আমার বন্ধু বাপ্পা কী দারুণ ভাগ্যবান। তার কাকা লটারিতে এক কোটি টাকা পেয়ে গেলেন।
বাপ্পা নিজে পায়নি, তাতে কী হয়েছে। ওর কাকা তো পেয়েছেন। এক মাত্র কাকা।
এক কোটি টাকা মানে কত? একের পিঠে সাতটা শূন্য! ওরে বাবা, এত টাকা দিয়ে মানুষ কী করে! অত টাকার কথা ভাবতে আমারই মাথা ঘুরে যাচ্ছে।
কেউ হঠাৎ বড়লোক হলে অমনি তার আশেপাশে ভিড় জমে যায়। বাপ্পাদের বাড়িতে এখন সব সময় অনেক লোক। তারা নানারকম পরামর্শ দেয়। কেউ বলে বোতলের জলের ব্যবসা করতে, কেউ বলে, আপনার মায়ের নামে একটা মন্দির বানিয়ে ফেলুন না। আর সবাই বললেন, আমাদের গ্রামে একটা রাস্তা বানিয়ে দিন।
বাপ্পার বীরুকাকা এইসব শুনে মুচকি মুচকি হাসেন। কারও-কে হা-ও বলেন না, -ও বলেন না। কত লোক চাঁদা চাইতে আসে। তাদের তিনি বলেন হবে, পরে হবে।
হঠাৎ একদিন বীরুকাকা উধাও হয়ে গেলেন।
একমাস বাদে তার খোঁজ পাওয়া গেল। বাপ্পার বাবাকে তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি টাকি নামে একটা জায়গায় একটা বাড়ি কিনেছেন, সেখানেই থাকবেন, কলকাতায় আর ফিরবেন না কখনো। ওখানে আর কেউ তাকে জ্বালাতন করতে পারবে না।।
প্রথমবার বাপ্পা টাকিতে গিয়ে সেই বাড়ি দেখে এসে আমাদের যা বলল, তা শুনে আমরা একেবারে হাঁ। সে যে কী দারুণ সুন্দর বাড়ি আর কী বিশাল বাগান, তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না? সেটা আগে এক জমিদারের বাড়ি ছিল, তারা এখন খুব গরিব হয়ে গেছে, তাই বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে।
বীরুকাকা সেই বাড়িটা কিনেছেন বিরাশি লক্ষ টাকা দিয়ে। জমিদারদের বংশে এখন তেইশ জন শরিক, তাদের মধ্যে টাকাটা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। আমি মনে-মনে বিরাশিকে তেইশ দিয়ে ভাগ করার একবার চেষ্টা করলাম। তারপরই মনে হল, আমি তো টাকা পাচ্ছি না। আমার হিসেব করার দরকার কী?
অত টাকা দিয়ে শুধু-শুধু একটা বাড়ি কেনার কোনও মানে হয়?
বীরুকাকা বলেছেন, সারাজীবন তিনি ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন, তাই তার নিজস্ব একটা বাড়ির খুব শখ ছিল। লটারিতে জেতার খবরটা যেদিন পান, তার আগের রাত্তিরেই তিনি একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলেন। পুরোনো আমলের সুন্দর দোতলা বাড়ি, সামনে মস্ত বড় পুকুর, দুপাশে বাগান। ওইরকম স্বপ্ন তিনি দেখলেন কেন? নিশ্চয়ই লটারির টাকা পাওয়ার সঙ্গে ওই রকম একটা বাড়ির সম্পর্ক আছে। অনেক খুঁজে-খুঁজে টাকিতে তিনি প্রায় স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যাওয়া বাড়িটা দেখতে পেলেন আর অমনি কিনে নিলেন।
বাপ্পা আর ওর বোনেরা সেখানে প্রত্যেক শনিবারে যায়। সে বাড়ির পুকুর ভর্তি কত বড়-বড় মাছ, আর বাগানে কত ফুল, সেই গল্প করে।
আর একমাস পরেই জানা গেল, সেটা ভূতের বাড়ি। এক রবিবার বাপ্পা টাকি থেকে ফিরে এল, তার বাঁ-পায়ে মস্ত বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভূতে তার পা ভেঙে দিয়েছে।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বাপ্পাই সবচেয়ে বেশি গুলবাজ! এমন সুন্দর ভাবে গল্প বলে যে বিশ্বাস করে ফেলতে হয়। টাকির ওই অতবড় বাড়ির গল্প কি তবে গুল। বলতে-বলতে একেবারে ভূত এনে ফেলেছে।
আমি জিগ্যেস করলুম, ভূতে তোর পা ভাঙল কী করে রে? ঠেলা মারল? ঠিক দুকুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা।।
বাপ্পা বলল, নীলু তুই বিশ্বাস করিস না তো? তুই এই শনিবার চল আমার সঙ্গে। নিজের কানে শুনবি।
শুনেই আমি এক পায়ে খাড়া। আর কিছু না হোক, বেড়ানো তো হবে।
টাকি খুব দূর নয়। কলকাতা থেকে একটা বাসে যাওয়া যায় হাসনাবাদ। সেখান থেকে আর এক বাসে টাকি।।
পোঁছে দেখি, বাপ্পা তো একটুও মিথ্যে বলেনি। বিরাট লোহার গেট, তারপর লাল সুরকি বেছান রাস্তা, বাড়িটা প্রায় দুর্গের মতন। তার সামনে একটা চারকোণা মস্ত বড় পুকুর, সেটাকে দিঘিই বলা উচিত। টলটলে জল। অনেক মাছ থাকতেই পারে। দুপাশে বাগান, একদিকে সব ফুল গাছ। আর একদিকে ফলের গাছ। মস্ত-মস্ত সব গাছ, সে বাগানটা অনেকখানি ছড়ানো।
বাড়িটা বেশ পুরোনো, দেওয়ালে শ্যাওলা জমে গেছে। এরকম বাড়িতে ভূত থাকা স্বাভাবিক। সিমলায় এ রকম ভূতের বাড়ি দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, ছোটবেলা থেকেই আমি বিশ্বমামার চ্যালা। বিশ্বমামা যে বলে দিয়েছেন, ভূত বলে কিছু নেই। আজ পর্যন্ত কেউ সত্যি-সত্যি ভুত দেখেনি। অনেক মানুষ এমনি-এমনি ভয় পায়।
আমি জিগ্যেস করলুম, ভূতটা কোথায় থাকে রে? এই বাড়ির ছাদে, চিলেকোঠায়? বাপ্পা বললে, না।
তারপর আঙুল দেখিয়ে বললে, থাকে ওই ফলের বাগানে। বোধহয় ব্রহ্মদৈত্য। ব্রহ্মদৈত্যরা বাড়িতে থাকে না। গাছে থাকে।
আবার জিগ্যেস করলুম, তুই নিজের চোখে দেখেছিস? বাপ্পা বলল, দেখা দেয় না। কথা শোনা যায়, ভয় দেখায়।
বীরুকাকা বসে আছেন বৈঠকখানায়। হাতে একখানা বই। সেই ঘর ভর্তি অনেক বই, পাশের ঘরে তিন চারখানা বই ভর্তি আলমারি। বীরুকাকা এখানে সর্বক্ষণ বই পড়েন।
এত বড় বাড়িতে এখন দুজন মাত্র কর্মচারী। এক জন দরোয়ান, আর একজন রান্নার ঠাকুর। দারোয়ানের আবার কাল থেকে জুর হয়েছে। আমি বীরুকাকাকে প্রণাম করতেই তিনি বাপ্পার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, এ কে?
বাপ্পা বললে, আমার বন্ধু নীলু, ও খুব আসতে চাইছিল—
বীরুকাকা বললেন, ওকে বুঝি ভূত দেখাতে এনেছিস? এবার সারা কলকাতায় রটে যাবে দলে-দলে লোক ছুটে আসবে।
বাপ্পা বলল, না, না, নীলু আর কারুকে বলবে না।
আমি ফস করে জিগ্যেস করলুম, বীরুকাকা, সত্যি এখানে ভূত আছে? বীরুকাকা বললেন, আছে তো বটে, কিন্তু সে তো কারুর ক্ষতি করে না। বাপ্পা বলেছিল, ওর কথা শুনে আমার যে পা ভাঙল। বীরুকাকা বললেন, তুই ভয় পেয়ে দৌড়েছিলি, তাই আছাড় খেয়ে পা ভেঙেছিস। বাপ্পা বলল, রান্নার ঠাকুর যে বমি করল?
বীরুকাকা বললেন, আমি কারুকে এখন ওই বাগানের দিকে যেতে বারণ করেছি, এখন ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। আমার এ বাড়িতে নতুন এলে তো, তাই ব্ৰহ্মদৈত্য ঠিক মেনে নিতে পারছে না। কিছুদিন কেটে যাক, আমরা যদি ওকে বিরক্ত না করি, তাহলে ও আর কিছু বলবে না।
সত্যিই তাহলে ব্রহ্মদৈত্য আছে? তবে তত একবার দেখতেই হয়। বীরুকাকা বারণ করলেও যেতে হবে। বাপ্পাও তো আমাকে সেই জন্যই নিয়ে এসেছে।
বীরুকাকা বিকেলের দিকে একবার বাজারে যান। এখানে বিকেলে বাজার বসে।
বীরুকাকা বেরিয়ে যেতেই আমরা দুজনে চলে গেলুম ফলের বাগানের দিকে। বাপ্পার এখনো সারেনি, লেংচে-লেংচে হাঁটছে।
বাপ্পা বলল, শোন নীলু, ভয় পাবি না কিন্তু। দৌড়বি না। তুই দৌড়লে আমি পিছিয়ে পড়ব। তখন যদি আমার গলা টিপে দেয়।
আমি মনে-মনে হাসলুম। বীরুকাকা যাই-ই বলুন, আমি অত সহজে ভূত কিংবা ব্রহ্মদৈত্য বিশ্বাস করতে রাজি নই। বিশ্বমামার চ্যালারা অত সহজে ভয় পায় না।
বাগানের প্রথম দিকেই অনেকগুলো আমগাছ। কচি-কচি আম হয়েছে। তারপর জাম, কাঁঠাল, লেবু, আরও কত রকম গাছ। আমি চিনি না। একটা গাছ ভর্তি বেল।
হাঁটতে-হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এলুম। বাগান তো নয়, যেন জঙ্গল। এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না। এপাশেও একটা ছোট পুকুর আছে। এমনিতেই বাগানের ভেতরটা ছায়া-ছায়া, এখন আবার সন্ধে হয়ে এসেছে। বেড়াতে ভালো লাগছে। ভয় করছে না একটুও। কোথায় ভূত কিংবা ব্রহ্মদৈত্য? তাহলে কি বাপ্পার মতন বীরুকাকাও গুল মারেন?
পুকুরটার ধার দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ গম্ভীর গলায় কে যেন ধমকে উঠল। ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। আওয়াজটা আসছে শেষ গাছের ওপর থেকে। এবার ভয়ে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। মারলুম টেনে একটা দৌড়। বাপ্পা কাতর গলায় বলতে লাগল, এই নীল, দাঁড়া, দাঁড়া, আমায় ফেলে যাস না!
আমি দৌড় থামালুম একেবারে বৈঠকখানার সিঁড়িতে পৌঁছে।
বাপ্পা এসে গেল একটু পরে। চোখ পাকিয়ে বলল, বিশ্বাসঘাতক, কাওয়ার্ড। আমাকে ফেলে পালাতে লজ্জা করল না? যদি আমার গলা টিপে দিত?
আমি একটু চুপ করে রইলুম। সত্যিই তো আমার দোষ!, তারপর ফিসফিস করে জিগ্যেস করলুম, তুই ওকে দেখতে পেলি?
বাপ্পা বললে, ওরা অশরীরী? সবসময় কি দেখা যায়? মাঝে-মাঝে স্বরূপ ধরে এবার নিজের কানে শুনলি তো?
আমি বললুম, আমার কিন্তু পা ভাঙেনি, কোনও ক্ষতিও হয়নি। বাপ্পা বলল, দ্যাখ না কী হয়। ও ধমকালে একটা না একটা কিছু হবেই।
সত্যিই, সে রাতে আমার জ্বর এসে গেল। রাত্তিরবেলা খালি মনে হতে লাগল, মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ, মাথায় জটা, চোখ দুটো আগুনের ভাটার মতন, একটা ব্রহ্মদৈত্য জানলা দিয়ে আমাকে দেখছে।
পরদিন সকালে আমি জুর গায়েই পালিয়ে এলুম কলকাতা।
বিশ্বমামা কিছুদিন ধরে খুব ব্যস্ত। বিনা বিদ্যুতে ঘরের পাখা চালানো যায় কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা করছেন। মন দিয়ে শুনলেন আমার কথা।
তারপর বললেন, আমার চ্যালা হয়ে তুই যখন ভয় পেয়েছিস, তখন তো ব্যাপারটা সিরিয়াস মনে হচ্ছে। তুই নিজের কানে শুনেছিস?
--হ্যাঁ।
--স্পষ্ট?
--স্পষ্ট মানুষের গলা। --কোনও লোককে দেখতে পাসনি।
--না। গাছের ওপর-ওপর লুকিয়ে থাকতে পারে।
--তাহলে তো এগিয়ে দেখতে হয়। চল কালকেই যাই।
--কিন্তু বীরুকাকা যদি রেগে যান? উনি এ নিয়ে বেশি হই-চই পছন্দ করেন। কলকাতা থেকে কেউ যাক, উনি চান না।
--আরে বীরুকাকা মানে বীরেশ্বর দত্ত তো? আমাকে উনি ভালোই চেনেন। লটারির টাকা পেয়ে বড়লোক হয়েছেন বলে তো আর আমাকে ভুলে যাবেন না!
পরদিন বিশ্বমামার গাড়িতে চেপে বসলুম আমি আর বাপ্পা। খানিকবাদে বিশ্বমামা বললেন, তোরা গাড়ি-ভূত দেখেছিস কখনো? আমি আর বাপ্পা চোখ বড়-বড় করে তাকালুম।
বিশ্বমামা বললেন, একটু চুপ করে থাক।
হঠাৎ মিষ্টি মেয়েলি গলায় কে যেন বলে উঠল আজ মঙ্গলবার, ৭ সেপ্টেম্বর, এখন বেশ ভালো রোদ উঠেছে। কিন্তু বিকেলের দিকে বৃষ্টি হবে। রাস্তাটা ভালো নয়, একটু সাবধানে চালাও!’
কথাটা থেমে যাওয়ার পর বিশ্বমামা বললেন, দেখলি আমার গাড়ি কীরকম কথা বলে।
আমি বললুম, এটা গাড়ি-ভূত তো নয়, গাড়ি-পেত্নী হতে পারে। মেয়ের গলা।
বিশামা বললেন, তা ঠিক গাড়ি-পেত্নী শুনতে ভালো না। গাড়ি-পরী বললে কেমন হয়?
বাপ্পা বললে, আপনি গাড়িতে কোনও যন্ত্র লাগিয়েছেন।
বিশ্বমামা বললেন, এটা আমার আবিষ্কার করা যন্ত্র। আবহাওয়া বলে দেবে, রাস্তার অবস্থা বলে দেবে।
বাপ্পা বললে, আমার কাকার বাগানবাড়িতে আমরা শুনেছি, তা কিন্তু কোনও যন্ত্র হতে পারে না। বাগানে কে যন্ত্র বসাবে? তাছাড়া যখনই ও ধমকে বলে, দেখাচ্ছি মজা, তারপরই কারুর জ্বর হয়, কারও পা মচকায়, কারুর বমি হয়।
বিশ্বমামা বললেন, হাঁ!
টাকির সেই বাগানবাড়িতে পৌঁছে বিশ্বমামা খুব খুশি। বারবার বলতে লাগলেন, দারুণ বাড়ি। চমৎকার বাড়ি। এত খোলামেলা। এখানে এসে মাঝে-মাঝে থাকতে হবে।
বীরুকাকার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি সেই কথা শুনে বললেন, বিশ্ব, তুমি এসেছ, বেশ করেছ। যতদিন ইচ্ছে থাকে। কিন্তু বাগানের দিকে গিয়ে গোলমাল করো না।
বিশ্বমামা বললেন, বীরুকাকা আপনি ভূত পুষেছেন এখানে।
বীরুকাকা বললেন, আমি কুকুর পুষি না। বেড়াল পুষি না। ভূত পুষতে যাব কেন? ভূত কাকে বলে আমি জানিই না। তবে বাগানে কে একজন কথা বলে। আমরা কেউ ওদিকে যাই, সে পছন্দ করে না। তাই ধমকায়।
বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, আপনিও শুনেছেন?
বীরুকাকা বললেন, হ্যাঁ, একবার শুনেছি। আর ওদিকে যাই না। বিশ্বমামা বললেন, আপনার কোনও ক্ষতি হয়েছে? জ্বর কিংবা পেটের অসুখ?
বীরুকাকা বললেন, নাঃ, সেরকম কিছু হয়নি।
বিশ্বমামা বললেন, আপনি বাড়ির মালিক বলে আপনার কোনও ক্ষতি করেনি। কিন্তু আপনারই বাগান অথচ সেখানে আপনি যেতে পারবেন না, এটাই বা কেমন কথা!
বীরুকাকা বললেন, আমার ধারণা, আর কিছুদিন থাকলেই ওই ভূত আমাদের চিনে যাবে। তারপর কিছু বলবে না।
বিশ্বমামা বললেন, বীরুদা আপনি লটারিতে বহু টাকা পেয়ে এমন দুর্দান্ত একটা বাড়ি কিনেছেন। ওই টাকা নিয়ে আপনি সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, বাড়িতে দশটা কাজের লোক রাখতে পারবেন, সারাজীবন রোজ রাবড়ি খেতে পারবেন। কিন্তু একটা কী জিনিস পারবেন না বলুন তো? এই যে বিশ্ব আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কান ধরে ওঠবোস করাতে পারবেন? এক কোটি টাকা পুরোটা দিয়ে দিলেও পারবেন না।
বীরুকাকা অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে আমি কান ধরে ওঠ-বোস করাতে যাব কেন?
বিশ্বমামা বললেন, ছোটবেলা থেকেই আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে। আমাকে যদি কেউ ভূত দেখাতে পারে তার সামনে আমি দশবার কান ধরে ওঠ-বোস করব। সেই জন্যই আপনার বাগানে আমি দু-একবার যেতে চাই। ভূতকে আমি বিরক্ত করব না, তাড়াবারও চেষ্টা করব না। শুধু একবার দেখব।
বীরুকাকা বললেন, শুনেছি ভূত সবসময় চোখে দেখা যায় না। অশরীরী হয়ে থাকে। আমিও তো দেখিনি শুধু তার কথা শুনেছি।
বিশ্বমামা বললেন, কথা শুনলেও চলবে। কোনও মানুষ নেই, অথচ শূন্য থেকে কথা বলছে, তাও তো ভূতের কাণ্ডই বলতে হবে।
বীরুকাকা বললেন, যেতে চাও যাও, তবে সাবধানে থেকো। বেড়াতে এসেছ, তোমার কোনও ক্ষতি হোক, তা আমি চাই না।
তারপর চা-জলখাবার খেয়ে বিকেল বেলা বাগানের কাছে এসে বিশ্বমামা বললেন, নীলু, বাপ্পা, তোরা কোন জায়গায় ভূতের কথা শুনেছিস, সেই জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে দে। তোদের সঙ্গে যেতে হবে না। আমি একা যাব।
আমার ইচ্ছে ছিল, বিশ্বমামার সঙ্গে গিয়ে ব্যাপারটা কী হয় তা দেখা। কিন্তু বিশ্বমামা দারুণ গোঁয়ার মানুষ, একবার যখন বলেছেন একা যাবেন, তখন আর ওলটানো যাবে না।
বিশ্বমামা চলে গেল বাগানে। আমরা বসে রইলুম পুকুরটার ধারে। ঘন-ঘন তাকাচ্ছি বাগানের দিকে। খালি মনে হচ্ছে, এই বুঝি বিশ্বমামা দৌড়ে বেরিয়ে আসবে।
বিশ্বমামা বাগান থেকে বেরিয়ে এল প্রায় এক ঘণ্টা পরে। দৌড়ে নয়, আস্তেআস্তে হেঁটে।
এই রে, বিশ্বমামা ভূতের কথা শুনতে পাননি নাকি? বিশ্বমামা এত বড় বিজ্ঞানী, তাকে দেখেই কি ভূত ভয় পেয়ে চুপ করে গেছে।
বিশ্বমামা তার লম্বা নাকটার ওপর হাত তুলেছেন। ওটা দেখেই বোঝা যায়, ওর মাথায় কিছু একটা নতুন আইডিয়া এসেছে।
আমাদের কাছে এসে বললেন, বেশ সুন্দর বাগানটা। পিকনিক করার পক্ষে আদর্শ।
আমি কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিগ্যেস করলুম, বিশ্বমামা, তুমি কিছু শুনতে পাওনি?
সে আর উত্তর না দিয়ে বিশ্বমামা বললেন, বল তো, কোন গাছে বাজ পড়েছে, তা কী করে বোঝা যায়?
এখন এই সব কথা শুনতে কারুর ভালো লাগে?
আমি আবার জিগ্যেস করলুম, শুনতে পেয়েছ কিনা, সেটা আগে বলল।
বিশ্বমামা বললেন, হ্যা শুনেছি। খুবই স্পষ্ট। আমার ধারণা ছিল ভূতরা নাকি সুরে কথা বলে। তা কিন্তু নয়। অবিকল মানুষের মতন গলা।
বাপ্পা জিগ্যেস করল, সেখানে কোনও মানুষ ছিল?
বিশ্বমামা মাথা নেড়ে বললেন, না কোনও মানুষ ছিল না। আমি ভাললা করে দেখেছি। গাছের ওপরেও কেউ লুকিয়ে ছিল না।
বাপ্পা বলল, তবে?
বিশ্বমামা বললেন, মানুষ নেই, অথচ কথা বলছে। এতে রহস্যময় ব্যাপার বটেই। তবে কি এবার সত্যি সত্যি কান ধরে ওঠবোস করতে হবে? আর একটা দিন সময় দরকার। তোরা কথাটা কবার শুনেছিলি?
বাপ্পা বলল, আমি দুবার।।
আমি বললুম, আমি একবার শুনেই....
বিশ্বমামা বললেন, তারপর দৌড় মেরেছিলি, তাই তো? ঠিক আছে। রাত্তিরে বীরুদা কী খাওয়াবে? এইসব জায়গায় খুব ভালো কচি পাঁঠার মাংস পাওয়া যায়-মাংসের ঝােল আর লুচি যদি হয়।
আমরা ভেবেছিলুম, বিশ্বমামার জুর কিংবা বমি হবে। সেরকম কিন্তু কিছুই হল। দিব্যি লুচি মাংস খেলেন, তারপর ঘুমােত গেলেন তাড়াতাড়ি।
পরদিন সকালে উঠে ভূত বিষয়ে কোনও কথাই বললেন না। গাড়ি নিয়ে আমরা ঘুরলাম গ্রামে-গ্রামে। এখানকার নদীতে নৌকা চেপে বেড়ানোও হল। নদীর ধারেই একটা দোকানে গরম-গরম জিলিপি পাওয়া গেল, শিঙাড়া খেলুম প্রাণভরে। এক ঠোঙা নিয়েও আসা হল বীরুকাকার জন্য।
বীরুকাকা জিলিপি খেতে-খেতে জিগ্যেস করলেন, কী বিশ্ব, কিছু বুঝলে? তোমার মতন একজন বৈজ্ঞানিক, পৃথিবীতে কত দেশে বক্তৃতা দিতে যাও, তুমি কান ধরে ওঠবোস করবে, এটা ভাবতেই আমার মজা লাগছে।
কিছু না বলে বিশ্বমামা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
বীরুকাকা বললেন, অবশ্য, তোমাকে যে ওরকম করতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। আমি তো আর তোমার সঙ্গে বাজি ধরিনি। তুমি নিজেই ঠিক করেছ।
বিশ্বমামা বললেন, বীরুদা, আজ সন্ধেবেলা একবার আমার সঙ্গে বাগানে যাবেন?
বীরুকাকা বললেন, না, না, আমি তো বলেইছি ওসব অপদেবতাদের ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। সে তত আমাদের কোনও ক্ষতি করছে না। আমরাই বা তাকে ডিসটার্ব করতে যাব কেন? আর কথাটা বেশি রটে গেলে অনেক লোক ভিড় করে এসে ভূতের বাড়ি দেখতে চাইবে।
বিশ্বমামা বললেন, আমি ভূত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করব না। ডিসটার্বও করব না। একটা অন্য জিনিস দেখাব, নীলু আর বাপ্পাকে সঙ্গে নিতে পারি। কিন্তু ওদের ভয় পেয়ে দৌড়ানো চলবে না। না দৌড়ালে জ্বরও হবে না, পা-ও মচকাবে না।
সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর বেরিয়ে পড়লুম সদলবলে।
বাগানের মধ্যে ঢুকে বিশ্বমামা এমনভাবে এগোলেন, মনে হল উনি কোথায় যাবেন, আগে থেকেই ঠিক করা আছে।
একটা লম্বা গাছের কাছে গিয়ে তিনি থামলেন। সেটাকে গাছ বোঝাই যায় না। তালগাছ ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ওপরের ডালপালা কিছু নেই।
বিশ্বমামা বললেন, এই গাছটার ওপর বাজ পড়েছিল অনেক দিন আগে। সাধারণত এরকম লম্বা গাছের ওপরই বাজ পড়ে।
বীরুকাকা বললেন, বাজ পড়া গাছের সঙ্গে ওই ব্যাপারটার কী সম্পর্ক তা তো বুঝলাম না।
বিশ্বমামা বললেন, বুঝিয়ে দিচ্ছি। কেউ কোনও কথা বলবেন না। একদম চুপ। ভূতের রং কুচকুচে কালো।
তারপর ভূতের গলার আওয়াজ শোনার আগেই বিশ্বমামা চেঁচিয়ে বললেন, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।
সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন শোনা গেল, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।
আর কেউ নেই সেখানে, তবু শোনা গেল সেই কথা।
বিশ্বমামা একগাল হেসে বললেন, বীরুদা, নীলু, বাপ্পা, তোমরা তিনজনেই এই একই কথা শুনেছ?
তিনজনেই মাথা নেড়ে বললুম, হ্যা। বিশ্বমামা বললেন, ভূত কি শুধু এই একটাই কথা জানে? আর কিছু বলতে পারে না?
বিশ্বমামা এবার চেঁচিয়ে বললেন, রাধাকৃষ্ণ।
আর কিছু শোনা গেল না। বিশ্বমামা আবার বললেন, ময়না, বলো রাধাকৃষ্ণ।
এবার শোনা গেল, রাধাকৃষ্ণ। বীরুকাকা চোখ বড়-বড় করে বললেন, ময়না?
বিশ্বমামা বললেন, নিশ্চয়ই। টকিং বার্ড। অবিকল মানুষের গলা নকল করতে পারে। কারুর বাড়ির পোষা ময়না, আগেকার মালিক ওই কথাটা শিখিয়েছিল, চোরটোরদের ভয় দেখাবার জন্য। আপনি রাধাকৃষ্ণ বলতে শেখান, তাই শিখবে। রামসীতাও শেখাতে পারেন। ভূত তো কখনো রামনাম উচ্চারণ করে না।
আমাদের তিনজনেরই চোখে তখনই অবিশ্বাসের ছাপ দেখে বিশ্বমামা আবার বললেন, ময়না পাখি সাধারণত নির্জন জায়গায় বাসা বাঁধে। এমন গাছের ভেতরে থাকে, যে গাছে সাধারণত মানুষ ওঠে না। এই জন্য ওরা বাজ-পড়া গাছ বেশি পছন্দ করে। দেখবেন পাখিটা?
পোড়া তালগাছটা ধরে খানিকটা ঝাকাতেই তার ডগা থেকে ঝটপট করে একটা কালো রঙের পাখি বেরিয়ে উড়তে লাগল, আর বলতে লাগল, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা! রাধাকৃষ্ণ।
বিশ্বমামা বললেন, আমি ইচ্ছে করলে ওকে ধরে খাঁচায় রাখতে পার, কিন্তু আগেই কথা দিয়েছি, ওকে ডিসটার্ব করব না। ও থাক নিজের মতন!
বীরুকাকা বললেন, বিশ্ব, তোমাকে আর কান ধরে ওঠ-বোস করতে হল না। তার বদলে তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। কী চাও, বলো?
বিশ্বমামা বললেন, গলদা চিংড়ি ভাজা।
0 coment�rios: