দূরের পলাশ, মহুয়া বনের মাথায় কখন সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু লেপটে পরে চিক চিক হেসে উঠেছিল এখন আর তার কিছুই টের পাওয়া যাবে না। টের পাওয়া যাবে না, কখন আকাশ-সাঁতার-ক্লান্ত পাখিরা ঘরে ফেরবার পথে সমস্ত বনানী প্রদেশ কিচির মিচির শব্দে মুখর করে তুলেছিল। এখন চারিদিকে শুধু জমাট অন্ধকার। এই যে কিছুক্ষণ আগেও কোয়েল নদীর কিনারে একদল বুনো হাঁস আলগোছে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, এখন আর তাদের কাউকে দেখা যাবে না। সমস্ত চরাচর এখন অন্ধকালের করাল গ্রাসে আবদ্ধ।
গ্রামের নাম গাড়ি। এখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হবে ঠিক আটটায়। খাওয়া দাওয়া সেরে তাই সকলে আমরা প্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মোটামুটিভাবে সকলের মধ্যে একটা পরামর্শ হ’ল। ঠিক হল পথ প্রদর্শক হবে আলিমুদ্দিন। এই বন সম্বন্ধে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া এখানকার পথঘাট, অলি-গলি সবই তার নখদর্পণে। সে সকলের আগে “স্পট-লাইট” ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যাবে। তার পিছনে প্রথম সারিতে থাকবে শশীবাবু আর মহাত্মা। এরপর চারজন মালবাহী দেহাতি এবং সবশেষে থাকবো আমি আর রতনলাল। দেহাতিদের সঙ্গে নেবার কারণ হল, যদি কোন শিকার মেলে তাহলে ওরাই বহন করে গ্রামে পৌছে দিয়ে যাবে। যথাসময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। প্রথম ঘণ্টাখানেক গল্প করতে করতেই আমরা এগুলাম। বন যে এখন পর্যন্ত হালকা তা স্পষ্টতঃই বোঝা গেল। কেননা শাল-মহুয়া বন ভেদ করে স্পট-লাইটের আলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। বোধহয় সেটা কৃষ্ণপক্ষের রাত। চারিদিকে ভয়ানক অন্ধকার। তার উপর গভীর কুয়াসার আস্তরণ। মনে হচ্ছিলো একটা অদ্ভুত রহস্যের মধ্যে ডুবে গিয়ে সমস্ত বনাঞ্চল স্তব্ধ হয়ে ভাবছে। আকাশে ছড়ানো ছেটানো তারাগুলো দপদপ জ্বলছে। হঠাৎ এই বনের স্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে এক ঝাঁক হাওয়ায় কেঁপে উঠল সমস্ত অরণ্য। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত শিহরণ আমার রক্তে দাপাদাপি শুরু করে দিলো। অনুভব করলাম, এই নির্জন অরণ্যে যেন আমাদের অসহায় একাকীত্বকে ঘিরে দুপাশে গাছগুলি ভয়ানক উপহাস করছে।
