Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

প্রফুল্ল রায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

      বাজু একসঙ্গে মাথা আর হাত নাড়তে নাড়তে বলে, ‘না দাদাই, ভূত-টুত বলে কিস্‌সু নেই! স্রেফ গাঁজা?       বাজুর বন্ধু বিটুও ঠোঁট উন্টে দিয়ে ...

      বাজু একসঙ্গে মাথা আর হাত নাড়তে নাড়তে বলে, ‘না দাদাই, ভূত-টুত বলে কিস্‌সু নেই! স্রেফ গাঁজা?
      বাজুর বন্ধু বিটুও ঠোঁট উন্টে দিয়ে বলে, একদম বোগাস। 
      ফি বছর বাজু পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি আসে। পুরো ছুটিটা কাটিয়ে একেবারে ভাইফোটার পর নিজেদের বাড়ি ফিরে যায়।
      বাজুর অবশ্য আপন মামা নেই। তবে মাসি আছে, দাদাই আছেন, দিদন আছেন। বেড়িয়ে, গল্প করে, মজার মজার বই পড়ে ছুটিটা তোফা কেটে যায়।
      এ বছর বাজুর সঙ্গে এসেছে তার প্রাণের বন্ধু বিটু। দুজনের গলায় গলায় ভাব। একই স্কুলে তারা ক্লাস ফোরে পড়ে। দুজনেরই বয়স দশ।
      দুই বন্ধুই লেখাপড়ায় দারুণ। হাফ ইয়ারলিতে বাজু ফাস্ট হলে, অ্যানুয়ালে বিটু। দুজনেরই দারুণ বুদ্ধি আর সাহস।
      বাজু মামাবাড়িতে এলে সন্ধের পর রোজ ছাদে আলো নিভিয়ে শতরঞ্জিতে আরাম করে বসে গল্পের আসর জমানো হয়। গল্প বলেন অবশ্য দাদাই অর্থাৎ দাদামশাই। মামাবাড়িতে অজস্র বই, আট-দশটা আলমারি একেবারে বোঝাই। তবু প্রতি মাসেই দাদাই প্রচুর বই কেনেন। কত রকমের বই তার ঠিক নেই। দেশবিদেশের ইতিহাস, সায়েন্স ফিকশান, কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি, রূপকথা, অ্যাডভেঞ্চার, প্রকৃতি বিজ্ঞান ইত্যাদি। এইসব বইয়ের প্রতিটি পাতা দাদাইয়ের মুখস্থ। ছুটিতে বাজু মামাবাড়ি এলে তিনি তাকে এই বইগুলোর গল্প শোনান।
      গল্পের আসরে শ্রোতা শুধু একা বাজুই নয়—মাসি, দিদন এবং মামাবাড়ির চারপাশে যারা থাকে যেমন বুম্বা, পাপাই, বুবলা—এরাও বুম্বাদের সঙ্গেও খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বাজুর।
     দিন তিনেক আগে এবার পুজোর ছুটি পড়েছে আর আজই দুপুরে বাজু বিটুকে সঙ্গে করে মামাবাড়ি চলে এসেছে। বাজুর মা-ই তাদের পৌছে দিয়ে গেছেন।
      দিনের বেলাটা হৈ হৈ করে কাটিয়ে এখন এই সন্ধেবেলায় ছাদে গল্পের আসর বসিয়েছে বাজুরা। এতদিন যারা গল্প শুনে আসছিল বিটু আসায় এবার তাদের সংখ্যাটি বেড়েছে।
      এবার মামাবাড়িতে পা দিয়েই বাজু খবর পেয়েছে, ইদানিং কিছুদিন ধরে দাদাইকে ভূতে পেয়েছে। ইংরজি আর বাংলায় ভূত-প্রেত নিয়ে যত বই বেরিয়েছে, সবই কিনে ফেলেছেন। এগুলো রাখার জন্য নতুন আলমারিও করতে হয়েছে।
      কাজেই দাদাইয়ের গল্পে ভূত যে এসে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী। বেশ জমিয়ে খাস বিলেতের এক ঠ্যাঙা সাহেব-ভূতের কীর্তিকলাপ যখন তিনি বলতে শুরু করেছেন সেই সময় বাজু আর বিট্টু প্রবল চেঁচামেচি জুড়ে দেয়।
      তাদের দেখাদেখি শিয়ালের পালের মতো পাপাইরা কোরাসে বলে ওঠে, বাজে, বাজে, বাজে। আমরা ভূত বিশ্বাস করি না।’
      দাদাই চোখ কুঁচকে সবাইকে দেখতে দেখতে জিগ্যেস করেন, কর না তো? 
      'না, না, না।’ 
      ‘কেন কর না?’
      আমরা কেউ ভূত দেখিনি, তাই।’ 
      দাদাই কী একটু ভাবেন। তারপর বলেন, যদি তোমাদের ভূত দেখিয়ে দিতে পারি, তাহলে করবে?’
     এদের মধ্যে বাজু এবং বিট্টুর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। তারা বলে, কবে দেখাবে? কখন দেখাবে? তাদের আর তর সইছে না যেন।
     দাদাই বলেন, দু-একদিনের ভেতর দেখতে পাবে।
      ‘দিনের বেলা, না রাত্তিরে?’ 
     ‘রাত্তিরে।’ কোথায় দেখাবে?’ 
     দাদাইদের বাড়ির পেছনে অনেকটা ফাঁকা মাঠ। মাঠটা ঝোপঝাড় আগাছায় ভর্তি। তারপর রেললাইন চলে গেছে। আর রেললাইনের ধারে একটা প্রকাণ্ড পুরোনো ভাঙাচোরা জমিদার বাড়ি কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটায় লোকজন থাকে না, আলো-টালো নেই। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ওটাকে ভূতুড়ে দেখায়। বাড়িটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দাদাই বলেন, ঐ বাড়িটায় রাত বারোটার সময় দোতলার দক্ষিণের শেষ ঘরটায় পরশু যদি যাও, ভূত দেখতে পাবে। তারপর ক্ষুদে শ্রোতাদের দিকে ফিরে পরপর সবাইকে দেখতে দেখতে চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলেন, তোমাদের মধ্যে কে কে যেতে চাও, বল।’
      পাপাই, বুম্বা আর বুবলার মুখ চুপসে গেছে। তাদের বুকের ভেতরটা ভীষণ ঢ়িব ঢ়িব করছিল। বুম্বা ঢোক গিলে বলে, ‘আমাদের বাড়ির গেটে রাত দশটায় তালা লাগানো হয়। আমি যে বেরুতে পারব না।’
      পাপাই বলে, ‘কাল সকালে চন্দননগরে পিসির বাড়ি যাচ্ছি। ফিরব চারদিন বাদে। পরশু ভূত দেখতে যাব কী করে?’
      বুবলা বলে, 'নটা বাজলেই আমার ঘুম পেয়ে যায়। বারোটা পর্যন্ত আমি বাবা জেগে থাকতে পারব না।’
     মুচকি হেসে দাদাই বলেন, ‘বুঝেছি তোমরা কেমন বীরপুরুষ। তারপর বাজুদের জিগ্যেস করেন, ‘কী, তোমরাও বুবলাদের দলে নাকি?
      বাজু এবং বিট্টু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বুক ফুলিয়ে মোটা গলায় বলে, নেভার। 
      নিতান্ত ভালোমানুষের মতোই দাদাই জিগ্যেস করেন, তাহলে তোমরা পরশু রাতে ওখানে যাচ্ছ? 
      বাজু বলে, ‘নিশ্চয়ই। কিন্তু— 
     ‘কী?’
     ‘পরশু রাত বারোটায় ওখানে গেলে ভূত দেখতে পাব, কী করে জানলে?’ 
     আমি জানি, পরশু হল বুধবার। প্রতি বুধবার রাত বারোটায় ওখানে গেলে তাকে দেখা যায়। 
      বিট্টু বলে, ‘তুমি দেখেছ দাদাই? 
      দাদাই বলেন, ‘নিশ্চয়ই। না হলে তোমাদের অত জোর দিয়ে বলছি কী করে?’ 
      বাজু আর বিট্টু এবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে গাদা গাদা প্রশ্ন করে যায়। তাকে দেখতে কেমন? কথা-টথা বলেছে কিনা? বললে কী বলেছে? ইত্যাদি।
      দাদাই বলেন, ‘আমি কিছু বলব না। সাহস থাকলে নিজেরা গিয়ে দেখবে। ঠিক আছে। আমরা পরশু যাচ্ছি।’ 
      দিদন কিন্তু খুব রেগে যান। দাদাইকে বলেন, কেন বাচ্চা দুটোকে ঐ হানাবাড়িতে পাঠাচ্ছ? শেষে ভয়-টয় পেয়ে যদি কিছু হয়ে যায়?
      বাজু আর বিট্টুর ওপর দাদাইয়ের দারুণ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ওরা ভয় পাবার ছেলে নয়। তুমি ভেবো না। দুজনে ঠিক পরশু রাত বারোটায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারবে।’
      দিদনের দুশ্চিন্তা কাটে না। তিনি বলতে থাকেন, কী যে তোমার অলুক্ষণে কাণ্ড বুঝতে পারি না। এই বাচ্চাদের কেউ অমন করে উসকে দেয়!
      দিদন এবং মাসির ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও বুধবার রাত বারোটায় মাঠ পেরিয়ে দুই বন্ধু পোড়ো জমিদার বাড়িতে চলে আসে। তাদের দুজনের হাতে রয়েছে বড় টর্চ আর লাঠি। পিঠে বাঁধা আছে এয়ারগান।
      বাড়িটার সামনে বাজুরা থমকে যায়। কেউ কোথাও নেই, চারিদিক একেবারে সুনসান। এধারে ওধারে ঝিঁঝিঁরা একটানা ডেকে চলেছে। অনেক দূরে, রেললাইনের ওপারে কোথায় যেন মিহি, মোটা, নানা সুরে ঝাঁকে ঝাঁকে কুকুর ডেকে ওঠে। এছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দ নেই।
      এ লাইনে লাস্ট ট্রেন চলে যায় পৌনে বারোটায়। তারপর এদিকটা একেবারে নিঝুম হয়ে পড়ে। সব দেখে-শুনে বিট্টু দমে একটু যায়। বলে, ‘কি রে বাজু, ভেতরে যাবি? 
      বাজু বলে, ‘নিশ্চয়ই। এই পর্যন্ত এসে যদি ফিরে যাই, দাদাই ঠাট্টা করে করে আমাদের জ্বালিয়ে মারবে।’ বলে টর্চ জ্বালে।
      ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দশ-বারো ফিট দূরে ভাঙা লোহার গেট। সেটার একটা পাল্লা নেই, অন্য পাল্লাটাও ভেঙে হেলে পড়েছে। গেটটাকে ঘিরে প্রচুর বুনো ঘাস আর কাঁটার ঝাড়।
      বাজু বলে, ‘চল, ভেতরে ঢুকি।’ 
      টর্চ জ্বেলে রেখেই দুজনে ঘাস এবং ঝোপঝাড় ঠেলে বাড়ির ভেতর চলে আসে। গেটের পর মস্ত বাঁধানো চাতাল। তারপর দশ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে মোটা মোটা থামের ভেতর টানা বারান্দা। থামে এবং বারান্দায় ফাটল ধরে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। ফাঁকে ফাঁকে বট-অশ্বথের চারা গজিয়ে উঠেছে।
      দোতলায় উঠে দক্ষিণের শেষ ঘরখানায় যেতে হবে বাজুদের। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সিঁড়িটা বের করে তারা ওপরে উঠতে থাকে। হঠাৎ নাকে ভক করে একটা বেটকা দুৰ্গন্ধ এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ফর ফর করে অগুনতি চামচিকে মাথার ওপর উড়তে থাকে। এদের দু-একটা আবার বাজু এবং বিট্টুর নাকে-মুখে নখের আঁচড় বসিয়ে যায়।
      দুহাতে লাঠি আর টর্চ ঘোরাতে ঘোরাতে চামচিকেদের আক্রমণ ঠেকিয়ে কোনোরকমে দোতলায় উঠে আসে বাজু আর বিট্টু। চারপাশে আলো ফেলে ফেলে দক্ষিণ দিকটা ঠিক করে নেয়। টানা একটা বারান্দা সোজা ওদিকে চলে গেছে, যার শেষ মাথার ঘরটায় যাবার কথা বলে দিয়েছেন দাদাই। বাজুরা পা বাড়াতে যাবে, কোথায় কোন অদৃশ্য ঘুলঘুলির ভেতর থেকে আওয়াজ ওঠে, তিক্‌খো তক্‌খো— অর্থাৎ তক্ষক ডাকছে।
      তক্ষকটাকে ভেংচি কেটে বা পাশের সিলিংয়ের কোণ থেকে কারা যেন ভারী গম্ভীর গলায় হুমকে ওঠে, ভূতুম—ভূতুম—ভূতুম—
      অমন যে দুর্জয় সাহসী বাজু, তার বুকের ভেতরটা পর্যন্ত ছমছম করে ওঠে। হাত-পা তার ভীষণ কাঁপছে আরেকটু হলে তার হাত থেকে টর্চ আর লাঠি খসে পড়ত। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেয় সে।
      বিট্টুর বুকটাও গুরগুর করছিল। বাজুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে কাঁপা গলায় বলে, কী ব্যাপার রে?”
      বাজু বলে, ‘দাঁড়া দেখছি।’
     সিলিংয়ের যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছে, আন্দাজ করে মুখ তুলে সেখানে তাকায় বাজু। আর তখনই দেখতে পায় চারজোড়া জ্বলন্ত চোখ সেখানে স্থির হয়ে আছে। বিট্টু ‘বাবা গো' বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পড়ে। বাজুও পড়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী মনে পড়তে সেই চোখগুলোর ওপর টর্চের আলো ফেলে। তখনই দেখা যায়, সিলিংয়ের লোহার বিমের ওপর সারি সারি চারটে পেঁচা বসে আছে।
      বাজু হাত ধরে বন্ধুকে টেনে তুলতে তুলতে বলে, ভয় নেই বিট্টু, ওগুলো পেঁচা রে! ওঠ ।
      বিট্টু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পেঁচাগুলোকে দেখে তার ভয় অনেকটা কেটে যায়। বলে, আর দাড়াস না। চল—”=’
      পা টিপে টিপে বারান্দা ধরে দুই বন্ধু এগিয়ে যায়। তাদের বা পাশে সারি সারি ঘর। বেশিরভাগ ঘরেরই দরজা-জানালা লোপাট হয়ে গেছে। বিরাট বিরাট ফোকরগুলো দিয়ে বাইরের ঝাপসা আলো ভেতরে গিয়ে পড়েছে। সেদিকে তাকালে মনে হয়, কারা যেন ঘরগুলোর মধ্যে ওঁত পেতে বসে আছে যে কোনো মুহুর্তে তারা ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
      শেষ পর্যন্ত দক্ষিণের শেষ ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ায় বাজুরা। এ ঘরের দরজার পাল্লা নেই, তবে জানালাগুলো আস্তই আছে।
      বিট্টু ফিসফিসিয়ে বলে, কি রে, ভেতরে ঢুকবি?’
     বাজু কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ঘরের ভেতর থেকে খোনা গলায় কেউ বলে ওঠে, ‘ঢুঁকবে বৈকি, অ্যাঁদ্দু এঁসে নাঁ ঢুঁকলে চলে? এঁসো, এঁসো, তোঁমাদের সঁঙ্গে এঁকটু গঁল্প-টঁল্প কঁরি।’
      দুই বন্ধুর হৃৎপিণ্ড বলের মতো লাফাতে থাকে। তারা কী করবে, ভেবে পায় না।
      ঘর থেকে সেই গলাটা আবার ভেসে আসে, ‘কীঁ হঁল, দাঁড়িয়ে রঁইলে কেঁন? তোঁমাদের তোঁ দাঁরুণ সাঁহস। চঁলে এঁসো। আঁমি দেঁখতে পাঁচ্ছি, তোঁমাদের সঁঙ্গে টঁর্চ, লাঁঠি আঁর এঁয়ারগাঁন রঁয়েছে।
      অন্ধকারে দুই বন্ধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর দেখাই যাক না, কী হয়’—এমন একখানা ভাব করে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ে।
      বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা অনেক বেশি অন্ধকার। একটা দেওয়ালের কাছে সেই অন্ধকার যেন আরো জমাট বেঁধে আছে। মনে হয় লম্বা কালো কোট পরে বেজায় ঢ্যাঙা কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে। কম করে সে আট-নফিট লম্বা তো হবেই, মাথা প্রায় সিলিংয়ে গিয়ে ঠেলেছে। সেটার গায়ে দুটো জুলন্ত চোখ আটকানো। আর যা চোখে পড়ে তা হল দশ-বারো ইঞ্চি মাপের বিরাট বিরাট ধবধবে ক’টা দাঁত।
      দাঁত এবং চোখ দেখে দুই বন্ধুর দাঁতকপাটি লেগে যাবার অবস্থা। তাদের গলার ভেতর থেকে ‘আঁক’ করে একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসে।
      সেই গলাটা আবার শোনা যায়, ‘কী নাম তোমাদের?’
     ম্যালেরিয়া হলে যেমন হয়, ভয়ে তেমনি ঠকঠক করে কঁপিছিল বাজুরা। তারই মধ্যে কোনোরকমে দুজনে নাম বলে।
      ‘তোঁমরা কোঁথায় থাঁকো?’
      বাজু বলে, সেলিমপুরে। বিট্টু বলে, ট্রাঙ্গুলার পার্কের কাছে।’
      ‘এখানে কোথায় এসেছিলে?’
      কোথায় এসেছে, বাজুরা জানায়।
      ‘ওঁ মাঁমার বাঁড়িতে বেঁড়াতে এঁসেছ?’
      ‘হ্যাঁ।’
      ‘রাত দুপুরে এই হানাবাড়িতে ঢুকেছিলে কেন?
      ‘এই–মানে, মানে—’
      বুঁঝতে পেঁরেছি। ভূঁত দেঁখতে এঁসেছ। তোঁমাদের মঁতো সাঁহসী ছেঁলে আঁর দেঁখিনি। আঁলাপ কঁরে ভাঁরী খুঁশি হঁলাম।
      কাঁপতে কাঁপতে বাজুরা বলে, “আমরাও।”
      সেই গলাটি শোনা যায়, তোমাদের সাহসের জন্যে কিছু উপহার দিচ্ছি। এই নাও।
      দুটাে বেজায় লম্বা কালো হাত বাজু আর বিট্টুর দিকে এগিয়ে আসে। সেই হাতে কাজুবাদামের প্যাকেট, বড় চকোলেট বার ইত্যাদি রয়েছে।
      বাজুরা নেবে কি নেবে না যখন ভাবছে, সেই সময় গলাটা ফের কানে আসে, ‘নাঁও, নাঁও—
      কাঁপতে কাঁপতে বাজু আর বিটু কাজুবাদাম আর চকোলেট তুলে নিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ।
      ‘থ্যাঁঙ্কস তোঁ আঁমার দেঁবার কঁথা। আঁচ্ছা, এঁবার তোঁমরা বাঁড়ি যাঁও। নঁইলে দাঁদাই দিঁদুন আঁর মাঁসি ভাঁববে।’
      পোড়ো বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজুরা আবার সেই ফাঁকা নির্জন মাঠের ওপর দিয়ে ফিরে আসে।
     মাসি আর দিদন গেটের কাছের দুটো জোরালো আলো জ্বেলে বসেছিলেন। বাজুদের দেখে দৌড়ে আসেন। দুজনকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে বলেন, তোদের জন্যে ভেবে ভেবে আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিছু হয়নি তো তোদের?
      বাজু এবং বিটু একসঙ্গে জানায়, কী আবার হবে?
      মাসি বলে, ‘ভয়-টয় পাসনি তো?’
      ভয় যে যথেষ্টই পেয়েছে তা কি আর বাজুরা স্বীকার করে? তারা বলে, কিসের ভয়? ধুস—’
      দারুণ কৌতুহল হচ্ছিল মাসির। সে জিগ্যেস করে, কী দেখলি ওখানে?
     দিদন চান না পোড়ো বাড়ির ব্যাপারে আজ কোনো কথা হোক। তিনি মাসিকে বলেন, যা শোনার কাল শুনিস। রাত দেড়টা বাজে। ওদের ঘুমনো দরকার। আয় বিট্টু, আয় বাজু— দুজনকে তাদের ঘরে নিয়ে যান তিনি।
      ওরা যখন হাত-পা ধুয়ে জামা-প্যান্ট পাল্টে শুয়ে পড়েছে আর দিদন ওদের মশারি গুজে দিচ্ছেন সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে দাদাই এসে হাজির। তিনি বলেন, কি বাজুদাদা, বিটুদাদা— মোলাকাত হল?’
      দুই বন্ধু বলে, তা হয়েছে। আমরা ভালো ভালো প্রেজেন্টও পেয়েছি। কিন্তু—’
      কিন্তু কী?’
      ‘ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’
      ‘কোনো খটকা লাগছে?’
      ‘হুঁ।’
      ‘কী?’
      একটু চিন্তা করে বাজু বলে, ‘কাল বলব।’
      ‘ওকে। কালই শুনব। গুড নাইট।’
      ‘গুড নাইট।’
      দাদাই দিদন আর মাসিকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
      ভোরবেলা, তখনও রোদ ওঠেনি, আকাশটা আবছা মতো, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় বাজুর। রাত্তিরে ভালো করে ঘুমোতে পারেনি সে। বার বার পোড়ো বাড়ির ঘটনাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। পোড়ো বাড়িতে তারা যা দেখেছে তার মধ্যে কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে। গোলমালটা কী ধরনের সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
      দুই বন্ধু একটা প্রকাণ্ড খাটে পাশাপাশি শুয়েছিল। আস্তে আস্তে বাজু বাঁদিকে কাত হতেই দেখতে পায় বিট্টু মশারির চালের দিকে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে আছে। সে ডাকে, এই—
      বিট্টু সাড়া দেয়, কী বলছিস? 
     তক্ষুনি উত্তর দেয় না বাজু! কী যেন ভেবে কিছুক্ষণ বাদে বলে, ‘আচ্ছা, ভূতেরা তো শুনেছি দাঁত-মুখ খিচিয়ে খালি ভয় দেখায়।’
      ‘হুম।’
      কিন্তু কাল রাত্তিরে কী হল? আমাদের সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলল, কাজু-চকোলেট দিল। জানিস, আমার কিরকম যেন মনে হচ্ছে।’
      আমারও তাই। রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়নি, খালি এইসব কথা ভেবেছি। 
      খানিকক্ষণ চুপচাপ। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে কিছু চিন্তা করে বাজু। তারপর বলে, ‘এক কাজ করি চল—’ 
      বিট্টু বলে, কী রে?
      কাউকে না জানিয়ে চুপি চুপি এখন একবার ঐ পোড়ো বাড়িটায় যাই চল। আমার মনে হয় কোনো একটা ক্লু-টু পেয়ে যাব।’
      দুই বন্ধু অজস্র ডিটেকটিভ গল্প পড়েছে। তাদের ধারণা, শার্লক হোমস, কিরীটী রায়, ফেলুদার মতো তারাও একেকটি দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। পোড়ো বাড়ির ভূতটিকে মেনে নিতে তাদের আটকাচ্ছে। নিশ্চয়ই এর ভেতর কোনো রহস্য আছে।
      আমিও তাই ভাবছিলাম। চল, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি। বিটু প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। মামাবাড়িতে এখনও কেউ ওঠেনি। বিটু আর বাজু নিঃশব্দে গেট খুলে বেরিয়ে পড়ে। পোড়ো বাড়ির দোতলায় সেই ঘরটিতে এসে দেখতে পায়, দেওয়ালের কাছে যেখানে কাল দুটো জুলন্ত চোখ আর লম্বা লম্বা সাদা দাঁত দেখেছিল সেখানে অনেকগুলো ইট থাকে থাকে সাজিয়ে উঁচু বেদির মতো করা হয়েছে। তার ওপর কালো কাপড়ের বিরাট এক আলখাল্লা পড়ে আছে। সেটা তুলে ধরতে দেখা যায়, দু’জায়গায় গোল করে কী যেন লাগানো রয়েছে। আবছা অন্ধকারে সে দুটো যেন জ্বলছে।
      বাজু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে, ফসফরাস। কাল রাত্তিরে এই দেখে মনে হয়েছিল ভূতের চোখ। এদিকে বিটু সাদা শোলার তৈরি দাঁতের পাটি আবিষ্কার করে ফেলে। বলে, এই দ্যাখ, ভূতের দাঁত। কাল এগুলো চোখের নীচে আটকে আমাদের ভয় দেখানো হয়েছিল।’
      ‘হুঁ।’ বাজু বলে, দ্যাখ তো আর কিছু ক্লু পাওয়া যায় কিনা।’ 
    খোঁজাখুঁজি করতে করতে দু’বন্ধুর চোখে পড়ে ঘরের মেঝের ধুলোতে তাদের জুতোর ছাপ ছাড়াও বড় কেডসের দাগ পড়ে আছে।
      দাগগুলোর পাশে বসে দুই বন্ধু অনেকক্ষণ ঝুঁকে দেখতে থাকে। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ভীষণ ব্যস্তভাবে বাজু বলে, ‘তুই এখানে থাক, আমি দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসছি।’ বলে দৌড়তে দৌড়তে বেরিয়ে যায়।
      দশ মিনিটও লাগে না, তার অনেক আগেই একজোড়া কেডস নিয়ে ফিরে আসে বাজু। তারপর পুরোনো দাগগুলোর পাশে কেডস রেখে চাপ দিতেই নতুন দাগ হয়ে যায়। আগের দাগ আর এই দাগ হুবহু এক। অর্থাৎ বাজু যে কেডস নিয়ে এসেছে সেটা পরে কাল কেউ এখানে এসেছিল।
      বাজু দাগগুলো দেখিয়ে বলে, বুঝতে পারছিস তো? 
       বিট্টু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। বলে, ‘হু। 
     ‘চল, এবার ফেরা যাক।’ 
      কালো আলখাল্লা, দাঁত, কেডস ইত্যাদি নিয়ে যখন বাজুরা মামাবাড়িতে ফিরে আসে, দাদাই আর দিদন সামনের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। মাসিকে অবশ্য দেখা যায় না। সে একেবারে লেট লতিফ, সাড়ে আটটার আগে কোনোদিনই তার ঘুম ভাঙে না।
      বাজুদের দেখে অবাক হয়ে যান দাদাই আর দিদন। দাদাই বলেন, এ কী, কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?
      বিট্টু বলে, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল, তাই ভাবলাম ঐ পোড়ো বাড়িটায় একবার ঘুরে আসি। 
      দাদাই চমকে ওঠেন, ‘গিয়েছিলে নাকি?’ 
      ‘হ্যাঁ গেলাম। ভাবলাম দেখি যদি কালকের সেই মক্কেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।’ 
      ‘কী সর্বনাশ!’ 
      বাজু বলে, দেখা হল না। তবে তার জার্সিটা নিয়ে এসেছি। বলে সেই আলখাল্লাটা এবং দাঁতগুলো তুলে ধরে।
     তারপর সেগুলো নামিয়ে রেখে সেই কেডস দুটো দেখিয়ে বলে, ‘পোড়ো বাড়ির ঐ ঘরটায় ধুলের ওপর এগুলোর অনেক ছাপ রয়েছে। চোখের কোণ দিয়ে দাদাইকে দেখতে দেখতে বলে, তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে এই কেডস দুটো তোমার। এ দুটো পরে তুমি বিকেলে লেকের দিকে বড়তে যাও না?’
      ঢোক গিলেই দাদাই বলেন, ‘হ্যাঁ আমারই তো। কিন্তু—’ 
      ‘আমরা কোত্থেকে নিয়ে এলাম, জানতে চাইছ কি?’
      ‘হ্যাঁ’
      ছাপের সঙ্গে মেলাবার জন্যে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বাজু বলতে থাকে, দিস ইজ ব্যাড দাদাই। আমাদের বিশ্বাস করাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভুত সাজতে হল!'
      দিদন হঠাৎ ভীষণ রেগে গিয়ে দাদাইকে বলেন, ‘ছি ছি, এ কী করেছ তুমি! যদি কিছু একটা হয়ে যেত! তোমার কি আক্কেল নেই!’
      দাদাই কাচুমাচু মুখে বলেন, “ওদের সাহস কতখানি সেটাই পরখ করছিলাম। ওখানে গিয়ে তো ক্ষতি হয়নি, কাজুবাদাম পেয়েছে, চকোবার পেয়েছে।’
      বাজু বলে, ‘ভূত যে আছে, তা কিন্তু প্রমাণ করতে পারনি দাদাই। আমাদের স্রেফ ধাপ্পা দিয়েছ।
      দাদাই বলেন, তা হয়তো দিয়েছি। কিন্তু একটা কথার জবাব দাও তো দাদারা—’
      ‘কী?’
      ‘কাল জুলন্ত চোখ আর লম্বা লম্বা দাঁত দেখে তোমরা ভয় পাওনি?’
      বাজু, বিটু দুজনেই হকচকিয়ে যায়। বলে, মিথ্যে কথা বলব না, সত্যি ভয় পেয়েছিলাম।
     দাদাই এবার হেসে হেসে বলেন, ভূত-টুত নেই, আবার আছেও। কোথায় আছে জানো? আমাদের মনের ভেতর। ভয় পেলেই সে তোমাকে চেপে ধরবে, যেমন কাল ধরেছিল। ভয় না পেলে তোমাদের একশ মাইলের ভেতর সে ঘেঁষবে না।’

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

     ধর্মতলায় নিধু জ্যাঠার সঙ্গে ট্রাম থেকে নেমে কার্জন পার্কের ভেতর দিয়ে ইডেন গার্ডেনের দিকে য়েতে যেতে একেবারে হাঁ হয়ে গেল রাজা। চারপাশ...

     ধর্মতলায় নিধু জ্যাঠার সঙ্গে ট্রাম থেকে নেমে কার্জন পার্কের ভেতর দিয়ে ইডেন গার্ডেনের দিকে য়েতে যেতে একেবারে হাঁ হয়ে গেল রাজা। চারপাশ থেকে যত বাস মিনিবাস ট্রাম ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার আসছে, সব মানুষে ঠাসা। গাড়িগুলো এসে থামছে কার্জন পার্কে, রাজভবনের গায়ে এবং ওধারের ময়দানে। সেগুলো থেকে গল গল করে মানুষ বেরিয়ে এসে সোজা চলেছে ইডেন গার্ডেনের দিকে। আজ গোটা কলকাতা যাচ্ছে রঞ্জি স্টেডিয়ামে ইণ্ডিয়া ভার্সাস ইংল্যাণ্ডের টেস্ট ম্যাচ দেখতে।
     কার্জন পার্ক থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। অগুনতি গাড়ি সামনে দিয়ে দারুণ স্পীডে রেড রোডের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ট্রাফিক কনট্রোলে লাল আলো জ্বলতেই ছুটন্ত গাড়িগুলো থেমে গেল। আর নিধু জ্যাঠার হাত ধরে, রাস্তা পেরিয়ে রাজভবনের ফুটপাথে চলে এল রাজা। তারপর মানুষের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল।
     নিধু জ্যাঠার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সাধারণ বাঙালিদের তুলনায় সে অনেক লম্বা, প্রায় ছ ফুটের মতো। টান টান চেহারা, শরীরে এক গ্রাম বাজে চর্বি নেই। মাথার প্রায় সব চুল সাদা হয়ে গেছে, তবু নিধুজ্যাঠা খুব স্মার্ট। তার হাটার ভঙ্গি যুবকদের মতো।
     এই মুহুর্তে নিধু জ্যাঠার পরনে মালকোচা দিয়ে পরা ধুতি আর ফুল শার্ট, তার ওপর রোয়াওলা উলের সোয়েটার। পায়ে কেডস। কাঁধ থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে।
     তার পাশে রাজাকে বেশ ছোট দেখাচ্ছে। রাজার পরনে এখন ফুল প্যান্ট আর বুশ শার্ট, তার ওপর লাল পুল-ওভার। পায়ে নীল মোজা আর বুট।
     রাজভবনের ফুটপাথটা সেমি সার্কেলে ঘুরে গেছেf সেটা ধরে খানিকটা যেতেই চোখে পড়ল, ওধারের ময়দানে কয়েক হাজার প্রাইভেট কার পার্ক করা রয়েছে। তার মানে গাড়িওলারা ওখানে গাড়ি রেখে স্টেডিয়ামে ঢুকেছে। খেলা ভাঙলে ফিরে এসে যে যার গাড়িতে উঠে চলে যাবে।
     নিধু জ্যাঠার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দারুণ ভাল লাগছিল রাজার, ভীষণ উত্তেজনাও হচ্ছিল। তার কারণ, এই প্রথম সে ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাচ্ছে।
     রাজারা থাকে উত্তর কলকাতায়—বাগবাজারের কাছে একটা সরু গলিতে। সে পড়ে মডেল স্কুলে, ক্লাস সিক্সে। আজ একত্ৰিশে ডিসেম্বর। এ বছরেরই অক্টোবরে সে এগার পেরিয়ে বারোয় পা দিয়েছে।
     পড়াশোনায় রাজা বেশ ভাল। প্রতি বছর ক্লাসে ফাস্ট হয়ে আসছে। লেখাপড়ার মতো খেলাধুলোতেও তার খুব ঝোঁক। কিন্তু নর্থ ক্যালকাটায় খেলার মাঠ নেই। কখনও সখনও কোনো পার্কে একটু জায়গা পেলে পাড়ার ছেলেদের জুটিয়ে টেনিস বল দিয়ে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল কি ইণ্ডিয়া-অষ্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের আসর বসিয়ে দেয়। নইলে খবরের কাগজের খেলার পাতা আর ঝকমকানো রঙিন সব স্পোর্টস ম্যাগাজিন পড়ে কখনও সে স্বপ্ন দ্যাখে পেলের মতো ফুটবল খেলোয়াড় হবে, কখনও বা ভাবে ভিভ রিচার্ডসের মতো ব্যাটসম্যান না হলে চলবে না।
     এই খেলাধুলোর ব্যাপারটায় সারাক্ষণ রাজাকে তাতিয়ে রাখে নিধু জ্যাঠা। এই যে আজ জীবনে প্রথম ইডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাচ্ছে সেটাও নিধু জ্যাঠার জন্যই।
     রাজার বাবারও খেলাটেলায় যথেষ্ট আগ্রহ। তিনি মোটামুটি একটা চাকরি করেন। এদিকে ফ্যামিলিতে লোকজন অনেক। রাজারা চার ভাইবোন, বাবা, মা, ঠাকুমা আর এক বিধবা পিসিমা। মোট আটজন। এত বড় সংসার চালাতে অফিস ছুটির পরও বাবা আরো কী সব করেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোজই তার রাত হয়। অনেক কষ্টে টায়টোয় কোনোরকমে রাজাদের চলে যায়।
     বাবার পক্ষে পঁচাত্তর টাকা দিয়ে টেস্ট ম্যাচের টিকিট কেটে দেওয়া সম্ভব না। দামী দামী খেলার ম্যাগাজিনও তিনি কিনে দিতে পারেন না। বাড়িতে একটাই মোটে বাংলা খবরের কাগজ আসে। নিধু জ্যাঠাই এর ওর কাছ থেকে অন্য সব খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন চেয়ে এনে রাজাকে দেয়। পড়া হয়ে গেলে সেগুলো ফেরত দিয়ে আসে।
     টেস্ট খেলা তো আজ বললে কাল হয় না। ছ'মাস কি তারও আগে ঠিক করা থাকে। এবার ইডেনে ইণ্ডিয়া ইংল্যাণ্ডের টেস্ট দেখার জন্য রাজা আর নিধু জ্যাঠা সবাইকে লুকিয়ে পয়সা জমাতে শুরু করেছিল। দুজনের টিকিটের দাম দেড়শ টাকা। টেস্টের তারিখটা জানার পর থেকেই টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে একটা ফাঁকা পাউডারের কোটোয় রাখছিল রাজা। এইভাবে পচিশ টাকা জমানো গেছে। বাকি একশ পঁচিশ টাকা দিয়ে দুখানা টিকিট কিনে আনে নিধু জ্যাঠা।
     নিধু জ্যাঠা রাজার আপন জ্যাঠা নয়। এমন কি তার সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্কই নেই। না থাক,তবু আপনজনের চেয়ে সে অনেক বেশি।
     রাজা শুনেছে, দেশভাগের আগে ঢাকা শহয়ে বাবা যে পাড়ায় থাকতেন নিধু জ্যাঠাও সেখানেই থাকত। বাবার থেকে কয়েক বছরের বড় ; সেই হিসেবে সে বাবার দাদা, রাজাদের জ্যাঠা।
     নিধু জ্যাঠার পোশাকী নাম প্রিয়নাথ নাগ, ডাকনাম নিধু। ভাল নামটা লোকে ভুলেই গেছে। নিধুটাই সবার মুখে মুখে চালু রয়েছে।
     নিধু জ্যাঠার তিন কুলে কেউ নেই, বিয়েও করেনি। রাজা শুনেছে, দেশভাগের কয়েক বছর বাদে ঢাকা থেকে বাবাদের সঙ্গে সে-ও কলকাতায় চলে আসে। তার জন্মের ঢের আগে থেকেই নিধু জ্যাঠা তাদের বাড়িতে আছে। তবে তার খরচ সে নিজেই চালায়। কলেজ স্ত্রীটে একটা বড় বইয়ের দোকানে কী একটা কাজ করে। তাতে যে মাইনে পায় তার প্রায় সবটাই মাসের শেষে বাবার হাতে তুলে দেয়। তাতে রাজাদের যথেষ্ট উপকার হয়। দিনে সাত-আট কাপ চা ছাড়া আর কোনো নেশা নেই। সবাই তাকে ভালবাসে। ছোটদের যত আবদার তার কাছে।
     রাজা আরো শুনেছে ঢাকায় থাকতে দুর্দান্ত স্পোর্টসম্যান ছিল নিধু জ্যাঠা । বিখ্যাত উয়াড়ি ক্লাবের যে ছিল বাঘা রাই আউট। তখন ঢাকায় ক্রিকেট খেলাটা তেমন একটা হত না। তবু উৎসাহ কম ছিল না। ওরই মধ্যে ব্যাট-ট্যাট কিনে প্র্যাকটিশ করত।
     পৃথিবীতে যত বড় বড় ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা হয়েছে তার সমস্ত রেকর্ড নিধু জ্যাঠার মুখস্থ। তার কাছেই রাজা শুনেছে টেস্ট ম্যাচে কে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছে, কে বেশি ক্যাচ ধরেছে, কোন দেশে সবচেয়ে বেশি অল রাউণ্ডার পাওয়া গেছে, ইত্যাদি। ফুটবলের গল্প শুরু হলে তো রাতের পর রাত কাবার করে দিতে পারে নিধু জ্যাঠা। পেলে, লেভ ইয়াসিন, গ্যারিঞ্চা বা জার্ড মূলার থেকে পাওলো রোসি পর্যন্ত কে কীভাবে গোল করে, কার খেলার স্টাইল কী রকম—বলতে বলতে তার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে।
     এতক্ষণে বাঁ দিকে রেড রোড, নেতাজীর স্ট্যাচু, দেশবন্ধুর মূর্তি রেখে আকাশবাণী ভবনের সামনে এসে পড়ল রাজারা। এখানে বাঁশের খুঁটি পুঁতে নানা গেটের দিকে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারদিকে প্রচুর পুলিশ। একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করে সাত নম্বর গেটের হদিসটা জেনে নিল নিধু জ্যাঠা।
     মিনিট পনেরর ভেতর দেখা গেল, ক্লাব হাউসের ডান দিকে সিমেন্টের গ্যালারিতে তারা সীট খুঁজে বসে পড়েছে। বাড়ি থেকে আসার সময় দুপুরে খাবার জন্য মা লুচি আলুভাজা ডিমসেদ্ধ আর কমলালেবু দিয়েছিল। খাবারগুলো একটা কাপড়ের সাইড-ব্যাগে পুরে নিয়ে এসেছে নিধু জ্যাঠা । ব্যাগটা এখন তার কোলে।
     এখনও খেলা শুরু হয়নি। সবে সাড়ে ন’টা। আরো আধ ঘণ্টা বাদে ঠিক দশটায় টস হবে, তারপর তো খেলা।
     রাজা মাথা ঘুরিয়ে ঘুবিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। তাদের বাঁ পাশে ক্লাব হাউস। তারপর থেকে গোল মাঠটাকে ঘিরে স্টেডিয়ামের অনেকগুলো ব্লক। ব্লকগুলোতে এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। অসংখ্য গেট দিয়ে আরো অনেকে আসছে। কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা থাকবে না, খেলা শুরু হবার আগে স্টেডিয়াম বোঝাই হয়ে যাবে।
     পশ্চিম দিকের ব্লকগুলোর পেছনে ইডেন গার্ডেনের উঁচু উঁচু গাছ, আরো দুরে হাইকোর্টের চুড়ো দেখা যাচ্ছে।
    এতদিন রাজা তার বন্ধু বুবুনদের টিভিতেই রঞ্জি স্টেডিয়াম দেখেছে। এখন নিজের চোখে সব দেখতে পাচ্ছে। এত মানুষ, তাদের নানা রঙের পোশাক, মাথার টুপি, ক্লাব হাউস, ইডেনের গাছপালা—সমস্ত মিলিয়ে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
     এ বছর শীতটা বেশ জাকিয়েই পড়েছে। কনকনে হাওয়া ইডেন গার্ডেনের ওপর দিয়ে সাই সাই ছুটে যাচ্ছে। হাওয়াটা এত ঠাণ্ডা, মনে হয় হিমালয়ের বরফ গায়ে মেখে নেমে এসেছে। অবশ্য রোদও উঠেছে চমৎকার। উষ্ণ সোনালি রোদ আর ঠাণ্ডা বাতাসে শীতের সকালটি দারুণ লাগছে।
     চারপাশের মানুষেরা আজকের খেলাটার ব্যাপারে নানা রকম মন্তব্য করে যাচ্ছে। একজন বলল, ‘গাভাসকার টপ ফর্মে আছে। ইডেনে ডাবল সেঞ্চুরি করবে।’ আরেক জন বলল, কচু করবে। কাওয়ানস আর এডমণ্ডসকে ঠেকিয়ে কুড়িটা রান আগে করুক। তারপর বলবেন--”
     তৃতীয় লোকটি বলল, “এই নতুন ছেলেটা, মনে আজাহারউদ্দিন সম্পর্কে কী মনে হয়? 
    চতুর্থ লোকটি বলল, “আমার ধারণা, খুব ভাল খেলবে। ওকে পাওয়াতে ইণ্ডিয়ার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে।’
     পঞ্চম লোকটি বলল, ইংল্যাণ্ডের ল্যাম্ব আর গ্যাটিং দুর্দান্ত খেলছে এই সীজনটা। এখানকার টেস্টের রেজাল্ট কী হবে কে জানে।
     রাজারা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে পাঁচ রো নিচের সীট থেকে একটা লোক অনবরত চেঁচিয়ে যাচ্ছে, এই আইসক্রিম, এই পটেটো চীপস, এই চিউয়িং গাম, এই পপ কন, ইধর আও— অর্থাৎ সামনে দিয়ে যে ফেরিওলা যা-ই নিয়ে যাক তাকেই ডাকছে লোকটা।
      রাজার বাঁ পাশের সীটে এক মহিলা স্টেডিয়ামে ঢুকেই ব্যাগ থেকে উলের গোলা বার করে সোয়েটার বুনে চলেছেন। তার ডান ধারে এক বেজায় মোটা মারোয়াড়ি আরেক জনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোতে শুরু করেছে। খুব সম্ভব উল বোনা আর ঘুমোবার মতো জরুরি কাজের জন্যই তাদের এখানে আসা।
     রাজা কিন্তু এসব কিছুই শুনছিল না, বা লক্ষ্যও করছিল না। সে শুধু স্বপ্নের ঘোরে পুরো স্টেডিয়ামটা বার বার দেখছে।
     হঠাৎ পাশ থেকে নিধু জ্যাঠা ডাকল, ‘রাজা—
     অন্যমনস্কর মতো সাড়া দিল রাজা, উ—
     “নোট বইটা এনেছিস?
    একটা তিন ইঞ্চি বাই দু ইঞ্চি মাপের ছোট-সবুজ মলাটের নোট বই রাজাকে দিয়েছে নিধু জ্যাঠা। ওটাতে পেলে গ্যারিঞ্চা বেকেন বাউয়ার থেকে শুরু করে মারাদোনা ফ্রান্সিস কোলি ইউসেবিও পর্যন্ত ফুটবলের বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের গোল করার কায়দা যেমন লেখা আছে তেমনি ভিভ রিচার্ডস, ব্রাডম্যান, উইকস, গাভাসকার ইত্যাদি ক্রিকেটের বড় বড় স্টাররা কে কীভাবে স্ট্রোক করেন তার নিখুঁত বর্ণনাও নোট বইটিতে পাওয়া যাবে। ক্রিকেট এবং ফুটবলের দারুণ কিছু ঘটলেই রাজার সবুজ নোট বুকে তা উঠে যায়।
     রাজা ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘এনেছি।’
     ‘ভেরি গুড। যখনই কারো ভালো স্ট্রোক কি বোলিং দেখবি তক্ষুণি টুকে রাখবি।
     মুখে কিছু না বলে আবার ঘাড় কাত করে রাজা।
     কাঁটায় কাঁটায় দশটায় পেঙ্গুইন পাখির মতো ঢলঢলে কালো কোট-পরা দুই আম্পায়ার এবং দু'দলের ক্যাপ্টেন সুনীল গাভাসকার আর ডেভিড গাওয়ার মাঠের মাঝখানে টস করতে এলেন। টসে জিতে ইণ্ডিয়া ব্যাটিং নিল। গাওয়ার এবং গাভাসকার ক্লাব হাউসে ফিরে গেলেন।
     আম্পায়াররা মাঠেই থেকে গেলেন।
    একটু পরেই গাওয়ার তার টম নিয়ে ফিল্ডিং করতে এলেন। গাভাসকার তার পার্টনার গাইকোয়াড়কে নিয়ে এলেন ব্যাটিং করতে।
     সবুজ কার্পেটের মতো গোল মাঠে ধপধপে সাদা ট্রাউজার্স শার্ট পরা এগার জন ফিল্ডার, দুজন ব্যাটসম্যান আর কালো কোট পরা দুজন আম্পায়ার ছাড়া আর কেউ নেই।
     এতদিন টিভিতে আর স্বপ্নে রাজা যাদের দেখেছে, এখন তারা একেবারে চোখের সামনে। উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে তার, চোখের পলক পড়ছে না।
     গাভাসকার আর গাইকোয়াড় কিন্তু বেশিক্ষণ ব্যাট করতে পারলেন না, অল্প রান করেই এডমণ্ডস এবং কাওয়ানসের বলে কট আউট হয়ে গেলেন।
     কাওয়ানস দুর্দান্ত বল করছিলেন। নিধু জ্যাঠা পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, ‘কাওয়ানসের বল করার কায়দাটা টুকে নে।’
     রাজা নোট বই আর ডট পেন বার করেই রেখেছিল। তক্ষুণি লিখে ফেলল। গাভাসকার এবং গাইকোয়াড়ের পর এলেন বেঙ্গসরকার আর অমরনাথ। বেঙ্গসরকার এবং অমরনাথের দুটো স্ট্রেট ড্রাইভ, একটা স্কোয়ার কাট আর একটা সুইপের বর্ণনা লিখে নিল রাজা।
     বেঙ্গসরকার এবং অমরনাথ জুটি আউট হলে এলেন রবি শাস্ত্রী আর আজাহারউদ্দিন। তাদের কত লেট কাট, অন ড্রাইভ, পুল আর কভার ড্রাইভের বিবরণ যে রাজার নোট বুকে টোকা হতে লাগল তার ঠিক নেই।
     একসময় প্রথম দিনের খেলা শেষ হলো ।
    এরপর আরো চার দিন নিধু জ্যাঠার সঙ্গে ইডেনে এল রাজা। ইণ্ডিয়ার প্রথম ইনিংস সাত উইকেটে চারশ সাইত্রিশ রানে ডিক্লেয়ার করে দেওয়া হলো। ইংল্যাণ্ড আউট হলো দুশো ছিয়াত্তর রানে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ ড্র হয়ে গেল।
     এর মধ্যে মাইক গ্যাটিং আর অ্যালান ল্যাম্বের হাটু মুড়ে পুল, সুইপ, ড্রাইভ, চেতন শৰ্মা, শিবরামকৃষ্ণণ ও শিবলাল যাদবের বোলিং-এর স্টাইল, ডেলিভারি, সব টুকে নিয়েছে রাজা।
     ১৯৫৫-এর পাঁচই জানুয়ারি খেলা শেষ হবার ঘণ্টাখানেক আগে পাশ থেকে নিধু জ্যাঠা হঠাৎ বলল, "আচ্ছা রাজা—’
     পাঁচ দিন ধরে রাজার চোখ মাঠের মাঝখানেই আটকে আছে। মুখ না ফিরিয়ে সে বলল, ‘কী বলছ?
     ‘স্টেডিয়ামে সবসুদ্ধ কত লোক আছে বল তো—
     ‘খবরের কাগজে লিখেছে আশী হাজার।’
     ‘এর মধ্যে কত বাঙালী আছে, মনে হয় ?
     ‘বলতে পারব না।’
     একটু ভেবে নিধু জ্যাঠা বলল, ‘ধর মিনিমাম সত্তর হাজার।
     রাজা উত্তর দিল না।
     নিধু জ্যাঠা এবার বলল, “সত্তর হাজার লোকের হাত কতগুলো?
     রাজা হতভম্বের মতো বলল, “তুমি কি খেলা দেখতে এসে গুণ অঙ্কের ক্লাস বসাতে চাইছ?
     ‘বল না—
     ‘একজন মানুষের দুটো করে হাত হলে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার।’
    ‘রাইট। ভেবে দ্যাখ, কেউ ভাল ব্যাট, বল বা ফিল্ডিং করলে সত্তর হাজার বাঙালী একলাখ চল্লিশ হাজার হাতে হাততালি দিচ্ছে। দিচ্ছে কিনা?
     মাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে বিমূঢের মতো তাকালো রাজা। বলল, ‘হ্যাঁ দিচ্ছে।’
     ‘এবার বল মাঠে কত জন প্লেয়ার খেলছে?
     ‘দু দলের বাইশ জন।
     ‘তাদের ভেতর ক'জন বাঙালী ?
     একজনও না।’
     অনেকক্ষণ চুপচাপ।
    তারপর খুব আস্তে আস্তে, অথচ বেশ জোম দিয়ে নিধু জ্যাঠা বলল, আর কেউ পারুক, আর না-ই পারুক, তোকে অন্তত মাঠের মাঝখানে ওই বাইশ জনের একজন হতে হবে।’
     রাজা চমকে উঠল, ‘কীভাবে?
     ‘লেখাপড়ার সঙ্গে ক্রিকেট প্র্যাকটিশ করে করে, ভাল খেলা শিখে।’
     ‘শিখব কী করে? আমার কি প্যাড আছে? ব্যাট, উইকেট, গ্লাভস, ডিউস বল আছে?
     ঠিক বলেছিস। খানিকক্ষণ চিন্তা করে নিধু জ্যাঠা বলল, “দেখি কী করা যায়।
    টেস্ট ম্যাচ শেষ হবার মাসখানেক বাদে একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ভীষণ অবাক হয়ে গেল রাজী। যতটা অবাক, ততটাই খুশি। নিধু জ্যাঠা নতুন ব্যাট, লাল টুকটুকে ডিউস বল, প্যাড, উইকেট আর গ্লাভস কিনে এনে তারজন্য অপেক্ষা করছে।
     রাজার বাবাও হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ায়, আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, নিধুদা, এত টাকা খরচ করে এসব কিনতে গেলে কেন ?
     নিধু জ্যাঠা বাবাকে বলল, “এ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না ভজন। রাজার বাবার ডাকনাম ভজন।
     “কিন্তু টাকাগুলো পেলে কোথায়? নিশ্চয়ই ধার-টার করেছ ? 
    ‘যা ভাল বুঝেছি, করেছি। তোর শরীর ভাল না, শুয়ে থাক গিয়ে। 
   বাবা তার এই একরোখা জেদী দাদাটিকে ভাল করেই চেনেন। আর একটি কথাও না বলে তিনি অনা ঘরে চলে গেলেন।
     নিধু জ্যাঠা বলল, তাহলে কাল থেকেই প্রাকটিশ শুরু করা যাক। ভাবছি তোর সঙ্গে আমিও নতুন করে আরম্ভ করব। ভোরবেলা উঠে আড়াই ঘণ্টা পড়ে নিবি, তারপর এক ঘণ্টা প্র্যাকটিশ। মাঠ থেকে ফিরে আধঘণ্টা রেস্ট। রেস্টের পর স্নান করে খেয়ে স্কুলে। আর আমি চলে যাব কলেজ স্ত্রীটে। কাল থেকে এই হবে আমাদের রোজকার রুটিন । ঠিক আছে?
     রাজা মাথা হেলিয়ে জানালো, “ঠিক আছে।’ 
    ‘মনে রাখবি, ইডেন গার্ডেনে মাঠের ভেতর যে বাইশ জনকে দেখেছিস তার একজন তোকে হতেই হবে।’
    রাজা বলল, মনে রাখবে। পরদিন সকালে ব্যাট প্যাড-ট্যাড নিয়ে ঠিক আটটায় রাজা আর নিধু জ্যাঠা চলে গেল কাছাকাছি একটা পার্কে। সেখানে ঘাস-টাস বলতে কিছু নেই। চারদিক গর্তে বোঝাই। এখানে ক্রিকেট প্র্যাকটিশ অসম্ভব।
     নিধু জ্যাঠা বলল, ‘চল, অন্য জায়গায় যাই।’ 
     খানিকটা দুরে আরেকটা পার্কে এসেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। সি. এম. ডি. এ’র কী সব কাজকর্ম হচ্ছে এদিকে, যার জন্য পার্কটায় অগুনতি গুদাম বানিয়ে মালপত্র রাখা হয়েছে। দশ ইঞ্চি জায়গাও এখানে ফাঁকা পড়ে নেই।
     এবার রাজারা গেল আরো দূরের একটা পার্কে। সেটা পাতাল রেল দখল করে রেখেছে। এখানেও বিরাট বিরাট গোডাউন। সেগুলো সিমেন্ট বালি লোহার রড এবং নানারকম ভারী ভারী যন্ত্রপাতিতে বোঝাই।
     রাজার স্কুল আর নিধু জ্যাঠার কাজে যাবার সময় হয়ে আসছিল। ওরা বাড়ি ফিরে এল। ঠিক হলো, পরের দিন আবার মাঠের খোঁজে বেরুবে।
     কিন্তু পরের দিনও খেলার মাঠ পাওয়া গেল না। সব পার্কই হয় সি. এম. ডি. এ নয় পাতাল রেল কিংবা হকার আর ভিখিরিরা দখল করে রেখেছে।
     চারদিন ঘোরাঘুরির পর একটা পার্ক পাওয়া গেল কিন্তু সেখানে বদমাশ বাজে ছোকরাদের আড্ডা। রাজাদের উইকেট পুততে দেখে তারা তেড়ে এল, এখানে খেলা-ফেলা চলবে না। ভাগ—
     রাজা হতাশ হয়ে পড়ল। কিন্তু নিধু জ্যাঠা ভেঙে পড়ার মানুষ না। খবর নিয়ে সে জানতে পারল, ওই ছোকরাগুলো সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পার্কে বসে থাকে। সারাক্ষণ নেশাটেশা করে। ওরা পারে না, এমন নোংরা কাজ নেই। ওদের জন্য সন্ধে পর্যন্ত কেউ পার্কে ঢুকতে পারে না। তবে সন্ধের পর ঠাণ্ডাটা যখন আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায় তখন ওরা পার্ক থেকে চলে যায় ।
     এই পার্কটার ভেতরে এবং চারদিকের রাস্তায় কপোরেশন প্রচুর তেজী আলো লাগিয়ে দিয়েছে। এত আলো যে একটা আলপিন পড়লে খুঁজে নেওয়া যায়।
     নিধু জ্যাঠা আর রাজা ঠিক করে ফেলল, রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর আলোয় ঝলমলে ফাঁকা পার্কে তারা প্র্যাকটিশ করতে আসবে। ঠাণ্ডাটা তখন একটু বেশিই থাকবে কিন্তু কী আর করা যাবে! ক্রিকেট তো শীতেরই খেলা। তা ছাড়া ইংল্যাণ্ডে গেলে তো এর থেকে অনেক বেশি ঠাণ্ডায় খেলতে হবে।
     পরদিন রাত থেকেই আলোকিত ফাঁকা মাঠে সত্তর বছরের একজন বোলার বারো বছরের এক ব্যাটসম্যানকে বল করতে থাকে। চারদিক নিঝুম, মাথার ওপর জানুয়ারির হিম পড়ে যাচ্ছে অবিরাম। কিন্তু দুই ক্রিকেটারের সে ব্যাপারে হুঁশ নেই। সারা পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে তারা প্রাকটিশ করে চলেছে।
     নিধু জ্যাঠা বল করতে করতে বলে, ‘এই একটা লেগ স্পিন দিলাম। সুইপ কর— রাজা ব্যাট চালায়। নিধু জ্যাঠা হা হা করে ওঠে, হলো না, হলো না। ল্যাম্ব শিবরামকৃষ্ণণের বলে টু মুড়ে কীভাবে সুইপ করেছিল, ভেবে নে--- বল কুড়িয়ে এনে আবার ডেলিভারি দিতে গিয়ে বলল, ‘আবার লেগ স্পিন দিচ্ছি। ট্রাই এগেন –
     এইভাবে রাতের পর রাত দুজনে প্র্যাকটিশ করে যায়। ইডেন গার্ডেনে বাইশ জন টেস্ট খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন হতে পারবে কিনা, রাজা জানে না। কিন্তু চেষ্টা তো করে যেতে হবে।