Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

এক সময় বড় একটি শহরের উপকন্ঠে এক তরুণ বাস করত । গরিব মা ছাড়া তার সংসারে আর কেউ ছিল না। এই বয়সেও সে রয়ে গেল একরকম দুর্বল মনের এবং কোনো কিছু...

বোকা তরুণের কাণ্ড-- তিব্বতের লোককাহিনী

এক সময় বড় একটি শহরের উপকন্ঠে এক তরুণ বাস করত । গরিব মা ছাড়া তার সংসারে আর কেউ ছিল না। এই বয়সেও সে রয়ে গেল একরকম দুর্বল মনের এবং কোনো কিছু করতে গেলে আধখানা করার পর সব ভণ্ডুল করে দিত। অথবা পুরো কাজটি করতে পারলেও তার ভাগ্যে জুটত সামান্য খুদ কুঁড়ো। তার স্বভাবের দোষেই এরকম হত। এজন্য পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা তাকে উদ্ভট উদ্ভট কাহিনী বলে বিভ্রান্ত করে দিত বা বোকা বানিয়ে ছাড়ত। 
সেই বোকা-বকাই তরুণের জীবনে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। সেদিন সে গ্রামের পাশের বিশাল তৃণপ্রান্তরে ঘুরতে গেল। সেখানে ফুটে আছে যত হলুদ চন্দ্রমল্লিকা, সাদা ও লাল ডালিয়া। ওদিকে গোলাপ ও গন্ধরাজ। সে ফুলগাছের পাশে গিয়ে বসল। সুগন্ধি ফুল তুলে পাশে রাখছে আর কখনো কখনো গন্ধ শুকে দেখছে।
এমন সময় এক যুবক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে ডাক দিয়ে বলল, কী হে, এখানে বসে বসে কি করছ? তোমার তো দেখি পায়ের পাতা হলুদ হয়ে গেছে। তার অর্থ তুমি আর বাঁচবে না, তুমি মরতে বসেছ।’-এই বলে সে চলে গেল । 

এই গরিব তরুণ, বোকাপ্রায় লোকটি মৃত্যুর কথা শুনে খুব ভয় পেল। সে তখন পায়ের পাতাগুলো ভালো করে দেখতে লাগল। পাশে লাল-হলুদ ফুল থাকার কারণেই হোক অথবা সরল বিশ্বাসের জন্যই হোক সে সত্যিই তার পায়ের পাতার রঙ হলুদ হয়ে গেছে দেখতে পেল । আমনি সে মনে মনে বলতে লাগল, মরবই যদি তাহলে কবরটা খুঁড়ে রাখি। আমার মা তো বুড়ো মানুয, তার চেয়ে নিজেই কাজটা সেরে রাখি ।


তারপর সে চারদিক দেখে-শুনে ভিজে স্যাতসেতে নরম জায়গায় শরীরের সমান লম্বা ও সরু একটা কবর খুঁড়ে সেখানে শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল । 

কিছুক্ষণ পরে রাজার এক খানসামা সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল । তার হাতে ছিল একটা বড় মাটির জালা। সেই জালাটি ছিল তেলে ভর্তি। রাজার রান্নার তেল । সে কবরে শুয়ে থাকা তরুণকে দেখে দাড়িয়ে পড়ল। বলল, কী হে, তুমি অমন সরু একটা কবরের মতো গর্তে শুয়ে আছ কেন? 

‘আমার পায়ের পাতা হলদে হয়ে গেছে। তুমি তো জানো ভাই, এটা নিৰ্ঘাত মৃত্যুর লক্ষণ। আমি মরতে বসেছি। সেজন্য নিজের হাতে নরম মাটিতে কবর খুঁড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছি। রাজার খানসামা বলে উঠল, “বোকার হদ আর কাকে বলে! তুমি যদি মরতে বসতে তাহলে এভাবে কথাই বলতে পারতে না। ওঠো তো দেখি! চলো আমার সঙ্গে ।

 আমার এই জালাটি বয়ে নিতে সাহায্য করো। এতে রাজার রান্নার জন্য তেল আছে। এটা নিয়ে গেলে তোমাকে একটা মুরগি দেব।’ 

বোকা তরুণ ওর কথায় মৃত্যুর ভয় থেকে রেহাই পেয়ে উঠে দাঁড়াল । যেতে যেতে সে ভাবতে লাগল মুরগিটি পেলে সে কী করবে। সে ভাবল, মুরগিটি একদিন ডিম দেবে। অনেকগুলো ডিম হলে মুরগিকে ডিমগুলোতে তা দিতে বসিয়ে দেব। তারপর একদিন বাচ্চা ফুটবে। বাচ্চাগুলো বড় হবে। সেগুলো তারপর হাটে নিয়ে বিক্রি করে একটা গাই কিনব । গাই থেকে হবে বাচ্চা। বাচ্চাটা বড় হলে দুটিই বেচে দিয়ে একখানা সুন্দর ঘর বাধবো। ঘর হলে করব বিয়ে। তারপর আমাদের একটি ছেলে হবে। ছেলেটি বড় হলে তাকে স্কুলে দেব। আমি তাকে খুব ভালো শিক্ষা দেব। আমার ছেলে যদি ভালোভাবে লেখাপড়া শেখে তাহলে তাকে খুব আদর করব। ভালোবাসব। আর সে যদি দুষ্ট হয়, আমার কথা না শোনে তাহলে তাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেব। এইভাবে... ।'

 বলেই সে এমন জোরে একটি লাথি ছুড়ে মারল যে টাল সামলাতে না পেরে নিজেই পড়ে গেল এবং পিঠের তেলের জালা পড়ে গিয়ে খান খান হয়ে গেল। তাই না দেখে রাজার খানসামা তো রেগে আগুন সে বলল, “এই বোকার হদ বোকা, তুই কী এমন দেখেছিস যে এত বড় লাথি ছুড়ে মারলি? এখন দেখ, তেলের জালা ভেঙে টুকরো টুকরো। রাজা তোকে এবার শূলে চড়াবে ।"


বোকা তরুণ সত্যি কথাটা বলে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু রাজার খানসামা সে কথা শুনতে নারাজ। সে তাকে টেনে-হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে চলল । 

রাজার কাছে পৌছতেই রাজা বললেন, ‘খানসামা, কী ব্যাপার, ওকে তুমি এভাবে নিয়ে আসছ কেন ।" খানসামা তখন তেলের জালা ভেঙে টুকরো টুকরো করার কাহিনী তার মতো করে রাজাকে বলল। রাজা তখন বোকা তরুণকে সমস্ত ঘটনা নিৰ্ভয়ে খুলে বলতে আদেশ দিলেন। 

বোকা তরুণ তখন বলল, মহারাজ, আপনার খানসামা আমাকে এই তেলের পাত্র বয়ে আনলে একটা মুরগি দেবে বলে কড়ার করে। তখন আমার মনে স্বাভাবিকভাবে ভাবনা আসে যে মুরগিটা পেলে আমি কী করব! আমি তখন ঠিক করলাম যে মুরগির অনেকগুলো ছানা হলে সেগুলো বেচে একটা গাই কিনব। সেই গাইয়ের বাচ্চা হবে, বাচ্চা বড় হবে। তখন দুটিকে বেচে দিয়ে আমি একখানা সুন্দর ছোট ঘর বাধব। ঘর বেঁধে বিয়ে করব, বাচ্চা হবে এবং সেই বাচ্চাকে যথাযথ শিক্ষা দেব। কিন্তু সে যদি তারপর অবাধ্য হয় তখন তাকে কী করে লাথি মারব তা পরখ করতে গিয়েই এই বিপত্তি, কিন্তু আমার ভাবনা মোটেই তুচ্ছ ব্যাপার নয় মহারাজ। আমার অবাধ্য ছেলেকে আমি শিক্ষা দেব না।’ 

