পার্কে আনন্দ বসেছিল। তাকে ঘিরে ক'জন বন্ধু। এক কোণায় রাজ্যের ডাই করা আবর্জনা। তা থেকে দুৰ্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ন্যাড়া গাছটার ডালে কয়েকটা কাক বসে ডাকছে।
অমল পিঠে হাত রেখে বলল, আনন্দ, এমন নিরানন্দ হয়ে বসে থাকিস না। উপায় একটা হবেই।
আনন্দের চােখে উদাস শূন্যতা, কী হবে? পয়সা কোথায়? অপারেশনের খরচ ষাট-সত্তর হাজার টাকা। সেদিন তো সঙ্গে ছিলিস। শুনেছিস । ডাক্তাররা তো বলেই দিল-এর কমে হবে না।
অমিত বলে, আমরা জানি। ও-রকম অপারেশনের খরচ ওই রকম। টাকাটা যোগাড় করতে হবে মাসিমার জন্য। আমরা সকলে সেটা করব। কিছু ভাবিস না।
—ভাবব না? চাকরি নেই। পড়াশুনা করে চাকরি যোগাড় হল না। অফিস থাকলে ‘লোন’ নিতে পারতাম। কোন বড়লোক আত্মীয়-স্বজন নেই। হাত পাতলে যারা সাহায্য করবে। টিউশনি ক’রে যা পাই তাতে মাস চলে না।.
সুজিত কথা থামিয়ে দেয়। বলে, এ আর নতুন কথা কি? আমরা সকলে গ্র্যাজুয়েট। সকলেই বেকার। বয়স সকলের প্রায় শেষ হয়ে এলো। চাকরি আর জুটবে না, সারা জীবন এ রকম বেকারই থাকতে হবে। আমাদের দেশের কোটি কোটি এরকম বেকারদের জন্য জনদরদী কোন নেতা ভাবে না। সরকারও ভাবে না।
সমীর ফোঁস করে উঠল, সরকার সরকার করিস না তো! সরকারের মন্ত্রিগুলোর কেচ্ছাকাহিনী কাগজে দেখছিস না ? কত রকমের কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আছে নিজেরাই। বড় বড় চুরি। বড় বড় রাহাজানি। বড় বড় ডাকাতি। ওরাই আবার ভাববে। আমাদের কথা ?
আনন্দ মাথা তোলে কি বলছিস তুই! সরকারের কেউ কেউ অসৎ ব’লে তো সকলে অসৎ নয়।
—বেশ, তা স্বীকার করি। কিন্তু কিছু যদি সৎ থাকে তা দিয়ে হয় না। দু’জন মস্তান বিশজন মানুষের সামনে মস্তানি করে বেরিয়ে যায়। ভয়ে আর সব চুপ করে থাকে। পাঁচজন লোক রেললাইনে বসে ট্রেন আটকায়। কয়েকশ লোক স্টেশনে থাকলেও ঝামেলা এড়াতে-স্পিকটি-নট। আর সরকারের কথা বলিস না। প্রশাসনের কথা বলিস না। কোনটা করছে তারা? পুলিশ বাঁ-হাতে টাকা নিয়ে গাল, চাটছে তোলাবাজাদের আর ডাকাতদের।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমল বলে, কি ভাবছিস তোরা ?
অমিত বলে, ভাবি নি। তবে আমাদের ভাবতে হবে। আনন্দের মা তা বলে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে?
সুজিত বলে, অপারেশনের টাকা যেভাবেই হােক যোগাড় করতে হবে আমাদের ।
সমীর বলে, ঠিক। এই কথা আমি বলতে চাইছিলাম। আর টাকা যোগাড় করবই। যে ভাবে হােক।
কদিন পর। তখন বিকেল তিনটে । চারতলার একটা ফ্ল্যাটে কলিংবেল বেজে উঠল। সুরেলা এক মিষ্টি আওয়াজ ভরে উঠল ভেতরে।
ভিতরে ছিলেন এক বৃদ্ধা। তিনি দরজা খুললেন। দেখলেন,-চার-পাঁচজন ছেলে।
বললেন, পুজোর চাঁদা? চাঁদা। আমি তো দিতে পারব না। তোমাদের আসতে হবে তা হলে সাড়ে চারটে পাঁচটায়। বৌমা না এলে...............
—জানি। কাকিমা স্কুল থেকে ফেরেন চারটের পর। কিন্তু আমরা চাঁদার জন্য আসিনি, ঠাকুমা।
—তবে ?
—আমরা এসেছি। একটা সমস্যায়। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি পরামর্শ দিয়ে সমাধান করতে পারবেন।...একটু ভিতরে কি বসব ?
বৃদ্ধা বললেন, বসবে? আজকাল যা দিন এসেছে কাকে বা বিশ্বাস করে ঘরে বসাই।
ছেলেদের একজন বলে উঠল, ঠিক বলেছেন, ঠাকুমা। দুপুরের দিকে বাড়িতে কেউ নেই দেখে, ফেরিওয়ালারা দরজায় কড়া নেড়ে—কাপড়-চােপড় থালাবাসন বিভিন্ন কসমেটিক বিক্রির ছুতোয় ডাকাতি করে যাচ্ছে।
এরপর এক একজন বলে চলল।
—এখন দুপুর নয়। তিনটে বাজে।
—আমরা কিন্তু ফেরিওয়ালা নাই।
—কেবল আপনার সঙ্গে দরকার বলেই.........
বৃদ্ধা বললেন, এসো। বসো। কি বলছ শোনা যাক।
ছেলেগুলাে সব এবার সােফায় বসে পড়ে।
খুব বিনীত ভাবে একজন আরম্ভ করে।—ঠাকুমা। আমাদের বন্ধুটির মা খুবই অসুস্থ। নার্সিংহােমে ভর্তি আছে। দু-একদিনের মধ্যে অপারেশন হবে। অথচ বন্ধুটি বেকার। বি.এ. পাস। কিন্তু কোন চাকরি নেই। আমরা যে সাহায্য করব।—তার উপায় নেই। সবাই বাবার হােটেলে খাই। আমরা কেউ বি.কম. কেউ বি.এস.সি. কেউ এম.কম। সে-রকম মামা খুঁজে না পাওয়ায় কেউ চাকরি যোগাড় করতে পারিনি।
অথচ আমরা ওকে সাহায্য করতে চাই।
আমরা যে-যার আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরেছি। কেউ কিছু দিতে রাজি হয় নি। সবাই-এর প্রশ্ন, শোধ দেবে কি করে?
তাই আপনার কাছে এসেছি। বন্ধুটি এসেছে, আমরাও এসেছি। বসাককাকু আমাদের কারোর আত্মীয় নন-জেনেও । অথচ, তিনি একজন মানুষ। একজন বিত্তবান মানুষ। বসাক জুয়েলারি স্টোর্সের মালিক। তিনি কি অপারেশনের খরচ ষাট-সত্তর হাজার টাকা ধার দিতে পারেন না? আমরা কিছু বন্ধক রেখে ধার নিতে পারব না। সততার জামিনে এই কার্জ পেতে চাই। একদিন না একদিন আমরা শোধ দেবই।
বৃদ্ধ অর্থাৎ বসাক জুয়েলারি স্টোর্সের মালিকের মা বললেন, অতগুলো টাকা কেউ কি এরকম ভাবে দিতে পারে, বাবারা। আমার ছেলে কেন, অন্য কোন বড় বিত্তবান মানুষ-কেউ পারবে না।
ছেলেগুলো প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, ‘বাবা’ বলবেন না, ঠাকুমা। আমরা সকলেই আপনার নাতি।
—নাতি?
—হ্যাঁ।.জানি আপনার বৌমার কোন ছেলে নেই। আমরা আপনার বৌমার ছেলে মানে আপনার নাতি হতে পারি না ?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ তা পারো বই কি ?
—তবে কি আমরা এই বন্ধুর মায়ের অপারেশনের টাকাটা আপনার কাছ থেকে পাব না ?
বৃদ্ধা দোলাচল মনে বললেন, তা কি করে হয়। তারপর পাঁচজনের দু’জন বসে রইল সোফায়। তিনজন উঠে দাঁড়াল। ঠাকুমা, বাথরুমটা কোন দিকে? একটু বাথরুম থেকে আসি।
দুজন বৃদ্ধর সঙ্গে গল্প করে চলেছে। আর তিনজন তখন ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানার তোষকের নীচ, কিংবা ড্রায়ার টেনে খুঁজে নিতে ব্যস্ত আলমারির চাবি।
চাবি খুঁজেও পেয়েছে।
আলমারি খুলে পেয়েছে কিছু সোনার গয়না ও নগদ টাকা। সেগুলো ভরে নিয়েছে এক সাইড ব্যাগে। তারপর কেউ হাতে পিস্তল-কেউ হাতে ছোরা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল বৃদ্ধার।
বৃদ্ধা আঁতকে ওঠেন, একি ? তোমরা ভাল মানুষ সেজে ডাকাতি করতে এসেছিলে ?
—চোঁচামেচি করবেন না, ঠাকুমা। একদম না। তাহলে অন্য কিছু করে ফেলতে আমরা পিছপা হব না। প্লিজ ঠাকুমা প্লিজ।.
আর, আমরা ভালমানুষ সেজে নয়, আমরা এখনও ভাল মানুষ। আপনার কাছে অনুরোধ রেখে, কিছু পাওয়ার আশ্বাস পাইনি। তাই আমরা ডাকাত নয়; ডাকাত সেজেছি। বন্ধুর মায়ের অপারেশনে যেমন খরচ লাগে—সে মত গয়না ও নগদ নিয়ে চলে যাচ্ছি।
চলে যাওয়ার সময় সকলে একে একে পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করে বৃদ্ধাকে।
—আশীর্বাদ করুন, ঠাকুমা। যেন আমাদের আর কোনদিন এরকম ডাকাতি করতে না হয়।
0 coment�rios: