Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

মোগলি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

   তবু একদিন নেকড়ে-মা বলে দিয়েছিল, শেরে খানের মত প্রাণীকে বিশ্বাস করো না। সুযোগ পেলেই কিন্তু সে তোমাকে মেরে ফেলবে।    মোগলি জানতে চেয়েছিল...

   তবু একদিন নেকড়ে-মা বলে দিয়েছিল, শেরে খানের মত প্রাণীকে বিশ্বাস করো না। সুযোগ পেলেই কিন্তু সে তোমাকে মেরে ফেলবে।
   মোগলি জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা মা, শেরে খান কেমন প্রাণী? সে থাকে কোথায়?
  নেকড়ে-মা মোগলিকে বুকের কাছটিতে আদর করে বসিয়ে বলেছিল, শেরে খান থাকে এখান থেকে অনেক দূরে বাণগঙ্গা নদীর তীরে। তার হুঙ্কার বড় মারাত্মক-সে হল বনের বাঘ। জন্ম থেকেই তার এক পা খোঁড়া-সেই জন্য তার মা তাকে লুংড়ি বলে ডাকত। বাণগঙ্গার তীরের মানুষদের গ্রামে ঢুকে সে কেবল গরু-ছাগল মারে।
   মোগলির মনে শেরে খানের বিষয়ে খুবই কৌতুহল জেগে উঠেছিল। একদিন যখন দুজনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে --মোগলি বাঘিরার পিঠের ওপর দুদিকে দু'পা ঝুলিযে বসে থেকে তাকে জিগ্যেস করছিল, আচ্ছা বাঘিরা,শেরে খানটা কে? তুমি কি তাকে দেখেছ?

   বাঘিরা বলেছে, শেরে খান যে কে তা তোমাকে বলে দিতে হবে না-চেহারা দেখলেই তুমি তাকে চিনতে পারবে। তাকে বনের সকল প্রাণীই এড়িয়ে চলে। মানুষদের সে একদম পছন্দ করে না।
   মোগলি বলেছিল, আমি মানুষ হলেও, মানুষদের গ্রামে তো আমি থাকি না--এই জঙ্গলে নেকড়ে মায়ের কোলেই তো আমি বড় হয়েছি—তাদের শিকার খেয়েছি-জঙ্গলের আইন মেনে চলেছি--
   বাঘিরা আর বেশি কিছু বলতে চায়নি। অন্য কথা তুলে প্রসঙ্গটা পাল্টে দিয়েছিল।
   শেরে খানের ব্যাপারে সেই থেকে একটা খটকা লেগে আছে মোগলির মনে। এটুকু সে বুঝতে পেরেছিল যে, শেরে খানকে সকলেই ভয় করে চলে। আর ওই শিশু বয়সেই সে জেনে গিয়েছিল, বাঘিরা যে ঘুরে ঘুরে প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে আসে, তার সঙ্গে নানান গল্প করে,ঘুরে বেড়ায়--সে আর কিছুই না, সে তাকে আগলে রাখে।
   চোখে চোখে রাখতে চায় যাতে সে কোন বিপদে না পড়ে।

   মোগলি জানত না, প্রথম দিন থেকেই মোগলির মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিল বাঘিরা। নেকড়ে বাবা-মায়ের কাছে মানুষ হলেও সব দায়িত্বটা তারই। তাই গত দশ বছর ধরে তার কাছে ঘুরে ঘুরে না এসে পারত না সে।
   মোগলিকে হাসিমুখে খেলা করতে দেখলে আনন্দে তার বুক ভরে উঠত। মোগলিও বাঘিরা কখন আসবে যেন সেই অপেক্ষায় সময় গুণত। জঙ্গলে পশুদের সঙ্গে জীবন এভাবেই কাটছিল মোগলির-আনন্দ আর খুশির মধ্যে। কোন মানবশিশুই হয়তো তার মত এমন সুখী ও হাসিখুশি ছিল না। কিন্তু বর্ষার আকাশের মতই একদিন সহসা মোগলির জীবনে দেখা দিল দুঃখ আর বেদনার কাল মেঘ।
   জঙ্গলের নেকড়েরা দলবদ্ধ স্বাধীন প্রাণী। গোটা দল যার হুকুমে চলে সেই তাদের দলপতি বা সর্দার। দলে সর্দারের কথাই শেষ কথা। জঙ্গলের সাধারণ নিয়মের বাইরেও নেকড়ে দলের প্রত্যেককে সমাজের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়।
এসব নিয়ম-কানুন ঠিক করে দলের বয়স্ক নেকড়েরা সর্দারের সঙ্গে পরামর্শ করে।

   প্রতি মাসে একদিন ভর চাঁদের রাতে ফুটফুটে জোছনায় নেকড়েদের দলীয় সভা বসে। যেই পাথুরে পাহাড়ের সমতল চুড়ায় এই সভা বসে নেকড়ের তার নাম দিয়েছে পরিষদ-পাহাড়। সেই পাহাড়ের আশপাশে পাথরের টুকরো ও বড় বড় পাথরের চাঁই ছড়ানো। সেই পাথরে পাথরে লাফিয়ে নেকড়ের চূড়ায় সভার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে।
   সেবার পূর্ণিমার এক রাতে গোটা জঙ্গলের গাছপালা যখন বুদ হয়ে আছে জোছনার মৌতাতে, সেই সময় দেখা গেল নেকড়ের উঠে এসেছে তাদের পরিষদ পাহাড়ে।
 
নেকড়েদের সর্দার-বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ নেকড়ে, তার নাম একেলা, গোটা দলকে সে চালায় শক্তি ও চাতুরির গুণে।
  পাহাড়ের ওপর পৌছে তার নির্দিষ্ট পাথরটার ওপর এসে বসল একেল | তার নিচে বসল নানা মাপের ও বর্ণের আরও চল্লিশ বা তারও বেশি নেকড়ে।
   একেলা উপস্থিত নেকড়েদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আজ আমাদের এক গুরুতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু রাম দেখছি এখনো এসে পৌছায়নি।
   বয়স্ক এক নেকড়ে বলল, পরিষদে যা আলোচনা হবার কথা, তা নিয়ে আমরা উপস্থিত সকলেই নিজেদের মতামত জানাতে পারি। সিদ্ধান্ত যা হবে সেটা পরে রামাকে জানিয়ে দিলেই হবে। নিশ্চয় সে কোন কাজে আটকা পড়েছে। তা আজ
একেলা বলল, গতকাল সন্ধ্যায় পাত-চাটা টাবাকুই এসে খুব মারাত্মক একটা খবর দিয়ে গেছে। খবরটা শোনার পর থেকে আমি খুবই অস্বস্তির মধ্যে রয়েছি।
   টাবাকুই হল ঝাঁকড়া লেজওয়ালা শেয়াল। সে সব সময়েই গা-ঢেকে চলাফেরা করে আর সকলেরই ক্ষতি করে বেড়ায়।
   জঙ্গলের নানান খবর সে চারদিকে রটিয়ে বেড়ায়-আজগুবি সব গল্প বলে। আর মানুষদের গ্রামে দিয়ে আস্তাকুঁড় থেকে চামড়ার টুকরো তুলে খায়।
    নেকড়েকুল টাবাকুইকে ছোট নজরে দেখে, তারা তাকে পাত-চাটা টাবাকুই বলে ডাকে।
   সভায় উপস্থিত নেকড়েরা একেলার মুখে টাবাকুই-এর নাম শুনে নড়েচড়ে বসল। সাগ্রহে তাকিয়ে রইল একেলার দিকে।
   একেলা বলতে লাগল, পাত-চাটা টাবাকুই আমাকে বলেছে, শেরে খান শিকারের অঞ্চল বদলে ফেলেছে। বাণগঙ্গা নদীতীরের গ্রামবাসীরা তার ওপর চটে গেছে সেই কারণে সে এখন থেকে এই পাহাড়ি জঙ্গলেই শিকার ধরবে। টাবাকুই অনেক আজগুবি গল্প বললেও, সত্যি খবরও অনেক সময় তার মুখ থেকে শোনা যায়। টাবাকুই তার শিকারের দিব্য দিয়ে বলেছে, শেরে খান নিজে তাকে শিকারের অঞ্চল পাল্টাবার কথা বলেছে। কথাটাকে আমি উড়িয়ে দিতে পারিনি। তোমরা তো জান রামা আর তার বৌ একটা মানুষের বাচ্চাকে নিজেদের বাচ্চার সঙ্গে পালন করেছে। নেকড়ের দলে মানুষ রয়েছে বুঝতে পারলে শেরে খান তাকে ছেড়ে দেবে না। দু-পেয়ে মানুষকে সে একদম পছন্দ করে না। মানুষের বাচ্চাটার জন্য নেকড়েদের গোটা দলটাই শেরে খানের শত্রু হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় আমাদের এখন কি করা কর্তব্য সেটা ঠিক করতে হবে।
   একেলার কথা শেষ হলে বয়স্ক এক নেকড়ে পাশ থেকে বলল, বিপদ-বিপদ-সমূহ বিপদ দেখতে পাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে তার কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল উপস্থিত নেকড়েদের মুখে মুখে। প্রায় এক ঘণ্টা সময় নেকড়ে পরিষদের সভার কাজ চলল। বহু আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত স্থির হল, রামাকে জানিয়ে দিতে হবে নেকড়ে দলে মানুষের বাচ্চা রাখা চলবে না।
   রামাকে এই দুঃসংবাদটা জানাবার দায়িত্বও দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হল দলপতি নিঃসঙ্গ নেকড়ে একেলার ওপর।
 
থালার আকারের চাঁদ আকাশের মাঝামাঝি এসে পৌছবার আগেই নেকড়ে দলের সভা ভঙ্গ হল। নেকড়েরা যে যার মত নিজেদের কাজে চলে গেল। সবার শেষে একেলা নেমে এলো পরিষদ পাহাড় থেকে!
   তারপর সোজা ছুটে এসে দাঁড়াল নেকড়ে রামার বাসার সামনে । রাম গুহার বাইরেই ঘোরাঘুরি করছিল। একেলাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।
   একেলা বলল, পরিষদ সভায় আজ তুমি যাওনি। তাই পরিষদের একটা সিদ্ধান্তের কথা জানাবার জন্য আমাকেই আসতে হল।
   রামা বলল, পাত-চাটা টাবাকুই গিয়েছিল বুঝি?
   একেলা বলল, তুমি দেখছি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছ। তোমাকে দুঃসংবাদটা জানাবার দায়িত্ব আমার ওপরেই পড়েছে।
   রামা বলল, টাবাকুই এসে আমাকেও জানিয়ে গেছে শেরে খান বাণগঙ্গার অঞ্চল ছেড়ে আমাদের এখানে চলে এসেছে। এই চাঁদ থেকে সে এখানেই শিকার ধরবে। তা শেরে খান শিকার ধরতে আসবে তো আমাদের চিন্তিত হবার কি আছে? আমরা তো আর তাকে বাগড়া দিতে যাচ্ছি না।
   একেলা বলল, তোমার বাসায় মানুষের বাচ্চাটা না থাকলে চিন্তার কিছুই ছিল না। টাবাকুই এতদিনে খবরটা নিশ্চয় শেরে খানের কানে পৌঁছে দিয়েছে। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, মানুষের বাচ্চাটার লোভেই হয়তো শেরে খান এই জঙ্গলে চলে এসেছে। পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মানুষের বাচ্চাটাকে নেকড়ে দলে রাখা চলবে না। তুমি তার বাবা, এবারে তুমি যা ব্যবস্থা নেবার নাও ।
   রামা এবারে পা ভেঙ্গে বসল। বলল, মানুষের ছেলেটা এখন আমার নিজেরই ছেলে হয়ে গেছে। নেকড়েদের থেকে সে অনেক বেশি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। ভবিষ্যতে দলটাকে সে রক্ষা করতে পারবে—এটা তো এতদিন দলের সকলেই মেনে নিয়েছিল। এখন তাকে দল-ছাড়া করবার কথা উঠছে কেন? বাচ্চাটা আমাদের সঙ্গে খেয়েছে—আমাদের সঙ্গে ঘুমিয়েছে, আমাদের জন্য শিকারকে তাড়া করেছে–জঙ্গলের বা নেকড়েদলের আইন একটাও লঙ্ঘন করেনি।
   একেলা বলল, তোমার কথা সবই সত্য রামা। কিন্তু দুঃখের কথা কি জান, টাবাকুইর কাছে খবর পেয়ে আমি বুঝতে পারছি শেরে খান মানুষের বাচ্চাটাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে।
   রামা বলল, কিন্তু আমর মানুষ ছেলে শেরে থানের তো কোন ক্ষতি করেনি। সে মানুষ হলেও বর্তমানে নেকড়ে দলের একজন সদস্য।
   একেলা বলল, তুমি তো জান রামা, শেরে খান মানুষদের খুবই ঘৃণা করে। বন্দুক কাঁধে করে মানুষরা জঙ্গলে এসে শেরে খানের খোঁজই করে বেড়ায়। সে-কারণে তোমার ছেলে মোগলি বড় হয়ে বন্দুক কাঁধে নিয়ে আর একজন বাঘ-শিকারী হয়ে উঠবে শেরে খান এটা কিছুতেই হতে দেবে না।
   মোগলির নেকড়ে-বাবা রামা বলল, কিন্তু একেলা, মোগলি তো কোনদিনই বাঘ-শিকারী হবে না। দরকার হলে মোগলি নিজে গিয়েই শেরে খানকে একথা বুঝিয়ে বলে আসবে।
   একেলা এবারে ব্যথিত গলায় বলল, তুমি তো জন রামা, বাঘ শেরে খান কারুর কোন কথা মানে না, তাই কেউ তাকে কিছু বলে বোঝাতে পারে না। শেরে খান নিজে যা ভাল বোঝে তাই করে। তাছাড়া দেখ, মোগলি থাকলে এক সময় না এক সময় তাকে নিয়ে শেরে খানের সঙ্গে নেকড়ে দলের বিবাদ বেঁধে যাবে! শেরে খানের তুলনায় নেকড়ে দল শক্তিতে খুবই দুর্বল। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও আমরা তোমার ছেলেকে বাঁচাতে পারব কি না সন্দেহ। তার চাইতে তুমি বরং মোগলকে মানুষদের গ্রামে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। নিজের জাতের সঙ্গে সে ভালই থাকবে--বিপদের কোন ভয় থাকবে না। মোগলি বেঁচে যাবে। কিন্তু এখানে থাকলে শেরে থানের হাতে সে নির্ধাৎ মরবে।
   এ কথার পরে রামার মুখে আর কোন উত্তর জোগাল না। সে চুপ করে মাথা নিচু করে রইল।
  একেল এবার যাবার উদ্যোগ করল। শেষবারের মত বলল, তুমি যত তাড়াতাড়ি পার মোগলিকে মানুষদের গ্রামে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর । এই বলে নেকড়ে দলপতি স্থান ত্যাগ করল।

   গুহার ভেতরে নেকড়ে-মা একপাশে মোগলি আর অন্যপাশে নিজের বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে ছিল। গুহার বাইরের কথাবার্তা সবই তার কানে পৌছেছিল। ছড়ানো দু'পায়ের ওপর মাথা রেখে একেলার কথাগুলি শুনেও সে বাইরে বেরিয়ে আসেনি। সে বুঝতে পেরেছিল, একেলা মোগলিকে আর দলে রাখবে না। আর সে জানে দলে থেকে সর্দারের আদেশ অমান্য করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
   দলের নেকড়েরা একজোট হয়ে তাদের সকলকে মেরে ফেলবে। অথচ তার আদরের ছেলে মোগলিকে কেবল মানুষ হওয়ার দোষে বাসা থেকে বার করে দিতে হবে এই কথাটা ভাবতে গিয়ে তার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল। তার দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে গুহার মেঝেতে পড়ছিল।
   রামা গুহায় ঢুকে স্থির বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তার সঙ্গিনীর দিকে। সব কথাই যে তার কানে পৌঁছেছে তা রামা বুঝতে পারছিল।

   তার কর্তব্য ঠিক শেষ হল কিনা বুঝতে পারছিল না বাঘিরা। মানুষের বাচ্চার কান্না এখন আর তার কানে আসছে না। নেকড়ে-মায়ের কোলে শুয়ে নিশ্চয় সেটা...

   তার কর্তব্য ঠিক শেষ হল কিনা বুঝতে পারছিল না বাঘিরা। মানুষের বাচ্চার কান্না এখন আর তার কানে আসছে না। নেকড়ে-মায়ের কোলে শুয়ে নিশ্চয় সেটা এখন দুধ খাচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ ঝোপের আড়ালে গা-ঢেকে থেকেই নেকড়ের গুহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
   না, উদ্বিগ্ন হবার মত কিছুই আর তার নজরে পড়ল না।
   একসময় ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে লাফ দিয়ে একটা গাছের ডালে উঠে বসল বাঘিরা। নিজের মনেই বলল, থাক এখানেই। মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতে হবে কেমন থাকে।
   গাছে গাছে লাফিয়ে বাঘিরা জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
   নেকড়েরা এমনই জীব যে প্রয়োজন হলে একটা ডিমকে একটুও না ভেঙে অনায়াসে মুখের মধ্যে রাখতে পারে। এমনি সতর্ক আর সাবধানী তারা। মা-নেকড়ে তার চারটে বাচ্চা যেখানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল সেখানে এসে ধামাটা মুখ থেকে নামাল ।
তারপর দুটো চোয়াল দিয়ে শিশুটার পিঠটাকে চেপে ধরল। শিশুটার নরম চামড়ায় দাঁতের একটা আঁচড়ও পড়ল না।
অনায়াসেই শিশুটাকে তুলে এনে নেকড়ে-মা তার বাচ্চাদের একপাশে নামিয়ে রাখল।
   কান্না তখনো চলছে। কিন্তু সেই কান্না কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল যখন নেকড়ে-মা শিশুটার পাশে শুয়ে তাকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াতে আরম্ভ করল ?
   নেকড়ে-মা বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে স্নেহের সুরে বলে উঠল, একটুও ভয় পায়নি। কত ক্ষুদে-কেমন ন্যাংটো আর মাথায় চুল কত কমG
   রামা এসে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে তার বউ এর কথাটা শুনল। বলল, ও যে অন্য বাচ্চাগুলোর খাবারই খাচ্ছে—
   নেকড়ে-মা বলল, পেট-ভরা খিদে নিয়ে এসেছে-আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গেই ও মিলেমিশে থাকবে। দেখ দেখ, এর মধ্যেই কেমন একটা বাচ্চাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে।
   খুঁতখুঁতে রামা বলল, কিন্তু মানুষের বাচ্চাকে এভাবে পালন করা নিয়ে যদি দলে কথা ওঠে—
   নেকড়ে-মা বলল, সে তখন দেখা যাবে। জানতো মানুষ আর তার বাচ্চারা খুব জ্ঞানী হয়। বড় হয়ে এই বাচ্চাটা আমাদের অনেক কাজে আসবে। কোন নেকড়ে মা কি কোন দিন গর্ব করে বলতে পেরেছে যে একটা মানুষের বাচ্চা তার বাচ্চাদের সঙ্গে বড় হয়েছে? আমি সেই কাজটাই করব ।
   নেকড়ে-বাবা এবারে সামনের পা ভেঙ্গে আধাছুবনি পেতে বসে বলল, কিন্তু যে মানুষরা এটাকে এখানে রেখে গেছে তার একদিন ঠিক খুঁজে খুঁজে এসে নিয়ে চলে যাবে।
   দুধ টানতে টানতে মানুষের বাচ্চাটা একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। নেকড়ে-মা নাক দিয়ে ঠেলে ঠেলে তাকে একপাশে কাত করে দিল।পরে বলল, নিয়ে গেলে যাদের বাচ্চা তাদের কাছেই বড় হবে, সে তো ভাল কথা ! সেই দিনটা আসার আগে পর্যন্ত পুঁচকেটা আমার বাচ্চাদের সঙ্গেই থাকবে- খেলবে- তুমি আছ আমি আছি—দুজনে মিলে দেখেশুনে রাখব। এ নিয়ে এত ভাবনা চিন্তার কি আছে ?
   মানুষের ছেলে মোগলি সেই দিন থেকে নেকড়ে মায়ের কাছেই থেকে গেল।
   দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। এক এক করে দশ-দশটা বর্ষ পার হয়ে গেল। মোগলি এখন দশ বছরের বালক। তার বালক হয়ে ওঠার আগেই নেকড়ে বাচ্চারা হয়ে উঠল এক একটি প্রাপ্তবয়স্ক নেকড়ে। মোগলিকে তারা দাদা বলে ডাকে।
   মোগলি তার চার নেকড়ে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, খেলা করে, শিকার ধরে।
   জঙ্গলের অধিবাসীদের জীবনে যতরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সে সবেরই এখন মোকাবিলা করতে শিখেছে মোগলি ।
   নেকড়ে-বাবা সব কিছু তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। চেনা-জানার কাজটা সে জেনেছে কতক নেকড়ে মায়ের কাছেও।
   জঙ্গলে এমন সব শব্দ আছে যা শুনতে এক রকম কিন্তু অর্থটা অন্যরকম।
   কোন শব্দের কি অর্থ সেসব মোগলির আর জানার বাকি নেই।
  ঘাসের প্রতিটি শব্দ, বাতাসের নিঃশ্বাস, মাথার ওপর কাক-শকুন আর পেঁচাদের প্রতিটি ডাক, এমন কি জঙ্গলের জলাশয়ের জলে ছোট মাছের লাফিয়ে পড়ার শব্দ পর্যন্ত-সব কিছুর অর্থ মোগলি শিখে নিয়েছে।


   গত দশ বছর ধরে সে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছে আর একটু একটু করে নেকড়ে-বাবা তাকে সেসব শিখিয়ে দিয়েছে।
   মোগলি যেমন সাঁতার কাটতে পারে, ঠিক ততটাই পারে গাছ বেয়ে উঠতে। একটা গাছের ডাল ধরে সে নাগাড়ে আধাঘণ্টা ঝুলতে পারে। জোড়-কদমে ছুটে চলা হরিণ বাচ্চাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে-এমন কি হোঁৎকা চেহারার নীল রঙের বুনো শুয়োরের পিঠেও সে সওয়ার হতে পারে। মোটকথা মোগলি এখন জঙ্গলের সব রকম দুর্ঘটনা থেকে মোটামুটি নিরাপদ ।
   সাপ, পাখি বা পশু কেউ আর তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
   গাছে চড়া কাজটা কেমন করে করতে হয়, সেটা মোগলিকে দেখিয়ে দিয়েছে কাল প্যান্থার বাঘিরা।
   সব কিছু বুঝবার মত বয়স হবার আগে থেকেই বাঘিরা মোগলির সঙ্গী হয়েছে। সেই প্রথম দিন, বাঘিরা যেদিন ছোট্ট মোগলিকে নেকড়েদের গুহার মুখে রেখে গিয়েছিল, তারপর থেকে মাঝে মাঝেই সে জঙ্গলের পথ ধরে এসে হাজির হত গুহার মুখে ।
   নেকড়ে-বাবা বা নেকড়ে-মার সঙ্গে দেখা হলে সে মোগলির খবরাখবর নিত। কখনো ছোট্ট মোগলিকে তার মোলায়েম থাবার পিঠ দিয়ে আদর করে যেত ।
   মোগলি যখন সারা গায়ে কাদা মেখে টুকরো টুকরো পাথর ছুড়ে খেলা করত তার নেকড়ে ভাইদের সঙ্গে বাঘিরা অনেক দিনই সেই সময় এসে মোগলিকে পিঠে তুলে নিত। জঙ্গলের গলিঘুঁজি ধরে খুশিমত ঘুরে বেড়াত আর গল্প শোনাত ।

সেই সময়ই একদিন গাছে ওঠার কায়দাটা বাঘিরা মোগলিকে শিখিয়ে দিয়েছিল। প্রথম প্রথম মোগলি ভালুকের মতই খুব ধীরে ধীরে গাছে উঠত। বাঘিরার কায়দা রপ্ত করে অল্প ক'দিনের মধ্যেই সে গাছে ওঠায় দড় হয়ে উঠেছে।
   সাহসে ভর করে হনুমানের মতই একডাল থেকে ঝুল খেয়ে আরেকটা ডালে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে শিখেছে।
কেমন করে বোঝা যায় গাছের কোন ডালটা পচা, আর কোন ডালটা শক্ত, কোন গাছে সাপ থাকে, দুপুরবেলা বাদুর ম্যাঙ বিরক্ত করলে তখন তাকে কি বলতে হয়, ঝিলের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে জলচর সাপদের কি বলে সতর্ক করে দিতে হয়—এসবের শিক্ষা জঙ্গলে ঘোরার ফাকে ফাঁকে মোগলিকে শিখিয়ে দিয়েছিল বাঘিরাই।
   আরো একটা মস্ত বিষয় শেখানো হয়েছিল মোগলিকে। জঙ্গলের কোন প্রাণীই বিরক্ত হওয়াটা পছন্দ করে না। কোন আগন্তুককে দেখলেই তারা তাকে তাড়া করে।
   পশুদের প্রত্যেকেরই শিকারের জন্য নিজ নিজ এলাকা ভাগ করা থাকে।
যখনই জঙ্গলের কোন প্রাণী নিজের এলাকার বাইরে শিকার ধরতে যায় তখনই তাকে বারবার শিকারের ডাক ডাকতে হয় যতক্ষণ তার কোন পাল্টা জবাব না আসে।
   আগন্তুককে বলতে হয়, আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে শিকার করতে দাও।
   সেই ডাক শুনে, যার এলাকা তার জবাবটা আসে এই রকম, শিকার ধরতে পার, খাবার জন্য কেবল, মজা করার জন্য নয়।
   আগন্তুক প্রাণীর শিকারের ডাক মোগলি শিখেছিল বাঘিরার কাছে।
নেকড়ে ভাই চারটে মোগলিকে খুবই ভালবাসত। সেই অতটুকুন বয়স থেকে তারা একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে। একসঙ্গে খাওয়া, শোওয়া, খেলাধূলা, শিকার ধরা-সব কিছুতে কোন একজনকে কেউ বাদ দিত না । কেবল নেকড়ে ভাইরাই নয়, নেকড়ে দলের সব বাচ্চারাই মোগলিকে পছন্দ করত। তারা ছিল মোগলির প্রিয় বন্ধু। হুটোপটি দৌড়ঝাঁপ করার সময় জঙ্গলের পথে নেকড়েদের পায়ে অনেক সময় কাঁটা ফুটে যেত। আর ছিল চোর-কাঁটা-এগুলো চামড়ায় লেগে তাদের খুবই কষ্ট ভোগ করাত।
   মেগলি নেকড়েদের এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচাত। সে তাদের পা থেকে কাটা তুলে দিত, গায়ের লোম থেকে চোর-কাঁটা বেছে পরিষ্কার করে দিত।
   মোগলির সবচাইতে ভাল লাগত, বাঘিরার সঙ্গে গভীর বনের মধ্যে গিয়ে সারাটা দিন ঘুরে কাটাতে আর ঘুমোতে আর রাত হলে বাঘিরা কেমন করে শিকার ধরে সেটা দেখতে।
নেকড়ে-মা মোগলিকে বাঘিরার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত। সে জানত, বাঘিরা মোগলিকে ভালবাসে। তার সঙ্গে থাকলে মোগলির কোন বিপদ হবে না।

   এক সময় নিজের মনেই বলে উঠল, আরে! এ তো মানুষের কচি বাচ্চার কান্নার শব্দ। শিশুটা এই জঙ্গলে এলো কী করে?    জঙ্গলের শেষ প্রান্তে ফসলের ক্ষেতে...

   এক সময় নিজের মনেই বলে উঠল, আরে! এ তো মানুষের কচি বাচ্চার কান্নার শব্দ। শিশুটা এই জঙ্গলে এলো কী করে?
   জঙ্গলের শেষ প্রান্তে ফসলের ক্ষেতের ওপারে মানুষের গ্রামেও রীতিমত যাতায়াত আছে বাঘিরার।
   সেই সূত্রে মানুষের চাল-চলন, স্বভাব একেবারে অজানা নয় তার।
   মানুষের গলা থেকে বেরিয়ে আসা অনেক শব্দের সঙ্গেও সে বিলক্ষণ পরিচিত; শিশুর কান্নার শব্দ ভাষাহীন ধ্বনি মাত্র হলেও সেই ধ্বনিতে মিশে থাকে শিশুর মনের অনেক ভাব অনুভব। সেই অনুভবের স্পর্শ কী জানি কি করে দোলা জাগলো কাল প্যান্থার বাঘিরার মনে ।

   কিছুক্ষণ কান পেতে শব্দটা শুনে সে যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ। এ যে খিদের কান্না। এ সময়ে খাবার না পেলে কাঁদতে কাঁদতে যে মারা পড়বে বাচ্চাটা। আহা রে!
   বলতে বলতে চঞ্চল হয়ে উঠল বাধিরার দৃষ্টি।

   পিঠময় নুয়ে থাকা লোমের ওপর খেলে গেল একটা অদ্ভুত ঢেউ। দু’একবার ইতস্ততঃ করে হঠাৎ ঝুপ করে গাছ থেকে মাটিতে লাফিয়ে নেমে পড়ল বাঘিরা।
   হাওয়ায় বার কতক নাক টেনে টেনে কিসের গন্ধ শুকল।
   তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে চলল কান্নার শব্দটাকে অনুসরণ করে।
   বঘিরা যদি জানতে পেত যার দিকে সাগ্রহে কৌতুহল ও সহানুভূতি নিয়ে সে এগিয়ে চলেছে, তার সঙ্গে ভবিষ্যতে তাকে কতটা জড়িয়ে পড়তে হবে তাহলে হয়তো বুনো স্বভাবটাই এসময়ে তার মধ্যে সবার আগে কাজ করত ।
   একে বিদঘুটে শব্দ। তার ওপর সেই শব্দটা মানুষের বাচ্চার গলা থেকে বেরনো।
   এর পর পিঠটান দেওয়াই তো রীতি । 
   দু’-পেয়ে মানুষকে সব জানোয়ারেরই ভয়। তবে বাচ্চাটা মানুষের হলেও শিশু তো বটে। তার দিক থেকে ভয়ের কিছু নেই বুঝতে পেরে আর কান্নাটা যে খিদের তা ধরতে পেরেই নির্ভাবনায় সেদিকে পা বাড়াল বাঘিরা।
   কাছে গিয়ে দেখল, না, আশপাশে কোন বয়স্ক মানুষ নেই। গাছের নিচেই গোড়া ঘেসে একটা ছোট্ট ধামায় ন্যাকড়া জড়ানো শিশুটা শুয়ে হাত-পা ছুড়ছে আর পরিত্রহী চিৎকার করছে।
   ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নার তীক্ষ্ণ শব্দটা যেন বুকে এসে বিঁধতে লাগল বাঘিরার। সে স্থির করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাচ্চাটার দিকে।
   তার মাথায় তখন ভাবনা চলছে-এখুনি মানুষের গ্রামে নিয়ে যেতে না পারলে তো এটাকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু এখান থেকে সব চেয়ে কাছের গ্রামটাও যে কয়েকদিনের পথ। আমি এখন কি করি!
   বনের হিংস্র পণ্ড নিজের অজান্তেই বাঁধা পড়ে গেল মানব শিশুর টানে। বাঘিরা ভেতরে ভেতরে বড়ই অস্থির আর উতলা হয়ে উঠল ।
   সে বুঝতে পারছিল, খিদেয় কাতর শিশুটা শিগগিরই খাবার কিছু না পেলে একেবারেই মারা পড়বে।
   মানুষ অথবা পশু সব শিশুরই খিদের কান্নার ভাষা বুঝি একই। তাই সেই কান্না শুনে আর স্থির থাকতে পারছে না বাঘিরা।
   সে দ্রুত ভাবতে শুরু করল, এই সময় মানুষের গ্রামে একে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করা বৃথা। এখুনি এর খিদে মেটাতে পারে এমন কে আছে আশপাশে-জান চেনার মধ্যে !
   আবার কেবল চেনা-জানা হলেই তো হবে না, তাদের ঘরে বাচ্চা থাকা চাই, যেই বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ খায়।
   মানুষের খোকার এখন ভরপেট দুধ চাই। 
   ভাবতে ভাবতে সহসা খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বঘিরার।
   হ্যাঁ, মনে পড়েছে—কাছেই তার পরিচিত একটা নেকড়ে পরিবার থাকে। কিছুদিন আগেই তাদের ঘরে নতুন বাচ্চাও এসেছে।
   পরিবারের কর্তা রামা-সে হল বাবা-নেকড়ে। কথাটা মনে পড়ার পর আর মূহূর্ত মাত্র দেরি করল না বাঘিরা এগিয়ে গিয়ে ন্যাকড়া জড়ানো ধামার একটা দিক আলতো করে কামড়ে ধরে বাচ্চা শুদ্ধ সেটাকে মাটি থেকে তুলে নিল।
   বাচ্চাটা তখনো গলা-চিড়ে কেঁদে চলেছে।
   ধামাতে নাড়া পড়া মাত্র মূহুর্ত কয়েকের জন্য তার কান্নার বেগ কমে এলো। স্পর্শের আশায় ক্ষণিকের জন্য কান্না থামাল।
   কিন্তু তেমন কোন ছোঁয়া না পেয়ে আবার সে আগের মতই চিৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করল। ঘন ঘন ছোট লাফ দিয়ে ঝোপ-ঝাড় ডিঙিয়ে অদূরে পাহাড়ের একটা ছোট গুহার মুখে এসে দাঁড়াল বাঘিরা।
   এই গুহাতেই থাকে নেকড়ে রামা তার বৌ আর বাচ্চাদের নিয়ে।
   গুহার ভেতরে সরাসরি ঢুকে পড়ল না বাঘিরা। কিংবা হাকড়াকও কিছু করল না।
যেমনি আলতো করে সতর্কভাবে মুখে করে এনেছে বাচ্চার ধামাটা তেমনি সতর্কতার সঙ্গেই সেটাকে গুহার মুখের কাছে মাটিতে নামিয়ে রাখল। বাঘিরা জানে, মায়ের মনের দিক থেকে সকলেই এক ।
   সে মানুষই হোক আর জন্তুই হোক। মায়েদের কাছে সব শিশুই সমান—সে নিজের সন্তানই হোক আর অন্যের সন্তানই হোক।
   যে-কোন মায়ের কাছে যে-কোন শিশুকে রেখেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
   রামার বৌ-মা-নেকড়ের কানে মানুষের বাচ্চাটার খিদের কান্না পৌছলে সে কিছুতেই স্থির থাকতে পারবে না । মায়ের মন কেঁদে উঠবে নিশ্চিত। 
   মা-নেকড়ে ঠিক বাচ্চাটাকে খাওয়াবার ব্যবস্থা করবে।
   শিশুটার কান্নার বিরাম নেই। বড় বেশি খিদে পেয়েছে যে ।
   ধামা নামিয়ে রেখেই দ্রুত পায়ে পিছিয়ে গিয়ে ঝোপের ভেতরে গা-ঢাকা দিল বাঘিরা। কিন্তু চোখ ধরে রাখল গুহার মুখের দিকে। কান রইল সজাগ প্রহরীর মত—অন্য কোন জন্তুর অতর্কিত আবির্ভাবের আশঙ্কায়। বাবা নেকড়ে রামার সম্পর্কে রয়েছে তার খানিকটা শঙ্কা ।
  রামা এমনিতে বড়ই ভাল। কিন্তু বড় খুঁতখুতে স্বভাবের। মানুষের বাচ্চাটাকে দেখে যদি সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়ে!
  মানুষদের তো জঙ্গলের জন্তুর বন্ধু ভাববার সুযোগ পায় না বড় একটা। তাই মনে থাকে তাদের ভয় আর সন্দেহ।
শত্রু ভেবে বাচ্চাটাকে আঁচড়ে কামড়ে দেয়া রামার পক্ষে অসম্ভব তো নয়।
   তাই বাচ্চাটাকে ঠিক জায়গায় এনে ফেলতে পেরেছে জেনেও বঘিরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কান সজাগ করে ঘাড় উঁচিয়ে ঝোপের পাতার ফাঁকে মাথা জাগিয়ে গুহার মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
   কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটল ঘটনাটা। রামা হঠাৎ ব্যস্তভাবে ছুটে এলো গুহার বাইরে। ধামাটার কাছ বরাবর এসে থমকে দাঁড়িয়ে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
   তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ধামার গায়ে নাক ঠেকিয়ে শুকে শুকে দেখতে লাগল। একরকম প্রায় পেছন পেছনই এসে জুটল রামার বউ-মা-নেকড়ে।

   কেঁদে কেঁদে বাচ্চাটা নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।তাই তার কান্নায় আগের মত জোরালো ভাবটা এখন অনেকটাই কম। কিন্তু কান্নার বিরাম নেই। 
   মা-নেকড়ে সোজা গিয়ে দাঁড়াল ধামাটার একপাশে ।
   রামার দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বলল, তোমার এখানে কি? মানুষের খোকা এ তো দেখেই চিনতে পারছ, তার আবার অত শোকাশুকির কি আছে ?
   রামা থতমত খেয়ে অপরাধী অপরাধী মুখ করে দু'পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, না-মানে এই তো —দেখছিলাম আর কি
   বেশ করেছ, এবারে নিজের কাজে যাও। অমন কচি বাচ্চা--আহা, কেঁদে কেঁদে গলা শুকিয়ে গেল--

   বলে মা-নেকড়ে নাক বাড়িয়ে বাচ্চাটার গায়ের গন্ধ শুকল দু'বার। তারপর বিশেষ কিছু ভাবনা চিন্তা করল না ধামাটার একমাথা কামড়ে ধরে তুলে নিয়ে চলে গেল গুহার ভেতরে।
   রামা হতভম্বের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সে-ও একসময় গুটি গুটি পায়ে গুহায় গিয়ে ঢুকল।
   বাঘিরা আড়ালে দাঁড়িয়ে সবই দেখতে পেল। এবারে এতক্ষণ বাদে তার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
   যাক, মানুষের বাচ্চাটার একটা হিল্লে তো করা গেল। খিদেয় আর কষ্ট পাবে না--অযত্ন অবহেলায় অসহায় ভাবে জঙ্গলে পড়ে থেকে তাকে মরতে হবে না ।

   ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বন জঙ্গল থেকে উঠে আসা কত আশ্চর্য কাহিনীই না শোনা যায় লোকের মুখে । কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় সব...

   ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বন জঙ্গল থেকে উঠে আসা কত আশ্চর্য কাহিনীই না শোনা যায় লোকের মুখে । কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় সব কাহিনীর সেরা হল নেকড়ে-বালক মোগলির কাহিনী।
   ভারতের উত্তর প্রান্তে ছোট পাহাড় ঘেরা এক জঙ্গলের জগতে এখনো ছড়িয়ে আছে মোগলির বন্ধুরা।
   হয়তো এখনো তারা নিজেদের প্রতিদিনের শিকারের অবসরে মোগলির কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

   ঘন গাছপালা আর পাতা-লতা ঘেরা এই বিস্ময়কর জঙ্গলে । 
   জানা অজানা অসংখ্য বন্যপ্রাণীর বাস । 
   এদের কেউ সবল, কেউ দুর্বল । 
   কেউ হিংশ্র, কেউ নিরীহ । 
   কারুর খাদ্য মাংস—তারা আমিষাশী ; কেউ খায় ঘাস, লতা-পাতা তারা শাকাশী।
   এমনি বিচিত্র সব প্রাণীর বাস এই জঙ্গলের রাজ্যে ।
   যেমনি বিচিত্র তাদের জীবনযাত্রা তেমনি অদ্ভুত তাদের জীবনের ঘটনা।
   রহস্য আর রোমাঞ্চ ঘেরা জঙ্গলের পশুরাজ্যে কত বিস্ময়কর ঘটনাই না ঘটে। সব ঘটনার খবর মানুষের জগতে সব সময় কী আর পৌছয় ।
   কখনো-সখনো দু’একটি ঘটনার  কথা জঙ্গলের সীমানা অতিক্রম করে মানুষের গাঁয়ে গিয়ে পৌছয় যখন, তখন বিস্ময় ও কৌতুহলের আলোড়ন ওঠে।
   অরণ্য-শিশু মোগলির ঘটনা জানাজানি হবার পর এমনি আলোড়ন পড়েছিল অরণ্যপ্রান্তের চাষীবাসি মানুষদের গ্রামে।
   সেখান থেকে ক্রমে শহরে গঞ্জে । 
   সে-কাহিনীই এখন তোমাদের শোনাব।

   মোগলি মানুষের ছেলে। 
   কিন্তু শিশু বয়স থেকে তাকে মানুষ করেছিল এক নেকড়ে-মা।
   নেকড়ে-মা আর নেকড়ে-বাবার সঙ্গে সে তাদের পাহাড়ি গুহাতেই বড় হয়ে উঠেছিল।
   নেকড়ে মা-ই আদর করে তার নাম দিয়েছিল মোগলি।
   নেকড়েদের ভাষায় মোগলি কথার কী যে মানে তা কারুর জানা নেই ;
   মোগলি নিজেও হয়তো জানত না। তবু ওই নামেই সে তার পরিচয় দিত।
   এবারে শোন মোগলির জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনী।

  আকাশ-উঁচু গাছপালা আর তাদের পত্র-পল্লবের তলদেশে, ঘন ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে আবড়ালে, শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ তুলে, কখনো বা নিতান্তই নিঃশব্দে বিচরণ করে অরণ্যবাসী জন্তু-জানোয়ার।
   অরণ্যই তাদের আবাসভূমি । 
   অরণ্যই তাদের পৃথিবী। 
   এই পৃথিবীর দুটি স্তর। একটি মাটির কোল ঘেসে-তাকে বলে প্রথম তল ।
   আর দ্বিতীয় তল হল গাছের ওপরের শাখাপ্রশাখার জগৎ।
   বানর আর হনুমানদের পাশাপাশি এই দ্বিতলে বসবাস করে পক্ষীকুল।
   পুরোপুরি বসবাস না করলেও দ্বিতলে মাঝে মাঝে বিচরণ করে আরো কিছু প্রাণী।
   এদেরই মধ্যে একজন হল বধিরা। বঘিরা হল বাঘেদেরই নিকট আত্মীয় হিংস্র জানোয়ার প্যান্থার (চিতাবাঘ)।
 দেখতে-শুনতে বাধেরই মত—বাঘের সমাজেই এর গণ্য।
   তবে বঘিরার গায়ের রং কিন্তু হলুদ নয় ডোরাকাটা বা ফুটকাটাও নয়।
   বঘিরা ছিল মিশমিশে কাল রঙের এক প্যান্থার। সে বুনো মোষের মত সাহসী আর আহত হাতির মত বেপরোয়। তার দেহটা হাল্কা শক্তসমর্থ ও ভয়ঙ্কর। তার গায়ের চামড়া ছিল লোমের মত নরম ।
   বধিরা ছিল এমনই সজাগ আর চতুর যে তার চোখ ও কান সর্বত্র খোলা থাকত। বনের পথ ধরে সে যখন চলত, শুকনো পাতায়ও তার পায়ের শব্দ উঠত না। আর চোখের পলকে সে যখন-তখন মাটি ছেড়ে অবলীলায় গাছের ডালে চড়ে বসতে পারত।
   নিঃশব্দ কিন্তু নিৰ্ভীক ছিল বাঘিরার চলাফেরা। জঙ্গলের কাউকে তোয়াক্কা করে না সে। তার বেপরোয়া স্বভাব আর হিংস্রতার খবর রাখে না এমন প্রাণী জঙ্গলে একটিও নেই!
   তাই দায়ে না পড়লে তার কাছ ঘেঁসত না কোন জন্তু।
   তবে জঙ্গলের প্রাণীদেরও তো একটা সমাজ থাকে। সেই সমাজের সভাসমিতিতে, আলাপ-আলোচনার সময়কালে হিংস্র নিরীহ, ঘাস-খেকো, মাংস-খেকো সব প্রাণীই মেনে চলে জঙ্গলের অলিখিত নিয়ম।
   নিজেরাই নিয়ম করে সেই নিয়ম ভেঙে অনিয়মকেই নিয়ম করে নিতে অভ্যস্ত কেবল দু পেয়ে মানুষের সমাজ ।
   বাঘিরা নিজে যতই বেপরোয়া আর বুদ্ধিমান হোক না কেন, সে ভুল করেও কখনো জঙ্গলের নিয়ম ভঙ্গ করত না।
   সময়টা তখন বসন্তকাল । গাছে গাছে নতুন কচিপাতা আর রঙবাহারি ফুলের সমারোহ।
  হাওয়ার গায়ে চনমনে ভাব-পাখিদের গলায় নতুন সুরের গান—পশুদের মনে ফুর্তির জোয়ার। বনে জঙ্গলে সর্বত্রই একটা খোলামেলা ভাব। এমনি দিনে বাঘিরাও খোলামেলা মন নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিল জঙ্গলের এক প্রান্তে।
   কখনো মাটিতে, কখনো বা গাছের ডালে-জঙ্গলের দ্বিতীয় তল যাকে বলে।
   আপন খেয়ালে চলেছে বধিরা। এমনি সময়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত বিদঘুটে শব্দ তার সজাগ কানে এসে লাগল।
শব্দটা আসছিল একটা উঁচু গাছের গোড়া-ঘেঁসা ঝোপের ধার থেকে।
   —ওঁয়া—ওঁয়া—ওঁ—ওঁ—আ-- 
  কান খাড়া করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাঘিরা। শব্দটা চিনতে কিন্তু সময় লাগল না তার। চমকে উঠে গাছের ওপরতলা থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে ঝোপটার দিকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলল।