এক সময় প্রজাপতি বলেছিলেনঃ
যে আত্মা নিষ্পাপ, জরাবিহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন, পিপাসাহীন, সত্যকাম ও সত্যসংকল্প, সেই আত্মারই সন্ধান করবে। আর সেই আত্মাকে জানবার জন্যেও সতত আগ্রহ থাকা উচিত। যিনি শাস্ত্র ও আচার্যের নিকট থেকে এই আত্মার পরিচয় পেয়ে তদনুযায়ী তাকে বিশেষ রূপে অনুভব করেন, তার সমস্ত কামনাই পূর্ণ হয়।’
প্রজাপতির এই উপদেশ দেবলোক ও দৈত্যলোকে সমানভাবে প্রচারিত হল। সবাই বুঝলেন আত্মাকে জানতে পারলেই, অর্থাৎ আত্মজ্ঞান করতে পারলেই চরম সুখভোগ করা সম্ভব । তাই দেবতারা ভাবলেনঃ যে আত্মাকে অনুসন্ধান করলে সকল লোক ও সকল কাম্য-বস্তু পাওয়া যায় আমাদের তারই অনুসন্ধান করা উচিত।”
এই ভেবে দেবতারা ইন্দ্রকে পাঠালেন প্রজাপতির নিকট আত্মজ্ঞান শিখে আসার জন্যে। ইন্দ্রও সন্ন্যাস গ্রহণ করে প্রজাপতির নিকট উপস্থিত হলেন।
ওদিকে অসুররাও ভোগসুখে অত্যন্ত উৎসাহী। তারা ভাবল, আত্মজ্ঞান শিখলে যদি সকল কাম্য-বস্তুই পাওয়া যায়, তবে তারাই বা বঞ্চিত হবে কেন? তারা পাঠাল তাদের রাজা বিরোচনকে প্রজাপতির কাছে। বিরোচনও সন্ন্যাস গ্রহণ করে আত্মজ্ঞান লাভের জন্য প্রজাপতির নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন।

ইন্দ্র ও বিরোচন দুজনে অপরের অজ্ঞাতে যজ্ঞকাষ্ঠের বোঝা নিয়ে প্রজাপতির আশ্রমে পৌছলেন। প্রজাপতি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, কাউকে কিছু বল্লেন না। তারা উভয়েই প্রজাপতির আশ্রমে আছেন এবং শিষ্যের মতো প্রজাপতির সেবা করছেন।
ক্ৰমে প্রজাপতির আশ্রমে উভয়ের বত্রিশ বৎসর ব্রহ্মচর্যবাস সম্পূর্ণ হল। ইন্দ্র ও বিরোচন একসঙ্গে আছেন। তাদের মধ্যে জন্মগত শত্ৰুতা থাকলেও বিদ্যালাভের আগ্রহে উভয়েই তা ভুলে গিয়ে বন্ধুভাবে বাস করছেন।
তখন একদিন প্রজাপতি তাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ কি প্রযোজনে তোমরা এতদিন এখানে বাস করলে ?” দীর্ঘ বত্রিশ বছর তারা ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে বাস করছেন—অথচ তাদের আগমনের উদ্দেশ্য পর্যন্ত গুরুকে বলা হয়নি। তাঁদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা বুঝি সফল হতে চলেছে—গুরু বুঝি প্রসন্ন হয়েছেন, এবার কৃপা করবেন।
তাঁরা দুজনেই বললেনঃ আপনি বলেছেন, যে আত্মা নিম্পাপ, জরাবিহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন, পিপাসাহীন, সত্যকাম ও সত্যসংকল্প, সেই আত্মারই সন্ধান করবে। আর সেই আত্মাকে জানবার জন্য সতত আগ্রহ থাকা উচিত। যিনি শাস্ত্র ও আচার্যের নিকট থেকে এই আত্মার পরিচয় পেয়ে তদনুযায়ী তাকে বিশেষরূপে অনুভব করেন, তার সমস্ত কামনাই পূর্ণ হয়। আমরা সেই আত্মাকে জানবার উদ্দেশ্যেই এতকাল ব্রহ্মচর্য পালন করে আপনার আশ্রমে বাস করছি।’
ব্রহ্মা ভাবলেন—এরা বত্রিশ বৎসর আমার আশ্রমে থেকে ব্রহ্মচর্য আচরণ করছে—এদের অন্তর নিশ্চয়ই নির্মল হয়েছে। এই ভেবে তিনি তাদের আত্মজ্ঞান শিক্ষা দিলেন। তিনি বললেনঃ
চক্ষুতে যে পুরুষকে দেখা যায়, তিনিই আত্মা,—আত্মা মৃত্যুহীন, ভয়হীন। ব্রহ্মার কথা শুনে ইন্দ্র ও বিরোচন উভয়েই ভাবলেন, চক্ষুর দিকে তাকালে তো আমাদের ছায়া দেখা যায়—তবে ঐ ছায়াই কি আত্মা? এই ভেবে তারা দুজনেই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেনঃ জলে এবং দর্পণে যে পুরুষকে দেখা যায় তাদের মধ্যে কোনজন আত্মা? প্রজাপতি বললেনঃ এই সমস্ত কিছুর মধ্যে যাঁকে দেখা যায়, তিনিই আত্মা।’ প্রজাপতি বললেন বটে, কিন্তু মনে মনে বুঝলেন যে এতদিন ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেও তাদের মন নির্মল হয়নি—তাই তারা প্রকৃত আত্মাকে বুঝতে পারেনি, তারা বুঝেছে ছায়াই বুঝি আত্মা।
ইন্দ্র এবং বিরোচন কিন্তু সত্যি সত্যি ছায়াকেই আত্মারূপে বুঝে মনে করেছিলেন, তারা সব বুঝে ফেলেছেন। স্পষ্ট করে প্রজাপতি তাদের ভুল ভাঙালেন না; কারণ তারা বত্রিশ বছর এত কষ্ট সহ্য করে যদি জানতে পারে যে, সব বুঝেছে, তবে হয়তো তারা হতাশ হয়ে পড়বে। তাই সোজাসুজি তাদের হতাশ না করে দিয়ে প্রজাপতি আসল ব্যাপারটা অন্য ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি তাদের একপাত্র জল আনতে বললেন। জল নিয়ে এলে পর প্রজাপতি তাদের বললেনঃ
জলের দিকে তাকিয়ে দেখ তো—কি দেখা যায়?
তারা উভয়ে জলের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
নখ, চুল-সমেত আমাদের ছায়াই তো দেখতে পাচ্ছি।’
তখন প্রজাপতি বললেনঃ নখ, চুল কেটে উৎকৃষ্ট বসন-ভূষণ পরে এসে জলের দিকে তাকিয়ে বল তো, কি দেখতে পাচ্ছ? প্রজাপতির আদেশে তারা ঐভাবে তৈরি হয়ে এসে জলের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ জলের মধ্যে আমাদের সাজগোজ-করা রূপই দেখতে পাচ্ছি।’ প্রজাপতি একটু নীরব থেকে বললেনঃ
ইনিই আত্মা।’ ইন্দ্র আর বিরোচন একটু ধীর স্থির ভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারতেন যে ছায়া আত্মা হতে পারে
না। কারণ পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তনে ছায়ার পরিবর্তন হয়—কাজেই ছায়া আত্মা হতে পারে না। কারণ আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না।
কিন্তু ইন্দ্র এবং বিরোচন উভয়েই এই ভুল করলেন। তারা আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন ভেবে প্রফুল্ল হয়ে ব্রয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন।
যেতে যেতে বিরোচন ভাবছেনঃ
‘প্রজাপতি তো শিখিয়ে দিলেন ছায়াই আত্মা। এখন ছায়া তো দেহ থেকেই হয়—তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেহই আত্মা।’
যা বোঝা, তাই কাজ।
‘প্রজাপতির কাছ থেকে আত্মজ্ঞান শিখে এসেছি—দেহই আত্মা, কাজেই দেহেরই পূজা করবে। তাতেই ইহলোক এবং পরলোকে সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।’
ইহাই অসুরদের উপনিষদ। খাও, দাও আর স্ফূর্তি কর—এই মন্ত্রই শিখল অসুররা—আর এই ভুল আত্মজ্ঞান শিখবার ফলে, তারা কোনো দিনই আর কাম্য-বস্তুর সন্ধান পেল না।
এদিকে ইন্দ্রও বিরোচনের মতোই প্রফুল্লচিত্তে আত্মজ্ঞান শিখেছেন ভেবে স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন। পথে যেতে যেতে ইন্দ্রও ভাবছেন—ছায়াই বুঝি আত্মা। পরেই মনে হল—ছায়ার তো পরিবর্তন হয়, ছায়া নষ্টও হয়ে যেতে পারে—কিন্তু আত্মার তো পরিবর্তন হয় না, নষ্টও হয় না। তাহলে ছায়া আত্মা হয় কিভাবে ? ইন্দ্রের মনে খটকা লাগল।
হাজার হোক, ইন্দ্র দেবতা—অসুরদের অপেক্ষা তার বুদ্ধি অনেক নির্মল। তাই তার মনে সংশয় জাগতেই বুঝতে পারলেন–তাঁর আত্মজ্ঞান শিক্ষা হয়নি।
আবার যজ্ঞের কাঠ মাথায় নিয়ে তিনি পৌছুলেন প্রজাপতির আশ্রমে। প্রজাপতি ইন্দ্রকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেনঃ
আত্মজ্ঞান শিখে প্রফুল্লচিত্তে বিদায় নিয়ে গেলে—আবার ফিরে এলে কেন?’
ইন্দ্র তাঁর মনের সংশয় জানালেন প্রজাপতিকে ।
প্রজাপতি বললেনঃ বেশ, তাহলে আরো বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে এখানে থাক। চিত্ত আর একটু নির্মল হোক—
তখন তোমাকে আত্মজ্ঞান শিক্ষা দেব।’
ইন্দ্র আত্মজ্ঞান না শিখে স্বর্গে ফিরে যাবেন না—তার জন্যে যদি আরো বত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়, তাতেও তিনি প্রস্তুত। কাজেই প্রজাপতির প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ইন্দ্র আরো বত্রিশ বছর প্রজাপতির আশ্রমে বাস করে গুরুর সেবা করলেন। বত্রিশ বছর পর ব্রহ্মা আবার ইন্দ্রকে আত্মজ্ঞান শিক্ষা দিলেন। ইন্দ্র আত্মজ্ঞান শিক্ষা করে প্রফুল্লচিত্তে স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন, কিন্তু পথে গিয়ে তাঁর মনে সংশয় জাগল। তিনি আবার ফিরে এলেন প্রজাপতির আশ্রমে।
আবার বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে আত্মজ্ঞান শিক্ষা করে ইন্দ্র যখন স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন, তখন মনে হল—এখনো হয়নি, এখনো মনে সংশয় জাগছে—পরিপূর্ণ সুখ অনুভব করতে পারছেন না। ইন্দ্র ফিরে এলেন প্রজাপতির আশ্রমে। এবার আরো পাঁচ বছরের জন্য তাকে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে থাকতে হল। মোট একশ’ এক বছর ব্রহ্মচর্য আচরণ করে গুরুগৃহে থেকে যখন ইন্দ্রের চিত্ত একেবারে নির্মল হল, তখনই তিনি প্রকৃত আত্মজ্ঞান লাভ করলেন। ইন্দ্রের জীবন ধন্য হল,—তার গুরুগৃহে বাস, ব্রহ্মচর্য ধারণ সার্থক হল। আত্মজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি অভয় অমৃত পুরুষকে লাভ করলেন। প্রজাপতিকে প্রণাম করে ইন্দ্র আত্মজ্ঞানের অধিকারী হয়ে দেবভূমিতে ফিরে এলেন।
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances