সেদিন চলের কুখ্যাত দস্যুসর্দার যাকে ধরার জন্যে পাঁচ বছর ধরে সারা ভারত তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে যত গোয়েন্দা ও পুলিশবাহিনী, যার মস্তকের মূল্য সরকার থেকে ঘোষিত হয়ে বাড়তে বাড়তে ক্রমশ পঞ্চাশ হাজারে উঠেছিল, হঠাৎ সে ধরা পড়েছে আমাদের এই কলকাতায় মানিকতলার এক বস্তির কুঁড়ে ঘরে, সকালবেলা খাটিয়ায় বসে স্ত্রী ও শিশু পুত্রকন্যার সঙ্গে যখন আলাপরত—সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে পরদিন এ খবরটা পড়ে সর্বপ্রথম যার কথাটা মনে হলো তার নাম কোথাও খুঁজে না পেয়ে বিস্মিত হলুম।
সারা ভারতের ত্রাস-স্বরূপ। যেই দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ, নিষ্ঠুর জল্লাদকে ধরলে, সে দুঃসাহসিক বীরপুরুষটি সে কে? কি নাম তার? কেন বড় বড় হরফে ছাপা হয় নি তার কথা? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পঞ্চাশ বছর আগে, আমার শৈশবে ফিরে যাই। মনে পড়ে গেল, যখন মায়ের কোলে দুধ খেতে চাইতুম না, মা ভাত খাওয়াতে গেলে পেট ভরে গেছে, আর খাব না বললে, সাধারণত মায়েরা যেমন জুজুর ভয় দেখিয়ে বা ভূত পেতনী বেহ্মদৈত্যের কথা ভয়ার্তকণ্ঠে বলে, শিগগির খেয়ে নাও, নইলে এক্ষুনি ডাকবো জুজুকে’—‘এই জুজু আয় তো’ কিংবা আয়তো ভূত, খোকাকে নিয়ে যা তো, খোকা খেতে চাইছে না বলে ভয় দেখিয়ে খাওয়ায়। আমার মাকে কিন্তু ওসব বলতে শুনিনি খাব না’ বলে মুখ ঘোরালে তিনি চোখ দুটো বড় বড় করে বলতেন, ওই রামলাল ডাকাত আসছে, শিগগির খেয়ে নাও!” ব্যস আর দ্বিতীয়বার বলতে হতো না, ভয়ে সারা দেহ কাটা হয়ে উঠত এবং নিমিষে খাদ্যবস্তুও যথাস্থানে প্রস্থান করত। ভূতপ্রেতের চেয়ে ওই রামলাল ডাকাতকে কেবল শিশুরা নয়, তাদের মা বাবা এমনকি গায়ের বৃদ্ধবৃদ্ধারা পর্যন্ত সে নাম শুনলে যেন আতঙ্কে শিউরে উঠতেন। যখন ছোট ছিলুম, কিছু বুঝতাম না। শুধু ওই নামটা শুনলেই বুকের মধ্যেটা দুরদুর করে কাঁপত। ভূত-প্রেত, শাকচুনীর চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর মনে হতো। বড় হতে দেখি ওই রামলাল ডাকাতের ভয়টা কেবল আমাদের নয়, গ্রামের আবালবৃদ্ধবণিতা, সবাইয়ের কাছে সে একটা দারুণ আতঙ্ক। সাক্ষাৎ মৃত্যুস্বরূপ। দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিল এই রামলাল। তার নামে নাকি বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়’; এমনি কথা লোকের মুখে মুখে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। খুন, রাহাজানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে লুটপাট করতে তার জুড়ি ছিল না। .
তখন বৃটিশ আমল। ইংরেজের রক্তচক্ষুকে সে থোড়াই কেয়ার করত। পুলিশ অফিসাররা পর্যন্ত তার ভয়ে কাঁপত। কখন কোথা থেকে, কোন ছদ্মপেশে কার কাচামাথাটা দেহ থেকে ছিড়ে নেবে কেউ জানত না।
সত্যমিথ্যায় মিলিয়ে অসম্ভব-অসম্ভব কত যে কাহিনী কত লোকের মুখে শুনেছি তার ঠিক নেই।
মা, বাবা, ঠাকুমা এবং গাঁয়ের কত লোককে জিজ্ঞেস করেছি কী রকম তাকে দেখতে, কেমন চেহারা?
কিন্তু কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারে নি। কেউ বলে, ইয়া লম্বা চওড়া বিরাট দৈত্যের মতো দেখতে। কেউ বা বলে অন্যরকম। মোট কথা একজনের সঙ্গে আর একজনের বর্ণনার মিল কখনই হয় না। কল্পনার রং লাগিয়ে ভয়ঙ্করকে ভয়ঙ্করতর করে তুলত তারা।
গোরা পুলিশ সারা গাঁকে ঘিরে ফেলে প্রত্যেকটি ঘরে অনুসন্ধান করেও নাকি ধরতে পারে না। তাদের চোখের সামনে দিয়ে কখনও বুড়ি ভিখিরীর বেশে, লাঠিতে ভর দিয়ে কোমর ভেঙে ভিক্ষে করতে করতে পালিয়ে যায়। কখনো বা পুলিশেরই ছদ্মবেশে লাল পাগড়ি এটে, ঠিক ওদেরই মতো পোশাক পরে অনুসন্ধানকারীদের দলে ভিড়ে গিয়ে রাত্রের অন্ধকারে, বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরে পড়ে। একধিকবার হত্যার অভিযোগে রামলালের মাথার জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়েছিল, তখন হঠাৎ একদিন সারা গাঁয়ের লোক আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল।
রামলাল ডাকাত নাকি ধরা পড়েছে। তার বিচার হবে ডায়মণ্ডহারবার কোর্টে আগামী সোমবার।
পাঁচ-সাতখানা গায়ের ছেলেবুড়ো ছুটল আদালতে। বিচারে যে তার ফাঁসি হবে এটা সবাই জানত। কিন্তু তবু যে সবাই ছুটছিল তার ওই একটাই কারণ। সাতখানা গায়ের আতঙ্ক যে মানুষটা, বৃটিশ সরকারের সুদক্ষ গোয়েন্দা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন খুন, জখম, হত্যা, লুঠতরাজ ইচ্ছামত চালিয়েছে, তাকে দেখতে কেমন এটাই ছিল সকলের কৌতুহল।
বলাবাহুল্য, আমিও সেই কৌতুহল বুকে নিয়ে বাবার সঙ্গে ভোরে উঠে, দুক্রোশ পথ হেঁটে আদালতে ঢুকে দর্শকের আসনে আগে ভাগে স্থান নিয়েছিলাম।
যথা সময়ে আদালতের কাজ শুরু হলো! দুহাতে হাত কড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে রামলালকে নিয়ে এসে রিভলবারধারী পুলিশের দল যখন কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলে, তখন বিস্ময়ে আমি হতভম্ব!
এই রামলাল! বৃটিশ সরকারের ত্রাস! মাখোয়া গায়ের মানুষের ঘুম কেড়ে নেওয়া আতঙ্ক! এই ছোট্ট, বেঁটে-খাটো, ফুট পাঁচেকের মতো এক রোগা খিড়খিড়ে মানুষটার ভেতরে এত বিক্রম, এত দুর্জয় সাহস! বয়েস কত হবে— বড়জোর চল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু দেখলে, মনে হয় আরো কম। লৌহ আকর দিয়ে তৈরি কঠিন চেহারা, ছোট ছোট চোখ দুটোর মধ্যে যেন আগ্নেয়গিরির জ্বালা!
সওয়াল শেষ হলে হাকিম যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন—তুমি আইনের চোখে যে অপরাধ করেছ, তাতে তোমার শাস্তি প্রাণদণ্ড। এখন যদি তোমার কিছু বলার থাকে বলতে পার?
রামলাল তেজদৃপ্ত কণ্ঠে বললে—হুজুর, আমার এই শাস্তির বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই। তবে ওই যে লোকটি আমাকে ধরেছে বলে দাবি জানাচ্ছে সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা!
যেন আদালত ঘরটা হঠাৎ চমকে উঠল। হাকিম তাঁর চশমার ভেতর দিয়ে বড় বড় চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—সেকী! আরও যারা সাক্ষী এখানে রয়েছেন তারাও দেখেছেন, ওই লোকটি ধরেছে। ওর ঘরে তুমি সেদিন গভীর রাত্রে ঢুকেছিলে চুরি করতে, ওর পাশে শুয়ে ঘুমচ্ছিল ওর স্ত্রী আর স্ত্রীর বুকের কাছে ছিল ওই শিশু পুত্রটি। ওইতো তোমার সামনে, এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা সকলে। সেই লোক, তার স্ত্রী, আর তার কোলের বাচ্চাটি।
ঘোরটা ফিরতেই হঠাৎ রামলালের চোখদুটো যেন জড়িয়ে গেল সেই শিশুটির মুখের ওপর। কিছুক্ষণ মুখ দিয়ে আর কথা সরে না। তারপর বললে— হুজুর মৃত্যুর আগে, ভগবানের নামে দিব্যি করে সত্যি বলব, শপথ নিয়েও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আপনার সামনে মিথ্যে বলব না। আমাকে ধরেছে, ওই শিশুটি।
—সেকি? হাকিম প্রশ্ন করেন।
—হ্যা হুজুর, সত্যি বলছি। ওই শিশুটি তখন ওর মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল আর তখন ছোট্ট জানালাটা দিয়ে এক ঝলক চাঁদের আলো এসে পড়েছিল ওদের মুখে। এমন স্বর্গীয় দৃশ্য আমি জীবনে কখনও দেখি নি। তাই তাকিয়েছিলাম ওর মুখের দিকে। কোমর থেকে ছুরিটা বার করতে ভুলে গিয়েছিলাম, কেন বলতে পারব না। ঠিক সেই অবসরে কে আমায় পিছন থেকে জাপটে ধরে ফেলেছিল। মনে নেই। নইলে ও কেন, ওর বাবা, তার বাবার সাধ্য ছিল না, আমায় ধরে।
সহসা বিস্মৃতির পর্দা ছিড়ে দীর্ঘকাল পরে, রামলালের ওই কথাটা আমার মনে পড়ে গেল। চম্বলের দস্যুকে কে ধরেছে। স্ত্রী-পুত্র কন্যার সঙ্গে মিলিত গার্হস্থ্যজীবনের সেই ক্ষণিক সুখের ছবি, না কোনো মানুষ?
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances