Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

হাসির গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

     আমরা, শিকারীর বংশ বুঝলি কেষ্টা! — কম্বলমামা কেষ্টার দিকে সগৌরবে তাকিয়ে বললেন। স্বীকার করতেই হলো কেষ্টাকেঃ তা তো বটেই।      বটেই মানে? ...

     আমরা, শিকারীর বংশ বুঝলি কেষ্টা! — কম্বলমামা কেষ্টার দিকে সগৌরবে তাকিয়ে বললেন। স্বীকার করতেই হলো কেষ্টাকেঃ তা তো বটেই।
     বটেই মানে? — কম্বলমামা খেঁকিয়ে উঠলেন, অবিশ্বাস – আমার কথায় অবিশ্বাস? রে—রে দুরাচার, কুলের আচার, তবে এশোন – তোর মত তালিপত্র সৈনিক অর্থাং শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে তালপাতার সেপাই – সেম আমার কথার মর্ম বুঝবে কি? বুঝতো যদি চকা সমাদার থাকতো; তা হলে তোকে এক কথায় সমঝিয়ে দিতো বীরত্ব কাকে বলে। আমার পিসতুতো কাকী এক লাফে এক উড়ন্ত কাক ধরে তার নাকে কৌটোর খাপ পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার কাকা বাড়ীর ঘুমন্ত কুকুরকে মারবার জন্য তিনটে গুলি ছুড়েছিলেন, শেযে বাঁশ দিয়ে সেটাকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। আর আমার শ্যামনগরের পিসীমা? -- বলবো কি কেষ্টা, ঝাঁটা দিয়ে পিসী একটা খ্যাকশেয়ালী ঘায়েল করলেন। এখন তুই চিন্তা কর আমাদের কথা – তোকে আধ ঘন্টা সময় দিলাম।
     কম্বলমামা হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন। 
     শিকারে খুব সাহস দরকার। -- খুব গম্ভীরভাবে বললে কেষ্টা। 
     সাহসের কথা যদি বলিস কেষ্টা, তবে শুনে নে আমার মেজ মাসী গোষ্ঠমোহিনীর কথা। কথায় বলে — যার দাপটে বাঘে গরুতে এক ঘাটের জল খায়। গোষ্ঠমাসী তাই করাতেন। তিনি থাকতেন চুটিয়াপাড়ার গভীর জঙ্গলে।
     চুটিয়াপাড়া? সেটা আবার কোথা? আফ্রিকায় বুঝি? 
     কোথায় তা দিয়ে তোর দরকার কী? গল্পটা হচ্ছে সাহসের, তার মধ্যে কেবল ঘ্যানঘ্যান করছে – কোথায়? কোথায় আবার, – তোর মাথায় !
     কেষ্টা নিজের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেঃ বলো— বলো জিজ্ঞাসা করবো না।
     সেখানে ছিল গভীর জঙ্গল। অসংখ্য বুনো জন্তু— এই ধর বাঘ, সিংহ, হাতী ঘোড়া, উট সব—’
     অত জঙ্গলে মিছিমিছি উনি কষ্ট করে যেতে গেলেন কেন? — কেষ্টা আবার জিজ্ঞাসা করলো।
    গেছে তো গেছে, বেশ করেছে। তোর তাতে কি রে? — কম্বলমামা বেশ চটে উঠলেন, গেছে আমার মাসী গেছে – তোর মাসী তো যায় নি।
     সত্যিই কেষ্টার মাসী কোথাও যান নি। এমন কি গঙ্গা নাইতে কাশীতেও না! শুধু একবার গোবর আনতে আমবাগানের মাঠে গিয়ে সেই যে একটা গুতোনো গরুর ভয়ে পালিয়ে এসেছেন সেই থেকে গোবরের পবিত্র কাজ ঘুঁটিতেই সারেন ; কাজেই তার সাহসের কথা কেষ্টার আপাততঃ কিছুই মনে না পড়াতে সে চুপ করে গেল।
     আমার গোষ্ঠমাসীকে একবার শুঁটকে সাহেব বলেছিলেন খুশী হয়ে — গোস্ট আনটি, তোমাকেই প্রকৃতপক্ষে বীরাঙ্গনা বলা উচিত। আমি যখন আবার চুটিয়াপাড়ায় আসবো তখন তোমাকে আমার চাই-ই। তোমার সঙ্গে আমি শিকারে যাবো।
     মাসীও স্বীকার করেছিলেন । সে অনেক দিনের কথা। একদিন দুপুরবেলা মাসী লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ছারপোকা মারছেন, দরজায় সেই কণ্ঠস্বর শোনা গেল – গোস্ট আনটি — আমি কেটলী সাহেব।
     ওমা, এস বাবা এস। — মাসী স্বাগত জানালেন। 
    আনটি, তৈরী হয়ে নাও। আমরা ওই বনে শিকারে যাবো, তাবু ফেলেছি। গোষ্ঠমাসী হাতের লাঠি খাটিয়ার ওপর রেখে খানিকটা গালে হাত দিয়ে ভাবলেন। তারপর বললেন – তা ভালোই। এলিনর রুজভেল্ট ছিলেন কতবড় শিকারী – আমিই বা কম কিসের? বেশ, যাবো।
     সাহেব বিকেলবেলা মাসীর উঠোনে এসে চমকে গেলেন। এ কি রণসজ্জা ? পায়ে সুপুরীর ডোঙার চটি — সে আবার খুব শক্ত করে নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা; পরনে গেরুয়া ধুতি, গায়ে নামাবলী। টিকিতে একটা জবাফুল বাঁধা আর হাত একগাছা মুড়ো বাটা। বা হাতখানা কোমরে রেখে মাসী তিলের নাডুর মত দুর্ভেদ্য মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে প্রথম দেখেই কেটলী সাহবে আমড়ার আঁটির মত ছটকে গেলেন। কিন্তু বলতে হবে সাহেব — ওদের গোঁ-ই আলাদা। তখনি বেশ একটি ভিরমি হাসিমুখে সামলে নিয়ে কুলের আচারের মত মিষ্টি মুখ করে বললেন – বাঃ গোস্ট আনটিকে তো বেশ লাগছে। — শুঁটকো সাহেব চি-চি খক-খক হুয়া-হুয়া করে হেসে উঠলেন।
     গোষ্ঠমাসী চিড়েভাজার মোয়ার মত আরো কঠিন হয়ে গিয়ে বললেন – আর হিঁ হিঁ করতে হবে না চিংড়ী অবতার, এখন চল তো দেখি।
     গভীর বন ৷ শাল, তাল-তমাল, পিয়াল এসব ভালো ভালো কবিদের ভালো লাগবার মত গাছের সঙ্গে সঙ্গে পিন্ডিখেজুরের মত লেপটে রয়েঠে জিকে, আম, জাম, কাঁঠাল, বিছুটি ইত্যাদি। অরণ্যের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ – পাশে পাশে গিরিমালা।
     পাহাড়ও বুঝি ছিল সেখানে – কেষ্টা বিস্ময় প্রকাশ করে। 
     ছিল বৈ কি! গিরি ছিল, গিরিমালা ছিল, রুদ্রাক্ষের মালার মত জড়িয়ে ; তার মধ্যে ছিল প্রস্রবণ —
     উঃ রে—বাবাঃ– 
    বাবা কিরে। এরপর যখন গল্প আরম্ভ হবে তখন বলিব ঠাকুরদাদা’! গোষ্ঠমাসী তো চলেছে। পিঠে একটা প্রকাণ্ড বস্তা।
     ওটা কী গোস্ট আনটি – এটা আবার কোথা থেকে জোটালে? — সাহেব বললে। 
     চুপ কর তো বাছা! সব কথা কী তোমার ওই বাদুড়-চোষা শুটকো মগজে ঢোকে? শুধু দেখ কী করে গণ্ডার শিকার করতে হয়। দেখে তাজ্জব হবি। তোর ও কচুগাছের মত বন্দুকের কাজ নয়, এ বুদ্ধির দরকার! — বলেই গোষ্ঠমাসী টিকিসুদ্ধ জবাফুলটাকে পটাস করে দুলিয়ে দিলেন আর ওটা সশব্দে কপালে এসে লাগলো। সাহেপ উচ্চিংড়ের মত লাফিয়ে সরে গেলেন।
     সন্ধ্যেবেলার ওরা ক্যাম্পে এসে খানিকটা বিশ্রাম করে নিলো। চারদিকে নিবিড় অন্ধকার কালো কালো হয়ে রয়েছে, টিপ্‌-টিপ করে জোনাকী জ্বলছে – ঝিঁঝিঁ একটানা ঝনঝনি বাজিয়ে অরণ্য-সঙ্গীত গাইছে।
     গোষ্ঠমাসী ক্যাম্পের খাটিয়ার ওপর বসে বললেন— কি রে ছারপোকা-টোকা নেই তো?