এরকম হাস্যকর মজার-কাহিনী শুনে রাজা খুব আনন্দ পেলেন এবং তিনি প্রাণভরে হো হো করে হেসে উঠলেন। তিনি তখন বোকা তরুণকে এক টুকরো সোনা দিয়ে বললেন, যাও, তোমার মায়ের কাছে চলে যাও তুমি । বোকা তরুণ এবার ঘরে ছুটল। ঘরের দরজার সামনে এসেই সে দেখল একটা অচেনা কুকুর মুখে একটা বটুয়া নিয়ে চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছে। বটুয়ার ভেতরে দেখা যাচ্ছে টাকার বাণ্ডিল। দেখে সে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে মাকে ডাকতে লাগল, মা-মা, তোমার টাকার বটুয়া নিয়ে একটা কুকুর পালাচ্ছে।’

 মা বেরিয়ে এসে ভাবল ছেলেটা তো বোকার হদ । তার টাকা টাকা চেচামেচিতে পড়শীরা জেনে যাবে তার টাকার কথা। এত লোকজন তাড়া করে কুকুর থেকে টাকা কেড়ে নিয়ে নিজের বলে দাবি করে আর দিতে চাইবে না তাকে । মা ছিল তখন ঘরের ছাদের উপরে। সে বুদ্ধি করে ছাদের উপর মিছরি ছড়িয়ে দিয়ে ছেলেকে ডাকতে লাগল। 

মায়ের বোকা ছেলেটি ছিল চিনি ও মিছরির ভীষণ ভক্ত। মিছরির কথায়  সে কুকুরের কথা ভুলে গিয়ে ঘরের ছাদে উঠে গেল । 
মা তখন বলল, বাছারে, কী অবাক কাণ্ড দেখ, আজ আমাদের ছাদে চিনি ও মিছরির বৃষ্টি হয়েছে। তুই এগুলো তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নে '
 ব্যাস্, ছেলে একেবারে কুপোকাত। চিনি ও মিছরির দানা সে একটি একটি করে কুড়োতে লাগল। দু'এক টুকরো মুখেও পুরে দিতে লাগল। এদিকে মা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কুকুরটার পিছু নিয়ে তাকে খুঁজে পেল এবং টাকার বটুয়া উদ্ধার করে আনল। সবকিছু ভালোয় ভালোয় উৎরে গেল ।

কিছুদিন পর মা তার ছেলের বিয়ে ঠিক করল এক ধনীর মেয়ের সঙ্গে । কন্যাপক্ষ জানত না যে ছেলেটি বোকা-বকাই।
তিব্বতের রীতি অনুযায়ী বিয়ে করে ছেলেকে বউয়ের সঙ্গে শ্বশুর-বাড়িতে থাকতে হয়। এভাবে সে শ্বশুরবাড়ির সদস্য হয়ে যায়। বিয়ের সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেলে কনের বাড়ি থেকে ঘোড়া এল বরকে নিয়ে যেতে। 

তরুণ বর সেরা পোশাক পরে নিল, মাথায় বাধল পাগড়ি। কনে বাড়ির সকলের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে সবাই যাত্রা শুরু করল । বর বলল, “তোমরা সবাই আগে আগে যাও, আমি থাকব সবার শেষে।” মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের আদরের ছেলে চলল বিয়ে করতে ।

বিকেলের দিকেই বরযাত্রী বের হয়েছিল। আস্তে আস্তে সন্ধে নামল, আকাশে উঠল চাঁদ। সবার পেছনে একা চলছে বর। তার মনে কত কল্পনা, কত স্বপ্ন। এমন সময় চাঁদের আলোয় সে দেখল তার পিছে পিছে ছায়া আসছে। সে ভেবে পেল না তার সঙ্গে কে আসছে। সবাই তো তার আগে আগে চলে গেছে। সে ভাবল রাতের বেলায় ভূত ছাড়া কে তার পিছু নেবে এভাবে। ভূতটা তার ক্ষতি করতে পারে, এমনকি তার বিয়েও পণ্ড করে দিতে পারে বলে ভাবল । 

সে তখন জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। তখন দেখে কি ছায়াও তার সঙ্গে সমান তালে ছুটে চলেছে। সে ভাবল, না এভাবে তো ভূতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। তখন সে ভূতকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য তার পাগড়ি খুলে তার উপর ছুড়ে মারল। এতেও কোনো ফল হলো না। সে তার কোট ছুড়ে মারল। একে একে সমস্ত পোশাক খুলে ভূতকে আক্রমণ করল। না, কিছুতেই তাকে ভয় পাইয়ে দিয়ে নিরস্ত করতে পারল না, ভূত আগের মতো তাকে অনুসরণ করে চলল। তখন সে হঠাৎ ঘোড়া থামিয়ে তার থেকে নেমে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে মস্ত বড় এক পপলার গাছের ছায়ায় না পোঁছা পর্যন্ত ছায়া তাকে ছাড়ল না। 

এবার সে নিশ্বাস নিয়ে বাঁচল । খুশিতে তার মন ভরে উঠল। ভূত তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু পপলার গাছের ছায়া থেকে উকি মেরে যেই বাইরে যায় আমনি সে ছায়া দেখতে পায়। গাছের এদিকে, ওদিকে, চারদিকে গিয়ে দেখে একই অবস্থা। তখন সে ভাবল গাছতলায় থাকাই তার জন্য নিরাপদ । 

এই ভেবে সে গাছে উঠে আগার বড় একটা ডালে আয়েশ করে শুয়ে পড়ল । বড় ধকল গেছে এতক্ষণ ধরে। তার জন্য এই ভালো । একটু পরেই সেই পথ দিয়ে আসার সময় কয়েকজন লোক মূল্যবান পোশাক ও অলঙ্কার পড়ে থাকতে দেখে কুড়িয়ে নিল। একটু এগিয়ে এসে দেখতে পেল একটা ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে। তারা ঘোড়াটিও নিল । শেষে তারা পপলার গাছের নিচে এসে সব জিনিস রেখে ভাগ করতে বসল। 

ঠিক তখনই বোকা তরুণ বরটি জেগে উঠল। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা তার জিনিসগুলো ভাগাভাগি করতে বসেছে। আমনি সে উপর থেকে বলে উঠল, আমার ভাগটিও যেন থাকে। গাছের মাথা থেকে আচমকা কারো ভাগ চেয়ে বসাতে তারা ভাবল, ওখানে নিশ্চয়ই দৈত্য আছে। সে তার ভাগ দাবি করছে । আমনি তারা দ্বিতীয়বার না ভেবে সব ফেলে ভো দৌড় । 

তখন সে গাছ থেকে নামল । তার কাপড়-চোপড় পরে নিল। চড়ে বসল ঘোড়ার পিঠে এবং শ্বশুরবাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করল। এদিকে বর কেন এত দেরি করছে ভেবে কনে পক্ষের লোকজন তাকে খুঁজতে শুরু করে দিল । তারা ঘোড়া ছুটিয়ে এসে বরকে পথের মাঝে পেয়ে সঙ্গে নিয়ে চলল। 

কনের মা ও বাবা এসে বরকে বরণ করে নিল। তারা খোজ খবর নিল কেন তার এত দেরি হল ইত্যাদি। তার চেয়ে বড় কথা ওদিকে আত্মীয়-স্বজনেরা ভোজের অপেক্ষায় বসে আছে, বর-কনেকে আশীৰ্বাদ করবে। বিয়েবাড়ি বলে কথা, কত কাজ, কত আচার-অনুষ্ঠান। বিয়ে হয়ে গেল। আমনি শুরু হল ভোজ । 

ভোজ খেতে শুরু করে বোকা বরের মায়ের কথা মনে পড়ল। এমন ভালো ভালো খাবার তার মা কতদিন খায় না। ছেলের বিয়েতেও খেতে পারবে না তাই বলে? তখন সে ভোজের টেবিল থেকে একটা তামার ছোট সরু মুখ পাত্র সবার অগোচরে পোশাকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। তারপর নিজে খেতে খেতে ভালো ভালো খাবার থেকে কিছু কিছু নিয়ে তামার পাত্রে ভরতে লাগল। সবাই বিয়ের হৈ চৈ আর ভোজে মত্ত। অঢেল খাবার ও পানীয়। কত যে নতুন নতুন মিষ্টি আর পিঠে তার লেখাজোখা নেই। একসময় একটা পিঠে তামার পাত্রে ঢোকাতে গিয়ে বোকা বরের হাত গেল আটকে । আর তো সে হাত খুলতে পারে না । এদিকে অতিথিরা জানতে পারলে হাসাহাসি হবে, তাই সে খাওয়া বন্ধ করে বলল, অনেক খেয়েছি, আর পারি না। কনের মা-বাবা এসে ‘এটা খাও, ওটা একটু নাও" বলে কত সাধাসাধি করল । এদিকে আমাদের বোকা বরের পেটের কোনাও তখন ভরে নি। কিন্তু কী করবে সে, সবই নসিব । সে খালি বলতে লাগল, ‘এরি মধ্যে আমার যথেষ্ট খাওয়া হয়ে গেছে। আজকের দিনে আর বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। আপনারা খান। 

ভোজ শেষ হয়ে গেল । অতিথিরা গেল চলে । রাত নামল । বর এবার কনের সঙ্গে একা ঘরে বসে আলাপ করছে। কনে বলল, আচ্ছা, বলো তো খাবার সময় তুমি এরকম অদ্ভুত আচরণ করলে কেন? তোমার ডান হাতখানা সব সময় পোশাকের নিচে লুকানো ছিল কেন? প্রথমে সে ভীষণ লজ্জা পেল। কী করে তার নববধূকে এমন কথা নিজের মুখে বলে! কিন্তু কনের মধুর সোহাগে সে সত্য কথা বলে হাতখানা বের করে দেখাল । নববধূ মধুঢালা গলায় বলল, ‘ও এই! এজন্য তুমি একটুও ভেব না। আমাদের এই দোতলা ঘরের সিড়ির নিচে এক টুকরো সাদা পাথর আছে । তুমি চুপি চুপি গিয়ে তামার পাত্রটা সেখানে বাড়ি মেরে ভেঙে এসো। অন্ধকারে কেউ তোমাকে দেখতে পাবে না। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। যাও, তাড়াতাড়ি সেরে এসো। 

বোকা বর ভাবল তার বউ ভালো কথা বলেছে। সে তাড়াতাড়ি সিড়ি বেয়ে নেমে সাদা পাথর খুঁজতে লাগল। অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখা যায় না। সে হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজতে লাগল যতক্ষণ সাদা পাথর খুঁজে না পায়। এক সময় পেল। সে হাত তুলে তামার পাত্রটি দিয়ে এক বাড়ি মারল সাদা পাথরের ওপর । একটা শব্দ হল । তামার পাত্রটা ভাঙল কিনা কে জানে কিন্তু তার ভেতর থেকে হাতটা বেরিয়ে এল এবং তামার পাত্রটা গড়িয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। কিন্তু সাদা পাথর থেকে একটা গোঙানির শব্দ সে শুনতে পেল। সে ভালো করে খুঁজে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারল পাথরের বদলে সে সাদা চুল মানুষের মাথায় দিয়েছে বাড়ি। আর সেই বুড়োটি হল তার শ্বশুর। বিয়ে বাড়িতে জায়গায় অভাব হওয়াতে বেচারি সিড়ির তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ব্যাস, ভয়ে কাবু বর। সে ভাবল যে, নিশ্চয়ই তার শ্বশুর এক আঘাতে অক্কা পেয়েছে। এই ভয়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল অন্ধকার রাতে। ছুটতে ছুটতে সে পার্শ্ববতী খামারে গিয়ে পৌছল। খামারবাড়ির এক কোনে গিয়ে সে শুয়ে পড়ল। সেখানে ছিল একটা বড় মৌচাক । সারাদিনের ধকলে এসব খেয়াল করার সময় কোথায় তার। অল্পক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে মৌচাকের মধুতে তার সারা গা লেপটে গেল। 

শেষ রাতে ঘুম গেল ভেঙে, শীতে ঠক ঠক কাঁপছে। তখন সে শীতের কাথা খুঁজতে খুঁজতে পাশের কামরায় ঢুকল। সেই ঘরটা ছিল ভেড়ার লোমের ঘর। সে উলের নতুন বিছানায় শুয়ে পড়ল। অমনি উষ্ণতা তাকে ঘুমের কোলে টেনে নিল । 
ভোরের প্রথম আলোয় তার ঘুম ভাঙল। সে দেখে তার সারা শরীর ভেড়ার লোমে ঢাকা । তখন সে ভাবল, সে তার শ্বশুরকে হত্যা করার পাপে বুঝি ভেড়া হয়ে গেছে। তখন সে ভেড়ার মতো চার হাত-পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ভেড়ার দলে গিয়ে মিশে গেল। ভেড়ার পালের সঙ্গে পাশের পাহাড়ের নিচে চড়তে চলে গেল। সে সারাদিন ভেড়াদের সঙ্গে ভেড়ার মতো ঘুরল, খুব কষ্ট হল তার, তবুও ভেড়ার স্বভাব রপ্ত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করল। বিকেল হতেই ভেড়ার পালের সঙ্গে আবার চলে এল খামার বাড়ির পাশে যেখানে তারা রাতে থাকে । সেই রাতে একদল ডাকাত এল সেখানে। ডাকাতি করার আগে তারা ভাবল একটা ভেড়া কেটে খাওয়া দরকার। সারাদিন তারা বিশেষ কিছু খায় নি। সবচেয়ে নাদুস-নুদুস ও বড় ভেড়াটি তারা বাছাই করতে লাগল এবং পেল সেই বোকা তরুণকে । 

একজন ডাকাত তাকে ভেড়ার মতো করে কাধে তুলে একটু দূরে ছোট্ট নদীর ধারে নিয়ে গেল। সেখানে তারা ভেড়াটি রাখল এবং কাটার জন্য ছোরা বের করল । এবার বোকা তরুণ বরটি আর চুপ করে থাকতে পারল না। এ যে জান নিয়ে টানাটানি! এতক্ষণ ধরে সে যে ভেড়ার মতো ব্যবহার রপ্ত করেছিল তা মাথায় উঠল। সে মানুষের গলায় বলে উঠল, ‘হে ডাকাত ভায়েরা, আমাকে মেরো না, দোহাই তোমাদের।” শুনেই অমনি ডাকাতদের পিলে চমকে উঠল।

ভেড়া কি মানুষের মতো কথা বলে? আমনি তারা যে যেদিকে পারে দে দৌড়। সেও বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে ডাকাতদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে শ্বশুরবাড়িতে এল। এসে দেখল তার শ্বশুর গুরুতর আহত হলেও বেঁচে গেছে। তারপর এরি মধ্যে ঘটে যাওয়া সবকিছু বলে সে রেহাই পেল এবং জামাই হিসেবে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে লাগল। এভাবে কয়েক বছর বউয়ের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে সে ভাবল যে, ব্যবসা করে তার কিছু টাকা-কড়ি রোজগার করা দরকার। 

তারপর বেশ কিছু মালপত্র জোগাড় করে সে বাণিজ্যের উদ্দেশে ভারতের পথে যাত্রা করল । তার আশা সে এসব জিনিস বিক্রি করে ভালো লাভ করতে পারবে । চলতে চলতে বিকেল হয়ে এলে সে একটি বড় বাড়ি দেখে থামল। বাড়ির মালিক একজন জমিদার ব্যবসায়ী। সে খুব আদর-যত্ন করে তাকে রাতের জন্য থাকতে আমন্ত্রণ জানাল । তরুণ ব্যবসায়ী ঘরে ঢুকে বসার সঙ্গে সঙ্গে জমিদার তার গল্প শুরু করল। তার মধ্যে কিছু কিছু গল্প এত উদ্ভট যে তরুণ ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে বলল, ‘এসব আমি বিশ্বাস করি না ।" 

তখন জমিদার বলল, “আমি যে-সব গল্প বলছি তা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিতে পারি। আমি বাজি ধরে বলছি, সন্ধে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চাকরের বদলে একটি বেড়াল এসে এই ঘরে বাতি দিয়ে যাবে।' ঠিক আছে। আমিও বাজি ধরে বলছি এটা কখনো সম্ভব নয়।’ 
জমিদার তখন বলল, ঠিক তো! 
যদি এরকম না ঘটে আমি এই ঘর, আমার ব্যবসার মাল-সামান এবং আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দেব। কিন্তু যদি তা ঘটে তাহলে তোমার সব মালপত্র ঘোড়াসহ আমাকে দিয়ে দিতে হবে। 

ঠিক? ‘হ্যা, ঠিক।’ আসলে এটি হল এই জমিদার ব্যবসায়ীর পুরনো এক কৌশল। তার একটি পোষা বেড়াল আছে। সে বেড়ালটাকে প্রত্যেক সন্ধেয় মুখে করে একটি হ্যারিকেন ঘরে এনে দেওয়া শিখিয়েছে। এখন বেড়ালটিকে বললেই হ্যারিকেন এনে ঘরের মাঝে রেখে যায়। এভাবে সে অসাবধানী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাজি ধরার নামে তাদের প্রতারিত করে সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নেয় । 

ধীরে ধীরে গোধূলি নেমে এল। এল সন্ধে। সাদা একটি বড় বেড়াল আস্তে আস্তে বসার ঘরে এসে ঢুকল। তার মুখে হ্যারিকেন ঝুলছে। বেড়ালটি দরজা দিয়ে ঢুকে ঘরের মাঝখানে বাতিটি রেখে আস্তে আস্তে আবার চলে গেল। তরুণ ব্যবসায়ী তখন তার ব্যবসার সমস্ত মালপত্র জমিদারের হাতে তুলে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল। সে ঠিক করল জমিদারের বাড়িতে সে চাকর হয়ে থেকে যাবে। জমিদারও তাতে রাজি হল । এদিকে এক মাস যায় দু’ মাস যায় তরুণ ব্যবসায়ীর বউ কোনো খবর না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারপর সে শুনতে পেল যে তার স্বামী কী এক অসুবিধায় পড়েছে বা সে-রকম কোনো গোলমালে জড়িয়ে পড়েছে। 

কাজেই সে একদিন পুরুষের ছদ্মবেশে জিনিসপত্র নিয়ে ব্যবসা করতে বেরিয়ে পড়ল। সে তার স্বামীর পথ ধরে লোকজনের কাছ থেকে জিগ্যেস করতে করতে চলতে লাগল । কয়েক দিন পরে সে এক বিকেলে সেই জমিদার ব্যবসায়ীর বাড়ির সামনে এসে পড়ল। সেখানে তার স্বামী এখন চাকর । সে তার স্বামীকে জমিদার বাড়ির আঙিনায় দেখতে পেল এবং তার কাছ থেকে সব কথা জেনে নিল ।

 সে তার স্বামীকে বলল তাকে না চেনার ভান করতে। তারপর সে জমিদার বাড়িতে রাতের মতো আশ্রয় চাইল । জমিদারও তাকে সমাদর করে থাকতে বলল। তারপর যথারীতি জমিদারের সঙ্গে আলাপ শুরু হলো । জমিদারও চিরাচরিত নিয়মে তার উদ্ভট সব কাহিনী বলতে লাগল যেমনটি বোকা তরুণ স্বামীর সঙ্গে করেছিল। অন্যদের কাছে করেছিল। তখন তরুণের স্ত্রী বলল, ‘এমন গল্প উদ্ভটই বলতে হবে, এমন গল্প বিশ্বাস করা যায় না। সম্ভবত আপনার বেড়ালটি ভালো তালিম পেয়েছে বলে এভাবে হ্যারিকেন নিয়ে আসতে পারে। আজকের রাতটা আমাকে ভাবতে দিন, আগামীকাল আমি আপনার সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলব, বাজি ধরা বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেব ।” 

পরদিন সকালে জলপান করার সময় তরুণী বধূ ব্যবসায়ীকে বলল, হ্যা, আমি গতকালের বিষয়টি নিয়ে মত ঠিক করেছি। এখন আমি আপনার সঙ্গে বাজি ধরতে প্রস্তুত। আপনার বেড়াল সন্ধের সময় মুখে হ্যারিকেন নিয়ে এসে ঘরের মাঝখানে রেখে যাবে, এই তো? ‘হ্যা তাই। আর বাজির শর্ত ওই একটি। যদি বেড়াল হ্যারিকেন নিয়ে আসে তাহলে তোমার ব্যবসার মালপত্র সব আমার, আর যদি না আনে তাহলে আমার ঘরের সব জিনিস তোমার। 

তখন তরুণী বধূ তার স্বামীকে গোপনে সব শিখিয়ে দিল। তার স্বামী আগে থেকে তিনটি ইদুর ধরে ছোট একটি বাক্সে করে তার কাপড়ের নিচে বুকের কাছে লুকিয়ে রাখবে। এই বলে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিল । বিকেল ঘনিয়ে এল। জমিদার ও ব্যবসায়ী খাবার ঘরের টেবিলে গিয়ে বসল। সন্ধে হলে বেড়াল আসার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে রইল। তরুণী বধূর স্বামী বাড়ির আঙিনার কাছে দরজার বাইরে লুকিয়ে রইল । ঠিক সন্ধের সময় বেড়াল হ্যারিকেন মুখে নিয়ে বাড়ির আঙিনা থেকে দরজার দিকে আসতে লাগল। আঙিনার মাঝামাঝি আসতেই বোকা স্বামী কাপড়ের তলায় লুকানো বাক্স থেকে একটা ইদুর ছেড়ে দিল । ইদুরটি আঙিনার দিকে দৌড় দিল । দেখার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু দৌড় দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার মুহুর্তে তার এতদিনের শিক্ষা তার স্বভাবের উপর প্রভুত্ব করে বসল। সে সঙ্গে সঙ্গে সংযত হয়ে ইঁদুরটাকে পালিয়ে যেতে দিল । 

তারপর আবার আগের মতো হ্যারিকেন মুখে নিয়ে ঘরের দিকে আসতে লাগল। তখন বোকা স্বামী আর একটি ইদুর ছেড়ে দিল সেই মুহুর্তে। ইদুরটা বেড়ালের সামনে দিয়ে চি চি করে ছুটে গেল। এবারও বেড়ালের মজ্জাগত স্বভাবের ওপর এতদিনের শিক্ষার জয় হল । বেড়ালটি আবার ঘরের দিকে চলতে লাগল আস্তে আস্তে । ঘরের দরজার কাছে পা রাখতেই তৃতীয় ইদুরটি লাফিয়ে পড়ল বেড়ালের সামনে । এবার বেড়ালটি আর পারল না, তার এতদিনের শিক্ষা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। হ্যারিকেনটা দরজার চৌকাঠের ওপর ফেলে উঠোনের দিকে ছুটে যাওয়া ইদুরের উপর ঝাপিয়ে পড়ে সেটা ধরে ফেলল। 

ইদুরটা গর্তে ঢোকার সময়টুকু পর্যন্ত পেল না। হ্যারিকেনটাও কাত হয়ে পড়ে দু-তিনবার দপ দপ করে নিভে গেল । এদিকে খাবার ঘরে অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকারে বসে আছে জমিদার ও তরুণী বধূ ব্যবসায়ী। তখন জমিদার স্বীকার করতে বাধ্য হল যে সে বাজিতে হেরে গেছে। সে ছদ্মবেশী তরুণী বধূ ব্যবসায়ীর হাতে শুধু তার সম্পত্তি নয়, এর আগে তার স্বামী থেকে পাওয়া জিনিসপত্রও ফেরত দিল । স্বামী ও স্ত্রী মিলে তখন সব মালপত্র ঘোড়া ও গাধার পিঠে তুলে নিয়ে ঘরের উদ্দেশে রওনা হল। ঘরে ফিরে তারা সুখে দিন কাটাতে লাগল। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেরও আর কোনো দরকার পড়ল না।

0 coment�rios: