Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

রূপকথার গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

    কোন এক অঞ্চলে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। সেখানে বাস করত এক বুড়োবুড়ি দম্পতি। তাদের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না। আত্মীয় স্বজন দূরসম্পৰ্কীয় বলতে ক...

    কোন এক অঞ্চলে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। সেখানে বাস করত এক বুড়োবুড়ি দম্পতি। তাদের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না। আত্মীয় স্বজন দূরসম্পৰ্কীয় বলতে কেউ নেই। বৃদ্ধের বয়স হয়েছে তাই তার শরীরের চামড়াও কুচকুচে কালো হয়ে পড়েছে। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। যতই দিন যাচ্ছিল তার ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল। ছেলেমেয়ে কেউ নেই বিধায় কাদের উপর নির্ভর করবে। তারা । তাদের জমানো সম্পদও পড়ে রাইবে অবেলায় ।
    একদিন বুড়ো বুড়িকে ডেকে বলল, “ও বুড়ি, তোমার এখনও ছেলেমেয়ে সন্তান পাবার আশা মিটল না । তাই তোমার জন্য একটা কন্যা সন্তান এনেছি। ঐ যে ঝুড়িটা দেখছ এরই মধ্যেই রয়েছে। ঝুড়ির ঢাকনা খুলে দেখ সুন্দর একটা কন্যারত্ব যত্ন করে রেখেছি।”

    এক দেশে এক রাজা ছিল। তার রাণী একটি পুত্র একটি কন্যা সন্তান রেখে মারা গেল। রাজা দুই সন্তানকে নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন দিন কাটাত। রাজা যখন ...

    এক দেশে এক রাজা ছিল। তার রাণী একটি পুত্র একটি কন্যা সন্তান রেখে মারা গেল। রাজা দুই সন্তানকে নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন দিন কাটাত। রাজা যখন রাজসভায় থাকত দুটি শিশু রাজপ্রাসাদের বাইরের বারান্দায় ছুটােছুটি করে খেলত, দাস-দাসীরাও তেমন খেয়াল করত না। প্রাসাদের বাইরে প্রাচীর ঘেঁষে ছিল প্রজাদের একটি ছোট গ্রাম। খেলাধূলা করতে শিশু দুটি পাশ্ববর্তী গ্রামেও চলে যেত। গ্রামের একজন মহিলা প্রতিদিন শিশুদের খাবার দিত। দই, চিড়া, কলা, মুড়ি খাওয়াত। মাঝে মধ্যে ক্ষীর রেঁধে খাওয়াত। শিশুদুটি পেটভরে খেয়ে মহিলাটির কথা শুনত। একদিন মহিলাটি বলল, তোমাদের বাবা যদি আমাকে রাজপ্রাসাদে নিতেন, তাহলে তো তোমাদের আরও আদর যত্ন করতাম। পরিষ্কার করে প্রতিদিন স্নান করাতাম আর ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির গল্প শুনাতাম ।

    কোন এক রাজ্যে এক রাজা ছিল। সেই রাজ্যের রাজার ছিল একটি সুন্দর ফুলের বাগান। স্বর্গের পারিজাত ফুল থেকে শুরু করে এমন কোন ফুল নেই যে রাজার ব...

    কোন এক রাজ্যে এক রাজা ছিল। সেই রাজ্যের রাজার ছিল একটি সুন্দর ফুলের বাগান। স্বর্গের পারিজাত ফুল থেকে শুরু করে এমন কোন ফুল নেই যে রাজার বাগানে ফুটে না। গোলাপ, চামেলী, সূর্যমুখী আর চাঁপা ফুলের সুগন্ধের বাহার। রজনীগন্ধার মাঝে নিত্য ভ্রমর খেলা করত। আর মধু আহরণ করে বেড়াত। রাজা ভ্রমরের মৌ মৌ রবে নিজে গুনগুনিয়ে মনের অজান্তে গান গেয়ে উঠত। রাজ্যের হাজার কাজের মাঝেও এমন কোন দিন নেই যে রাজা বাগানে বেড়াতে যেত না। সুস্থ সুঠামদেহী পাহাড়াদার দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা বাগান তদারক করে থাকে। বাগানের মাঝখানে থাকত একটি আরাম কেদারা। রাজা মাঝে মধ্যে পরিশ্রান্ত হলে এখানে বিশ্রাম নিত। আর বাগানে ফুলের সৌন্দর্য অবলোকন করত। আলোর ঝলমল আভায় চোখ ধাঁধা লেগে যেত। হাজার হােক রাজার বাগান তো।

    এক দেশে ছিল একটি গ্রাম। সে গ্রামে ছিল একটি পরিবার। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। স্ত্রীর নাম পাচতলেইমা। পাচতলেইমা ছিল খুব অলস...

    এক দেশে ছিল একটি গ্রাম। সে গ্রামে ছিল একটি পরিবার। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। স্ত্রীর নাম পাচতলেইমা। পাচতলেইমা ছিল খুব অলস। পাশের বাড়ির বউ তাড়ালেইমা ছিল কর্মঠ। তাড়ালেইমার কাজ দেখে সবাই প্রশংসা করত। রাস যাত্রার নাচও সে খুব ভালো জানে। মৃদঙ্গর গমগম ধ্বনিতে তাড়ালেইমাবা বহুবার নেচেছে। শুধু তাই নয়, সে নানার ধরনের চাদর, গামছা, শাড়ি বুনতে পারে।
    পাচতলেইমার স্বামী একদিন স্ত্রীকে ডেকে বলল, ওহে গৃহলক্ষ্মী, তোমার মতো একজন তো পাশের বাড়িতেও আছে, ওর কারুকাজ তুমি কি দেখতে পাও না? বাড়িতে অতিথি এলে বসতে দেয়ার মতো কোনো কিছু নেই। অতিথিকে পরতে একটা বড় গামছাও দিতে পারব না। কেউ একজন ঘুমাতে এলে একটি বিছানার চাদরও নেই। এভাবে কী থাকা যায়? তুমি তোমার মায়ের বাড়ি চলে যাও।

    অনেক দিন আগের কথা। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে একটি ঝর্ণা, সেই ঝর্ণার ধারে ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামের প্রান্তে বাস করত এক বুড়ো...

    অনেক দিন আগের কথা। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে একটি ঝর্ণা, সেই ঝর্ণার ধারে ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামের প্রান্তে বাস করত এক বুড়ো-বুড়ি দম্পতি। তারা ছিল নিঃসন্তান। বুড়ো বয়সে তারা তেমন কাজ-কর্মও করতে পারত না। কাছের পাহাড়ে ছিল বন বাঁদরের বাস। ওরা মাঝে মধ্যে বুড়োর পশ্চিমের রবিশস্যের ক্ষেতে বিচরণ করত। আর এটা ওটা ফলমূল খেয়ে ফেলত। বুড়ো তাদের কোনদিন তেমন করে শাসায়নি। বলতে গেলে কলা করল্লার অর্ধেক অংশই তাদের পেটে যেত।
    সামনে কচুর মুখি লাগানোর মৌসুম। বুড়ো-বুড়ি ঠিক করল বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ের নিকটে এক পোয়া জমিতে এবার ভালভাবে কচুর মুখি লাগাবে। একদিন বুড়ো-বুড়ি দুজনে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে জমি খোদাই করে নিল। পরদিন দ্বিতীয়বারের মত কুপিয়ে জমিকে উর্বর করে তুলল।

    কোন এক সময়ে এক মহাজন ও একজন টেটন (বুদ্ধিমান) একটি সংকীর্ণ পাৰ্ব্বত্যপথে বিপরীত দিক হতে এসে হঠাৎ এক স্থানে মিলিত হল; কিন্তু রাস্তা এরূপ...

    কোন এক সময়ে এক মহাজন ও একজন টেটন (বুদ্ধিমান) একটি সংকীর্ণ পাৰ্ব্বত্যপথে বিপরীত দিক হতে এসে হঠাৎ এক স্থানে মিলিত হল; কিন্তু রাস্তা এরূপ সংকীর্ণ যে তাতে একবারে একাধিক লোক যাতায়াত করতে পারে না। পথিকেরা উভয়ই গর্বিত যুবক। কে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে, এই ভাবনায় উভয়েই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মহাজন ভাবল, আমি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, আমার যেমন ধনসম্পত্তি তেমনি সম্মান, প্রতিষ্ঠা, আমি এই সামান্য লোকের জন্য এক পার্শ্বে সরে যাব কেন?
    টেটন ভাবল, ‍বুদ্ধির জন্যে রাজদরবারের আমার কত প্রতিপত্তি, আমি কেন সরে যাব। টেটন, কিছুক্ষণ পরে, নির্বোধ লোকের সহিত পথিমধ্যে কলহ করা বুদ্ধিমানের শোভা পায় না, এই ভেবে বিনা বাক্য ব্যয়ে একপার্শ্বে একটুকু সরে দাঁড়াল।

      সে এক দেশ। আর সেই দেশের পশ্চিমে এক বিরাট পাহাড়। লোকে সেই পাহাড়কে বলে কাঁচ পাহাড়। আর সেই কাঁচ পাহাড়ে বাস করে এক কাঁচ দৈত্য। কাঁচের ...

      সে এক দেশ। আর সেই দেশের পশ্চিমে এক বিরাট পাহাড়। লোকে সেই পাহাড়কে বলে কাঁচ পাহাড়। আর সেই কাঁচ পাহাড়ে বাস করে এক কাঁচ দৈত্য। কাঁচের তার হাত-পা, কাঁচের তার চোখ-মুখ, এক কথায় সারা দেহটাই তার কাঁচের তৈরী। কিন্তু কাঁচ হলে কি হবে—দেহটা তার একেবারে পাথরের মতো শক্ত।
      এমনি সে কাঁচ দৈত্য, সে কিন্তু পশু খায় না, পক্ষী খায় না—খায় না মানুষও ! কিন্তু হলে কি হবে। সে দৈত্য তো বটে। হাতে না মারলেও—মারে সবাইকে ভাতে !
      যখনই তার ইচ্ছে হয়, কাঁচ পাহাড় থেকে নেমে আসে সেই দেশে। আর সেই দেশের সতেজ রসালো মাটিতে মুখ ডুবিয়ে শুষে খেয়ে যায় সব রসটুকু। তাই সেই দেশে হয় না চাষ, হয় না ফসল। বারো মাসই দেশে লেগে থাকে অাকাল।
তাই লোকে আর কি করে? উপায়ান্তর না দেখে শেষে একদিন রাজার পায়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—রাজা মশায় আমরা সবাই যে জানে-মালে মরতে বসেছি। ঘরে দুমুঠো চাল নেই যে খেয়ে বাঁচবো। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো, আমাদের চোখের সামনে শুকিয়ে মরছে না খেতে পেয়ে। কিন্তু কিছুই করতে পারছিনা আমরা। তাই উপায়ান্তর না দেখে ছুটে এসেছি আপনার কাছে। একটা কিছু উপায় যে আপনাকে করতেই হবে।
      কিন্তু কে শুনবে তাদের আকুতি! রাজা ছিল যেমন আলসে আর তেমনি নিষ্কর্মা। সারা দিন বসে বসে খেলতো কেবল পাশা। সেদিনও রাজা তাই খেলছিল। সবে একটা এঁটে সেঁটে বেশ করে চাল দিতে যাচ্ছে, আর অমনি হুড়মুড় করে ঢুকলো সেই লোকরা। আর তাদের গণ্ডগোলে রাজা গেলো ভুলে তার চাল। আর তাই রেগে হলো সে টং। রেগে মেগে প্রায় তেড়ে এসে চিৎকার করে উঠলো, —জাহান্নামে যা, যতো সব নচ্ছাড়ের দল। অমন সুন্দর চালটা আমার দিলো একেবারে পণ্ড করে। দাঁড়া, সব ব্যাটাকে চড়াবো আজ শূলে। তোরা মরবি তো আমার কি? সাহস কতো যে আমার খেলা করিস পণ্ড।
      রাজার এমন কথায় লোকরা তো একেবারে হতবাক। আশ্চর্য হয়ে তারা বল্লে, —রাজা, আমাদের প্রাণের চাইতে তোমার খেলাটাই হলো বড়ো ! বেশ তবে তুমি খেলো। দেখি এবার থেকে তোমার খাবার জোগায় কারা। তোমার সারা বছরের চাল ডাল তো জোগাতে হয় আমাদেরই। আমরাও দিলাম আজ থেকে সব বন্ধ করে। ব’লে তারা সবাই ধীরে ধীরে গেলো চলে। আর রাজা আবার বসলো খেলতে। কোন চিন্তাই যেন নেই তার।
      এদিকে সেই লোকদের মধ্যে ছিল, বিধবার একছেলে। যেমন ছিল সে চঞ্চল, তেমনি ছিল সাহসী আর তেমনি ছিল চালাক। নাম ছিল তার নিপু।
      সেই নিপু, সব দেখে—সব শুনে ছুটে এলো মা'র কাছে। বললো, —মা, আমি যাব সেই দৈত্য মারতে।
      ওর এমন কথা শুনে মা তো অবাক। বলে, —পাগল, তুই এতটুকু ছোট্ট ছেলে। অতবড়ো দৈত্য তুই মারতে পারিস? কিন্তু নিপু নাছোড়বান্দা। সে যাবেই। তাই মা আর কি করে? চোখের পানি মুছে একদিন তাকে বিদায় দেয়। নিপুও তাড়াতাড়ি মা'র চোখের পানি মুছিযে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সেই কাঁচ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। আর কি জানি কি ভেবে সাথে নিলো পাকা বাঁশের একটা লাঠি আর এক ঘটি খাঁটি সরষের তেল।
      তারপর নিয়ে-থুয়ে বেরিয়ে পড়লো পশ্চিমের পথে। সে চলছে—চলছে আর চলছে। পথ যেন আর শেষ হয় না। সে যতোই এগোয় পাহাড়টা যেন ততোই পেছিয়ে যায়। এমনি হাঁটতে হাঁটতে—হাঁটতে, শেষে সে এসে পৌছলো এক গহীন বনে।
      চারিদিকে তখন নেমে এসেছে নিকষ আঁধার। এতো আঁধার যে নিজেকে পর্যন্ত দেখা যায় না। এমনি আঁধারে নিপু পথ ফেললো হারিয়ে। এদিক যায়—ওদিক যায় কিন্তু পথ সে আর পায় না। তাই কি আর করে উপায় কিছু না করতে পেরে শেষে ভাবলো, রাতটা না হয় বনেই কাটানো যাক। ভোর হলে আলোয় পথ চিনে আবার রওয়ানা দেয়া যাবে ‘খন।
       এই ভেবে সে এদিক ওদিক থেকে কিছু ফলমূল, জোগাড় করে পেট ভরে খেয়ে নেয়। তারপর একটা বড়ো শক্তপোক্ত গাছ দেখে—তাতে চড়ে বসে। বলা তো যায়না কখন কোন জন্তু জানোয়ার এসে হামলা করে।
      রাত গড়িয়ে চল্লো। আর রাত যতো বাড়তে লাগলো, চারিদিক ততোই হতে লাগলো নিঝুম। শুধু থেকে থেকে পাখীর পাখা ঝাপটার শব্দ ভেসে আসে।
      এমন সময় হঠাৎ একটা হিস-হিস্ শব্দে সে একেবারে চমকে উঠে। সে সোজা হয়ে বসে এদিক ওদিক চায়। কিন্তু চোখে পড়েনা কিছুই। ভাবে— বাতাসের শব্দ হবে হয়তো। কিন্তু না, শব্দটা যেন ওকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে। সে ত্রস্তে গাছের ডালপাতাগুলো দেখে নিলো। কিন্তু কিছুইতো নড়েনা। এতো বাতাস নয়—নিশ্চয়ই অন্য কিছু ! কিন্তু কি?
এমন সময় তার চোখে পড়লো দুটো আগুনের পিণ্ড যেন এগিয়ে আসছে ও’র দিকে। ঠিক ও যে ডালে বসেছিল সেই ডালটা বেয়ে বেয়ে—আর তাই থেকে বেরুচ্ছে অদ্ভুত একটা হিস্-হিস্ শব্দ।
      সে স্থাণুর মতো বসে বসে কেবল দেখতেই লাগলো। নড়বার শক্তিও নেই তার এতোটুকু। কিসের মন্ত্রবলে যেন সে তার জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। যেন নেই তার হঠাৎ হিম-ঠাণ্ডা একটা নিঃশ্বাসের স্পর্শে সে চমকে উঠলো। দেখলো—সেই আগুনের পিণ্ড দুটাে একেবারে ওর সামনে। তারপরই ও'র মনে হলো ঠাণ্ডা কি যেন একটা ওকে আস্তে আস্তে চেপে ধরছে। আর বুঝি ও’র রক্ষা নেই। এবার সে বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে—ময়াল অজগরের হাত থেকে কেউ যেমন রক্ষা পায়না সেও পাবেনা। আস্তে আস্তে আরো জোরে যেন চেপে ধরছে অজগরটা। এতো জোরে যে, ও’র হাড়গুলো পর্যন্ত গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় আর কি।
      এমন সময় হঠাৎ ওর মাথায় খেলে গেলো এক বুদ্ধি। অনেক কষ্টে কোন রকমে একটা হাত মুক্ত করে, হঠাৎ তেলের ঘটিটা থেকে এক খাবলা তেল নিয়ে অজগরের জ্বলন্ত চোখ দুটোয় দিলো ছিটিয়ে।
      আর অমনি অজগরের চোখ উঠলো জ্বলে। দৃষ্টি হলো অন্ধ। তারপর চেপে ধরা বাঁধনটা আস্তে আস্তে হয়ে গেলো টিলে। আর সেই ফাঁকে নিপু তাড়াতাড়ি বাগিয়ে ধরলো তার লাঠিটা, ঠিক অজগরের মাথাটা লক্ষ্য করে। অজগরতো এবার প্রাণের ভয়ে হাউ মাউ করে উঠে বল্লো, —আমাকে মেরো না ভাই আমাকে মেরো না! তোমাকে আমি দৈত্য মারার পথ ব’লে দিচ্ছি। দৈত্য মারার উপায়ও করে দিচ্ছি। আমায় তুমি ছেড়ে দাও। আমায় তুমি মেরো না। আমি আর তোমার কোন ক্ষতি করবো না।
      নিপুর কেমন যেন মায়া হলো একটু—আহা বেচারা এমন করে বলছে। কি হবে মেরে? ব’লছে যখন—কিছু আর ক্ষতি করবেনা, তখন ছেড়েই দেয়া যাক। ছাড়া পেয়ে অজগর তো মহা খুশী। খুশী হয়ে নিপুকে বল্লে, —তুমি যখন আমার প্রাণ ফিরিয়ে দিলে, তখন আমিও তোমায় একটা উপহার দিলাম—এই নাও। বলে নিপুকে আশ্চর্য সুন্দর একটা তলোয়ার এগিয়ে দিলো।
      নিপু তলোয়ারটা নিয়ে চোখের সামনে ধরতেই সেটা সেই আঁধারেও ঝকঝক করে উঠলো। সে দেখলে তলোয়ারটা খাটি হীরের তৈরী। সে অদ্ভুত এই তলোয়ারটার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল।
      ও’কে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অজগর আবার বলে উঠলো, —এটা সাবধানে রেখো অনেক কাজে লাগবে। আর আরেকটা কথা, সকাল বেলায় এই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকবে এক পঙ্খীরাজ। কথা না বলে সটান চড়ে বসবে তাতে। সে তোমায় পশ্চিমের কাঁচ পাহাড়ে পৌছে দেবে। তারপর তোমার কাজ হয়ে গেলে, পঙ্খীরাজ আবার তোমায় তোমার দেশে রেখে আসবে। এই বলে অজগর আস্তে আস্তে আঁধারে গেলো মিলিয়ে। আর হতভম্ব নিপুহতবুদ্ধি হয়ে ঠায় রইল বসে।
      এদিকে সময় চল্লো বয়ে। রাত প্রথম প্রহর থেকে দ্বিতীয় প্রহরে পড়লো, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় প্রহরে তারপর তৃতীয় থেকে চতুর্থ প্রহরে যেই পড়েছে, অমনি হঠাৎ আকাশ ফাটানো একটা চি—হি—হি—হি শব্দে নিপু একেবারে চমকে উঠলো।
      সম্বিৎ পেয়ে ধড়মড় ক’রে উঠে বসতেই দেখে ঠিক তার নিচেই সুন্দর এক পঙ্খীরাজ দাঁড়িয়ে। ব্যাপার বুঝতে কিছুমাত্র তার দেরী হলো না। অজগরের কথা মতো তাই সে সটান চড়ে বসলো পঙ্খীরাজের পিঠে। তলোয়ারটা বেশ করে গুজে নিল কোমরে আর তেলের ঘটি ও লাঠিটা হাতে নিল বুলিয়ে।
      আর যেই না বসা, অমনি পঙ্খীরাজ দিল ছুট। সে কি আর যে-সে ছোটা? ঝড়-বিদ্যুৎকেও হারমানায়। শ’মাইল পথ যায় এক পলকে।
      পঙ্খীরাজ তো ছুটছে-ছুটছে-ছুটছে। পথ যেন আর শেষ হয় না। অমনি ছুটতে ছুটতে কখোন যেন দিনের প্রথম প্রহর গড়িয়ে দ্বিতীয় প্রহর এলো, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় প্রহর আর তৃতীয় থেকে চতুর্থ প্রহর যেই এলো, অমনি পঙ্খীরাজ পড়লো দাঁড়িয়ে। আর নিপু দেখলো সেই কাঁচ পাহাড়টা আকাশ পর্যন্ত উঁচু হয়ে পথ আগলে রয়েছে দাঁড়িয়ে।
      নিপু যখন এমনি চারদিকে দেখছে, পঙ্খীরাজটা তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে—তাকে কোন মতে পিঠ থেকে নামিয়েই হওয়ায় গেলো মিশে।
      কি আর করা—ভেবে, নিপু চারিদিকে একবার ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বসে পড়লো সেখানেই।
      অমনিতেই সে ক্লান্ত শ্রান্ত তার ওপর কাঁচ পাহাড়ে পড়ন্ত সূর্যের রোদ পড়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে আলোর ছটা। আর সে ছটা এতো প্রখর যে চোখ খুলে রাখাই দায়। তাই একসময় নিপুর চোখ জোড়া এল বুজে। আর অমনি পড়লো সে ঘুমিয়ে। সে ঘুম কি আর যে-সে ঘুম। সাত রাজ্যের রাজার মতো নাক ডেকে ঘুম। নাক ডাকছে সে ঘড়ঘড়, ঘড়ঘড়। আর সেই ঘড়ঘড় শব্দ কাঁচ পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে হয়ে উঠছে যেন সিংহের গর্জন।
      কতক্ষণ যে সে এমনি ঘুমিয়েছে কে জানে। হঠাৎ একটা বিকট হুংকারে বন্ধ হয়ে গেলো তার নাক ডাকা। ঘুম গেলো তার ভেঙ্গে। চেয়ে দেখে ভোর তখনও হয়নি। চারিদিকে আবছা আঁধার। কাঁচ পাহাড়ের ঠিকরে পড়া চোখ ঝলসানো ছটাও আর নেই। কিন্তু হঠাৎ আঁতকে উঠে তড়াক করে প্রায় লাফিয়ে উঠলো নিপু। ঠিক তার পেছনেই, প্রায় ঘাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেই কাঁচ দৈত্য ।
      কি সাংঘাতিক কিন্তু ত কিমাকার তার দেহ। কাঁচের চোখ দুটাে কেমন অদ্ভুত আর স্থির—একটু এদিক ওদিক নড়ে না, একটা পলক পর্যন্ত পড়ে না। কাঁচের জিহ্বাটা কি সাংঘাতিক লকলকে। কাঁচের হাত দুটো যেন আস্তো ইস্পাতের সাড়াশী।
      কিন্তু ওর আর ভাবা হলনা। সেই কাঁচ দৈত্য এবার হুংকার ছাড়লো মেঘের গর্জনে, —-কোন হতভাগারে তুই? অসময়ে নাক ডেকে, কাঁচা ঘুমটা আমার দিলি নষ্ট করে? বুকের পাটা তো তোর কম নয় দেখছি? মানুষ হয়ে আসিস দৈত্যের ঘুম ভাঙ্গাতে। সাত রাজ্য যার ভয়ে থরহরি কম্প, আর তুই ক্ষুদে পুঁচকে একটা মানুষ—তারই ঘুম দিলি পণ্ড করে? দাঁড়া দেখাচ্ছি এবার মজাটা। পাট খড়ির মতো মটমটু করে ভাঙ্গবো তোর হাড়গুলো। নেহাত আমি মানুষ-টানুষ খাইনা, নইলে ঘাড়টি মটকে খেতাম রক্তটুকু শুষে। বলে দৈত্য দুটো আঙ্গুল দিয়ে, নিপুকে ধরলো চেপে।
      ওই দুটো মাত্র আঙ্গুলের চাপেই নিপুর দু চোখে ফুটে উঠলো যেন সাত আকাশের তারা। দম এলো প্রায় বন্ধ হয়ে।কিন্তু এতোদূর এসে এতো সহজেই কি সে হার মানবে? না—অসম্ভব! মরতে যদি হয় হাত-পা নেড়েই মরবে। এই-না ভেবে, হঠাৎ সে একটা ঝটকা মেরে ও'র হাত থেকে ছিটকে এলো বেরিয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় খেলে গেলো এক বুদ্ধি। সে করলো কি—ঘটি ভর্তি সেই তেল আচ্ছা করে গায়ে নিলো মেখে। তাতে তার গা হলো পুরোনো ঘাটের শ্যাওলার মতো পিচ্ছিল। এবার দৈত্য ও’কে যতোই বাগিয়ে যায় ধরতে আর অমনি সুরুৎ করে পিছলে পড়ে সে বেরিয়ে।
      এমনি যতো বারই দৈত্য তাকে ধরে ততবারই সে পিছলে ও'র হাত থেকে বেরিয়ে পড়ে। এমনি করতে করতে সে একবার করলো কি? তার সেই পাকা বাঁশের লাঠিটা বেশ শক্ত করে ধরে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে মারলো এক ঘা। কিন্তু দৈত্যের অত শক্ত কাঁচের দেহটা। এত তাড়াতাড়ি ভাঙবে কেন? ঘা-এর চোটে লাঠিটাই গেলো ভেঙ্গে। আর সেটা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে টুকরো টুকরো হয়ে। কাণ্ড দেখে দৈত্য লাগলো হো-হে ক'রে হাসতে। তার সেই হাসির দমকে মাটি শুদ্ধো উঠলো কেঁপে। তারপর দৈত্যটা আবার আসতে লাগলো এগিয়ে।
      এদিকে নিপুর গায়ের তেলও ততক্ষণে প্রায় শুকিয়ে এসেছে। গা আর তেমন পিছল হয়ে নেই। সে এবার পড়লো মহা ভাবনায়। এখন উপায় ... এখন উপায় ?
      ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আনন্দে সে প্রায় লাফিয়ে উঠলো। হ্যাঁ উপায় একটা আছে। অজগরের দেয়া সেই তলোয়ার। কি আশ্চর্য! ওটার কথা সে একেবারে ভুলেই গিয়েছিল? অথচ ওটাই কাঁচ দৈত্যের জন্য মোক্ষম অস্ত্র। হীরে দিয়েই কাঁচ কাটে—তাহলে ওই কাঁচ দৈত্যের কাঁচ দেহটা হীরের তলোয়ারে নিশ্চয়ই কেটে দুফাঁক হয়ে যাবে!
      যা ভাবা, সেই কাজ। দৈত্যটা ছুটে আসতেই, তলোয়ারটা কোমর থেকে একটানে বের করে চোখ দুটো বন্ধ করে মারলে এক কোপ। আর সেই কোপ লাগলো ঠিক দৈত্যটার পেটে।
      সে যা ভেবেছিল ফলও হলো তাই। দৈত্যটার পেট কেটে হয়ে গেলো দুফাঁক। আর তার পর পরই পেট চেপে ধরে দৈত্য উল্টে পড়লো মাটিতে। আর মাটিতে পড়তেই বিকট ঝন-ঝন শব্দ তুলে একশো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো তার দেহটা৷ তারপরই আরেকটা বিকট শব্দে কাঁচ পাহাড়টাও ভেঙ্গে পড়লো গুড়ো গুড়ো হয়ে। তারপর একসময় সেগুলো গেলো মাটির সাথে মিশে।
      এতো তাড়াতাড়ি যে এতোগুলো কাণ্ড হয়ে যাবে তা নিপু ভাবতেই পারেনি। তাই সে সমস্ত কাণ্ড দেখে একেবারে 'থ' হয়ে গেল ।
      এমনি সে কতক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা পরিচিত চি—হি-হি-হি শব্দে চমকে চোখ তুলে চাইতেই দেখে সেই পঙ্খীরাজটা দাঁড়িয়ে ঠিক তার সামনেই। তার মনে পড়ে গেল অজগরের কথা। আর মনে হতেই তাড়াতাড়ি সে চেপে বসলো পঙ্খীরাজের পিঠে। আর দেখতে না দেখতে পঙ্খীরাজ দিল ছুট।
      দেশে ফিরে তো নিপু অবাক! যেখানে সে দেখে গিয়েছিল ধুধু মাঠ, সেখানে আজ সবুজের বন্যা। যেখানে সে দেখে গিয়েছিল কান্নার রোল, আজ সেখানে বসেছে হাসির হাট।
      নিপু যখন এমন ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিলো, তখন সারা দেশের লোক এসে ধরলো তাকে ঘিরে। সে সবাইকে জিজ্ঞেস করলো,
      —রাজা কই ?
      সবাই বল্লো,
      ——না খেতে পেয়ে মরেছে।
      সে বল্লো,
      —রাজপ্রাসাদ কই ?
      সবাই বল্লো,
      ধুলোয় গেছে মিশে
      সে বল্লো,
      —আর তোমাদের কোন অভাব আছে?
      সবাই বল্লো,
       —না না না
       সে বল্লো,
      —আর তোমাদের কোন দুঃখ আছে?
      —না না না

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

      সূদন ছিল ভারী গরীব, তার একমুঠো অন্নের সংস্থান নাই। রোজ রোজ জুয়া খেলে লোককে ঠকিয়ে যা পাওয়া, তাই দিযে কোনরকমে তার চলে যায়। যেদিন যা উ...

      সূদন ছিল ভারী গরীব, তার একমুঠো অন্নের সংস্থান নাই। রোজ রোজ জুয়া খেলে লোককে ঠকিয়ে যা পাওয়া, তাই দিযে কোনরকমে তার চলে যায়। যেদিন যা উপায় করে, সেইদিনই তা খরচ করে ফেলে, একটি পয়সাও হাতে রাখে না। এই রকম কয়েক বছর কেটে গেল; ক্রমে সূদনের জ্বালায় গ্রামের লোক অস্থির হয়ে পড়ল, পথে তাকে দেখলেই সকলে ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা দেয়। সে এমন পাকা খেলোযাড় যে কেউ তার সঙ্গে বাজি রেখে খেলতে চায় না।
      একদিন সূদন সকাল থেকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, গ্ৰামময় ঘুরেও কাউকে দেখতে পেল না। ঘুরে ঘুরে নিরাশ হয়ে সূদন ভাবল – “শিব মন্দিরের পুরুতঠাকুর ত মন্দিরেই থাকে—যাই, তার সঙ্গেই আজ খেলব।” এই ভেবে সূদন সেই মন্দিরে চলল। দূর থেকে সূদনকে দেখেই পুরুত ঠাকুর ব্যাপার বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মন্দিরের অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ল।
      মন্দিরের পুরুতকে না দেখতে পেয়ে সূদন একটু দমে গেল বটে ; কিন্তু তখনই স্থির করল —যাঃ—তবে আজ মহাদেবের সঙ্গেই খেলব। তখন মূর্তিব সামনে গিয়ে বলল—
      “ঠাকুর। সারাদিন ঘুরে ঘুরে এমন একজনকেও পেলাম না, যার সঙ্গে খেলি! রোজগারের আর কোন উপায়ও আমি জানি না, তাই এখন তোমার সঙ্গেই খেলব। আমি যদি হারি, তোমার মন্দিরের জন্য খুব ভালো একটি দাসী এনে দিব, আর তুমি যদি হার , তবে তুমি আমাকে একটি সুন্দরী মেয়ে দিবে—আমি তাকে বিয়ে করব” এই বলে সূদন মন্দিরের মধ্যে খুঁটি পেতে খেলতে বসে গেল। খেলার দান ন্যায়মত দুই পক্ষই সুদন দিচ্ছে – 
       একবার নিজের হয়ে একবার দেবতার হয়ে খেলছে। অনেকক্ষণ খেলার পর শেষে সুদনেরই জিত হল। তখন সে বলল—“ঠাকুর। এখন ত আমি বাজি জিতেছি, এবার পণ দাও।” পাথরের মহাদেব কোনো উত্তর দিলেন না। একবোরে নির্বাক রইলেন। তা দেখে সূদনের হল রাগ। “ বটে ! কথার উত্তর দাও না কেমন দেখে নেব”—এই বলেই সে করল কি, মহাদেবের সম্মুখে যে দেবীমূর্তি ছিল সেটি তুলে নিয়েই উঠে দৌড়।
       সূদনের স্পর্ধা দেখে মহাদেব ত একেবারে অবাক! তখনি ডেকে বললেন “ আরে , আরে, করিস কি? শীগগির দেবীকে বেখে যা। কাল ভোরবেলা যখন মন্দিরে কেউ থাকবে না, তখন আসিস, তোকে পণ দিব।” এ কথায় সূদন দেবীকে ঠিক জায়গা রেখে চলে গেল।
      এখন হয়েছে কি , সেই রাতে একদল স্বর্গেরা অন্সরা এল মন্দিরে পুজো করতে। পূজোর পর সকলে স্বর্গে ফিরে যাবার অনুমতি চাইলে, মহাদেব রম্ভা ছাড়া সকলকে যেতে বললেন, সকলেই চলে গেল, রইল শুধু রম্ভা। ক্রমে রাত্রি প্রভাত না হতে সূদন এসে হাজির ৷ মহাদেব রম্ভাকে পণস্বরূপ দিয়ে তাকে বিদায দিলেন।
      সূদনের আহ্লাদ দেখে কে! অন্সরা স্ত্রীকে নিয়ে অহংকারে বুক ফুলিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল। সূদনের বাড়ি ছিল একটা ভাঙাকুড়ে , অন্সরা মায়াবলে আশ্চর্য সুন্দর এক বাড়ি তৈরী করল। সেই বাড়িতে তারা পরম সুখে থাকতে লাগল। এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল!
      সপ্তাহে একদিন, রাত্রে অন্সরাদের সকলকে ইন্দ্রেব সভায হাজিব থাকতে হয়। সেই দিন উপস্থিত হলে, রম্ভা যখন ইন্দ্রের সভায় যেতে চাইল, তখন সূদন বললে—“আমাকে সঙ্গে না নিলে কিছুতেই যেতে দেব না।” মহা মুশকিল। ইন্দ্রেব সভায় না গেলেও সর্বনাশ—দেবতাদেব নাচ গান সব বন্ধ হয়ে যাবে— আবার সূদনও কিছুতেই ছাড়ছে না। তখন রম্ভা মায়াবলে সূদনকে একটা মালা বানিয়ে গলায় পরে নিয়ে ইন্দ্রের সভায় চলল। সভায় নিয়ে সূদনকে মানুষ করে দিলে পরে, সে সভার এক কোণে লুকিযে বসে সব দেখতে লাগল। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হলে, নাচগান সব থেমে গেল। রম্ভা সুদনকে আবার মালা বানিয়ে গলায় পরে চলল তার বাড়িতে। ক্রমে সূদনকে বাড়ির কাছে একটা নদীর কাছে এসে রম্ভা তাকে আবার মানুষ করে দিল, তখন সূদন বলল –“ তুমি বাড়ি যাও, আমি এই নদীতে স্নান ও আহ্নিক করে পরে যাচ্ছি।
       এই নদীর ধারে ছিল ত্ৰিভূবন তীর্থ। এখানে দেবতারা পর্যন্ত স্নান করতে আসতেন।
       সেদিন সকালেও ছোটখাটো অনেক দেবতা নদীর ঘাটে স্নান করছিলেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখে সূদন চিনতে পারল— তারা রাত্রে ইন্দ্রের সভায় রম্ভাকে খুব খাতির করছিলেন। সূদন ভাবল –আমার স্ত্রীকে এরা এত সম্মান করে তাহলে আমাকে কেন করবে না?” এই ভেবে সে খুব গম্ভীর ভাবে তাদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল—যেন সেও ভারি একজন দেবতা। কিন্তু দেবতারা তাকে দেখে অত্যন্ত অবজ্ঞা করে তার দিকে ফিরেও চাইলেন না। —তারা তাদের স্নান ও আহ্নিকেই মন দিলেন। এ তাচ্ছিল্য সূদনের সহ্য হল না। সে করল কি, একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে দেবতাদের বেদম প্রহার দিয়ে বলল—“এতবড় আস্পর্দ্ধা ! আমি রম্ভার স্বামী, আমাকে তোরা জানিস নে?” দেবতারা মার খেয়ে ভাবলেন "কি আশ্চর্য। রম্ভা কি তবে মানুষ বিয়ে করেছে? তারা তখনই স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রের কাছে সব কথা বললেন।
      এদিকে সূদন বাড়ি গিয়েই হাসতে হাসতে স্ত্রীর কাছে তার বাহাদুরির কথা বলল। শুনে রম্ভার ত চক্ষুস্থির, স্বামীর নিবুদ্ধিতা দেখে লজ্জায সে মরে গেল, আর বলল-—“তুমি সর্বনাশ করেছ। এখনি আমাকে ইন্দ্রের সভায যেতে হবে।” দেবতারা ইন্দ্রের কাছে গিয়ে নালিশ করলে পর ইন্দ্রের যা রাগ। এতবড় স্পর্দ্ধা। স্বর্গের অঙ্গরা হয়ে রম্ভা পৃথিবীর মানুষ বিয়ে করেছে? ঠিক সয়য রত্তাও গিয়ে সেখানে উপস্থিত! তাকে দেখেই ইন্দ্রের রাগ শতগুণ বেড়ে উঠল। আর তিনি তৎক্ষণাৎ শাপ দিলেন, “ তুমি স্বর্গের অন্সরা হয়ে মানুষ বিয়ে করেছ, আবার তাকে লুকিয়ে স্বর্গে এনে আমার সভায় নাচ দেখিয়েছ এবং স্পর্দ্ধা করে সেই লোক আবার দেবতাদের গায়ে হাত তুলেছেঃ অতএব, আমার শাপে তুমি আজ হতে দানবী হও। বাবাণসীতে বিশ্বেশ্বরের যে সাতটি মন্দির আছে সেই মন্দির চুবমার করে আবার যতদিন কেউ নতুন করে গড়িয়ে না দেবে, ততদিন তোমার শাপ দূব হবে না।
      রম্ভা তখনি পৃথিবীতে এসে সূদনকে শাপের কথা জানিযে বলল—“আমি এখন দানবী হয়ে বারাণসী যাব। সেখানে বারাণসীর বাজকুমারীর শবীরে ঢুকব, আর লোকে বলবে রাজকুমারীকে ভূতে পেযেছে। রাজা নিশ্চয়ই যত ওঝা কবিবাজ ডেকে চিকিৎসা করবেন , কিন্তু আমি তাকে ছাড়ব না, তাই কেউ রাজকুমারীকে ভালো করতে পারবে না। এদিকে তুমি বারাণসী গিয়ে বলবে যে, তুমি বাজকুমারীকে আরাম করতে পারো। তারপর তুমি বুদ্ধি করে ভূত ঝাড়ানোর চিকিৎসা আরস্তু করলে আমি একটু একটু করে রাজকুমাবীকে ছাড়তে থাকবো। তাবপর তুমি রাজাকে বলবে যে, তিনি বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চুর্ণ করে, আবার যদি নুতন করে গড়িয়ে দেন। তবেই রাজকুমারী সম্পূর্ণ আরাম হবেন। রাজা অবশ্য তাই করবেন আর তাহলেই আমার শাপ দূর হবে। তুমিও অগাধ টাকা পুরস্কার পেয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে।” এই কথা বলতে বলতেই রস্তা হঠাৎ দানবী হয়ে, তখনই চক্ষের নিমেষে বারাণসী গিয়ে একেবারে রাজকুমারীকে আশ্ৰয করে বসল।
      রাজকুমারী একেবারে উন্মাদ পাগল হয়ে, বিড় বিড় করে বকতে বকতে সেই যে ছুটে বেরুলেন, আর বাড়িতে ঢুকলেনই না। তিনি শহরের কাছেই একটা গুহার মধ্যে থাকেন, আর রাস্তা দিয়ে লোকজন যারা চলে তাদের গায়ে ঢিল ছুড়ে মারেন। রাজা কত ওঝা বদ্যি ডাকলেন, রাজকুমারীর কোন উপকারই হলো না। শেষে রাজা ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন, — “যে রাজকুমারীকে ভাল করতে পারবে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দিব—রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে দিব।”
     রাজবাড়ীর দরজার সামনে ঘন্টা ঝুলান আছে, নতুন ওঝা এলেই ঘন্টায় ঘা দেয়, আর তাকে নিয়ে গিয়ে রাজকুমারীর চিকিৎসা করান হয়। সূদন রম্ভার উপদেশ মতো বারাণসী গিয়ে রাজকুমারীর পাগল হওয়ার কথা শুনে ঘন্টায় ঘা দিল। রাজা তাকে ডেকে বললেন— “ ওঝার জ্বালায় অস্থির হয়েছি বাপু তুমি যদি রাজকুমাবীকে ভাল করতে না পার, তবে কিন্তু তোমার মাথাটি কাটা যাবে।” এ কথায় সূদন রাজী হয়ে তখনই রাজকন্যার চিকিৎসা, আরম্ভ করে দিল।
      ভূতের ওঝারা ভড়ংটা করে খুব বেশী , সূদনও সেসব করতে কসুর করল না। ঘি, চাল, ধুপ, ধূনা দিয়ে প্রকাণ্ড যজ্ঞ আরস্ত করে দিল, সঙ্গে সঙ্গে বিড় বিড় করে হিজিবিজি মন্ত্র পড়াও বাদ দিল না। যজ্ঞ শেষ করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সেই পৰ্বতের গুহায় চলল, যেখানে রাজকন্যা থাকে। সেখানে গিয়েও বিড় বিড় করে খানিকক্ষণ মন্ত্র পড়ল— ‘‘ভূতের বাপ— ভূতের মা—ভূতের ঝি,—ভূতের—ছা—দুর দুর দূর, পালিয়ে যা”। ক্রমে সকলে দেখল যে, ওঝার ওষুধে একটু একটু করে কাজ দিচ্ছে। কিন্তু ভূত বাজকুমারীকে একেবাবে ছাড়ল না। তিনি তখনও গুহার ভিতরেই থাকেন, কিছুতেই বাইরে আসলেন না। যা হোক, রাজা সূদনকে খুব আদর যত্ন করলেন, আর, যাতে ভূত একেবারে ছেড়ে যায়, সেটার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। দুদিন পর্যন্ত সুদন আরো কত কিছু ভড়ং করল। তৃতীয় দিনে সে রাজার কাছে এসে বলল—“ মহারাজ রাজ কুমারীর ভূত বড় সহজ ভূত নয়— এ হচ্ছে দৈবী ভূত। মহারাজ যদি এক অসম্ভব কাজ করতে পারেন—বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চুরমার করে, আবার নুতন করে ঠিক আগের মত গড়িয়ে দিতে পারেন, —তবেই আমি রাজকন্যাকে আরাম করতে পারি।”
       রাজা বললেন– “এ আর অসম্ভব কি?” রাজার হুকুমে তখনই হাজার হাজার লোক লেগে গেল। দেখতে দেখতে মন্দিরগুলি চুরমার হয়ে গেল। তারপর এক মাসের মধ্যে আবার সেই সাতটি মন্দির ঠিক যেমন ছিল তেমনটি করে, নতুন মন্দির গড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীও সেরে উঠলেন, অঙ্গরাও শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেল। তারপর খুব , ঘটা করে সূদনের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হল আর রাজা বিয়েব যৌতুক দিলেন তাব অর্ধেক রাজত্ব।

গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।

Download : PDF

    এক কাঠুরের তিন ছেলে৷ তাদের মধ্যে ছোটো ছেলেটি একটু বোকা; তাই তাকে সকলে হাঁদারাম বলে ডাকে৷ একদিন কাঠুরে তার বড়ো ছেলেকে বলল, আজ আমার অসুখ ...

    এক কাঠুরের তিন ছেলে৷ তাদের মধ্যে ছোটো ছেলেটি একটু বোকা; তাই তাকে সকলে হাঁদারাম বলে ডাকে৷ একদিন কাঠুরে তার বড়ো ছেলেকে বলল, আজ আমার অসুখ করেছে, আমি কাঠ কাটতে বনে যেতে পারব না, তুমি যাও৷
    তা শুনে কাঠুরের বড়ো ছেলে কাঠ কাটতে বনে চলল৷ তার মা তার সঙ্গে রুটি আর দুধ দিয়ে বলে দিল, বন তো ঢের দূরে, সেখানে গিয়ে তোমার বড্ড খিদে পাবে৷ তখন এই রুটি আর দুধ খেয়ো৷
    বনের ধারে এক বুড়ো বসে ছিল৷ সে কাঠুরের ছেলেকে দেখে বলল, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে৷ আমাকে একটু কিছু খেতে দেবে? বড়ো ছেলে বলল, যা আছে তাতে আমার নিজেরই পেট ভরবে না৷ তোকে কোত্থেকে দেব; পালা! এই বলে সে কাঠ কাটতে গেল৷ গিয়ে যেই একটা গাছ কাটতে
    কুড়ুল উঠিয়েছে অমনি সেই কুড়ুল ফসকে তার হাতের উপর পড়ে গেল৷ হাত কেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল৷ কাজেই কাঠ কাটা আর হল না৷
    পরদিন মেজো ছেলে কাঠ কাটতে গেল৷ তার সঙ্গে তার মা রুটি আর দুধ দিল৷ সেদিনও সেই বুড়ো বনের ধারে বসে ছিল, আর কাঠুরের ছেলের কাছে খেতে চাইল৷ তার মেজো ছেলে বলল, নিজে না খেয়ে তোমাকে খেতে দিই আর কি!
বয়ে গেছে! তারপর সে বনের ভিতর গিয়ে কাঠ কাটবার জন্য যেমনি কুড়ুল উঠিয়েছে, অমনি ধপাস করে কুড়ুলটা তার
    পায়ের উপর পড়ে গেল, কাজেই সেদিন আর সে হেঁটে বাড়ি যেতে পারল না৷
    তারপর কাঠুরের ছোটো ছেলে গেল কাঠ কাটতে৷ সে বেচারা বোকা বলে তাকে কেউ ভালোবাসে না৷ তার সঙ্গে তার মা খাবার দিল, খালি বাসি রুটি আর জল৷ সেদিনও বনের ধারে সেই বুড়ো বসে৷ হাঁদারামকে দেখে, বড়ো খিদে পেয়েছে বাবা৷ কিছু খেতে দেবে? বলল বুড়ো৷ হাঁদারাম বলল, তাই তো কী করি? আমার কাছে তো কিছু নেই৷ শুধু বাসি রুটি আর জল আছে, তাতে কি তোমার পেট ভরবে?
    তারা দু-জনে মিলে সেই রুটি আর জল ভাগ করে খেল৷ খেয়েদেয়ে, বুড়ো ভারি খুশি হয়ে বলল, তুমি আজ প্রথমেই যে গাছটা কাটবে, তার নীচে একটা খুব ভালো জিনিস পাবে৷ তারপর হাঁদারাম গেল কাঠ কাটতে৷ গিয়ে সে একটা গাছ কাটতেই গাছের ভিতর থেকে বার হল সুন্দর একটি সোনার হাঁস৷
    সমস্ত দিন কাঠ কেটে, সন্ধ্যার সময়ে, কাঠ আর সেই হাঁসটি নিয়ে হাঁদারাম বাড়ি চলেছে, আর খানিক দূরে যেতেই রাত হয়ে গিয়েছে৷ তখন সে ভাবল, রাত্রে আর কোথায় যাব? একটা সরাইয়ে আজ থাকি৷ এই ভেবে সে এক সরাইখানাতে গিয়ে উঠল৷ সরাইওয়ালার দুই মেয়ে৷ সোনার হাঁস দেখে তাদের ভারি লোভ হয়েছে৷ দু-জনেই মনে করছে, ওর একটা পালক নিয়ে খোঁপায় পরব৷
    রাত্রে যখন সকলে ঘুমিয়েছে, কেউ জেগে নেই, তখন সরাইওয়ালার বড়ো মেয়ে পা টিপে টিপে হাঁসের কাছে গেল৷ হাঁসের কাছে গিয়ে যেই সে তার একটা পালক ধরে আস্তে আস্তে টেনেছে, অমনি সর্বনাশ৷ পালক তো ছিঁড়ল না, লাভের মধ্যে তার হাতখানা হাঁসের গায়ে আটকে গেল৷ কিছুতেই সে হাত খুলল না৷ কাজেই সেখানে বসে থাকতে হল৷ খানিক পরে তার বোনও পালক চুরি করতে এসেছে৷ এসে দেখে তার দিদি হাঁস নিয়ে কী করছে, অমনি সে তার কাছে গিয়ে
হাত ধরে বলল, বাঃ৷ তুমি একলা নেবে নাকি? আমাকে দাও? বলে, আর সে তার হাত টেনে আনতে পারে না৷ সে তার দিদির হাতের সঙ্গে একেবারে জুড়ে গিয়েছে৷ কাজেই সেইরকম হয়ে দু-বোনকে সমস্ত রাত সেইখানে থাকতে হল৷
সকালে উঠে হাঁদারাম তার হাঁস নিয়ে বাড়ি চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে সরাইওয়ালার দুই মেয়েই ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলেছে৷ তাই দেখে সরাইওয়ালা ব্যস্ত হয়ে দৌড়ে এল, আরে, কোথায় যাচ্ছিস? বুড়ো বুড়ো মেয়েরা এমনি করে চলেছিস, লজ্জা করে না? বলে যেই তার ছোটো মেয়ের হাত ধরেছে, অমনি সেও তাদের সঙ্গে আটকে গেছে৷ হাঁদারাম কিন্তু সেদিকে চেয়েও দেখে না৷ সে তাঁর হাঁস নিয়ে, আর হাঁসের সঙ্গে তাদের তিনজনকে নিয়ে, মনের সুখে বাড়ি চলেছে৷ সেইখান দিয়ে তখন এক গোয়ালা যাচ্ছিল৷ সে সরাইওয়ালাকে দেখে দৌড়ে এসে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ? গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছ নাকি? আমার দুধের দাম দিয়ে গেলে না! আর দুধের দাম! গোয়ালা তখন হাত নিয়েই ব্যস্ত; তার হাত সরাইওয়ালার কাঁধে আটকে হাঁদারামের সঙ্গে চলেছে৷ গোয়ালার যে গোয়ালিনি ছিল, তার মেজাজ ভারি কড়া৷ সে ঘরের জানালা দিয়ে দেখলে, দুটি লোকের সঙ্গে দুটি মেয়ে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে তার গোয়ালাও চলে যাচ্ছে৷ অমনি সে ঝাঁটা হাতে দৌড়ে বেরিয়ে এল, কিন্তু কিছু না বলে একেবারে গিয়ে গোয়ালার পিঠে দিয়েছে ঝাঁটা বসিয়ে আর অমনি গোয়ালার পিঠে ঝাঁটা আর ঝাঁটায় গোয়ালিনির হাত আটকে গিয়ে, সেও হাঁদারামের সঙ্গে চলেছে৷
    সে দেশের যে রাজা, তার মেয়ে কখনো হাসত না৷ তাই রাজা ঢোল পিটিয়ে দিয়েছিলেন, যে তাঁর মেয়েকে হাসাতে পারবে সে-ই তাকে বিয়ে করবে৷
    এই কথা শুনে হাঁদারাম তার হাঁস ঘাড়ে করে আর তার পিছনে সরাইওয়ালার বড়ো মেয়ে, তার পিছনে সরাইওয়ালার ছোটো মেয়ে, তার পিছনে সরাইওয়ালা, তার পিছনে গোয়ালা, তার পিছনে ঝাঁটা হাতে গোয়ালিনিকে নিয়ে, একেবারে রাজার সভায় গিয়ে উপস্থিত হল৷ তাদের সেই চমৎকার তামাশা দেখে সকলে, রাজামশাই নিজে, রানি আর তাঁর সখীরা সকলে একেবারে মাটিতে লুটোপুটি করে হাসতে লাগলেন৷ আর, সকলের চেয়ে বেশি হাসল রাজার সেই মেয়ে৷

অনেককাল আগের কথা। কতকাল জিজ্ঞেস করলে কিন্তু বলতে পারব না। তারিখ-সাল যদি জানতে হয় ইতিহাসের পণ্ডিতের কাছে যাও। মোট কথা, তখন পরী-হুরীদের যেখান...

অনেককাল আগের কথা।
কতকাল জিজ্ঞেস করলে কিন্তু বলতে পারব না। তারিখ-সাল যদি জানতে হয় ইতিহাসের পণ্ডিতের কাছে যাও।
মোট কথা, তখন পরী-হুরীদের যেখানে সেখানে দেখা যেত, রাক্ষস-খোক্ষসরা বনে-জঙ্গলে ভয় দেখাত আর তেপান্তর পেলেই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী সেখানে গাছে বাসা বেঁধে রাজপুত্রদের ভালো ভালো মতলব দেবার জন্যে বসে থাকত।
রাজপুত্ররাও তখন কথায় কথায় পক্ষিরাজে চড়ে দেশ বিদেশ ঘুরতে বেরুত। কিন্তু রাজপুত্ৰ হ’লেই ত হয় না। দু’বিঘে দু’কাঠা হোক রাজ্য চাই, ছেঁড়া-খোঁড়া হোক ভারী মখমলের পোশাক চাই, মরচে-ধরা হোক ভাঙা হোক তলোয়ার চাই , আর কানা হোক খোঁড়া হোক একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া চাই-ই। তার ওপর তিন বন্ধু—মন্ত্রিপুত্র, কোটালপুত্র, সদাগরপুত্ৰ হ’লে ত কথাই নেই!
আমাদের রাজপুত্র খুদকুমীরের সে সব কিছুই নেই। রাজ্য ছিল, কিন্তু মন্ত্রীমশাই কুমতলব দিয়ে সেটাকে লাটে তুলেছেন। কোতল করবার মানুষ না পেয়ে কোটাল গেছেন ভিন রাজ্যে চাকরি খুঁজতে, আর সদাগর লোকসানের ব্যবসা গুটিয়ে, দোকানপাট তুলে নিয়ে কোথায় গেছেন, কেউ জানে না।
তারা নেই তো তাদের পুত্ররা আর থাকবে কোথায়! তাই আকাশ যেখানে দূর পাহাড়ের পেছনে নুয়ে পড়েছে, সেই দিকে তাকিয়ে তার চোখ ছলছল করে।
খুদকুমারের বড় সাধ—দেশভ্রমণে যাবে। কিন্তু সাধই আছে, সাধ্য কোথায়? তবু দুঃখিনী মার আশীৰ্বাদ নিয়ে খুদকুমার একদিন বেরিয়ে পড়ল।

রাজপোশাক নেই। ছেড়া জামা মা দিয়েছেন সেলাই করে। তলোয়ার নেই, ফলা-ভাঙা ছুরিটা আছে ট্যাঁকে সে-ই জানে। যাবার সময় মা শুধু চিড়ে-মুড়ি বেঁধে দিয়েছেন পথে খেতে, আর মনে রাখতে দিয়েছেন একটি শ্লোক—

কান পাতবে বনে, 
শত্তুর মারবে মনে। 

মাঠ-বন পেরিয়ে যায় খুদকুমার। খেয়ার কড়ি নেই, নদী-নালা পার হয় সাতরে। রোঁ-ওঠা কুকুরটা যায় সঙ্গে।
সূয্যি ডোবে যেখানে, সেখানে গহন অরণ্যে গিয়ে খুদকুমার থামে। গাছের ডালে নিজের জায়গা করে নেয়, কিন্তু কুকুরটা থাকবে কোথায়?
কুকুরের ভাবনা ভাবতে হয় না। দেখা যায় গাছের কোটরে শুকনো ছেড়া লতা-পাতার ফাকে বেশ অনায়াসে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছে।
রাত বাড়ে! গাছপালা অন্ধকারে একাকার হয়ে যায়। ঘন ডালপালা লতাপাতার ফাঁকে একটা-দুটো তারা যেন ভয়ে এক আধবার উঁকি দেয়।


খুদকুমারের চোখে ঘুম নেই। এক প্রহর, দু প্রহর, তিন প্রহর রাত কেটে যায়। হঠাৎ খুদকমারের কান খাড়া হয়ে উঠল। গাছের মাথায় যেন হাওয়ার শিস। হাওয়ার শিস না কাদের ফিসফিস? ফিসফিসই ত বটে। 
“বুক যে ফেটে গেল গো!”—কে যেন বলছে। 
“ফাটুক, তবু রা না শুনি”—কার যেন ধমক। 
আবার সেই ফিসফিস, “আর যে পারি না।” 
তার জবাবে, “না পারিস ত মর না।”

আগেরটা যেন মেয়ে আর পরেরটা যেন পুরুষের গলা।
এরা আবার কারা ?
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী নয় ত?
হ্যা তাতে আর ভুল নেই। খানিকবাদে ডানা ঝটপট করে ব্যাঙ্গমী শুধোয় ফিসফিসয়ে, “আচ্ছা, সব না হয় একটু!”


“একটু কেন, সব-ই বল!” 
ব্যাঙ্গমা এবার রেগে গলা ছেড়ে দেয়, “আর না বলেই বা করবি কি? যেমন আমাদের কপাল, কত নিশুতি রাত জেগে কাটালাম, কোথায় কোনরাজপুত্ত্বর ঝলমলে সাজে পক্ষিরাজে আসবে, আশ মিটিয়ে পেটের কথা বলব, শুলুক-সন্ধান দেব,—না, কোথাকার এই উইয়ে-খাওয়া পুঁইয়ে পাওয়া আখদে রাজপুত্ত্বর এল রোঁ-ওঠা এক ঘেয়ো কুকুর নিয়ে।”

“বল, বল, ওকেই বল।” 
“বললে কি শুনবে, হয়ত ঘুমেই ন্যাতা। শুনলে কি বুঝবে, হয়ত বুদ্ধিই ভোঁতা।” 
“আহা, তবু বলি। শুনে না বুঝুক; বলে তো সুখ।” 
ব্যাঙ্গমী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। তারপর মিহি সুরে ধরে, “দিনরাত্তির দুয়ারে ঘা।”
ব্যাঙ্গমা মোটা গলায় বলে, “দুয়ার তবু খোলে না।”
ব্যাঙ্গমার মোটা গলা, “এখনো চুল বাঁধেননি।” 
মিহি সুরে, “চুল বাঁধবেন কবে!”
মোটা সুরে, “কালরাক্ষস ঘায়েল যেদিন হবে।”
এবার মিহি-মোটা একসঙ্গে—

“বনের শেষে তেপান্তরে 
তা ছাড়িয়ে নদীর চর, 
নদীর ধারে দুধ-পাহাড় 
সেখানে পুরী চার-দুয়ার; 
চার-দুয়ারের একটি খিল 
খুলবে তো তাল করো তিল।” 

বুকের বোঝা হালকা করে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী বুঝি ঘুমালো। খুদকুমারের চোখে আর কি ঘুম আসে। রাতের আঁধার ফিকে হতে-না-হতেই সে বেরিয়ে পড়ে। গহন বন ছাড়িয়ে তেপান্তর। তেপান্তর পেরিয়ে নদীর চর। নদীর পারে মেঘের রাশি। কিন্তু দুধ পাহাড় কই?

এপারে দাঁড়িয়ে খুদকুমার আকুল চোখে চারিদিকে তাকায়। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী কি তা হ’লে ভুল ঠিকানা দিয়েছে? কিন্তু তা তো দস্তুর নয়। রাজপুত্র বলে তাকে না হয় পছন্দই হয়নি, কিন্তু তাই বলে মিথ্যে খবর? ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর তা হলে তো জাত যাবে। রূপকথার রাজ্যে মুখ দেখাতে পারবে না।

ভুল নয়, ঠিক। আকাশের কোলে সাদা মেঘ নয়—দুধ-পাহাড়ের মাঝে চার-দুয়ারে বিশাল পুরী। কিন্তু একি ব্যাপার! বিশাল পুরীর চার-দুয়ারে হৈ-হৈ হট্টগোল, থই-থই ভিড়।

খবর তো আর সে একা পায়নি; পুব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ যেখানে যত রাজপুত্র, কেউ আর আসতে বুঝি বাকি নেই।
কী তাদের চেহারা আর কী সব সাজপোষাক! দুধ-পাহাড়ের গা ঝলমল করছে
তাদের হীরে মুক্তো চুনি পান্নার জেল্লায়।
কিন্তু দুয়ার তো খোলে না। রাজপুত্রদের ঝকঝকে ধারাল সব তলোয়ার ভোতা হয়ে গেল। দরজায় দাগ পড়ে না। দল বেঁধে বড় বড় গাছ পাথর নিয়ে তারা চড়াও হ’ল।


দরজা নড়ে না। খুদকুমার কিছু করবে কি, হোমরাচোমরাদের দলে সে পাত্তাই পায় না। রাজপুত্রদের ভারি মখমলের সাজ ছিড়ল, মাথার ঘাম পায়ে পড়ল। দরজা যেমন তেমনি বন্ধ।
হয়রান হয়ে সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, খুদকুমার ভয়ে ভয়ে গেল এগিয়ে।

চার- দুয়ারের একটি খিল
খুলবে তো তাল করো তিল। 

কিন্তু কোথায় তাল আর তিলই বা করবে কি ! অনেক খুঁজে পাথরের মতো নিরেট দরজায় চুলের মতো একটি ফুটাে যদিবা বেরুল, তাও ধুলোয় ঢাকা। কিন্তু ধুলো সরাতে একটি ফু যেমন দেওয়া, অমনি কড়কড় ঝনঝন করে চার-দরজা একসঙ্গে গেল খুলে।
আর তখন রক্ষে আছে! পিল পিল করে রাজপুত্রেরা খুদকুমার আর তার ঘেয়ো কুকুরকে কোথায় ঠেলে সরিয়ে ফেলে মাড়িয়ে চার-দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল পুরীতে।
খাঁ খাঁ পুরী। কেউ কোথায়ও নেই। দেউড়ি থেকে দালান, এ-মহল থেকে সে মহল, রাজপুত্রের দল খুঁজতে খুঁজতে একেবারে পুরীর মাথায় মণিকোঠায় রাজকন্যার দেখা পেল।
কাঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ চুল মেলে বিছানার ওপর শুয়ে আছেন। সকলকে দেখে কান্নায় ভেজা চোখ মুছে শুধোলেন, “কে খুললে দরজা ?” হাজার রাজপুত্র একসঙ্গে হাক দিয়ে উঠল, “আমি।”
 দুঃখের মধ্যেও রাজকন্যা হাসলেন। বললেন, “শুধু দরজা খুললে তো হবে না, এ পুরীর এমন দশা যে করেছে, সেই কালরাক্ষসকে যে ঘায়েল করবে তার জন্যেই গলার মালা আছে তোলা।”
“কোথায় থাকে কালরাক্ষস ?”—হাজার গলা গর্জে উঠল।

“দুধ-পাহাড়ে দধি-সায়র 
তার মধ্যে কালরাক্ষসের গড়।” 

কিন্তু দুধ-সায়র তো যেমন তেমন নয়, নৌকা ভাসলে ক্ষারে গলে যায়, সাঁতরে পার হতে গেলে কালরাক্ষসের পোষা কুমিরে খায়, কালরাক্ষসের নাগাল পাওয়াই দায়। 
‘আচ্ছা কুছ পরোয়া নেই? হাজার রাজপুত্ত্বর এক দঙ্গলে দুধ-সায়রের পাড়ে গিয়ে হাজির!
কিন্তু জলে যে নামে সে আর ওঠে না।

সকাল থেকে দুপুর গিয়ে সন্ধ্যে হ’ল!—হাজার রাজপুত্রের কেউ তখন কুমিরের ভোজ, কেউ ভয়ে নিখোঁজ।
সন্ধ্যে গিয়ে রাত হ’ল। ঘেয়ো কুকুর নিয়ে খুদকুমার দধি-সায়রের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। থকথক করছে দধি-সায়র, তার মাঝে থমথম করছে চাদের আলোয় কালরাক্ষসের গড়। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর ছড়ার গুণে দরজা খুলেছে বিশাল পুরীর, কিন্তু দধি সায়র পার হবার হদিশ মেলে কোথায় ? হঠাৎ খুদকুমার চেঁচিয়ে উঠল, “আরে থাম থাম!” 
আর 'থাম থাম!—বলা নেই কওয়া নেই ঘেয়ো কুকুর হঠাৎ দুধ-সায়রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওদিকে কুমিরেরও টনক নড়েছে।
হা করে এল তেড়ে, কুকুর বেচারার দশা বুঝি দিল সেরে!
এতদিনের পথের সাথী, এই বিপদে কি ছাড়া যায়? খুদকুমার ফলা-ভাঙা ছুরি হাতেই দুধ-সায়রে পড়লো লাফ দিয়ে।
কিন্তু বাঁচাতে গেছে কাকে! কুকুর নয় যেন জলের মাছ! কুমিরকে চরকিপাক খাইয়ে ঘেয়ো কুকুর যেন মজা দেখে। কুকুরের পেছনে কুমির ছোটে, আর খুদকুমার নিঝঞ্জাটে কালরাক্ষসের গড়ে গিয়ে ওঠে। কুমিরকে কলা দেখিয়ে ঘেয়ো কুকুরও তার পিছল পিছু গা-ঝাড়া দিতে দিতে উঠে আসে।
কালরাক্ষসের গড়। তার কত গম্বুজ কত খিলানে কত সুড়ঙ্গ কত সিঁড়ি। কিন্তু কোথাও কারুর সাড়াশব্দ নেই কেন?—এ-মহল থেকে ও-মহল, একতলা থেকে দোতালা, তা থেকে তেতালার এক ঘর। ঢুকতে গিয়ে খুদকুমার থমকে দাঁড়াল। তারই মতো একটি ছেলে একটা ময়লা বিছানায় বসে হাপুসনয়নে কাঁদছে। 

আর কি বুঝতে কিছু বাকি থাকে? নির্ঘাত সেই কালরাক্ষসের কাজ। কোনো অচিনদেশের কুমার হবে নিশ্চয়। বেচারাকে ধরে এনে কয়েদ করে রেখেছে মনের সুখে মারবার জন্যে।
“কাঁদছ কেন ভাই? ভয় কি!”—কাছে গিয়ে খুদকুমার মিষ্টি গলায় সাহস দেয়। অচিনকুমার চমকে উঠে বসে কেমন হতভম্ব হয়ে তাকায়! তারপর তার কান্না আবার যেন উথলে ওঠে নতুন করে।
খুদকুমার পাশে বসে পিঠে হাত দেয় এবার, “ছি, পুরুষ মানুষ কি কাঁদে!”
“না কাঁদে না”—অচিনকুমারের গলায় এবার ঝাঁঝ, আমার মতো হতে তো বুঝতে। আর এসেছ যখন, বুঝবে। কিন্তু তুমি কে? এখানে এলেই বা কি করে, আর কেন?” 
খুদকুমার নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, “এসেছি কালরাক্ষসের দাপট ভাঙতে।” 
কান্না ভুলে হেসে ওঠে অচিনকুমার, “এখানে এসেছে কালরাক্ষস খুঁজতে?” 
“এখানে আসব না তো যাব কোথায়?”—খুদকুমার তো অবাক! 
“কালরাক্ষস কোথায় থাকে তাও জান না?” অচিনকুমার আবার হেসে ওঠে। 
খুদকুমার এবার গরম; হয়ে বলে, “থাকে তো এইখানেই।” 
“না হে না, এখানে তো থাকি আমি! জন্ম থেকে আছি কালরাক্ষসের দাপটে কয়েদ হয়ে। তাই তো আমন করে কাঁদি।”
“তা হলে যে শুনলাম..... ” —খুদকুমার শুধোয় অবাক হয়ে। 
“যা শুনেছ তা ভুল, ওই তো দধি-সায়রের পারে চার-দুয়ার বিশাল পুরী। ওই হ’ল কালরাক্ষসের গড়।”
এবার খুদকুমারের হাসবার পালা। ঠাট্টা করে বলে, “তুমি তো তা হলে খুব জান দেখছি।”
“তা আর জানি না।” অচিনকুমার একটু চটেই ওঠে, “সাতপুরুষ ধরে গড়বন্দী হয়ে আছি, আমি জানব না তো জানবে কে! ওই কালরাক্ষসের জন্যেই তো নিঝুমপুরীর এই হাল!”
খুদকুমারকে অনেক কষ্টে এবার সব বলে বোঝাতে হয়। বোঝাবুঝির পর দু’জনেই দু'জনের মুখের দিকে অবাক হয়ে চায়।
“এখানে নয় ওখানে নয়, তো কালরাক্ষস থাকে কোথায়?” 
“কোথাও না।” বলে দু’জনে একসঙ্গে হেসে ওঠে। আর তক্ষুনি বানানো বুজরুকির ফাকি দুঁফাক হয়ে মিথ্যা কুয়াশার মতো উবে যায়। -
থমথমে নিঝুমপুর গমগম করে ওঠে খুশীতে হাসিতে। থকথকে দধি-সায়র গলে টলটলে জল হয়ে ঝকঝক করে ভোরের সোনালী আলোয়। কুমির হয়ে যায় কাঠের গুড়ি।
খুদকুমার আর অচিনকুমার হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে ঘেয়ো কুকুর। ঘেয়ো কুকুরের ঘা কই? সব সেরে গিয়ে রেশমের মতো নরম লোমে গা গেছে ঢেকে। ওপারের বিশাল পুরী চার-দুয়ার খুলে যেন সবাইকে ডাকছে।
কুঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ চুলই শুধু বাঁধেনি, যজ্ঞির রান্না রাঁধতে বসেছে হাজার রাজপুত্রকে নেমস্তন্ন খাওয়াতে।
কালরাক্ষস সত্যি আজ ঘায়েল। কোথাও সে নেই, আবার আছেও বটে। আছে প্রাণের লুকোনো হিংসেয়, মনের মিথ্যে ভয়ে।
ঘর ছেড়ে বাইরে এসে, আপনার মতো পরকে ভালবেসে তাই বার-বার হারিয়ে শূন্যে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে হয়। মা'র শেখান ছড়াটার মানে যেন কিছুটা বুঝতে পারে খুদকুমার।

কাঞ্চীর রাজপুত্র এবার যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবে। রাজ্যময় ধূমধাম পড়ে গেছে। কাঞ্চীর উত্তরপ্রান্তে গরুড়ধ্বজ বিষ্ণুমন্দির। পুরোহিত গেছেন সেখানকা...

কাঞ্চীর রাজপুত্র এবার যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবে। রাজ্যময় ধূমধাম পড়ে গেছে। কাঞ্চীর উত্তরপ্রান্তে গরুড়ধ্বজ বিষ্ণুমন্দির। পুরোহিত গেছেন সেখানকার আর্শীবাদী নির্মাল্য আনতে, লোক পাঠানো হয়েছে প্রয়াগতীর্থ থেকে জল আনবার জন্য। সেই জলে স্নান করিয়ে বিষ্ণুর পূজা-নির্মাল্য তার কপালে দিয়ে রাজপুত্রকে পুরনারীরা বরণ করবেন।
রাজা বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করছেন। রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর। কোশলরাজের দূত কি এক প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, রাজা তাই আজ সারাদিন ধরে মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন—শরীর ও মন দুই বড় ক্লান্ত। এমন সময়ে রাজকুমার কক্ষে ঢুকে পিতাকে প্রণাম করে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজা বললেন ‘চন্দ্রসেন, তোমার কিছু বলার আছে ?’
রাজপুত্র বিনীত অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘বাবা, গত বছর যখন গুরুগৃহ থেকে ফিরে আসি তখন আপনি বলেছিলেন—আমায় কিছুদিন দেশভ্রমণে যাবার অনুমতি দেবেন।
আপনার অসুখের জন্যে এতদিন কোনো কথা বলিনি। আমি এইবার এ বিষয়ে অনুমতি চাই।’
—“তুমি জানো, তোমার যৌবরাজ্যে অভিষেকের সব আয়োজন করা হয়েছে ?
—“সেই জন্যেই তো আরও বেশী করে যেতে চাই, বাবা। আমি কাঞ্চী ছাড়া জীবনে কখনও কিছু দেখলুম না, জানলুম না—কানে শুনেছি উত্তরে হিমবান পর্বত আছে, দক্ষিণে সমুদ্র আছে, পশ্চিমে সিন্ধুনদ আছে—কাঞ্চী ছাড়া আরও কতো রাজ্য-দেশ আছে, কিন্তু উনিশ-কুড়ি বৎসর বয়সে আমি চোখ থেকেও অন্ধ। যার জীবনে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাকে দিয়ে দেশ শাসন কি করে হবে? আমায় যেতে দিন, বাবা!”

এর দুদিন পরে রাজ্যের লোক সবিস্ময়ে শুনলে রাজকুমার চন্দ্রসেনের অভিষেক উৎসব সম্প্রতি স্থগিত থাকলো—কারণ, তিনি চলেছেন দেশভ্রমণে—একা, সঙ্গে তিনি কাউকে নিতে রাজী নন।
সত্যই রাজকুমার কাউকে সঙ্গে নেননি। 
আজ সপ্তাহ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, চন্দ্রসেন তার প্রিয় সাদা ঘোড়াটিতে চড়ে একা পথ চলেছেন। তার সঙ্গে থাকবার মধ্যে বা দিকে খাপে ঝোলানো পিতৃ-দত্ত তলোয়ারখানি। আর চোখে অসীম তৃষ্ণা, বুকে অদম্য সাহস ও নির্ভীকতা। কাঞ্চী রাজ্যের সীমা ছাড়িয়েও দুদিনের পথ চলে এসেছেন, কতো গ্রাম, মাঠ, বন, নদী, পার হয়ে চলেছেন—সবই অচেনা, এ তার নিজের রাজ্য কাঞ্চী নয়, এখানে তিনি একজন অজানা পথিক মাত্র।

তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, এক নদীর ধারে তার ঘোড়া নিয়ে এসে পৌছল। প্রকাণ্ড নদী—বিকেলের রাঙা আলোয় ওপারের বনরেখা অপূর্ব দেখাচ্ছে। অত বড় নদী কি করে পার হবেন, রাজকুমার চিন্তায় পড়লেন। কোনোদিকে মানুষের চিহ্ন নাই— সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে ধূসর হয়ে এলো। বিজন নদী-তীরের ছন্নছাড়া চেহারাটা সুমুখ-আঁধার রাতে গাঢ় ছায়ায় যেন আরও বেশি ছন্নছাড়া হয়ে ফুটে উঠলো।
ওপারে দূরে একটা পাহাড়–নীল চুড়া একটু একটু চোখে পড়ে। রাজকুমার চেয়ে থাকতে থাকতে পাহাড়ের ওপর থেকে আগুন-রাঙা একটা হলকা হঠাৎ আকাশের পানে লক্ লক করে জ্বলে উঠেই দপ করে নিবে গেল। রাজপুত্র অবাক হয়ে সেদিকে চেয়েই আছেন, এমন সময় একটা প্রকাণ্ড বাজপাখি আকাশে ডানা মেলে নদীর উজান দিক থেকে উড়ে এসে তার মাথার ওপর তিন-চারবার চক্রাকারে ঘুরে আবার কোনদিকে অদৃশ্য হ’ল।

রাজকুমারের নির্ভীক মনও একটুখানি কেঁপে উঠলো। তিনি জানতেন, তাঁদের বংশে কারুর মৃত্যুর পূর্বে তার মাথার ওপর গৃধ্ৰুযাতীয় পাখি তিনবার ওড়ে—কেউ কেউ বলেছেন, বিশেষ করে শকুন-শাস্ত্রবিৎ কোনো গণৎকার সে-বার বলেছিলেন যে, এই গৃধ্ৰু তাদের পূর্বপুরুষদের হাতে অন্যায়ভাবে অবিচারে নিহত কোনো শত্রুর বংশধরের মৃত্যুর পূর্বাভাস। কোথা থেকে আসে, কোথায় আবার উড়ে চলে যায়—কেউ বলতে পারে না।

রাতের সঙ্গে-সঙ্গে এলো হাড়-কাঁপানো ধারালো শীত। একটা বড় গাছও কোথাও নেই, যার তলায় আশ্রয় নিতে পারেন। অবশেষে একটা মাটির ঢিপির পেছনে ঘোড়া থেকে নেমে রাজপুত্র নিজের আসন বিছোলেন—সেখানটাতে হাওয়া বেশি লাগে না—শুকনো লতা-কুটি কুড়িয়ে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে সে রাত্রের মতো সেইখানে রইলেন। উপায় কি ?

গভীর রাত্রে রাজপুত্রের ঘুম ভেঙে গেলো। বহুদূরে যেন কাদের আর্তনাদ—মৃত্যুপথের পথিকদের অন্তিম চিৎকারের মতো করুণ। রাজপুত্র নিজের অলক্ষিতে একবার শিউরে উঠলেন। শয্যার পাশের আগুন নিবে গিয়েছে, রাজপুত্র উঠে ভালো করে আগুন জ্বালালেন। সারারাত্রির মধ্যে আর ঘুম এলো না কিন্তু।

ভোরের দিকে একটা ডিঙি পাওয়া গেল। তাতে পার হয়ে রাজকুমার ওপারে গিয়ে উঠলেন। ডিঙির মাঝি আধ-পাগলা এবং বোধহয় কানে আদৌ শুনতে পায় না। রাজকুমারের প্রশ্নের কোনো উত্তর সে দিতে পারলে না।
প্রথমে একটা মরুভূমির মতো মাঠ—ঘাস, খড়, গাছপালা কিছুই নেই—কটা রঙের বালির পাহাড় এখানে-ওখানে। অনেক দূরে গিয়ে একটা জনপদ। কিন্তু কেমন একটা নিরানন্দ ভাব চারিদিকে। পথ দিয়ে পথিক চলে না, দোকান-পসরায় খদের নেই, নদীর ঘাটে স্নানার্থীর দল নেই, মাঠে চাষীরা চাষ করে না—যেন কেমন একটা বিষাদ ও অমঙ্গলের ছায়া চারিদিকে।
রাজকুমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় বড় কাতর হয়েছিলেন। কাছেই গৃহস্থের বাড়ি। সেখানে গিয়ে আশ্রয় চাইতেই তারা খুবই যত্নের সঙ্গে আশ্রয় দিলে। অনেকদিন পরে রাজকুমার ভালো খাবার খেলেন, ভালো বিছানায় বিশ্রাম করতে পেলেন, মানুষের সঙ্গ অনেকদিন পরে বড় প্রিয় মনে হ’ল। কয়েকদিন সেখানে রয়ে গেলেন তিনি। গৃহস্থের একটি ছোট মেয়ে ও ছেলের সঙ্গে রাজকুমারের বড় ভাব হ'ল। তারা তাকে ফুল তুলে মালা গেথে দেয়, দুপুরে তার কাছে বসে গল্প শোনে, তাদের শত আবদার প্রতিদিন তাকে সহ্য করতে হয়। ছোট ছেলেটির উপদ্রবের তো আর অন্ত নেই!

অল্পদিনের মধ্যে রাজকুমার সে বাড়ির সবার তো বটেই, গ্রামের সকলেরও প্রীতি ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠলেন। এত সুন্দর মুখশ্রী, এমন সুন্দর কান্তি, এমন মিষ্টি স্বভাবের মানুষ তারা কখনও দেখেননি। রাজকুমারের আসল পরিচয় কেউ জানেনা। তিনি কাউকে সে সব কথা বলেননি। সবাই ভাবে, তিনি একজন গৃহহীন পথিক—হয়তো তার কেউ কোথাও নেই। এতে সবারই স্নেহ তার ওপর আরও বেড়ে যায়, কিসে তিনি সুখে থাকবেন, কিসে আত্মীয়হীন নিঃসঙ্গ প্রবাস-কষ্ট তার কমবে—সবারই এক চেষ্টা।

তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, এমন সুন্দর চেহারার ছেলে নিশ্চয়ই কোনো বড়-ঘরের হবে। গ্রামের যিনি মণ্ডল, তার এক মেয়ে পরমাসুন্দরী—সবাই বলে, ওই ছেলেই এ মেয়ের উপযুক্ত হবে। বিধাতা ওর জন্যই যেন এই দেবতার মতো সৌম্যকান্তি ছেলেটিকে কোথা থেকে জুটিয়ে এনেছেন। মণ্ডল গৃহিণীও রাজকুমারকে একদিন দেখে এতো পছন্দ করলেন যে তিনি স্বামীকে জানিয়ে দিলেন—যদি ঐ ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হয় ভালো—নয় মেয়ে চিরকুমারী থাকুক, তার আপত্তি নেই।
রাজকুমার কিন্তু কিছুতেই তেমন আমোদ পান না। তার মনে কি একটা বিষাদের ছায়া সকল আনন্দকে ম্লান করে রাখে। একবার ভাবেন, হয়তো বাপ-মাকে অনেকদিন দেখেননি বলে এমন হয়—কিন্তু তার মন বলে, তা নয়, তা নয়, ও-সব সামান্য সুখ-দুঃখের ব্যাপার এ নয়, এমন একটা কিছু যার কারণ আরও গভীর, জীবন-মরণ নিয়ে এর কারবার।
ক্রমে এলো সে মাসের কৃষ্ণপক্ষ। রাজকুমার অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, বাড়িতে সবারই চোখে জল—গ্রামসুদ্ধ সকলে বিষন্ন, নিরানন্দ। কেউ কোনো কথা বলে না, কারণ জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর পাওয়া যায় না। সবাই কিসের ভয়ে জুজু হয়ে আছে যেন ।
অবশেষে রাজকুমার কথাটা শুনলেন। এখান থেকে যোজন দূরে গৃধ্ৰুকুট পাহাড়ের ওপর রাজগুরু এক কাপালিকের সাধন-পীঠ। প্রতি অমাবস্যায় সেখানে নরবলির জন্যে প্রতি গ্রাম থেকে পালাক্রমে একটি তরুণ বয়স্ক লোক পাঠানো চাই-ই। রাজার হুকুম। এবার এ গ্রামের পালা।
শোনামাত্র রাজকুমার নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। তার পিতৃদত্ত তৃণের তীক্ষ ইস্পাতের ফলা-পরানো যে বাণ, তা কি শুধু নিরীহ পশুপক্ষী শিকারের জন্যে ?


“খেত হতে ত্ৰাণ করে এই সে পরাণ—মহান ক্ষত্রিয় নাম বিদিত জগতে৷”—অস্ত্রগুরুর সে উপদেশ রাজকুমার কি ভুলে গিয়েছেন!
অমাবস্যার দিন মণ্ডলের বাড়িতে পাশার সাহায্যে নির্ধারিত হবে এবার কে যাবে গ্রাম থেকে। রাজকুমার এ-কথা শুনলেন। অমাবস্যার পূর্বদিন গভীর রাত্রের অন্ধকারে তিনি চুপি চুপি শয্যা ত্যাগ করে কোথায় চলে গেলেন—কেউ জানে না। সকালে উঠে তাকে আর কেউ দেখতে পেল না।
মণ্ডলের বাড়িতে পাশার মজলিসে যার নাম উঠলো সে গৃহস্থের একমাত্র পুত্র। সবাই চোখের জলে ভেসে তাকে বিদায় দিলে। তার বৃদ্ধ পিতা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চললো কাপালিকের কাছে—যদি হাতে-পায়ে ধরে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পারে, এই দুরাশায়।

গৃধ্ৰুকূট পৰ্বতের পাদদেশে গিয়ে তারা যা দেখলে, তাতে তারা অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। বড় জামগাছটার তলায় দুটো মৃতদেহঃ একটা তাদের গ্রামের সেই তরুণ অতিথির, আর একটা কাপালিকের—দেখে মনে হয়, দু’জনেই পরস্পরকে অস্ত্রাঘাত করেছে। 

দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ সবাই ছুটে এলো দেখতে, যে নিজের প্রাণ দিয়ে তাদের চিরকালের জন্য বিপদমুক্ত করে গেল—রাজার ভয়ে গোপনে চোখের জলে ভেসে তার শেষ সৎকার সম্পন্ন করলে।
রাজকুমারের আসল পরিচয় সে-দেশের লোকে তখনো জানেনি।

একটি ছেলে ছিল। রূপে যেন রাজপুত্ত্বর। মা আদর করে নাম রেখেছিলেন রাজকুমার। ছেলেটি এই পনরো-ষোলো বছর বয়সেই বেশ জোয়ান হয়ে উঠেছে। লেখাপড়ার সঙ্গ...

একটি ছেলে ছিল।
রূপে যেন রাজপুত্ত্বর। মা আদর করে নাম রেখেছিলেন রাজকুমার। ছেলেটি এই পনরো-ষোলো বছর বয়সেই বেশ জোয়ান হয়ে উঠেছে। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাবার কাছে শিখেছে ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার চালনা, তীর ধনুক লক্ষ্যভেদ, দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রভৃতি সব রকম রণকৌশল ও যুদ্ধবিদ্যা। কারণ, ছেলেটির বাবা ছিলেন এক রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। দুঃসাহসী যোদ্ধা বলেও তার সুনাম ছিল। এ পর্যন্ত তিনি যতো যুদ্ধে গেছেন সবগুলিতেই জয়ী হয়ে রাজার হাত থেকে জয়মাল্য পেয়েছেন।
রাজা তাকে খুবই স্নেহ করতেন। বীর বলে শ্রদ্ধাও করতেন। অনেক সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি তার এই প্রিয় সেনাপতির সঙ্গে পরামর্শ করে চলতেন। এর ফলে সেনাপতির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা ষড়যন্ত্র করে রাজ্য থেকে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই সেনাপতির কোনো দোষ বার করতে না পেরে শেষে সেনাপতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার এক মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে এলেন তারা।

রাজার কাছে সেনাপতির বিচার হ’ল। সেনাপতি বীরপুরুষ। সাদাসিধে সরল মানুষ। মন্ত্রীদের মতো অতো শতো কূটবুদ্ধি আর ঘোরপ্যাচ জানেন না। তিনি নির্ভীক। তিনি সত্যবাদী। কিন্তু হলে কি হবে ? মন্ত্রীরা গোপনে প্রচুর ঘুষ দিয়ে অনেক জাল মিথ্যা সাক্ষী হাজির করে রাজার কাছে প্রমাণ করে দিল যে, সেনাপতি রাজার রাজ্য ও সিংহাসন দখল করবার জন্য গোপনে শক্রদের সঙ্গে পরামর্শ করছিলেন।
এ ধরনের রাজনৈতিক অপরাধের জন্য সাধারণতঃ দোষীর প্রাণদণ্ডই হয়। কিন্তু রাজা তার এই বীর সেনাপতিকে খুবই ভালবাসতেন বলে তার প্রাণদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ড দিয়ে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন।
সেনাপতি সংগ্রামসিংহ এই দণ্ডাদেশে মর্মাহত হয়ে সে রাজ্য পরিত্যাগ করে অনেক দূর দেশে চলে গেলেন, সঙ্গে গেলেন তার সুযোগ্য সহধর্মিণী, পুত্র রাজকুমার আর কন্যা ইন্দিরা।
অপরূপ সুন্দরী ও গুণবতী ছিলো তার এই কন্যা ইন্দিরা। রাজকুমারের চেয়ে মাত্র ছ'বছরের ছোট। কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনায় সে ছিলো দাদার চেয়েও অগ্রসর। যারাই দেখতো মেয়েটিকে, তারাই তাকে ভাল না বেসে থাকতে পারতো না।
নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত সেনাপতি সংগ্রামসিংহ মনের দুঃখে দেশ ছেড়ে এই অনেক দূরে এক গ্রামে এসে চাষবাসের কাজে মন দিয়েছিলেন। মনে মনে তার নিজের উপরই ঘৃণা এসে গেল। বহু যুদ্ধে বহু লোকের প্রাণহানি করার অপরাধেই বোধহয় তার আজ এই কঠিন নিষ্ঠুর সাজা হ’ল। এই ভেবে তিনি যুদ্ধ করা ছেড়ে দিলেন।
ছেলে রাজকুমার ও মেমেয় ইন্দিরাকে নিয়ে তাঁর প্রতিব্রতা পত্নীও রাজ্য ছেড়ে স্বামীর অনুগামিনী হলেন। শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের সময় জনকদুহিতা সীতা যেমন রাজ্যসুখ তুচ্ছ করে দেবতুল্য পতির অনুগমন করেছিলেন, তেমনি তিনিও স্বামীর সঙ্গে দুঃখ বরণ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েই দেশ ছেড়ে চলে এলেন।
নতুন দেশে এসে সুখে-দুঃখে তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল এক রকম। কিন্তু মানুষের দুঃসময় যখন আসে তখন পর পর নানা অতর্কিত বিপদ ঘটে যায়। হঠাৎ একদিন ক্ষেতে চাষের কাজ করতে করতে অপাঘাতে সংগ্রামসিংহ ইহলোক ত্যাগ করলেন। পুত্র রাজকুমার ও কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে তাদের জননী শোকে-দুঃখে ও দুর্ভাবনায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন।
পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই এসে সান্তনা দিলেনঃ ভাবছো কেন মা ? এ-রকম অঘটন তো পৃথিবীতে অনেক ঘটে থাকে। ভগবান আছেন। তিনি তোমাদের রক্ষা করবেন। তুমি এমন অশান্ত হয়ে পড়লে ছেলে-মেয়ে দুটিকে সান্তনা দেবে কে? রাজকুমার চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, মা, চুপ করো তুমি। আর কোঁদো না। আমি তো বড় হয়েছি। বাবা আমাকে নিজের হাতে সব বিদ্যা শিখিয়ে গেছেন। আমি তোমার দুঃখ দূর করবো। তোমাদের কোনো কষ্ট হবে না।
মেয়ে ইন্দিরা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, মা, তুমি ভেবো না। সংসারের সব ভার আজ থেকে আমি নিজের হাতে তুলে নিলুম। তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। আমি এখানে গ্রামের ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য যে মুক্তাঙ্গন-পাঠশালা  খুলেছি তাতে ছেলেমেয়েরা দলে দলে আসছে লেখাপড়া শিখতে। টাকা-পয়সা তারা
দিতে পারে না বটে, কিন্তু চাল, ডাল, তরিতরকারি, ফল-মূল, দুধ, দই কতো কি আমাকে দিতে চায়। আমি এতদিন নিইনি, তবে এবার থেকে নেবো। গায়ের মেয়েরা হাতের কাজ যা শিখছে কী বলবো! ভারী সুন্দর। সেলাই-বোনাটা ওরা কেউ কেউ মোটামুটি আগেই জানতো, এখন আমার কাছ থেকে সূক্ষ্ম কাজ সব শিখছে।
মা বললেন, তুমি কারোর কাছে কিছু চেয়ো না কিন্তু ইন্দিরা। কেউ যদি স্বেচ্ছায় তোমাকে ওদের ক্ষেত-খামারের আর সবজি বাগানের ফসল কিছু দিতে চায়, তুমি নিয়ো, নইলে তাদের মনে কষ্ট হবে। সংসারের লোকে নেওয়ার চেয়ে দেওয়াতেই আনন্দ পায় বেশী, তাদের সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত ক’রো না।
রাজকুমারও একটা কাজ পেয়েছিল গ্রামের মোড়লের দয়ায়। সে চৌকিদারদের সর্দার হয়েছিল, কিন্তু ছেলেমানুষ ছোকরা দেখে তাকে কেউ সর্দার বলে মানতে চায়নি প্রথমটা। শুনে মোড়ল একদিন গ্রাম পঞ্চায়েত ডেকে চৌকিদারদের বললেন, তোমাদের মধ্যে যে এই ছোকরার সঙ্গে লাঠি খেলায়, তলোয়ার খেলায় বা সড়কি চালনায় আর তীর ছোড়ায় জিততে পারবে, তাকেই আমি সর্দার করে দেবো।

গ্রামে হৈ-হৈ পড়ে গেল। সবাই ছুটে এলো সেই বাজিখেলা দেখতে। কিন্তু সেই ছোকরা নতুন সর্দারের সঙ্গে কোনো বাজিতেই পাল্লা দিয়ে কেউ জিততে পারলো না। সবাই হেরে গিয়ে মাথা হেঁট করলো। আর রাজকুমারকে সর্দার বলে মেনে নিলো।
এইভাবে তাদের দিন চলছিল এক রকম। কিন্তু ভাগ্য যখন বিরূপ হয় তখন কোথা দিয়ে যে বিপদ আসে কেউ জানতে পারে না। রাজকুমার আর ইন্দিরার দুঃখিনী মা একদিন জল তুলতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে কুয়োর মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন তার ছেলে-মেয়ে দু’জনের কেউই বাড়িতে ছিল না। তারা যখন ফিরে এসে মাকে দেখতে না পেয়ে চারিদিকে খোজাখুঁজি করতে করতে দুর্ঘটনার ব্যাপারটা জানতে পারলো, তাদের সতী-লক্ষ্মী মা তখন আর নেই। কুয়োর ভিতর থেকে তার মৃতদেহ তুলে যথারীতি সৎকার কথা হ’ল।
শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পর ইন্দিরা একদিন কাঁদতে কাঁদতে রাজকুমারকে বললো, দাদা, এই শূন্য ঘরে থাকতে পারছিনে।
রাজকুমার বললো, ঠিক ওই কথাই আমিও তোকে বলবো-বলবো মনে করছিলুম ক'দিন ধরে। আমার কেবলই ইচ্ছে এখান থেকে পালিয়ে কোনো দূর দেশে চলে যাই। কিন্তু মা-বাবার স্মৃতিজড়ানো এ-কুটারখানি ছেড়ে তুই হয়তো অন্য কোথাও যেতে চাইবিনে ভেবে কিছু বলিনি।
ইন্দিরা বললো, চলো দাদা, দূরে কোথাও চলে যাই। রাজকুমার একটু ভেবে বললো, কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস বোন, যে, এখানে আমরা যা হোক দুমুঠো খেতে পাচ্ছি। অন্য জায়গায় গেলে অন্ন জুটবে কি করে?
ইন্দিরা বললো, সে ভয় ক’রো না দাদা। আমাদের শাস্ত্রে বলে ‘জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। মা’ও প্রায়ই বাবাকে বলতেন শুনেছি যে উদ্যোগী পুরুষসিংহভূপৈতি লক্ষ্মী! চলো বেরিয়ে পড়ি। কিছু-না-কিছু কাজ কোথাও-না-কোথাও তোমার আমার জুটে যাবেই। নিজের উপর বিশ্বাস হারিও না।
পরামর্শমতো ভাই বোন সেই দিনই ভোর রাত্রে দুর্গা বলে পথে বেরিয়ে পড়লো।
ঘুরতে ঘুরতে তারা কিছুদূরে এক বর্ধিষ্ণু নগরে এসে হাজির হল। তখন বেশ বেলা হয়েছে। ভাই বোন দু’জনেই বেশ ক্লান্ত, ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর। কাছেই একটি দেবমন্দির দেখতে পেয়ে তারা সেই মন্দিরে গিয়ে উঠলো। মন্দিরের পুরোহিত তখন সবে ঠাকুরের মধ্যাহ্ন -ভোগ দিয়ে পূজা সেরে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ সমানে দুটি  সুকান্ত সুন্দর ছেলে-মেয়েকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ? তোমরা কে গো? বিদেশী বলে মনে হচ্ছে!

রাজকুমার আর ইন্দিরা ভক্তিভরে পুরোহিতের চরণে প্রণাম করে তার কাছে নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা সমস্তই প্রকাশ করলো।
পুরোহিত শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে সমবেদনাপূর্ণ কষ্ঠে বললেন, করুণাময় ভগবান দয়া করে তোমাদের আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তোমাদের পিতা সংগ্রামসিংহ মহান ব্যক্তি ছিলেন। তারই অনুগ্রহে আমি এই মন্দিরের পুরোহিত-পদে নিযুক্ত হতে পেরে অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। যতদিন না তোমাদের কোনো ব্যবস্থা করতে পারি, ততদিন তোমরা আমার কাছে থাকো। অর্জন নামে আরো একটি উচ্চ বংশের ভাগ্যপীড়িত ছেলে ক’দিন হল আমার কাছে এসে রয়েছে। তার সঙ্গে তোমরাও আমার কাছে থাকো। আমার স্ত্রী পুত্র পরিবার কেউ নেই। ওই মন্দিরের নারায়ণই আমার সব। তোমরাও আমার সঙ্গে ঠাকুরের প্রসাদী ভোগ খাবে। চলো। অনেক বেলা হয়েছে। কিছু জলযোগ করে স্নানে চলে যাও। মন্দিরের পাশেই লক্ষ্মী হ্রদ।
পুরোহিত-ঠাকুরের আদেশমতো স্নান সেরে এসে তারা ঠাকুরের প্রসাদ পেয়ে একটু বিশ্রাম করতে গেল নাটমন্দিরের চত্বরে। সেখানে পুরোহিতের মুখে শোনা সেই অৰ্জুন ছেলেটির সঙ্গেও তাদের আলাপ-পরিচয় হ’ল। অৰ্জুনের বাবা-মা কেউ নেই শুনে ওদের খুব মায়া হ’ল অৰ্জুনের উপর। অর্জনও বেশ বলিষ্ঠ সুন্দর যুবা। রাজকুমারেরই সমবয়সী। সেও যুদ্ধবিদ্যায় ও রণকৌশলে খুব পরাদর্শী শুনে রাজকুমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অর্জন বললো, আমিও তোমাদের মতো কাজ খুঁজতে বেরিয়েছি ভাই। আমার ইচ্ছা কোনো রাজার সৈন্যদলে সেনানির কাজ করবো।

এমন সময় পুরোহিত-ঠাকুর একটি প্রবীণা মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের কাছে এসে বসলেন। বললেন, ইনি এই কাছেই থাকেন। এঁকে আমরা সবাই অন্নদা-মাসী বলি। ইনি বলছেন, এর বাড়িতে ইন্দিরা-মা এর মেয়ের মতোই থাকবে। সংসারের কাজকর্মে মেয়ের মতোই সাহায্য করবে। এর বয়স হয়েছে, একলা আর সব কাজ করতে পারছেন না। তাই ইন্দিরা মাকে নিতে চাইছেন। মাইনে-করা দাসী হিসারে নয়। এঁদের কন্যার মতোই থাকবে। খেতে পরতে দেবেন, হাত-খরচ কিছু দিতে পারবেন না। ইন্দিরা-মা রাজী হলে এখুনি উনি সঙ্গে করে ওঁর বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলছেন।
রাজকুমার বললো, বেশ তো ঠাকুরমশাই, আপনার পরিচিত ভদ্র পরিবার যখন বলছেন তখন ইন্দিরা ওঁদের কাছেই থাকবে।


ইন্দিরা বললো, না দাদা, তোমাকে এমন অনিশ্চিত অবস্থায় কোথাও রেখে যাবো না। ওঁদের বাড়িতে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর তো কেউ নেই বলছেন। তবে তুমিও চলো না আমার সঙ্গে। দুজনেই ওঁদের ঘরে ছেলে-মেয়ের মতো থাকবো।
অন্নদা-মাসী এ কথা শুনে বললেন, না বাপু, কর্তা দুজন লোককে পুষতে রাজী হবেন না। তাকে খুব জানি।
রাজকুমার বললো, বেশ তো মাসী, আপনি ইন্দিরা বোনটিকে নিয়ে যান। একটা কাজ আমি ঠিক জুটিয়ে নেবো।
পুরোহিত-ঠাকুর হাসিমুখে বললেন, ঠিক বলেছে বাবা, এই তো আত্মবিশ্বাসী পুরুষের যোগ্য কথা। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে অন্নদা-মাসীর সঙ্গে যাও মা, এই তো কাছেই। আমি রোজ তোমার খবর নেবো। রাজকুমারও যতদিন না কাজকর্ম পায় মাঝে মাঝে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করবে। এটা দেবমন্দির। কতো রকমের লোকজন আসা-যাওয়া করে। এখানে তোমার থাকা উচিত নয়।

ইন্দিরা বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে অবস্থা বুঝে, অন্নদা-মাসীর সঙ্গে চলে গেল। যাবার সময় দাদা আর অর্জুনকে প্রণাম করে মিনতি জানিয়ে গেল তারা যেন মাঝে মাঝে ইন্দিরার খোঁজ-খবর নেয়। দু'চোখ তার বিদায়বেলার জলে ভরে উঠেছিল। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সে এক-পা এক-পা করে এগুচ্ছে দেখে অন্নদা-মাসী এক রকম জোর করেই তার হাতটি ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন।
রাজকুমার আর অর্জুন স্নান মুখে ইন্দিরার চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলো। পুরোহিত বললেন, সন্ধ্যারতির সময় হয়ে এলো। আমি চললুম মন্দিরে।

ওরা সে-কথা শুনতেই পেলো না। এতোই অন্যমনা হয়ে পড়েছিল দু’জনেই।
অন্নদা-মাসী যখন ইন্দিরাকে নিয়ে বাড়ি ঢুকছেন, সেই সময় ত্ৰৈলোক্যবাবু কি কাজে বাইরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ স্ত্রীর সঙ্গে একটি সুন্দরী মেয়েকে বাড়ির মধ্যে আসতে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে পত্নীকে প্রশ্ন করলেন, সঙ্গে আবার কে ? একে কোথা থেকে জোটালে? মন্দির থেকে কুড়িয়ে এনেছ বুঝি? নাঃ, তোমার দেখছি লজ্জা নেই। সেই যে সে-বার 'ফকরে বলে একটা ছোড়াকে মন্দির থেকে ধরে এনেছিলে বাড়ির কাজকর্ম করবে বলে, সে তো তে-রাত্রি পেরোবার আগেই আমাদের অনেক কিছু দামী জিনিসপত্র নিয়ে সরে পড়লো। এ তল্লাটে কোথাও তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
অন্নদা-মাসী বললেন, সে ছোড়ার কথা ছেড়ে দাও। সে একটা বাউণ্ডুলে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে—নেশাখের ছিচকে চোর। এটি ভদ্রলোকের মেয়ে। চেহারা দেখে বুঝতে পারছে না, বড়ো ঘরের সন্তান। পেট-ভাতায় থাকতে রাজী করিয়ে এনেছি। তোমাকে এক পয়সাও মাইনে দিতে হবে না। দেশসুদ্ধ লোক জানে, তুমি কি রকম কঞ্জস আর কৃপণের জাসু! কিন্তু আমার বয়স বাড়ছে, বুড়ো হয়ে পড়ছি। আমি আর এখন একলা তোমার সংসার চালাতে পারছিনে। একজন লোক আমার চাই।

ত্ৰৈলোক্যবাবু বললেন, বেশ তো। আমি কি আর নিষেধ করছি? রাখো না তুমি যত খুশি লোক। শুধু আমার সেজন্যে এক পয়সা বাড়তি খরচ না হলেই হ'ল। ফকরে ছোড়া তোমার আমার পাতের ভাত খেতো। তার জন্যে আলাদা চালের খরচ ছিল না। বছরে দুখানা ধুতিও দিতে হত না। আমার পুরোনো ছেড়া কাপড়গুলোই সেলাই করে সে পরতো। কিন্তু তুমি যে এই রাজরানীর মতো মেয়েটিকে ধরে এনেছো, এ কি ও ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে চাইবে ?

অন্নদা-মাসী ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, সে ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না। ওর ভাল যখন আমি নিয়েছি, তখন ওর যা দরকার হবে সে আমি ব্যবস্থা করবো। তোমাকে এর জন্য কিছু খরচ করতে না হলেই তো হ’ল।
ব্যস, তাই চাই। লোক রাখায় খরচ না বাড়লে আমার আপত্তি নেই। বলে ত্ৰৈলোক্যবাবু বেরিয়ে গেলেন।
ইন্দিরা অন্নদা-মাসীর বাড়িই রয়ে গেল। কিন্তু মনে তার সুখ ছিল না। দু’চারদিনের মধ্যেই ইন্দিরা বুঝতে পারলো, এখানে থাকা তার পক্ষে কতো কষ্টকর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে বাড়ির সব কাজই একলা করতে হয়। রাঁধা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘরদোর ধোয়া-মোছা, আলো বাতি সাজানো, বিছানা করা, বিছানা তোলা, একে একে সব কাজই অন্নদা-মাসী তা ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। নিজে আর কড়ার কুটোটা নাড়েন না। এদিকে পেটভরে খেতে দেন না ইন্দিরাকে। নিজের পুরোনো ছেড়া কাপড় তাকে পরতে দেন। ইন্দিরা অস্থির হয়ে উঠল। সে তার দাদাকে গিয়ে সব কথা জানাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুবার সময় পায় কই ? মন্দির তো খুব কাছেই। সেখানে তার দাদা রয়েছে। কিন্তু দাদা তো কই একদিনও এলো না তার খবর নিতে! দাদার বন্ধু সেই অৰ্জুন ছেলেটি এসেছিল বটে। বেশ ছেলেটি, খুব ভালো লেগেছিল তাকে ; কিন্তু সেও তো আর এল না।

একদিন ইন্দিরা মন্দিরে যাবার সুযোগ পেয়ে গেল। ত্ৰৈলোক্যবাবু আর অন্নদা-মাসী সেদিন তাদের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণে গেলেন। সারাদিন থাকবেন, সেই একেবারে রাত্রে ফিরবেন। ইন্দিরা ঠিক করলো আজ সে দাদার খবর নিতে মন্দিরে যাবেই। তাকে সব কথা জানিয়ে আসবে। এখানে সে আর একদিনও থাকতে পারছে না। কিন্তু মন্দিরে গিয়ে ইন্দিরা পুরোহিত-ঠাকুরের কাছে শুনলো যে, তার দাদা আর দাদার বন্ধু আজ রাজবাড়িতে গেছে এক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে। রাজা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিয়েছিলেন রাজকুমারীকে যে ঘোড়দৌড়ে, লক্ষ্যভেদে, হাতের লেখায় আর অঙ্ক কষায় হারাতে পারবে রাজকুমারী তারই গলায় জয়মাল্য দিয়ে পতিত্বে বরণ করবেন। আর দাদা সে ঘোষণা শুনে বন্ধুকে নিয়ে রাজবাড়িতে গেছে প্রতিযোগিতায় যোগ দেবার জন্য। কাল এই পরীক্ষা শুরু হবে। চারিদিকে হৈ-হৈ পড়ে গেছে। কিন্তু মা, আমার কি দুর্ভাবনা হয় জানো ?.রাজা ঘোষণায় বলেছেন, প্রতিযোগিতায় যে হেরে যাবে, তাকে যাবজজীবন কারাগারে বন্দী রাখা হবে। এসব জেনেও তোমার দাদা প্রতিযোগিতায় গেল!

শুনে ইন্দিরা চমকে উঠলো, কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললো, কী হবে ঠাকুর, দাদা যদি হেরে যায়! তারপর চোখ মুছে নিজেই বললো, নাঃ, দাদাই জিতবে। দাদা বীরপুরুষ।
পুরোহিত বললেন, মন্দিরে দেবতার কাছে ভয়ের জয় কামনা করে পুজো দিয়ে যাও। ভগবান যেন তার মঙ্গল করেন। - 
আজ রাজকুমারী স্বয়ম্বর হবার জন্য প্রতিযোগিতায় নামবেন। রাজ্যের সবাই ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে রাজপ্রসাদ-সংলগ্ন ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে। কোন ভাগ্যবান জয়ী হয়ে কন্ঠে রাজকন্যার বরণমাল্য পাবে অথবা পরাজিত হয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় যাবজীবনের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে। উৎসুকচিত্তে নগর উজাড় করে যেন দর্শকরা এসে জমলো ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে।

অৰ্জুন বললো, এমন দুঃসাহসিক প্রতিযোগিতায় তুমি যোগ দিও না। পরাজয়ের সম্ভাবনাই বেশী। নইলে রাজকুমারী সদম্ভে এমন ঘোষণা করতে সাহসী হতেন না।
রাজকুমার বললো, যদি আমি হেরেই যাই তাহলেও বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভালো থাকবো। দেবালয়ের নাটমন্দিরের দালানে ভিক্ষুকের মতো পড়ে থেকে দিনান্তে দুটি প্রসাদ পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আমি তো মনে করি রাজ-কারাগারে পরম সুখে থাকা যাবে। বন্দী-জীবন আমাদের কার নয়, বলো? সবাই যে যার সংসার-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বন্দীর জীবনই যাপন করছি ; ওই যে পুরোহিত-ঠাকুর, উনিও তো ওই মন্দিরে দেবতার পুজোর শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে রয়েছেন। ওটাকে আমি তার সশ্রম কারাবাস বলেই মনে করি। কিন্তু এ-প্রতিযোগিতায় আমি যদি হারি যাবজীবন বন্দী হয়ে থাকবো এই মাত্র।


কয়েদীদের মতো কঠিন পরিশ্রম তো কিছু করতে হবে না। বেশ নির্জনে ভগবানের নাম ' করে জীবনটা কাটিয়ে দেবো। তুমি রইলে বন্ধু, আমার দুঃখিনী বোন ইন্দিরার ভার তোমার ওপর রইলো।
ঢং ঢং ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠলো। ঘন ঘন শঙ্খরোল শুরু হ’ল। সময় হয়েছে। তুরী, ভেরী, ঢাকঢোল বেজে উঠে সমবেত জনতাকে সচকিত করে তুললো। রাজকুমার এই সময় রাজার সামনে গিয়ে প্রণামান্তে অভিবাদন জানিয়ে দাঁড়ালো। এই দিব্যকান্তি কিশোর সুকুমার যুবকটিকে দেখে রাজার মনে কেমন একটা বাৎসল্য-ভাবের স্নেহসিক্ত মমতা জেগে উঠলো। তিনি বললেন, তুমি এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল সমস্ত জেনেশুনে প্রস্তুত হয়ে এসেছে তো? হেরে গেলে পরিণাম কি হবে সেটা বুঝেই আশা করি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দিচ্ছ? এমন তরুণ বয়সে সারাজীবন কারাবাস যে বড় দুঃখের হবে।

রাজকুমার মহারাজকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে বললো, পরাজয়ের ভাবনা ভেবে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেওয়া যায় মহারাজ? আমি জয়ী হবো, এই বিশ্বাস নিয়েই এসেছি। আশীর্বাদ করুন যেন আমি আপনার পণ রক্ষা করতে পারি। ভয়ই তো মানুষকে কাপুরুষ করে তোলে!
রাজকুমারের এই বীরোচিত কথা শুনে মহারাজ খুব খুশী হলেন। বললেন, বেশ। তোমাকে আমার খুব ভালো লাগলো। জগদীশ্বরের নিকট কায়মনে কামনা করি, তুমি জয়ী হও, বৎস।

দ্বিতীয় ঘণ্টা বাজলো। জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সুসজ্জিত অশ্বপৃষ্ঠে সুবেশা সুন্দরী রাজকন্যা কদমে কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ক্রীড়াক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। সমগ্র জনতা করতালি দিয়ে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে জয়ধ্বনি করে রাজকুমারীকে সম্বর্ধনা জানালো।

মহারাজ কুমারকে বললেন, কোন ঘোড়া তুমি নিতে চাও, তোমার পছন্দমতো বেছে নিয়ে সওয়ার হও। তৃতীয় ঘণ্টা বাজলেই ছুটতে হবে। মনে রেখো।

সারি সারি ঘোড়া দাঁড়িয়ে ছিল। অশ্বরক্ষীরা ঘোড়ার মুখ ধরে অপেক্ষা করছে। রাজকুমার তার মধ্যে সবচেয়ে তেজী দেখে একটি পঞ্চকল্যাণ অশ্ব বেছে নিয়ে পলকের মধ্যে তার পিঠের উপর উঠে সওয়ার হ’ল। আরো একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত ছিলেন। তারাও একে একে অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হলেন।
ঢং ঢং ঢং ঢং করে তৃতীয় ঘণ্টা বেজে উঠলো। মহারাজের ইঙ্গিত মাত্র সব অশ্বারোহী তীরবেগে ছুটতে শুরু করলো। রাজকুমারীর ঘোড়া সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো।

চারদিকে আনন্দ-করতালি শোনা যেতে লাগল। রাজকুমার সেটা লক্ষ্য করে ঘোড়ার পিঠে পা ঠুকে একটু ইঙ্গিত করলো। মুহুর্তের মধ্যে রাজকুমারীকে বহু পশ্চাতে ফেলে রেখে বিদ্যুদ্বেগে রাজকুমারের পঞ্চকল্যাণ ঘোড়াটি বিজয়স্তম্ভ পার হয়ে গেল।

ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে সে কী বিপুল জয়ধ্বনি! দশ মিনিট ধরে লক্ষ লোকের আনন্দ-করতালি যেন আর থামে না, জনসমুদ্রে যেন উত্তাল তরঙ্গ উঠলো।
মহারাজ তখন বিজয়ী রাজকুমারকে কাছে ডেকে মহানন্দে তার কণ্ঠে জয়মাল্য পরিয়ে দিয়ে বললেন, জয় হোক তোমার, বিজয়ী বীর! আজ তুমি বিশ্রাম করো বৎস। কাল আবার ঠিক এই সময়ে ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে এসো। লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা হবে। তোমার ধনুর্বাণ আছে তো?
আমার আশৈশবের সঙ্গী। বাবা আমাকে ধনুর্ধর বলেই ডাকতেন।
সেদিনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ হ’ল। লোকমুখে চারিদিকে রটে গেল, কে এক অজ্ঞাতকুলশীল অপরিচিত সুদর্শন যুবক রাজকুমারীকে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় দারুনভাবে পরাস্ত করে দিয়েছে। ফলে পরের দিন লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতা দেখবার জন্য ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে দ্বিগুণ দর্শকের প্রচণ্ড জনতা সমবেত হ’ল।
বর্মচর্ম পরিহিত রাজকুমার ধনুর্বাণ নিয়ে আজ যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিল সেখানে। রাজকন্যা আগের দিন ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বেশ একটু লজ্জিত ও কুষ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি একটু পরে প্রবেশ করে তার ধনুকে বাণ সংযোজন করে ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন।
ঘণ্টা পড়লো। মহারাজ ইঙ্গিত করলেন। লক্ষ্যভেদ করতে গিয়ে রাজকন্যার হাত যেন একটু কেঁপে উঠলো। রাজকুমারের ধনুকের নিক্ষিপ্ত তীর ততক্ষণে লক্ষ্য বিদ্ধ করে সেখানে যেন থর-থর করে আনন্দে কঁপিছিল। রাজকুমারীর নিক্ষিপ্ত শর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বেশ একটু তফাতে গিয়ে বিদ্ধ হ’ল।
লক্ষ লক্ষ জনতার কণ্ঠে আবার সেই বিপুল জয়ধ্বনি। তাদের সমবেত আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে সকলের সঘন করতালি যেন কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। ‘জয়’ ‘জয় রবে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠলো।
রাজকন্যা আজকেও পরাজয় বরণ করে লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরের দিন হাতের লেখা ও গণিতের পরীক্ষা। আজ রাজকুমারের মনটা একটু ভারাক্রান্ত ছিল। কারণ, তার হস্তলিপি যে খুব ভালো নয় এটা তার জানা এবং অঙ্কের ব্যাপারেও সে যে খুব ওস্তাদ নয় এটা সে আগের রাত্রে অর্জুনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বেশ বুঝেছিল। তবু ভগবানকে স্মরণ করে সে এসেছে। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে তাকে আজো জিতিয়ে দেয় এই ভরসায়।

সবাই উৎসুক হয়ে রাজকন্যার আগমন প্রতীক্ষা করছে। রাজকন্যার তখনো দেখা নেই। সময় প্রায় হয়ে এলো। শেষ ঘণ্টা পড়লো। রাজকুমারী কই?
এমন সময় দেখা গেল নববধূর বেশে সুসজ্জিতা হয়ে রাজকন্যা ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে তার সখীরা নানা মাঙ্গলিক উপাচার হাতে নিয়ে পিছু-পিছু এলেন। পুরনারীরা হুলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি করছিলেন।
রাজকন্যা ধীরে-ধীরে রাজকুমারের নিকট এগিয়ে এসে রাজকুমারের গলায় নিজের কষ্ঠের বহুমূল্য বরণমাল্য খুলে পরিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধাভরে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে উঠে সমবেত সকলকে সম্বোধন করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, এই অজ্ঞাত বীরের কাছে বার বার পরাজয় স্বীকার করে আমি লজ্জিত হইনি। আমি গর্বিত। আপনাদের সকলের সম্মুখে আমি সকল দেবতাকে আর আমার স্নেহময় পিতা মহারাজকে সাক্ষী রেখে এই বিজয়ী যুবককে আজ পতিত্বে বরণ করলাম। অন্য পরীক্ষা দুটি প্রত্যাহার করে নিলাম।

ক্রীড়া-প্রাঙ্গণের সেই বিরাট জনসমাবেশ তখন আনন্দ-কলেবরে চারিদিক যেন পূর্ণ করে তুললো। সারা প্রাসাদ যেন আনন্দ-উৎসবের হর্ষধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠলো। রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে বর-বধূকে সাদরে আশীৰ্বাদ করে তাদের দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে ঘোষণা করলেন, সাতদিন উৎসব হবে। আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ রইলো।
ইতিমধ্যে অর্জুন উর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে সেখানে হাজির হল। বললো, বন্ধু, তোমার আদেশ পূর্ণ করেছি। রাজকুমার ইন্দিরা আর অর্জুনের পরিচয় করিয়ে দিলেন রাজার সঙ্গে। ইন্দিরা ও রাজকুমার সেনাপতি সংগ্রামসিংহের পুত্র-কন্যা শুনে রাজার আর আনন্দ ধরে না। বললেন, আমরা ছিলাম বাল্যবন্ধু। তোমার পিতা আমাকে সাহায্য না করলে আমি আমার হৃতরাজ্য ফিরে পেতুম না। শ্রীভগবানের অশেষ দয়ায় আজ তোমাদের আমি কাছে পেলুম। আপনজন করে পেলুম।

তারপর? বিবাহ-সভায় সে রাত্রে শুধু রাজকুমারের সঙ্গে রাজকন্যারই বিবাহ হ’ল না, ইন্দিরার সঙ্গে অর্জুনেরও বিবাহ হ’ল রাজকুমারের ইচ্ছানুসারে। মহারাজ রাজকুমারকে সে রাজ্যের যুবরাজ বলে ঘোষণা করলেন আর অর্জুনসিংহকে করে দিলেন তার প্রধান সেনাপতি। রাজ্য জুড়ে সাতদিন ধরে আনন্দ-উৎসব চলতে লাগলো।
আমার কথাটি ফুরোলো।

এক দেশে এক রাজা বাস করতেন। রাজার সাত রানী। পাটরানী, রূপবতী রানী, গুণবতী রানী, বিদ্যাবতী রানী, সেবাবতী রানী আর সোহাগিনী রানী। সাত রানীর কাহিন...

এক দেশে এক রাজা বাস করতেন। রাজার সাত রানী। পাটরানী, রূপবতী রানী, গুণবতী রানী, বিদ্যাবতী রানী, সেবাবতী রানী আর সোহাগিনী রানী।
সাত রানীর কাহিনী—সাত রানীর যশ—দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে, বসন্তকালের বাতাসের মতন—নাগকেশর ফুলের গন্ধের মতন—শরৎকালের রৌদ্রের মতন।
রাজা শ্বেতপাথরের সাদা ধবধবে দেওয়ালে মণিমুক্তো-পান্না-পোখরাজের লতাপাতা-ফুল-পাখি-আঁকা সাতটি মহল রাজপুরীর মধ্যে তৈয়ার করে দিয়েছেন সাত রানীর জন্যে।
পাটরানী যিনি, তিনি ধীর স্থির গম্ভীর রাশভারী মানুষ। শান্ত প্রসন্ন মূর্তি, কিন্তু বেশি হাসেন না, বেশি কথা বলেন না। রাগ হলে কখনও বাইরে প্রকাশ করেন না। রাজামশায় শুদ্ধ তাঁকে সমীহ করে চলেন।

রূপবতী রানী—রূপের তার সীমা-পরিসীমা নেই। হাজারখানা চাদের জোছনা নিঙড়ে, কনকচাঁপা ফুলের পাপড়ি দিয়ে হালকা দেহখানি গড়া। চোখ দেখে পদ্মপাপড়ি পলাশ লজ্জা পায়। ঠোট দুখানি বাঁধুলি, নাকটি যেন তিলফুল। দাঁতগুলি সারবন্দী মুক্তো। আর আঙুলের নখ থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত প্রত্যেকটির অঙ্গ নিখুঁত সুন্দর।

রূপবতী রানী সারাদিন রূপচর্চা নিয়ে কাটান। একজন দাসী তার কচি পল্লবের মতো নরম পা দুখানির সেবা করে। পায়ের রংয়ের সংগে রং মিলিয়ে গোলাপী আলতা পরায়, পায়ের নখ পালিশ করে পরশপাথর দিয়ে। আর একজন দাসী গায়ে রূপটান মাখায়। আমলকি-বাটা মাখায়। দুধের সর মাখিয়ে ডাবের জল দিয়ে ধুয়ে দেয়। তিনজন দাসী তার কেশের সেবা করে। একজন চুলে নানারকম সুগন্ধি তেল মাখায়, আর একজন সুরভি জলে চুল ধুয়ে অগুরু-ধূপের ধোয়ায় চুল শুকিয়ে তোলে। একজন শুধু বেণী রচনা করে—রকম-বেরকমের কবরী বাঁধে।

গুণবতী রানীর মহলে অহরহ কাজের সাড়া। গুণবতী রানী রাত্রিশেষে স্নান সেরে প্রাসাদশিখরে গালিচা পেতে বসেন। বীণাযন্ত্রে প্রতিদিন ভোরের রাগ-রাগিণী আলাপ করেন খোলা আকাশের নিচে। সে সুর শুনে গাছে-গাছে ঘুমভাঙা পাখিরা গান গেয়ে ওঠে। অন্ধকার আকাশ সুরের পরশে সাদা হয়ে আসে—সমস্ত পুবদিকটা সুরের আবীর-কুসুমে রাঙা টকটকে হয়ে ওঠে।
গুণবতী রানী শিল্পকাজ করেন। দেশ-বিদেশের শিল্পী-গুণীরা এসে শিল্পকর্ম দেখে ধন্য ধন্য করে যান।
রান্না করেন গুণবতী চৌষট্টি ব্যঞ্জন, পায়েস-পরমান্ন-পিঠা। নানা দেশের নানা রকমের —নানান স্বাদের রান্না। সে রান্না মুখে দিলে কেউ ভুলতে পারে না কোনদিন। বিদ্যাবতী রানীর মহলে দিনরাত শুধু বিদ্যাচর্চা। কতো দেশের—কতো জাতের—কতো ভাষার নানান আকারের পুঁথিতে মহল বোঝাই। চারদিকে শুধু বই আর পুঁথি। নানা দিগদেশের পণ্ডিতেরা এসে পর্দার আড়ালে বসা মহারানীর সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করেন। রানীমা শুধু পড়ছেন আর লিখছেন সর্বদা। স্নানের খেয়াল নেই, আহারের খেয়াল নেই, ঘুমের খেয়াল নেই, বিশ্রামের খেয়াল নেই, তন্ময় হয়ে থাকেন পুথি-পত্তরের মাঝে।
বুদ্ধিমতী রানীর মহল পরিষ্কার ছিমছাম। তিনি সদা-সর্বদা নিজের মহলে থাকেন না। আর ছয় রানীর মহলে ঘুরে তাদের বিলিব্যবস্থা করতেই তার বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। প্রতিদিন পাটরানীর মহলে গিয়ে তার সেবাযত্নের তদারক ক’রে তাকে প্রণাম ক’রে আসেন সকাল বেলায়। তারপরে যান রূপবতীর মহলে। রূপবতীর দাসীরা কাজকর্ম ঠিকমতো করছে কি না, কাচা হলুদগুলি কাচা-দুধে মিহি ক’রে বাটা হচ্ছে কি না, মুসুরডাল-বাটার সঙ্গে কুসুমফুল-বাটা সমান পরিমাণে মেশানো হচ্ছে কি না, চুলের সুরভি তেল বিশুদ্ধ আছে কি না, গন্ধদ্রব্যগুলি যত্ন ক'রে বন্ধ রাখা হয়েছে কি না—সমস্ত দেখে-শুনে, রূপবতীর কাছে কিছুক্ষণ হাসি-গল্প ক’রে যান গুণবতীর মহলে।

গুণবতীর সঙ্গীতের যন্ত্রগুলি যত্নে আছে কি না, ছবি আঁকার চিত্রশালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রয়েছে কি না, সূচীশিল্পের কাজগুলির তালিকা তৈরি করে তুলে রাখা হয়েছে কি না, রন্ধনশালার পাত্রগুলি নিখুঁত পরিচ্ছন্ন আছে কি না—খোঁজখবর নিয়ে গুণবতীর সঙ্গে কিছুক্ষণ শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করে তারপর যান বিদ্যাবতীর মহলে।
বিদ্যাবতীর মহলে বেশ কিছু খাটতে হয় প্রতিদিন। বিদ্যাবতীর দৈনন্দিন কাজের, অর্থাৎ পাঠের ও রচনার হিসাব লেখা, রচনাগুলির পরের পর ক্রম-অনুসারে সাজিয়ে, গুণেগেঁথে তুলে দিয়ে আসেন সহকারিণীদের সাহায্যে।
তারপর যান সেবাবতীর মহলে। সে মহলে দাসী-চাকরাণী একটিও নেই। সেবাবতী  নিজের গাতে সমস্ত কিছু করতে ভালবাসেন। মহারাজের পূজার আয়োজন, স্নানের আয়োজন, আহারের আয়োজন সমস্তই সেবাবতী নিজের হাতে ক’রে থাকেন। বুদ্ধিমতী রানী গেলে সেবাবতী ছুটে এসে বুদ্ধিমতীর পা দুখানি ধুইয়ে দেন। নিজের হাতে তৈরি নরম ফুলের মতো আসনে তাকে বসিয়ে পাখার বাতাস দেন, না হয় চুল খুলে চুল ফুলিয়ে দেন, না হয় পায়ে হাত বুলিয়ে দেন। সেবাবতী সেবা ভিন্ন একদণ্ডও থাকতে পারেন না। সেবাবতীর কাছে বসে একটু আরাম উপভোগ করে গল্পগুজব ক’রে উঠে যান ছোটরানী সোহাগিনীর মহলে।
এখানে এলে প্রায়ই দেরি হয়। সোহাগিনী সবচেয়ে ছেলেমানুষ, বিষম আবদারে আর অভিমানিনী। অর্ধেক দিনই তিনি অভিমান ক’রে না খেয়ে-দেয়ে শুয়ে থাকেন গোঁসাঘরে। বুদ্ধিমতী গিয়ে তাকে বহুক্ষণ ধরে সাধ্য-সাধনা করে আদর করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তুলে স্নান করান, ভাত খাওয়ান, যতক্ষণ না তার মলিন মুখে হাসি ফোটে ততক্ষণ তিনি নড়েন না। সোহাগিনী হাসলে, সহজ হ’লে, তারপর বুদ্ধিমতী নিজের মহলে ফিরে এসে স্নান-আহার করেন।
মোটের ওপর সাত রানীতে খুব ভাব, একটুও হিংসে নেই, আড়ি নেই রানীদের মধ্যে।

সারা রাজ্যের লোক রানীমাদের রূপ-গুণ, বিদ্যা-বুদ্ধি আর সেবাধর্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
রাজামশায়ের মনে কিন্তু সুখ নেই, রানীদের কারুর ছেলে হয়নি। নিঃসন্তান রাজা মনের দুঃখে কাল কাটান, তিনি মারা গেলে তার পিতৃ-পিতামহের নাম ডুবে যাবে, বংশ লোপ পেয়ে যাবে। পিতৃ-পুরুষরা জলপিণ্ড পাবেন না আর!
ক—তো যাগযজ্ঞি, ক—তো ওষুধ-বিষুধ, মানত-উপোস হ’ল, কিছুতেই কিছু হয় না। সাত রানীর একজনেরও সন্তান হ’ল না।

একদিন মহারাজ বনে মৃগয়া করতে গিয়েছেন। স্ত্রীলোকের কাতর চিৎকার শুনতে পেয়ে সেইদিকে ছুটে চললেন।
‘কে কোথায় আছো, রক্ষা করো—রক্ষা করো—” রাজামশায় উঁচু গলায় হাক দিয়ে সাড়া দিলেন—“কে কার উপর অত্যাচার করে ?—আমি এই রাজ্যের রাজা....সাবধান!”
রাজামশায়ের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই একটা বিকট-আকার রাক্ষস মড়-মড় শব্দে বনের গাছপালা ভাঙতে-ভাঙতে দারুণ গর্জন করে মহারাজের দিকে তেড়ে এলো। মহারাজের দেহে শক্তি ছিল অসীম। তা ছাড়া, অস্ত্রচালনায় তার জুড়ি ছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই রাক্ষসটাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে ফেললেন। এগিয়ে গিয়ে দেখেন, এক বুড়ী ঋষিপত্নী বসে বসে কাঁদছেন। রাক্ষসটা তার ব্রত-পূজার আয়োজন নষ্ট করে দিয়েছে। -
রাজামশায় বললেন—“মা, আমি দুষ্ট রাক্ষসকে মেরে ফেলেছি, আপনার কোন-কোন জিনিস নষ্ট হয়েছে বলুন, আবার সংগ্রহ করে এনে দেবো।”
ঋষিপত্নী রাজার কথা শুনে খুব খুশী হলেন। হাত তুলে বললেন—“বাবা, তুমি আজ আমার ছেলের কাজ করেছো, তোমা হতে আমি যেমন খুশী হয়েছি— তুমিও তেমনি তোমার নিজের ছেলে থেকে এমনি খুশী হবে, আশীৰ্বাদ করছি!”
রাজামশায় মাথা হেঁট ক’রে বললেন—“মা, আমি নিঃসন্তান, আমার ছেলে নেই।” ঋষিপত্নী তখন ঘরের ভিতর থেকে একটি ছোট ফল এনে রাজার হাতে দিয়ে বললেন—“কাল ভোরবেলা স্নান করে পূর্বমুখী হয়ে এই অনন্ত ফলটি রানীমাকে খেতে বোলো। দেখো, যেন ফলটিতে কোনো ছেদ না পড়ে। এই ফল খেলে, পরম সুন্দর বীর পুত্র কোলে পাবেন মহারানী।”
রাজা আনন্দে আটখানা হয়ে ফলটি নিয়ে রাজধানীতে তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন। রাজপুরীতে এসে রাজামশায় একেবারে সোহাগিনী রানীর মহলে গিয়ে তার হাতে ফলটি দিয়ে সমস্ত কাহিনী বললেন। সোহাগিনী রানী শুনে বললেন—“আগে বুদ্ধিমতী রানী-দিদিকে ডাকি। তিনি এসে যেমন বলবেন, তেমনি করলে ভালো হবে।”
রাজা বললেন—“তা হোক। বুদ্ধিমতী রানী-দিদি কখনো মন্দ পরামর্শ দিতে পারেন না।”
বুদ্ধিমতী রানী এলেন। সমস্ত শুনে তিনি বললেন—মহারাজ ! এই ফল পাটরানী-দিদিকে খেতে দেওয়া উচিত। তিনিই যথার্থ রাজমাতা হওয়ার যোগ্যা। আমরা সকলেই তাকে মানি, তাকে ভক্তি করি, তার গর্ভে ভবিষ্যৎ রাজা জন্ম নিলে আমাদের সকলেরই মর্যাদা বাড়বে। আপনি আর সকল রানীর মত জিজ্ঞাসা করুন।”

বিদ্যাবতী, সেবাবতী, রূপবতী ও সোহাগিনী সকলেই বুদ্ধিমতীর মতে মত দিলেন। ফল খাওয়ার এক বৎসরের মধ্যেই পাটরানীর গর্ভে সূর্যের মতো উজ্জ্বল, চন্দ্রের মতো স্নিগ্ধ এক পরম রূপবান পুত্র জন্মালো, রাজ্যে আনন্দ-উৎসব পড়ে গেল। ছয় রানী গিয়ে পাটরানীর আঁতুড়ঘর ঘিরে বসে রইলেন, ছয় রানীর কোলে-কোলে রাজকুমার বাড়তে লাগলো—পূর্ণিমার শশিকলার মতো।
বিদ্যাবতী মায়ের কাছে থেকে বিদ্যা, নান ভাষা, জ্ঞান বিজ্ঞান, শাস্ত্রতত্ত্ব অনেক কিছু শিখতে লাগলো রাজপুত্র। গুণবতী মায়ের কাছে নানা গুণপনা, সেবাবতী মায়ের কাছে থেকে সর্বজীবের সেবা। বুদ্ধিমতী মায়ের কাছে সুন্দর সূক্ষ্ম বুদ্ধির বিকাশ ঘটতে লাগলো কুমারের। সোহাগিনী মায়ের কাছ থেকে জিদ আর অভিমান এ দুটি দোষও বেশ এলো রাজপুত্রের স্বভাবে। কুমারের এত রূপ, এত গুণ, এত বিদ্যা, এত বুদ্ধি, কিন্তু এক-একটা বিষয়ে এমন জিদ ধরেন, তখন সে জিদ স্বয়ং রাজামশায়ও ভাঙাতে পারেন না।
অনেক বছর কেটে গেছে। রাজামশায় বুড়ো হয়ে পড়েছেন। রাজপুত্র এখন যুবরাজ। একদিন রাজপুত্র নগরের বাইরে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে গেছেন। নদীর ধারে এক পাগলকে দেখতে পেলেন। সে পাগল আকুল চিৎকার করে বলছে—“আর-একবার তাকে দেখতে চাই, আর একটিবার মাত্র দেখতে চাই।”
ঐ একটিমাত্র কথাই সে মাঝে-মাঝে ফুকরে বলে উঠছে আর দূর শূন্যের পানে চোখ মেলে পথ হেঁটে চলেছে। মাথার চুলে জট পড়েছে, সমস্ত শরীর ধুলোয়-কাদায় মলিন, পোশাক ছিড়ে কুটি-কুটি হয়েছে, কিন্তু তবুও পাগলকে দেখলেই বোঝা যায়, এক সময়ে সে খুব রূপবান পুরুষ ছিল।
রাজকুমার তার ঘোড়ার সহিসকে জিজ্ঞাসা করেন—“লোকটি কে জানো কি? ও কি দেখতে চায় আর একবার ?”
সহিস সেলাম ক'রে বললে—“যুবরাজ, ঐ লোকটি এক বিদেশী রাজকুমার। ও এখন পাগল হয়ে দেশে-দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক পরমাসুন্দরী পরী-রানীকে দেখে তার সৌন্দর্যে ও পাগল হয়ে গেছে। রাজসিংহাসন ছেড়ে দিয়ে, দেশভূমি বাপ-মা ত্যাগ করে ফকির হয়ে পথে-পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর একবার সেই পরী-রানীকে দেখবার ঝোকে।”
রাজপুত্র বললেন—“সে পরী-রানীকে ও কোথায় দেখতে পেয়েছিল, জানো?” সহিস বললে—“এখান থেকে বহুদূরে—সাত সমুদুরের মাঝে এক মনুষ্যহীন দ্বীপ আছে, সেই দ্বীপে বৎসরে একদিন স্বর্গের পরীরা সমুদ্র-স্নানে নেমে আসেন চৈত্র-পূর্ণিমার রাত্রে। সেই রাত্রি ছাড়া অন্য কোনোদিন অন্য কোনো স্থানে স্বর্গের পরীকে মর্ত্যের মানুষেরা দেখতে পায় না। কিন্তু শুনেছি, যারাই পরীদের দ্যাখে, তারাই নাকি অমনি পাগল হয়ে যায়। সে-রূপ মর্ত্যের মানুষ সহ্য করতে পারে না।” .
রাজপুত্র বললেন—“আমার সহ্য হবে। আমি দেখতে যাবো স্বর্গের পরীদের।”
সহিস ভয়ে জিভ কেটে, দুই কানে হাত দিয়ে বললে—“অমন কথা মুখেও আনবেন না যুবরাজ। সাত রানীমা শুনতে পেলে প্রাণত্যাগ করবেন।”
যুবরাজ দৃঢ়স্বরে বললেন—“না। আমি যাবোই দেখতে। তুমি রাজপুরীতে ফিরে যাও। খবর দিও মায়েদের, আমি পক্ষিরাজে চড়ে সাত-সমুদ্রের মধ্যিখানে মনুষ্যহীন দ্বীপে যাচ্ছি। চৈত্র-পূর্ণিমা রাত্রে সেখানে স্বর্গের পরীদের স্বচক্ষে দেখবো। পারি যদি গোটা-কতক বাচ্চা-পরী ধরেও আনবো মায়েদের জন্যে। বাবা আর মায়েরা যেন আমার জন্যে চিন্তা না করেন!”

রাজপুত্র পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চেপে পরীর খোঁজে সাত-সমুদ্রের মাঝ-মধ্যিখানে জনহীন দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
সাত বৎসর, সাত মাস, সাত পক্ষ, সাত দিন, সাত রাত্রের পর রাজকুমার ফিরে এলেন সাত রঙের পরমাসুন্দরী সাতটি পরী নিয়ে, কাঁধে সোনালী রুপোলী ডানা-সমেত সত্যিকারের পর। আকাশের পরীকে মর্ত্যের মাটিতে পেয়ে সাত রানীমার আনন্দ আর ধরে না। পরীদের হাত জোড়া ডানা কেটে তখুনি সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হ’ল, তারপর শাখ বাজিয়ে—উলু দিয়ে—তেল হলুদ সিঁদুর-শাখা দিয়ে সাত রঙের সাত পরীর সঙ্গে রাজকুমারের বিয়ে দিয়ে ফেললেন। সাত রানীমার সাত মহলে লাল পরী, নীল পরী, হলদে পরী, সবুজ পরীরা বৌ হয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা শিখতে লাগলো।
আমার কথাটি ফুরুলো...... এইবার তোমরা ঘুমুতে চলো।

এক ছিলেন রাজা। মহারাজাধিরাজ চক্রবর্তী ছিলেন তিনি। বহু রাজা তাকে কর দিত। সসাগরা ধরার অধীশ্বর বললেও চলে। রাজকোষ মণি-মুক্ত হীরা-জহরত সোনা-রূপায...

এক ছিলেন রাজা। মহারাজাধিরাজ চক্রবর্তী ছিলেন তিনি। বহু রাজা তাকে কর দিত। সসাগরা ধরার অধীশ্বর বললেও চলে। রাজকোষ মণি-মুক্ত হীরা-জহরত সোনা-রূপায় পরিপূর্ণ, সৈন্যশালায় রাজভক্ত সুশিক্ষিত বিক্রমশালী বুদ্ধিমান বিচক্ষণ সেনাপতি,—হাতিশালায় ঐরাবতের মতো হাতি,—অশ্বশালায় উচ্চৈঃশ্রবার মতো ঘোড়া, অসংখ্য দাসদাসী নিয়ে রাজার সৌভাগ্য বর্ষার নদীর মতো কানায় কানায় পরিপূর্ণ। রাজা নিজেও খুব বিক্রমশালী পুরুষ। প্রজা থেকে, কর্মচারী থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত কেউই রাজার মুখের দিকে চাইতে সাহস করেন না। সূর্যের দিকে যেমন চাওয়া যায় না, অমিততেজী সেই রাজাধিরাজ, তার মুখের দিকেও তেমনি চাওয়া যায় না।
কিন্তু রাজার একমাত্র দোষ—রাজা ঐশ্বর্যের অহঙ্কারে মহা অহঙ্কারী। তিনি যখন চলে যান তখন পায়ের শব্দে তার দম্ভ লোকে অনুভব করে, রাজপ্রাসাদ যেন কাঁপে। রাজার পুত্রসন্তান নেই, আছে দুটি কন্যা। বড়টির নাম মুক্তামালা, ছোটটির নাম কাজলরেখা। রাজার রানী নেই। মেয়ে দুটির শৈশবেই তিনি মারা গিয়েছেন। রাজা আর বিবাহ করেন নাই। মেয়ে দুটিকে প্রাণের চেয়ে ভালবাসেন। তারা যা চায়, তাই দেন। মেয়েদের ধাইমা মেয়েদের মানুষ করে। তারা আপন মনে নিজের নিজের খুশিমতো খেলা করে, গান গায়, হাসে, খায়-দায়। রাজপণ্ডিত আসেন, তার কাছে পাঠ নেয়। দিনে দিনে কুঁড়ি থেকে যেমন একটু একটু করে পাপড়ি মেলে ফুল ফোটে, তেমনই করে তারা বড় হয়ে ওঠে।

এক বাপ-মায়ের দুই মেয়ে,—কিন্তু আশ্চর্য, রূপে গুণে দুই মেয়ে ঠিক বিপরীত। বড় মেয়ের রূপ দেখলে চোখ যেন ঝলসে যায়। আয়নাতে রোদের ছটা পড়ে তার আভা যেমন ঝকমক করে, তেমনই রূপ তার। গুণেও ঠিক তাই। শাণিত অস্ত্রের মতো তার স্বভাব। দাসদাসী সকলে তার কাছে জোড়হাতে সশঙ্কিত হয়ে থাকে। আর ছোট রাজকুমারী কাজলরেখার রূপ শান্ত স্নিগ্ধ, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, স্বভাবও ঠিক তেমনই মধুভরা। ফুল যেমন মধুর ভারে নুয়ে পড়ে, মিষ্ট গন্ধে বুক ভরিয়ে দেয়, তেমনই ধারা মধুর প্রকৃতি তাঁর; ঠোঁটের ডগায় হাসি লেগেই আছে, কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদের চাঁদের মতো সে হাসিটুকু।
বড় রাজকন্যা মুক্তামালা মেয়ে হলেও অস্ত্রশিক্ষা করেছেন; তিনি ঘোড়ায় চড়েন, উড়ে বেড়ায় যে-সব পাখি, তার তীর তাদের বিঁধে মাটির দিকে নামিয়ে আনে ঝড়ে ঝরে-পড়া ফুলের মতো। কাজলরেখাও রাজকন্যা, সেই হিসাবে তিনিও অস্ত্রশিক্ষা করেছেন, কিন্তু অস্ত্রের চেয়ে শাস্ত্রে তার অনুরাগ বেশি। তিনি ঘরে বসে নানা শাস্ত্র পাঠ করেন। পড়তে-পড়তেই দিন শেষ হয়ে যায়, ঘরের আলো কমে যায়, তিনি গিয়ে বসেন জানলার ধারে। আকাশের বুকে পাখির ঝাঁক উড়ে যায় গান করে— তাদের গান শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাদের দিকে চেয়ে থাকেন। আঁচলে করে নিয়ে যান পঞ্চশস্য, ছাদের উপর অঞ্জলি ভরে ছড়িয়ে দেন, ডাকেন তাদের—আয়-আয়-আয়! ওরে পাখিরা, তোদের আমি ভালবাসি, তোরা খেয়ে যা। তারা শন শন শব্দে পাক দিয়ে নেমে আসে, কেউ বসে তার মাথায়, কেউ বসে কাঁধে, কেউ বসে হাতে—বসবার জায়গা যারা না পায় তারা পাক দিয়ে উড়তে থাকে, যেমন ভ্রমর ওড়ে ফুলের চারদিকে, মাছেরা ঘোরে জলবালির চারদিকে, তারার দল ঘোরে চাঁদের চারিদিকে, তেমনি তারাও কাজলরেখাকে প্রদক্ষিণ করে উড়তে থাকে।
এইভাবে দিন যায়। *
ক্রমে মেয়েরা বড় হয়ে উঠলেন। একদিন রাজবাড়ির বৃদ্ধ কঞ্চুরী রাজাকে বললেন,—কন্যাদের এইবার বিবাহের কাল হয়েছে। মহারাণী নাই; থাকলে তিনিই রাজাধিরাজকে একথা বলতেন। তার অভাব কর্তব্য আমার, আমিই আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।

রাজা সচেতন হয়ে উঠলেন। মনে মনে হিসাব করে দেখলেন, হ্যা, তাই তো, মুক্তমালার বয়স হ’ল আঠারো। আর কাজলরেখার ষোলো।
তিনি ডাকলেন মেয়েদের। দেখলেন। চোখ জুড়িয়ে গেল। যেন সদ্য-ফোটা দুটি পদ্মফুল।
বড় মেয়ে প্রণাম করে বাপের বিছানার পাশে বসলেন। কাজলরেখা বাপকে প্রণাম করে তার পায়ের কাছে বসলেন।
রাজা ভ্ৰকুঞ্চিত করে কাজলরেখাকে বললেন,—একি, তুমি মাটিতে বসলে কেন? উঠে বস।
কাজলরেখা বললেন, বাবা শাস্ত্রে আছে পিতা দেবতা, তার সঙ্গে সমাসনে বসা উচিত নয়, তার পায়ের তলাতেই বসা কর্তব্য। আর আসন হিসাবে মৃত্তিকাই হ’ল শ্রেষ্ঠ আসন। তবে আপনি যখন আদেশ করছেন, তখন তাই বসছি।
এই উত্তরে রাজা সন্তুষ্ট হলেন। তারপর কন্যাদের পিঠে হাত বুলিয়ে সস্নেহে প্রশ্ন করলেন,—মা, তোমরা এইবার বড় হয়েছ। বিবাহের বয়স হয়েছে। বিবাহ দিতে হবে। কিন্তু পাত্র সন্ধান করবার পূর্বে আমি জানতে চাই, তোমাদের কিরূপ আকাঙক্ষা, কে কেমন স্বামী প্রার্থনা কর। —মা মুক্তামালা, তুমি বড়, তুমিই বল আগে।

মুক্তামালা বললেন—আমার আকাঙক্ষা। আমার স্বামী হবেন তিনি যিনি শৌর্যে বীর্যে তেজস্বিতায় হবেন আপনার যোগ্য জামাতা। রূপে হবেন তিনি কন্দপের মতো, বীর্যে হবেন তিনি ঝড়ের সদৃশ–পবন দেবতার মতো।
রাজা হেসে কন্যার কথায় বাধা দিয়ে রহস্য করলেন, বললেন,—তাহলে তোমার ছেলের প্রকাণ্ড লেজ থাকবে মা। কেননা পবননন্দন হলেন হনুমান। পিঠের উপর লেজ তুলে দিয়ে ‘জয় রাম বলে এক লাফে সাগর ডিঙিয়েছিলেন, জান তো?
মুক্তামালা একটু লজ্জিত হলেন। রাজা হেসে বললেন,—বল,বল। মুক্তামালা বললেন,—তিনি বীর্যে পবনের মতো হবেন এই জন্য যে শত্ৰুকুল তার বীরত্বের সম্মুখে বড় বড় গাছের মতো ভেঙে পড়বে। তেজে তিনি হবেন অগ্নির মতো,—তাঁর রক্তচক্ষুর দৃষ্টির উত্তাপে যারা দুষ্ট, যারা হবে তার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, তারা অগ্নির সম্মুখে তৃণের মতো ম্লান হয়ে শুকিয়ে যাবে; তাতেও যারা সংযত না হবে, তারা সেই তেজে হবে ভস্মীভূত। তাকে হতে হবে খ্যাতিমান প্রাচীন রাজবংশের সন্তান। যেহেতু সকল গুণের আকরই হ’ল বীজ,—অমৃতফলের বীজ হতে জন্মায় যে-গাছ সে-গাছের ফল কখনও বিস্বাদ অথবা বিষাক্ত হয় না। সংসারে জন্মগুণই শ্রেষ্ঠ।


রাজা মুগ্ধ হয়ে গেলেন কন্যার কথা শুনে। হ্যাঁ, তার মতো রাজাধিরাজের উপযুক্ত কন্যা! রাজকন্যার উপযুক্ত কথা বলেছে সে!
কন্যার মাথায় হাত দিয়ে বাপ আশীর্বাদ করলেন। বললেন,—তুমি ইন্দ্রাণীর মতো ভাগ্য লাভ কর। তোমাকে আমি আশীৰ্বাদ করছি। তোমার মনোমতো স্বামীই আমি অনুসন্ধান করব। পৃথিবীতে না পাই, দেবলোকে, গন্ধৰ্বলোকে পর্যন্ত অনুসন্ধান করে অবশ্যই নিয়ে আসব।
মুক্তামালার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

তারপর রাজা ছোট মেয়ের দিকে হাসিমুখে, অত্যন্ত আদরের সঙ্গে পিঠে হাত দিয়ে বললেন, —মা, এবার তুমি বল, তোমার মনের কথা।
কাজলরেখা চুপ করে রইলেন। বাপকে নিজের বিয়ের কথা, বরের কথা বলতে লজ্জা হ’ল তার।
রাজা হেসে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,—লজ্জা বোধ করছ? আচ্ছা, থাক। আমি বুঝেছি—তোমার দিদি যা বলেছেন, তার যেমন আকাঙক্ষা, তোমারও কল্পনা তাই, বক্তব্যও তোমার তাই। -
কঞ্চকী বিনয় করে বললেন,—আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, অন্য প্রকার বাসনা বা বক্তব্য থাকবে কেন? পৰ্বতের কন্যা হল নদী। নানা ধারায় দেশের মধ্য দিয়ে তারা স্বয়ংবরা হবার জন্য ছুটে চলে। তাদের গুণও এক—দেশকে করে উর্বর, আর তাদের লক্ষ্যও এক—মহাসাগরে মিলিত হওয়াই তাদের একমাত্র কামনা। সুতরাং মা কাজলরেখার বক্তব্যও ঐ এক।
এবার কাজলরেখা ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে বললেন,—না।

রাজা বিস্মিত হলেন। বললেন,—তবে বল, শুনি তোমার কামনার কথা।
কাজলরেখা মৃদুস্বরে বললেন,—আমার স্বামী যিনি হবেন, তিনি যেন হন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি রাজপুত্র হতে পারেন, আবার অতি সাধারণ, এমন কি দীন-দরিদ্রের সন্তানও হতে পারেন। কান্তিতে তিনি কন্দর্পতুল্য হতে পারেন, আবার মহর্ষি অষ্টাবক্রের মতো রূপহীনও হতে পারেন। তিনি গুণে হবেন মহাজ্ঞানী। যেহেতু জ্ঞানই হ’ল প্রশান্তির একমাত্র আকর এবং যেহেতু অন্তরের প্রশান্তি ভস্মীভূত সৌম্যতা, সেই হেতু তিনি রূপহীন যদি হন, তবুও হবেন সৌম্যদর্শন শান্তপ্রকৃতি। পুণ্যকৰ্মই হবে তার অস্ত্র, কর্মই হবে তার ধর্ম। মানুষকে তিনি জয় করবেন না। মানুষের সেবায় তিনি তাদের সেবক হবেন, মানুষই তাকে স্বেচ্ছায় বরণ করবে বিজয়ী বলে। সাম্রাজ্য তিনি কামনা করবেন না, রাজপ্রাসাদের ঐশ্বর্যে তিনি মোহগ্ৰস্ত হবেন না। সাম্রাজ্য উথলে উঠবে তাঁর পদক্ষেপে, রাজপ্রসাদ কাঁদবে তার পদধূলির জন্য। তার রক্ষী থাকবে না কেউ, যেহেতু জীবনই তার কাছে বড় নয়; এবং সেই হেতুই তিনি হবেন অসামান্য।

রাজা এবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। তার কন্যা হয়ে এ কী বলছে কাজলরেখা! তার কথার মধ্যে যে বার বার রাজত্বকে তুচ্ছ করছে, রাজাকে হেয় করছে! তিনি বাধা দিয়ে বললেন—তোমার মস্তিষ্ক বোধহয় ঠিক নাই, কাজলরেখা। তাই বার বার তুমি অসম্ভব কথা বলছ। রাজপুত্রকে কামনা না করে সাধারণ মানুষকেই বরণ করবার কথা বলছ
কাজলরেখা বললেন,—কন্যার ঔদ্ধত্য মার্জনা করবেন। আমি কিন্তু মনে করি অন্যরূপ। জন্ম থেকেও কর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। কর্ম থেকেই মানুষের প্রতিষ্ঠা, মানুষের প্রতিষ্ঠা থেকেই হয় একটি বংশের প্রতিষ্ঠা। আবার সেই বংশের বংশধরের অপকর্মে হয় সেই বংশের অধঃপতন। আপনার এই মহৎ বংশ—এই বংশের মহিমা এবং স্থায়িত্ব নির্ভর করছে পুণ্যকর্মী উত্তরাধিকারীর উপর। উদ্ধত উগ্র ক্ষমাহীন প্রেমহীন উত্তরাধিকারী আপনার দৌহিত্র—হোক না কেন মাতৃকুলের দিকে তার আপনার বংশে জন্ম, হোক না কেন পিতার দিক থেকে অন্য কোন বড় রাজবংশে জন্ম, সে কখনও আপনার বংশমহিমা কুলগরিমাকে অক্ষুন্ন অটুট রাখতে পারবে না। বিধাতার লিপিও খণ্ডিত হয় মানুষের কর্মফলে, সুতরাং আপনার ইচ্ছা এবং আশীৰ্বাদই আপনার উত্তরাধিকারীকে ভাবীকালে রক্ষা করতে পারবে না।

এই কথায় রাজা অত্যন্ত রুষ্ট হলেন কাজলরেখার উপর। কেননা, তার মনে হ’ল কাজলরেখা তাকে অপমান করেছে। রাজার পুত্রকে কামনা না করে সাধারণ মানুষকে কামনা করে সে বংশের অপমান করেছে। তার আশীর্বাদ, তার ইচ্ছা উত্তরাধিকারীকে রক্ষা করতে পারবে না বলে, সে তাকে অপমান করেছে।

একবার তার ইচ্ছা হ’ল প্রহরীকে ডেকে এখুনি এই হীনমতি কন্যাকে বন্দিনী করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
তারপর একটা কথা তার বিদুত্যের মতো মাথায় খেলে গেল। ভাল, তাই হবে। কাজলরেখা রাজত্বকে উপেক্ষা করে; সাধারণ মানুষকে বিবাহ করতে তার প্রবৃত্তি। তাই তিনি করবেন। সেই বিবাহই হবে তার উপযুক্ত শাস্তি। রাজকন্যা হয়ে সে গরীবের বউ হবে। দাস থাকবে না, দাসী থাকবে না, রাজভোগ পাবে না, মোটা কাপড় পরবে, নিজে ভাত রাঁধবে, ঘুটে দেবে, নিজের হাতে ঝাঁটা ধরবে—এই তো উপযুক্ত শাস্তি! তিনি তাই স্থির করে দুই কন্যার পাত্র সন্ধান করতে লাগলেন। মুক্তামালার বর খুঁজতে চারিদিকে রাজ্যে রাজ্যে রাজ-ঘটক গেল; আর গরীবদের ঘটকালি করে যারা,
তাদের কয়েকজনকে ডেকে কাজলরেখার পাত্র সন্ধান করতে বললেন।

এই ঘটকের মধ্যে একজন বৃদ্ধ, তিনি বললেন,—যদি অনুমতি করেন, তবে ছোটকন্যার মুখ থেকে একবার তার কথা শুনতে চাই।
রাজা অনুমতি দিলেন। বুড়ো ঘটক রাজকন্যাকে বললেন,—মা, কয়েকটি প্রশ্ন করব। মহাদেবের বয়সের গাছ-পাথর ছিল না—জান তো ? তিনি শ্মশানে বাস করেন— জান তো? দেবতারা যখন অমৃত পান করেন তখন তিনি বিষ পান করেন—জান তো? দক্ষরাজার কন্যা তাকে বিবাহ করার ফলে দক্ষযক্ষ হয়েছিল—জান তো?.
কাজলরেখা বললেন—জানি।
বৃদ্ধ বললেন,—তবে ?
—তবে? কাজলরেখা বললেন,—বৃদ্ধ, আমি সতীকন্যা, আমার সঙ্কল্প কখনও ভঙ্গ হয় না।
—হ্যাঁ। বুঝলাম। তুমি সমস্ত কিছু সহ্য করতে প্রস্তুত।
—নিশ্চয়।
তারপর রাজ্যে এক মহা-উৎসব আরম্ভ হ'ল। মুক্তামালার বিবাহ। মহা-সমারোহ করে মুক্তামালার বিয়ে হ’ল এক রাজপুত্রের সঙ্গে। যেমন বর চেয়েছিলেন মুক্তামালা তেমনই বর।
আর কাজলরেখা ? হ্যাঁ। তারপর একদিন সেই বৃদ্ধ-ব্রাহ্মণ-ঘটক নিয়ে এল এক বর। সাধারণ একটি লোক। এক দেশের এক কবি। গরীব, কিন্তু খুব পণ্ডিত। দেখতে মোটেই সুন্দর নন, কিন্তু মুখের হাসিটি বড় শান্ত। দেখলেও মানুষ শান্তি পায়।
রাজা কন্যাদান করবার সময় ভেবেছিলেন মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন, মুখ দেখবেন না। হঠাৎ একবার দৃষ্টি পড়ল ছেলেটির মুখের দিকে। তার মুখের হাসিটি বড় ভাল লাগল। তিনি একবার ভাল করে দেখলেন। আবার দেখলেন। কন্যাদান শেষ করে উঠে একবার ডাকলেন, তাদের ডেকে ধনরত্ন দিয়ে তাদের আদর করে নিজের কাছেই রাখবেন। কিন্তু না। নিজেকে কঠোর করে তুললেন। কর্তব্য করতেই হবে। মুখ ঘুরিয়ে বললেন,—আজই রাত্রে তোমরা আমার রাজ্য থেকে চলে যাও। প্রভাতে যেন দেখতে না পাই। কেউ যেন জানতে না পারে।

কাজলরেখার বিয়ের কথা কাউকে জানাননি তিনি। আলো জ্বলে নাই, বাজনা বাজে নাই, শুধু দু’চারবার শাঁখ বেজেছিল। দুটি প্রদীপ জ্বলেছিল, তাও ঘর বন্ধ করে। অন্ধকারের মধ্যে বর আর কনে—কবি আর কাজলরেখা হাত ধরাধরি করে, পায়ে হেঁটে, রাজ্য থেকে চলে গেলেন। যাবার সময় রাজা কিছু ধনরত্ন দিতে চাইলেন জামাইকে। জামাই বললেন,—আমাকে ওসবের বদলে কিছু চাল দিন, যা রান্না করে দশজনকে ভোজন করিয়ে অবশিষ্টাংশ আমরা ভোজন করে তৃপ্তি পাব। ধনরত্ব অলঙ্কার—এর মূল্য আমি বুঝি না।

কন্যা কাজলরেখা তাঁর গায়ের সমস্ত অলঙ্কার খুলে বাপের পায়ের কাছে নামিয়ে দিলেন।
তারপর কবি আর কাজলরেখা এলেন কবির ঘরে।
গরীবের ঘর। কাজলরেখার তাতে কোনো দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। প্রসন্ন মনে সমস্ত করেন—ঝাট দেওয়া থেকে রান্নাবান্না, বিছানাপাতা, জল আনা, সমস্ত।
কবি কাব্য লেখেন। রাত্রে কাজলরেখাকে শোনান। কাব্যে কবি ভগবানকে স্তব করেন, প্রার্থনা করেন—হে ভগবান, তুমি মঙ্গলময়, তুমি দীন-দরিদ্রের বন্ধু, তাদের দুঃখ তুমি দূর কর। সকল বিপদে তুমি তাদের রক্ষা কর। তাদের বড় কষ্ট, তুমি তাদের দিকে তাকাও। শুনতে শুনতে কাজলরেখার চোখ জলে ভরে ওঠে।

কবি সকালে বার হন একতারা নিয়ে। গ্রামের পথে-পথে গান গেয়ে চলেন,—ধনী, অহঙ্কার কোরো না, ধন-সম্পদ হ’ল পদ্মপত্রের জল। দরিদ্র, তুমি দারিদ্র-দুঃখে পরের হিংসা কোরো না। অসৎ উপায়ে উপার্জনের চেষ্টা কোরো না; হিংসা হ’ল নিজের কাপড়ে ধরানো আগুন, তাতে তুমিই পুড়ে মরবে। অসৎ উপায়ে উপার্জন করা হল পাপ, —পাপ তোমাকে ধবংস করবে। উপরের দিকে চাও, যেখানে আছেন সকল মানুষের পরম বন্ধু এবং সকল রাজার রাজা, তিনি তোমাদের রক্ষা করবার জন্য, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করবার জন্য ব্যগ্র হয়ে বসে আছেন, সকল অবিচারের বিচার করবার জন্য ন্যায়দণ্ড নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তার দ্বারস্থ না হলে তিনি কি করবেন! তার শরণ নাও, তার শরণ নাও, তোমরা সকলে তার শরণ নাও।

এদিকে রাজা মুক্তামালার বরকে তার প্রতিনিধি করে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। মুক্তামালার বর মহা-বীর, মহা-যোদ্ধা; তিনি মৃগয়ায় যান, পশু-পক্ষী বধ করেন, সৈন্যসামন্ত নিয়ে দেশ জয় করেন, রাজাদের বন্দী করে এনে দাস করেন, রাণী আর রাজকন্যাদের এনে মুক্তামালার দাসী করে দেন।
আবার, তিনি কঠোর শাসক। সামান্য দোষও কেউ করলে তার নিষ্কৃতি নাই। চারিদিকে গুপ্তচর নিযুক্ত করেছেন। কে কোথায় রাজার নিন্দা করছে, সন্ধান রাখে গুপ্তচরেরা, কে কোথায় রাজার বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করছে, সে সন্ধান রাখে তারা। জামাই-রাজা কঠোর শাস্তি দেন।
প্রজারা সভয়ে সশঙ্কিত হয়ে দিন যাপন করে। কার কোনদিন কি হয়। শস্য উঠলে সর্বাগ্রে রাজার কর আদায় দেয়, শস্য যদি নাও হয় তুবও ঋণ করে অথবা কিছু বিক্রি করে, যেমন করেই হোক, রাজার কর দিয়ে আসে। ক্রমে দুটি কন্যারই দুটি ছেলে হ'ল। ছেলে দুটি আপন বাপ-মায়ের কাছে বড় হতে লাগল।
মুক্তামালার ছেলে, ভবিষ্যৎ রাজা, রাজপ্রাসাদে সোনার ভাটা নিয়ে খেলা করে। তীর ধনুক নিয়ে পোষা-পাখি বিধে লক্ষ্যভেদ শেখে।
আর কাজলরেখার ছেলে, ভোরে উঠে জোড়হাত করে বসে, কাজলরেখার সঙ্গে তার বাপের রচনা-করা ভগবানের স্তব গান করে, আঙিনায় খেলা করে পাথর-নুড়ি কুড়িয়ে এনে। যেগুলো ময়লা, মাটি লেগে থাকে, সেগুলিকে বলে, মা—এরা গরীব-দুঃখী নয়? গায়ে ময়লাটি লেগে রয়েছে।
তাদের সে স্নান করায়। বলে,—এদের সেবা করছি। সন্ধ্যায় সে শাস্ত্র পড়ে বাপের কাছে— নানা শাস্ত্র।
এমন সময়, সেবার একবার দেশে এল মহা-হাহাকার। একবারেই বৃষ্টি হ’ল না। দারুণ অনাবৃষ্টি। বর্ষা না হলে শস্য হয় না। শস্য না হলেই দেশে হয় দুর্ভিক্ষ। দেশে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হ’ল। লোকে অন্নের অভাবে গাছের পাতা খেতে আরম্ভ করলো। 
জামাই-রাজার কঠোর শাসন। রাজকর আদায়ের জন্য নায়েব-গোমস্তার সঙ্গে সৈন্য-সামন্ত দেওয়া হ’ল।
কাজলরেখার স্বামী কবি, মানুষের দুঃখ দেখে অবিরাম কাঁদেন। ভগবানকে ডাকেন,—উপায় কর প্রভু। তুমি উপায় কর। মানুষকে তুমি রক্ষা কর।
কাজলরেখা জোড়হাত করে বসে থাকেন স্বামীর পাশে। ছেলেটিও থাকে। রাত্রে কবিকে স্বপ্নাদেশ হ’ল। এক জ্যোতির্ময় দিব্যকান্তি পুরুষ এসে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন,—আমার প্রতিনিধি স্বরূপ দেশে রাজা রয়েছে। তুমি প্রজাদের সঙ্গে করে তার দরবারে যাও—জানাও তাকে তোমাদের দুঃখের কথা। তিনি যদি প্রতিকার না করেন, তখন আমার কাছে নালিশ জানালে তার প্রতিকার আমি করব।
সকালে উঠেই কবি কাজলরেখাকে সব বললেন। বলে বললেন,—দেখ, তোমার দিদি মুক্তামালার স্বামী যে প্রকৃতির কথা আমি শুনেছি, তাতে ভগবানের অভিপ্রায় যে কী তা আমি বুঝতে পারছি না। তবু আমাকে যেতে হবে। সত্যপ্রিয় (ছেলের নাম সত্যপ্রিয়) তোমার কাছে রইল। আমি যদি না ফিরি তবে তার ভার তোমার উপর রইল।
তারপর তিনি দুঃখীদের নিয়ে দরবারে গেলেন। যত যান, তত দলে দলে লোক তার পাশে জমা হয়। এমনিভাবে তারা প্রসাদের সম্মুখে গিয়ে জোড়হাত করে ডাকলে—হে মহারাজ ! আমাদের দয়া করুন, আমাদের অন্ন দিন।

মুক্তামালার স্বামী ঘুমুচ্ছিলেন। । চিৎকারে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি বেরিয়ে এলেন বারান্দায় রক্তচক্ষু হয়ে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে। বিছানা থেকে তরবারি হাতে নিতেই কিন্তু চিৎকার স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি বুঝলেন, সম্ভবতঃ তারা তার তরবারি হাতে নেওয়া জানতে পেরেছে। কিন্তু তিনি বারান্দায় এসে দেখলেন, শক্তিপ্রিয় (তাঁর ছেলের নাম শক্তিপ্রিয়)—তারই ভয়ে প্রজাদের চিৎকার স্তব্ধ হয়ে গেছে। শক্তিপ্রিয় ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে বুক ফুলিয়ে, আর নিচে প্রজাদের সামনে, সর্বাগ্রে একটি মানুষের দেহ পড়ে আছে। তার বুকে একটা তীর বসে রয়েছে। দেখলেই ছেলেকে তিনি মহা-গৌরবের সঙ্গে বুকে তুলে নিলেন। উপযুক্ত পুত্র। উদ্ধত প্রজার বিদ্রোহ দমন করতে সে পারবে।

এদিকে খবর পেয়ে মাতাপুত্ৰ হাতজোড় করে ভগবানকে ডাকলেন। বললেন,— প্রভু, তোমার আদেশে সে গিয়েছিল; তাকে রাজা বধ করেছে। তার প্রতিহিংসা আমরা চাই না। আমরা চাই, তুমি বলেছিলে রাজা প্রতিকার না করলে তখন তোমার কাছে নালিশ জানাতে। রাজা প্রতিকার করে নাই। তুমি এইবার প্রতিকার কর, দুঃখীদের বাঁচাও, ত্রাণ কর।
এইবার ভগবানের আসন টলে উঠল। তিনি ডাকলেন ক্ষোভকে। বায়ুর মধ্যে যে ক্ষোভ থাকে, সে এল। বললে—আমার অন্তরের সকল রস যখন সূর্য হরণ করে, তখন আমি জেগে উঠি—বাতাসকে করে তুলি ঝড়। মেঘ আসে আমার সঙ্গে—সে সূর্যকে ডেকে ফেলে। জলের মধ্যে যে ক্ষোভ থাকে, সে এল। বললে—ঝড় যখন আমাকে আঘাত করে, তখন তাকে প্রতিহত করবার জন্য আমি জাগি সমুদ্রের তরঙ্গে। মাটির মধ্যে থাকে যে ক্ষোভ, সেও এল। সে বলল—মৃত্তিকাকে যখন উত্তপ্ত করে তোলে, আর যখন সহ্য হয় না, তখন আমি জাগি। আমার সঞ্চরণে মাটি তখন কাঁপে ভূমিকম্পে।

ভগবান বললেন,—তোমাদেরই আমি চাই। অন্যায়ের ঔদ্ধত্যের প্রতিকারের জন্যই তোমাদের সৃষ্টি হয়েছে। ঈর্ষার অন্যায় তোমাদের মধ্যে নাই— যাও, তোমরা গিয়ে প্রজাদের বুকের মধ্যে অধিষ্ঠিত হও, দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠ, তারা মৃত্যুকেও তুচ্ছ করতে পারে। এমনভাবে তাদের ক্ষুব্ধ করে তোল।
ক্ষোভ এল। অনাহারে মানুষ পাগল হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল পেটের জ্বালায়। অপমানবোধ ছিল না। পশুর মতো উচ্ছিষ্ট খুঁজে, অখাদ্য খুঁজে, ঘুরে বেড়াচ্ছিল ধনীর দুয়ারে। নগরের পথে-পথে, বনে-প্রান্তরে-পথে যারা মরছিল সেই সব মড়ার মাংস খাচ্ছিল অপর সকলে। তাদের অন্তরে ক্ষোভ এসে জাগল। মনের মধ্যে প্রশ্ন উদিত হ’ল,—কেন আমরা এমনভাবে না খেয়ে মরব ?
উত্তর দিলে সত্যপ্রিয়—বললে,— প্রশ্ন কর রাজাকে, যিনি প্রজাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছেন, যিনি এর জন্য কর নিয়ে থাকেন।
দলে দলে মানুষ এসে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এক বিরাট জনসমুদ্রের সৃষ্টি করলে। তারা দেখতে দেখতে অন্য রকম হয়ে উঠল। দক্ষযজ্ঞের সময় শিবের জটা থেকে জন্ম নিয়েছিলেন বিরূপাক্ষ, তেমনই মূর্তি হ’ল তাদের। তারা ছুটল দলে-দলে, মার—মার শব্দে। মার, ঐ রাজাকে মার! রাজার পাপেই হয় অনাবৃষ্টি, রাজার পাপেই হয় দুর্ভিক্ষ, রাজার অত্যাচারেই আমাদের এই দশা। রাজাকে মার!

সত্যপ্রিয় পেছনে পেছনে ছুটল,—না না না, এরূপ নয়, এরূপ নয়! শান্ত হও, শান্ত হও। শান্ত ধীর পদক্ষেপে চল। অশান্ত অধীর হিংস্র হয়ে উঠো না তোমরা।
কিন্তু সে-কথা তাদের কানে ঢুকল না। জনতার কোলাহলের মধ্যে তার কন্ঠস্বর হারিয়ে গেল।
তার ছুটে গিয়ে পড়ল দলে-দলে হাজারে-হাজারে লাখে লাখে রাজধানীতে, রাজপ্রাসাদের উপর। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা ক্ষেপে উঠল, হাতি ক্ষেপে উঠল, ঘোড়া ক্ষেপে উঠল। আকাশে পাক দিয়ে ঘুরতে লাগল বাজপক্ষী, শকুনি, গৃধিনী; সে এক প্রলয়ের ব্যাপার, ভেঙে পড়ল রাজার সিংহদ্বার। ছিড়ে পড়ল ঝাড়-লষ্ঠন। মুক্তামালার বর কিন্তু মহা-বীর, শক্তিপ্রিয়ও বীর,—মুক্তামালাও যুদ্ধ করতে জানেন। তারা পালালেন না, যুদ্ধ করতে এলেন। কিন্তু এত মানুষের কাছে তারা কি করবেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজন লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। -

প্রজারা তাদের দেহ মাড়িয়ে এর পর ছুটল—কোথায় সে বুড়ো রাজা! এইবার তাকে আমরা বধ করব। কোথায় সে ?
অথর্ব বৃদ্ধ রাজা বসেছিলেন আপনার ঘরে। তিনি ইষ্ট স্মরণ করতে লাগলেন। কোলাহল এগিয়ে আসতে লাগল।
কিন্তু রাজা আশ্চর্য হলেন, হঠাৎ কোলাহল স্তদ্ধ হয়ে গেল। বাঁশির আওয়াজ শুনে দংশনোদ্যত অজগর যেমন থমকে দাড়িয়ে যায়, পাগলা হাতি যেমন শান্ত হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি পাগলা লোকেরা থেমে গেল। রাজার ঘরে এসে ঢুকল ষোল-সতেরো বৎসরের একটি ছোট ছেলে, সে যেন কুমার কার্তিক। কিন্তু তার হাতে ধনুর্বাণ নাই, অঙ্গে রাজবেশ নাই। পিছনে-পিছনে এসে ঢুকলেন বিধবা কাজলরেখা।
—বাবা!
—রাজা চমকে উঠলেন। মা কাজলরেখা!
—হ্যাঁ বাবা। এই আপনার দৌহিত্র।
—জামাই?
—তাকে তো বধ করেছে শক্তিপ্রিয়।
—রাজা কাঁদতে লাগলেন।
কাজলরেখা বললেন, —বাবা, জন্ম থেকে শ্রেষ্ঠ হ’ল কর্ম, তাই সেই কৰ্ম-পুণ্যবলে মানুষের সেবার পুণ্যে উন্মত্ত মানুষও আজ সত্যপ্রিয়ের অনুগত। সেই পুণ্যে আপনাকে আজ রক্ষা করতে পেরেছি, এই মহা-ভাগ্য।
রাজা উঠলেন। নিজের মাথার মুকুট খুলে পরিয়ে দিলেন সত্যপ্রিয়ের মাথায়। প্রজারা জয়ধ্বনি করে উঠল। রাজা বললেন,—আমার রাজকোষ, রাজভাণ্ডার তোমাদের খুলে দিলাম।
সত্যপ্রিয় মাথার মুকুট খুলে প্রজাদের পায়ের তলায় রেখে দিয়ে বললে—এও তোমাদের।