     না মাসী, নুতন খাট দেখছো না! — সাহেব বললেন। 
    তবে একটু গড়িয়ে নিই। আজ আবার একাদশী কি না! — বলেই ট্যাক থেকে প্রকাণ্ড তামাকপাতা-পোড়ার গুড়ো দাঁতে ঘসে বস্তাটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
     শিকারে যাবে না মাসী? — শুটকে সাহেব চিঁ চিঁ করে বললেন। 
     তোরাই আজ যা ; পরে তো আমি যাবোই। — মাসীর আদেশ শোনা গেল। 
    কিন্তু সাহেব জেদ ধরেছে – যাবেই যাবে এই রাতেই যাবে যুদ্ধে। সাহেবদের এইসা গোঁ কী বলবো। অনেক করে বুঝিয়েও কিছু করা যায় না। শেষে দুটাে কুলি, এক ফ্লাস্ক চা, খানিকটা বিস্কুট – এসব নিয়ে তামাটে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে সাহেব বনে রওনা হলেন।
     খানিকটা দূর এগোতেই একটা মস্ত কোলাবাঙ তার ছেলেপুলেদের নিয়ে জলার ধারে বসে জোনাকীর প্রদীপ জ্বলে কচ্ছপের টেবিলের ওপর বই রেখে পিঁপড়ে আর পিঁপড়ীর গল্প পড়ে শোনাচ্ছিল। শুটকে সাহেপ পাশ দিয়ে যেতে সে চোখের চশমা নাকে চড়িয়ে বললে — ওটা আবার কে যায়। — সাপ-টাপ তো নয়? — আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙের তিন ছেলে ছড়া কেটে বললে –
শুঁটকী চামচুটকি সিঙ্গী মাছের ঝোল
শুটকীর টিকি ধরে তোল। 
ভারি বেয়াদব ছেলেদের একটা ধমক দিয়ে ব্যাঙ বললে – এই রাতে চলছে শিকার করতে ! ছোঃ
     সাহেব বললেন — কী বলে রে ওরা? 
     ও সব বাজে কথায় কান দেবেন না সার, চলুন।
     বনবেড়ালের দল, হায়েনা, ইঁদুর ছুটে পালালো। ওদের দেখে কিন্তু সাহেব কিছুতেই ভয় পেলেন না, বন্দুকটাকে শক্ত করে ধরে হেঁটে চললেন।
     দুটাে জলা পেরিয়ে ওরা একটা বড় গাছের ওপর চড়ে বসলো। এখানেই জন্তুজানোয়ারের প্রধান আড্ডা কিনা, তাই।
    একটা কিছু ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে ভেবে কেষ্টার চোখের তারা দুটাে রাজভোগের মত আকার নিলো, বললেঃ তারপর?
      তারপর সব জস্তুদের মিটিং বসবে। একটা খেঁকশেয়াল হোয়া হোয়া করে তা প্রচার করে দিয়ে গেল। সভা বসবে, তাই ছোট ছোট বাচ্চার দল ভিড় করেছে – খরগোসরা ছুটোছুটি করছে। দূরে জলার পাড়ে হরিণরা লক্ষ্য করছে ব্যাপারটা কী ঘটতে যাচ্ছে।
     মাইক বসেছে। কচুফুলের মালা গেথেছে হনুমানের দল। সভাপতি সিংহ আর উদ্যোক্তা জিরাফ। সবাই এসেছে। হাতী, বাঘ, সিংহ, হায়েনা – কেউ বাদ নেই। হায়েনারা ফট্‌কের মত হি-হি করছে এমন সময় সভাপতি বললেন – একটা বেশ গন্ধ পাচ্ছি – বেশ চপকাটলেটের মত ।
     সাহেবের তো মুখ শুকিয়ে গেছে। গলা দিয়ে হেঁচকি উঠছে – হিক -হিক-হিক! গুপ্তচর — গুপ্তচর জিরাফ অমনি তার আঁকশির মত গলাটা গাছের দিকে প্রসারিত করতে লাগলো।
     সাহেব যতই ওপরে ওঠেন – জিরাফ ততই গলা লম্বা করে। সভার মধ্যে হাসির বন্যা বলে গেল — হি, হি – হে, হে — হেউ — হেউ হায়েনারা এ ওর গায়ে চিমটি কেটে হাসতে লাগলো। সে কি হাসি !
     শেষে আর উপায় নেই দেখে সাহেব বললেন – আমার কুলিরা পালিয়েছে, আমায় মেরো না। আমার বন্দুক পড়ে গেছে – পোটলা-পুটলী হারিয়ে গেছে --
     বাজে বকিস নি – বলেই সিংহমশাই একটা হুঙ্কার দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ভালুকের দলের সে কি উৎসাহ ! তারা শালুক খায় আর বলে – টেনে নামা – টেনে নামা।
     জিরাফ আঁকশির মত গলায় দিয়ে পাকা আমটির মত কেটলী সাহেবকে পেড়ে ফেললে।
     তারপর -- তারপর  — কেষ্টা বললে । 
     তারপর আর কী একেবারে হুম্বা হুম্বা নাচ শুরু হয়ে গেল চারদিকে।
    সকালে আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই সেই কুলি দুটো লাফিয়ে উঠলো এঁদো পুকুর থেকে। তারপর নাক-কান থেকে ব্যাঙচিগুলো ঝেড়ে ফেলে ছুটে খবর দিলো — নিদারুণ সংবাদ, যুদ্ধে কেটলী সাহেব বন্দী।
     শুনে গোষ্ঠমাসির টিকি রাগে অপমানে তরমুজের বেঁটার মত খাড়া হয়ে উঠলো। তিনি হুঙ্কার ছাড়লেন – হরি – হরি! এসব শুকনো লঙ্কা নিয়ে গণ্ডার শিকারে আসা? ছি—ধিক্ ওর জীবনে। ওরা ওকে শুকতনী বানিয়ে খাক—আমি কিছু বলবো না।
     কিন্তু কুলি দুটো কেঁদে পড়ল – মাইজী— 
     তোমার গোষ্ঠমাসী তবে কি শিকারী ? — কেষ্টা বললে। 
    আরে তাই তো বলছি – শোন না। মাসী সন্ধ্যের আগেই সবাইকে ঠিক করে নিলেন। তারপর নিজে সেজেগুজে তৈরী হয়ে চললেন বনের ভেতরে। পেছনে চলেছে মুটের মাথায় সেই বস্তা – আর মাসীর পায়ে সেই সুপুরীর খোলার চটি নারকোল দড়ি দিয়ে বাঁধা। পরনে গেরুয়া ধুতি আর নামাবলী আর হাতে বন্দুকের মত করে ধরা বাটা। বনের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতেই অন্ধকার হয়ে এলো। কিন্তু একটু সাড়া-শব্দ নেই। মাসী বললেন – ওরা এখন বসেছে কেটলী সাহেবকে সায়েস্তা করতে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে চল। 
     বনের ভেতর আবার সেই জায়গা। মাসী একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে শুনলেন। সভা বসেছে। ঢোঁড়া সাপের দড়ি দিয়ে উটের সঙ্গে সাহেবকে শক্ত করে বেঁধেছে আর মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছে – তোরা আমাদের চিড়িয়াখানায় বন্ধ করে রাখিস কেন?
     কেটলী সাহেব যেন কী বলতে গেলেন, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুলো না। ডোরা বাঘের দিকে আঙুল দেখিয়ে সিংহ বললে – ওকে তিন মাস আগে খাঁচায় বন্ধ করে কলা দেখিয়েছিস আর ছোলা ভিজে খেতে দিয়েছিস?
     আমি না স্যর— ওটা বিল্টুর কাকা। 
    হোক বিল্টুর কাকা — তাকে তো আর পাওয়া যাচ্ছে না! 
    এর মধ্যে গোষ্ঠমাসীর ইসারায় কী যেন কাজ চলছে নিঃশব্দে। কেউ জানতে পারছেন না কিন্তু ! ধীরে ধীরে ওরা কি যেন করছে।
     তোরা এই নিরীহ ছেলেমানুষ বাঁদরগুলোকে ফ্রক পরিয়ে ফুলমণি আর গোপালবাবু সাজিয়ে দরজায় দরজায় নাচাস। আর তোদের বখাটে ছেলেগুলো ছড়া কাটে – বাঁদর, কলা খাবি? আজ আমরা তোদের সমস্ত দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ নেবো। আমরা তোকে তেঁতুলগোলা, কাঁচা লঙ্কা, নুন আর লেবুর রস দিয়ে ছোলা ভিজার সঙ্গে মিশিয়ে খাবো। দেখি তোকে কে বাঁচায় ? — বললে সিংহ।
     বলার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বনের ভেতরে আগুন জ্বলে উঠলো শুকনো পাতায় আর সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাচ— ফাচ – ফ্যাঁচচো – আওয়াজে সমস্ত বনভূমি কম্পিত হয়ে উঠলো। সবাই যে যার প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে। সজারু এতক্ষণ এক কোণায় বসে গায়ের কাঁটা দিয়ে ছেলের গায়ের সোয়েটার বুনছিল, সে হঠাৎ দু’হাত দিয়ে খুচ-খুচ করে নাক ঘসে হাঁচলো— হ্যাঁচচো-হ্যাঁচচো—
     গোষ্ঠমাসী বস্তা ভরে তামাকপাতা এনেছিলেন, সমস্ত বনে তাই ছড়িয়ে তাতে আগুন দিয়েছেন – আর রক্ষে আছে?
   কেটলী সাহেব চারদিকে তাকিয়ে দেখলে সে মুক্ত, সবাই পালাচ্ছে যে যার মত। আর দূরে একটা পাথরের ওপর হিটলারের মত গোফহীন গোষ্ঠমাসী বসে বসে মালা জপ করছেন। আর কুলির দল আনন্দে নাডুগোপালের মত গদ-গদ হয়ে বসে বসে গান ধরেছে— মৌসীকী হিম্মত দেখো—
     কেটলী সাহেব পড়ি কি মরি মাসীর কাছে ছুটে এসে প্রণাম করে বললেন – ধন্যি মেয়ে তুমি মাসী। তোমায় গড় করি।
     হরি — হরি! — মাসী কপালে হরিনামের ঝোলা ঠেকালেন। সেই শুনে কুলির ছুটে এসে গোষ্ঠমাসীকে ঘিরে নাচতে লাগলে – হরিবোল – হরিবোল —
     সাহেব বললেন – হরিবল – গোস্ট আনটি – হিপ – হিপ – হুররে!

ডাউনলোড PDF: ডাউনলোড

      গাড়ির শব্দে বারান্দা থেকে পাতিহাসের মত গলাটা বাড়িয়ে নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে দেকে নিয়েই পিন্ধি চীৎকারে করে উঠল ‘ওমা: পাউরুটি মাসি !!’  ...

      গাড়ির শব্দে বারান্দা থেকে পাতিহাসের মত গলাটা বাড়িয়ে নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে দেকে নিয়েই পিন্ধি চীৎকারে করে উঠল ‘ওমা: পাউরুটি মাসি !!’
      আহ্লাদে পিঙ্কির চুলগুলো সোনালী আর মুখটা রূপোলী হয়ে উঠল। আর এমন দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল যে, নেমেই ধাক্কা নানকুর সঙ্গে। নানকুও উঠছিল কিনা হুড়মুড়িয়ে।
      অন্যদিন হলে অবশ্য এই ধাক্কার ফলে খুনোখুনি হয়ে যেত, কিন্তু আজ নানকু সেদিকে গেল না, চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, পিঙ্কি সববোনাশ! পাউরুটি মাসসি!’
      পাউরুটি মাসি ওদের প্রাণের দেবী, ছুটি ছাটাই যখনই কলকাতায় চলে আসে পাউরুটি মাসি, পিঙ্কি নানকু আহ্লাদের সাগরে ভাসে।
      কারণ?
     কারণ ফুলো ফুলো গোলগাল পাউরুটি মাসির গুণের যে তুলনা নেই! পাউরুটি মাসি গান গায় সুন্দর, কথা বলে মিষ্টি, গল্প বলে অপূর্ব আর সর্বদাই যেন হাসি খুশির খনি।
      তা ছাড়া পাউরুটি মাসি এলে – মা?
      মা তো একেবারে অন্য মানুয!
      সারা বছরে আর কবে মা এমন আহ্লাদের পাহাড়, আর উদারতার অবতার হয়ে ওঠেন?
     পাউরুটি মাসি থাকাকালীন অবস্থায় কত কী-ই না বাগিয়ে নেওয়া যায়। যা চাও — মা স্রেফ কল্পতরু ! হাসবেন আর বলবেন, “দেখছিস তো পাউরুটি, কি রকম চাঁদচাওয়া আবদার আমার ছেলেমেয়ের! ধরেছ যখন তোমরা ছাড়বে না জানি। এই নাও টাকা!’
      অথচ অন্য সময় ?
      অন্য সময় রেগে গেলে বলবেন, চাঁদচাওয়া আবদার, ছেলেমেয়ের! টাকা যেন গাছে ফলে!”
      মানে?
    মানে হচ্ছে, মা অর্থাৎ পাউরুটি মাসির রাঙাদি, চান তাদের দুই মাসতুতো বোনের অনর্গল গল্পের মধ্যে কোনো ব্যাঘাত এসে না নাক গলায়! অতএব পিঙ্কি নানকু জিনিস চাইলে জিনিস, পড়ায় ছুটি চাইলে ছুটি, যা খুশি করতে চাইলে যা খুশির অনুমতি।
      এই পাউরুটি মাসির আবির্ভাবে সববোনাশ! 
      পিঙ্কির সোনালী-হয়ে-ওঠা চুল কালো হয়ে গেল, সজারুর কাটার মত খাড়া হয়ে উঠল। পিঙ্কি দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ পাকিয়ে বললো, সববোনাশ মানে কী রে দাদা? 
      সববোনাশ মানে সববোনাশ! মানে আজই এক্ষুণি পটকাকাকু আসছে! 
      সিঁড়িতে বসে পড়ে পিঙ্কিও বলল, সববোনাশ! 
     পটকাকাকুও ওদের প্রাণের ঠাকুর, তার সরু লম্বা খটখটে হাড়ে হাজার ভেলকি। পটকাকাকু ঘড়ি গুড়িয়ে আস্ত করা, নোট উড়িয়ে ঘুড়িধরা, ইত্যাদি করে একশো রকম ম্যাজিক জানে, পটকাকাকু পঞ্চাশ প্রাণীর ডাক ডাকতে পারে, আর স্বৰ্গ মৰ্ত্ত পাতাল তিন ভূবনের খবর নির্ভুল বলতে পারে। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান তিনকালেরও পারে। তাছাড়া পটুক কাকু এলেই তো বাবা করুণাপারাবার, মহতের অবতার!
      নিজে ডেকে ডেকে বলবেন,‘পিঙ্কি নানকু তোমরা আজ কোন দিকে বেড়াতে চেতে চাও বল। আমি গাড়ি রেখে যাচ্ছি। আচ্ছা পটকাকেই বোলো তার যেদিকে ইচ্ছে! পেট্রলের টাকা রেখে গেলাম রে পটকা, বেশ পেটঠেশে তেল ভরে নিবি।”
      এই পেটঠাশার ব্যাপারের লক্ষ্যটা যে বাবার পিসতুতো ভাই পটকা, পিঙ্কি নানকু উপলক্ষ্য মাত্র, তা কি আর বোঝে না ওরা? কিন্তু বুঝে ক্ষতি কি? ওদের তো হু হু করা বাতাস চোখে মুখে লাগিয়ে মাইলের পর মাইল গাড়ি চড়ার সুখটা জোটে।
      আবার নিজেও পটকা কাকু কম নাকি?
      পটকা কাকু মানেই সার্কাস, সিনেমা, খেলাদেখা, ইত্যাদি কের রাজ্যির আমোদ।
      আর পটকা-কাকুর অনারে রান্নাঘরে রোজ উৎসব। অথচ পিঙ্কি বলল, পটকা-কাকু? সববোনাশ! 
      মানে কি? 
     মানে তাহলে খুলেই বলতে হয়। মানে হচ্ছে পাউরুটি মাসি যেমন মার প্রাণের পুতুল, পটকা কাকু তেমনি বাবার প্রাণের মাণিক! কাজেই পাউরুটি মাসি এলে মার মনে হয় তেমন যত্ন হচ্ছে না, বাবা মোটেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর পটকা কাকু এলেই বাবার মনে হয় তেমন যত্ন হচ্ছে না, মা মোটেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
      অতএব? 
      অতএব ওঁদের কেউ একজন এলেই বাবাতে আর মা-তে রোজ ধুন্ধুমার বাধে। 
    পাউরুটি মাসি এক মাস থাকলে বাবা যদি উনত্রিশ দিন গাড়ি দান করেও একটা দিন বিশেষ কাজে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান, মা আক্ষেপ করে বলেন, এবারে আর পাউরুটিকে নিয়ে বেড়ানোই হল না! অথচ কত জায়গায় নিয়ে যাব ভেবেছিলাম —
      আর পটকা কাকু দু’মাস থাকলে মা যদি উনষাট দিন ভোজপর্ব চালিয়ে একটা দিনও শুধু সাধাসিধে ডাল ভাত রাঁধেন, বাবা মনঃক্ষুন্ন হয়ে বলেন, এবার আর পটকাকে তেমন জুৎ করে খাওয়ান হল না। অথচ পটকা খেতেটেতে ভালবাসে—
      কথাটা অবিশ্যি সত্যি।
      পিঙ্কি নানকু জানে সে কথা। বরং তারা অবাক হয়ে গবেষণা করে— পটকা কাকুর ওই সরু লম্বা দেহটার মধ্যে এত খাবার-দাবার ঢোকে কোথায়, আশ্রয় নেয় কোথায়! কুড়িটা লুচি, বারোটা ফ্রাই, ষোলটা চপ, এক সের মাংস, গোটা আষ্টেক রাজভোগ, বড় একবাটি পায়েস এক সঙ্গে পেটের মধ্যে চালান করে দিয়েও, পটকা কাকু যখন দাঁড়িয়ে ওঠে, দেখতে পাওয়া যাবে যেখানকার পেট সেখানে !
      সেই পেটে পিঠে এক, হাড় আর চামড়া।
      এত মাল যায় কোথায়?
      ভেবেছে ওরা অনেক দিন। সারা গায়ে ছড়িয়ে গেলেও তো গায়ে একটু মাংস লাগবে?
      পিঙ্কির বাবাও সেই কথাই বলেন, যত্নআত্তি পেলে তো গায়ে একটু মাংস লাগতো! বারো মাস মেসে পড়ে থাকে যত্ন পায় না! নিজের বোনটি যখন আসে, তখন তো বেশ তিনদিনের পাঁউরুটিকে ফুলিয়ে তুলোর গাঁট করে তুলতে পারে।
      ব্যস !
      বুঝতেই পারছো?
     আর মার রাগ হবারই কথা। পাউরুটি মাসি কোনোদিন তিনটের বেশি লুচি খেতে পারেন নি, আধখানা ছাড়া একখানা চপ খায় না, আর মিষ্টি? সে তো দেখলেই চোখ বোজে !
      তবে বাবা বিশ্বাস করেন না। বাবা বলেন, হুঁ ৷ হলেই হল! তা হলে বলতে হবে গ্যাসবেলুনের মত বাতাস পাম্প করা হয় ওকে!
      কাজেই – নারদ! নারদ !
      কিন্তু সে তো এক একজনের জন্যে ।
     এক সঙ্গে দু’জন হলে কী হবে, বা হতে পারে, অথবা হওয়া সম্ভব, তা আন্দাজ করতে না পেরে ওরা দুজনেই বলে, সববোনাশ!
      তারপর অবশ্য ছুটে বাইরে বেরিয়ে যায় দুজনেই কারণ আর একটা গাড়ির শব্দ হয়ে গেছে ততক্ষণে।
      বাবা চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ি ঢোকেন, এই শুনছো, পটকু এসেছে। ইস, কতদিন পরে যে এলি পটকু !
      মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই চেঁচিয়ে ওঠেন ও মা পাউরুটি তুই? ওরে বাবারে কী মজারে! উঃ কত দিন যে দেখিনি তোকে পাউরুটি!"
      পাউরুটি মাসি আর পটকাকাবু দুজনেই একসঙ্গে মাকে আর বাবাবে প্রণাম করেন, কিন্তু ততক্ষণে তো শুরু হয়ে গেছে ধুন্ধুমার।
      ‘পাউরুটির দিকে তুমি তাকালে না যে বড়?’, মা বললেন রেগে রেগে। 
      বাবাও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, তুমিও পটকার দিকে তাকাওনি ! ও বেচারী বারোমাস হোস্টেলে পড়ে থাকে। এতদিন পরে দিদির কাছে এল, ওর দিকে আগে তাকাব না ?
      সারাক্ষণ তো তুমি এখন ভাইকে নিয়েই মত্ত থাকবে, আমার বোনটার যত্ন হচ্ছে কিনা, বেড়াতে পাচ্ছে কিনা, সিনেমা দেখল কিনা, এসব খোজই করবে না !
      তুমিও সারাক্ষণ বোন নিয়ে মত্ত থাকবে, আমার ভাইটা খেতে পেল কিনা, শুতে পেল কিনা, তার জামা কাপড় শুকোলো কিনা খোঁজই করবে না !
      তা মত্ত থাকবো না? জানো পাউরুটি আমার থেকে দশ বছরের ছোট ছোট্টবোনটি! 
      তা মত্ত থাকবার রাইট আমারও আছে, পটকাও আমার থেকে বারো বছরের ছোট ছোট্ট ভাইটি!
      আহা! আহা! কত যে আদরের ও আমার ! 
      দু'জনেই নিশ্বাস ফেললেন। 
      সেই অবসরে পটকা কাকু বলে উঠলো, সুটকেশটা কোথায় রাখবো বৌদি? 
     আর পাউরুটি মাসি বলে উঠল, ট্যাক্সিড্রাইভার কত নিল জামাইবাৰু? 
     পিঙ্কিদের মা এবার যাট্‌ যাট করে ছুটে এলেন, ওমা তুমি নিজে সুটকেশটা বইছো পটকা ঠাকুরপো! ছি ছি, রাখো রাখো ওইখানেই রাখো।'
      নানকুদের বাবা বলে উঠলেন, আহা আহা তোকে আর ট্যাক্সিভাড়া নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না পাউরুটি, থাম! চুপ কর!
      তখনকার মত অবশ্য কিঞ্চিত সন্ধি হল। কারণ মা ওদের জন্যে চা জলখাবার আনতে গেলেন, আর বাবা ওদের জন্যে চাকরকে বকবকি করতে গেলেন।
      কিন্তু সে আর কতটুকু? সন্ধি তো এক্ষুণি বিচ্ছেদ হয়ে যাবে, জানা কথা! নানকু আর পিঙ্কির দিকে এতক্ষণে তাকালো পাউরুটি মাসি! হেসে ফেলে বললো, জামাইবাবু কী ঝগড়াটে !
      পটকাকাকুও এতক্ষণ পরে তাকালো ওদের দিকে হেসে বললো, বৌদি কী রাগী!
      তারপর নিজেরা তাকিয়ে বললো, আমাদের নিয়ে তাহলে এখন নারদ নারদ চলবে কি বল? :
      তা চললোই। 
      উঠতে বসতে খেতে বেড়াতে বাবা বলছেন, পটকার কথা তুমি ভাবছই না! আর মা বলছেন. পাউরুটির কথা তুমি মনের কোণেও আনছো না!
      বাবা যদি গাড়ি রেখে যান, মা বলেন নির্ঘাৎ ভাইয়ের জন্যে রেখে গেছেন, তোমাদের আর চড়ে কাজ নেই পাউরুটি!
      যদি গাড়ি নিয়ে যান, মা বলে বেড়ান, নিৰ্ঘাং পাউরুটির জন্যে ! পাছে আমি ওকে নিয়ে একটু বেড়াতে যাই!
     মা যেদিন রান্না ঘরে ভাল ভাল সব আইটেম করেন, বাবা তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে বলেন, বুঝতে পেরেছি নিজের বোনের জন্যে! তা নইলে এত ভাল-মন্দের ব্যবস্থা ! যেদিন একটু ঝাড়া ঝাপটা রাঁধেন, বাবা ঘাড় নেড়ে বলেন, বুঝতে বাকি নেই, আমার ভাইয়ের জন্যে! পাছে সে একটু খায় দায়—
    অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই দু’জনে ক্ষমা চেয়ে নেন পটকা ঠাকুরপো, তুমি কিছু মনে কোরনা ভাই, তোমার দাদার একচোখেনি দোষেই মন্দ হচ্ছি আমি !
       পাঁউরুটি খাই তুই কিছু মনে করিস না, তোর দিদির একচোখোমির দোষেই অভদ্র হতে হচ্ছে আমায়।
       ব্যস আবার লেগে গেল তুলোরাম খেলারাম! 
      কিন্তু এদিকে পিঙ্কি আর নানাকুর এবারের পুজোর ছুটিটাই গুবলেট ! ওরা না পাচ্ছে পটকাকাকুর কাছে পড়ে থাকতে, না পাচ্ছে পাউরুটি মাসির কাছেই বসে থাকতে। পাউরুটি মাসির স্কুলের ছাত্রীরা যে কী বেদম রামবোকা, এ গল্পতো কোনোই হল না। এবার আর পটকাকার কলেজের ছাত্ররা যে কি সাংঘাতিক বিচ্ছু চালাক, সে গল্পও কোনোই হল না। এবার আর পটকাকার কলেজের ছাত্ররা যে কি সাংঘাতিক বিচ্ছু চালাক, সে গল্পও থলে চাপা।
      এদিকে পাউরুটি মাসি ডেকে ডেকে বলে, এবার আর তোরা গল্প শুনতে আসিস না কেন রে পিঙ্কি নানকু? কাকা এসেছে বলে বুঝি সাপের পা দেখেছিস ; মাসিকে আর চিনতেই পারছিস না?
      অতএব এসে এসে পড়তে হয় ওদের। পটকা কাকুর যে নতুন মাজিক দেখাবে বলেছিল, যাওয়া হয় না সেদিকে।
      ওদিকে পটকাকাকু ডেকে ডেকে বলে এবার বুঝি মাসিকে পেয়ে দিনে তারা দেখেছিস তোরা? কাকুকে আর চিনতেই পাচ্ছিস না!
      কাজে কাজেই এসে বসে পড়তে হয় ওদের। অথচ ম্যাজিকে মন বসে না। ওদিকে ভূতের গল্প পড়ে আছে। কাজেই কেবলই মনে হয় কী যেন হারাচ্ছি, কী যেন হারাচ্ছি!
      পাউরুটি মাসি বলে তোমার ছেলে মেয়ে এবার বদলে গেছে রাঙাদি । সে জেল্লা নেই, সে হাসি নেই।
      পটকাকাকুর বলে তোমার ছেলে মেয়ে এবার বদলে গেছে নতুনদা, সে উৎসাহ নেই, সে স্ফূর্তি নেই।
      পিঙ্কি আর নানকু মনের দুঃখে মনে মনে বলে, তোমরাই করেছ এটি। তোমরাই ঘুচিয়েছ আমাদের জেল্লা, হাস, স্ফূর্তি, উৎসাহ! না বলে কয়ে একই ছুটিতে দু’জন এসে ইহকাল পরকাল খেয়েছ আমাদের!
      এর একটা প্রতিকার করতে হবে। বলল পিঙ্কি।
     নানকু হতাশ গলায় বলল, এবারে আর উপায় কোথা : ছুটিতো শেষ হয়ে এল! দু’জনকেই এবার মা সত্যপীরের দিব্যি দিয়ে পায়ে ধরতে হবে, যেন আর কিবনে নোটিশে দু’জনে একদিনে এসে হাজির না হয় !
      পিঙ্কি আরো হতাশ গলায় বলে, সে তো পরে! এবারে আর তাহলে কোনো আশাই নেই?
      না !
      বেশ চল, তবে বলিগে । পটকাকাকু যদি পুজোর ছুটিতে, তো পাউরুটি মাসি গরমের ছুটিতে আর পাউরুটির মাসি যদি পুজোর ছুটিতে তো পটকাকাকু গরমের ছুটিতে! তিনসত্যি করিয়ে নিইগে।
      হঠাৎ চমকে ওঠে নানকু, তা হলে তো এটাও করা যেত যে পিঙ্কি, দুপুরে যদি পাঁউরুটির মাসির গল্প, তো সন্ধ্যের পটকাকুর, আর পটকাকুর যদি--
      আহা ভারী তো বললি, পিঙ্কি ঝামরে ওঠে দুজনকেই যে আমাদের সকাল সন্ধ্যে দুপুর সর্বদা পেতে ইচ্ছে করে!
      তা হলে?
      তা হলে একটা কাজ করলে হয়—
      কি হয় তা আর শোনা হল না নানকুর।
      শুনতে পেল শুরু হয়ে গেছে ওদিকনে নারদ নারদ ।
      মা বলছেন, তুমিই বল পটকা ঠাকুরপো, তোমাকে আমি অগ্রাহ্য করছি? অবহেলা করছি? খুব সুবিধে দেখছি না?
      বাবা বলছেন, তুইই একবার বল পাঁউরুটি আমি তোকে অগ্রাহ্য করি, অবহেলা করি? কষ্ট আকষ্ট দেখিনা ।
      কে কি বলত কে জানে, মা বলে উঠলেন, আগে পটকা ঠাকুরপো বলবে!
      বাবা বলে উঠলেন, আগে পাউরুটি বলবে!
      না, আগে পটকা ঠাকুরপো –
      না, আগে ঠাকুরপো –
      কক্ষণো না! আগে ঠাকুরপো –
      আলবাৎ না, আগে পাউরুটি ---
      আগে পট –
       আগে পাঁউ —
      ভাল হবে না বাপু —
      ভাল হবে না বলছি –
      হঠাৎ পাঁউরুটি মাসি আর পটকা কাকু দুজনেই ওঁদের রাঙাদি আর নতুনদা, বৌদি আর জামাই বাবুর গলার ওপরে গলা চড়িয়ে উদাত্ত স্বরে বলে ওঠেন, নতুনদা তোমাদের এই ঝগড়া কস্মিনকালেও থামবে বলে মনে হয় না। তার কারণ ঝগড়াতেই তোমাদের আহ্লাদ, ঝগড়াতেই তোমাদের ক্ষিদে বৃদ্ধি। কিন্তু যেহেতু আমরা দু’জনেই এই ঝগড়ার উপলক্ষ্য তখন তোমরা যতই আমাদের লজ্জিত হতে বারণ করো, হবোই লজ্জিত ! হচ্ছিও। অতএব—
      পাঁউরুটি মাসির মিহি গলা আর এককাঠি চড়লো, অতএব আমরাই এটা মিটিয়ে ফেলবার ব্যবস্থা করবো ঠিক করেছি। আর বেশি দেরীও করবো না। সামনের এই পূর্ণিমাতেই –
      পিঙ্কি চুপিচুপি বলে, পূর্ণিমার দিন ঝগড়া থামলে, আর কখনো বুঝি ঝগড়া হয় না দাদা?
      নিশ্চয়ই! তাও জানিসনে বোকা? নানকু ও চুপিচুপি বলে, পূর্ণিমা মানে তো পুরোপুরি? তার মানেই পুরোপুরি মিটে যাবে!
      কিন্তু পিঙ্কির বাবাও পিঙ্কির মতই বোকাটে গলায় বলে ওঠেন ঝগড়া থামানোর জন্যে আবার দিনস্থির করতে হয়? তা তো জানিনা। পূর্ণিমার দিন বুঝি —
      হ্যাঁ শুভদিন — পটকা কাকু লজ্জা লজ্জা গলায় বলে ওঠে, ওই দিনটাই আমরা বিয়ের জন্যে ঠিক করেছি!
      মা চেঁচিয়ে ওঠেন, বিয়ের ঠিক করেছ? কার বিয়ের দিন ঠিক করেছ?
    পাঁউরুটি মাসি অাঁচলটা টেনে মুখ ঢাকে, আর পটকা কাকু রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলে, এই আমার আর পাউরুটির?
      অ্যাঁ।
      অ্যাঁ।
      সত্যি।
      সত্যি। -
      কি আর করা। এ ছাড়া তো তোমাদের ঝগড়া থামাবার উপায় দেখছি না –
      মা পটকা কাকুকে কথা শেষ করতে দেন না, বিষম উল্লাসে বলে ওঠেন, আমার বোনের বিয়েতে বেশি ঘটা করতে হবে তা বলে দিচ্ছি?
      বাবা প্রবল প্রতাপে বলে ওঠেন আমার ভাইয়ের বিয়েতে এক ইঞ্চি কম হবে না তা বলে দিচ্ছি!
       তোমার শাসন চলবে না –
      তোমার আবদার কমাতে হবে –
      সব মার্কেটিং আমি করবো – 
      তার মানে নিজের বোনের কোলে ঝোল টানবে —
      ওরা আর শোনে না!
      ওরা কে ঘরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে।
      একই দুঃখে দুঃখী দুই ভাইবোন! 
      নানকু একসময় নিশ্বাস ফেলে বলে, ও সব পূর্ণিমা ফুর্ণিমা বাজে! প্রেম চিরকাল চলবে! ...... তার মানে প্রতিকারের কোনো আশা নেই। তার মানে এরপর থেকে সব ছুটিই শুবলেট যখনি আসবে, দুজনে একই সঙ্গে আসবে।
      দাদা!
      পিঙ্কি ডুকরে উঠে বলে, তা হলে কী হবে? 
      হবে আবার কী! কিছু হবে না। সববোনাশের পর নতুন আর কিছু হয় নাকি।

ডাউনলোড PDF : ডাউনলোড

     এক ছিল রাজা আর তার ছিল এক মস্ত বড়ো দেশ। তার নাম হল কানকাটার দেশ। সেই দেশের সকলেরই কান কাটা। হাতি, ঘোড়া, ছাগল, গরু, মেয়ে, পুরুষ, গরিব...

     এক ছিল রাজা আর তার ছিল এক মস্ত বড়ো দেশ। তার নাম হল কানকাটার দেশ। সেই দেশের সকলেরই কান কাটা। হাতি, ঘোড়া, ছাগল, গরু, মেয়ে, পুরুষ, গরিব, বড়োমানুয সকলেরই কান কাটা। বড়োলোকদের এক কান, মেয়েদের এক কানের আধখানা, আর যত জীবজন্তু গরিব দুঃখীদের দুটি কানই কাটা থাকত। সে দেশে এমন কেউ ছিল না যার মাথায় দুটি আস্ত কান, কেবল সেই কানকাটা দেশের রাজার মাথায় একজোড়া আস্ত কান ছিল। আর সকলেই কেউ লম্বা চুল দিয়ে, কেউ চাপ দাড়ি দিয়ে, কেউ বা বিশ গজ মলমলের পাগড়ি দিয়ে কাটা কান ঢেকে রাখত, কিন্তু সেই রাজা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে সেই ন্যাড়া মাথায় জরির তাজ চাপিয়ে গজমোতির বীরবৌলিতে দুখানা কান সাজিয়ে সোনার রাজসিংহাসনে বসে থাকতেন।
     একদিন সেই রাজা এক-কান মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কানকাটা ঘোড়ায় চেপে শিকারে বার হলেন। শিকার আর কিছুই নয়, কেবল জন্তু জানোয়ারের কান কাটা। রাজ্যের বাইরে এক বন ছিল, সেই বনে কানকাটা দেশের রাজা আর এক-কান মন্ত্রী কান শিকার করে বেড়াতে লাগলেন। এমনি শিকার করতে করতে বেলা যখন অনেক হল, সূর্যদেব মাথার উপর উঠলেন, তখন রাজা আর মন্ত্রী একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঘোড়া বেঁধে শুকনো কাঠে আগুন করে যত জীবজন্তুর শিকার করা কান রাঁধতে লাগলেন। মন্ত্রী রাঁধতে লাগলেন আর রাজা খেতে লাগলেন, মন্ত্রীকেও দু-একটা দিতে থাকলেন। এমনি করে দুজনে খাওয়া শেষ করে সেই গাছের তলায় শুয়ে আরাম করছেন, রাজার চোখ বুজে এসেছে, মন্ত্রীর বেশ নাক ডাকছে এমন সময় একটা বীর হনুমান সেই গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে রাজাকে বললে, — রাজা তুই বড়ো দুষ্ট্র, সকলের কান কেটে বেড়াস, আজ সকালে আমার কান কেটেছিস ; তার শাস্তি ভোগ কর। এই বলে রাজার দুই গালে চড় মেরে একটা কান ছিড়ে দিয়ে চলে গেল। রাজা যন্ত্রনায় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ পরে যখন জ্ঞান হল, তখন রাজা চারদিক চেয়ে দেখলেন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, হুনুমানটা কোথাও নেই, মন্ত্রীবর পড়ে পড়ে নাক ডাকাচ্ছেন। রাজার এমনি রাগ হল যে তখনি মন্ত্রীর বাকি কানটা এক টানে ছিড়ে দেন; কিন্তু অমনি নিজের কানের কথা মনে পড়ল, রাজা দেখলেন, ছেঁড়া কানটি ধূলায় পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি সেটিকে তুলে নিয়ে সযত্নে পাতায় মুড়ে পকেটে রেখে তাজ টুপির সোনার জরির ঝালর কাটা কানের উপর হেলিয়ে দিলেন যাতে কেউ কান দেখতে না পায়, তারপর মন্ত্রীর পেটে গুতো মেরে বললেন, – ঘোড়া আন। এক গুতোয় মন্ত্রীর নাক ডাকা হঠাৎ বন্ধ হল, আর এক গুতোয় মন্ত্রী লাফিয়ে উঠে রাজার সামনে ঘোড়া হাজির করলেন। রাজা কোন কথা না বলে একটি লাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে একদম ঘোড়া ছূটিয়ে রাজবাড়িতে হাজির। সেখানে তাড়াতাড়ি সহিসের হাতে ঘোড়া দিয়েই একেবারে শয়ন-ঘরে খিল দিয়ে পালঙ্কে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
     সকাল হয়ে গেল, রাজবাড়ির সকলের ঘুম ভাঙল, রাজা তখনও ঘুমিয়ে আছেন। রাজার নিয়ম ছিল রাজা ঘুমিয়ে থাকতেন, আর নাপিত এসে দাঁড়ি কমিয়ে দিত, সেই নিয়ম মত সকাল বেলা নাপিত এসে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলে। এক গাল কামিয়ে যেই আর এক গাল কামাতে যাবে এমন সময় রাজা ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে জেগে উঠলেন। নজর পড়ল নাপিতের দিকে, দেখলেন নাপিত ক্ষুর হাতে হাঁ করে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ কানে হাত দিয়ে দেখলেন কান নেই। রাজা আপসোসে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে নাপিতের হাতে ধরে বললেন, — নাপিত ভায়া এ কথা প্রকাশ কর না। তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব। নাপিত বললে, কার মাথায় কটা কান যে এ কথা প্রকাশ করব। শুনে রাজা খুশি হলেন। নাপিতের কাছে আর-আধখানা দাড়ি কামিয়ে তাকে দু-হাতে দু-মুঠো মোহর দিয়ে বিদায় করলেন। নাপিত মোহর নিয়ে বিদায় হল বটে কিন্তু তার মন সেই কাটা কানের দিকে পড়ে রইল। কাজে কর্মে ঘুমিয়ে জেগে কী লোকের দাড়ি কাটবার সময়, কী সকালম কী সন্ধ্যা মনে হতে লাগল – রাজার কান কাটা, রাজার কান কাটা ; কিন্তু কারুর কাছে এ কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না – মাথা কাটা যাবে। নাপিত জাত সহজে একটু বেশী কথা কয়, কিন্তু পাছে অন্য কথার সঙ্গে কানের কথা বেরিয়ে পড়ে সেই ভয়ে তার মুখ একেবারে বন্ধ হল। কথা কইতে না পেয়ে পেট ফুলে তার প্রাণ যায় আর কি।
     এমন সময় একদিন রাজা নাপিতের কাছে দাড়ি কামিয়ে সোনার কৌটো খুলে কাটা কানটি নেড়ে চেড়ে দেখছেন, আর অমনি কোত্থেকে একটা কাক ফস্‌ করে এসে ছোঁ মেরে রাজার হাত থেকে কানটি নিয়ে উড়ে পালাল। রাজা বললেন – হাঁ হাঁ হাঁ ধরো কাক কান নিয়ে গেল!! রাজা মাথা ঘুরে সেইখানে বসে পড়লেন। ভাবতে লাগলেন, প্রজাদের কাছে কী করে মুখ দেখাব।
     এদিকে নাপিত ক্ষুর ভাঁড় ফেলে দৌড়। পড়ে-তা-মরে এমন দৌড়। শহরের লোক বলতে লাগল – নাপিত ভায়া নাপিত ভায়া হল কী? পাগলের মতো ছুটছ কেন?
     নাপিত না রাম না গঙ্গা কাকের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে একেবারে অজগর বনে গিয়ে হাজির। কাকটা একটা অশ্বখ গাছে বসে আবার উড়ে চলল, কিন্তু নাপিত আর এক পা চলতে পারল না, সেই অশ্বখ গাছের তলায় বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল, আর ভাবতে লাগল — ‘এখন কী করি? রাজার কান কাটা ছিল, অনেক কষ্টে সে কথা চেপে রেখেছিলুম ; এখন সেই কান কাকে নিলে এ কথাও যদি আবার চাপতে হয় তাহলে আমার দফা একদম রফা! ফোলা পেট এবারে ফেটে যাবে, এখন করি কী? নাপিত এই কথা ভাবছে এমন সময় গাছ বললে – ‘নাপিত ভায়া ভাবছ কী?
     নাপিত বলল, — ‘রাজার কথা।’
     গাছ বলল – ‘সে কমন?”
     তখন নাপিত চারিদিকে চেয়ে চুপিচুপি বললে –
‘রাজার কান কাটা। 
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’ 
     এই কথা বলতেই নাপিতের ফোলা পেট একেবারে কমে আগেকার মতো হয়ে গেল, বেচারা বড়োই আরাম পেল, এক আরামের নিঃশ্বাস ফেলে মনের ফুর্তিতে রাজবাড়িতে ফিরে চলল।.
     নাপিত চলে গেলে বিদেশী এক ঢুলি সেই গাছের তলায় এল। এসে দেখলে গাছটা যেন আস্তে দুলছে, তার সমস্ত পাতা থারথার করে কাঁপছে, সমস্ত ডাল মড়মড় করছে আর মাঝে মাঝে বলছে— --
‘রাজার কান কাটা। 
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’ 
     ঢুলি ভাবলে এ তো বড়ো মজার গাছ! এরই কাঠ দিয়ে একটা ঢোল তৈরি করি। এই বলে একখানা কুডুল নিয়ে সেই গাছ কাটতে আরম্ভ করলে।
     গাছ বললে – চুলি, ঢুলি আমায় কাটিসনে! 
     —আর কাটিসনে! এক-দুই-তিন কোপে একটা ডাল কেটে নিয়ে ঢোল তৈরি করে—‘রাজার কান কাটা, তাই নিলে কাক ব্যাটা’ বাজাতে বাজাতে ঢুলি কানকাটা শহরের দিকে চলে গেল।
     এদিকে কানকাটা শহরে রাজা কান হারিয়ে মলিন মুখে বসে আছেন আর নাপিতকে বলছেন – নাপিত ভায়া এ কথা যেন প্রকাশ না হয়!’ নাপিত বলছে – মহারাজ কার মাথায় দুটো কান যে এ কথা প্রকাশ করবে! এমন সময় রাস্তায় ঢোল বেজে উঠল –
‘রাজার কান কাটা। 
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’ 
     রাজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে নাপিতের চুলের মুঠি এক হাতে আর অন্য হাতে খাপ-খোলা তরোয়াল ধরে বললেন– তবে রে পাজি! তুই নাকি এ কথা প্রকাশ করিসনি? শোন দেখি ঢোলে কী বাজছে? নাপিত শুনলে ঢোলে বাজছে—
‘রাজার কানা কাটা 
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’ 
নাপিত কঁদিতে কঁদিতে বললে— দোহাই মহারাজ, এ কথা আমি কাউকে বলিনি, কেবল বনের ভিতর গাছকে বলেছি। তানইলে হুজুর পেটটা ফেটে মরে যেতুম!আর আমি মরে গেলে আপনার দাড়ি কে কমিয়ে দিত বলুন?’
     রাজা বললেন— চল ব্যাটা গাছের কাছে বলে নাপিতকে নিয়ে রাজা মুড়িসুড়ি দিয়ে গাছের কাছে গেলেন। নাপিত বললে— ‘গাছ আমি তোমায় কী বলেছি? সত্য কথা বলবে।’
     গাছ বললে –
‘রাজার কান কাটা। 
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’ 
     রাজা বললেন – আর কারো কাছে নাপিত বলেছে কি?’ 
     গাছ বললে – না।’
     রাজা বললেন – তবে ঢুলি জানলে কেমন করে?
  গাছ বললে – ‘আমার ডাল কেটে ঢুলি ঢোল করেছে। তাই ঢোল বাজছে – ‘রাজার কান কাটা। আমি তাকে অনেকবার ডাল কাটতে বারণ করেছিলাম কিন্তু সে শোনেনি।’
     রাজা বললেন – ‘গাছ, এ দোষ তোমার ; আমি তোমায় কেটে উনুনে পোড়াব।' 
    গাছ বললে – ‘মহারাজ, এমন কাজ কর না। সেই চুলি আমার ডাল কেটেছে, আমি তাকে শাস্তি দেব। তুমি কাল সকালে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এস।”
     রাজা বললেন – ‘আমার কাটা কানের কথা প্রকাশ হল তার উপায় ? প্রজারা যে আমার রাজত্ব কেড়ে নেবে।’
     গাছ বলে – ‘সে ভয় নেই, আমি কাল তোমার কাটা কান জোড়া দেব। শুনে রাজা খুশি হয়ে রাজ্যে ফিরলেন।
     রাজা ফিরে আসতেই রাজার রানী, রাজার মন্ত্রী, রাজার যত প্রজা রাজাকে ঘিরে বললে – ‘রাজামশাই তোমার কান দেখি।’ রাজা দেখালেন – এক কান কাটা। তখন কেউ বললে, – ‘ছি ছি', কেউ বললে – ‘হায় হায়’। কেউ বললে, — ‘এমন রাজার প্ৰজা হব না। তখন রাজা বললেন, "বাছারা কাল আমার কাটা-কান জোড়া যাবে, তোমরা এখন সেই ঢুলিকে বন্দী কর। কাল সকালে তাকে নিয়ে বনে যে অশ্বখ গাছে তারই তলায় যেও। রাজার কথা শুনে প্রজারা সেই ঢুলিকে বন্দী করবার জন্যে ছুটল।
     তার পরদিন সকালে রাজা মন্ত্রী নাপিত, রাজ্যের প্রজা আর সেই চুলিকে নিয়ে ধুমধাম করে সেই অশ্বত্থতলায় হাজির হলেন। রাজা বললেন,‘অশ্বত্থ ঠাকুর ঢুলির বিচার কর।’
     অশ্বত্থ ঠাকুর নাপিতকে বললেন— নাপিত, ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দাও। নাপিত ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দিল। চারদিকে ঢাক-ঢোল বেজে উঠল, রাজার কান জোড়া লেগে গেল। এমন সময় যে হনুমান রাজার কান ছিঁড়েছিল সে এসে বললে— অশ্বথ ঠাকুর, বিচার কর— রাজামশায় আমার কান কেটেছে, আমার কান চাই।’
     অশ্বখ বললে, – রাজা ঢুলির অন্য কান কেটে হনুকে দাও। এক কান কাটা থাকলে বেচারির বড়ো অসুবিধা হত— দেশের বাইরে দিয়ে যেতে হত। এইবার ঢুলির দু-কান কাটা হল— সে এখন দেশের ভিতর দিয়ে যেতে পারবে।’
     রাজা এক কোপে ঢুলির আর-এক কান কেটে হনুর কানে জুড়ে দিলেন— আবার ঢাক-ঢোল বেজে উঠল। তখন অশ্বথ ঠাকুর বললে, — ঢুলি এইবার ঢোল বাজা। ঢুলি লজ্জায় ঘাড় হেট করে ঢোল বাজাতে লাগল— ঢোল বাজছে—
ঢুলির কান কাটা। 
ঢুলির কান কাটা। 
     রাজা ফুল-চন্দনে অশ্বত্থ ঠাকুরের পুজো দিয়ে ঘরে ফিরলেন। রানী রাজার কান দেখে বললেন— ‘একটি কান কিন্তু কালো হল।'
     রাজা বললেন-— তা হোক, কাটা কানের থেকে কালো কান ভালো। নেই মামার চেয়ে কানা-মামা ভালো।’