন, ‘এখন  কি উপায় বলুন?’
বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘জ্ঞাণী ব্রাহ্মণদের ডাকিয়ে আনুন, তাঁরা কয়েদিন হাতিশালের পাশে ভালো ভালো কথা আলোচনা করলেই মহিলামুখ আবার শান্ত হয়ে যাবে।’।
ব্রহ্মদত্ত বললেন, ‘আপনিই তার বন্দবস্ত করুন।’

বোধিসত্ত্ব সেরকম ব্যবস্থা করলেন। ব্রাহ্মণরা আলোচনায় বসে বলতে লাগলেন, ‘কাউকে মারধোর করা খুবই খারাপ। সবাইকে ভালোবাসতে হবে। ক্ষমা করতে হবে। তবেই না স্বর্গে যাওয়া যাবে।’

এইসব উপদেশ শুনে মহিলামুখ আগের মতই ভাবল, ‘এরা আমাকেই উপদেশ দিচ্ছে। এখন থেকে আমি শান্ত সভ্য হয়ে চলব।’ আর সত্যি মহিলামুখ আবার আগেকার মতই ভালো হয়ে গেল।

ব্রহ্মদত্ত এই কান্ড দেখে অবাক। ভাবলেন, সত্যি বোধিসত্ত্বের শুণের কোন শেষ নেই। জীবজন্তুর ভাষাও জানেন। রাজা তখন বোধিসত্ত্বকে খুবই সম্মান দেখালেন।

এই জাতকের নীতিকথা হচ্ছে: বিচার বিবেচনা না করে অন্ধ অনুকরণ উচিত নয়।

বোধিসত্ত্ব একবার কুকুরকুলে জন্ম নেন। স্থান সেই বাণারসী এবং রাজত্ব করছেন ব্রহ্মদত্ত। বোধিসত্ত্ব তখন শ-শ কুকুরে সঙ্গে মহাশ্মশানে থাকতেন। সাজন ...

বোধিসত্ত্ব একবার কুকুরকুলে জন্ম নেন। স্থান সেই বাণারসী এবং রাজত্ব করছেন ব্রহ্মদত্ত। বোধিসত্ত্ব তখন শ-শ কুকুরে সঙ্গে মহাশ্মশানে থাকতেন।
সাজন গোছান রথে চড়ে বাগানে বেরিয়ে রাজা ব্রহ্মদত্ত এক সন্ধায় ফিরে এলন। চামড়া দিয়ে সাজানো রথের সাজগুলো সে রাতে আর খুলে রাখা হল না। সাজ সমেত রখটি উঠানেই পড়ে রইল।
রাকে জোর বৃষ্টি হল। তাতে চামড়ার সাজ ভিজে জবজবে হয়ে গেল। তখন রাজার পোষা কুকুরের দঙ্গল দোতলা থেকে নেমে এসে সেগুলো খেয়ে ফেলল।

পরের দিন রাজার চাকরেরা রাজাকে বলল, ‘মহারাজ, নর্দমার মুখ দিয়ে বাইরের কুকুর ঢুকে রথের সাজ খেয়ে ফেলেছে।’ শুনে রাজা খুব রেগে গেলেন। হুকুম হলঃ ‘যেখানে যত কুকুর আছে সব মেরে ফের।’ সারা শহরে সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল কুকুর হত্যা যজ্ঞ। প্রাণের ভয়ে একদল কুকুর বোধিসত্ত্বের কাছে ছুটে এল। অত কুকুরকে একসঙ্গে দেখে বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞেস করলেন,“ তোমরা সাবই মিলে হঠাৎ শ্মশানে এলে কেন?’
তারা বলল, ‘আমাদের বাঁচান। রাজার রথের সাঁজ কুকুর খেয়ে ফেলেছে। রাজা হুকুম দিয়েছেন, কুকুর দেখলেই বধ করা হবে।’
বোধিসত্ত্ব ভেবে দেখলেন, রাজবাড়িতে ঢুকে বাইরের কুকুরের পক্ষে এ কাজ করা স হজ নয়। রাজার পোষা কুকুরই এর হোতা। মজা হল, দোষ করেও তারা নিরাপদে আছে। আর যারা কোন দোষ করেনি তারা মারা যাচ্ছে। আমার উচিত রাজাকে দেখিয়ে দেওয়া কে দোষী। এতে আমার জাতভাইদের প্রাণ বাঁচবে।
তখন আর সব কুকুরকে ডেকে নিয়ে তিনি বললেন, “তোমাদের ভয় নেই। আমি তোমাদের বাঁচাবার রাস্তা খুঁজে বের করব। তবে আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজার সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসছি ততক্ষণ তোমরা এখানে অপেক্ষা করবে।’

তারপর বোধিসত্ত্ব ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ নিলেন। মনে মনে এই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, ‘রাস্তায় কেউ যেন আমাকে লাঠি বা ঢিল দিয়ে না মারে।’ ফলে তাঁকে  দেখে কারো রাগ দেখা দিল না।

রাজা তখন বিচারালয়ে। বোধিসত্ত্ব সেখানে ঢুকেই এক লাফে রাজার আসনের তলায় লুটিয়ে পড়লেন। রাজার চাকরেরা তাঁকে তাড়া করল। কিন্তু রাজা তাদের বাধা দিলেন। ভরসা পেয়ে বোধিসত্ত্ব রাজার আসনের তলা থেকে বেরিয়ে এলেন। রাজাকে নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহারাজ, আপনি কি কুকুর মেরে ফেলার আদেশ দিয়েছেন?’
হ্যাঁ।
কুকুররা কি অপরাধ করেছে রাজা?
তারা আমার রথের চামড়ার সাজ খেয়ে ফেলেছে।
কোন কুকুর খেয়েছে জানেন কি?
না, তা জানি না।
সত্যিকারের অপরাধীকে না চিনে সব কুকুর মারা এই আদেশ দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?
কুকুর রথের চামড়া খেয়েছে, তাই সব কুকুরকেই মারা হবে।
আপনার লোক কি সব কুকুরকে মারছে, না কি কোন কোন কুকুরকে মারছে না?
রাজবাড়িতে ভালো বংশের যেসব কুকুর আছে তাদের মারা হচ্ছে না।
তাহলে তো সব কুকুরকে মারা হচ্ছে না। রাজবাড়ির কুকুরেরা রেহাই পাচ্ছে। এটা কি সুবিচারের নমুনা> বিচার হবে দাঁড়িপাল্লার মত সমান সমান।
বেশ তো, কুকুর দলপতি, আপনিই বলুন না কে রথের চামড়া খেয়েছে?
রাজবাড়ির কুকুর মহারাজ।
প্রমাণ কি? আপনি রাজবাড়ির কুকুরদের এখানে আনান। আমাকে একটু ঘোল আর কুশ দিন।
এরপর বোধিসত্ত্ব ঘোলের সঙ্গে কুশ রাজবাড়ির কুকুদের খাওয়ালেন। তখন তারা বমি করে  ফেলল। আর বমির সঙ্গে সঙ্গে চামড়ার টুকরো উঠে এল।

সব দেখে শুনে রাজা খুবই প্রীত হলেন। তিনি বললেন, ‘বাহ্‌, এ বেশ ভালো ব্যবস্থা।’ তারপর নিজের শ্বেতছত্র দিয়ে বোধিসত্ত্বের পূজা করলেন। বোধিসত্ত্বও রাজাকে অনেক ধর্মকথা শোনালেন।

এই জাতকের মূল কথা: স্বজাতির মঙ্গল সাধনই জীবের ধর্ম