Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

উপনিষদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

এক সময় প্রজাপতি বলেছিলেনঃ যে আত্মা নিষ্পাপ, জরাবিহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন, পিপাসাহীন, সত্যকাম ও সত্যসংকল্প, সেই আত্মারই সন্ধান করব...

এক সময় প্রজাপতি বলেছিলেনঃ
যে আত্মা নিষ্পাপ, জরাবিহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন, পিপাসাহীন, সত্যকাম ও সত্যসংকল্প, সেই আত্মারই সন্ধান করবে। আর সেই আত্মাকে জানবার জন্যেও সতত আগ্রহ থাকা উচিত। যিনি শাস্ত্র ও আচার্যের নিকট থেকে এই আত্মার পরিচয় পেয়ে তদনুযায়ী তাকে বিশেষ রূপে অনুভব করেন, তার সমস্ত কামনাই পূর্ণ হয়।’
প্রজাপতির এই উপদেশ দেবলোক ও দৈত্যলোকে সমানভাবে প্রচারিত হল। সবাই বুঝলেন আত্মাকে জানতে পারলেই, অর্থাৎ আত্মজ্ঞান করতে পারলেই চরম সুখভোগ করা সম্ভব । তাই দেবতারা ভাবলেনঃ যে আত্মাকে অনুসন্ধান করলে সকল লোক ও সকল কাম্য-বস্তু পাওয়া যায় আমাদের তারই অনুসন্ধান করা উচিত।”
এই ভেবে দেবতারা ইন্দ্রকে পাঠালেন প্রজাপতির নিকট আত্মজ্ঞান শিখে আসার জন্যে। ইন্দ্রও সন্ন্যাস গ্রহণ করে প্রজাপতির নিকট উপস্থিত হলেন।

ওদিকে অসুররাও ভোগসুখে অত্যন্ত উৎসাহী। তারা ভাবল, আত্মজ্ঞান শিখলে যদি সকল কাম্য-বস্তুই পাওয়া যায়, তবে তারাই বা বঞ্চিত হবে কেন? তারা পাঠাল তাদের রাজা বিরোচনকে প্রজাপতির কাছে। বিরোচনও সন্ন্যাস গ্রহণ করে আত্মজ্ঞান লাভের জন্য প্রজাপতির নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন।


ইন্দ্র ও বিরোচন দুজনে অপরের অজ্ঞাতে যজ্ঞকাষ্ঠের বোঝা নিয়ে প্রজাপতির আশ্রমে পৌছলেন। প্রজাপতি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, কাউকে কিছু বল্লেন না। তারা উভয়েই প্রজাপতির আশ্রমে আছেন এবং শিষ্যের মতো প্রজাপতির সেবা করছেন।
ক্ৰমে প্রজাপতির আশ্রমে উভয়ের বত্রিশ বৎসর ব্রহ্মচর্যবাস সম্পূর্ণ হল। ইন্দ্র ও বিরোচন একসঙ্গে আছেন। তাদের মধ্যে জন্মগত শত্ৰুতা থাকলেও বিদ্যালাভের আগ্রহে উভয়েই তা ভুলে গিয়ে বন্ধুভাবে বাস করছেন।

তখন একদিন প্রজাপতি তাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ কি প্রযোজনে তোমরা এতদিন এখানে বাস করলে ?” দীর্ঘ বত্রিশ বছর তারা ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে বাস করছেন—অথচ তাদের আগমনের উদ্দেশ্য পর্যন্ত গুরুকে বলা হয়নি। তাঁদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা বুঝি সফল হতে চলেছে—গুরু বুঝি প্রসন্ন হয়েছেন, এবার কৃপা করবেন।

তাঁরা দুজনেই বললেনঃ আপনি বলেছেন, যে আত্মা নিম্পাপ, জরাবিহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন, পিপাসাহীন, সত্যকাম ও সত্যসংকল্প, সেই আত্মারই সন্ধান করবে। আর সেই আত্মাকে জানবার জন্য সতত আগ্রহ থাকা উচিত। যিনি শাস্ত্র ও আচার্যের নিকট থেকে এই আত্মার পরিচয় পেয়ে তদনুযায়ী তাকে বিশেষরূপে অনুভব করেন, তার সমস্ত কামনাই পূর্ণ হয়। আমরা সেই আত্মাকে জানবার উদ্দেশ্যেই এতকাল ব্রহ্মচর্য পালন করে আপনার আশ্রমে বাস করছি।’
ব্রহ্মা ভাবলেন—এরা বত্রিশ বৎসর আমার আশ্রমে থেকে ব্রহ্মচর্য আচরণ করছে—এদের অন্তর নিশ্চয়ই নির্মল হয়েছে। এই ভেবে তিনি তাদের আত্মজ্ঞান শিক্ষা দিলেন। তিনি বললেনঃ
চক্ষুতে যে পুরুষকে দেখা যায়, তিনিই আত্মা,—আত্মা মৃত্যুহীন, ভয়হীন। ব্রহ্মার কথা শুনে ইন্দ্র ও বিরোচন উভয়েই ভাবলেন, চক্ষুর দিকে তাকালে তো আমাদের ছায়া দেখা যায়—তবে ঐ ছায়াই কি আত্মা? এই ভেবে তারা দুজনেই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেনঃ জলে এবং দর্পণে যে পুরুষকে দেখা যায় তাদের মধ্যে কোনজন আত্মা? প্রজাপতি বললেনঃ এই সমস্ত কিছুর মধ্যে যাঁকে দেখা যায়, তিনিই আত্মা।’ প্রজাপতি বললেন বটে, কিন্তু মনে মনে বুঝলেন যে এতদিন ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেও তাদের মন নির্মল হয়নি—তাই তারা প্রকৃত আত্মাকে বুঝতে পারেনি, তারা বুঝেছে ছায়াই বুঝি আত্মা।
ইন্দ্র এবং বিরোচন কিন্তু সত্যি সত্যি ছায়াকেই আত্মারূপে বুঝে মনে করেছিলেন, তারা সব বুঝে ফেলেছেন। স্পষ্ট করে প্রজাপতি তাদের ভুল ভাঙালেন না; কারণ তারা বত্রিশ বছর এত কষ্ট সহ্য করে যদি জানতে পারে যে, সব বুঝেছে, তবে হয়তো তারা হতাশ হয়ে পড়বে। তাই সোজাসুজি তাদের হতাশ না করে দিয়ে প্রজাপতি আসল ব্যাপারটা অন্য ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি তাদের একপাত্র জল আনতে বললেন। জল নিয়ে এলে পর প্রজাপতি তাদের বললেনঃ

জলের দিকে তাকিয়ে দেখ তো—কি দেখা যায়?
তারা উভয়ে জলের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
নখ, চুল-সমেত আমাদের ছায়াই তো দেখতে পাচ্ছি।’
তখন প্রজাপতি বললেনঃ নখ, চুল কেটে উৎকৃষ্ট বসন-ভূষণ পরে এসে জলের দিকে তাকিয়ে বল তো, কি দেখতে পাচ্ছ? প্রজাপতির আদেশে তারা ঐভাবে তৈরি হয়ে এসে জলের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ জলের মধ্যে আমাদের সাজগোজ-করা রূপই দেখতে পাচ্ছি।’ প্রজাপতি একটু নীরব থেকে বললেনঃ
ইনিই আত্মা।’ ইন্দ্র আর বিরোচন একটু ধীর স্থির ভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারতেন যে ছায়া আত্মা হতে পারে
না। কারণ পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তনে ছায়ার পরিবর্তন হয়—কাজেই ছায়া আত্মা হতে পারে না। কারণ আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না।
কিন্তু ইন্দ্র এবং বিরোচন উভয়েই এই ভুল করলেন। তারা আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন ভেবে প্রফুল্ল হয়ে ব্রয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন।
যেতে যেতে বিরোচন ভাবছেনঃ
‘প্রজাপতি তো শিখিয়ে দিলেন ছায়াই আত্মা। এখন ছায়া তো দেহ থেকেই হয়—তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেহই আত্মা।’
যা বোঝা, তাই কাজ।
‘প্রজাপতির কাছ থেকে আত্মজ্ঞান শিখে এসেছি—দেহই আত্মা, কাজেই দেহেরই পূজা করবে। তাতেই ইহলোক এবং পরলোকে সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।’
ইহাই অসুরদের উপনিষদ। খাও, দাও আর স্ফূর্তি কর—এই মন্ত্রই শিখল অসুররা—আর এই ভুল আত্মজ্ঞান শিখবার ফলে, তারা কোনো দিনই আর কাম্য-বস্তুর সন্ধান পেল না।
এদিকে ইন্দ্রও বিরোচনের মতোই প্রফুল্লচিত্তে আত্মজ্ঞান শিখেছেন ভেবে স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন। পথে যেতে যেতে ইন্দ্রও ভাবছেন—ছায়াই বুঝি আত্মা। পরেই মনে হল—ছায়ার তো পরিবর্তন হয়, ছায়া নষ্টও হয়ে যেতে পারে—কিন্তু আত্মার তো পরিবর্তন হয় না, নষ্টও হয় না। তাহলে ছায়া আত্মা হয় কিভাবে ? ইন্দ্রের মনে খটকা লাগল।
হাজার হোক, ইন্দ্র দেবতা—অসুরদের অপেক্ষা তার বুদ্ধি অনেক নির্মল। তাই তার মনে সংশয় জাগতেই বুঝতে পারলেন–তাঁর আত্মজ্ঞান শিক্ষা হয়নি।
আবার যজ্ঞের কাঠ মাথায় নিয়ে তিনি পৌছুলেন প্রজাপতির আশ্রমে। প্রজাপতি ইন্দ্রকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেনঃ
আত্মজ্ঞান শিখে প্রফুল্লচিত্তে বিদায় নিয়ে গেলে—আবার ফিরে এলে কেন?’
ইন্দ্র তাঁর মনের সংশয় জানালেন প্রজাপতিকে ।
প্রজাপতি বললেনঃ বেশ, তাহলে আরো বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে এখানে থাক। চিত্ত আর একটু নির্মল হোক—
তখন তোমাকে আত্মজ্ঞান শিক্ষা দেব।’
ইন্দ্র আত্মজ্ঞান না শিখে স্বর্গে ফিরে যাবেন না—তার জন্যে যদি আরো বত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়, তাতেও তিনি প্রস্তুত। কাজেই প্রজাপতির প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ইন্দ্র আরো বত্রিশ বছর প্রজাপতির আশ্রমে বাস করে গুরুর সেবা করলেন। বত্রিশ বছর পর ব্রহ্মা আবার ইন্দ্রকে আত্মজ্ঞান শিক্ষা দিলেন। ইন্দ্র আত্মজ্ঞান শিক্ষা করে প্রফুল্লচিত্তে স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন, কিন্তু পথে গিয়ে তাঁর মনে সংশয় জাগল। তিনি আবার ফিরে এলেন প্রজাপতির আশ্রমে।

আবার বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে আত্মজ্ঞান শিক্ষা করে ইন্দ্র যখন স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন, তখন মনে হল—এখনো হয়নি, এখনো মনে সংশয় জাগছে—পরিপূর্ণ সুখ অনুভব করতে পারছেন না। ইন্দ্র ফিরে এলেন প্রজাপতির আশ্রমে। এবার আরো পাঁচ বছরের জন্য তাকে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে থাকতে হল। মোট একশ’ এক বছর ব্রহ্মচর্য আচরণ করে গুরুগৃহে থেকে যখন ইন্দ্রের চিত্ত একেবারে নির্মল হল, তখনই তিনি প্রকৃত আত্মজ্ঞান লাভ করলেন। ইন্দ্রের জীবন ধন্য হল,—তার গুরুগৃহে বাস, ব্রহ্মচর্য ধারণ সার্থক হল। আত্মজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি অভয় অমৃত পুরুষকে লাভ করলেন। প্রজাপতিকে প্রণাম করে ইন্দ্র আত্মজ্ঞানের অধিকারী হয়ে দেবভূমিতে ফিরে এলেন।

সেকালে গৌতমবংশীয় আরুণি নামে এক ঋষি ছিলেন–তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। পিতা যেমন বেদবিদ ছিলেন, পিতার নিকট শিক্ষা লাভ করে পুত্র শ্বেতকেতুও সেই...

সেকালে গৌতমবংশীয় আরুণি নামে এক ঋষি ছিলেন–তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। পিতা যেমন বেদবিদ ছিলেন, পিতার নিকট শিক্ষা লাভ করে পুত্র শ্বেতকেতুও সেইরূপ বেদবিদ হয়ে উঠেছেন। অল্পবয়সে এভাবে বেদশাস্ত্রে দক্ষতা লাভ করে শ্বেতকেতুর মনে বেশ অহঙ্কার হল। তিনি ভাবলেন, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে বড় বড় জ্ঞানীদের তর্ক করে, বিচার করে জয়ী হয়ে যশের মাল্য নিয়ে ফিরবেন ঘরে। এই ভেবে শ্বেতকেতু প্রথমেই যাত্রা করলেন পাঞ্চাল দেশের দিকে। সেকালে নানাবিধ বিদ্যাচর্চার জন্য পাঞ্চল দেশের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল, এই কারণেই শ্বেতকেতু সর্বপ্রথম পাঞ্চালে গিয়েই উপনীত হলেন।
জীবল রাজার পুত্র রাজা প্রবাহণ ছিলেন তখন পাঞ্চাল দেশের রাজা। তার রাজসভায় আশ্রয় পেতেন বহু জ্ঞানী-গুণী। শ্বেতকেতু ভেবেছিলেন, রাজা এবং রাজসভাস্থিত পণ্ডিতদের সহজেই বিচারে পরাজিত করে তারপর অন্য দেশে যাবেন। এই ভেবে তিনি সরাসরি একেবারে রাজসভায় এসে উপস্থিত হলেন।
আরুণি ঋষির পুত্র শ্বেতকেতু বেদবিদ্যা শিখে খুবই আত্মাভিমানী হয়ে উঠেছেন—এ সংবাদ রাজা প্রবাহণ আগেই শুনেছিলেন। এক্ষণে তাকে নিজের রাজসভায় উপস্থিত হতে দেখে রাজার ইচ্ছা হল—শ্বেতকেতুর বিদ্যার বহর কত, একটু যাচাই করে দেখবেন।
তাই শ্বেতকেতু রাজার সম্মুখে পৌছানো মাত্রই রাজা তাকে যথোচিত সংবর্ধনা করে জিজ্ঞেস করলেনঃ ঋষিকুমার! আপনি কি আপনার পিতার নিকট থেকে সমস্ত বিদ্যা শিখে নিয়েছেন?’

রাজার সরাসরি প্রশ্নে ঋষিকুমার একটু বিব্রত হলেন, বিরক্তও হলেন। তবু মনের ভাব গোপন রেখে বাইরে যথাসম্ভব বিনয়ী হয়ে বল্লেনঃ
হা মহারাজ! পিতা সকল বিষয়েই আমায় যথাযোগ্য উপদেশ দিয়েছেন।” 
ঋষিকুমারের উত্তর শুনে রাজা মনে মনে হাসলেন। তারপর রাজা প্রবাহণ জন্মমৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে শ্বেতকেতুকে পর পর পাঁচটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। এখন এই প্রশ্নগুলি হল ব্রহ্মবিদ্যা সম্পর্কিত। শ্বেতকেতু পিতার নিকট থেকে বেদবিদ্যাই শিখেছিলেন—ব্রহ্মবিদ্যা কিছুই জানতেন না। কিন্তু তথাপি তার মনে অহমিকা ছিল যে তিনি সর্ববিদ্যাবিশারদ হয়ে উঠেছেন।
রাজার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরেই মাথা নুইয়ে রাজসভার সামনে দাঁড়িয়ে শ্বেতকেতুকে বলতে হলঃ
‘আমি এর উত্তর জানিনে মহারাজ।’
লজ্জায় শ্বেতকেতুর মাথা হেট হয়ে গেল। এত জাঁক করে এসেছিলেন, কিন্তু রাজার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলেন না। শ্বেতকেতু যে কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারবেন না—এতটা হয়তো রাজা প্রবাহণও বুঝে উঠতে পারেননি। তাই বিস্মিত হয়ে বল্লেনঃ
এই বিদ্যা নিয়ে আপনি দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন ঋষিকুমার! আমার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলেন না, অথচ আপনার বিদ্যার বড়াই তো শুনে আসছি বহুকাল। যে সর্ববিষয়ে বিশারদ নয়, সে কি করে আপনাকে সর্ববিদ্যাবিদ বলে পরিচয় দেয় ?”
রাজার টিটকারিতে শ্বেতকেতুর ইচ্ছা হল তিনি যেন মাটির সঙ্গে মিশে যান। সভাসুদ্ধ লোকের সামনে এমনি ভাবে অপমানিত হয়ে লজ্জায়, দুঃখে, ক্ষোভে শ্বেতকেতু রাজসভা ত্যাগ করলেন।
ধীরে ধীরে শ্বেতকেতু ফিরে এলেন পিতার আশ্রমে—অভিমানে তাঁর কণ্ঠ বাপরুদ্ধ। পিতার সঙ্গে দেখা হতেই শ্বেতকেতু বললেন সমস্ত কাহিনি। কী ভাবে ক্ষত্রিয় রাজা প্রবাহণ তাঁকে পাঁচ পাঁচটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন–কিন্তু শ্বেতকেতু কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেননি। সভাশুদ্ধ লোকের সামনে তাকে রাজার ধিক্কার সইতে হল—অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হল রাজসভা ছেড়ে। সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে শ্বেতকেতু বললেনঃ
পিতা, আপনি তো আমাকে সর্ববিদ্যা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তবে আমি রাজার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলাম না কেন ??
আরুণি একে একে প্রশ্নগুলি শুনলেন পুত্র শ্বেতকেতুর মুখে। 
তারপর বললেনঃ বৎস তোমার কোনো দোষ নেই। রাজা তোমাকে যে সমস্ত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন, আমি নিজে তার একটিরও উত্তর জানিনে। আর আমি জানতাম না বলেই তোমাকেও শেখাতে পারিনি।’
পিতার কথা শুনে শ্বেতকেতু বুঝলেন, পিতা তাকে ঠকাননি। এতে শ্বেতকেতু কিছুটা শান্ত হলেন, কিন্তু আরুণি মনের শান্তি হারালেন। তিনি বুঝলেন—তাঁকেও ব্রহ্মবিদ্যা শিখতে হবে, আর শিখতে হবে, রাজা প্রবাহণের কাছেই। ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয়ের নিকটই তাকে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হবে—এ বিষয়ে মনের মধ্যে কোনো অহংকার পুষে রাখলে ব্রহ্মবিদ্যা শেখা হবে না।
এই ভেবে অন্তরে শ্রদ্ধা নিয়ে আরুণি ঋষি রাজা প্রবাহণের রাজসভায় গিয়ে উপনীত হলেন। রাজা ঋষিকে রাজসভায় উপস্থিত দেখে যথাযোগ্য সংবর্ধনা জানালেন।

পরদিন প্রভাতে রাজা ঋষিকে বললেনঃ
ভগবান, মানুষের প্রিয় যে কোনো বস্তুর জন্য আপনি আমার নিকট বর গ্রহণ করুন।
প্রিয় বস্তু আর বিত্ত দিয়ে কি হবে! ঋষির মন ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে—বিত্তের প্রতি তার কোনো লালসাই নেই। 
তাই তিনি বললেনঃ মানুষের প্রিয় বিত্ত আপনারই থাক মহারাজ। আমার অন্য প্রার্থনা আছে।
আশ্চর্য হয়ে রাজা বললেনঃ“কি সে প্রার্থনা ভগবান ?’
তখন আরুণি বললেনঃ ‘মহারাজ, আপনি আমার পুত্র শ্বেতকেতুকে যে বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, সেই ব্রহ্মবিদ্যা আমায় দান করুন।’
ঋষির কথায় রাজা প্রবাহণ একটু চিন্তিত হলেন—কারণ এতকাল পর্যন্ত এই পবিত্র বিদ্যা শুধু রাজারাই জানতেন; ব্রাহ্মণ বেদবিদ্যা পর্যন্ত জানতেন, কিন্তু জানতেন না শুধু ব্রহ্মবিদ্যা। এক্ষণে মহর্ষি প্রার্থনা করছেন, তাকে ফিরিয়ে দেবার জো নেই। এতকাল পর্যন্ত যা শুধু ক্ষত্রিয়ের জ্ঞাত ছিল, এখন তা ব্রাহ্মণেরও আয়ত্ত হবে—এই ভেবে রাজা চিন্তিত হয়েছিলেন। কিন্তু আরুণিকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। 
তাই বললেনঃ আপনাকে আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীর্ঘকাল এখানে বাস করতে হবে—তবেই অপর ব্রাহ্মণের অজ্ঞাত এই ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারী হতে পারবেন।”
ঋষি এই বিষয়ে তৈরি হয়েই এসেছেন। তিনি সর্ব অহংকার বিসর্জন দিয়ে, শ্রদ্ধাযুক্ত মন নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা করলেন। ক্ষত্রিয়ের গুপ্তবিদ্যা এই ভাবে প্রথম ব্রাহ্মণও শিখে নিলেন।

বিদেহ রাজ্যের রাজা জনক। জনক শুধু রাজা হিসাবে সে যুগে শ্রেষ্ঠ ছিলেন না, তিনি ছিলেন সেকালের একজন শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ। সেই জন্যই লোকে তাকে বলতো র...

বিদেহ রাজ্যের রাজা জনক। জনক শুধু রাজা হিসাবে সে যুগে শ্রেষ্ঠ ছিলেন না, তিনি ছিলেন সেকালের একজন শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ। সেই জন্যই লোকে তাকে বলতো রাজর্ষি। সেকালের বড় বড় পণ্ডিত, মুনি এবং ঋষিরাও ভাবতেন যে জনক রাজার সঙ্গে কিছু শাস্ত্রচর্চা না করলে তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই প্রত্যহই কয়েকজন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী জনকের রাজসভায় উপস্থিত থাকতেন।
একবার জনক রাজা এক বিরাট যজ্ঞ করলেন; যজ্ঞ যেমন বিরাট, তার দক্ষিণাও ছিল তেমনি প্রচুর— তাই যজ্ঞের নামই ছিল বহু-দক্ষিণ যজ্ঞ। সেই যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কুরু, পাঞ্চাল এবং বিদেহ দেশের বড় বড় পণ্ডিত এবং মুনি-ঋষিগণ।

যজ্ঞ তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় জনক রাজার এক অদ্ভুত খেয়াল হল। তিনি ভাবলেনঃ
‘আমার যজ্ঞসভায় এত এত ব্রহ্মবিদ এসেছেন—তাদের মধ্যে কে সর্ববিষয়ে শ্রেষ্ঠ, তা তো বুঝা হল না!”
অথচ সোজাসুজি এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেসও করা যায় না। তাই জনক রাজা এক অদ্ভুত ব্যবস্থা করলেন। তিনি এক হাজার উৎকৃষ্ট গাভি বাছাই করলেন, তারপর তাদের শিং সোনায় মুড়িয়ে দিয়ে তাদের যজ্ঞশালার কাছাকাছি এক জায়গায় বেঁধে রাখলেন। তারপর সমবেত মুনি-ঋষিদের লক্ষ করে জোড়হস্তে বললেনঃ
আপনারা সবাই বেদবিদ ও ব্রহ্মবিদ। আপনাদের মধ্যে কে বড় কে ছোট—আমি জানিনে, বিচার করবার দুঃসাহসও আমার নেই। যিনি আপনাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ, ব্রহ্মিষ্ঠ, তিনি ঐ সহস্র স্বর্ণশৃঙ্গ গাভিদের গ্রহণ করে আমায় কৃতাৰ্থ করুন।

জনকের কথা শুনে সমবেত মুনি-ঋষিরা স্তদ্ধ হয়ে গেলেন। কার এত বড় বুকের পাটা যে নিজেকে ব্রহ্মিষ্ঠ বলে পরিচয় দেবে! আর জনকেরই বা কী সাহস যে এরূপ প্রস্তাব করেন!
সবাই নীরব—সভায় টু শব্দটিও নেই। সবাই মাথা নুইয়ে বসে আছেন, আর ভাবছেন—কে উঠে দাঁড়াবেন।
যজ্ঞ-সভার এক প্রান্তে বসেছিলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। ধীরে ধীরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সমবেত সবাই তাকিয়ে দেখলেন—দীর্ঘদেহ সৌম্য শাস্ত জটামণ্ডিত-শির এক জ্যোতির্ময় ব্রাহ্মণ তাঁর শিষ্য সামশ্রবকে আদেশ
করছেনঃ
সামশ্রব, ঐ ধেনু সহস্ৰকে আমার আশ্রমে নিয়ে যাও।
সভাশুদ্ধ লোক চমকে উঠল । কী দুঃসাহস—এতগুলি বেদবিদ ব্রহ্মবিদ ব্রাহ্মণের মধ্যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে পরিচয় দেয় যাজ্ঞবল্ক্য!
সমস্বরে চিৎকার উঠলঃ
'যাজ্ঞবল্ক্য! তুমি কি ব্রাহ্মিষ্ঠ বলে নিজের পরিচয় দিচ্ছ?
যাজ্ঞবল্ক্য জোড়হাতে সবাইকে প্রণাম জানিয়ে বললেনঃ
ব্রাহ্মিষ্ঠের চরণে শতকোটি প্রণাম।
জনকের পুরোহিত ছিলেন অশ্বল। রাজার পুরোহিত বলে অহঙ্কারও ছিল তার যথেষ্ট। তিনি ভেবেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ঐ সমস্ত গাভি নিশ্চয় তারই গোশালায় ঠাঁই পাবে। কিন্তু যখন দেখলেন যে যাজ্ঞবল্ক্যের শিষ্য সামশ্রব গাভিগুলির বাঁধন খুলছেন, তখন আর তার সহ্য হল না। তিনি সবার আগে উঠে দাঁড়িয়ে যাজ্ঞবল্ক্যকে লক্ষ করে বললেনঃ
কি হে যাজ্ঞবল্ক্য, তুমিই কি আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ।
ব্রহ্মিষ্ঠের চরণে আমার শতকোটি প্রণাম। আমার ধেনুর প্রয়োজন ছিল মাত্র।
এই উত্তেজিত ব্রাহ্মণমন্ডলীর মধ্যে একমাত্র যাজ্ঞবল্কাই ধীর, শান্ত। জনকের মনে হল—গাভিগুলি হয়তো যোগ্য পাত্রেই পড়েছে।
অশ্বল কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তরে খুশি হলেন না। তিনি সভার মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যকে অপদস্থ করবার ইচ্ছায় তাকে এমন কতগুলি প্রশ্ন করলেন, যা যাজ্ঞবল্ক্যের জানবার কথা নয়। অথচ কি আশ্চর্য, যাজ্ঞবল্ক্য অবলীলাক্রমে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন।  নিজে অপদস্থ হয়ে অশ্বল বসে পড়লেন।
অশ্বলকে পরাজিত হতে দেখে ব্রাহ্মণরা যাজ্ঞবল্ক্যের উপর আরো চটে গেলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন ঋষি আর্তভাগ। আর্তভাগের প্রশ্ন শুনে যাজ্ঞবল্ক্য খুশি হয়ে বললেনঃ
‘এই সভার মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর তো তুমি বুঝতে পারবে না। এসো আমার সঙ্গে।’
এই বলে আর্তভাগকে নিরালায় নিয়ে ধীরে সুস্থে তার প্রশ্নের উত্তর বুঝিয়ে দিলেন। আর্তভাগ শান্ত হলেন—এবার উঠে দাঁড়ালেন ভুজু ঋষি। ভুজু ঋষি গন্ধৰ্বলোক থেকে এমন জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, যা অন্য কারো জানবার কথা নয়। অনেক ভূমিকা ফেঁদে তারপর ভুজু ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে সেই অজ্ঞাত বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। যাজ্ঞবল্ক্য কিন্তু স্পষ্টভাষায় তার যথাযথ উত্তর দিলেন।

তারপর পর পর উষস্ত ঋষি এবং কহোল ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করলেও যাজ্ঞবল্ক্য ধীর শান্তভাবে উত্তর দিলেন।
এইবার ব্রাহ্মণ সভা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এক নারী—গার্গী তার নাম। সেকালে পুরুষদের মতো নারীরা সমস্ত জ্ঞান এবং বিদ্যার অধিকারী ছিলেন। তাদের অনেকেই বেদের মন্ত্র পর্যন্ত রচনা করেছিলেন।


সভাস্থ সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখলেন গার্গী প্রশ্ন করছেন যাজ্ঞবল্ক্যকে। গার্গী প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, শান্তভাবে তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন যাজ্ঞবল্ক্য। শেষ পর্যন্ত গার্গী এমন এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসলেন, যা বেদের বিধান পার হয়ে যায়। যাজ্ঞবল্ক্য তখন তাকে সাবধান করে দিয়ে বললেনঃ
সাবধান গার্গী। আর প্রশ্ন করো না—তুমি বেদবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছ, তোমার মুণ্ড খসে পড়বে।’ ভয়ে পেয়ে গার্গী আর প্রশ্ন না করে চুপ করে গেলেন।
এবার উঠে দাঁড়ালেন অরুণ ঋষির পুত্র উদ্দালক। তিনি অত্যন্ত কঠিন এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বললেনঃ
'যাজ্ঞবল্ক্য, যদি তুমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারো, তাহলে ব্রাহ্মিষ্ঠের গোধন অপহরণের অপরাধে তোমারই মুণ্ড খসে পড়বে।’
কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের মুণ্ডপাত হল না। উদালক যে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সে বিষয়ও যাজ্ঞবল্ক্যের অজ্ঞাত ছিল না। সভাসথ সবাই সবিস্ময়ে শুনলেন, যাজ্ঞবল্ক্য ধীর স্থির এবং বিস্তারিতভাবে উদ্দালককে তাঁর প্রশ্নের বিষয় সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
উদালক চুপ করে গেলেন । অন্য কেউ উঠেও আর প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না। কিন্তু গার্গী উস্‌খুস্‌ করছেন। যাজ্ঞবল্ক্যের ভয়ে তখন তিনি চুপ করে গেলেও একেবারে দমে যাননি। তিনি মনে মনে অন্য প্রশ্ন চিন্তা করছিলেন। উদ্দালককে পরাজিত হতে দেখে তিনি আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ
‘আমি যাজ্ঞবল্ক্যকে আর দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। যদি যাজ্ঞবল্ক্য দুটি প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারেন, তবে বুঝতে হবে, এ সভায় এমন কেহ নেই, যিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে পরাজিত করতে পারেন।”
সমবেত ব্রাহ্মণগণ কেহ মাথা তুলতে পারছিলেন না—তাদের প্রশ্নের ভাণ্ডারও বুঝি ফুরিয়ে আসছিল। এ অবসথায় গার্গীকে আবার উঠতে দেখে তারা উৎসাহিত হয়ে বললেনঃ
বেশ গার্গী, তুমিই প্রশ্ন জিজ্ঞেস কর।’ গার্গী প্রথম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। বেশ সহজেই যাজ্ঞবল্ক্য তার প্রশ্নের উত্তর দিলেন। এবার গার্গী কিছুটা নম্র হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যকে তার নমস্কার জানালেন–কিন্তু তবু দ্বিতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে ছাড়লেন না। যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীর দ্বিতীয় প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন, অধিকন্তু তাকে অতিরিক্ত কতকগুলি উপদেশও দান করলেন। যাজ্ঞবল্ক্য থামলেন, গার্গীও শান্ত হলেন। তারপর যাজ্ঞবল্ক্যের চরণে শতকোটি প্রণাম নিবেদন করে সভাসথ সমস্ত ব্রাহ্মণদের লক্ষ করে বললেনঃ
পূজনীয় ব্রাহ্মণগণ! এই সভায় যাজ্ঞবল্ক্যই ব্রহ্মিষ্ঠ। আপনারা আর কেহই তাকে পরাজিত করতে পারবেন না। এখন একে নমস্কার করেই আপনারা মুক্তিলাভ করুন।’
প্রমাণিত হল এই সভায় যাজ্ঞবল্ক্যই ব্রাহ্মিষ্ঠ এবং তার পরবর্তী স্থানই গার্গীর প্রাপ্য। কিন্তু এই সহজ প্রমাণকে মেনে নিতে ব্রাহ্মণরা বুঝি রাজি হলেন না। তাই আবার উঠে দাঁড়ালেন আর এক ব্রায়ণ–শকল ঋষির পুত্র বিদগ্ধ।
বিদগ্ধ সমানে যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন, যাজ্ঞবল্ক্য সবগুলিরই উত্তর দিলেন। কিন্তু বিদগ্ধের বাচালতা দেখে মুনি যাজ্ঞবল্ক্য কিছুটা রুষ্ট হয়েছিলেন। যখন বিদগ্ধের প্রশ্ন শেষ হল, তিনি চুপ করে গেলেন, তখন যাজ্ঞবল্ক্য এক প্রশ্ন করে বসলেন তাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলেনঃ
যদি তুমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পার, তবে এখনি তোমার মুণ্ড খসে পড়বে।’ বিগন্ধ যাজ্ঞবল্ক্যের প্রশ্নের উত্তর জানতেন না—তিনি চুপ করে রইলেন, যাজ্ঞবল্ক্যের শাপে তার মুণ্ড খসে পড়ল।
এবার যাজ্ঞবল্ক্য সভাসথ ব্রাহ্মণদের লক্ষ করে বললেনঃ আপনারা যে কেউ অথবা সবাই আমাকে প্রশ্ন করুন। অথবা আমিই আপনাদের সবাইকে প্রশ্ন করব।’ বিদগ্ধের অবস্থা দেখে আর কেউ যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না। তারা নীরবেই যাজ্ঞবল্ক্যের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে যাজ্ঞবল্ক্য সবাইকে লক্ষ করে এক প্রশ্ন করলেন।
ব্রাহ্মণ-সভা নীরব—কেউ যাজ্ঞবল্ক্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে দাঁড়ালেন না। কাজেই নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হল যে যাজ্ঞবল্ক্যই সমবেত বেদবিদ আর ব্রহ্মবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। জনক রাজাও প্রকৃত ব্রাহ্মিষ্ঠের সন্ধান পেয়ে আনন্দিত হলেন।
যাজ্ঞবল্ক্যের শিষ্য সামশ্রব আনন্দধ্বনি করতে করতে স্বর্ণশগমণ্ডিত সহস্র গাভিকে তাড়িয়ে নিয়ে চললেন গুরু আশ্রমে।

জবালার পুত্র সত্যকাম। সত্যকাম বাল্য পার হয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে। তখন একদিন মাকে বলল সত্যকামঃ মা, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে পড়াশুনা করত...

জবালার পুত্র সত্যকাম। সত্যকাম বাল্য পার হয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে। তখন একদিন মাকে বলল সত্যকামঃ মা, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে পড়াশুনা করতে যাব। তুমি অনুমতি দাও।”
মা পুত্রকে আশীৰ্বাদ করে দিনক্ষণ দেখে গুরুগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। সত্যকাম গৌতমবংশীয় হারিদ্রুমত নামক এক গুরুর গৃহে গিয়ে উপনীত হয়ে তার মনের অভিপ্রায় জানাল। সবিনয়ে সত্যকাম বললঃ
মহাশয়! আপনার গৃহে থেকে আপনার নিকট আমি পড়াশোনা করতে চাই—আপনি অনুমতি দিন।
শান্তস্বরে গুরু বললেনঃ
‘তোমার পরিচয় কী আর গোত্র কী বৎস?’
সত্যকাম পিতার নামও জানে না, কোন গোত্র তাও জানে না। বাড়ি ফিরে এসে সে তার মাকে জিজ্ঞেস করলঃ মা, আমার কোন গোত্র?
জবালা তার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বললেনঃ ‘বাবা! আমি বহুজনের সেবা করে তোমায় লাভ করেছি। তোমার পিতার পরিচয় কিংবা গোত্র তো আমার জানা নেই।’

সত্যকাম আবার ফিরে গেল গুরুগৃহে। তারপর মা তাকে যা বলেছিলেন, তাই সে জানাল গুরুকে। গুরু হারিদ্রুমত সত্যকামের এই সরল ও সত্য কথা শুনে বললেনঃ
‘ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কেউ এমন সত্য কথা বলতে পারে না। কাজেই তুমিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ। তোমার মাতার নাম জবালা—তোমার গোত্র হল জাবাল। তুমি আজ থেকে সত্যকাম জাবাল বলে পরিচিত হবে।’
এই বলে গুরু তাকে আশীৰ্বাদ করলেন এবং বললেন যে তার উপনয়ন দিয়ে তাকে ব্রাহ্মণ করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি সত্যকামকে লক্ষ করে বললেনঃ
বৎস! তুমি যে সত্যভ্রষ্ট হওনি, সেজন্য আমি খুবই, খুশি হয়েছি। তুমি যজ্ঞের জন্য কাঠ নিয়ে এসো— আমি তোমার উপনয়ন দেব।’
সত্যকাম গুরুর আদেশে অরণ্যে গিয়ে যজ্ঞের জন্য কাঠ কুড়াল, তারপর কাঠ নিয়ে গুরুগৃহে ফিরে এলে গুরু সেই কাঠে যজ্ঞ করে তার গলায় পৈতে পরিয়ে দিলেন—সত্যকাম ব্রাহ্মণ হল।
তারপর গুরু সত্যকামকে চারশ ক্ষীণ ও দুর্বল গোরু পৃথক করে দিয়ে তাকে লক্ষ করে বললেনঃ ‘এই গাভিগুলির ভার তোমায় দিলাম—তুমি এদের চরিয়ে নিয়ে এস।” গুরুর আদেশে সত্যকাম সেই চারশ’ গরু নিয়ে বনের পথে রওনা হল, আর মনে মনে ভাবলঃ এই চারশ’ গরু হাজারে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত আমি গুরুগৃহে ফিরব না।’ সত্যকাম বনে চলে গেল। দীর্ঘকাল সে বনে বনেই কাটাল—তারপর একদিন গরুর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল হাজারে!
সত্যকামের শ্রদ্ধা ও তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অনুগ্রহ করবার জন্য বায়ুদেবতা এক ষাঁড়ের দেহ আশ্রয় করে সত্যকামকে বললেনঃ
সত্যকাম, গুনে দেখ, আমরা এখন সংখ্যায় হাজার পূর্ণ হয়েছি—এবার আমাদের গুরুগৃহে নিয়ে চল। এই বলে বৃষস্থিত বায়ুদেবতা আবার বললেনঃ সত্যকাম, তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে কিছু উপদেশ দিতে চাই। সবিনয়ে সত্যকাম বললেনঃ
দয়া করে বলুন, প্রভু।
তখন বৃষরূপী বায়ুদেবতা বললেনঃ
পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ—এই চার দিককে ব্রহ্মের চার অংশ বলে জানবে। যিনি ব্রহ্মকে এইভাবে উপাসনা করেন, তিনি দেবলোক জয় করতে পারেন। এ বিষয়ে অগ্নিও তোমাকে উপদেশ দেবেন।
পরদিন সত্যকাম হাজার গরু নিয়ে গুরুগৃহে ফিরে গেল। তারপর সন্ধ্যা এসে গেছে দেখে গরুদের বেঁধে রেখে যজ্ঞকাষ্ঠ দিয়ে আগুন জ্বালাল। তারপর অগ্নির পশ্চাতে পূর্বমুখী হয়ে বসল । তখন অগ্নি তাকে বললেনঃ
‘সত্যকাম! আমি তোমাকে ব্রহ্ম সম্বন্ধে কিছু উপদেশ দেব। পৃথিবী, আকাশ, স্বৰ্গ আর সমুদ্ৰ—এরা ব্রহ্মের চার অংশ। যাঁরা এভাবে ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তারাই পরলোকে জয়ী হন। এ বিষয়ে হংস তোমায় আরও উপদেশ দেবেন।”

পরদিন সত্যকাম আবার গাভিদল চরিয়ে সন্ধ্যাকালে গুরুগৃহে ফিরে এল। তারপর গরু বেঁধে যজ্ঞকাষ্ঠে আগুন জ্বেলে পূর্বমুখী হয়ে বসল। -
তখন সূর্য হংসরূপে সেখানে উড়ে এসে বললেনঃ সত্যকাম, আমি ব্রহ্ম বিষয়ে তোমায় কিছু উপদেশ দেব, শোন। অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র আর বিদ্যুৎ—এরা ব্রহ্মের চার অংশ। যারা এভাবে ব্রশ্নের উপাসনা করেন, তারাই পরলোকে চন্দ্রলোক ও সূর্যলোক জয় করতে পারেন। এ বিষয়ে মদগু তোমায় আরও উপদেশ দেবেন।
এই বলে হংস উড়ে চলে গেলেন। পরদিন আবার দিনমানে গরু চরিয়ে সন্ধ্যাকালে সত্যকাম গুরুগৃহে ফিরে এসে অন্যদিনের মতোই গরু বেঁধে আগুন জেলে পূর্বমুখী হয়ে বসলেন।
তখন মদগু নামে এক জলচর পাখি উড়ে এসে বললেনঃ সত্যকাম! ব্রহ্ম বিষয়ে কিছু উপদেশ দেব—শোন! প্রাণ, চক্ষু, কর্ণ আর মন—এরা ব্রহ্মের চার অংশ। যারা এভাবে ব্রহ্মের উপাসনা করেন—তারাই পরলোকে জয়ী হন।’
এই বলে মদগু-রূপী জলদেবতা উড়ে চলে গেলেন। সত্যকাম এই ভাবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবার পর তার দেহে অপূর্ব এক জ্যোতি দেখা দিল। পরদিন সন্ধ্যায় গরুর দল নিয়ে সত্যকাম গুরুগৃহে ফিরে এলে পর তাঁর দিকে তাকিয়ে গুরু হারিদ্রুমত অবাক হয়ে গেলেন তারপর সত্যকামকে লক্ষ করে বললেনঃ
সত্যকাম—তোমার দেহে ব্ৰহ্মতেজ বিদ্যমান দেখছি। কোন ব্যক্তি তোমায় উপদেশ দিযেছেন—সত্য করে বল |’ -
সত্যকাম সবিনয়ে বললেনঃ ‘প্রভু, আমি গুরুত্যাগ করিনি। অপর কোনো মানুষের কাছে আমি উপদেশ পাইনি। যাদের কাছ থেকে পেয়েছি—তারা কেউ মানুষ নন। আপনার কাছ থেকেই প্রকৃত ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ করতে চাই—উপদেশ দিন প্রভু। 
তখন গুরু হারিদ্রুমত সত্যকামকে ব্রহ্মবিষয়ে পুনরায় উপদেশ দিলেন। পূর্বে সত্যকাম যে সমস্ত জ্ঞান লাভ করেছিলেন, গুরুর নিকটও সেই উপদেশই পেলেন।
সত্যকাম কালক্রমে একজন প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞাণী হয়ে উঠলেন।

অনেক দিন আগের কথা। সেকালে বাজশ্রবা নামে এক মুনি ছিলেন। মুনি ছিলেন পরম ধাৰ্মিক এবং যাগযজ্ঞপরায়ণ। তার এক পুত্র ছিলেন—নাম নচিকেতা। বাজশ্রবা মু...

অনেক দিন আগের কথা। সেকালে বাজশ্রবা নামে এক মুনি ছিলেন। মুনি ছিলেন পরম ধাৰ্মিক এবং যাগযজ্ঞপরায়ণ। তার এক পুত্র ছিলেন—নাম নচিকেতা।
বাজশ্রবা মুনি একবার এক বিরাট যজ্ঞ করেন, সেই যজ্ঞের নাম বিশ্বজিৎ যজ্ঞ। যেমন যজ্ঞ, তেমন তার দক্ষিণা। যিনি যজ্ঞ করেন তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুকেই যজ্ঞের দক্ষিণারূপে দান করতে হয়।
বাজশ্ৰবা দান করছেন অনেক গোরু। নচিকেতা ভাবলেন, তিনি বাজশ্রবার পুত্ৰ—পুত্ৰই তো পিতার সর্বাপেক্ষা প্রিয়জন।
কাজেই তাকে যদি দান করা না হয়, তবে তো যজ্ঞের সম্পূর্ণ ফল তার পিতা পাবেন না। এই ভেবে তিনি বাজশ্রবা মুনির কাছে গিয়ে বললেনঃ
“পিতা আপনি আমাকে কার কাছে দান করবেন ??
বাজশ্রবা কোনো উত্তর দিলেন না। একবার, দুইবার, তিনবার—নচিকেতা তার বাবাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন। তখন বাজশ্রবা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেনঃ
আমি তোমাকে যমের হাতে তুলে দেব।’
পিতার কথা শুনে নচিকেতা ভাবলেনঃ.
‘আমি তো পিতার শিষ্যদের মধ্যে হীন নহি; কোনো বিষয়ে উত্তম আর কোনো বিষয়ে মধ্যম। তবে কেন অন্যকে যমের কাছে না পাঠিয়ে আমাকে পাঠাতে চাইছেন? নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর প্রয়োজন আছে, যে কারণে আমারই যমের নিকট যাওয়া প্রয়োজন।’

এই ভেবে নচিকেতা স্থির করলেন তিনি যমের কাছে যাবেন। কিন্তু বাজশ্ৰবা সত্যিই তো আর তাকে যমের বাড়ি পাঠাতে চাননি! বিরক্ত হয়ে শুধু একটা কথার কথা বলেছিলেন। তাই নচিকেতা যখন যমের বাড়ি যেতে চাইলেন, তখন তিনি তাকে বাধা দিলেন। সত্যিই তো, কেউ ইচ্ছে করে কি আর নিজের প্রিয় পুত্রকে যমের হাতে তুলে দিতে পারে? -
পিতার নিষেধে নচিকেতা কিন্তু মত পরিবর্তন করলেন না। তিনি ভাবলেনঃ
যজ্ঞের সামনে বসে তিনি আমাকে যমের হাতে দান করেছেন। এখন যদি তিনি সে কথা ফিরিয়ে নিতে চান, তবে যজ্ঞের ফল পাবেন না, অধিকন্তু সত্যভ্রষ্ট হয়ে আরো পাপের ভাগী হবেন। কাজেই পিতার সত্যরক্ষার জন্যেও আমাকে যমের বাড়ি যেতে হবে।’ -
এই সমস্ত ভাবনা-চিন্তা করে নচিকেতা তার বাবাকে সাত্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ পিতা, আপনার পিতা-পিতামহগণের কথা চিন্তা করুন। তারা সত্যনিষ্ঠ ছিলেন, কোনো দিন, কোনো কারণেই তারা সত্যভ্রষ্ট হননি; অন্যান্য সৎ ব্যক্তিরাও সত্য থেকে সরে যাননি। কাজেই আপনি বা কেন সত্যভ্রষ্ট হবেন? আর তাছাড়া মানুষের জীবনের মূল্য কি? শস্য যেমন কিছুদিন পর মরে যায়, মানুষও তেমনি মরবেই। কাজেই এই মরণশীল মানুষের জন্য কেন সত্যভ্রষ্ট হবেন? আমি আজ যদি যমালয়ে না যাই, পরে যেতেই হবে; কাজেই দুঃখ করবেন না—আমাকে যেতে দিন।' -
বাজশ্রবা বুঝলেন আপত্তি করে কিছু হবে না। অতঃপর নচিকেতা যমালয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। নচিকেতা যখন যমের বাড়িতে গিয়ে পৌছলেন, তখন যম বাড়ি ছিলেন না। নচিকেতা সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলেন। একদিন, দুদিন, তিনদিন পার হয়ে গেল। নচিকেতা একঠায় বসে আছেন—স্নান নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই। যমের সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না—অন্য কর্মও করতে পারছেন না।

তিনদিন পর যম বাড়ি ফিরে শুনলেন, তিনদিন ধরে অনাহারী অতিথি ব্রাহ্মণ  তাঁর ঘরে অপেক্ষা করছেন। এই সংবাদ পেয়ে যম অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে উঠলেন। কারণ ঘরে আগুন লাগলে তাকে না নেভাতে পারলে গৃহস্থের যেমন অমঙ্গল হয়, তেমনি ব্রাহ্মণ বাড়িতে এলে যদি তাকে শাস্ত না করা যায়, তবে গৃহস্থের মঙ্গল নেই। কাজেই সত্বর পাদ্য অর্ঘ দিয়ে নচিকেতাকে শান্ত করতে গেলেন। নতুবা, যমের সমস্ত কর্মফলও নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ শাস্ত্রে আছে অতিথির উপবাসের ফলে দানফল, যজ্ঞফল, এমন কি পুত্রফল পর্যন্ত নষ্ট হয়। কাজেই যমরাজা যথাযোগ্য সমাদর করে নচিকেতাকে বললেনঃ
‘হে ব্রাহ্মণ, তুমি অতিথি হয়েও আমার গৃহে তিন রাত্রি অনাহারে কাটিয়েছ, তাই তোমাকে নমস্কার করি। তোমার ক্রোধে আমার যেন কোনো অমঙ্গল না হয়। তোমার প্রতি আমি প্রসন্ন হয়েছি—প্রতি রাত্রির জন্যে একটি করে তুমি তিনটি বর প্রার্থনা কর—আমি পূর্ণ করবো।’
তখন নচিকেতা তিনটি বরই প্রার্থনা করলেন; প্রথম বরে বললেনঃ হে যমরাজ, তিনটি বরের মধ্যে আমি প্রথম বর চাই—আমার জন্য আমার পিতার মনে যেন কোনো উদ্বেগ না থাকে, আমার প্রতি যেন তিনি ক্ৰোধশুন্য ও প্রসন্ন হন। আর যমালয়ে গত ব্যক্তির সঙ্গে মর্ত্যলোকের কারো পরিচয় থাকে না—কিন্তু আমার পিতার সঙ্গে যেন আমার ঐরূপ সম্বন্ধ না ঘটে—তিনি যেন আমায় চিনতে পারেন।
যম সন্তুষ্ট হয়ে বললেনঃ ‘তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হোক। তোমার পিতা পূর্বে তোমার প্রতি যেরূপ স্নেহপরায়ণ ছিলেন, তোমায় চিনতে পেরে ভবিষ্যতেও সেরূপ থাকবেন। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে যাবার পর আমার আদেশে তিনি ক্ৰোধশুন্য হবেন এবং বহুরাত্রি সুখে নিদ্রা যাবেন। এক্ষণে দ্বিতীয় বর প্রার্থনা কর।’
দ্বিতীয় বর প্রার্থনা করে নচিকেতা বললেনঃ স্বৰ্গলোকে কোনো ভয় নেই—সেখানকার অধিবাসীরা আপনার ভয়ে কখনও ভীত হয় না। সেখানে লোক বৃদ্ধ হয় না, লোকের ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না—আনন্দের মধ্য দিয়ে তারা দিন যাপন করে। হে যমরাজ, অগ্নিবিদ্যার প্রভাবে যারা এই অমরত্ব লাভ করে, তাদের সেই অগ্নিবিদ্যার রহস্য আপনি জানেন। এই রহস্য আমায় বলুন— দ্বিতীয় বরে ইহাই আমি প্রার্থনা জানাই।’

তখন যমরাজ অগ্নিবিদ্যা প্রকাশ করলেন—নচিকেতাও শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে শিষ্যের মতো সমস্ত শুনলেন। নচিকেতা শিষ্যত্ব গ্রহণ করায় যমরাজ প্রীত হয়ে তাকে তিনটি ববের অতিরিক্ত একটি বর দিয়ে বললেনঃ
স্বেচ্ছায় তোমাকে এই চতুর্থ বর প্রদান করছি। অতঃপর অগ্নি তোমার নামেই প্রসিদ্ধ হবেন। যিনি তোমার নামে যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করবেন, তিনিও জন্মমৃত্যু অতিক্রম করবেন। এক্ষণে তোমার তৃতীয় বর প্রার্থনা কর।’

তখন নচিকেতা বললেনঃ মানুষের মৃত্যুর পর এই সংশয় উপস্থিত হয়—আত্মা আছে কি নেই, দয়া করে আমাকে মৃত্যুর এই স্বরূপের বিষয় বলুন—ইহাই আমার তৃতীয় প্রার্থনা।’

যম নচিকেতাকে পরীক্ষা করবার জন্যে বললেনঃ
দেবতারাও এই তত্ত্ব জ্ঞাত নহেন। কাজেই তুমি এই বর ত্যাগ কর অন্য বর প্রার্থনা কর।’ যখন দেবতারাও জানেন না তখন মৃত্যুর স্বরূপ নিশ্চয়ই অত্যন্ত রহস্যময়, এই ভেবে নচিকেতা যমকে বললেনঃ না প্ৰভু! আমাকে এই তত্ত্বই বলুন—অন্য কোনো প্রার্থনা আমার নেই।’
যম নচিকেতকে লোভ দেখিয়ে বললেনঃ তুমি দীর্ঘায়ু পুত্র-পৌত্রসমূহ প্রার্থনা কর, বহু গবাদি পশু, হস্তি, স্বর্ণ কিংবা বিশাল রাজ্য প্রার্থনা কর, কিংবা অমরত্ব;–আমি তোমার সমস্ত প্রার্থনা পূর্ণ করবো, শুধু মৃত্যুর স্বরূপ জানতে চেয়ো না।’

নচিকেতার জেদ চড়ে গেল—তিনি মৃত্যুর স্বরূপই জানবেন, তাই বললেনঃ মানুষ কখনও ধন-রত্ন নিয়ে সুখী হতে পারে না, আমার কামনা থাকলে আপনার কৃপায় প্রচুর বিত্ত কিংবা অমরত্বও পেতে পারি; কিন্তু সে বিষয়ে আমার কামনা নেই—আমাকে মৃত্যুর স্বরূপ বলুন।
যম সন্তুষ্ট হয়ে বললেনঃ নচিকেতা, তোমায় পরীক্ষা করে দেখলুম, তুমি লোভহীন; সাধারণ মানুষ যা চায়, তুমি তা চাও না—তুমি প্রকৃত বিদ্যাভিলাষী, তাই উপযুক্ত শিষ্য ভেবে দেবতাদেরও অজ্ঞাত মৃত্যুতত্ত্বের বিষয় তোমাকে জানাবো ? -
এই বলে যম নচিকেতাকে মৃত্যুর স্বরূপ সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে উপদেশ দিলেন। একমাত্র ব্রহ্মবিদ্যার সহায়তায়ই ইহার স্বরূপ জানা যায়—যম নচিকেতাকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করলেন। "
এই ব্রহ্মবিদ্যা জ্ঞাত হয়ে নচিকেতাও জরামৃত্যুর অতীত মুক্তি লাভ করলেন।