Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

ভুতের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবারের বারবেলায় বেরুতে অনেকেই বারণ করেছিল। কিন্তু সকলের কথা অগ্রাহ্য করে বড়বাজার থেকে কেনাকাটা সেরে যখন শিয়ালদা স্টেশনে পৌছলাম তখন আর ম...

শনিবারের বারবেলায় বেরুতে অনেকেই বারণ করেছিল। কিন্তু সকলের কথা অগ্রাহ্য করে বড়বাজার থেকে কেনাকাটা সেরে যখন শিয়ালদা স্টেশনে পৌছলাম তখন আর মাত্র পাঁচ-সাত মিঃ বাকি আছে গাড়ি ছাড়তে। তাই তাড়াতাড়ি বোলপুরের একটি টিকিট কিনে দৌড়লাম, সেখানে গয়া প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে আছে। কুলি দুজন সব মালপত্র বাঙ্কের উপর গুছিয়ে রেখে তাদের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে চলে গেল। ট্রেন ধরার তাগিদে খেয়ালই হয়নি। যখন খেয়াল হল তখন ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা দিয়ে দিয়েছে। একটা বড় বগীতে একমাত্র যাত্রী বলতে আমিই। মনটা খারাপ হয়ে গেল— যখন মনে হল চুরি, রাহাজানি ও ছিনতাইয়ের জন্য এই গাড়িটার যথেষ্ট নামডাক আছে। একটা মাত্র আলো শিবরাত্রির সলতের মতন জ্বলছে। সারা বগীটার মধ্যে যেন একটা আলো-আঁধারির খেলা চলছে। নিজেকে কি রকম যেন অসহায় মনে হতে লাগল। দুর্গা নাম স্মরণ করে, সাহসে ভর দিয়ে দরজার ছিটকিনিগুলো লাগিয়ে দিয়ে এবং মালপত্রগুলো গোছগাছ করে বসে পড়লাম। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। চিন্তা করছিলাম ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর কথা, এখন তারা কি করছে? আর এইসব ঝামেলা আমার মাথার উপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য মনে মনে স্ত্রীকে খুব গালিগালাজ করছিলাম। আমি যেখানটায় বসেছিলাম সেখান থেকে ওপাশের বাথরুমটা পরিষ্কারই দেখা যায়। একমনে চিন্তা করছি, ঠিক সেই সময় বোলপুরের কিঙ্করবাবু বাথরুম থেকে হাসতে হাসতে আমারই সামনে বসে পড়লেন। কিঙ্করবাবুকে দেখামাত্র কেমন যেন হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ, তবে এই চলতি গাড়িতে এলেন কেমন করে? এইসব যখন চিন্তা করছি কিঙ্করবাবুই তার সমাধান করে দিলেন। বললেন—ভায়ার কি শ্বশুরালয়ে যাওয়া হচ্ছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি? আর জিজ্ঞাসা করতে হল না। উনিই বললেন–জানি ভায়া তোমার মনের মধ্যে এই প্রশ্নটাই তোলপাড় করে তুলেছে। আরে ভায়া তুমি আসবার একটু আগেই বাথরুমে গিয়েছিলাম। ক’দিন ধরে পেটটা বড় গোলমাল শুরু করেছে। তা তোমাকে দেখতে পাব আমিও আশা করিনি। যাক ভালোই হয়েছে ভায়া তোমাকে পেয়ে, বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে কি বলো?

যুক্তিটা মনে মনে মেনে নিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম—তা আপনি হঠাৎ এ সময়ে এখানে? আপনি তো কোথাও বড় একটা বার হন না শুনেছি।

আর বলো কেন ভায়া, আত্মীয়স্বজনে ভরতি বাড়ি, যেন গমগম করছে, তা সত্ত্বেও বড় বৌমার জন্য মনটা খারাপ হওয়ায় বাধ্য হয়েই সবাইকে রেখে বেলা ২টার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি বৌমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। শিবপুরে এসে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হব হব। এসেই শুনি বৌমার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে ঠিক বেলা ২টার সময়। তাই আর দেরি না করে, এই রাত্রের ট্রেনে যাওয়াই স্থির করে সেই শুভ সংবাদ বয়ে নিয়ে চলেছি। তুমি তো জানো বড় ভাগ্নের বিয়ে আমি নিজে দেখে দিয়েছি। বড় বৌমা আমার ঘরের লক্ষ্মী। আমি কি না এসে থাকতে পারি?

এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে একটা বিড়ি ধরিয়ে চুপচাপ টানতে লাগলেন। আজ যেন কিঙ্করবাবুকে কেমন কেমন মনে হতে লাগল। দেখে মনে হয় ওঁর যথাসর্বস্ব কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। চুলগুলো কেমন এলোমেলো, চোখ দুটো যেন কোটরের মধ্যে ঢুকে আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে, গলার স্বরটাও যেন ক্ষীণ শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে বহু দূর থেকে কে যেন কথা বলছে। সে চেহারায়ও যেন সেই সুন্দরতা আর নেই। মনে হয় সারা শরীর কে ঝলসে দিয়েছে। কাপড়টা ছেঁড়া, এক পা ধুলো ভরতি। আজকের কিঙ্করবাবু আর সেদিনের কিঙ্করবাবু আকাশপাতাল তফাৎ। অথচ বোলপুরে একে চেনে না এমন লোক বোধহয় খুব কমই আছে। বিরাট অবস্থা, নিজের ছেলেমেয়ে বলতে কেউ নেই। ঐ ভাগ্নে দুজনকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেছেন, তাদের বিয়ে-থা দিয়েছেন, এখন তারাই এনার সব। তারাই এনার ব্যবসাপত্তর, জমিজমা, সব দেখাশুনা করে। শখের মধ্যে যার দু’বেলা ইন্ত্রি করা জামাকাপড় না হলে চলে না সে কিনা এই ছেঁড়া পোশাকে আমারই সামনে এই অবস্থায় ট্রেনে যাচ্ছে! কিন্তু কেন?

হঠাৎই কিঙ্করবাবু বললেন—ভায়া তো অনেক রকম বাজার করেছ দেখছি, তা গীতার বিয়ে তাহলে বেশ ভালোভাবেই হচ্ছে?

বললাম—সবই আপনাদের আশীর্বাদ।

আমাদের আশীৰ্বাদ সব সময়ই আছে ভায়া। তা ছেলেটি বেশ ভালোই, যেমন সুন্দর চেহারা তেমনি সুন্দর মন। সর্বদাই হাসিখুশি। জান ভায়া একবার জিগ্যেস করেছিলাম—হ্যাঁরে, বিয়েতে কি কি পাচ্ছিস? তাতে কি বললে জানো। কি হবে ঐ সামান্য যৌতুক নিয়ে। যাকে নিয়ে সারাজীবন ঘর করতে হবে তার মধ্যে ঐ সামান্য যৌতুক যে সব সময় মনে করিয়ে দেবে নিজের অক্ষমতা। তাই তো বলে দিয়েছি আমার কোনো দাবিই নেই। ভাব তো—এই রকম চিন্তা যদি সব ছেলেদের মধ্যে থাকত, তাহলে আর মেয়ের বাপেরা সর্বস্বাস্ত হত না। লোভকে কতখানি দমন করতে পারলে, এই ধরনের কথা বলা যায়। তাই তো আশীৰ্বাদ করছি ভায়া ওদের বিয়ে সার্থক হোক, ওরা সুখী হোক। প্রসঙ্গটা পালটে হঠাৎ বলে উঠলেন—ভায়া, আমার এই ঘড়িটা ও টাকাগুলো তোমার ঐ তরকারির বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখো তো। শুনেছি এই ট্রেনটা ভালো না। একটা কাগজে মুড়ে গোটা কতক টাকা ও ঘড়িটা আমার হাতে দিলেন।

যুক্তিটা ভালোই মনে করে আমিও আমার ঘড়ি, আংটি ও কিছু টাকা একটা রুমালে বেঁধে তরকারির বস্তার মাঝামাঝি জায়গায় রেখে দিলাম। কিঙ্করবাবুর উপস্থিতিটা আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল, তাই বার বার বগীটার ওপাশে গিয়ে ধূমপান করতে হচ্ছিল। কিঙ্করবাবু বোধহয় আমার মনের কথাটা টের পেয়েছিলেন, তাই একটা বিড়ি বাড়িয়ে ধরলেন আমার সামনে। আমি ইতস্তত করছি দেখে, হাসতে হাসতে বললেন—ভায়া ছেলেরা বড় হলে তাকে ঠিক বন্ধুর মতন করে নিতে হয়। এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই, অসঙ্কোচে ধরিয়ে ফেল।

আমিও আর দ্বিরুক্তি না করে বিড়িটার সৎগতি করলাম। কিঙ্করবাবু চোখ বুজে বিড়ি টেনে চলেছেন দেখে আমিও জানলার বাহিরে দূরে বহু দূরে ঘুমন্ত গ্রামগুলির দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাই কোনো এক অজানা স্বপ্নপুরীর উদ্দেশ্যে। তাকিয়ে থাকি জ্যোৎস্নায় স্নাত মাঠ, ঘাট, বন, প্রান্তরের দিকে। সম্ভবত আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমার পূর্ণ আলোয় সারা পৃথিবী যেন অবগাহন স্নান করছে। ঠিক যেন একটা স্বপ্নলোকের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের যন্ত্রদানবটা। দানবটার গর্জনে আকাশবাতাস কেঁপে উঠছে। সেই ভয়ে শিশুরা সব মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে। গাছগুলোও সব ভয়ে পিছন দিকে ছুটে পালাচ্ছে। তারই মধ্যে দিয়ে দানবটা গর্জন করতে করতে ছুটে চলেছে সামনের দিকে। আরও একজন সমান তালে ছুটে চলেছে তার হাসিমুখ নিয়ে। দেখে মনে হয় দুজনেরই চলার শেষ নেই।—হঠাৎ কল্পলোক থেকে ফিরে এলাম পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বিকট আর এক দানবের গর্জনের আওয়াজে। ঘুরে দেখি—কিঙ্করবাবু চোখ দুটো খোলা রেখে, মুখটা হা করে ঘুমুচ্ছেন। যেন একটা মরা মানুষকে কেউ বসিয়ে রেখে দিয়েছে। বগীর ভেতর অল্প আলোয় কিঙ্করবাবুর মুখটা দেখে বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। রাত এগারোটা হবে, এইবার গাড়ি ব্যান্ডেলে পৌছবে। নানান ধরনের চিন্তার মধ্যে দিয়ে এক সময় খেয়াল হল গাড়ি প্লাটফর্মে ঢুকছে—কিঙ্করবাবু সেইভাবেই ঘুমিয়ে আছেন। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একটা চা-ওয়ালাকে ডেকে দুভাঁড় চা নিয়ে কিঙ্করবাবুকে ডেকে তুললাম। চা খেতে খেতে দুজনে গল্প করতে থাকি। এক সময় কিঙ্করবাবুই বললেন—ভায়া এবার তুমি একটু গড়াগড়ি দিয়ে নাও। আমি তো অনেকক্ষণ ঘুমোলাম।

সুযোগ পেয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু তন্দ্রার মতন এসেছিল হঠাৎ একটা চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি কিঙ্করবাবু নেই। বুকটার মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল। উঠে গিয়ে দেখি কিঙ্করবাবু দরজাটা খুলে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছেন পেছন দিকে। হয়তো আমারই পায়ের শব্দ শুনে আস্তে আস্তে ঘুরে নিজের সিটের দিকে চলে গেলেন। কিছু কথা জিগ্যেস করবার সাহস হল না। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আমি আমার জায়গায় এসে বসলাম।

এই কিঙ্করবাবুর সঙ্গে আমার বছর খানেক দেখা-সাক্ষাৎ নেই। প্রায় এক বছর পর আমি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। তবে আগে যতবার গেছি এর সঙ্গে দেখা না করে আসিনি। এনার অমায়িক ব্যবহার যেন বার বার হাতছানি দিয়ে ডাকে। কিন্তু আজ কেবলই মনে হচ্ছে এই কিঙ্করবাবুর মধ্যে কোথায় যেন একটা বিরাট তফাৎ উঁকি মারছে।

শক্তিগড় বহুক্ষণ পার হয়ে এসেছি। বর্ধমান আসতে আর বেশি দেরি নেই, তাই আর না ঘুমিয়ে জেগে বসে রইলাম। ওদিকে কিঙ্করবাবুও চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছেন। রাত্রি এখন প্রায় দুটো হবে, ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়াতে শীত শীত করছে।

এক সময় বর্ধমানে গাড়ি থামতে কিঙ্করবাবু উঠে পড়লেন। বললেন—একটু বোস ভায়া আমি আসছি, বলেই এমন করে চলে গেলেন মনে হল যেন হাওয়ায় মিশে গেলেন। তার ঠিক একটু পরেই একজন চেকার গাড়িতে উঠলেন টিকিট চেক করতে। আমাকে একা দেখে বেশ আশ্চর্য হয়েই প্রশ্ন করলেন।—এত বড় কামরায় এত মাল নিয়ে এই রাত্রের গাড়িতে যাওয়া মোটেই উচিত হয়নি আপনার। একটু আগেই শক্তিগড়ের কাছে একজন নামকরা গুন্ডা গাড়ি থেকে পড়ে মারা গেছে। এই বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন এবং যাবার সময় সাবধানে থাকতে বলে গেলেন আমাকে। ভদ্রলোকের কথা শুনে চিন্তার ঝড় বয়ে চলে মনের মধ্যে—শক্তিগড়ের কাছাকাছিই তো কিঙ্করবাবু দরজা খুলে বাইরে কি যেন দেখছিলেন, একটা চিৎকারেই তো আমার ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। তবে কি…

আর চিন্তা করতে পারলাম না। কিন্তু একি! গাড়ি তো চলতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ, কিঙ্করবাবু কোথায়? একটা অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর দুরদুর করতে লাগল। জানলা থেকে, পেছনে ফেলে আসা অন্ধকারে আচ্ছন্ন প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে কিঙ্করবাবুকে খোঁজবার চেষ্টা করছি। এমন সময় একখানা হাত আমার কাঁধের উপর পড়ায় আঁতকে উঠে ফিরেই দেখি, বিরাট এক ঠোঙা খাবার হাতে নিয়ে কিঙ্করবাবু সেই প্রাণ কাঁপানো হাসি হেসে চলেছেন। আমার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই অকস্মাৎ বলে উঠলেন—দরজায় দাঁড়িয়ে চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখছিলাম, তাই খেয়ালই ছিল না তোমার কথা। এস খাওয়া যাক, ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে, বলে নিজেই দুটো জায়গা করে খাবার ভাগ করলেন। খাবারের পরিমাণ দেখে আমার চোখ তো ছানাবড়া—এত খাবার জীবনে কোনোদিনই খাইনি, বিশেষ করে মিষ্টি তো খেতেই পারি না। তাই ওরই মধ্যে সামান্য কিছু নিয়ে বাকিটা কিঙ্করবাবুর পাতে তুলে দিই। তাই দেখে কিঙ্করবাবুর হাসি আর ধরে না, বললেন—ভায়া তোমাদের বয়সে আমরা কবজি ডুবিয়ে খেতাম আর পাহাড় ভেঙে বেড়াতাম। আর তোমরা?— মানে আজকের এই যুবসম্প্রদায় সে তুলনায় খেতেই পারো না। অবশ্য এর জন্য তোমাদেরই বা দায়ী করি কি করে। দেশের এমনই সমাজ-ব্যবস্থা, যার ফলে এই সম্প্রদায় না খেতে পেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে দেশলাইয়ের কাঠির মতন হয়ে উঠেছে। জান, আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে ঐ শুকিয়ে যাওয়া কাঠিগুলোর মাথায় এমন একটা বারুদের খোল দিয়ে ঘষা দিতাম যার ফলে সব কাঠিগুলো একসঙ্গে জ্বলে উঠত—আর সেই আগুনে সব জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে আসল সোনার রং ধরিয়ে দিতাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।—তাই তো বলি ভায়া, কবজি ডুবিয়ে খাবে, পাহাড় ভেঙে বেড়াবে, আর মনকে করবে নির্ভীক। দেখবে সেখানে থাকবে না কোনো ভয়। নাও নাও আরম্ভ কর.....।

খাওয়ার শেষে ওয়াটার বোতল থেকে খানিকটা করে দুজনে জল খেয়ে, একটা সিগারেট ধরালাম। কিঙ্করবাবু নিজে একটা বিড়ি ধরিয়ে চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে রইলেন। সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।—হঠাৎ কিঙ্করবাবুর ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসি।—অজয় নদী পার হচ্ছে ভায়া, মালপত্তর সব ঠিক করে নাও। বাইরে চাঁদের আলোটা কেমন যেন একটা ঘুমন্ত স্বপ্নপুরির মতন দেখাচ্ছিল। আস্তে আস্তে প্লাটফর্মে গাড়িটা দাঁড়াতে, কিঙ্করবাবু আর আমি মালপত্তর সব ধরাধরি করে প্লাটফর্মের একটা গাছতলায় জড়ো করে রাখলাম।—ঠান্ডাটাও বেশ পড়েছে, হিমশীতল জ্যোৎস্না আলোকিত প্লাটফর্মে আমরাই মাত্র দুজন যাত্রী। একজন স্বপ্নলোকের মধ্যে আকুলিবিকুলি হয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে, তার ঐ চাহনির মধ্যে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ভায়া কি এই রাত্রেই বাড়ি যাবে, না বাকি রাতটুকু এইখানে কাটিয়ে ভোরবেলায় যাবে?

তাইতো ভাবছি, আর মাত্র ঘণ্টা দুই রাত আছে, এত মালপত্তর নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?

তাহলে এক কাজ করো, এসো ভায়া, বাকি রাতটুকু দুজনে গল্প করে কাটিয়ে দিই।

অগত্যা দুজনে গাছতলার বাধানো জায়গায় বসে পড়লাম। চারিদিকে নিস্তব্ধ। দূরের লাইটগুলো যেন এক একটা প্রদীপের মতন টিমটিম করে জ্বলছে। চাঁদের আলোটা অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। লাইনের ওপাশে দুটো কুকুরের মারামারির চিৎকার ভেসে আসছে দূর থেকে। এক সময় কিঙ্করবাবু উঠে চলে গেলেন বুকিং অফিসের দিকে।

একা একা বসে আছি আর ভাবছি...আজ থেকে ১৫ বছর আগে ঠিক এমনি একটা রাত, সেদিনও সম্ভবত আকাশে এই জ্যোৎস্নাই মুখরিত করে দিয়েছিল। তবে সেদিন সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রী। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের তীর্থভূমির সঙ্গে, লালমাটির এই দেশ আম্রকুঞ্জের ছায়ায় স্থাপিত শান্তিনিকেতনের সঙ্গে। আজ তার কত পরিবর্তন। হঠাৎ চমক ভাঙল একটা মালগাড়ির আওয়াজে। তারই পিছনের লাল আলোটা ধীরে ধীরে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল কোন এক নামনা-জানা দেশের উদ্দেশ্যে। ফিরে দেখি, একজন পাহারাদার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

বাবুসাহাব কি কলকাত্তাসে আসলেন? কোথা যাবেন?

যাব শুড়িপাড়ায়। শ্বশুরমশায়ের নাম বলাতে বুঝলাম শ্বশুরমশাইকে চেনে।

হাসতে হাসতে পাহারাদার বলল—আরে উনকে তো হামি বহুত চিনে। পরশুরোজ উনকা ছোট লেড়কির সাদি আছে, হামার ভি নিমন্ত্রণ আছে। তা হাপনি বুঝি উসব বাজার করিয়ে আনলেন। আচ্ছা বাবুজি হামি চল্লো, পরশুরোজ ফিন দেখা হোবে।

চলে গেল একটা দেশওয়ালি সুর ভাজতে ভাজতে। কিঙ্করবাবু দুভাঁড় চা নিয়ে হাজির। ভোর ৩ ৪টার সময় চা কোথায় পেলেন চিন্তা করছি। এমন সময় উনিই হাসতে হাসতে বললেন—একজনকে ডেকে তুলে চা করিয়ে নিয়ে আসতে হল।

চা খেতে খেতে গল্প করছি। এক সময় বললাম—আপনি বরং বাড়ি চলে যান। মিছিমিছি আমার জন্য এই ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছেন।

হাসতে হাসতে কিঙ্করবাবু বললেন—বুঝলে ভায়া সবই মায়া, আর এই মায়া আছে বলেই মানুষ বারবার পৃথিবীতে জন্ম নেয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে তাই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে থাকতে চায়। অহেতুক উতলা হয়ো না, একসঙ্গেই যাওয়া যাবে।

অগত্যা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। এক সময় পূর্ব গগনে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা ধীরে ধীরে তার মিষ্টি আলোর ধারা ছড়িয়ে দিতে লাগল এই মর্ত্যের পৃথিবীতে। হঠাৎ কিঙ্করবাবু কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। দুটো বিড়ি বার করে, একটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন—ভায়া, একটু বসো, আমি ঐ মাঠটা দিয়ে ঘুরে আসি একবার। বলে, উত্তর দিকের মাঠটায় আলো-আঁধারির মধ্যে মিশে গেলেন।

আলোর রেখাটা ধীরে ধীরে বড় থেকে বড় হয়ে ভরিয়ে তুলেছে আলোর বন্যায়। সেই আলোর পরশে পাখিরা সব গান ধরেছে, দিনমণির আগমনের অপেক্ষায়। দু’একজন করে লোক চলতে শুরু করেছে, কিন্তু কিঙ্করবাবুর আর আসার নাম নেই! যেন হারিয়ে গেছে লোকটা। অনেকক্ষণ বসে আছি, চলে যাব কিনা ভাবছি এমন সময় আমারই বড় শালা শুড়িপাড়া থেকে বেরিয়ে লাইন পার হয়ে দোকান খোলার উদ্দেশ্যে এদিকেই আসছে। আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে প্রশ্ন করল—কি ব্যাপার এখানে বসে? রিকশা পাননি বুঝি?

বললাম—আরে, না হে। তোমাদের কিঙ্করবাবু আমাকে বসতে বলে, সেই যে গেলেন ঐ মাঠটার দিকে এখনো পর্যন্ত তার ফেরার নাম নেই।

শালাবাবু কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডেকে মালপত্তর তুলে শুড়িপাড়ার দিকে রওনা হল আমাকে নিয়ে। পথে যেতে যেতে যতবারই কিঙ্করবাবুর কথা তুলি, ততবারই অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় শালাবাবু। তবে কি কিঙ্করবাবুদের সঙ্গে এদের কথা বন্ধ নাকি! হয়তো সেই কারণে শুনতে চাইছে না কিঙ্করবাবুর কথা, তাই হয়তো বার বার অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে। মনে মনে বিরক্তি বোধ হতে লাগল বড় শালাটির উপর। রিকশা চৌমাথা হয়ে সোজা উত্তরে উকিলপট্টির দিকে চলতে লাগল। আর সামান্য পথই বাকি আছে।

এক সময়ে শ্বশুরবাড়ির দরজার সামনে এসে রিকশা দাঁড়ায়। আমাকে দেখে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়স্বজন সবাই বেরিয়ে সদরে এল। চেয়ে দেখি, পাশেই কিঙ্করবাবুদের বাড়িটা তখনো ঘুমে অচেতন।

শাশুড়ি ঠাকুরন দাওয়ায় একটা মাদুর পেতে দিলেন। হাত-মুখ ধুয়ে এসে বেশ আরাম করে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছোট শালীটি এককাপ গরম চা এনে দিল এবং বেশ আমেজ করেই খেতে লাগলাম। আদর-আপ্যায়নের বহরে সমস্ত ক্লান্তি যেন সরে যেতে লাগল। হাজার হোক বড় জামাই তো!

আমার মাল নাবাতেই ব্যস্ত, বড় শালাকে দেখেই মনে পড়ে গেল কিঙ্করবাবুর কথা। জিজ্ঞাসা করলাম—হ্যাঁ হে, কিঙ্করবাবু ফিরেছে কিনা একবার খোঁজ নিয়েছ, না, আমার জন্য তিনি আবার স্টেশনে দৌড়োদৌড়ি করছেন? কি ভাববেন ভদ্রলোক! সারারাত একসঙ্গে এলাম, আমাকে কত খাওয়ালেন, আদর-যত্ন করলেন, আর আমি কিনা তাকে রেখেই চলে এলাম! একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে তাকিয়ে দেখি বাড়িসুদ্ধ সবাই হা করে চেয়ে আছে আমার দিকে। ওদের চাউনিতে নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হতে লাগল।

হঠাৎ শাশুড়ি ঠাকুরন প্রশ্ন করলেন—তুমি কার কথা বলছ বাবা? তুমি কি সত্যি বলছ যে, কিঙ্করবাবু গত রাত থেকে তোমার সঙ্গে ছিলেন? বললাম—হ্যাঁ মা, আমি মিথ্যে বলব কেন ব্যস্ আমার উত্তর পেয়েই, এ আমার কি হল রে.....বলে চেঁচিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন শাশুড়ি। সামনে বড় শালাকে দেখে বললেন—ওরে বাবলু, যা তো বাবুর বড় ভাগ্নেকে তাড়াতাড়ি একবার ডেকে আন ।

এবার বিস্ময়ের পালা আমার। মাথাটা কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এদের সব কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে আমি এবার কেঁদে ফেলব। বিস্ময়ের পর বিস্ময়! কিছুক্ষণের মধ্যেই কিঙ্করবাবুর দুই ভাগ্নে আমার সামনে এসে হাজির। তাকে দেখামাত্র শাশুড়ি ঠাকুরন বলতে লাগলেন—বাবা ধীরেন, আমার বড় জামাই তোমার মামার সম্বন্ধে কি বলছে শোন। ছোট শালীটিও দেখি তার মায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সবাই একই সুরে সুর মিলিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। শ্বশুরমশাই মাথায় হাত দিয়ে একপাশে চুপটি করে বসে আছেন। মোটের উপর সবাই অনেকটা তফাতে সরে আমার দিকে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের উপর এই দৃশ্য দেখে কেমন যেন অস্থিরতার মধ্যে ছটফট করতে থাকি। মনে হচ্ছে এবার আমি পাগল হয়ে যাব। এমন সময় ধীরেন আমার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল—কি হয়েছে জামাইবাবু, আমাকে সব খুলে বলুন তো?

ধীরে ধীরে গত রাত্রের সমস্ত ঘটনাগুলো ধীরেনকে বললাম। আর এও বললাম—তোমার মামা

যে আমাকে বললেন গতকাল বেলা দুটার সময় তোমার একটি পুত্রসস্তান হয়েছে। তাছাড়া, আরও বললেন, তার ক্যাশবাক্সের কোন এক গোপন স্থানে রেখেছেন একছড়া সোনার হার হিরের লকেট সমেত তোমার ছেলের অর্থাৎ তার ভাবী নাতির জন্য। লক্ষ করলাম, আমার কথা শেষ হতে না হতে ধীরেনের ছোট ভাই এক দৌড় মারল তাদের বাড়ির দিকে। আমি বলে চললাম—তাছাড়া, এই দেখ না আমার তরকারির বস্তার মধ্যে রাখা তোমার মামার ঘড়ি ও কিছু টাকা—বলে তাড়াতাড়ি সকলের সামনে তরকারির বস্তাটা খুলে ঢেলে ফেললাম। সকলেই অবাক হয়ে আমার কার্যকলাপ দেখছিল। তৎক্ষণাৎ তরকারির ভেতর থেকে রুমালে বাঁধা জিনিসটা টেনে নিয়ে খুলে ফেললাম সকলের সামনে। কিন্তু এ কি? কি করে সম্ভব? আমার জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই দেখে মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। অথচ আমি নিজের হাতে যা বেঁধে রেখেছি তাহলে—। আমার অবস্থা দেখে সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শাশুড়ি ঠাকুরন তো আবার গলা ছেড়ে ভৈরবী রাগে সুর ধরেছেন। অন্যরাও ধরব ধরব করছে। আমার তখন ত্রিশঙ্কুর মতন মনের অবস্থা। ধীরেন অসহায় ভাবে সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করছে।

ঠিক এমন সময় ধীরেনের ছোট ভাই বাইরে থেকে ঐ পরিস্থিতিতে এসে ঢুকল। হাতে তার একছড়া সোনার হার হিরের লকেট সমেত ।

হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে—দাদা, এইমাত্র শিবপুর থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছিল যে, গতকাল দুপুর দুটির সময় তোমার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। এই বলে ধীরেনের ভাই চুপ করে। দেখি ধীরেন অবাক নেত্রে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সকলের মুখের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, এ কোথায় এলাম রে বাবা! আমি পাগল না, এরা সব পাগল! আসল ব্যাপারটা যে কি, বুঝতে না পেরে কাঁদব না হাসব কিছুই ঠিক করতে পাচ্ছি না। এক সময় ধীরেনই সমস্যার সমাধান করে দেয়, বলে—জামাইবাবু, আপনি আমায় যে অবস্থায় দেখছেন, এটা মামার শেষ কাজ আমি করেছি বলে। মামা গতকাল দুপুর দুটায় দেহ রেখেছেন।

ধীরেনের কথা শুনে, সারা শরীরের মধ্যে রক্তের স্রোত যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভয়ে সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ধীরেনের মুখে ঐ একটি কথা শুনে। সকলে মিলে আমাকে ধরে শুইয়ে দিল। কিরকম একটা গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে ছটফট করতে থাকি। তবে কি আমি সব ভুল দেখলাম! কিন্তু তা কি করে সম্ভব!— ঐ লকেট দেওয়া হার? ট্রাঙ্ককলের ঐ বার্তা? সে তো মিথ্যে নয়!

 

অ-      অ+ কথা শুনলে গায়ে জ্বালা ধরে গাঁয়ের লোকের। যত নালিশই আসুক ডলফের নামে, মা তা হেসে উড়িয়ে দেন—ও ছেলে আমার তেমন নয় গো! দুটা...


অ-     অ+

কথা শুনলে গায়ে জ্বালা ধরে গাঁয়ের লোকের।

যত নালিশই আসুক ডলফের নামে, মা তা হেসে উড়িয়ে দেন—ও ছেলে আমার তেমন নয় গো! দুটাে দিন যেতে দাও বাছারা, ওর বুদ্ধিটা একটু পাকুক, তখন দেখো, ও একটা নামকরা মানুষ হবে দেশের মধ্যে। একটু ক্ষ্যামা-ঘেন্না এই কয়টা দিন তোমরা না করলে, আর কে করবে বলো!

বিধবা অনাথা মেয়েমানুষটাকে কী আর বলা যায় মুখের উপর? বেগুন বেচা মুখ করে সবাই চলে যায় হেলিগার গিন্নির সমুখ থেকে। গজগজ করে আড়ালে আড়ালে—‘শাসন নেই, শিক্ষা নেই। বুদ্ধি যখন পাকবে, ও ছেলে হবে ডাকু। এই পনেরো-ষোল বছরেই যা নমুনা ছাড়ছে বাছাধন। কারও বাগানে একটা আপেল পাকবার জো নেই, ও গিয়ে রাতের আঁধারে তা পেড়ে এনেছে। কারও মোরগ উঠোনের বাইরে আসবার জো নেই, ও তাকে ভোগে লাগিয়েছে শিককাবাব করে। বুদ্ধি পাকলে?—হুঁঃ!’

অনাথ হেলিগার গিন্নির মুখ চেয়ে গাঁয়ের লোক বাধ্য হয়েই দস্যি ছেলেটাকে ক্ষ্যামা-ঘেন্না করে। তবে সদাই তারা সচেষ্ট থাকে ওর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে। সদাই চোখ-কান মেলে রাখে, যাতে নিজেদের ছেলেগুলোও উচ্ছন্নে না যায় ওর সঙ্গে মিশে। উপায় কী? সাবধান থাকতেই হবে কয়টা বছর, যতদিন বুদ্ধি না পাকে ডলফের।

সবাই ডলফের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে, কেবল এক বুড়ো গ্রুট ছাড়া। গির্জার চাকরি করে গ্রুট। গাঁয়ে কেউ মরলে গ্রুন্টই তার কবর খোঁড়ে। কাজেই তার একটু আলাদা রকম খাতির আছেই গাঁয়ের ভিতর। সেই খাতিরটুকু সম্বল করে বুড়ো লেগে গেল, কী করে ছেলেটাকে কোনো একটা কাজে ভিড়িয়ে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টায়।

ডাক্তার নিপারসেন হচ্ছেন গাঁয়ের একমাত্র ডাক্তার। ওষুধপত্র তার তত নেই, যত আছে মোটা মোটা ডাক্তারি কেতাব। যখনই কোনো রোগী আসুক, দেখতে পাবে ডাক্তারটি বসে আছেন সেই সব কেতাবেরই কোনো একখানায় তন্ময় হয়ে। রোগী দাঁড়িয়ে বা বসে নিজের ব্যারামের বৃত্তান্ত বলে গেল। ডাক্তারের চোখ কিন্তু বই ছেড়ে রোগীর দিকে একবারও তাকিয়ে দেখল না। বৃত্তান্তটা শেষ হলে একটা হাঁক শোনা গেল—ডাক্তার ডাকছেন তাঁর সহকারীকে, ওষুধ দেবার জন্য।

সহকারী একজন চিরদিনই রাখেন ডাক্তার নিপারসেন। একাধারে সে ছাত্র ও কম্পাউন্ডার। গাঁয়েরই কোনো গরিবের ছেলেকে তিনি বহাল করেন এ কাজে। উদয়াস্ত সে খাটে। বড়ি পাকায়, মলম বানায়, পাঁচমিশেলি ওষুধে জল ঢেলে ঢেলে লাল-নীল-সাদা ওষুধ তৈরি করে হরেক রকম। বিনিময়ে খেতে ও শুতে পায় ডাক্তারের বাড়িতে, আর পায় ভবিষ্যতের জন্য দরাজ প্রতিশ্রুতি—“তোকে আমি পুরোদস্তুর ডাক্তার বানিয়ে দেব। আমি মরলে আমারই জায়গা তুই দখল করতে পারবি এ গাঁয়ে”—ইত্যাদি।

ছাত্র কম্পাউন্ডার এ যাবৎ অনেক এসেছে নিপারসেনের কাছে, কেউ এক বছর কেউ দুই বছরের বেশি টেকেনি। একঘেঁয়েমির জন্যই হোক অথবা পেট ভরে খেতে না পাওয়ার জন্যই হোক, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পাকাপোক্ত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সবাই পালিয়েছে একে একে। গ্রুট শুনতে পেল, আবার কম্পাউন্ডারের সিংহাসন খালি হয়েছে নিপারসেনের ডাক্তারখানায়। সে গিয়ে ধরে পড়ল ডাক্তারকে—

“ডলফ হেলিগারকেই নিতে হবে মশাই! ওর বাবা আমার দোস্ত ছিল। আমার খাতিরে ছেলেটার একটা হিল্লে করে দিন আপনি।”

ডাক্তারের কাজ মানুষকে কবরে পাঠানো, গ্রুটের কাজ মানুষের জন্য কবর খোড়া। কাজেই পরোক্ষভাবে দুজনকে সহকর্মী না বলা যাবে কেন? অন্তত গ্রুট তো নিশ্চয়ই ডাক্তারকে মনে করে সহকর্মী, তা নইলে কিসের জোরে সে খাতির দাবি করে তার কাছে?

সে যাই হোক, খানিকটা গাই-গুঁই করে শেষ পর্যন্ত ডলফকেই চাকরি দিলেন ডাক্তার। পাড়াপড়শি মন খুলে আশীৰ্বাদ করল ডাক্তার আর গ্রুট দুজনকেই।

নিপারসেন ডাক্তারের চাকরি যখন নিয়েছে ডলফ, দিনের বেলাটা অন্তত গাঁয়ের বাড়িগুলো রেহাই পাবে ওর দৌরাত্ম্য থেকে।

আশীৰ্বাদ করলেন হেলিগার গিন্নিও। তার এতকালের আশা বুঝি সফল হবার পথ ধরেছে এইবার। নিপারসেন তো বলেইছেন ডলফকে ডাক্তার করে দেবেন। তা ডাক্তারের চেয়ে মান্যগণ্য লোক আর কে থাকতে পারে পাড়াগাঁ জায়গায় ? তিনি পড়শিদের ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন—“দেখলে তো? আমি বলিনি যে ও একটা নামকরা মানুষ হবে দেশের মধ্যে?”

দিন কাটে। ডলফ নামকরা মানুষ হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। খেটে যাচ্ছে ভূতের মতো। না খেটে উপায় নেই। ডাক্তারটি কড়া মনিব। বড়ি পাকানো, মলম বানানো, পাঁচমিশেলি ওষুধে জল ঢেলে ঢেলে লাল-নীল-সাদা হরেকরকম মিক্‌চার তৈরি করা, এসব ব্যাপারে এক মিনিটের ঢিলেমি দেখলে নিপারসেন গর্জে ওঠেন—“তবেই হয়েছ তুমি ডাক্তার। কাজে ফাঁকি দিতে চাও যদি, বেরিয়ে যাও আমার ডাক্তারখানা থেকে।”

হায়! বেরিয়ে যাওয়ার উপায় যদি থাকত, ডলফ কি এক মিনিট দেরি করত বেরিয়ে যেতে? এ কাজ তার একদম ভালো লাগে না! এ যাবৎ তার দিন কেটেছে মাঠে-ঘাটে দস্যিপনা করে করে। কখনও কোনো পড়শির ঘোড়ার সওয়ার হয়ে দেশবিদেশ ছুটে বেড়াচ্ছে ঝড়ের বেগে, কখনও বা হডসন নদের দুর্বার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে সাঁতার কাটছে এপার-ওপার, আবার এমনও কোনো কোনো দিন ঘটে গিয়েছে যে, কোনো বন্ধুর বাবার বন্দুকটা কোনো ফিকিরে হাতিয়ে নিয়ে সে গিয়ে ডুব মেরেছে গহন অরণ্যে। হরিণ-টরিণ তুচ্ছ প্রাণীর তো কথাই নেই, দুর্দান্ত বাইসন বা জাগুয়ার সামনে পড়লেও সে তার মোকাবিলা করতে ভয় পায়নি সেদিন।

সেই ডলফ কিনা বুক-সমান-উঁচু টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পিল বানাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা? জীবনে ধিক্কার এসে গিয়েছে ওর। কবে সে এ শিক্ষানবিশিতে লাথি মেরে বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়, যদি না তার লজ্জা করত অনাথা মায়ের দুঃখের অন্নে ভাগ বসাবার জন্য সেই মায়েরই কুঁড়েতে ফিরে যেতে।

লজ্জা করবে, পারবে না ডলফ মায়ের মনে কষ্ট দিতে। মা যে দিন গুনছে, কবে ডলফ ডাক্তার হয়ে বেরুবে, কবে সে দশজনের একজন হয়ে মাথা উঁচু করে বেড়াবে এই গ্রামে। ডলফ ভাগ্যকে অভিশাপ দেয়। তবু দিনের পর দিন পিল বানাতেই থাকে নিপারসেনের টেবিলে দাঁড়িয়ে

বললে লোকে হয়তো বিশ্বাস করবে না, এইভাবে চব্বিশ ঘণ্টা নিজেকে শাপান্ত করতে করতেও পরিপূর্ণ চারটি বছর নিপারসেনের ডাক্তারখানায় কাটিয়ে দিল ডলফ হেলিগার। ডাক্তারি সে থোড়াই শিখেছে, ডাক্তার হওয়া তার ভাগ্যে আছে, এমন আশা ভুলক্রমেও সে কখনও করে না।

কুড়ি বছর বয়স হল ডলফের। গাঁট্টা জোয়ান সে এই বয়সেই। আর এই সময়ই ঘটল একটা ঘটনা।

দেদার পয়সা জমিয়েছেন নিপারসেন এই গাঁয়ে ডাক্তারি করে করে। কি কল্প যায় সে পয়সা দিয়ে? গাঁ থেকে মাইল তিন দূরে একটা বাড়ি সস্তায় বিক্রি হচ্ছে শুনে ঝট করে তিনি তা কিনে ফেললেন।

কিনবার পরে তাঁর চক্ষুস্থির। বাড়িটা যে হানাবাড়ি, সে খবর তো তাকে আগে কেউ বলেনি!

নিপারসেনের মতলব ছিল, বাড়িতে আপাতত এক ঘর চাষীকে তিনি বসাবেন। বাড়ির লাগোয়া জমিগুলো আবাদ করবে তারা। আধাআধি বখরা দেবে ফসলের ফি-বছর। কিন্তু দেখ বরাতের ফের, কোনো চাষী ওবাড়িতে বসবাস করতে রাজি হয় না। এমনকি লাঙল নিয়ে ও-বাড়ির জমিতে ঢুকতেও তারা নারাজ। “কাচা মুন্ডুটা যমের হাতে কে তুলে দেবে মশাই?” সাফ জবাব দেয় সবাই।

ডাক্তার যখন বাড়ি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন, ডলফ এল একটা প্রস্তাব নিয়ে—“বলেন যদি, আমি গিয়ে বাড়িটাতে বাস করি কিছুদিন। ভূত আমার করবে কী? আমি ওখানে বাস করেও জ্যান্ত আছি— এটা যখন দেখবে চাষীরা, সাহস পাবে ওদিকে ভিড়তে।”

নিপারসেন তো লুফে নিলেন এ প্রস্তাব। নিজে তিনি যথেষ্ট বিশ্বাস রাখেন যে ভূতেরা ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারে মানুষের। বাড়ি কেনার অর্থটা বিলকুল লোকসান হতে বসেছে দেখেও নিজে গিয়ে ওখানে বাস করার কল্পনা এক মুহুর্তের জন্যও মগজে আসেনি তার। হাজার হোক পয়সা লোকসান হলে তা একদিন কোনো না কোনোভাবে পূরণ হতেও পারে, কিন্তু জান লোকসান হয়ে গেলে তা আর পূরণ হবার ভরসা নেই কোনোদিন। তবে ডলফ যেতে চাইছে, যাক না! হাজার হোক, নিজের জীবনে অন্যের জীবনে বহুৎ ফারাক। হ্যাঁ, যায় যদি তো যাক। কিন্তু ডলফ? সে যেতে চায় কেন? সে কি বিশ্বাস করে না ভূতে?

তা করে। পাড়াগাঁয়ের ছেলে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ভগবানে আর ভূতে সমানভাবেই বিশ্বাস করতে শিখেছে। হ্যাঁ, বিশ্বাস করে, তবে ভয় করে না। করে না এই কারণে যে ভয় বস্তুটাই তার অস্থি-মজ্জায় কোথাও নেই। ভূত আছে, থাকুক, একটা শক্তসমর্থ মানুষের সে কী ক্ষতি করবে? আর বলতে কী, ভূতের অস্তিত্বে ষোল আনা বিশ্বাস আছে বলেই ডলফ যেতে চাইছে হানাবাড়িতে। স্রেফ একঘেঁয়ে জীবনে একটুখানি বৈচিত্র্যের আশায়। পিল পাকিয়ে পাকিয়ে জীবনটাই যে বিস্বাদ লাগছে তার কাছে!

ডাক্তারের কাছে একটি শুধু অনুরোধ রাখল ডলফ তার মায়ের কাছে এ খবর এক্ষুনি যেন না পৌছায়। যাক কিছুদিন। সব লোক যখন জানবে, মাও জানবেন আস্তে আস্তে। গোড়ায় জানতে পারলে মা একটা কান্নাকাটি জুড়ে দেবেন, একটা বিষম বাগড়া পড়ে যাবে ব্যাপারটাতে।

তাই হল। যথাসময়ে একদিন সন্ধ্যার পরে নিঃশব্দে হানাবাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল ডলফ। সঙ্গে গেলেন ডাক্তার নিজে তার রাঁধুনিটিকে নিয়ে। বাড়িটা দেখিয়ে শুনিয়ে দেবার জন্য আর কি! একটা ঘর খুলে ডলফকে তার ভিতর স্থিতু করে দিয়ে ওঁরা দুজন ফিরে আসবেন। ডাক্তারের হাতে লণ্ঠন, রাঁধুনির হাতে একটা মোমবাতি, ডলফের বগলে একখানা কম্বল।

তিন মাইল পথ, এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌছে গেল সবাই। জায়গাটা এমন, দিনের বেলাও একা সেখানে গেলে গা ছমছম করার কথা। চারদিকেই ছোট ছোট পাহাড়। মাঝ বরাবর একটা নিচু উপত্যকায় ঐ একটি মাত্র বাড়ি। যথেষ্ট পুরোনো বটে, তবে ভেঙেচুরে পড়েনি এখনো। আসবাবপত্র অনেকই রয়েছে, তবে সবই কেমন সেকেলে ধরনের। ওলন্দাজেরা যখন উত্তর আমেরিকার এই অঞ্চলটাতে প্রথম আসে উপনিবেশ গড়ে তুলবার জন্য, সেই যুগের।

বলাবাহুল্য ডলফেরাও ওলন্দাজ। এ ফ্যাশানের খাট-বিছানা-টেবিল-চেয়ার গায়ের ধনীদের বাড়িতে সে আগেও দেখেছে। কাজেই এ বাড়ির পরিবেশটা তার ঘরোয়া বলেই মনে হল। সেও একটা স্বস্তি ।

অনেক লম্বা লম্বা বারান্দা পেরিয়ে, অনেক সরু সরু সিঁড়ি মাড়িয়ে ডাক্তার ডলফকে এনে তুললেন একখানা বৃহৎ শয়নকক্ষে! একপাশে বৃহৎ খাট, তাতে ছেঁড়া গদি। অন্যপাশে বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড, তাতে আগুন নেই। কোথা থেকেই বা থাকবে? মাঝখানে একখানা বৃহৎ সোফা, তার উপরে আচ্ছাদনের কোনো বালাই নেই। শক্ত কাঠে ধুলো জমে আছে রাশি রাশি।

ডলফ কম্বল বিছিয়ে ফেলল ছেঁড়া গদির ওপর। রাঁধুনি মোমটা জ্বেলে অগ্নিকুণ্ডের মাথায় বসিয়ে দিল। ডাক্তার বললেন—“দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। কেমন?”

এই বলেই লণ্ঠন এবং রাঁধুনি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। ডলফ ঘরের দরজায় খিল এটে দিল এবং শুয়ে পড়ল হানাবাড়ির ছেঁড়া গদিতে। ভূতের কথাই ভাবছে সে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে সে ভাবনার সঙ্গে ভয়ের সংস্রব আদৌ নেই। যা আছে, তা হল কৌতুহল। গাঁয়ে ঘরে ভূত হচ্ছে একটা পহেলা নম্বরের আলোচ্য বিষয়। যদিও এমন কোনো লোকের সঙ্গে ডলফের আজও পরিচয় ঘটেনি, যে নাকি নিজের চোখে ভূত দেখেছে। আজ যদি ডলফ নিজের চোখে তা দেখতে পায়, সে অবশ্যই নিজের বরাতের প্রশংসা করতে পারবে।

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েই পড়ল ডলফ। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল তার হিসাব কে দেবে? হঠাৎই ভেঙে গেল ঘুম। মোম তখনও জ্বলছে। সেই আলোতে ডলফ দেখল, এসেছে ভূত, সত্যিই এসেছে। ঘরে আর সে একা নয়। দরোজা যদিও আগের মতোই খিল বন্ধ রয়েছে, তবু এক দশাসই লম্বা চওড়া আধবয়সী পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে হাড্ডিসার সোফার উপরে। পোশাক তার পুরোনো কালের ওলন্দাজদের মতোই। লালচে চুল-দাড়ির বেষ্টনীর ভিতরে পাকাটে মুখখানা তার বড়ই যেন বিষণ্ন দেখাচ্ছে।

বেশ মনোযোগ দিয়ে দুজনে দুজনকে দেখছে। ভূত দেখছে ডলফকে, ডলফ দেখছে ভূতকে। ডলফ ভাবছে, ভূতটা যখন এসেইছে, কথা বলে না কেন? কিংবা ভয় দেখাবার মতলবে যদি এসে থাকে, ভেংচি-টেংচি কাটে না কেন? পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল ভূতের তো রক্ত-মাংসের দেহ নেই, যা দেখা যাচ্ছে, তা ছায়া বই আর কিছু নয়। ছায়া কথা কইবে কেমন করে? আর ভেংচি, ভয় দেখাবার জন্য ও হয়তো আসেইনি আদৌ।

তবে ? ওর সঙ্গে আলাপ জমানো যায় কেমন করে ?

খানিকটা ইতস্তত করে বেশ মোলায়েম সুরেই ডলফ বলল—“দেখুন মিস্টার ভূত, আপনি যখন দয়া করে দেখা দিয়েছেন এ অধমকে, তখন অবশ্যই ধরে নিতে পারি যে আমার কাছে কোনো দরকার আছে আপনার। সে দরকারের কথাটা চটপট বলে ফেললে ভালো হয় না কি ? রাত এখনও খানিকটা আছে বোধহয়। আর একটু ঘুমুতে চাই।”

নাঃ, জবাব নেই, মিস্টার ভূতের তরফ থেকে।

অতঃপর কী করা যেতে পারে, তাই ভাবছে ডলফ। এমন সময়ে ভূতটা উঠে দাঁড়াল সোফা ছেড়ে। হেঁটে গেল দুই পা, দরোজার দিকেই গেল। তারপর থামল, আর পিছন ফিরে তাকাল ডলফের দিকে। ডলফ যেন দেখল, ভূতের মাথাটা নড়ছে অল্প অল্প, যেন সে ইশারায় ডাকছে ডলফকে সঙ্গে আসবার জন্য ।

ডলফ উঠে বসল বিছানার উপরে।

ভূত আবার দুই পা হাঁটল, আবার থামল, আবার ইশারা করল তেমনিভাবে।

নিশ্চয়ই ভূত এইটাই চাইছে যে ডলফ অনুসরণ করুক তার?

মতলব কী ভূতটার? ভীষণ কৌতুহল হচ্ছে ডলফের। সে উঠে দাঁড়াল খাট থেকে, দুই পা সেও এগিয়ে গেল ভূতের দিকে। এবারে ভূতের মাথা বেশ জোরে জোরে নড়ছে, বেশ খুশি খুশি ভাব তার।

ভয় ? ডলফ ও চিজটার সঙ্গে পরিচিত নয়। ভূত কেন তাকে সঙ্গে আসতে বলছে, জানবার জন্য দারুণ ব্যস্ত হয়েছে ও।

ভূত দরোজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আবার ইশারা করল ওকে, তারপর কী কাণ্ড! বেমালুম উবে গেল ডলফের চোখের সামনেই। ডলফ চোখ কচলাচ্ছে। সত্যিই উবে গেল নাকি? নাকি চোখের ভুল হচ্ছে ডলফের ?

না, ভুল তার হয়নি। সত্যিই নেই ভূতটা। অর্থাৎ সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ঘরে ঢোকার বেলায়ও বন্ধ দরোজার ভিতর দিয়ে সে ঢুকেছিল। বেরুবার বেলায়ও বন্ধ দরোজা তার গতি রোধ করতে পারেনি। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার আগেও সে তৃতীয়বার ইশারা করে গিয়েছে ডলফকে। ডলফ কি ভয় পাবে তার সঙ্গে যেতে? আরে তাই কখনো হয় নাকি? ভয় ? ছিঃ !

যেহেতু বন্ধ দরোজার ভিতর দিয়ে বেরুনো ডলফের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই সে খুলে ফেলল দরোজাটা। বাঃ! ঐ যে মিস্টার ভূত, ঠিক দুই পা সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন তার প্রতীক্ষায়!

তারপর সরু সরু সিঁড়ি আর লম্বা লম্বা বারান্দা বেয়ে বেয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভূতের অনুসরণ করল ডলফ। অবশেষে ভূত থামল আর একটা দরোজায়। তারপর আবার চট করে উবে গেল ওর সমুখ থেকে।

এবার আর ভেবে দেখবার কিছু নেই, ডলফ দরোজাটা খুলে ফেলল। ঠিক! ঐ তো দাঁড়িয়ে আছে ভূত। ডলফকে দেখেই সে আবার চলতে শুরু করল। এবার আর তারা বাড়ির ভিতরে নেই। খোলা উঠোন, তার পরে খানিকটা মাঠ। অনেক পথ পেরিয়ে বিশাল এক ইঁদারার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ভূত।

ডলফও আছে ভূতের পিছনেই। ভূত আবারও ফিরে তাকাল ডলফের পানে। জোছনায় ঝকঝক করছে চারিধার। ভূতের মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ডলফ। কী করুণ আবেদন বেচারা ভূতের মুখে-চোখে! কিছু একটা সাহায্য যে ডলফের কাছে ও চাইছে, তাতে তো আর কোনো সন্দেহই নেই!

কী সাহায্য হতে পারে সেটা ? হায়, বেচারা ভূত। তার তো কথা কইবার সামর্থ্য নেই!

এইবার আর এক কাণ্ড! ভূতটা ইদারার ভিতরে নেমে যাচ্ছে যে! আরে, কোথায় যায় ও? কোথায় যায় ?

ডলফের দিকেই দুই চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ভূতটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে ইদারায়। এইবার তার কোমরের নীচের সবটা অদৃশ্য হয়ে গেল। এইবার বুক। এইবার কাঁধ—

আর একটা মিনতিভরা ইশারা, তারপর ভূত অদৃশ্য। ভূতটা পাগল নাকি? ওর ঐ শেষ ইশারা শিরোধার্য করে ডলফও ইদারায় নামবে, এরকমটা যদি ও প্রত্যাশা করে থাকে, তবে ডলফ বলবে, ভূতটা নেহাতই ভূত। ওর কোনো আক্কেল নেই। না, নামবে না ডলফ নিশ্চয়ই। তবে ইদারার উপর থেকে ঝুঁকে পড়ে যতটা সম্ভব দেখে নেবে ওর নীচের অবস্থাটা। ভূত কি এখনও নামছে, না উবে গিয়েছে?

উঁচু গাঁথুনি দিয়ে ঘেরা রয়েছে ইঁদারার মুখ। ডলফ এসে সেই গাঁথুনির উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। চাঁদের আলোতে ইঁদারার নীচের দিকটা পরিষ্কার দেকা যাচ্ছে। জল চকচক করছে জ্যোছনায়, তবে বহু বহু নীচে। আর ভূত? বেমালুম হাওয়া! সে ঐ পাতালে ডুব মেরেছে নিস্যস। এই পাতালেই থাকে না কি ও ? অমন ইট-পাথরের মোকাম পছন্দ নয় ওর!

যাক সে কথা, এ রাত্রে ডলফের আর কিছু করবার নেই। সে গুটি গুটি ফিরে গেল বাড়ির ভিতরে, তার শোবার ঘরে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল, যেন সে দড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে ইদারার ভিতরে—যাচ্ছে—যাচ্ছে, একদম পাতালে নেমে যাচ্ছে—

কী যেন একটা কী পাতাল থেকে তুলে আনবার জরুরি তাগিদ রয়েছে তার। না আনলে যেন কিছুতেই চলবে না। জিনিসটা যেন তারই, তার ছাড়া আর কারুর নয় যেন—

তারপর স্বপ্নেই সে আবার দেখল, সেই বিষণ্ন-বদন ভূতটাকে। সে যেন ঠোঁট নাড়ছে, ডলফের কানে যেন ভূতের কথা স্পষ্ট ধরা পড়ছে—“ওটা তোমারই। একটু মেহনত করে তুমি ওটা তুলে আন বাবা! তুমি তো ভীতু নও।”

ঘুম ভাঙলেই ডলফ দেখল, রাত ভোর হয়ে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল বাড়িটা থেকে, লোকজন জেগে ওঠার আগেই নিপারসেনের ডাক্তারখানায় তাকে পৌছোতে হবে। সে যে হানাবাড়িতে রাত্রি যাপন করেছে, এটা আপাতত কাউকে জানানো চলবে না—

“না, কিছু দেখিনি। অঘোরে ঘুমিয়েছি সারা রাত” ডাক্তারের নানা প্রশ্নের জবাবে সাফ জবাব দিয়ে দিচ্ছে ডলফ—“ভূত তো দূরে থাকুক একটা ছারপোকা পর্যন্ত কামড়ায়নি স্যার!”

বরাত ভালো ডলফের, দিনের ভিতর এক সময় গ্রুট এল ডাক্তারের বাড়িতে বেড়াতে। ডলফ কোনোদিন যা করেনি, তাই করল আজ। মুখটা কাঁচুমাচু করে গ্রুটকে বলল—“কাকা, বড্ডো মুশকিলে পড়েছি, কিছু পয়সা আমায় দেবে?”

কোনোদিন যে পয়সা চায়নি, সে আজ চায় কেন ? গ্রুট অবাক। তবু, গ্রুট ভালোবাসে ছেলেটাকে বিমুখ করতে পারল না তাকে। পকেটে যা ছিল, সব ঝেড়ে ডলফকে দিয়ে দিল।

সন্ধ্যা হতে না হতেই ডলফ বেরিয়ে পড়ল একটা মোমবাতি নিয়ে। আজ তো আর পথ দেখাবার জন্য ডাক্তার বা রাঁধুনির যাওয়ার দরকার নেই তার সঙ্গে।

ডলফ বেরুল, কিন্তু সোজাসুজি হানাবাড়ির দিকে না গিয়ে উঠল গিয়ে গায়ের মুদিখানার দোকানটাতে। ওরা গেরস্তালির হরেকরকম জিনিসই মজুদ রাখে সারা বছর। কার কখন কী দরকার হয়ে পড়ে, বলা যায় কী!

আজ ডলফের দরকার কয়েকগাছা মজবুদ দড়ি। ডাক্তারের গরু বাঁধবার দড়িগুলো বিলকুল পচে গিয়েছে। একটা একটা করে ছয়গাছা দড়ি সে বেছে নিল। দাম মিটিয়ে দিল গ্রুটের পয়সা দিয়ে। হানাবাড়িতে পৌছে ডলফের কাজ হল আজ, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়া নয়, ইদারার পাশে বসে খাটো দড়িগুলো জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা পেল্লায় লম্বা দড়ি বানানো। তা ছাড়াও, সেই পেল্লায় লম্বা দড়ির মাঝে মাঝে এক একটা গেরো দেওয়া। নামবার সময় ঐসব গেরোতে হাত রাখা চলবে এক-আধ মিনিটের জন্য, গেরোতে পা বাঁধিয়ে জিরোনোও চলবে দরকার মতো।

ইঁদারা থেকে সামান্য দূরে একটা বাবলা গাছ। কালই তা লক্ষ করেছিল ডলফ। সেই গাছের গুড়িতে শক্ত করে দড়ির এক মাথা বেঁধে ফেলল সে। তারপর দড়ি ঝুলিয়ে দিল ইঁদারার ভিতর। জলের তলাতেও দড়ি নেমে গেল অনেকদূর। এইবার ডলফ জামাকাপড় ছেড়ে রাখল বাবলার তলায়, আর ‘জয় যীশু’ বলে নেমে পড়ল দড়ি ধরে।

শীতের দিন নয়, তবু শীত-শীত করছে বই কি! কেমন যেন শিউরে শিউরে উঠছে দেহের ভিতরে। শীত? না ভয় ? ভয় ? ধুৎ! কিন্তু শীতও না। তবে কী এটা ?

যা খুশি তা হোক, ডলফ সড়সড় করে নামছে। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিচ্ছে দড়ির গিঠ ধরে ধরে, যাতে নতুন দড়ির ঘষায় হাতের চামড়া ছড়ে না যায়। কিন্তু কতক্ষণ আর ? নামতে শুরু করার একটু পরেই ডলফ দেখল সে জল ছুঁয়েছে। যদিও উপর থেকে মনে হয়েছিল, গভীর ইঁদারার তলায় পৌছুতে সময় লাগবে অনেক।

বরাত জোর, কুয়োর জল গরম। যতক্ষণ খুশি ও থাকতে পারবে এ জলে। কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে।

জল গভীরও। দশ-বারো ফুট তো বটেই। ডলফ দড়ি ছেড়ে দিয়ে ডুব দিল জলে। পচা গন্ধ অবশ্য জলটাতে। তা সে তো স্বাভাবিক ! কেউ নাড়ে-চাড়ে না এ-জল!

ডুব। ডুব! ডুবিয়ে হডসনের তলা থেকে মাটি তুলে আনে ডলফ, দশ-বারো ফুট জলের তলায় পৌছে মাটি হাতড়ে দেখা তার পক্ষে শক্ত কত! প্রথমবার গোল-পানা একটা কী পিছল জিনিস হাতে ঠেকতেই সেটা তুলে নিয়ে ভুচ্ করে জলের উপরে ভেসে উঠল ডলফ!

চাঁদের আলোতে জিনিসটা দাঁত বার করে হেসে উঠল ডলফকে দেখে। কী সর্বনাশ! মড়ার মাথা একটা, সাদা হাড় শ্যাওলায় সবুজ হয়ে গিয়েছে এখানে-ওখানে।

এমন চমকে উঠেছিল ডলফ যে মড়ার মাথাটা তার হাত থেকে ফসকে জলে পড়ে গেল আবার। সে ভাবতে লাগল—জলে ভাসতে ভাসতে অনেক কথাই মাথায় আসছে তার।

ভূত মশাইয়ের মতলবখানা এবার যেন বোঝা যাচ্ছে একটু একটু। এইখানে ইদারার জলে পড়ে আছে তার হাড়গোড়গুলো। গির্জার আঙিনায় কবর না পাওয়ার দরুন আত্মা শান্তি পাচ্ছে না তার। ডলফকে ডেকে আনার ভিতরে ভূতের উদ্দেশ্য ছিল এই যে ও তার হাড়গুলোকে তুলে নিয়ে খ্রিস্টধর্মের বিধানমতে কবর দিক।

বড় চাট্টিখানি কথা নয় মিস্টার ভূত! বহুৎ ঝামেলার ব্যাপার ওটা।

তবু, নেমে যখন আসাই গিয়েছে, নিঃসন্দেহ হয়ে নেওয়া ভালো। মাথাটাই ডলফ পেয়েছে এযাবৎ। ধড়টাও এখানেই আছে তো? এমন যদি হয় যে ধড়টা এখানে নেই। শুধু কাটা মুণ্ডুটাই পড়ে আছে। তাহলে ডলফ এক্ষুনি সেটাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। লুকিয়ে রাখতে পারে অন্য কোথাও দুইএকদিন, তারপর গ্রুটকে খোশামোদে রাজি করিয়ে গির্জার হাতায় একটা গর্ত করে—

সে পরের কথা। আগে জানা দরকার সত্যিকার অবস্থাটা। ডলফ আবার ডুব দিল। যাচ্চলে! একটা আংটার ভিতর হাত ঢুকে গেল ডলফের। কিসের আংটা হতে পারে? বালতির কড়ার? সিন্দুকের ডালার ?

না, সিন্দুক নয়, জিনিসটা হালকা। অনায়াসে এক হাতেই ওটা উঁচু করে তুলে ফেলল ডলফ। জলের উপরে ভেসে উঠে দেখল, একটা বালতির মতোই বস্তু, মাঝারি আকারের। কী থাকতে পারে এতে? বালতির মুখে একখানা থালা চাপা দেওয়া রয়েছে, সরু তার দিয়ে তা আবার বালতির সঙ্গে মজবুদ করে বাঁধা।

কী থাকতে পারে এর ভিতর ? বালতিটা দড়ির শেষ মাথায় বেঁধে ফেলল ডলফ, ওঠার সময় উপরে নিয়ে যাবে। তারপরে হাড়গোড়ের সন্ধানে আবার দিল ডুব। উঠল বই কি! বড়-ছোট নানা আকারের হাড়ের টুকরো উঠতে লাগল একটার পরে একটা। মানুষটাকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ইদারায় ফেলে দিয়েছিল কোনো ডাকুর দল। কী জন্য ? ঐ বালতিটার জন্যই কি?

হাড়গুলো আপাতত থাকুক। বালতিটা নিয়ে যাওয়া যাক। রহস্যের সমাধান হয়তো ওরই ভিতরে আছে।

ডলফ আগে নিজে উপরে উঠল দড়ি বেয়ে। তারপরে বালতিসুদ্ধ দড়িটাও তুলল টেনে। প্রথম কাজ জামাকাপড় পরে নেওয়া, তারপর বালতি আর দড়ি নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়া। সেখানে দরোজা বন্ধ করে বালতি খুলে দেখা—

খুলে যখন দেখল, ডলফের চক্ষুস্থির। এক বালতি মোহর বালতির ভিতর। আর একটা পিতলের মজবুদ কৌটো, সেটা খুলতে রীতিমতো বেগ পেতে হল ডলফকে। এমন ভাবে তা বন্ধ করা, যাতে জল ঢুকতে না পারে কৌটোতে।

তবু অনেক চেষ্টায় তা খুলে ফেলল ডলফ। আর কিছু নয়, একখানা চিঠি। ওলন্দাজ ভাষায় তাতে লেখা—

নদীর চড়ায় বালি ধুয়ে ধুয়ে সোনার কণা বার করেছি, প্রায় কুড়ি বছর ধরে। তারপর শহরে গিয়ে বেচলাম সেই সোনার কণাগুলি। মন্দ দাম হল না। তারপর শুরু করলাম লগনির ব্যবসা, চড়া সুদে। বছর দশেক রইলাম সে ব্যবসা নিয়ে। তারপর বাড়ির জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠল, ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে এক বালতি মোহর কিনে ফেললাম সর্বস্বের বিনিময়ে।

“বাড়ি এসে দেখি আপনার জন সব মরে গিয়েছে, তবে একটা ছোট বোন নাকি বেঁচে আছে হডসনের কূলে ক্যাটস্কিল পাহাড়ের আনাচে-কানাচে কোনো এক জায়গায়। তার স্বামীর নাম গুস্টেড হেলিগার—”

এই পর্যন্ত পড়েই চমকে আঁতকে একেবারে লাফিয়ে উঠল ডলফ। গুস্টেড হেলিগার তো তারই বাবার নাম! এ চিঠি যার লেখা, সে তা হলে সাক্ষাৎ মামা ডলফের ? হ্যাঁ, মনে পড়ছে তো! তার মা তো মাঝে মাঝেই তার এক নিরুদ্দেশ মামার গল্প করে থাকে। কী নাম ভালো? স্পিগেল! ফিলিয়ান ভ্যান্ডার ম্পিগেল!

চিঠির নীচেও এই যে নাম সই রয়েছে ‘ফিলিয়ান ভ্যান্ডার স্পিগেল’ !

নিজের উত্তেজনা নিজেই কোনোরকমে শান্ত করল ডলফ। তারপরে পড়ে ফেলল চিঠির বাকি অংশটা। খুঁজতে খুঁজতে স্পিগেল এই বাড়ি পর্যন্ত এসে পড়েছিল। হঠাৎ ঝড়-বাদলা শুরু হল বলে আশ্রয় নিল এই বাড়িতেই রাতটার জন্য। কিন্তু তাইতেই হল সর্বনাশ। মালিকেরা কেউ উপস্থিত ছিল না এখানে, ছিল একপাল চাকর-বাকর। তারা কেমন করে যেন টের পেয়ে গেল যে বালতিতে সোনা ভর্তি।

আর তারা যে টের পেয়েছে, তা বুঝতেও পারল স্পিগেল। তার মনে নিশ্চিত ধারণা হল যে রাতের ভিতরেই তাকে খুন করে ঐ চাকরেরা তার সোনা লুঠ করবে।

“কী করব? কেমন করে রক্ষা পাব এ সংকটে?”—এই ভাবতে ভাবতে ম্পিগেল লিখে ফেলেছিল এই চিঠিটা। “কেমন করে রক্ষা পাব”—এই কথাতেই চিঠি শেষ ।

না, রক্ষা সে পায়নি।

চিঠি লেখার পরের ঘটনাগুলো ডলফ অনুমান করেই নিল। চিঠি কৌটোয় বন্ধ করে বালতিতে রেখে সেই তুমুল ঝড়-বাদলায় বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে হয়তো বেরিয়ে পড়েছিল মামা। চাকরগুলোও হয়তো সঙ্গে সঙ্গে ধাওয়া করেছিল পিছনে। পালাবার মুখে বালতিটা লুকিয়ে ফেলবার জন্যই হয়তো বেশি ব্যস্ত হয়েছিল স্পিগেল। তাই ইঁদারাটা দেখতে পেয়ে ওটা ফেলে দিয়েছিল তারই ভিতরে। তারপরে চাকরগুলোও হয়তো তাকে ধরে ফেলেছিল, আর মোহর না পাওয়ার দরুন রাগের মাথায় স্পিগেলকে খুন করে ফেলে দিয়েছিল ঐ ইঁদারাতেই।

সে যাই হোক, মামার অর্থ ভাগনেই পেয়েছে। পাতাল থেকে তুলে এনে মামাকে যথাশাস্ত্র কবর দেবেই ডলফ।

*ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর ভৌতিক গল্প “ডলফ হেলিগার” অবলম্বনে।

 

      এই ঘটনাটা ষাট বছরেরও আগে ঘটেছিল—এখন এর অনেকটাই ভুলে গেছি। যেটুকু মনে আছে বলছি।       আমরা যখন গ্রামে থাকতাম তখন আমাদের রাজ্যটি এত ছোট ...

      এই ঘটনাটা ষাট বছরেরও আগে ঘটেছিল—এখন এর অনেকটাই ভুলে গেছি। যেটুকু মনে আছে বলছি।
      আমরা যখন গ্রামে থাকতাম তখন আমাদের রাজ্যটি এত ছোট ছিল না। এখন থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে এক বাংলা দুটি বাংলা হয়ে যায়। আমাদের বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের একটি ছোট গ্রামে। গ্রাম ছোট হলে হবে কি তখন ছোট ছোট গ্রামেই হাজারে হাজারে ভূত বাস করত।
      আমাদের গ্রামের নাম ছিল রতনদিয়া। ঐ গ্রামে ভূতদের দমিয়ে রাখার জন্য অন্তত বারোজন গুণিন ছিলেন। ফলে ভূত প্রচুর থাকলেও তারা অত্যাচার করতে ভয় পেত। গুণিনরা দুষ্টু আর বদমাইশ ভূতদের কঠোর শাস্তি দিতেন—কোনও কোনও গুণিন ভূতদের ঝি-চাকর-দারোয়ান করে রাখতেন। খুব লজ্জার কথা হলেও দু’একজন গুণিন পেত্নিদের দিয়ে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করানোর কাজ করাতেন। এছাড়া রান্নার কাজও করিয়ে নিতেন। এটা গুণিনদের করার কথা নয়। যাই হোক এক একজন ছোট গুণিন ষোলটা করে ভূত-পেত্নিকে বেগার খাটাতে পারতেন। আরও বড় বড় গুণিনরা কেউ বত্ৰিশ কেউ চৌষট্টিটা করে ভূত রাখতেন বেগার খাটানোর জন্য। হিন্দু-মুসলমান দুরকম ভূতই গ্রামের বাইরে একটা পোড়ো বাড়ির দখল নিয়ে থাকত। শোনা যায় এই ভূতদের মধ্যে দুজন খ্রিস্টান সাহেব ডাক্তার ভূতও ছিল! মোটামুটি ব্যাপারটা এই যে ভূত বেশি থাকলেও গুণিনদের ভয়ে তারা সভ্যভব্য হয়েই থাকত। আমরাও নিশ্চিন্ত মনে গ্রামে থাকতাম। প্রচুর ভূত আশেপাশে থাকলেও আমরা ভয়ংকর ভূতদের পাল্লায় কখনও পড়িনি।
      ভয়টা কিন্তু ছিলই। তাছাড়া সব ভূত সব সময়েই যে শান্তশিষ্ট হয়ে থাকত তাও নয়। আমাদের গ্রামের এক জামাইকে পইপই করে বলা হয়েছিল সে যেন কক্ষনো রাতের গাড়িতে গ্রামে না আসে। সে জামাই ছিল বেপরোয়া, নাম শ্রীকান্ত চাটুজ্জে, বয়স পঁচিশ, বিজ্ঞান পড়ে পড়ে তার ধারণা হয়েছে ভূত মানুষের মনের সৃষ্টি, ভূত বলে কিছু নেই। তা যেহেতু তাকে বারণ করা হয়েছে রাতের ট্রেনে গ্রামে না আসতে, আসলেও যেন আগে সে খবর দেয় সেই জন্যই শ্রীকান্ত খবর না দিয়ে রাতের ট্রেনেই কলকাতা থেকে কালুখালি রেল স্টেশনে নেমে বেশি সাহস দেখানোর জন্য একাই ছোট সুটকেস একটা ঘাড়ে করে টর্চ জ্বালাতে জ্বালাতে গ্রামের পথ ধরে শ্বশুরবাড়ি চন্দনা নদীর ধারে রামহরি মুখুজ্জের বাড়িতে যাচ্ছিল। রাতটা ছিল আবার অমাবস্যা। অমাবস্যার রাতে ভূতেদের মন কি রকম যেন চনমনে হয়ে যায়। তখন তাদের কালো রক্তে ইয়ার্কি-ফাজলামো করার একটা প্রবণতা হয়। এমনিতে ভালোমানুষ ভূত অমাবস্যার রাত্রে হঠাৎ হয়তো হেসে উঠল খ্যাঁ খ্যাঁ করে। সম্পূর্ণ অকারণ হাসি। কোনও দরকার নেই তবু হাসি! অথবা ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না—যেন কেউ ভীষণ মেরেছে কাউকে। কখনও কুকুরের ডাক, কখনও শেয়ালের ডাক, কখনও ফেউয়ের ডাক। তাছাড়া খটাস বলে একরকম বেড়াল জাতের প্রাণী ছিল, ভীষণ হিংস্র, আর ছিল বাঘডাঁশা! বাঘডাঁশাও এক ধরনের বুনো বেড়াল, অনেকটা বাঘের মতো দেখতে—ভূতেরা বাঘডাঁশার ডাকও ভারী চমৎকার নকল করতে পারত। এ হচ্ছে ভূতদের একরকমের ইয়ার্কি। ডাকলে ভীতু মানুষেরা ভয় পায়, সাহসী মানুষরাও চমকে ওঠে, ছোটরা কেঁদে বাড়ি মাথায় করে, এতেই ভূতেদের আনন্দ! কোনও কোনও বাচ্চা ভয়ে না চেঁচিয়ে চুপ মেরে যায়, তাতে ভূতেরা ভারী রাগ করে। ঐ সব বাড়িতে ভূতেরা ঢিল ছোড়ে।
      ঢ়িল ছুঁড়লে আর সেই সঙ্গে হাউ মাউ খাউ করলে যে-সব বাচ্চা ফুপিয়ে কাঁদে তারা পর্যন্ত গাঁ গাঁ করে চিৎকার করে। অন্য সব রাত্রে ভূতেরা গুণিনদের ভয়ে বিশেষ গোলমাল করে না, কিন্তু অমাবস্যার রাতগুলোতে ভূতদের আড্ডা ইয়ার্কির খানিকটা অনুমতি দেওয়া হয়। এটা ভূতদের অভিভাবক যারা, যেমন ব্রহ্মদৈত্য এবং বড় বংশের ভূত-পেত্নি এরাও মেনে চলেন। ফলে বিচ্ছিরি রকম কাণ্ড বিশেষ ঘটে না।
      যেদিনকার কথা বলছি সে দিনটা ছিল অন্যরকম। দিন না বলে রাত্তির বলাই ভালো। দিনের বেলা ভূতেরা ঘুমোয়, আবার কেউ কেউ দিনের বেলায় মানুষ সেজে গেরস্ত বাড়িতে কাজকর্ম করে কিছু উপরি রোজগারও করত বলে আমি শুনেছি। যাই হোক আমি যা বলছি সে সব সত্যিই আমাদের গ্রামেই ঘটেছিল, তবে আমি নিজের চোখে কিছুই দেখতে পাইনি। যখন ব্যাপারটা ঘটেছিল তখন আমি এমন ঘুমে অচেতন হয়ে ছিলাম যে কিছুই বুঝতে পারিনি। পরে সব শুনেছি। রাত্রেও অনেক নাকি হৈচৈ গোলমাল হয়েছিল, কিছু গোলমাল করেছিল ভূতে, কিছু আবার মানুষে! একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি যে রাতের কথা বলছি সেটা ছিল একটা বিশেষ রাত। ঐ রাতের তিনদিন আগে থেকেই গ্রামের যত গুণিন ছিলেন তারা চার-পাঁচ দিনের জন্য সারা বাংলা গুণিন সমাবেশে
ছিল মহা আনন্দের দিন। বড় বড় অভিভাবক শ্রেণির ভূত, ব্রহ্মদৈত্য এমনকি মামদোরা পর্যন্ত ভূতদের ইয়ার্কি-ফাজলামো একদম পছন্দ করেন না, তাই তারাও খুব উদ্বিগ্ন এই রাতে কি হয় ভেবে। তারা সব যে-যার নিজেদের বাড়ির ভূত ছানাদের আর যুবক ভূতদের সাবধানও করে দিয়েছিলেন যেন সবাই শান্তশিষ্ট থাকে, বেশি ঝামেলা না করে। বিশেষ করে যে-সব ভূত গুণিনদের বেগার খাটে, তাদের মেজাজ এমন তিরিক্ষে যে তাদের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলাও সম্ভব নয়। ইয়ার্কি-ফাজলামোয় তারাই ছিল সবিশেষ পটু।
      যেদিনকার কথা বলছি, সেদিন বড় ভূতেরাও একটা মেলায় গিয়েছিলেন, ফলে ছোট ভূতদের সেদিন হয়েছিল ডবল মজা।
      সন্ধের ট্রেনে গ্রামের শেষ গুণিন গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন শেয়ালদার গাড়িতে চড়ে উত্তরপাড়ার পথে, আর বেগার-খাটা ভূতের দল যেন একেবারে খেপে গেল। তারা সন্ধে থেকেই শুরু করল তাদের নানারকম তাণ্ডব। তারা হা হা হা হা করে কতরকম হাসল আর চিৎকার করল, বাড়িতে বাড়িতে ঢ়িল ছুড়ল—কিন্তু গ্রামের লোকেরাও খুব সাবধান হয়ে রইল। একটুও ভয় না পেয়ে তারা গুণিনদের দেওয়া নতুন পান পাতা তাতে রক্তচন্দনে রাম রাম লেখা, সঙ্গে ঘি মাখানো সলতে দিয়ে বাড়ির চারদিকে সাজিয়ে রেখেছিল বলে ভূতেরা কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারল না। ভূতেরা এইসব দেখে রাগে গাঁ গাঁ করতে লাগল, বিচ্ছিরি রকম সব গালাগাল করতে লাগল মানুষের মতো গলায়, চন্দ্রবিন্দু ছাড়া উচ্চারণ করতে লাগল যাতে মানুষেরা রেগে গিয়ে বাড়ির সীমানার বাইরে চলে আসে, তাহলে ভারী ফুর্তি করা যায় তাদের নিয়ে। কিন্তু গুণিনরা সব কথা আগেই গ্রামের সকলকে বলে যাওয়ায় একটা মানুষও বাইরে বেরল না। এতে কার না রাগ হয়! ভূত বলে কি ওদের অনুভূতি নেই? ওদের মধ্যে যারা অণুভূত তারা গেল সবচেয়ে চটে! অণুভূত কি বুঝতে পারলে? একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে অণুভূত অর্থাৎ ছোট ভূত। অণু মানে ছোট। কেউ কেউ অবশ্য উপভূতও বলেন ওদের।
      রাত্তির তখন একটা হয়ে গেছে অথচ একটা মানুষ হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা তাদের কাছে খুব দুঃখের ব্যাপার বলে মনে হল। তারা মনের দুঃখে রাস্তার উপর নর্দমা থেকে গাদা গাদা কাদা নিয়ে এসে ছুঁড়তে লাগল এদিকে-ওদিকে, এর বাড়ি তার বাড়ি। লোকেরা ভয়ে দরজা-জানলা বন্ধ করে রইল। ভূতেরা দারুণ চিৎকার করে গান গাইতে লাগল—
      একবার বেরিয়ে আয় না বাবুরা তোদের খাই, বিবিরা আয় না বাইরে আমরা তোদের ভাই। সকলে ভয়ে দরজা-জানালা আর খোলে না, গরমে অস্থির হয়। ছোটরা ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে, আর তাই শুনে ভূতদের বাঁদরামি আরও বাড়তে থাকে। কিন্তু ওদের তাতে সুখ নেই। মানুষদের ধরে নানারকম বীভৎস কাণ্ডকারখানা না করলে অণুভূত, মানে ছোট ভূতদের ফুর্তি ঠিক জমে না। তা তারা আস্ত মানুষ হাতে না পেয়ে বড়ই কষ্টে ছিল, এমন সময় রাতের ট্রেনটা কালুখালি স্টেশনে এসে থামল আর জনা বারো লোক ট্রেন থেকে নেমে যে যার বাড়ির দিকে চলল। ভূতের দল লক্ষ করল ওদের মধ্যে সকলেই চেনা লোক, অনেকেই ভূতেদের কেউ কাকু, কেউ বা পিসেমশাই। ওদের ভয় দেখিয়েও অত সুখ নেই। একজন অপরিচিত লোক পেলে তাদের সবচেয়ে ভালো লাগে। এমন সময় দেখা গেল শ্রীকান্ত চাটুজ্জে হাতে সুটকেস—কখনো কাঁধে তুলে নিচ্ছে, অন্য হাতে টর্চ জ্বেলে দিব্যি হনহনিয়ে আসছে!
      হঠাৎ দেখা গেল শ্ৰীকান্ত চাটুজ্জের হাতের টর্চটা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল অন্তত দশ মিটার। আবার টর্চটা বাই করে বেঁকে গিয়ে রাস্তার ধারের একটা তালগাছে ক্রমাগত পাক খেতে লাগল। এই অসম্ভব কাণ্ড এত অকস্মাৎ ঘটে গেল যে শ্রীকান্ত প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল! তারপর মনটাকে একটু সুস্থির করার চেষ্টা করল। মনে মনে ভাবল এর নিশ্চয় একটা সঙ্গত কারণ আছে। জগতে তো অসম্ভব কত কাণ্ডই ঘটে, কিন্তু সেগুলোর কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। যেখানে চট করে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না সেখানে আরও ভালো করে দেখতে হয়। অলৌকিক বলে তো কিছু হয় না। যা হয় তা আপাতদৃষ্টিতে যতই আজগুবি এবং অস্বাভাবিক মনে হোক না কেন কোনোটাই অলৌকিক নন। ভাবতে ভাবতে টর্চটা উঠে গেল তালগাছটার মাথায়, সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে শো করে নীচে নেমে এসে রাস্তার উপর ধেই ধেই নাচতে লাগল।
      নাঃ, এর তো কোনও মাথামুণ্ডু বোঝা যাচ্ছে না। শ্রীকান্ত চাটুজ্জের মনটা দুর্বল হতে শুরু করেছে। হঠাৎ তার কানের কাছে স্পষ্ট একটা খোনা খোনা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল—

ওরে শ্রীকান্ত এই ভবে ক
ত অন্ধকার সে কে কবে
জমাট কালোর রাজ্যে আমরা
তুলে নেব তোর গায়ের চামড়া!! 

      তারপর খিঁ খিঁ করা হাসি। সে হাসি শুনলে হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়! শ্রীকান্ত কিন্তু সামলে নিল। কিন্তু তারপর ফের শুরু হল আর এক বিচ্ছিরি করাতচেরা কষ্ঠের গান—

শ্বশুরবাড়িতে তুই এসেছিস রে চাটুজ্জে শ্রীকান্ত 
জামাই অাদরে রাখব তোকে একখান গান গা তো! 

      শ্ৰীকান্ত নিজেও মাঝে মাঝে কবিতা লিখে থাকে, সে দেখল একবার বলছে তুই এসেছিস’ আবার বলছে ‘গান তোঁ! এর সংশোধন দরকার। শ্ৰীকান্ত নিজে এই অদ্ভুত অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা রেখে গাইল—

ওরে তোরা সব অশিক্ষিত, নেই কো তোদের শিক্ষা 
গান বানানো নয়কো সহজ নিতে হবে যে রে দীক্ষা! 

      এবারে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। খানিকক্ষণ সব চুপ। এদিকে ঝিঁঝিঁর দল ডাকছে, দূরে ব্যাঙেরাও ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ করছে। প্যাঁচারাও সুযোগ বুঝে বেশ মজাসে গান গাইছে। সে কি গান—কানের পোকারাও পর্যন্ত কান থেকে বেরিয়ে এসে কাঁধের উপর বসে নাচতে শুরু করেছে! এ তো এক মহা মুশকিল হল!
      শ্ৰীকান্ত কিন্তু ভয় পেল না। সে দৃঢ়ভাবে নিজের মনকে শক্ত করে রাখল। কিন্তু একটু পরেই ভূতেদের দল ওর হাত থেকে ছোট সুটকেসটা নিয়ে তার ডালাটা খুলে ফেলল। অন্ধকারেও শ্রীকান্ত বুঝতে পারল সুটকেস খুলে তছনছ করছে কারা! সে এও বুঝতে পারল তার শ্বশুরবাড়ির জন্য অনেক কষ্টে সংগ্রহ করা বিখ্যাত এক মিষ্টিওলার কাছ থেকে আনা কড়াপাকের সন্দেশগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তার জামা-টামা টুথপেস্ট টুথব্রাশ দাঁড়ি কামানোর সরঞ্জাম তোয়ালে এসবও সব ছত্ৰখান হয়ে গেল। শ্রীকান্ত ভাবল এমন তো হওয়ার কথা নয়, সে নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে তো কত রকম বিদকুটে জিনিস দেখা যায়, এ বোধহয় সেই রকম একটা কিছু হবে। কিন্তু সবটা স্বপ্ন নয়। সে বেশ বুঝতে পারল কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে যা স্বাভাবিক নয়।
      এরপরে চারদিকে কচমচ খচমচ আওয়াজ হতে লাগল। সর্বনাশ! মনে হল যেন কড়াপাকের সন্দেশগুলো কেউ কচর-মচর করে খাচ্ছে। এদিকে তার টর্চটা যেটা এতক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরছিল সেটাও স্থির হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। সে আলোতে কতই বা দেখা যায় কিন্তু তবু ঐটুকু আলোতেই সে দেখল তার সুটকেস খোলা, আর তার সব জিনিস কোথায় যে সব হাওয়া হয়ে গেছে!
      তার কান্না পেতে লাগল। সে ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে উঠল, ডাকাত ডাকাত! কিন্তু তার চিৎকার করাই সার হল। কে আসবে তাকে সাহায্য করতে? রতনদিয়া গ্রাম তখন চ্যাংড়া ভূতেদের কজ্জায়। ভূতেদের তখন সন্দেশ খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। তারা বলল—
      
ডাকাত তুই কাকে বলছিস ধূর্ত
মজাটা দেখবি হয়ে উঠি যদি মূর্ত। 
এলি কেথা থেকে কোন দেশ থেকে কোন দেশে 
খুশি হনু মোরা তোর আনা কড়াপাক সন্দেশে। 
মারিব না তোরে ধরিব না তোরে কেবল তুলিব শূন্যে 
ধপাস করিয়া ফেলিব মাটিতে মরিবি বাপের পুণ্যে! 

      ওরে বাবা! এ যে সত্যি তাকে কারা যেন ধরে শূন্যে লোফালুফি খেলতে লাগল। সে একবার কাদের ঠান্ডা হাতে পড়ে যায়, আবার অন্য কারা ঠান্ডা হাতে লুফে নেয়। এ তো সাংঘাতিক খেলা এদের। ভূত তা হলে সত্যি আছে—সত্যি আছে! সে ভয়ে চিৎকার করতে লাগল আর বলতে লাগল, বাঁচাও বাঁচাও! ওরে বাবারে মরে গেলাম রে, মেরে ফেলল রে, বাঁচাও বাঁচাও !
      এইরকম কতক্ষণ চলল সে শ্ৰীকাস্তের খেয়াল নেই। হঠাৎ একসময় তার মনে হল ভূতেদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। তারা তাকে প্রায় আকাশসমান উঁচু থেকে ছেড়ে দিল, আর শ্রীকান্ত মাটিতে পড়তে লাগল। এবার আর রক্ষা নেই। শ্রীকান্ত এত বিপদেও রামনাম করেনি। করলেও কী হত কে জানে, আজকালকার ছোকরা ভূতেরা রামনামের তোয়াক্কা করে না।
      শ্ৰীকান্ত পড়তে লাগল—এর মধ্যে সে শুনতে পেল ইংরিজিতে কারা সব কথা বলছে। তাদেরও নাকি-সুর! বুঝতে না বুঝতে সে মাটির উপর আছড়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল তার হাড়টাড় সব ভেঙে গেল। পরে তার আর জ্ঞানই রইল না।
      একটু একটু জ্ঞান হলে সে দেখতে পেল সে একটা চমৎকার ঘরে শুয়ে আছে। আশেপাশে অনেকগুলো খাট। প্রত্যেক খাটের উপর গদির বিছানা। শ্রীকান্ত বুঝল সে কোনো হাসপাতালে শুয়ে আছে। ভালো হাসপাতাল। শ্রীকান্ত এ-রকম হাসপাতাল দেখেছে। সে দেখতে পেল সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরা নার্সরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা আবার মেমসাহেব! শ্ৰীকান্ত একটুখানি নড়াচড়া করতেই একটি নার্স এসে বলল, গুড মনিং সার! শ্রীকান্ত ইংরেজি জানত মোটামুটি। সে বলল, গুড মনিং মিস। এমন সময় একজন মোটাসোটা লম্বা চেহারার সাহেব ডাক্তার এসে তার কাছে একটা ছোট টুল নিয়ে বসলেন। বললেন, কেমন বোধ করছ? শ্রীকান্ত বলল, ভালোই তো মনে হচ্ছে তবে গায়ে বেশ ব্যথা, মাথাতেও ব্যথা খুব। ডাক্তার বললেন, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। তুমি কোন দেশের লোক, তোমাকে কারা মেরেছিল? শ্রীকান্ত বলল, কোন দেশের লোক মানে? আমি এদেশেরই লোক! ডাক্তার বললেন, এদেশের কোথায় তোমার বাড়ি? শ্রীকান্ত বলল, কলকাতা আমার বাসস্থান। ডাক্তার বললেন, এই দেশটা হচ্ছে ইংল্যান্ড। তুমি লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালে রয়েছ। তাছাড়া অনেকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। কেউ তোমার নাম জানে না কিছু না, তোমাকে কেউ ভর্তি করায়নি এই হাসপাতালে! একদিন রাত্রে হঠাৎ তোমাকে এই বিছানায় দেখে সকলে অবাক হয়ে যায়। সেও আজ প্রায় দশ দিন হয়ে গেল। তোমার জ্ঞান ছিল না। তোমার হাড়টাড় সব ভাঙা ছিল, কিন্তু কারা সব জোড়া দিয়েছিল, তারপর তারা এখানে এনে ফেলে গিয়েছিল। এই কাজ কারা করেছিল তুমি জান?
      শ্ৰীকান্তর এবার মাথাটা ঘুরে উঠল। এ কি কথা—সে এখন লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালে? অসম্ভব! অসম্ভব! সে আর ভাবতে পারল না, কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে রইল। সাহেব ডাক্তার বললেন, না, এর সঙ্গে অত কথা বলা বোধহয় ঠিক হয়নি, পরে ভালো করে ভেবে-চিন্তে কথা বলতে হবে। কলকাতার লোক বলছে এ। নামটাও তো জানা যাচ্ছে না, তাহলে কলকাতায় একটা খবর পাঠিয়ে দেওয়া যেত। যাই হোক, এরপর ওর জ্ঞান হলে ওর নাম আর ঠিকানাটা জোগাড় করতে হবে। ডাক্তার নার্সকে কথাগুলো বলে ভ্রু কুঁচকে কি ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেলেন।
      শ্ৰীকান্তকে চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা খালি একটা খাটে পড়ে থাকতে দেখেন নাইট ডিউটির একজন সিনিয়র নার্স রোগীর না ছিল পরিচয়, না ছিল কোনও রিপোর্ট। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন বোধহয় কোনও ইন্ডিয়ান উটকো লোক, থাকবার জায়গার অভাবে লুকিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছে। পরে পরীক্ষা করে দেখেন লোকটির সারা গায়ে নানারকম আঘাতের চিহ্ন। লোকটি সম্পূর্ণ অজ্ঞান। তারপর নানা কৌশলে তার এক্স-রে করে দেখা যায় তার অসংখ্য হাড় ভাঙা, তবে সেগুলো সেট করা হয়েছে ঠিক ভাবেই। এটা ভারী আশ্চর্যজনক ব্যাপার বলে তাদের মনে হয়। চামড়া না কেটে, বাইরে থেকে এমন ভাবে হাড় জোড়া দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। বিশেষ করে যে-সব হাড় ভেঙে ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেছে সেগুলোকে বাইরে থেকে সেট করা যায় না। এই নিয়ে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়।
      শ্রীকান্তকে বিশেষ রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তার জন্য একটা মেডিক্যাল টিমও গঠন করা হয়। অনেক বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শের পর যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তাতে সে দ্রুত সেরে উঠতে থাকে। দুদিন আগে তাকে অজ্ঞান অবস্থাতেই দাঁড় করানোও হয়। খবরের কাগজের লোকেরাও এই বিস্ময়কর রোগীকে নিয়ে যথেষ্ট কৌতুহল দেখায়। কিন্তু লোকটির পরিচয় কেউই বার করতে পারে না। কলকাতায় বাড়ি এটা শুনে কলকাতায় খোঁজও করেছিল পুলিশ, কিন্তু পুলিশ ওপর ওপর খোঁজখবর নিয়ে জানিয়েছিল তারা ঠিক ধরতে পারছে না। লোকটির নাম জানলেও একটা চেষ্টা করা যেত। কলকাতা থেকে রোজ কম লোক তো নিরুদ্দেশ হয় না।
      এরপর চলতে লাগল অপেক্ষা আর চিকিৎসা। আস্তে আস্তে শ্ৰীকান্ত প্রায় সম্পূর্ণই সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু অসুবিধে তারও ছিল। সে তার নিজের নামটাই আর মনে আনতে পারল না! সে কেবল বলত আমার বাড়ি কলকাতা, বাস! এইভাবে চলল আরও দু'মাস। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ। এক্সরে করে দেখা হয়েছে তার হাড়গুলো সবই বেমালুম জুড়ে গেছে! চামড়ায় যে সব কাটাছেড়ার দাগ ছিল সেগুলো মেলাল না তবে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল।
      এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সমস্যা হল একজন সুস্থ-সবল লোককে কোথায় পাঠানো হবে। হাসপাতালে রাখা চলবে না একেবারেই। সুস্থ লোককে হাসপাতালে রাখা যায় না। মানসিক রোগের হাসপাতালে পাঠানো হয়তো যায়, তার স্মৃতিশক্তি ফেরানোর চেষ্টা করা যায়। শ্ৰীকান্ত নিজেও কেমন যেন হয়ে পড়ল। তার নাম কি সে নিজেই জানে না! সে কেবল জানে তার বাড়ি কলকাতা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশেষে স্থির করলেন ওকে জাহাজে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে ওকে নিয়ে গাড়িতে করে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়ে আনলে তার হয়তো স্মৃতি ফিরে আসতেও পারে। অনেক টাকারও দরকার। সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে—সব ব্যবস্থা পাকা ।
      যে দিন সকালের ট্রেনে টিলবেরি ডকে যাওয়ার কথা, সঙ্গে একজন যাবে তার সঙ্গে, তার আগের রাত্রে হল এক অদ্ভুত কাণ্ড। হঠাৎ রাত দুটাে নাগাদ কর্তব্যরত নার্স শ্ৰীকান্তর বেডে এসে দেখল রোগী উধাও! খোঁজ খোঁজ! রোগী কোথাও নেই। ভারী আশ্চর্য ব্যাপার। হাসপাতালের দরজা বন্ধ, মেইন গেট বন্ধ, রোগী গেল কোথায়? চাঞ্চল্য পড়ে গেল চারদিকে। পুলিশ নানা সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য অনেক জায়গা খুঁজেও তার চিহ্ন পেল না!
      রতনদিয়ায় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল এরপরেই। শ্রীকান্তকে পাওয়া গেল তার শ্বশুরবাড়ির একটা ঘরের মধ্যে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায়। শ্রীকান্তকে ওখানে ঐ ভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ফের চাঞ্চল্য! সমস্ত গ্রাম দেখতে এল শ্রীকান্তকে। কালুখালি স্টেশন থেকে তাকে নামতে দেখেছে কয়েকজন সেই তিন মাস আগের বিচ্ছিরি ঐ রাত্রে! তারপর পাওয়া গেছে তার ভাঙা সুটকেস, আর ছড়ানো সব জিনিসপত্র। রক্তের ছাপ। ধস্তাধস্তির চিহ্ন। কেবল মানুষটাই হয়ে গেল নিরুদ্দেশ। সর্বত্র নেমে এসেছিল শোকের কুয়াশা! তারপর দিনের পর দিন গেল অথচ শ্ৰীকান্তর হদিস পাওয়া গেল না তখন সকলে ধরেই নিল শ্ৰীকান্তকে ভূতে খেয়েছে! কেননা সে রাত্রে ভূতেদের নানা চিৎকার আর হল্লা শোনা গিয়েছিল, ভূতদের বিচ্ছিরি সব ছড়াও শুনেছিলেন বহু মানুষ। গুণিনরা ফিরে এসে গ্রামের সব ভূতদের জেরা করেও কোনো সদুত্তর পাননি। সকলে একবাক্যে বলেছে, জানি না—
      একটা সত্যি কথা ছোট ভূতেরা সকলে বলেছে, তারা শ্ৰীকান্তকে দেখেছে কিন্তু তাকে কেউ মারেনি। এটা হতেই পারে তারা কেবল তাকে নিয়ে একটু লোফালুফি করেছিল, মারেনি। কিল না ঘুষি না লাঠির আঘাত না, কেবল উঁচু থেকে একবার ধপ করে ফেলে দিয়েছিল। সেটাকে মারা বলা যায় কি? তাছাড়া একটা ব্যাপার তারাও বুঝতে পারেনি, হঠাৎ কোত্থেকে একদল সাদা ধরনের ভূত (সঙ্গে একটু যেন নীল নীল ভাব) এসে মস্তানি করে তাদের হঠিয়ে দিয়েছিল আর মানুষটাকে কোথায় হাওয়া করে দিয়েছিল কেমন করে। ছোকরা ভূতদের ধারণ ঐ অদ্ভুত ভূতেরা লোকটিকে পুরোপুরি খেয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে-কথা তারা কাউকে বলেনি।
      বড় ভূতেরা ছোকরা ভূতদের আর বেশি ঘাটাননি। বড় বড় ভূতরাও সেদিন গ্রামে ছিলেন না। সে জন্য ছোকরা ভূতদের জঘন্য সব কীর্তিকলাপ দেখতে পাননি। পরে আন্দাজ করেছিলেন কিন্তু এ নিয়ে বেশি কিছু ঘাটাননি।
      এদিকে আর একটা ব্যাপার ঘটেছিল—শ্ৰীকান্ত চাটুজ্জের সব ঘটনা প্রকাশ হবার পর তাকে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়। ওর শ্বশুরবাড়িতে একটা বড় উৎসব হয় গ্রামের প্রথম বিলাতফেরত জামাই বলে। তার আগে ঐ গ্রামের কোনো জামাই বিলেত যায়নি। আর ঐ বিলাতফেরত হবার জন্যই তাকে বেশ বড় রকমের একটা কাজও দেওয়া হয়। শ্রীকান্ত ছিল একজন সামান্য কেরানি। মাসে মাইনে ছিল পঁয়তাল্লিশ টাকা। বড় পদে প্রতিষ্ঠিত করার পর তার মাইনে বেড়ে হল দুশো দশ টাকা! হবে না? বিলাতফেরত যে! তা ঐ সময়ে বিলাতফেরতদের ঐ রকমই সম্মান ছিল।
      এখন সে গ্রামই বা কোথায়, আর ভূতেরাই বা কোথায়!

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

      সে কী আজকের কথা! চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ঘটনা। আমার তখন কী বা বয়েস; বছর বাইশ। অনেক কষ্টে একটা চাকরি পেয়েছিলাম রেলের। তাও চাকরিটা...

      সে কী আজকের কথা! চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ঘটনা। আমার তখন কী বা বয়েস; বছর বাইশ। অনেক কষ্টে একটা চাকরি পেয়েছিলাম রেলের। তাও চাকরিটা জুটেছিল যুদ্ধের কল্যাণে। তখন জোর যুদ্ধ চলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমাদের এখানে যুদ্ধ না হোক, তোড়জোড়ের অন্ত ছিল না। হাজারে হাজারে মিলিটারি, শয়ে শয়ে ক্যাম্প, যত্রতত্র প্লেনের চোরা ঘাটি, রাস্তাঘাটে হামেশাই মিলিটারি ট্রাক আর জিপ চোখে পড়ত।
      ওই সময়ে সব জায়গাতেই লোকের চাহিদা হয়েছিল, কল-কারখানায়, অফিসে, রেলে। মিলিটারিতে তো বটেই।
      চাকরিটা পাবার পর আমাদের মাস তিনেকের এক ট্রেনিং হল, তারপর আমায় পাঠিয়ে দিল মাকোড়া সাইডিং বলে একটা জায়গায়। সে যে কী ভীষণ জায়গা আজ আর বোঝাতে পারব না। বিহারেরই একটা জায়গা অবশ্য, মধ্যপ্রদেশের গা ঘেঁষে। কিন্তু জঙ্গলে আর ছোট ছোট পাহাড়ে ভর্তি। ওদিকে মিলিটারিদের এক ছাউনি পড়েছিল। শুনেছি গোলা-বারুদও মজুত থাকত। ছোট একটা লাইন পেতে মাকোড়া থেকে মাইল দেড়-দুই তফাতে ছাউনি গাড়া হয়েছিল।
       স্টেশন বলতে দেড় কামরার এক ঘর। মাথার ওপর টিন। ইলেকট্রিক ছিল না। প্লাটফর্ম আর মাটি প্রায় একই সঙ্গে। অবশ্য প্লাটফর্মে মোরন ছড়ানো ছিল।
       স্টেশনের পাশেই ছিল আমার কোয়ার্টার। মানে মাথা গোঁজার জায়গা। সঙ্গী বলতে এক পোর্টার। তার নাম ছিল হরিয়া। সে ছিল জোয়ান, তাগড়া, টাঙ্গি চালাতে পারত নির্বিবাদে। হরিয়া মানুষ বড় ভালো ছিল। রামভক্ত মানুষ। অবসরে সে আমায় রামজী হনুমানজীর গল্প শোনাত। যেন আমি কিছুই জানি না রাম-সীতার।
      হরিয়াকে আমি খুব খাতির করতাম। কেননা সেই আমার ভরসা। হরিয়া না থাকলে খাওয়া বন্ধ। ভাত, রুটি, কচুর তরকারি, ভিন্ডির ঘেঁট, অড়হর ডাল, আমড়ার টক—সবই করত হরিয়া। আহা, তার কী স্বাদ! মাছ, মাংস, ডিম হরিয়া ছুত না। আমারও খাওয়া হত না। তাছাড়া পাবই বা কোথায়! হস্তায় একদিন করে আমাদের রেশন আসত রেল থেকে। চাল, আটা, নুন, তেল, ঘি, আলু, পিয়াজ আর লঙ্কা। ব্যস।
      জায়গাটা যেমনই হোক আমাদের কাজকর্ম প্রায় ছিল না। সারাদিনে একটা কি দুটো মালগাড়ি আসত। এসে স্টেশনে থামত। তারপর তিন-চারটে করে ওয়াগন টেনে নিয়ে ছাউনির দিকে চলে যেত। একসঙ্গে পুরো মালগাড়ি টেনে নিয়ে যেত না কখনো। আর প্রত্যেকটা মালগাড়ির দরজা থাকত সিল করা। ওর মধ্যে কী থাকত জানার উপায় আমাদের ছিল না। বুঝতে পারতাম, গোলাগুলি ধরনের কিছু আছে। হরিয়া তাই বলত।
      আমি অবশ্য অতটা ভাবতাম না। মালগাড়ির দরজা সিল করা থাকবে—এ আর নতুন কথা কী! তার ওপর মিলিটারির বরাদ্দ মালগাড়ি। খোলা মালগাড়িতে আমরা যে তারকাটা, লোহালক্কড় দেখেছি।
      মালগাড়ি ছাড়া আসত অদ্ভুত এক প্যাসেঞ্জার ট্রেন। জানলাগুলো জাল দিয়ে ঘেরা। ভেতরের শার্সি ধোয়াটে রঙের। কিছু দেখা যেত না। দরজায় থাকত রাইফেলধারী মিলিটারি। হস্তা-দুহস্তা বাদে এইরকম গাড়ি আসত। দু'এক মিনিটের জন্যে দাঁড়াত। আমাকে দিয়ে কাগজ সই করাত। তারপর চলে যেত ছাউনির দিকে। গাড়িটা যতক্ষণ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকত—ততক্ষণ কেমন এক গন্ধ বেরুতো। ওষুধ ওষুধ গন্ধ।
      সঙ্গী নেই, সাথী নেই, লোক নেই কথা বলার। একমাত্র হরিয়াই আমার সাথী। দিন আমার বনবাসে কাটতে লাগল। এসেছিলাম গরমকালে, দেখতে দেখতে বর্ষা পেরিয়ে গেল, অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। মনে হত পালিয়ে যাই। কিন্তু যাব কেমন করে। চাকরি পাবার লোভে বন্ড সই করে ফেলেছি। না করলে হয়তো চলত। কিন্তু সাহস হয়নি।
      আমার সবচেয়ে খারাপ লাগত মালগাড়ির গার্ড সাহেবগুলোকে। ওরা কেউ মিলিটারি নয়, কিন্তু স্টেশনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে দু-চার ঘণ্টা সময় যা কাটাত, কেউ এসে গল্পগুজব পর্যন্ত করত না। ওরা কোন লাট-বেলাট বুঝতাম না। কাজের কথা ছাড়া কোনো কথাই বলত না। আর এটাও বড় আশ্চর্যের কথা, গার্ডগুলো যারা আসত—সবই হয় মাদ্রাজি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, না-হয় গোয়ানিজ ধরনের।
      একজন গার্ড শুধু আমায় বলেছিল, চুপি চুপি, “কখনো কোনো কথা জানতে চেয়ো না। আমরা মিলিটারি রেল সার্ভিসের লোক। তোমাদের রেলের নয়। আমরা আমাদের ওপরঅলার হুকুমে কাজ করি। আর কোনো কথা জিগ্যেস করবে না। কাউকে কিছু বলবে না।”
      সেদিন থেকে আমি খুব সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম। সব জিনিসেরই একটা মাত্রা আছে। ওই জঙ্গলে, ওইভাবে একা পড়ে থাকতে থাকতে ছ’মাসের মধ্যেই আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। পাগল পাগল লাগত নিজেকে। হরিয়াকে বলতাম, “চল পালিয়ে যাই।”
      হরিয়া বলত, “আরে বাপ রে বাপ।” বলত, “আমন কাজ করলে হয় ফাটকে ভরে দেবে, না হয়, ফাঁসিতে লটকে দেবে। অমন কাজ করবে না বাবু!”
      ভয় আমার প্রাণেও ছিল। পালাব বললেই তো পালানো যায় না। সময় কাটাবার জন্যে আমি প্রথমে অনেক বলে-কয়ে দু’প্যাকেট তাস আনাই। রেশনের চালডালের সঙ্গে তাস পাঠিয়ে দেয় এক বন্ধু। পেশেন্স খেলা শুরু করি। তবে কত আর পেশেন্স খেলা যায়! তাসগুলোয় ময়লা ধরে গেল।
      তারপর শুরু করলাম রেলের কাগজে পদ্য লেখা। এগুতে পারলাম না। পদ্য লেখা বড় মেহনতের ব্যাপার।
    শেষে পেনসিল আর কাগজ নিয়ে ছবি আঁকতে বসলাম। স্কুলে আমি ছেলেবেলায় ড্রয়িং ক্লাসে ‘কেটলি’ এঁকেছিলাম, ড্রয়িং স্যার আমার আঁকা দেখে বেজায় খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘বাঃ! বেশ লাউ একেছিস তো! এক কাজ কর—এবার লাউ আঁকতে চেষ্টা কর, ‘কেটলি’ হয়ে যাবে।.তুই সব সময় উলটে নিবি। তোকে বলল, বেড়াল আঁকতে, তুই বাঘ আঁকা শুরু করবি, দেখবি বেড়াল হয়ে গেছে।’
      লজ্জায় আমি মরে গিয়েছিলুম সেদিন। তারপর আর ড্রয়িং করতে হাত উঠত না। বন্ধুদের দিয়ে আঁকিয়ে নিতুম।
       এতকাল পরে আবার ছবি আঁকতে বসে দেখলুম, ভূত-প্রেত দানব-দত্যিটা হাতে এসে যায়। গাছপালা মানুষ আর আসে না।
      ছবি আঁকার চেষ্টাও ছেড়ে দিলুম। তবে হিজিবিজি ছাড়তে পারলাম না। কাগজ-পেনসিল হাতে থাকলেই কিম্ভূতকিমাকার আঁকা বেরিয়ে আসত।
       এইভাবে শরৎকাল চলে এল। চলে এল না বলে বলা উচিত শরৎকালের মাঝামাঝি হয়ে গেল। ওখানে অবশ্য ধানের ক্ষেত, পুকুর, শিউলি গাছ নেই যে চট্‌ করে শরৎকালটা চোখে পড়বে। ধানের ক্ষেতে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কেউ ডাকার নেই, পুকুর নেই যে শালুকে শাপলায় পুকুর ভরে উঠবে, আর একটাও শিউলি গাছ নেই যে সন্ধে থেকে ফুলের গন্ধে মন আনচান করবে।
      ওসব না থাকলেও, আকাশ আর মেঘ, আর রোদ বলে দিত—শরৎ এসেছে। একটা জায়গায় কিছু কাশফুলও ফুটেছিল।
      এই সময় একদিন এক ঘটনা ঘটল। তখন সন্ধে রাত কি সবেই রাত শুরু হয়েছে, এঞ্জিনের হুইসল শুনতে পেলাম। রাতের দিকে আমাদের ফ্ল্যাগ স্টেশনে ট্রেন আসত না। বারণ ছিল। একদিন শুধু এসেছিল।
      কোয়ার্টারে বসে এঞ্জিনের হুইসল শুনে আমি হরিয়াকে বললাম, “তুই কচুর দম বানা; আমি দেখে আসছি।” বলে একটা জামা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কোয়ার্টার থেকে স্টেশন পঁচিশত্রিশ পা।
      বাইরে বেরিয়ে যেন চমক খেলাম। মনে হল, যেন সকাল হয়ে এসেছে। এমন ফরসা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি টলটল করছে চাঁদ। এমন মনোহর চাঁদ জীবনে দেখিনি। কী যে সুন্দর কেমন করে বোঝাই। মনে হচ্ছে, রুপোর মস্ত এক ঘড়ার মুখ থেকে কলকল করে চাঁদের আলো গড়িয়ে পড়ছে নীচে। জ্যোৎস্নায় আকাশ-বাতাস-মাটি—সবই যেন মাখামাখি হয়ে রয়েছে। এ-আলোর শেষ নেই, অন্ত নেই রূপের। আকাশের দু-এক টুকরো মেঘও সরে গেছে একপাশে, চাঁদের কাছাকাছি কিছু নেই, শুধু জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ছে।
      স্টেশনে এসে দরজা খুললাম। তার আগেই চোখে পড়েছে, অনেকটা দূরে এক মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। এঞ্জিনের মাথার আলো জ্বলছে না। ড্রাইভারের পাশের আলোও নয়।
      দরজা খুলে আমাদের লণ্ঠন বার করলাম। লাল-সবুজ লণ্ঠন। লন্ঠনের মধ্যে ডিবি ভরে দিলাম জ্বলিয়ে।
বাইরে এসে হাত নেড়ে নেড়ে লণ্ঠনের সবুজ আলো দেখাতে লাগলাম। মানে, চলে এসো, স্টেশন ফাঁকা, লাইন ফাঁকা।
      ট্রেনটা এগিয়ে এল না। কিছুক্ষণ পরে দেখি মালগাড়ির দিক থেকে কে আসছে। হাতে আমার মতনই লাল-সবুজ লণ্ঠন। তার হাঁটার সঙ্গে লণ্ঠন দুলছিল।
      আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। লোকটা কাছাকাছি আসতে চাঁদের আলোয় আমি তার পোশাকটা দেখতে পেলাম। সাদা পোশাক। গার্ড সাহেবের পোশাক।
দেখতে দেখতে গার্ড সাহেব একেবারে কাছে চলে এল। সামনে। আমি অবাক হয়ে লোকটাকে দেখতে লাগলাম। লম্বা চেহারা, ফরসা, মাথায় কোকড়ানো চুল। বাঁ-হাতে এক টিফিন কেরিয়ার।
      গার্ড সাহেব কাছে এসে দাঁড়াল। দেখল আমাকে। 
      “তুমি এই ফ্ল্যাগ স্টেশনে আছ?” 
      “হ্যাঁ স্যার। ” 
     “আমাদের এঞ্জিন বিগড়ে গেছে। মাইল চারেক আগে এঞ্জিনের কী হল কে জানে। থেমে গেল। ড্রাইভাররা চেষ্টা করেও চালাতে পারল না।”
      “আচ্ছা!” 
     “বিকেল থেকে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি। কোনো সাহায্য নেই। পাবার আশাও নেই। সন্ধের আগে এঞ্জিন আবার চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে, চাকা ঘষটে। কোনোরকমে এই পর্যন্ত এসেছি। আর এগুনো গেল না।”
       আমি বললাম,“তা হলে খবর দিতে হয় স্যার!”
       “হ্যাঁ, মেসেজ দিতে হয়। চলো মেসেজ দাও।”
      স্টেশনের ঘরে এসে টরে-টক্কা যন্ত্র নিয়ে বসলাম। খবর দিতে লাগলাম। ভাগ্যিস টরে-টক্কা যন্ত্রটা ছিল। তিন জায়গায় খবর দিয়ে যখন মাথা তুলেছি—দেখি গার্ড সাহেব চেয়ারে বসে বসে ঝিমোচ্ছে। -
      “দিয়েছ খবর ?”
      “হ্যাঁ স্যার।”
      “এবার তা হলে খাওয়া-দাওয়া যাক। তোমার এখানে নিশ্চয় জল আছে?”
      “ওই কলসিতে আছে।”
      “ধন্যবাদ।”
      গার্ড সাহেব উঠে গিয়ে রেল কোম্পানির মগ আর অ্যালুমিনিয়ামের গ্রাসে করে জল নিয়ে বাইরে গেল।
      লোকটা বাঙালি নয়। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানও নয়। ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে কথা বলছিল। কোথাকার লোক আমি বুঝতে পারছিলাম না। তার হিন্দি বুলিও স্পষ্ট নয়।
      হাত-মুখ ধুয়ে এসে লোকটা বলল, “আমি বড় হাংগরি। আমি খাচ্ছি। তুমি কিছু খাবে?”
      “না স্যার। আপনি খান।”
      “তুমি একটু খেতে পার। আমার যথেষ্ট খাবার আছে।”
     “থ্যাংক ইউ স্যার। আমার কোয়ার্টার আছে। আমাদের রান্না হয়ে গেছে। আপনি খান, আপনার খিদে পেয়েছে। আগে যদি বলতেন—আপনাকে আমার কোয়ার্টারে নিয়ে যেতাম। খাবারগুলো গরম করে নিতে পারতেন।”
      গার্ড সাহেব আমার দিকে চোখ তুলে কেমন করে যেন হাসল। বলল, “তোমার হাতটা বাড়াবে? বাড়াও না?”
      আমি কিছু বুঝতে না পেরে হাত বাড়ালাম।
     গার্ড সাহেব টিফিন কেরিয়ার থেকে এক টুকরো মাংস তুলে আমার হাতে ফেলে দিল। হাত আমার পুড়ে গেল যেন। মাটিতে ফেলে দিলাম।
      হাসতে লাগল গার্ড সাহেব। হাসতে হাসতে খাওয়াও শুরু করল। আমি কাগজে হাত মুছতে লাগলাম। হাতে না ফোস্কা পড়ে যায় আমার।
      খেতে খেতে গার্ড সাহেব বলল, “তোমার নাম কী ছোকরা?”
      নাম বললাম।
      “এখানে কতদিন আছ?”
      “ছ'মাসের কাছাকাছি।”
      “ভালো লাগে জায়গাটা?”
      “না।”
      “তা হলে আছ কেন?”
      “কী করব। চাকরি স্যার!”
      “চাকরি।” গার্ড সাহেব খেতে লাগল। দেখলাম সাহেব খুবই ক্ষুধার্ত। খেতে খেতে সাহেব বলল, “তোমাদের এখানে আজ কোনো ট্রেন এসেছে?”
      “না স্যার। আজ কোনো গাড়ি আসেনি।”
      “আমি বুঝতে পারছি না—আমার গাড়িটার কেন এরকম হল? ভালো গাড়ি, ঠিকই রান করছিল। হঠাৎ থেমে গেল কেন?”
      “এঞ্জিন ব্রেক ডাউন?”
      “কিন্তু কেন?..আমরা যখন ওই ছোট নদীটা পেরোচ্ছি, জাস্ট একটা কালভার্টের মতন ব্রিজ, তখন একটা শব্দ শুনলাম। এরোপ্লেন যাবার মতন শব্দ। কিন্তু শব্দটা জোর নয়, ভোমরা উড়ে বেড়ালে যেমন শব্দ হয় সেইরকম। ব্রেকভ্যান থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। আকাশে কিছু দেখতে পেলাম না।” 
      “নদীর শব্দ– ?” 
      “না না; জলের শব্দ নয়।...আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো, দু-এক ফালং আসার পর এঞ্জিন বিগড়ে গেল।”
      “হঠাৎ?” 
     “একেবারে হঠাৎ। আর একটা ব্যাপার দেখলাম। খুব গরম লাগতে লাগল। এই সময়টা গরমের নয়, জায়গাটাও পাহাড়ি। বিকেলও ফুরিয়ে আসছে। হঠাৎ অমন গরম লাগবে কেন? সেই গরম এত বাড়তে লাগল—মনে হল গা-হাত-পা পুড়ে যাবে। ড্রাইভাররা পাগলের মতন করতে লাগল। পুরো গাড়িটাও যেন আগুন হয়ে উঠল।”
      “ঘণ্টাখানেক এই অবস্থায় কাটল। আমরা সবাই নীচে নেমে দাঁড়িয়ে থাকলাম।”
     “তারপর গরম কমতে লাগল। কমতে কমতে প্রায় যখন স্বাভাবিক তখন দেখি এঞ্জিনটাও কোনোরকমে চলতে শুরু করেছে।”
      “এ তো বড় অদ্ভূত ঘটনা।” 
     “খুবই অদ্ভূত।...আরও অদ্ভুত কী জানো! আমরা গাড়ি নিয়ে খানিকটা এগুবার পর কোথা থেকে মাছির ঝাঁক নামতে লাগল।”
      “মাছির ঝাঁক?” আমার গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বেরুল। 
      “ও! সেই ঝাঁকের কথা বলো না। পঙ্গপাল নামা দেখেছ? তার চেয়েও বেশি। চারদিকে শুধু মাছি আর মাছি। আমাদের গাড়িও ছুটতে পারছিল না যে মাছির ঝাঁক পেছনে ফেলে পালিয়ে আসব। অনেক কষ্টে তাদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। আমি তো ব্রেক-ভ্যানের জানলা-টানলা বন্ধ করে বসেছিলাম। ড্রাইভাররা মরেছে। জানি না, মাছিগুলো এঞ্জিনের কিছু গোলমাল করে দিয়ে গেল কিনা! তবে, আগেও তো এঞ্জিন খারাপ হয়েছিল।”
      আমি চুপ। অনেকক্ষণ পরে বললাম, “এরকম কথা আমি আগে শুনিনি, স্যার।” 
      “আমারও ধারণা ছিল না।” 
      গার্ড সাহেবের খাওয়া শেষ। জল খেল। হাত ধুয়ে এল বাইরে থেকে। 
      “তুমি জানো, এখানের ক্যাম্পে কী হয়?” গার্ড সাহেব জিগ্যেস করল। 
      “না, স্যার। শুনি মালগাড়ি ভর্তি করে গুলিগোলা আসে।” 
     “ননসেন্স ।...এখানে প্রিজনারস অফ ওয়ার রাখা হয়। যুদ্ধবন্দী। ক্যাম্প আছে। বিশাল ক্যাম্প।” 
     আমার মনে পড়ল প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কথা। জানলায় জাল, ধোঁয়াটে কাচ। বললাম, “এখন বুঝতে পারছি, স্যার।”
      “তাছাড়া, হাত-পা কাটা, উন্ডেড সোলজারদের চিকিৎসাও করা হয়। মরে গেলে গোর দেওয়া হয়। জান তুমি?”
      চমকে উঠে বললাম, “আমি কিছুই জানি না। মালগাড়ি দেখে ভাবতাম...” 
     “মালগাড়িতে হাজাররকম জিনিস আসে। খাবার-দাবার, বিছানা, ওষুধপত্র, ক্যাম্পের নানান জিনিস।” টিফিন কেরিয়ার গোছানো হয়ে গিয়েছিল গার্ড সাহেবের। একটা সিগারেট ধরাল। আমাকেও দিল একটা। বলল, “থ্যাংক ইউ বাবু!..আমি আমার গাড়িতে ফিরে চললাম। ড্রাইভাররা কী অবস্থায় আছে দেখি গে।...কিন্তু তোমায় সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি, বাবু! বি কেয়ারফুল।...আমার মনে হচ্ছে, এদিকে কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে—আমি বলতে পারব না। সামথিং পিকিউলিয়ার। ম্যাগনেটিক্‌ ডিস্টারবেন্স, না কেউ এসে নতুন ধরনের বোমা ফেলে গেল—কে জানে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অত মাছি...হাজার হাজার...লাখ লাখ...।”
      গার্ড সাহেব চলে গেল। 
      স্টেশন ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি কোয়ার্টারের দিকে আসছিলাম। দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোৎস্নার আলোয় ধবধব করছে সব। হঠাৎ চোখে পড়ল, মালগাড়িটা কিসে যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তারপর দেখি মাছি। মাছির বন্যা আসছে যেন। দেখতে দেখতে আমার কাছে এসে পড়ল। বৃষ্টি পড়ার মতন মাছি পড়ছিল। ভয়ে ঘেন্নায় আমি ছুটতে শুরু করলাম।
      ছুটতে ছুটতে এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মরে যাবার অবস্থা।
      ঘুম ভাঙল পরের দিন। হরিয়া ডাকছিল।
      দরজা খুলে বাইরে আসতেই হরিয়া বলল, “বাৰু, জলদি...গাড়ি আয়া।”
    স্টেশনে গিয়ে দেখি একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন। সেই জানলায় জাল লাগানো, ধূসর কাঁচের আড়াল দেওয়া। ওষুধের গন্ধ ছড়াচ্ছে প্ল্যাটফর্মে।
      গার্ড সাহেব কাগজ সই করাতে এগিয়ে এল।
     তাকিয়ে দেখি, গতকালের সেই গার্ড সাহেব নয়, নতুন মানুষ। কিছু বলতে যাচ্ছিলাম আমি; গার্ড সাহেব এমন চোখ করে তাকাল—যেন আমাকে ধমক দিল। কথা বলতে বারণ করল। আমি চুপ করে গেলাম।
      কাগজ সই করে ফেরত দিলাম গার্ডকে। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, গতকালের মালগাড়ি, গার্ড সাহেব আর অত মাছি কোথায় গেল!

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

      সন্ধে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে।       পল্লি অঞ্চলের পথঘাট কাদায় মাখামাখি। একটি টিনের ঘরে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি পড়...

      সন্ধে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে। 
     পল্লি অঞ্চলের পথঘাট কাদায় মাখামাখি। একটি টিনের ঘরে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে—আর টিনের ঘরে সেই শব্দ অদ্ভুতভাবে একটি ঝিমঝিমে আমেজ এনে দিচ্ছে।
      চার বন্ধু বসে সেই বৃষ্টিভেজা রাতে একটু একটু করে চা খেতে খেতে সান্ধ্য-মজলিস জমিয়ে তুলেছে।
     খেলার খবর, ভুখা মিছিলের বার্তা, ইলেকট্রিক ট্রেনের কাহিনি, সিনেমার নানাবিধ গল্প.অবশেষে আপনা থেকেই গল্পের মোড়টা যেন ভূতের কাহিনির দিকেই এগিয়ে গেল।
      রক্ত যাদের গরম, জীবনটাকে যারা তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে ভালোবাসে—তারা চট করে ভূতকে বিশ্বাস করতে চায় না। ভূতটা যেন একটা রসিকতার ব্যাপার। চায়ের মজলিশে গরম পাপড়ের মতেই তা মুখরোচক। না হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু গরম গরম পেলে অতি সহজেই সান্ধ্য-মজলিশটা বেশ জমে ওঠে।
      এমনিভাবেই চারটি তরুণ বন্ধু ভূতের গল্পে মশগুল হয়ে উঠল। বাইরের দিকে ওদের তাকাবার ফুরসত ছিল না। কেননা বাইরেটা ছিল বড় অন্ধকার... তাকলেও চট করে কিছু চোখে পড়ে না! অনেকক্ষণ ধরে একঘেয়ে সুরে যে বৃষ্টি পড়ছিল— তাতে যে-কোনো মিয়োনো গল্পও দিব্যি জমে ওঠে। আর এ তো ছিল সান্ধ্য-মজলিশের সেরা অনুপান—ভূতুড়ে গল্প। কাজেই ছেলেরা নিজেদের মধ্যেই যেন মাকড়সার জাল বুনে একেবারে সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিল!
      এমন সময়ে হঠাৎ ঘরে এসে ঢুকল একটা লোক। তার সারা অঙ্গ ঢেকে রয়েছে একটি বর্ষাতি। আর সেই বর্ষাতি থেকে ক্রমাগত জল ঝরে পড়ছে।
      চার বন্ধু অবাক হয়ে সেই দিকে তাকাল। তাদের মনে হল—যেন কোনো ভূতের গল্পেরই একটি চরিত্র বাইরের ওই সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করল। ওদের বিস্ময় অবশ্য সেইখানেই কেটে যায়নি। কেননা আরো ভালো করে তাকিয়ে ওরা বুঝতে পারল যে, আগন্তুক তাদের পল্লি অঞ্চলের কেউ নয়—একেবারে খাটি সায়েব।
      তখন ওদের বিস্ময়ের আর পরিসীমা রইল না! 
     সায়েবটি সরাসরি তাদের কাছেই চলে এল, তারপর ওদের দিকে চোখ রেখে অস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করল, এখানে Haunted House কোথায় আছে?
      চার বন্ধুই কলেজের পড়ুয়া, তাই বিদেশি সায়েবের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে তাদের কোনো অসুবিধেই হল না!
      বন্ধুদের মধ্যে প্রথমে রমেনই কথার উত্তর দিলে। বললে, এই গ্রামের ভেতর মাইলখানেক পথ চলে গেলে—একটি বিরাট জমিদার বাড়ি আছে। বহুদিনের পুরোনো বাড়ি। কেউ এখন বসবাস করে না সেখানে। তারই দোতলায় একটি কামরা আছে—কেন, সেখানে যেতে চাও নাকি?
      শৈলেশ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ফোড়ন কাটলে,—হ্যাঁ, সেই নির্জন ঘরে যদি একরাত কাটাতে পারো তা হলেই ভূতের ঠিকানা ঠিক পেয়ে যাবে সায়েব।
      এই কথা শুনে সায়েব বিচ্ছিরি গলায় কেমন যেন হেসে উঠল। ক্রমাগত চিৎকার করার পর যে ভাবে মানুষের গলা ভেঙে যায়–অনেকটা সেই রকম তার গলার আওয়াজ।
      সায়েব তারপর ওদের দিকে একবার বাকা চোখে তাকালে, আর নিজের কোমরে গুজে রাখা রিভলভারটি খুলে নিয়ে ডান হাতের চেটোয় ঘন-ঘন নাচাতে লাগল।
      ওর ধরন-ধারণ দেখে চার বন্ধু বড্ড অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কোত্থেকে এল এই সায়েব? ওর নিয়তিই কি ওকে এই জলঝরা রাত্রে এই অজ পাড়াগাঁয়ে হাতছানি দিয়ে ডেকে এনেছে নাকি?
      বুদ্ধ রসিকতা করে প্রশ্ন করলে, তা সায়েব সেই ভূতুড়ে বাড়িতে তুমি একাই যেতে পারবে— না, লোক আর লণ্ঠন সঙ্গে জুটিয়ে দিতে হবে?
      সায়েব আর একবার তার সেই রহস্যময় হাসি হেসে উঠল। তারপর পকেট থেকে নিজের টর্চটি বের করে বাইরের মিশকালো আঁধারের উদ্দেশ্যে যেন আলোর বুলেট ছেড়ে দিলে! সত্যি জোরদার টর্চ বলতে হবে! একটা গাছের মাথায় আলোটা গিয়ে পড়তে—কয়েকটি বাদুড় ডানা ঝটপট করে আকাশে উড়ে গেল।
      যেমন আকস্মিকভাবে সায়েব ঘরে ঢুকেছিল—ঠিক তেমনি রহস্যজনকভাবে বৃষ্টির ভেতর সে বেরিয়ে গেল। অনেক দূর পর্যন্ত তার সেই টর্চটিকে জ্বলতে আর নিভতে দেখা গেল।
      ঘরের ভেতর বন্ধু চারজন নির্বাক হয়ে বসে রইল। সায়েবকে পোড়ো জমিদার বাড়িতে পাঠানো ঠিক হল কিনা—সেই কথাই ওরা হয়তো ভাবতে লাগল। প্রতিবাদ করবার সময়ও যে সায়েব দিলে না! এই কথা মনে করে ওদের সবাইকার নিভৃত অন্তরে যেন একটা অজানিত আশঙ্কা ঘনীভূত হয়ে উঠল।
      চার বন্ধুর বাড়ি ফিরবার তাড়া ছিল না। কেননা তারা গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে ফিরে এসেছে। রাত যত গভীরই হোক, বাড়িতে ভাত ঢাকা পড়ে থাকবে—জানা কথা।
      ওরা কিন্তু আরো খানিকক্ষণ বসে থেকে সায়েবের জন্যে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। সত্যি, এই বিদেশি লোকটি যদি কোনো বিপদে পড়ে, তবে তো ওরা চারজনই নিমিত্তের ভাগী হয়ে পড়বে। বাইরের মিশকালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আর ঝিমঝিম বৃষ্টির কথা ভেবে ওদের মন সত্যি ব্যাকুল হয়ে উঠল।
      মানুষটাকে একটা খেয়ালের ঝোঁকে মরণের মুখে ঠেলে দেওয়া হল না তো? চার বন্ধুরই বাইক ছিল। ওরা নিঃশব্দে চায়ের দোকানের পয়সা চুকিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর রওনা হল সেই পোড়ো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বহুকাল তারা ও অঞ্চলে যায়নি। তারপর সম্প্রতি কলেজ ছুটি হতে দেশে এসেছে। ওখানে পৌছে তো সবাই থমকে দাঁড়াল। সেই পোড়ো বাড়ির সামনে এমন আগাছা ও কাঁটা গাছ গজিয়েছে যে, ভেতরে ঢোকে কার সাধ্যি!
      অনেকক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে তারা জীর্ণপ্রায় ভবনটিতে ঢোকবার আশা একেবারে ত্যাগ করল। ভূত ছাড়া সাপের ভয়ও তো আছে! এই আঁধার রাতে পোড়ো বাড়িতে ঢোকা মানে নিজের জীবনটিকে যমের হাতে তুলে দেওয়া!
      তাদের আগে যে আর কেউ এই বাড়িতে ঢুকেছে—এমন কোনো চিহ্নও তারা খুঁজে পেলে না। দূর থেকে তারা অপরিচিত সায়েবকে উদ্দেশ করে ডাকাডাকি করলে। সে-শব্দ ভাঙা দেয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল। কোনো সাড়াই মিলল না।
      শৈলেশ বললে, কাল ভোরে খবর নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় তো দেখতে পাচ্ছি নে! জনার্দনের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে বললে, আমরা বড় জোর গ্রামের চৌকিদারকে খবরটা দিয়ে যেতে পারি। সে যদি রাত্রে বাড়িটার ওপর একটু নজর রাখে।
      এই পরামর্শে সবাই বেশ খুশি হল—আর যাওয়ার পথে চৌকিদারের কাছে খবরটা পৌছে দিয়ে তারা যে যার বাড়ি চলে গেল।
      তখন জলটা একটু ধরেছে বটে—তবে পথের দু’পাশের বড় বড় গাছ থেকে টুপটাপ করে ফোটা পড়ছে।
      রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে চার বন্ধু একটা বাড়িতে মিলিত হল। সেটা শৈলেশদের বাড়ি। ওদের বৈঠকখানা ঘরটা খালিই পড়ে থাকে। চার বন্ধু ঠিক করলে—সেই ঘরেই রাত্তিরটা কাটিয়ে দেবে। কেন যেন ওদের মনের কোণে বৃশ্চিক দংশন হতে লাগল যে, সায়েবের যদি কোনো অনিষ্ট হয়—তবে আইনের চক্ষে না হোক, পরোক্ষভাবে ওরাই কিন্তু দায়ী থাকবে।
      জনাৰ্দন মন্তব্য করলে, এসো, আমরা একটা রাত জেগেই কাটাই। কি জানি, যদি কোনো খারাপ খবর থাকে—তবে চৌকিদার এসে আমাদের ডেকে তুলবেই।
      রাত জাগা ঠিক হল না। গল্প করতে করতে কখন যে ওরা ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে— সে কথা নিজেরাই জানতে পারেনি।
      আচমকা সক্কলের ঘুম ভেঙে গেল শেষ রাত্তিরে—চৌকিদারের হাকডাকে। চৌকিদার ওই বাড়িটার ওপর দৃষ্টি রেখেছিল। তার শেষ টহলের সময় ওই বাড়ির ভেতর থেকে নাকি একটা বিচ্ছিরি খিলখিলে হাসি শুনে সে থমকে দাঁড়ায়। তারপর সে ক্রমাগত রাম-রাম চিৎকার করতে থাকে। একা সেবাড়িতে ঢোকবার সাহস চৌকিদারের ছিল না, তাই কলেজের বাবুদের ডাকতে এসেছে।
      চৌকিদারের সঙ্গে ওরা গিয়ে যখন জমিদারের ভাঙা বাড়িতে হাজির হল—তখন পুব আকাশটা প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে।
      চৌকিদার লাঠি দিয়ে আগাছা সরিয়ে ওদের পথ করে দিলে। ওরা সবাই তার পেছন পেছন এগিয়ে চলল। মানুষের সাড়া পেয়ে একটা শেয়ালের বাচ্চা একবার মুখ বাড়িয়েই—একেবারে দে ছুট! একতলায় জায়গায় জায়গায় বেশ ভেঙে গেছে। দোতলায় উঠবার সিঁড়িটা খুঁজে নিয়ে ওরা যেই ওপরের দিকে রওনা হয়েছে অমনি একদল চামচিকে সবাইকার মাথার ওপর চক্কর দিয়ে ঘুরতে লাগল। কিন্তু ওরা সে-সব কিছুই ভূক্ষেপ করলে না! হাজির হল গিয়ে দোতলার বিরাট বারান্দায়। সামনের একটা ঘর থেকে কেমন যেন গো-গো শব্দ শোনা যাচ্ছে। দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলে ফেলে সবাই একসঙ্গে ঢুকে পড়ল সেই ঘরে।
      কি আশ্চর্য ব্যাপার! 
     সেই সায়েবটাই তো! 
     লোকটার গোঁ আছে বলতে হবে। এই ভাঙা জঞ্জালে ভর্তি জনমানবহীন বাড়িতে ঢুকতে ওর এতটুকু ভয় করেনি। কিন্তু সায়েবটা যে অর্ধচেতন হয়ে পড়ে আছে—আর তারই মুখ থেকে ওই রকম একটা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে!
      শৈলেশ বললে, কি আশ্চর্য। টর্চটা জেলে সায়েব যেন কী লিখছিল! বুদ্ধ নিচু হয়ে বসে পড়ে মন্তব্য করলে, ডায়েরি দেখছি যে! সায়েব ডায়েরি লিখছিল! জনাৰ্দন বললে, তাজ্জব ব্যাপার! ডায়েরিটা তাহলে পড়ে দেখতে হয়! সেও নিচু হয়ে বসে পড়ল। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, পড়—পড়। সায়েব কি লিখতে লিখতে অজ্ঞান হয়ে গেছে—সেটা আগে জানা দরকার।
      জনাৰ্দন তখন ডায়েরি দেখে পড়তে লাগল— 
      ১২-১৫ মিঃ—অনেক কষ্টে ওপরে উঠে এসেছি। ভয়ের কিছুই নেই। শেয়াল আর চামচিকের আস্তানা হয়েছে বাড়িটা। ঠিক করেছি রাতটা এই ঘরেই কাটিয়ে দেব। বর্ষাতিটা ভালো করে মেঝেতে পেতে নিলাম। বেশ শীত করছে যেন! ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে দিলাম। টর্চটা জ্বালানোই থাকল।
     ১-২০ মিঃ—হয়তো একটু ঘুমই এসেছিল। হঠাৎ কিসের শব্দে চোখ মেলে তাকালাম। কি আশ্চর্য! ঘরের জানালাগুলো দড়াম-দড়াম করে খুলে যাচ্ছে। এর কারণ কি? জানালাগুলো আবার বন্ধ করলাম। 
       ১-৩০ মিঃ—একটা পৈশাচিক হাস্যে আবার চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি—জানালাগুলো আবার ভীষণ শব্দ করে খুলে যাচ্ছে! এবার সত্যি আশ্চর্য হলাম। উঠে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে। ক্ষীণ চাঁদের আলোতে বাইরেটা ভালো করে নজরে পড়ে না। পাশের ঘরে কি কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে?
      ১-৪৫ মিঃ—হঠাৎ ভেসে এল একটা বুক-ফাটা কান্নার শব্দ। তাকিয়ে দেখি–বন্ধ দরজা ভেদ করে একটি কঙ্কাল আসছে। কঙ্কালটা যেন দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকছে। কি কর্কশ কান্না! তাড়াতাড়ি কোমর থেকে রিভলভার বের করে কয়েকটা গুলি ছুড়লাম। ধোয়ায় ঘরটা ভর্তি হয়ে গেল। টর্চ তুলে দেখি, কঙ্কালটা আর ঘরের ভেতর নেই!
      ২-৫ মিঃ–এবার আর কান্না নয়—প্রচণ্ড খিলখিলে হাসি। তাকিয়ে দেখি, মাথার ওপর অনেকগুলি কঙ্কাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ঠান্ডা নিঃশ্বাস যেন আমার ঘাড়ে এসে লাগছে। মনে হচ্ছে, সেই জায়গাটা যেন জমে বরফ হয়ে গেল! তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠলাম মেঝে থেকে। প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলাম আমি নিজে। সেটা ভয় থেকে-না, ওদের ভয় দেখানোর জন্যে—নিজেই বুঝতে পারলাম না! হঠাৎ ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি-কঙ্কালগুলো যেন হাওয়ায় মিশে গেছে!
      ২-৩০ মিঃ—ঘুম চোখ থেকে একেবারে পালিয়ে গেছে! ভয়ানক শীত করছে আমার মনে হচ্ছে, যেন দাৰ্জিলিং কিংবা লন্ডনে আছি। গরমের কাল বলে সঙ্গে উলের কিংবা গরম জামা কিছু নেই। সবগুলো জানালা দিয়ে হু-হু করে শীতের হাওয়া আসতে লাগল। জানালাগুলো আবার বন্ধ করে দিলাম।
      ৩-১০ মিঃ—কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি জেগে আছি, না—ঘুমিয়ে পড়েছি? মনে হল শ্বেতশুভ্ৰ কঙ্কালগুলো আস্তে আস্তে পা টিপে-টিপে এসে আমার গায়ের ওপর একটি বরফের চাদর বিছিয়ে দিলে! আমি শত চেষ্টা করেও গা থেকে সে চাদর খুলে ফেলতে পারলাম না।
      .... কী কাল ঘুম যে এল আমার চক্ষে..কী প্রচণ্ড শীত..... ডায়েরিতে এই পর্যন্তই লেখা আছে। চার বন্ধু অবাক হয়ে ডায়েরির দিকে তাকিয়ে রইল। ওদিকে চৌকিদার এরই মধ্যে নীচে গিয়ে এক মগ জল সংগ্রহ করে এনেছে। সেই জল অজিলা করে নিয়ে সায়েবটির মুখে-চোখে ছিটিয়ে দিতেই সে দু'চোখ মেলে তাকাল। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। হা হা করে হেসে উঠল সেই সায়েব। সায়েবের গায়ে এত জোর যে ওরা চার বন্ধু মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারছে না। তারপরই তার দেহটা একেবারে নেতিয়ে পড়ল!
      কিছুক্ষণ বাদে এই বাড়িরই প্রাচীন বুড়ো দারোয়ান লাঠি ঠক্ ঠক্‌ করতে করতে এসে হাজির হল। সে এই ভূতুড়ে বাড়িটার কাছেই কোথায় যেন থাকে। এই বাড়িতে লোকজনের আনাগোনার শব্দ পেয়ে আর চিৎকার শুনে দেখতে এসেছে যে, আসল ব্যাপারটা কি !
      দারোয়ানের বয়স নাকি ১০৮ বছর। তার কাছেই সব কথা জানা গেল। এই জমিদার পরিবারে তিন পুরুষ আগে একজন নাকি ছিল খুব অত্যাচারী। হেন অন্যায় কাজ নেই—যা করতে তার হাত কাঁপত! একবার একদল দুর্ভিক্ষ-পীড়িত প্রজাকে অতি সামান্য কারণে ধরে এনে খেতে না দিয়ে দিনের পর দিন শুকিয়ে রেখে মেরে ফেলে। তারপর থেকেই এ বাড়িতে ভূতের উপদ্রব। শোনা যায়, সেই জমিদার নিজেও নাকি ভূতের হাতেই মারা পড়েছিল!
      কাহিনি শেষ করে সেই অতি বৃদ্ধ দারোয়ান আকাশের দিকে হাত তুলে বললে, নসিব! নসিব! সবই নসিব! নইলে এই পরদেশি সায়েব এখানে প্রেতাত্মার হাতে প্রাণ দিতে আসবে কেন ?....

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

      ছেলেবেলার স্মৃতি-জড়ানো বিরাট পাইন গাছটার সামনে এসে দাঁড়াল হানস্। কী দশাই হয়েছে গাছটার। স্নিগ্ধ, সবুজ পত্র-পল্লবের কোনো ঐশ্বর্যই আজ ...

      ছেলেবেলার স্মৃতি-জড়ানো বিরাট পাইন গাছটার সামনে এসে দাঁড়াল হানস্। কী দশাই হয়েছে গাছটার। স্নিগ্ধ, সবুজ পত্র-পল্লবের কোনো ঐশ্বর্যই আজ আর নেই তার দেহে, শুধু একটা মৃত শুষ্ক কাণ্ড হাড়গোড় বার করে দাঁড়িয়ে আছে! গাছটার দিকে চেয়ে চেয়ে চোখে জল এল হানস-এর। এই গাছের তলাতেই কবর দেওয়া হয়েছিল তার বাবা-মাকে। তাদের ছোট দুই ভাই-বোনকে রেখে মারা যান হানস্-এর বাবা ও মা—অল্পদিনের মধ্যেই, পর পর। বুড়ো দাদু ও দিদিমার কাছে মানুষ হয়েছিল হানস আর তার ছোট বোন লেনা। এই গাছের তলায় বসে দিনের-পর-দিন দাদু ও দিদিমা তাদের নিয়ে কত মজার মজার গল্পই না বলতেন! কিন্তু আজ সে দাদুও নেই, দিদিমাও নেই, আর আদরের সেই একমাত্র বোন লেনাও নেই—নেই মানে, বেঁচেই নেই নিশ্চয়! অতীতের শেষ স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে শুধু ঐ হাড়-বারকরা পাইন আর প্রাসাদসংলগ্ন বাগানের কারুকার্য করা লোহার গেটটা। বোমার মারাত্মক ধ্বংসলীলা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ঐ গেটটা যে কেমন করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার!
      হানস আর বেশিক্ষণ চেয়ে দেখতে পারল না এই ধ্বংসস্তুপ। একটা অসহ্য যন্ত্রণায় তার শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল; মাথা, কপাল আর গাল বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল অনর্গল। এই যুদ্ধ— এই তার পরিণতি! মানুষের সংসার-সুখ, ঘর-বাড়ি যদি নষ্ট হয়ে গেল, আপনার জন আত্মীয়স্বজন যদি সবই মরে-হেজে গেল; তাহলে আর রইল কি?—যুদ্ধে জয়লাভ হল আর না-হল, কি এসে গেল মানুষের তাতে!
      যুদ্ধ-শেষে দেশের বাড়িতে ফিরে এসে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল হানস্। অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল তাদের ধ্বংসাবশেষ প্রাসাদ ও আদ্যিকালের ঐ পাইন গাছটার দিকে। বাড়ির চেয়ে ঐ গাছটাই যেন সব চেয়ে বেশি আজ আকর্ষণ করছে তাকে। এত দিনের যুদ্ধে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত হানস চারিদিকের এই নিদারুণ দৃশ্য সত্যিই যেন আর সহ্য করতে পারল না—গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগল, চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। ‘কোলোন’-এ থাকার সময়ই যদিও হানস শুনেছিল তাদের দেশে বোমা পড়ার কথা, কিন্তু এ দৃশ্য সে কল্পনা করেনি। নতুন করে এখানে ঘর বাঁধবার আর সম্ভাবনা নেই—তাছাড়া টাকাই বা কোথা! যা ছিল, সবই জ্বলেপুড়ে ভেঙে-চুরে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে—পড়ে আছে শুধু ইট-কাঠ-লোহার বিক্ষিপ্ত ছোট-বড়ো কতকগুলো ন্তুপ!
      আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে, বিধ্বস্ত বাড়ির একটা খোলা অংশে গিয়ে বসে পড়ল হানস্। এখন একটু বিশ্রাম না নিলে আর চলতে পারা, এমন কি দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব নয় তার পক্ষে। বেলা পড়ে এসেছিল। আকাশের গায়ে কে যেন ভুসোর কালি ফেরাতে আরম্ভ করেছে, সন্ধ্যা হয় হয়। হানস তার হাতের রেন-কোটটা মাথায় দিয়ে ঐ দাওয়ার উপরেই নিজেকে ছড়িয়ে দিল। এই নিরালায়, চারিদিকের এই অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যেই কে যেন জোর করে শুইয়ে দিল তাকে।
      বাল্যকাল থেকেই অসীম সাহসী ছিল হানস, ভয় বলে কিছুই জানত না। এখানেও ভয় তার কিছুই করছিল না বটে, কিন্তু বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতি-জড়ানো এই বাড়িটার দুর্নিবার একটা মায়া আস্তে আস্তে কেমন যেন তাকে অভিভূত করে ফেলছিল তন্দ্রার মধ্যে।
      চোখ জুড়ে আসার মুখে, শুয়ে শুয়ে দাদু, দিদিমা ও লেনার কথা গভীরভাবে মনে পড়তেই হানস হঠাৎ দেখল, লেনা তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে।
      হানস লাফিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, একি, লেনা তুমি! বেঁচে আছ তাহলে?’ বলে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সেকহ্যান্ড করার জন্যে, কিন্তু লেনা একটু ব্যবধান রেখে সরে গিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ, আমি, দাদু ও দিদিমা আমরা সবাই আছি, কিন্তু এখানে নয়, অন্য দেশে!’
      হানস আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘দাদু-দিদিমাও বেঁচে তাহলে!—কোথায় তারা, এখুনি নিয়ে চলো তাদের কাছে আমায়! কিন্তু অন্য দেশে তোমরা চলে গেছ তো এখানে এ-সময় তুমি এলে কি করে?’
      তুমি এখানে এসেছ জানতে পেরেই আমি এলুম। এখন আমি সব জানতে পারি, সব করতে পারি ইচ্ছে করলে।’ লেনা বললে গম্ভীরভাবে।
      এ-কথার তাৎপর্য তলিয়ে দেখার অবসর হল না হানস্-এর। সে তাড়াতাড়ি বললে, সে কি অনেক দূর দেশ?
     যত দূরই হোক নিমেষে আমি তোমায় সেখানে নিয়ে যাব আবার নিমেষেই পৌছে দিয়ে যাব এখানে? বললে লেনা।
     এ-কথার উত্তরে হানস বিরক্তির সুরে বোকার মতো বললে, আবার পৌছে দিয়ে যাবে বলছ কেন? আমি আর যাব কোথায়, একসঙ্গেই তো থাকব আমরা সবাই?’
     তোমার সেখানে থাকা হবে না হানস্—তুমি শুধু দাদু-দিদিমাকে দেখেই চলে আসবে। তাড়াতাড়ি ঐ গাছটার উপরে উঠে বসবে চলো—আমার হাতে বেশি সময় নেই।’ বলে লেনা সেই পাইন গাছটার দিকে দেখিয়ে দিল।
     যন্ত্রচালিতের মতো লেনার সঙ্গে হানস শুকনো পাইন গাছটার উপর গিয়ে উঠে বসল। ওরা গাছে চড়ে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই এরোপ্লেনের মতো হুস হুস করে শূন্যে চলতে আরম্ভ করল গাছটা। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছটা এক জায়গায় এসে নাবতে আরম্ভ করল নীচের দিকে। নাববার মুখে লেনা বললে, ছেলেবেলা থেকেই তুমি তো খুব বীরপুরুষ, কিন্তু এখানকার সব দৃশ্য দেখে ভয় পেও না যেন!' তার কথা শেষ হতে-না-হতেই গাছটা ঝুপ করে এনে নাবিয়ে দিল তাদের এক বিস্ময়কর দেশে। শোঁ শোঁ শব্দে অনবরতই ঝড়ের বেগে হাওয়া বইছে এলোমেলো। চারিদিকে অস্বাভাবিক রকমের গাছপালা মাইলের পর মাইল জুড়ে অন্ধকার করে রেখেছে সারা দেশটা। মধ্যে মধ্যে তৃণাচ্ছাদিত জলাভূমিতে নানা ধরনের বীভৎস সব সরীসৃপ কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অসংখ্য রক্তপায়ী বাদুড় বিরাট বিরাট ডানা বিস্তার করে উড়ছে আর ঝটাপটি কামড়া-কামড়ি করছে পরস্পরে। ধোঁয়ার মতো এক ধরনের গ্যাস উঠছে চারিদিক থেকে। জলাভূমির মাঝে মাঝে জল ফুটছে টগবগ করে ...
    যত বীরপুরুষই হোক না কেউ, এ-দৃশ্য দেখে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। হানস জড়ানো গলায় বললে, ‘একি ব্যাপার! এখানে না আছে মানুষজন, না আছে মানুষের ঘর-বাড়ি—এখানে, এ কোন নরকপুরীতে নিয়ে এলে তুমি আমায়! শিগগির দাদু-দিদিমার কাছে নিয়ে চলো—তাদের সঙ্গে দুটো কথা বলেই আমি চলে যাব।’
     হানস-এর কথার উত্তরে লেনা এক রকমের অদ্ভুত হাসি হেসে বললে, ঘর-বাড়ি, মানুষজন সবই আছে এখানে, তবে তুমি দেখতে পাবে না—দেখলে আরো ভয় পেতে!’
      আচ্ছা বেশ, এখন ওঁদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি দেখাটা করিয়ে দাও—আর এক মুহুৰ্তও আমি থাকতে পাচ্ছি না এখানে তীব্র বিরক্তি হানস্-এর কথায়।
      ‘এসো আমার সঙ্গে।’ বলে একটা জলার পাড়ে হানসকে নিয়ে গেল লেনা। দূর থেকে ইঙ্গিত করে বললে, “ঐ দেখ দিদিমাকে।
      হানস দেখলে বুড়ি দিদিমা একটা লাঠির উপর ভর দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হানস সেদিকে যাবার জন্যে চেষ্টা করতেই লেনা ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, যেও না—যেও না ওদিকে, বিপদে পড়বে; তাছাড়া বুড়ি এখন মানুষও চিনতে পারে না, কথাও বন্ধ হয়ে গেছে!—দুজনেরই ঐ একই অবস্থা!".
      দাদু, দাদু কোথায়?’ বলে হানস মরিয়া হয়ে উঠল তাকে দেখবার জন্যে। 
      লেনা আর এক দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, “ওই দেখ দাদু বসে বাইবেল পড়ছে এক মনে। ওরও ‘শেল-শকে’ কথা বন্ধ হয়ে গেছে, লোক চেনারও ক্ষমতা নেই, আর কান তো গিয়েছিল আগে থেকেই!’
      কী বলছ তুমি!’ বলেই হানস লেনার কাছ থেকে ছুটে যেই বুড়োর দিকে যাবে, হঠাৎ দেখে বুড়ো-বুড়ি দুজনেই অন্তর্ধান! কেউ কোথাও নেই; শুধু দুটো রক্ত-চোষা বাদুড় ঝটপট করে উড়ে গেল সেখান থেকে।
      ‘হা হা হা!” বিকট ভাবে হেসে উঠল লেনা। 
      ‘এ কী সব কাণ্ড তোমার—কোথায় নিয়ে এলে তুমি...' কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করেই হানস যেন হাঁফাতে লাগল। তার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে!
      হানস্-এর কাছ থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল লেনা। এই কথার পর সে হানস-এর আরো কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। ভারী বিশ্রী দেখাচ্ছে লেনাকে এখন। ক্রমশই তার স্বাভাবিক চেহারাটা বদলাতে বদলাতে এখন যেন কেমন একটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে! রঙটা বদলাতে বদলাতে হয়ে আসছে যেন পোড়া কাঠের মতো! যুদ্ধ-ফেরত সাহসী জার্মান-সন্তান হানস মায়ের পেটের বোনের চেহারার এই ভয়াবহ পরিবর্তন দেখে ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। দুটো হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে সে চিৎকার করে উঠল, লেনা তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি আমায় বাঁচাও—এ আমি সহ্য করতে পারছি না!".
     কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকার পর লেনা কথা বললে। গলাটাও তখন তার অস্বাভাবিক রকম বদলে গেছে। সোজাসুজি লেনা বললে, শোন হানস, তুমি ভয় পেও না, আমরা কেউই আজ আর বেঁচে নেই—সকলেই মৃত! যুদ্ধ যখন আমাদের দোরগোড়ায় এসে পড়ল, চারিদিকে যখন বোমা পড়ে লোক কুকুর-বেড়ালের মতো মরতে লাগল ‘ডুরেনে’, সব যখন ধ্বংসের মুখে, আত্মরক্ষার আর কোনো উপায়ই রইল না যখন, তখন বুড়ো দাদু ও দিদিমা নিরুপায় হয়ে আমায় অনুরোধ করলেন তাদের বিষ দিতে। কারণ তারা দেখলেন, এ বয়সে তারা বেঁচে থেকে যদি আমি মরে যাই তো তাদের আর দুৰ্গতির শেষ থাকবে না, আর সেটা হবে তাদের মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণার। তাঁদের প্রস্তাবে শেষ পর্যন্ত আমি রাজি হই, এবং ঠিক করি, ওঁদের বিষ দেওয়ার পর আমি নিজেও বিষ খাব। এই ঠিক করে আমাদের যা পুরোনো মূল্যবান সোনাদানা ও জুয়েলারি ছিল, যার দাম হবে প্রায় পাঁচ-সাত লক্ষ টাকা, তা সবই বাগানের ঐ পাইন গাছের তলায় পুতে ফেলি। কিন্তু পুঁতে ফেলার আগে তার একটা লিস্ট খামের ভিতর পুরে সীল করে আমাদের পুরোনো মালী লিসেনভগকে দিয়ে দিই তুমি ফিরে এলে দেবার জন্যে। লিসেনভগ এখান থেকে পালিয়ে যায় আত্মরক্ষার জন্যে।
      তারপর যখন সত্যিই আর আমাদের বাঁচার কোনো উপায় নেই দেখি, তখন একদিন রাত্রে দাদু ও দিদিমাকে আমি নিজের হাতে বিষ তুলে দিই! কিন্তু সেই বিষ নিজে খেতে যাবার আগেই আমাদের বাগানের পাশে বোমা পড়ে এবং তারই ধাক্কায় আমাদের হাত থেকে বিষের গ্লাস পড়ে যায়। কিন্তু পাঁচ মিনিট না যেতে-যেতেই আবার বোমা পড়ে, এবং এবার ঠিক আমাদের বাড়ির উপরেই। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি-ঘর হুড়মুড় করে সব ভেঙে পড়ে আগুন জ্বলে ওঠে চতুর্দিকে! আমি প্রাণ নিয়ে পালাতে গিয়ে দাদু-দিদিমার সঙ্গেই পুড়ে মরি এই বাড়িতে! উঃ, সে কী ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা!
      ‘এখন তুমি ফিরে এসেছ দেখে, ঐ মূল্যবান ধনরত্ব যাতে তোমার হাতে পড়ে সেই খবরটাই দিতে এসেছি—থাকতে পারিনি!—আজ আমি মৃত! আমি মৃত! হানস আজ আমি মৃত!’ বলে শেষের দিকে বিকট চিৎকার করে কেঁদে উঠেই অদৃশ্য হয়ে গেল লেনা হানস-এর চোখের সামনে। যেমন হঠাৎ তার আবির্ভাব হয়েছিল,তেমনি অকস্মাৎ সে মিলিয়ে গেল!
      গাঢ় ঘুমের মধ্যেই ঐ চিৎকারে কর্ণপটহ যেন ছিড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল হানস-এর। লাফিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল সে। একবার ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখল চারিদিক। সে যেখানে ছিল সেইখানেই আছে। সারা আকাশ কুয়াশায় ঢেকে থাকলেও তার বুঝতে বাকি রইল না যে ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। সারা গায়ে তখনও ভীতির কাঁটা। এটা যে স্বপ্ন তা কিছুতেই ভাবতে পারছিল না হানস্। এত স্পষ্ট, চাক্ষুষ দেখার মতো এত জীবন্ত কি কখনো স্বপ্ন হয়! পাইন গাছের তলায় লুকোনো ধনরত্বের কথা মনে হতেই সে চাইল বাগানের দিকে। এখান থেকে সোজাসুজিই গাছটাকে দেখা যাচ্ছিল। এতে চড়েই তো গিয়েছিল সে লেনার সঙ্গে। এখনও কিন্তু ঠিক তেমনিই দাঁড়িয়ে আছে শুকনো পাইনের কঙ্কালটা, যেমন ছিল আগের দিন বিকালের দিকে। লেনার কথা মতো ওরই তলায় যদি পোতা থাকে তাদের সমূহ ঐশ্বর্য তাহলে তো সবটাই সত্যি হয়ে যায়! একবার ভাবল হানস্।
      এমনি সব ভাবতে ভাবতে হানস গাছটার দিকে যাবে বলে যেই উঠেছে, এমন সময় তার চোখের উপর ভেসে উঠল আর এক ভয়াবহ দৃশ্য। এই অদ্ভূত ভূতুড়ে গাছের কাণ্ড দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না হানস্। দেখে, তাদের সেই বিশ্বস্ত পুরোনো মালী লিসেনভগ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে, আর তার পিছু পিছু তাড়া করে ছুটছে ঐ শুকনো ভূতুড়ে পাইন! এক ভয়াবহ স্বপ্নকে সম্পূর্ণ সত্য বলে বিশ্বাস করে নেবার পূর্বেই আর এক সত্য স্বপ্নের মতোই ভেসে উঠল হানস্-এর চোখের সামনে!
      দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে সাহসী হানস ভাবতে লাগল, তাহলে কি লিসেনভগ সেই খাম খুলে আজই ধনরত্ব আত্মসাৎ করার জন্যে পাইন গাছের তলা খুঁড়তে এসেছিল?


গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF