ছোট ছোট পাহাড়। এধারে-ওধারে ঝোপঝাড়। পাশেই তিরতিরে ছোট্ট নদী। জলের নীচে পাথরকুচি দেখা যাচ্ছে। দুপুর বেলা। ছোট্ট টিকটিকি উলা খাবার খুঁজছে ঝোপে, ডালে, পাহাড়ের ফাঁকে। চুপ করে মাথা হেলিয়ে এধার-ওধার চোখ রাখছে। টুপ করে পোকা-মাকড় ধরছে, গিলেও ফেলছে। উলার পেছনে পেছনে ঘুরছে তিনটে ছোট্ট বাচ্চা টিকটিকি। তারই দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মা তাদের মুখেও মাঝে-মধ্যে ছোট্ট পোকা গুজে দিচ্ছে। মহা আনন্দ ছেলে-মেয়ের।
হঠাৎ উলা কেমন ভয় পেয়ে গেল। ঝোপের আড়ালে কিরকম যেন শব্দ হচ্ছে। অন্যরকম খসখস আওয়াজ। উলা মাথাটা ওদিকে নিল, এদিকে ঘোরালো। তেমন দেখলে সে ঠিক পালাতে পারবে। কিন্তু সঙ্গে রয়েছে তিনটে ছানাপোনা। ওরা তো তেমন বড় হয়নি, পালাবে কেমন করে? ওদের ফেলে উলা পালাবে কেমন করে? মা তো চুপ করে তাকিয়ে আছে। নড়ছে না, খাবার খুঁজছে না। বাচ্চা তিনটেও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। যেদিক থেকে শব্দ আসছে, উলা চোখ ঘুরিয়ে মাথা বেঁকিয়ে ভয়ে ভয়ে সেদিকে চেয়ে রইল। হঠাৎ একটা সাদা টিকটিকি ওপাশের ঘন ঝোপের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ল উলার ঠিক সামনে। ছেলে টিকটিকি। মাথা তুলে সামনের দুই পায়ে দেহ উঁচিয়ে সাদা টিকটিকি বলল, “আমি সাদা টিকটিকি। আমার নাম উইমবো। তুমি কালো দলের মেয়ে, তবু আমি তোমায় বিয়ে করব। পালাতে পারবে না। পালালে বাচ্চাদের মেরে ফেলব। চলো আমার সঙ্গে।
উলা পেছন ফিরে ছানাদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। বুকটা কেঁপে উঠল। চোখে চোখে কি কথা হল, উলা চলল উইমবোর পাশে পাশে, ছানারা চলল মায়ের পেছনে পেছনে। চারজনের বুক কাঁপছে।
গায়ে ঢুকছে উইম্বো। সর্দারের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সর্দার দাওয়ায় বসে বশ তৈরি করছিল। উইম্বো আর ওদের দেখে বুঝতে পারল। রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, "এই হতভাগা, ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে আনলি কেন? এক্ষুনি কালো দলের লোকেরা ছুটে আসবে। যুদ্ধ বাঁধবে। গাঁয়ে কি সাদা মেয়ের অভাব আছে? উটকো ঝামেলা বাঁধাস কেন? কে এখন এসব সামলাবে?
উইম্বো বলল, ‘গায়ের সবাই লড়ব। ওদের হারিয়ে দেব। সর্দার হাত নেড়ে বলল, ‘কেউ লড়বে না। কেন লড়বে? কেন মরবে? তুই করবি বিয়ে আর বিপদ হবে সবার? তোর হয়ে কেউ লড়বে না। কাউকে লড়তে দেব না।
উইমবো বলল, “বেশ, কাউকে লড়তে হবে না। আমি একাই লড়ব। বুদ্ধি করে ওদের হারিয়ে দেব। বিয়ে যখন একবার করেছি তখন বউকে ছাড়ছি না। বাচ্চাদেরও না। ভয় নেই, গাঁয়ের কারও কিছু হবে না। আমি একাই পারব।
সর্দারের বাবা কুঁজো হয়ে দাওয়ার একধারে বসে ছিল। সে বলল, পারবে, পারবে, ও একাই পারবে। ওর সাহস আছে, ওর আছে বুদ্ধি। ওদুটো থাকলে কেউ হারে না।
বুড়োর কথা কেউ শুনতে পেল না। সর্দার আবার বলল, ‘খুব কথা ফুটেছে মুখে। একা পারবি কেমন করে? ওরা তো আসবে দল বেঁধে।
উইমবো আর কিছু বলল না। নিজের বাড়ির দিকে চলল। ঘরে ঢুকে পড়ল। উলা আর বাচ্চারাও ঘরে ঢুকল।
সর্দার তাকিয়ে রয়েছে নদীর ওপারে। চোখ কচকে কপালে হাত রেখে শুধুই তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ বলে উঠল, “যা ভেবেছি ঠিক তাই। ওই আসছে কালো টিকটিকির দল। ছুটে আসছে। এই হতভাগা, যা এবার। কত সাহস দেখব।
কথা শেষ না হতেই গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো সবাই বাইরে বেরিয়ে এল। নদীর ওপারে দলে দলে কালো টিকটিকি। সবার হাতে তীর-ধনুক-বর্শা-লাঠি।
উইমবো ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার হাতে শক্ত কাঠের একটা মুখোশ। তাকে দেখেই সর্দার বলে উঠল, “যা, একাই যা। আমরা নেই ওসব বউ-চুরির মধ্যে?
ততক্ষণে উইমবো মুখে মুখোশ পরে নিয়েছে। হাতে একটা ছুঁচালো বর্শা নিয়ে ছুটে গেল নদীর পারে। গাঁয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সবাই দেখতে লাগল।
ছোট্ট নদী। উইমবো চেঁচিয়ে বলল, “সাহস থাকে এগিয়ে আয়। আমার নাম উইমবো।
শত্রুরা এগিয়ে আসছে। আরও কাছে, নদীর ওপারে। শত শত তীর ছুটে এল এদিকে। দেহ বেঁকিয়ে মুখটা সামনে রেখে হঠাৎ বসে পড়ল উইমবো। দেহে তীর বিঁধল না, অনেকগুলো তীর এসে মুখে লাগল। মুখোশে লেগে পড়ে গেল অনেক তীর। কাঠের শক্ত মুখোশ। কিছুই হল না তার। মুখ রয়েছে মুখোশের পেছনে।
উইমবো নড়ছে না, পড়ে রয়েছে মাটিতে। ওরা ভাবল, সে মরে গিয়েছে। একা এসেছে লড়তে ! একবার লড়াইতেই শেষ। আমাদের সঙ্গে লড়াই করা?
হঠাৎ উইমবো উঠে দাঁড়াল। হাত তুলে বর্শা বাগিয়ে ধরল। ওরা অবাক হল,—তাহলে শত্ৰু মরেনি!
আবার তীরের ঝাঁক। আগের চেয়ে শতগুণ বেশি। এধার-ওধার চারধার থেকে। আবার কায়দা করে বসে পড়ল সে। বর্শা তার হাতেই রইল। কিন্তু এবারও কিছু হল না তার। তীর দেহে বিঁধল না, মুখোশে লেগে পড়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পড়ে রইল উইমবো। এবার আর কি কৌশল করা যায় তাই ভাবছে। এর মধ্যে জল পেরিয়ে শত শত কালো টিকটিকি এপারে চলে এসেছে। তাকে চারধার থেকে ঘিরে ফেলল।
উইম্বো এটা বুঝতে পারেনি। চোখ তুলেই দেখে তার চারপাশে শত্রু। এবার পালাবে কোথায়? নাঃ, এবার বুঝি মরতেই হল। হঠাৎ উইম্বো দেহ বেঁকিয়ে লাফ দিল নদীর জলে। অনেক কালো টিকটিকি এদিকে এসেছিল জল পেরিয়ে—তাই জল ঘোলা হয়ে উঠেছে। জলের মধ্যে তারা আর উইমবোকে দেখতে পেল না।
কিন্তু দেখতে না পেলে কি হবে, ঝাঁকে ঝাঁকে তীর এসে পড়ল নদীর জলে। টুপ টুপ করে তীর পড়ছে জলে। উইমবো বুঝল, বিপদ আরও বেড়ে যাচ্ছে। কোন তীর যে কখন গায়ে লাগে !
হঠাৎ সে মুখের মুখোশ খুলে ফেলল। লুকিয়ে পড়ল বালি আর পাথরকুচির মধ্যে। হাঁফ ছাড়ল সে।
কাঠের মুখোশ। দু একবার ওলটপালট খেয়েই ভেসে উঠল জলের ওপরে। ওরা তাকিয়ে দেখল, ওটা জলে ভাসছে। কয়েকটা তীরও গিয়ে লাগল। কিন্তু ওটা আর পালাচ্ছে না। তাহলে? তাহলে উইমবো মরেই গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে চালাকি? উইমবো মরে জলে ভাসছে। হৈ হৈ করে আনন্দ করতে করতে কালো টিকটিকির দল ফিরে চলল। তারা নদীর ওপারে গেল। তারপর পাহাড়ের আড়ালে মিলিয়ে গেল।
এ গাঁয়ের সবাই দেখছে ওদের লড়াই। শত্রুরা ফিরে যাচ্ছে। সর্দার বলে উঠল, ‘অত সোজা একা লড়াই করা? হল তো! এমনি করে মরতে আছে? একটুও বুদ্ধি নেই। একা কখনও লড়াই করতে হয়? সর্দার বসে পড়ল দাওয়ায়।
গাঁয়ের সবার মন খারাপ। তারা ভাবছে, কি দরকার ছিল ওকে একা পাঠানো? না হয় বিয়ে করেই এনেছে। সর্দার অন্যদের পাঠাতে পারত। সর্দার নিষেধ করল, নইলে ওরাও যেত। কিন্তু সর্দার না বললে যায় কেমন করে? অনেক কিছু ভাবছে তারা।
হঠাৎ তারা দেখতে পেল, হাতে কাঠের মুখোশ নিয়ে উইম্বো ফিরে আসছে। সে হাসছে। এমনভাবে আসছে—তাহলে তো ওর গায়ে আঁচড়ও লাগে নি। সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
উইমবো গাঁয়ে ঢুকে সর্দারের দাওযার সামনে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, সর্দার, আমাদের মোড়ল, ওদের আমি হারিয়ে দিয়েছি। দেহের শক্তিতে নয়, বুদ্ধিতে। আমি একাই লড়েছি।
সর্দার নেমে এল দাওয়া থেকে। হাত বাড়িয়ে উইমবোর দু-কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুই পারবি, তুই পারবি আমাদের ভালো করতে। তোর অনেক বুদ্ধি। আমি বুড়ো হয়েছি। এবার তুই হবি গাঁয়ের সর্দার। আমরা সবাই তোকে মানব। আমাদের ভালো হবে, বিপদ-আপদ ঘটবে না। তোমরা জেনে রাখো—আজ থেকে উইম্বো হবে এই গাঁয়ের সর্দার, আমাদের গোষ্ঠীপতি।
পরবের মতো খাওয়া-দাওয়া হল। অনেক আনন্দ-গান-নাচ। সবার মনে আনন্দ। নতুন সর্দার আমাদের, আমাদের উইমবো।
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
0 coment�rios: