ভালুকের সঙ্গে দেখা হল এক ছোট্ট খরগোশের । কোনোকিছু না বলেই খরগোশের কান মলে দিল ভালুক ।
আহ' বলে চেঁচিয়ে উঠল খরগোশ । দু-গালে দুটো থাপ্পড় মেরে চলে গেল ভালুক। শক্তির বড়াই তার উপচে পড়ছে। খরগোশ কাঁদছে আর কাঁদছে। কানের ব্যথা মিলিয়ে গেল। তবু তার কান্না থামে না। এখন সে কী করবে? কেন সে ভালুকের সামনে পড়ল? তার কান বুঝি নষ্টই হয়ে গেছে! সাহায্যের জন্য কার কাছে সে যাবে? ভালুক অনেক শক্তিশালী। নেকড়ে আর শেয়ালও ভালুকের বন্ধু ।
আপন মনেই খরগোশ বলে ফেলল, ‘কে আমাকে সাহায্য করবে?’
কে একজন জবাবও দিল, “আমি করব।” বাঁ চোখের পানি মুছতে মুছতে খরগোশ দেখল, একটা মশা ।
‘তুমি কীভাবে সাহায্য করবে? ভালুককে কিছুই করতে পারবে না। সে অনেক বড়, তুমি অনেক ছোট। তোমার তেমন শক্তিও নেই।’মশা জবাব দিল, দেখই না।’ ভালুক সারাদিন গহন বনের এমাথা-ওমাথা ঘুরে বেড়াল। সে খুব ক্লান্ত । সন্ধেবেলায় তার দু-চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম । গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে ঝোপঝাড়ে আরাম করে শুয়ে পড়ল সে। যেই না তার চোখ বুজে এসেছে আমনি কানের পাশে বেজে উঠল পুন... পুন... ।
ভালুক জানে, এটা মশার গান। শ্বাস বন্ধ করে ভালুক চুপচাপ পড়ে রইল । মশা নাকের ডগায় বসলেই মজা দেখাবে। মাথার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মশা ঠিকই নাকের ডগায় বসল। থাবা দিয়ে ভালুক নিজের নাকে নিজেই থাপ্পড় মারল । মশা ততক্ষণে পালিয়ে গেছে ভো করে। ভালুক ডানদিকে কাত হয়ে আবার চোখ বুজল। সবে ঘুম এসেছে, আবার সেই পুনপুনানি । সময়মতো মশা এসে হাজির হয়েছে। ভালুক আবারও শ্বাস বন্ধ করল। ভাব দেখাল যেন সে ঘুমুচ্ছে । কান খাড়া করে মশার পুনপুন শুনছে ভালুক । কখন এসে মশা তার নাকে বসবে এই তার চিন্তা ।
মশার পুনপুন শব্দ হঠাৎ থেমে গেল। যাক বাচা গেল, ভাবল ভালুক। কিন্তু ততক্ষণে মশাটা ধীরে ধীরে ভালুকের কানে গিয়ে বসেছে। সর্বশক্তি দিয়ে বসিয়েছে এক কামড়। ভালুক লাফিয়ে উঠল। দু-থাবা দিয়ে ঘষতে লাগল কান। চোখে সরষে ফুল দেখল।
কান চুলকিয়ে চোখেমুখে হাঁচি দিয়ে ফের আরাম করে শুল সে । ঘুমঘুম আবেশে দু-চোখ তার বুজে এসেছে। কিন্তু সেই সময়ই কানের কাছে বেজে উঠল সেই একই গান, পুন... পুন। ভালুক গা ঝেড়ে উঠে বসল। অসহ্য এই যন্ত্রণা। চারদিকে মশা যেন ফাঁদ পেতে রেখেছে। আর সময় নষ্ট নয় । হাটতে শুরু করল ভালুক । ঝোপঝাড় পেরিয়ে চলল সে। কিন্তু পোড়া কপাল, মশা তার পিছু ছাড়ল না।
ভালুক দৌডুতে শুরু করল এবার। যতক্ষণ না সে ক্লান্ত হল, ততক্ষণ দৌডুল। তারপর এক ঝোপের ধারে বসল। জোরে শ্বাস দিতে নিতে কান চুলকাল বার কয়েক ।
জায়গাটা খুব নিরিবিলি। অন্ধকার । সব পশুপাখি ঘুমুচ্ছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। জোছনায় ভাসছে বন । শুধু একা জেগে রয়েছে ভালুক। খুব খারাপ লাগছে তার। কী যে হল!
নিজে নিজেই গজগজ করল সে । বেয়াদব মশাটা একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ল দেখছি। আগে একটু ঘুমিয়ে নিই। তারপর ধরব মশাটা।
ভালুক এক দেবদারু গাছে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমোল। চোখ বেয়ে নেমে এল রাজ্যের অন্ধকার। স্বপ্ন দেখতে শুরু করল সে : সারা বনে সে একা। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পেল এক মৌচাক । মধুতে ভরা। হাতের মুঠোয় সবে সে মৌচাক ধরেছে। অমনি পুন... পুন... সেই গান ভেসে এল ।
আবার ছোট্ট মশা এসে আরামের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল। জেগে উঠে ভারি রাগ হল ভালুকের। মাথার উপর চক্কর দিয়ে গান গাইছে তখন সেই মশা। কখনো কাছে, কখনো দূরে।
গানের সুরে সুরে মশা উপরে উঠতে লাগল। একসময় থামল সেই গান। ভালুক ভাবল, যাক রেহাই পেলাম। সে সরে গিয়ে ঝোপে ঢুকে ঘুমের সুযোগ খুঁজল ।
তক্ষুনি শুরু হল অনবরত কামড়। নাকে চোখে মুখে সে কী যন্ত্রনা। কামড়ে কামড়ে জ্বলে উঠেছে ভালুকের পা। অসহ্য জ্বালা। ‘বাঁচাও, বাঁচাও, চিৎকার করে কাঁদতে লাগল বেচারা ভালুক। সারা রাত দু’চোখের পাতা একবারও এক করতে পারল না সে।
‘হে মশা, কী অপরাধ আমার? তোমার কামড়ানো দয়াকরে বন্ধ কর। একমুহূর্তে আমার আর বেঁচে থাকতে মন চাচ্ছে না।’
সূর্য না ওঠা পর্যন্ত মশা জ্বালাতন করল।
একমুহূর্তে ঘুমোতে পারল না ভালুক। মুখচোখ তার ফুলে উঠেছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।
সূর্য উঠল। সারারাত আরামে ঘুমিয়ে জেগে উঠল বনের পশুপাখি। তারা সবাই গান গাইছে আনন্দে। সারা বনে কিচিরমিচির। ভালুক শুধু একা এই নতুন দিনের আনন্দে যোগ দিতে পারছে না।
সাত সকালে সেই খরগোশের সঙ্গে ভালুকের দেখা। একা একা হাঁটছে ভালুক, পা টলছে তার। কুব কষ্ট করে সে চোখের পাতা খুলে রখেছে। না ঘুমিয়ে শরীর তার ভারী হয়ে রয়েছে।
খরগোশ তাই দেখে মিটিমিটি হাসল। শক্তি বেড়াই দেখিয়েছিল ভালুক। উচিৎ সাজা পেয়েছে এখন। এমন সময় এল সেই মশা।
খরগোশ বলল, “ধন্যবাদ মশা ভাই, কী দিয়ে যে আপ্যায়ন করব!”
মশা মুখ টিপে হাসল, “ভালুকের অবস্থা তো দেখলে। আহা বেচারা!”
“দেখছি। কী যে হাসি পাচ্ছে আমার।” খরগোশ হাসতে হাসতে এলিয়ে পড়ল।
‘দেখলে তো? ছোট আর দুর্বল হয়েছি বলে কী হবে, বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে কীরকম নাস্তানাবুদ করলাম ভালুককে!’
বলেই মশা উড়ে গেল। আর ছড়িয়ে দিল তার গানের রেশ, পুন্... পুন্...।
0 coment�rios: