Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

শওকত আলী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

    চিত্রল সর্দারের মুখোমুখি মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। তারপর বললো, অনেক অনেক দূরে আছে সবুজ ঘাসের দেশ। সূর্য যখন ওঠেনি তখন থেকে ছুটতে হবে আর সূ...

    চিত্রল সর্দারের মুখোমুখি মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। তারপর বললো, অনেক অনেক দূরে আছে সবুজ ঘাসের দেশ। সূর্য যখন ওঠেনি তখন থেকে ছুটতে হবে আর সূর্যটা ডুবে আকাশ থেকে যখন লাল রং মুছে যেতে থাকবে তখন পৌছানো যাবে সে জায়গায়। একটা নদী পার হতে হবে, নদীর ওপারে শুধু সমতল মাটি। কেবল সবুজ আর সবুজ।
কিন্তু যাবে কি করে? চিত্রলের কথার মাঝখানে বাধা দিলো এক বুড়ো হরিণ। চিত্রল হেসে জিজ্ঞেস করলো, কেন যেতে অসুবিধা কোথায়? 
     কেন, ঐ যে কালরাজ ওৎ পেতে আছে।
     চিত্রল সমবেত সব হরিণের মুখের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর বললো, আসলে ভয়টা আমাদের নিজের ভেতরে। আজ আমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম। গায়ে গায়ে লেগে ছিলাম সর্বক্ষণ, কালরাজ হামলা করতে এসেও পারে নি। আর আমরা যদি ভয় পেয়ে এক একজন এক একদিকে ছুটে যেতাম তাহলেই মরতে হতো আমাদের। আমরা যদি একসঙ্গে থাকি, একজোট হয়ে মুখোমুখি দাঁড়াই, তাহলে কেউ আমাদের ওপর হামলা করতে সাহস পাবে না।
     চিত্রল আরো কিছু বলতো হয়তো, তার আগেই কে একজন বলে উঠলো, ঐ ছোকরাকে আর আসকারা দিও না। ওর কথা শুনে এখান থেকে বেরুলেই আমরা মরবো। কালরাজ আমাদের কাউকে ছাড়বে না। অনেক দিন ধরে সে হরিণের রক্তের স্বাদ পায় নি। না, আমরা যাবো না।
     সর্দার কিছু বললো না, শুধু দেখতে লাগলো। চিত্রল আর একবার চারদিকে তাকিয়ে বললো, আকাশে মেঘের দেখা নেই। এখানকার ফোয়ারা শুকোতে আর দেরী নেই, তখন পানি না খেয়ে মরতে হবে। এখন হয়তো বাচ্চারা খাদ লাফিয়ে পার হয়ে যেতে পারবে। না-খেয়ে না-খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়লে তখন সে শক্তিটুকুও আর থাকবে না। তখন বাচ্চারা শুকিয়ে না খেয়ে মারা পড়বে। তার চাইতে গেলে এখনই চলে যাওয়া ভালো।
     ওর কথা কেউ শুনলো না। বুড়োরা সমস্বরে না না বলে চেঁচাতে লাগলো।
     চিত্রল মাথা নিচু করে সরে এলো। কিছুটা হেঁটে এসে পেছনে তাকালো একবার। আহা বাচ্চাগুলোর ভারী কষ্ট হবে। এত সুন্দর বাচ্চারা, কী লাফালাফি ছুটাছুটি করছে—এরাই শুকিয়ে যাবে, হাড়-পাজরা দেখা দেবে। পিপাসায় কাতর হয়ে একসময় দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে খাদের মধ্যে পড়ে পড়ে মরতে থাকবে। তখন? তখন এই বুড়োরা কোথায় থাকবে?
     চারদিকে জ্যোৎস্না, পশ্চিম থেকে গরম হাওয়া বয়ে আসছে। সারাদিন পাহাড়ের গায়ে যে উত্তাপ জমেছিলো সেই জমানো উত্তাপ এখন হাওয়া হয়ে বইছে। চিত্রল আকাশের দিকে তাকালো। তারাগুলো ঝিকিমিকি কাঁপছে। অনেক অনেক দূরে তারার দেশ। চাঁদটা যে কত দুরে কে বলবে? তার জানতে ইচ্ছে করে। তাদের দলের এক বুড়ো ছিলো, সে তাকে সমুদ্রের কথা বলেছিলো, পাঁচ-পাহাড়ের ধবল চুড়োর গল্প শুনিয়েছিলো। এখনও তার ইচ্ছে করে সেই সব দেশে যেতে |
     কিন্তু এরা, এই জীবগুলো গর্ত থেকে বেরুতে চায় না মোটে। নিজের দলের হরিণদের কথা ভেবে করুণা হয় চিত্রলের।
     তবু সে যাবে। দরকার হয় একাকী চলে যাবে। এদিকে একটি একটি করে দিন যেতে লাগলো। আরো আগুন ছোটানো হাওয়া বয়ে এলো পশ্চিম থেকে। পাহাড়ের পাথরে পাথরে বুকজোড়া পিপাসা হা হা করে ফিরতে লাগলো। গাছের শুকনো পাতাও আর পাওয়া যায় না। ফোয়ারার পানি শুকিয়ে এসেছে, এখন আর স্রোত বয় না। আর কদিন কে জানে।
     চিত্রলের কোন কাজ নেই। সে আর দূর দেশে যায় না। বাচ্চা হরিণদের ছুটতে শেখায়, জোরে লাফাতে শেখায় আর শেখায় ঢালু পাহাড়ের গায়ে পাথর থেকে পাথরে কিভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যেতে হবে। যারা শিখে ফেলে তাদের নিয়ে যায় বাইরে, সেই বিপজ্জনক খাদের রাস্তা ডিঙ্গিয়ে বাইরের বন থেকে কিছু ঘাস-পাতা খাইয়ে আনে।
     হরিণেরা সবাই এখন গালাগাল করে একে অপরকে। বাইরে যাওয়া হরিণের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু তবু এ জায়গা ছেড়ে যে সবাই মিলে দুর অজানার পথে পা বাড়াবে, এমন সাহস কারো হয় না।
     কালরাজ হঠাৎ সেদিন দেখতে পেয়েছিলো। দুপুরে টিলার মাথায় দুটো প্রকাণ্ড পাথরের আড়ালে সে ঘুমোচ্ছিলো। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। কটা পাখি চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠেছিলো। উঠে বসতেই চোখে পড়ে তিনটে হরিণ একসঙ্গে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে যাচ্ছে। সে লাফিয়ে ওঠে, এতো কাছে সে বহুদিন হরিণ পায়নি। কিন্তু হরিণগুলো যে কিভাবে নিমেষে পাহাড়ের খাদের ওপারে চলে গেলো, সে আজো ভেবে পায় না। হরিণ তিনটের পিছু সে ছাড়ে নি।
     কালরাজ ছুটেছিলো ওদের পিছনে। কাছাকাছি গিয়েও ছিলো, কিন্তু ঝাপিয়ে পড়তে পারে নি। কাছাকাছি হতেই দেখলো তিনটে হরিণই শিং বাগিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
     কোনদিন এমন হয় নি। তার অবাক লেগেছিল। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। হরিণেরা তো চিরকাল বাঘ দেখে যে যেদিকে পেরেছে পালাতে চেয়েছে, আমন গায়ে গায়ে লেগে শিং বাগিয়ে রুখে দাঁড়ায় নি কখনো। কালরাজ দূর থেকে দাঁড়িয়ে হরিণ তিনটের সুঁচালো শক্ত শিংগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলো কিছুক্ষণ। শিংগুলোকে বড় বেশিধারালো মনে হয়েছিলো তার। তারপর থেকে কালরাজ লক্ষ্য রেখেছে কোন পথে আসে ওরা। পাহাড়ের গায়ে গায়ে সে ঘুরে বেডাচ্ছে। একদিনও কি পাবে না একটা হরিণকে। ওঃ। কতোদিন হরিণের রক্তের স্বাদ পায়নি, কতোদিন নরম মিষ্টি মাংস খায়নি। মনে পড়লেই তার জিভ থেকে লালা ঝরতে আরম্ভ করে।
     আরেকদিন কয়েকটা শুকনো ঝোপের আড়ালে আড়ালে হাঁটছিলো কালরাজ। লক্ষ্য রাখছিলো দুটি হরিণের ওপর। বড় হরিণটা খাদ পেরিয়ে এপারে এসে দাঁড়ালো। ছোটটা লাফিয়ে পার হবে ঠিক তক্ষুনি এক অলক্ষুণে পাখি চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠলো আর সঙ্গে সঙ্গে বড় হরিণটা ফিরে চাইলো। নড়লো না, পালিয়ে গেলো না। কালরাজ এগিয়ে গেলো। তার মনে হচ্ছিলো হরিণটা নির্ঘাৎ ভয় পেয়ে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সে কাছে গেলো, একপা একপা করে। আর একটা মাত্র লাফ । সে লাফ দেবে, এমন সময় দেখলো, হরিণটা লাফিয়ে ওপারে চলে গেলো।
     কালরাজের মনে হচ্ছিলো, এ হরিণটাকেই সে কদিন আগে দেখেছে। আরো দুটো হরিণের সঙ্গে শিং বাগিয়ে রুখে দাড়িয়েছিলো সেদিন। স্পষ্ট মনে পড়ে তার, দুই শিং এর মাঝখানে একটা চওড়া শাদা চিহ্ন দেখেছিলো সেদিনও।
     তার জেদ চেপে গেলো। চিরকাল সে রাজার মত হেঁটে ফিরেছে সারা বনে। সে যখন নির্জন দুপুরে হেঁটে যায় তখন বনের পাখিরা চেঁচায়। কে যায়, কে? অন্য পাখিরা উত্তর দেয় রাজা যায়, বনের রাজা। বনের রাজা কালরাজ, আজ হোক কাল হোক, সে দেখে নেবে হরিণের দলটাকে । তার সঙ্গে চালাকি!
     সে পাহাড়ের গায়ে দুটো প্রকাণ্ড পাথরের আড়ালে আস্তানা গাড়লো। আর লক্ষ্য রাখলো, কবে কখন ওরা দল বেঁধে বের হয়।
     বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। একদিন দেখলো, তখনও সন্ধ্যা হয়নি ভালো করে। সারারাত সে ঘুরে বেড়িয়েছে শিকারের খোজে। তিন দিন ধরে কিছুই পাচ্ছে না। ভোরের দিকে আস্তানায় ফিরছে এমনি সময় দেখলো অনেকগুলো হরিণ সেই খাদের ওপার থেকে একে একে এপারে লাফিয়ে আসছে। কালরাজের লোভী জিভ পানিতে ভর্তি হয়ে গেলো। আনন্দে সে গরগর করে উঠলো। ল্যাজটাকে আছড়ালো কয়েকবার। তারপর এগিয়ে গেলো। নিঃসাড়ে সে এগোতে লাগলো। যে চড়াই বেয়ে হরিণের ওপারে উঠে আসবে সেই চড়াইয়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়ালো। এমনিতে খাড়া চড়াই, ঢালু পাহাড়ের গা-ভর্তি নুড়িপাথর বিছানো। একটু নাড়া লাগতেই একটা নুড়ি গড়িয়ে পড়লো। শব্দ হলো।
     হ্যাঁ, শব্দ হলো। আর চকিতে তাকিয়ে দেখে নিলো চিত্রল। শয়তানটা ঠিক এসে দাঁড়িয়েছে।
     সর্দার তখনো ওপারে। বাচ্চারা এক এক করে সবাই লাফিয়ে এসেছে। সে ডাকলো অশান্ত, চপল। মুহুর্তে তিনজন পাশাপাশি দাড়িয়ে গেলো।
     কালরাজ দেখলো, দেখে অবাক লাগলো তার। হ্যাঁ সেই হরিণ তিনটা। নাকি এরা হরিণ নয়, অন্য কোন জীব? অবাক লাগে তার। আরো আশ্চর্য, দেখলো, বাচ্চা হরিণগুলো এক এক করে লাফিয়ে লাফিয়ে আবার খাদের ওপারে চলে যাচ্ছে। তার মানে, মুখের গ্রাস আবার ফস্কাবে। অসম্ভব। কভি নেহি! কালরাজ গর্জে উঠলো।
     নিচে খাদের ধারে যেখানে তিনটে পাথর পাশাপাশি মাটিতে গাঁথা সেখানে হরিণ তিনটে দাঁড়িয়ে। ঘাড় বাকিয়ে রেখেছে হরিণগুলো। লড়াইয়ে ডাকছে যেন। এতো সাহস তাদের। কালরাজ রাগে গরগর করতে করতে ল্যাজ আছড়াতে আছড়াতে দেখলো একে একে বাচ্চা হরিণগুলো ওপারে, তার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনটে ছিলো একটু আগে একটা গেলো। ঐ আরেকটা । কালরাজ গর্জে উঠলো। পাহাড়ে পাহাড়ে তার গর্জনের প্রতিধ্বনি শোনা গেলো। না, আর পিছোবে না সে। দেখে নেবে হরিণের দলটাকে।
     খাদের মুখে, যেখানে কটা পাথর ঢালু পাহাড়ের গায়ে গাঁথা, সেখানে নামতে পারলে খাদের ওপারে যেতে দেরী লাগবে না। আর তা হলেই নরোম উষ্ণ মিষ্টি রক্তমাংসের স্বাদে মুখটা ভরে যাবে। কালরাজের দুচোখে লোভ চকচক করতে লাগলো। সে পায়ে পায়ে ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে লাগলো। হরিণের লোমগুলো পর্যন্ত দেখতে পায় সে। আর একবার মাত্র একটা লাফ। আন্দাজ করে ঠিক মতো একটা লাফ শুধু!
     কালরাজ বসে পড়ে। শরীরটা গুটিয়ে আনে,পেছনের পা দুটোতে সারাজীবনের শক্তি এনে জড়ো করে।
     হুঁশিয়ার, চিত্রল চেঁচিয়ে উঠলো, শয়তানটা এক্ষুনি লাফ দেবে।
     একটা বাচ্চা হরিণ তখনও ওপারে যেতে পারেনি। বাঘ দেখে ভয় পেয়ে থরথর করে কাপছে সে।
    চিত্রল আক্রমণোদ্যত হিংস্ৰ লোভী জানোয়ারটাকে দেখছে। দেখছে আর ঘেন্না হচ্ছে তার। ঘাতক খুনী জীব, তার গায়ের গন্ধ, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, সব কিছুর মধ্যে কীরকম যেন একটা ঘেন্না মেশানো আছে বলে মনে হয় তার। চিত্রল মনে করতে চেষ্টা করলো, তার মা-বাবাকে মেরেছিলো এই শয়তানটাই। কতো হরিণ যে ওর পেটে গিয়েছে, কেউ তার হিসেব দিতে পারে না। কিন্তু এবার? এবার আর তা হতে দেবে না চিত্রল, এখানে এই ঢালু খাড়াইয়ের পাশে তোকে আজ উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে দেবো। সে মনে মনে বলে। আয় চলে আয়, চিত্রল ডাকে যেন বাঘটাকে। ডাকে আর দেখে, ডোরাকাটা দাগগুলো যেন তার শয়তানীর সাজ। জানোয়ারটার চোখের ভেতরে কী রকম ধূসর শীতল একটা আলো জ্বলছে। চিত্রল চেনে, সে আলো হচ্ছে বিশ্রী লোভের আলো।
     হঠাৎ চিত্রল চেচিয়ে উঠলো, হুঁশিয়ার। লাফ দিয়েছে বনের রাজা কালরাজ। বাচ্চা হরিণটা চিৎকার করে উঠলো। মাত্র কয়েক মুহুর্তের ব্যাপার। কালরাজ পাথর তিনটের ওপর এসে পড়লো। বিদ্যুৎ বেগে ওপরে উঠে গেলো চিত্রল, চপল, অশান্ত। বাচ্চা হরিণটা ছিটকে পড়ে নিচের একটা পাথরে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। কালরাজ পড়ামাত্রই বড় পাথর তিনটার নিচের নুড়িগুলো গড়িয়ে পড়লো। দুলে উঠলো পাথরটা। কালরাজ দেখলো হাত বাড়ালেই বাচ্চাটাকে পাওয়া যায়।
     যেই থাবা বাড়াতে যাবে, হঠাৎ অনুভব করলো তার পেটের কাছে কয়েকটা ধারাল খোচা লাগছে। চকিতে তাকিয়ে দেখলো তিনটি হরিণ তাদের ধারালো শিং দিয়ে তাকে ঠেলে ফেলতে চাইছে। কালরাজ শরীরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিলো তারপর ফিরে দাঁড়ালো। পেছনের একটা পা রাখার জায়গা পাথরটাতে নেই। নিচে কোন মাটি পাচ্ছে না সে,যে পায়ে জোর পাবে। তবু জানোয়ারটা রাগে লোভে হিংস্রতায় কুটিল হয়ে উঠলো। সে চিনে নিলো হরিণটাকে যেটা তার মুখের গ্রাস সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। চিত্রল কাছে ছিলো, চিত্রলের মাথা লক্ষ্য করে সে একটা থাবা মারলো। ধারালো নখ লেগে চিত্রলের গলার কাছ দিয়ে অনেকটা জায়গা চিরে গেলো। লাল হয়ে উঠলো গলাটা।
     ছোট্ট একটুখানি জায়গা পাথরের ওপর পাথর আলগা হয়ে লেগে আছে, বাঘের ভারী শরীরটা যেদিকে হেলছে পাথরটা সেদিকে ঝুঁকে পড়ছে।
     কালরাজ বুঝলো এক্ষুনি পাথরটা খসে গড়িয়ে পড়বে। নিচের অন্ধকার খাদের দিকে ও তাকিয়ে দেখলো। দেখে বুকের ভেতর কী যেন কেঁপে উঠে। না, তার উঠে যাওয়া দরকার। সে ওপরের দিকে একটা শক্ত পাথর খুঁজলো, যেখানে সে লাফ দিয়ে উঠে যেতে পারে। দেখলো কয়েক হাত দূরেই পাথরটা আছে। সে চলে যাবে এখনকার মত। কিন্তু মুখের গ্রাস কে ফেলে রাখে? বাচ্চা হরিণটাকে দেখে সেই মুহুর্তে সারা জীবনের ক্ষুধা যেন তার পেটের মধ্যে জ্বলে উঠেছে। বাচ্চা হরিণটার দিকে আরেকবার সে থাবা বাড়ালো।
     বাচ্চাটার বাঁচবার আশা নেই, নিজের ঘাড় থেকে দরদর করে রক্ত ঝরছে, তবু চিত্রল চেঁচিয়ে ডাকলো, আশাস্ত, চপল। তারপর শিং বাগিয়ে এগিয়ে গেলো। অশান্ত চপল তার ডাক শোনার আগেই সে শিংসুদ্ধ মাথাটা বিদ্যুৎ গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে দিলো। কি একটা ফুড়ে শিং দুটো ভেতরে প্রবেশ করলো বলে মনে হলো তার। আর সঙ্গে সঙ্গে নাকের কাছে একরাশ লোম এবং দুর্গন্ধ এসে লাগলো। আর ঠিক তক্ষুনি মনে হলো, কি একটা প্রচণ্ডশক্তি তার পিঠের ওপর ভেঙ্গে পড়েছে। সে মুখটা ফেরাতে চাইলো, পারলো না। সব কিছু ভুলে গিয়েছে সে তখন। কেবলি মনে হচ্ছে, জন্ম জন্মের শত্ৰু এই জানোয়ারটার কাছে তার হার মানলে চলবে না। পেছনের পা দুটোর ওপর ভর করে প্রচণ্ড শক্তিতে সামনের দিকে সে মাথার বোঝাটাকে ঠেলে ফেলতে চাইলো ।
     সবাই তখন বিমূঢ় হয়ে দেখছে।
     পাথরটা দুলছিলো, তার নীচ থেকে দুটি একটি করে নুড়ি খসে পড়ছিলো। এক সময় একটা পাথর খসে পডলো আর সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা চিত্রলের পিঠ ছেড়ে সামনের থাবা দুটাে দিয়ে কী যেন আঁকড়ে ধরতে চাইল। মুহুর্তের জন্য মাত্র, তারপরই পাথরটা আলগা হয়ে কাত হলো এবং বনের রাজা কালরাজকে নিয়ে পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটার পেটে শিং গাথা অবস্থায় চিত্রলও পড়লো সেই অনেক নিচে, অন্ধকার খাদে, যে অন্ধকার থেকে কেউ কোনদিন আর উঠে আসে না।
     তখন সকাল হচ্ছে, পাখীদের কলকাকলিতে সারা বন যেন ঝঙ্কার দিচ্ছে। পূব পাহাড়ের মাথায় সোনার মত রোদ ঝলমল করছে। হরিণেরা একে একে খাদ পার হয়ে এলো।
     বাচ্চারা ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বুড়োরা কথা বলছিলো না। চিত্রলের মা বাবা নেই। কেউ কাঁদছিলো না ওর জন্য। অশান্ত আর চপল সবার পেছনে আসছিলো। কিছুদুর এগোবার পর সর্দার ডাকলো, কোনদিকে যেতে হবে? অশান্ত সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, চপলও দেখলো, তারপর তারা এগিয়ে গেলো বাম দিকে, হ্যাঁ, বাম দিকে। অশান্ত সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, বাম দিকে চলো। পাহাড় বন পার হয়ে গেলে নদী দেখবো আমরা। নদী পার হয়ে গেলে পাবো সেই সমতল যেখানে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ।
     বাচ্চারা লাফাতে লাফাতে চললো চপল আর অশান্তর পেছনে পেছনে। তারা কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলো, বামের রাস্তা নদী পার হয়ে সবুজ প্রান্তরে গিয়ে উঠেছে। তারপর সবুজ প্রান্তর পার হয়ে তারা পৌছোবে পাঁচ-পাহাড়ের কোলে, যার চুড়োয় রুপোর মত বরফ ঝলমল করছে। দেখবে সেই বরফ গলে ঝর্ণা হয়ে কেমন করে নেমে যাচ্ছে। সেখানেই তারা থামবে না। পাহাড় আর ঝর্ণা পার হয়ে তারা আরো এগিয়ে যাবে। এগিয়ে গিয়ে দেখবে, বিশাল সমুদ্র আর তার বুকে নীল পাহাড়ের মত ঢেউ আকাশের বুক ছোঁবার জন্য উপরে উঠছে আর নামছে।

সম্পূর্ণ গল্পটি ডাউনলোড করো: ডাউনলোড

     শীতের পাতা ঝরা শেষ হয়েছে সেই কবে। পশ্চিম থেকে মাতাল হাওয়া দিগদিগন্ত দাপাদাপি করে চলে যায়। পাহাড়ের গায়ে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হাওয়ার ...

     শীতের পাতা ঝরা শেষ হয়েছে সেই কবে। পশ্চিম থেকে মাতাল হাওয়া দিগদিগন্ত দাপাদাপি করে চলে যায়। পাহাড়ের গায়ে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হাওয়ার ঝাপটা শিস দিয়ে ওঠে, মনে হয় কোথায় কোন গুহার ভেতর স্যাতসেঁতে অন্ধকার থেকে হিংস্র ময়াল তার শিকার দেখে শীৎকার দিয়ে উঠছে।
     দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। দিগন্ত ঘোলাটে, প্রখর সূর্য মাথার ওপরে জ্বলে যায়, বনের ভেতর গাছতলায় শুকনো পাতার রাশ ওড়ে। পাতাঝরা ডাল-পালায় হাওয়ার ঝাপটা নিজেকে কেবলি আছড়ায়। প্রখর শুকনো হাওয়া বুকের ভেতরকার রসটুকু পর্যন্ত শুষে নিয়ে যায়। বুক জোড়া পিপাসা হাহা করছে চারদিকে।
     হরিণের দলটা আকাশের দিকে তাকায়। আকাশটা নিষ্ঠুর। প্রখর সূর্যের দিকে তাকিয়ে দুপুর বেলা তারা পাহাড়ের গায়ে উঁচু পাথরগুলোর আড়ালে চলে যায়, আবার সূর্য ঢলে পড়লে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। সবার চোখ পড়ে থাকে দিগন্তের দিকে, হাওয়ার ঝটপটানি শুনলেই কান খাড়া হয়ে ওঠে। ঐ বুঝি মেঘ ডাকলো।
     তারা রুদ্ধশ্বাসে চোখ ফিরিয়ে দেখে। তারপর হতাশ হয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। না বৃষ্টি হবে না, মেঘ নেই আকাশে। একদিন দুদিন নয় বেশ কিছুদিন ধরে ওরা আটকা পড়ে গেছে। বহুদিন আগে যে পথে এসেছিলো, সে পথ এখন আর নেই। তারা এসেছিলো গভীর খাদের পাশ দিয়ে। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে, লাফিয়ে। গত বর্ষার দারুণ বৃষ্টিতে কখন ধ্বস নেমে পাথরের টাইগুলো ভেসে গিয়েছে কেউ লক্ষ্য করেনি। এখন সেখানে রাস্তা নেই, গভীর খাদ।
     এমনিতে ভারী আরামে ছিলো তারা। তিনদিকে পাহাড় খাঁড়া উঁচু হয়ে উঠেছে আর একদিকে হাল্কা বন, বনের ওপারে দুপেয়েদের বাস। দুপেয়ে জানোয়ারগুলো প্রচণ্ড শব্দ করে কী যেন ছুঁড়ে মারে। তাই ওদিকে বনের জানোয়ার এগোয় না। হরিণের দলটা ওদিকে কখনো যায় নি। দলের বুড়োৱা বলে দিয়েছিলো, দু’পেয়েরা যেদিকে আছে সেদিকে কখনো যেও না। ওরা ওদিকে কক্ষনো যায় নি। সামনে আর ডাইনে বায়ে যদি হিংস্র কোন জানোয়ার থাকে তাহলে তিরিশ চল্লিশ হাত পাথুরে খাড়াই বেয়ে ওঠার মত সামর্থ আর যারই থাক ওজনে ভারী বাঘ-চিতার নেই। ছোট ছোট পাথরে ভর্তি পাহাড়ের গা, খাড়াই পাহাড়ে একবার পা ফস্কালে গড়াতে গড়াতে পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে নিচে আছড়ে পড়তে হবে।
     বেশ আরামে ছিলো হরিণের দলটা। খাড়াই পাহাড় ঘেরা একটুখানি সমতল। এইটুকু জায়গার ভেতরেই একটা ছোট্ট জলা, মটির ভেতর থেকে ধীর ফোয়ারায় পানি বইছে আর সেই জলার চারদিক ঘিরে সবুজ ঘাস। শীতের প্রথম দিকেও ঘন কালে শ্বাস ছিলো। এখন সবুজ ঘাস রোদে পুড়ে গিয়েছে শুকিয়ে। জলার ধার ঘেঁষে যে জায়গাটুকুতে ঘাস ছিলো তাও এখন বাচ্চা হরিণেরা খেয়ে সাফ করে দিয়েছে।
     এখন এ জায়গা থেকে বেরুনো ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। যদি বৃষ্টি হতো, তাহলে হয়তো তাদের এতো দুশ্চিন্তা ছিলো না। বৃষ্টি হলে ঘাস গজাতো গাছপালা সবুজ হয়ে উঠতো, এক বছরের জন্যে তারা থেকে যেতে পারতো। কিন্তু বৃষ্টি নামে না, দিনের পর দিন আকাশের দিকে চেয়ে আছে আর অস্থির হচ্ছে।
     অস্থির হচ্ছে নিজেদের জন্যে নয়। বড়রা তো যেতেই পারে। বাচ্চারা এখনো ছোট ; এখনও সাহস পায় না যে প্রকাণ্ড খাদ লাফ দিয়ে পার হবে, কি ঢালু পাহাড়ের গায়ে ছড়ানো পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে ওপরে উঠে যাবে।
     আর এ জায়গা ছেড়ে গেলেই বেঁচে গেলো তাতো নয়। এ জায়গার বাইরে কোথায় যাবে? কোথায় খুঁজে বেড়াবে ঘাসের দেশ? যদি না পাওয়া যায়? শুধু দলসুদ্ধ সবাইকে খুঁজেই বেড়াতে হয়, তাহলে বনের হিংস্ৰ জানোয়াররা কি ছেড়ে দেবে? এ তল্লাটের শয়তান হচ্ছে কালরাজ, তার নাগাল এড়িয়ে যাওয়া কি অতই সহজ?
     তাই তরুণ হরিণের পথ খুঁজে ফিরছে। একটা পথ তারা খুঁজে পেয়েছে। অতি বিপজ্জনক রাস্তা। প্রকাণ্ড এক খাদের ওপারে পর পর ক’খানা বড় পাথরের চাই ঢালু পাহাড়ের গায়ে সাজানো আছে। পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে ওপরে চলে যেতে হবে। কিন্তু খুব সাবধানে, একবার পা ফস্কালে, কি একটা পাথর যদি গড়িয়ে পড়ে তাহলে নিশ্চিত মরণ। সে পথ দিয়েই কেউ কেউ বাইরে যায়, খুঁজে ফেরে কোথায় আছে ঘাসে ঢাকা সবুজ মাটি। কোথায় ঝর্ণার ঠাণ্ডা পানি টলটল করছে। কোন নদীর ধারে দিগন্ত বিস্তীর্ণ সমতলে সবুজ হাওয়া খেলা করে ফিরছে।
     কিন্তু আজো সে দেশের সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। হরিণেরা অপেক্ষা করছে একজায়গায় দাঁড়িয়ে। পথ চেয়ে আছে বাচ্চারা। কেউ কেউ কান পেতে আছে, যদি অতি পরিচিত শব্দটা শোনা যায়। সর্দার দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তার চকচকে গায়ে দিনশেষের আলোর আভা। মাঝে মাঝে সর্দার বলছে না ওরা ফিরবে না। ফিরলে তোক্ষণে ফিরে আসতো। কে জানে, হয়তো পালিয়েই গিয়েছে।
     যা বেয়াদপ ছোকরা তোমাদের ঐ চিত্রল। এক বুড়ে হরিণ নিচু গলায় মন্তব্য করে। বাচ্চারা তরুণরা কেউ কথা বলছে না। তাদের বিশ্বাস হয় না। তারা কান পেতে রেখেছে। কোথাও একটু শব্দ হলেই বুকের ভেতরে সেই শব্দের প্রতিধ্বনি শোনে।
     তারা জানে, চিত্রল ফিরে আসবে।
    আজ ভোরে, তখন পূবের পাহাড় চূড়োয় ভোরের আলো সবে দেখা দিয়েছে তখনই বেরিয়ে যায় চিত্রল অশাস্ত আর চপল। ওরা তিনবন্ধু। সেই যে গেলো, তারপর আর ফেরেনি। ওরা কী খবর নিয়ে আসে সেই জন্যে এখন সবার অপেক্ষা। বুড়োরা আর সর্দার নিজেদের মধ্যে কী যেন কানাকানি করছে। এক সময় সর্দার জিজ্ঞেস করলো, তোমরা দেখেছে কেউ, ওরা কোন দিকে গেছে? 
=================================
     একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করে, ওরা কি কাউকে কিছু বলে গিয়েছে?
    সর্দারের কথার জবাব কেউ দেয় না। কেউ জানলে তা! চিত্রল কাউকে কিছু বলে না। অশান্ত চপল তার অত বন্ধু,তারাও জানে না। সে কারো শাসন মানতে চায় না। জাতের নিয়ম কানুনের পরোয়া করে না। যখন ইচ্ছে, যে দিকে ইচ্ছে চলে যায়। আবার ইচ্ছেমত ফিরে আসে। যা কিছু কথা ওর, সব বাচ্চাদের সঙ্গে। তাদেরকে ও গল্প শোনায়,কোথায় আকাশ ঝকঝকে নীল। কোথায় বিশাল হ্রদে রাতের জ্যোৎস্না ছলোচ্ছল ঢেউ দিয়ে মাটি ছুয়ে যায়—কোথায় মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ।
     সে বলে আর তার দু'চোখের ভেতরে কেমন যেন কোমল আলো জেগে ওঠে। ওর কথা শুনতে শুনতে বাচ্চাদের শরীরে কী রকম কাঁপ লেগে যায়। গল্প বলা শেষ হলে বাচ্চা হরিণদের ডেকে বলে, আমরা একদিন সেই দেশে যাবো।
     তারপর সে নাচতে আরম্ভ করে দেয়। বলে, আমরা এমনি নাচতে নাচতে যাবো, চলো এসো সবাই।
    তখন সেই জ্যোৎস্নার মধ্যে খোলা মাঠে ওদের নাচ সুরু হয়ে যায়। খটখট খটখট গ্ররে তুররে শব্দ বাজতে থাকে। পাহাড়ে পাহাড়ে সেই শব্দ অফুট প্রতিধ্বনিত হতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে। অনেক রাত হয়ে যায়, তবু বাচ্চারা মায়ের কাছে ফেরে না।
     সেই চিত্রলের মনের খবর কে বলবে? দস্যিপনায় তার জুড়ি নেই, দুঃসাহসের সীমা নেই। সর্দার ফের জানতে চাইলো, কেউ বলতে পারে কি না, চিত্রল কোন দিকে গিয়েছে। কেউ বলতে পাবে না।
     সর্দার চিত্রলকে শাসন করো, চপলের বাবা কথা বললো হঠাৎ৷ 
     সর্দার মুখ ফেরায়। অশান্ত আর চপলের মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। তাদের দু'চোখের ভেতরে কী রকম একটা অজানা ভয় থমথম করছে।
     অন্যান্য বুড়োরাও তখন বলাবলি করে, নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। ছোকরা যা গোয়ার। একেক দিন রাত হয়ে যায়। তবু সে ফেরে না। সারা বনময় ঘুরে বেড়ায়। চওড়া চওড়া খাদ, নিচে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে,তাও সে হাসতে হাসতে লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে চলে যায়।
     আজ হয়তো অনেক দূরে কোথাও গেছে। ফেরার কথা হয়তো মনেই ছিলো না। যখন মনে হয়েছে তখন হয়তো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। আর যদি - - - - -
     কথাটা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে। কথাটা কেউ মুখ দিয়ে উচ্চারণও করতে চায় না। কিন্তু মনে মনে সবাই বোঝে। সবাই দেখেছে তাকে। কী ভয়ঙ্কর দেখতে। শয়তানটা বহুদিন ধরে তাদের দলের পেছনে লেগে আছে। হলদে গায়ে কালো কালো ডোরা, মাথাটা কী প্রকাণ্ড, চোখ জোড়া অসম্ভব নিষ্ঠুর, দেখলেই হাত-পা হিম হয়ে আসতে চায়। কতবার সে পিছন থেকে লাফিয়ে পড়েছে। দল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে কোন শিশু হরিণকে। সর্বদা তটস্থ থাকতে হতো তখন। এ জায়গায় আস্তানা নেওয়ার পর আর সে হামলা করতে আসতে পারে না। কিন্তু লোভ তার যায়নি। কতদিন দেখা গেছে, টিলার ওপর মাথা তুলে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে গরগর করছে, ল্যাজ আছড়াচ্ছে, আর থেকে থেকে কী হুঙ্কার।
     সবাই দেখেছে শয়তানটাকে। সবারই বুকের ভিতরে আশঙ্কা থমথম করে উঠলো। যদি কালরাজের মুখে চিত্রল চপল অশান্ত পড়ে, তাহলে?
     কথা বলতে পারে না কেউ। সর্দার মাথা উঁচু ডাইনে-বায়ে তাকালো। না কোথাও কোন সচল কিছু দেখা যায় না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। একটুপর আর কিছুই দেখা যাবে না সর্দার ডেকে জিজ্ঞেস করে সবাইকে, ওদের খুঁজতে যাবে কেউ?
     কেউ সাড়া দেয় না। গাছে পাতা নেই, তবু যেন নিম্পত্র ডাল থেকে উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে লাগছে কারো কারো গায়ে।
    ওদের চুপ করে থাকতে দেখেই কি না কে জানে সর্দার গালাগাল দিতে আরম্ভ করলো, ভীরুর দল, তোদের মরাই ভালো।
     বাচ্চারা দূর থেকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলো, ওরা একসঙ্গে কথা বলে উঠলো। বললো, সর্দার পথ ঘাট চেনে, বুড়োর রাক্ষুসে জানোয়ারদের চেনে, আমরা কেউ চিনি না। বড়রা যাক, ওদেরই যাওয়া উচিত প্রথমে।
     ওদের কোলাহল শুনে ধমকে ওঠে সর্দার, এ্যাই চোপ। শিং বাগিয়ে ধরে বলে, চ্যাঁচাবি তো খুঁচিয়ে মারবো।
    গালাগাল করতে থাকে সর্দার। বলে অমন বেয়াদপ হরিণ দলের কুলাঙ্গার। কালরাজ যদি ওকে চিবিয়ে খায় তবে তার উচিত শাস্তি হয়।
     হরিণের চুপ করে শোনে। তিনটে বুড়ো ছিলো, শিঙ্গের ভারে মাথা নুয়ে পড়েছে তাদের। তারা মাথা নেড়ে নেড়ে বলে, হ্যাঁ ঠিকই তো, ছোকরা আমাদের কথা শোনে না। গোয়ার একরোখা। ওর বাপের মত, বাপকে খেয়েছিলো কালরাজ, ছেলেকে কি আর ছেড়ে দেবে।
     সর্দারের কথা শোনার পর অশান্ত আর চপলের মা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলো। চিত্রলের জন্যে কাঁদবার কেউ নেই। শুধু বাচ্চারা চিত্রলের কথা ভাবতে লাগলো। তাদের তীর বেগে ছোটার কায়দা কে শেখাবে? হিংস্ৰ জানোয়ার সামনে এলে কি ভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে, কি ভাবে ক্ষিপ্রগতিতে তার চোখে ধূলো দিতে হবে, কার কাছে শিখবে এ সব? আর কে বলবে জ্যোৎস্নালোকিত হ্রদের গল্প? পাঁচ-পাহাড়ের চুড়োয় যেখানে রুপোর মত বরফ ঝলমল করে সেখান থেকে কেমন করে ঝর্ণাধারা বয়ে আসে, কোথায় যেন সমুদ্র আছে, শুধু নীল পানি, আর তার বুকে পাহাড়ের মত ঢেউ অনবরত দুলছে। কে শোনাবে তাদের এসব কথা? বড়দের জটলা থেকে বাচ্চারা একপাশে সরে দাঁড়ায়। কথা বলে না কেউ। তাদের আপন বলে আর কেউ থাকবে না। আর কেউ বলবে না যে দুনিয়া অনেক বড়। এই শুকনো বনভূমি পার হয়ে
পাহাড়ের ওপারে যে আরো সবুজ দিগন্ত আছে, সেই বিপুল মুক্তির কথা শোনাবার জন্যে আর কেউ থাকবে না তাদের কাছে।
     কারো কারো চোখে পানি টলমল করে ওঠে। আর ঠিক তক্ষুনি কে যেন বলে উঠলো, এই চুপ। শোনো তো কিসের শব্দ। সবাই চুপ করতেই শোনা গেলো, হ্যাঁ আসছে। খুরে খুরে শব্দ বাজছে নাচের ছন্দের মত। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। ভাঙ্গা চাঁদ ঝুলছে পাহাড়ের ওপরে। আর সেই জ্যোৎস্নায় ক্রমশঃ স্পষ্ট দেখা গেলো। তিনটে সজীব অন্ধকার যেন ধেয়ে আসছে। কাছে আসতেই চেনা গেলো। তিন বন্ধু—চিত্রল, অশান্ত, চপল।
     ওরা হাফাচ্ছিলো, চপল বললো, কালরাজ তাড়া করছিলো পেছনে, বাববাঃ শয়তানটা কী দৌড়ায়। অশান্ত ধমকে উঠলো, চুপ করবি তুই। আর বলবার কথা পেলি না।