কিছুক্ষণ একটানা হেঁটে যাবার পর আমরা এক জায়গায় এসে সকলে থেমে গেলাম। আলিমুদ্দিন জানালে, এখান থেকে বন খুব গভীর। আর আমরা যেখানে যাচ্ছি, সে বন খুবই দুর্গম। সবাইকে সে তাই সাবধান করে দিল এবং শেষবারের মত তার নির্দেশগুলি জানিয়ে দিল আমাদের। আমার সঙ্গী রতনলাল এই প্রথম শিকারে এসেছে। লক্ষ্য করে দেখলাম, কথা শুনেই তার হাত পা থর থর করে কাঁপছে। তাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘ভয় কি? তোমাকে ছেড়ে পালাবে না।’
দেখতে দেখতে আমরা আরো অনেকটা গভীর অরণ্যে ঢুকে পড়লাম। বন এখন এত গভীর যে, দূরের কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু স্পট-লাইটের আলো অরণ্য ভেদ করে যতদূর যায়, ততদূরই আমাদের নিশানা। কিন্তু কান সতর্ক রেখে চলেছি। কেননা বনে যে কোন মুহুর্তে বিপদ ঘটতে পারে। সামনে স্পট-লাইটের আলো ফেলতে ফেলতে চলেছে আলিমুদ্দিন। হঠাৎ তার হাতের আলোটা এক জায়গায় স্থির হয়ে গেল। চেয়ে দেখি, কিছুটা দূরে একটা মহুয়া গাছের তলায় দুটো বিরাটাকার হরিণ। আলোতে তাদের চোখ দুটো দপ দপ জ্বলছে। এখানে আলিমুদিনের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ, আলোটা একটু হেলে পড়লেই হরিণ দুটো ছুটে পালিয়ে যাবে। নির্দেশ মত আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। আলিমুদ্দিন স্পট-লাইটের আলোটা নিয়ে এগিয়ে গেল কিছুটা। কেননা, রেঞ্জের মধ্যে না ফেলতে পারলে গুলি করে কিছু লাভ হবে না। মহাত্মাও বন্দুক প্রস্তুত করে নিয়ে এগিয়ে গেল তার পিছু পিছু। অনেকটা এগিয়ে গেছে তারা। এবার হরিণ দুটো রেঞ্জের মধ্যে এসে পড়েছে। আলিমুদ্দিন স্পটের আলোটা হরিণ দুটোর উপর ঠিক রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। মহাত্মাও মুহুর্তের মধ্যে বন্দুকের নিশানা ঠিক করে ফেলল। প্রথম সাফল্য লাভের আশায় আনন্দ তখন আমাদের মনে দোলা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু, একি? পাশের জঙ্গলে একটা ভারী পায়ের শব্দ শুনে আমরা সবাই সচকিত হয়ে উঠলাম। একটা বিশাল প্রাণী যেন ছুটে আসছে আমাদের দিকে। সব কটা বন্দুক প্রস্তুত হয়ে গেল। আলিমুদ্দিন স্পট-লাইটের মুখ ঘুরিয়ে ফেলল সেদিকে। সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা থেমে গেল। আমাদের মনে তখন একটা ভয়ানক উৎকণ্ঠার ঝড়। দু মিনিট প্রায় নিঃশব্দে কেটে গেল। আলিমুদ্দিন স্পট-লাইটের আলোটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানোয়ারটাকে সন্ধান করতে লাগল। এক সময় শব্দটা আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। তেমনি উৎকণ্ঠায় আমরা প্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
‘ধুৎ!’ মহাত্মা তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলে আমাদের উৎকণ্ঠার সমাপ্তি ঘটালো। জিজ্ঞাসা করলাম ‘কি?’
‘কি আবার, বুনো শুয়োর।’ উত্তর দিলো মহাত্মা।
ঠিক তাই, একটা বিরাট বুনো শুয়োর তার একপাল বাচ্চা নিয়ে চলেছে। প্রথমে সে হয়ত আমাদের দেখতে পায়নি। পথে স্পট লাইটের আলো দেখে থমকে গিয়েছিল। যাই হোক, লাভজনক শিকারটা হাতছাড়া হওয়ায় আমরা সকলেই কিছুটা বিমর্ষ হলাম।
আলিমুদ্দিন আশ্বাস দিয়ে বললে—‘বনে এরকম হামেশাই ঘটে, ঘাবড়ে যাবেন না। আবার চলতে শুরু করলাম আমরা সকলে। বন ক্রমে আরো গভীর হয়ে উঠছে। চলার পথটাও এখন অনেক সঙ্কীর্ণ। দুপাশের ডালপালাগুলো এসে গায় লাগছিল। শীতটা পড়েছে খুব বেশি। এতোক্ষণ বনে বিশেষ হওয়া ছিলনা। এখন মৃদু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। একে শীত, তার উপর এই হাওয়ায় মনে হচ্ছিল, যেন হাত পা জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। বন্দুক হাতে আছে বটে, কিন্তু হাত পা সেভাবে প্রস্তুত ছিল না। বাতাসে আর একটা অসুবিধাও হল। পাতা ঝরার এমন একটা টুপটাপ শব্দ হচ্ছিল যে, হিংস্ৰ শ্বাপদ খুব কাছে না এলে তার পায়ের শব্দ বুঝার কোন উপায় আমাদের ছিল না। অবশ্য বাঘের কথা স্বতন্ত্র। তবে আশার কথা এই যে, এতগুলে প্রাণী দেখে সে হয়ত এগুতে সাহস পাবে না। বেশ অনুভব করলাম, একটা ছোট টিলার ওপর আমরা উঠছি। এখানে খুব খাড় বড় পাহাড় প্রায় নেই। ছোট ছোট রুক্ষ পাহাড়গুলোই এখানকার সৌন্দর্য। আসামের বনে যেমন ঝোপঝাড় খুব বেশি, এখানে তেমন নেই। তুলনায় বেশ হালকা। শীতে হাত পা জড়ো সড়ো হয়ে আসছে। তবু এগোন ছাড়া কোন উপায় ছিল না আমাদের। ছোট টিলাটা পার হয়ে সবে সমভূমিতে নেমেছি। এমন সময় একটা ভয়ানক শব্দে আমরা সচকিত হলাম। মনে হল দুদল মানুষ যেন লাঠি নিয়ে মারামারি করছে। সামনের বাঁশবনে আলো পড়তেই সকলে ভয়ানক আঁতকে উঠলাম।
সর্বনাশ! একদল হাতী, আর এত কাছে! আলিমুদ্দিন চেঁচিয়ে উঠল, ডেনজার, পালাও পালাও। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এত বড় দলটা যেন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। আমি আর রতনলাল ছিলাম সকলের পেছনে। বিদ্যুতের স্পর্শে আলো যেমন দপ করে জ্বলে ওঠে, তেমনি কেমন করে এক অলৌকিক শক্তিতে, সামনের বড় পাথরটা পার হয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছিলাম তা এখন আর বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে মনে আছে, আমার পেছন পেছন যে রতনলাল ছুটে আসছিল, এ অনুভব আমার তখন ছিল না। আমার কেবলই ওর পায়ের শব্দে মনে হচ্ছিল, হাতীগুলো বুঝি তাড়া করে আসছে পিছু পিছু। এক সময় একটা বুনো লতায় আটকে মাটিতে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম একটা ভারি জিনিস আমার পিঠের উপর আছড়ে পড়ছে। সে যে আর কেউ নয়, আমার বন্ধু রতনলাল, এ কথা যখন জানলাম, তখন কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পেলাম মনে।
আমরা যে আমাদের দল থেকে অনেকটা দূরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। কেননা নানারকম সাংকেতিক শব্দ করে কাছাকাছি কোন জায়গা থেকে কোন উত্তর পেলাম না। চারিদিকে প্রসারিত শুধু অন্ধকার। নিশুতি বনে কোথাও মানুষের কোন সাড়া নেই। আমরা অনেকক্ষণ কোথাও কোন মানুষের স্বর শোনা যায় কিনা তারজন্য অপেক্ষা করলাম। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাও বিপজ্জনক। আলিমুদিনের কাছে শুনেছিলাম, এ বনে হরিণের সঙ্গে বাইসন, হাতীও দেখা যায় মাঝে মাঝে। সুতরাং এভাবে নিশ্চল দাঁড়িয়ে না থেকে একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাক। ওদের সন্ধান করা এখন বৃথা। তা ছাড়া এখানের রাস্তাঘাট আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাই কোন নিরাপদ স্থানে অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
‘চলো গাছটায় উঠে বসি। ইঙ্গিতে মাথা নাড়ল রতনলাল। লক্ষ্য করলাম, তার বাকশক্তি প্রায় লোপ পেতে বসেছে।
একটা পাথর ডিঙিয়ে মাঝারি ধরনের একটা গাছের সামনে এসে দাঁডালাম ! প্রথমে আমি হাটু গেড়ে বসলাম। রতনলাল আমার ঘাড়ে পা দিয়ে দাঁড়ালো। আমি উঠে দাঁড়ালে ও একটা বড় ডাল ধরে ঝুলে উঠে পড়লো। আমিও অনেক কষ্টে উঠে পড়লাম গাছে। বললাম, রাতটা এভাবেই কাটানো যাক। তারপর সকাল হলে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
এভাবে কতক্ষণ কেটেছিল, তা এখন আর সঠিক বলা সম্ভব হবে না। একটা ভয়ানক আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা মিনিটকে মনে হচ্ছিল যেন এক একটা প্রহর। চারিদিকে তখন ভীষণ নির্জনতা। মনে হচ্ছিল অন্ধকারের বুকে সমস্ত বনভূমি এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে সামান্য হাওয়ায় যখন চারিদিকে ছড়ানো গাছের ডালপালাগুলি ঈষৎ কেঁপে উঠছিল, তখন হয়তো মনে করা যেতে পারতো, সোনার পালঙ্কে শায়িত কোন ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘুম ভাঙ্গাবার সাধনায় রূপকথার রাজপুত্র নিরলস চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু আমাদের মন নির্জনতার অদ্ভুত রহস্যকে অনুভব করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বরং হাওয়ার সামান্য শব্দও প্রতিমুহুর্তে আমাদের মন আতঙ্কে ভরিয়ে তুলছিল। প্রার্থনা করছিলাম, বাতাস বন্ধ হয়ে যাক। ডালপালা নড়বার শব্দ থামুক। এবং সমস্ত বনভূমিতে বিরাজিত হোক এক অপরিসীম নৈঃশব্দ্য।
অনেকটা দূরে একটা হরিণের ডাক শোনা গেলো। তারও পর শুকনো পাতায় একটা কিসের হেঁটে যাওয়ার শব্দ। রতনলাল আমার পিঠে ধাক্কা দিয়ে ওই শব্দটার প্রতি আমাকে সতর্ক করতে চেষ্টা করলো। অন্ততঃ তার মনে কিছুটা আশা সঞ্চার করার ইচ্ছায় আমি ইশারায় জানালাম, ওটা কিছু নয়। কিন্তু মনে একটা অকারণ ভয় মাতামাতি শুরু করলো। রতনলালের পকেট থেকে টর্চটা আমার হাতে নিলাম। শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। মনে হল জানোয়ারটা বোধ হয় কিছু একটা সন্দেহ করেছে। সাধারণতঃ মানুষখেকো বাঘ না হলে, আলো দেখলে বা বন্দুক দেখলে পথ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু একমাত্র সেই ভরসাতেই তো আর থাকা যায় না। তা ছাড়া আমরা দুজনের মধ্যে কেউই শিকারী বলতে যা বুঝায়, তা নই। শিকারের অভিজ্ঞতাও তেমন নেই। দু একবার শিকারী দলের সঙ্গে বনে এসেছি, এই মাত্র। ভাগ্যক্রমে সেই মুহুর্তে আমাকে শিকারীর ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে হচ্ছে। যাই হোক, কিছুক্ষণ আর শব্দটা শোনা গেল না। মনে কেমন যেন একটা কৌতুহল জাগলো। বা হাতে টর্চের সুইচটা টিপে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রাণী হুড়মুড় শব্দে পালিয়ে গেল। সামান্য আলোতে যতদূর লক্ষ্য করলাম তাতে মনে হল, প্যাস্থার জাতীয় কোন প্রাণী। কাছে কোথাও হয়ত জল আছে। সে হয়ত সেদিকেই যাচ্ছিল। অথবা কোথাও শিকার না পেয়ে নতুন শিকারের সন্ধানে এসেছিল এদিকে। তারপর এক সময়ে আমাদের দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল। টর্চের আলো দেখে নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে খুব। তাই আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে গেছে অন্যদিকে।
আরো কিছুটা সময় এরকম উৎকণ্ঠায় আর অনিশ্চয়তায় কেটে গেলো। এক সময় রতনলাল আমার পিঠে ধাক্কা মেরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো—
‘রোশনাই।’
সত্যি। লক্ষ্য করে দেখলাম, তিন চারটি টর্চের আলো কিছু সন্ধান করে বেড়াচ্ছে। মনে একটা আশা জেগে উঠলো। নিশ্চয়ই আমাদের দলের লোকেরা। তাছাড়া এই নির্জন বনে এত রাতে কেউ ঘুরে বেড়াতে পারে না। আমি প্রত্যুত্তরে আমার টর্চের আলো জ্বেলে ধরলাম। অপর দিক থেকে এইবার সঠিক উত্তর পাওয়া গেল। আমার নাম ধরে ডেকে উঠল একজন। মনে হল শৈলদার কণ্ঠস্বর। এইবার রতনলাল এবং আমি দু জনেই এক সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম ‘এদিকে, এ-দি-কে। এই আলো এবং উত্তর প্রত্যুত্তর বিনিময় করতে করতে প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ওরা আমাদের কাছে চলে এলো। তখন দলে মাত্র চারজন। শৈলদা, শশীবাবু, মহাত্মা এবং আর একজন। এই লোকটি এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিল না।আমরা গাছ থেকে নেমে এলাম। শৈলদা প্রায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। লক্ষ্য করলাম, একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তায় তার চোখমুখের চেহারা পাল্টে গেছে। অবশ্য এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। সে আমার সম্পর্কে পিসতুতো ভাই। এই অঞ্চলে ফরেস্ট অফিসারের কাজ করে। তার কাছেই এসেছিলাম আমি বেড়াতে। আমার বিশেষ অনুরোধে সে এই শিকারের ব্যবস্থা করেছিলো। তাই কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটলে, সেটা তার পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতো। শৈলদার মুখে এইবার একটা ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পেল। এতোক্ষণের সমস্ত অনিশ্চয়তাকে ঝেড়ে ফেলার মতো একটা দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলে
সে বললো—
বাস, কি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
‘খুবই স্বাভাবিক, সমর্থন জানাল মহাত্মা। কোলকাতার লোক এই গভীর জঙ্গলে ভয়েই শেষ হয়ে যেতো। যাক ভালোভাবেই উপসংহার হয়েছে।’
‘তোদের বললাম, সব সময় আমাকে লক্ষ্য করে চলবি, তা অন্যদিকে গেলি কেমন করে? গলায় একটা দৃপ্ত গাম্ভীর্য টেনে শৈলদা এবার প্রশ্ন করলো।
‘মানে পাথরটা ডিঙ্গিয়ে যেতেই মনে হল সামনে খোলা পথ রয়েছে।’
‘কিন্তু হাতীর সামনে পড়লে কি আর রক্ষা ছিল।'
‘হয়েছে। যা ঘটে গেছে, তা ভেবে আর লাভ কি?’ শশীবাবু বললেন।
‘কিন্তু ভাবুন তো আমাদের কথা।’
‘কিন্তু তোমরাই বা আমাদের ছেড়ে গেলে কেমন করে? এবার আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।’
এ‘ত লোকের মধ্যে কে কোথায় গেল, তা বিপদের সময় নির্ণয় করা যায় না। নিয়ম হচ্ছে, যারা দলে আছে, তারা নির্দেশ মত চলবে। আমরা তো ভাবতে পারিনি, তোরা নেই। বিপদ কেটে যাবার পর যখন একসাথে হয়েছি, তখনই খেয়াল হল। তখনই খুঁজতে বেরিয়েছি তোদের। সঙ্গে সাহেবকে নিয়ে এসেছি। এ জঙ্গল তার খুব চেনা। অন্যান্য সকলে এখন তার বাড়িতে অপেক্ষা করছে। যাক, এবার চল সেখানে। সবাই এতোক্ষণে হয়তো অস্থির হয়ে উঠেছে।’
সাহেবের আস্তানায় এসে দেখি বারদীয় আগুন জ্বলিয়ে সবাই তার চারপাশে গোল হয়ে আগুন পোহাচ্ছে। আমাদের দেখেই ওদের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। বুঝলাম, আমাদের না দেখে ওরাও চিন্তিত হয়েছিল।
বাইরে একটা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। হাওয়ার থাবায় সমস্ত অরণ্য অঞ্চল যেন কেঁপে উঠছে। নিঃশ্বাস ফেলার মত একটা অদ্ভুত শব্দ চারিদিকে যেন হুটোপুটি করে বেরাচ্ছে। ঘাসের উপর বিক্ষিপ্ত শিশির বিন্দুগুলো অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় জমাট বেঁধে গিয়েছে। এতোক্ষণ তেমন অনুভব করিনি, কিন্তু এখন সাহেবের বাড়িতে ফিরে আসার পর মনে হল, আমার পা দুটো শীতে অসাড় হয়ে গিয়েছে। তাই বারান্দায় জ্বালানো আগুন দেখে, তাড়াতাড়ি এসে তার পাশে বসলাম। জুতা এবং মোজা খুলে ফেলে আগুনে হাত পা গুলো সেঁকে নিতে আরম্ভ করলাম। একজন দেহাতি দু’কাপ চা নিয়ে এল আমার এবং রতনলালের জন্য। পরম সৌভাগ্য না থাকলে এ অসময়ে চা পাওয়া যায় না।
আমরা যখন আগুনের পাশে বসে চা খাওয়ায় ব্যস্ত, তখন সাহেব সবাইকে প্রস্তুত হবার জন্য ইঙ্গিত করল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়ালো। শৈলদা এসে বললো—তোরা এখানে থাক, আমরা আবার বেরুচ্ছি।’
কিছুমাত্র আপত্তি জানালাম না। কেননা এতোক্ষণের উৎকণ্ঠা এবং পরিশ্রমে ভয়ানক ক্লান্তি বোধ করছিলাম। তাছাড়া এই রাত্রিতে আবার বের হবার মত উৎসাহও আমার ছিল না। আমি আর রতনলাল ছাড়া সবাই বেরিয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, তখন রাত চারটে। সামনে একটা খড়ের বিছানা পাতা ছিল। আমি আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে, শরীর এলিয়ে দিলাম তার ওপরে। কখন যে আমার দুচোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল, তার কিছুই টের পেলাম না।
শিকার কাহিনী বা ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়তো এটি নয়। কিন্তু এক করুণ অভিজ্ঞতার বিবরণ হিসেবে এই কাহিনী স্মৃতিপট থেকে কখনও বিলুপ্ত হবে না। নির্জনতার যে একটা অদ্ভুত আস্বাদ আছে, অনিশ্চয়তার যে একটা অজানা শিহরণ আছে, অরণ্যের যে একটা দুৰ্গম আনন্দ আছে, পালামৌয়ের নির্জন অরণ্যে অতিবাহিত একটি রাত সেই অভিজ্ঞতাই যেন মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত করেছে। এখনো কান পাতলে, স্মৃতিপটে বেজে ওঠে অরণ্যের হাতছানি, বাতাসের অবিরল শব্দ, আর অন্ধকারের রহস্যময় প্রতিধ্বনি।
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
0 coment�rios: