সবে শীত পড়েছে। দিন ছােট হতে শুরু করেছে। খেয়েদেয়ে সকাল সকাল শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরেছিলাম যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতেই রাঙা দ্বীপে পৌঁছতে পারি। আমরা ভেবেছিলাম এক আর হল আর এক। দলের কয়েকজন ভীড়ের জন্য ট্রেন থেকে নামতে পারল না, তাদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সবাই মিলে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শুনি এ রাস্তায় কদিন থেকেই বাস বন্ধ। অগত্যা সাইকেল ভ্যানে করে যখন জামতলা পৌঁছলাম। তখন সন্ধ্যে গাঢ় হয়েছে। ভাগ্য ভাল, ঘাটে একটা ভুটভুটি ছিল অনেক অনুরোধের পর সে রাজি হল আমাদের রাঙাদ্বীপে পৌঁছে দিতে। ছজনের দলটি যখন রাঙাদ্বীপের ঘাটে কাদায় হাবুডুবু খেতে খেতে ডাঙার দিকে আসছি তখন ঘোর অন্ধকার। ভুটভুটির সারেং হ্যারিকেন নিয়ে আগে আগে চলেছে। আগে থেকে খবর পাঠানো ছিল আমরা আসছি। সুতরাং আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা পাকা ছিল। কোন ক্রমে স্কুল বাড়িতে ঢুকে খেয়ে নিয়েই সবাই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।
রাঙাদ্বীপে আমরা অবশ্য নতুন নয়। এটা দ্বিতীয়বার আমাদের আসা। সুন্দরবনের মধ্যে একটা বড় দ্বীপ এই রাঙাদ্বীপ। অনেক লোকের বাস। এখানকার মানুষজন খুব ভালো আর সরল। রাঙাদ্বীপের অগ্রগতি ক্লাব অনেক বছর ধরে একটা বড় জমাটি ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আশপাশের পাঁচ সাতটা দ্বীপ থেকে ভুটভুটি করে ছেলে বুড়ো সব খেলা দেখতে আসে। অন্য কোন বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় ফুটবল প্রতিযোগিতাটা এখানকার মানুষ চেটেপুটে উপভোগ করে। জেলার দলগুলোতো আছেই সঙ্গে কোলকাতা, হাওড়ার অনেক দলই এই প্রতিযোগিতায় খেলতে আসে। আমাদের ক্লাব ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন গত বছরই এই প্রতিযোগিতায় খেলতে আসে। শুধু খেলতে আসা নয়। সবার মন জয় করে আমরা চ্যাম্পিয়ানও হয়েছিলাম। এবার উদ্যোক্তারা তাই আমাদের স্পেশাল খাতির করে ডেকেছে। খেলা শুরু দিন তিনেক পর। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে সুন্দরবন বেড়াবার। উদ্যোক্তাদের বলে কয়ে আমরা ছয়জন তাই আগেই হাজির হয়েছি। দলের সবাই পরে আসবে।
তখন গভীর রাত, পথের ক্লান্তিতে ঘুমটা খুব জমাট হচ্ছিল, হঠাৎ কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে টিম টিম করে একটা কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। আবছা আলোয় দেখলাম সঙ্গীরা ঘুমোচ্ছে। পাশ ফিরে চোখ বুজিয়েছি...মনে হল কারা যেন চাপা গলায় কথা বলছে। গ্রামে গঞ্জে শুনেছি। এখনো ভূত-টুত আছে। ভয় পেয়ে অপুকে ডাকলাম। ঘুমকাতুরে অপু হ্যাঁ, হুঁ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক ঠক শব্দ। তড়াক করে বিছানার উপর বসে দেখি আপু কেন সবার ঘুম ছুটে গেছে। অবাক হয়ে আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি আবার ঠক ঠক ঠক। এবার আমরা বেশ ভয়ই পেলাম। ঘরের বাইরে একাধিক লোকজনের কথা আর নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছি। খেলার মাঠে অপু, ডাকাবুকো ব্যাক হলেও বাস্তবে অপুই সবচেয়ে ভয় পেল। গোলকিপার তিমির দরজা খুলবে বলে টর্চ নিয়ে এগোচ্ছে এমন সময় মড় মড় মড়াৎ। দরজাটা ভেঙে পড়ল। ভাঙা দরজা দিয়ে হুড় হুড় করে কয়েকটা লোক ঘরে ঢুকে পড়ল। লোকগুলোর মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। ষণ্ডামার্কা চেহারা। সবার হাতে তেল চুকচুকে লম্বা লাঠি। একজন দরজা আগলে দাঁড়িয়ে, যাতে আমরা পালাতে না পারি। বুঝতে পারলাম ভূত-টুত নয় ডাকাত পড়েছে। তিমির বলল “আপনারা বোধহয় ভুল করছেন আমরা খেলতে এসেছি। সঙ্গে কিছু নেই।” সর্দার মত একটা লোক বলল-আমরা ভুল করিনি। চলুন। ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুন।
বুঝলাম প্রতিবাদ করে লাভ নেই। ভয়ে ভয়ে ঘর থেকে বেরোলাম। আড় চােখে গুনে দেখি দশ দশ জন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছি। গভীর গলায় এক ডাকাত বলল—“পা চালিয়ে চলুন।”
অপু ভয়ে বলে ফেলল—“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ?”
—কথা বলবেন না ।
অন্ধকারে হােঁচটি খেতে খেতে এগোতে থাকি আমরা। ডাকাত দলের নির্দেশ মত ঘাটে বাঁধা ভুটভুটিতে উঠতে হল আমাদের। অবশ্য ডাকাতগুলো আমাদের কোলে তুলে ভুটভুটিতে তোলায় কাদা মাড়াতে হল না। অন্ধকারে নদীতে বিকট শব্দ করতে করতে ভুটভুটি চলতে থাকল। নিথর নিস্তব্ধ পরিবেশে কেবল ভুটভুটির যান্ত্রিক শব্দ। সেই শব্দকেও ছাপিয়ে শুনতে পাচ্ছি নিজেদের বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ। ডাকাতদের কি উদ্দেশ্য, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে কিছুই জানি না। আর জানলেও করার কিছু নেই। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কানে এলো ডাকাতের নির্দেশ—“বাবুরা এবার নামতে হবে।” ডাকাতের মুখে ‘বাবুরা’ সম্বোধন শুনে আমরা আরো ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু নির্দেশ অমান্য করার সাহস না দেখিয়ে সবাই সুড় সুড় করে নেমে পড়লাম। দিনের আলো ফুটতে শুরু হয়েছে। যতদূর বুঝতে পারছি আমাদের অন্য কোন দ্বীপে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। একটা মাটির বাড়ির সামনে এসে ডাকাত দলের একজন হাঁক পাড়ল—“বাবুরা এসে গেছেন।” ভেতর থেকে এক প্রৌঢ় বেরিয়ে আন্তরিক ভাবে বললেন—“এমন ভাবে ধরে আনতে হল বলে দুঃখিত। আপনারা ভেতরে আসুন।”
ভদ্রলোকের কথায় কিঞ্চিৎ ভরসা পেয়ে বললাম-কিন্তু আমাদের ধরে আনার কারণটা কি ?
—সব বুঝতে পারবেন। আপাতত আপনারা বন্দী। আমাদের সতর্ক পাহারা আছে, পালাবার চেষ্টা করবেন না। খানদান, মাঠে খেলুন, ভুটভুটি নিয়ে বনে বেড়ান...কিন্তু খবরদার, পালাবার চিন্তা মনেও আনবেন না।
তিমির বলল—“কিন্তু আমাদের আটকে কোন লাভ হবে না। মুক্তিপণ-টণ দেবার মত অবস্থা আমাদের নয়। আপনারা শুধু শুধু...।” কান্নায় বুজে আসে তিমিরের গলা ।
প্রৌঢ় বললেন—“ভয় পাবেন না। মুক্তিপণ আদায় আমরা করব না। আপনাদের শুধু একটা কাজ করে দিতে হবে, ব্যাস। শুনুন চিন্তা করবেন না বাড়ির ঠিকানা দিন, সাবায়ের বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেব।”
অগত্যা ছয়জন বাড়ির ঠিকানা বলে ব্যাজার মুখে বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখি আমাদের জন্য এলাহী ব্যবস্থা। বড় বড় কাঁসার থালায় ভাত, মাছের মুড়ো, চিংড়ি মাছের ঝাল আরো কত কী। ব্যাপারটা কি কিছুই বুঝতে পারছি না। বন্দীদের প্রতি এমন জামাই আদর করা হয়। ধারণা ছিল না।
প্রথম দিনটা খুব উদ্বেগে কাটল। কিন্তু পরের দিন থেকে মনেই হল না। আমরা বন্দী। প্রৌঢ় ভদ্রলোক সব ব্যবস্থা করেছেন—খাওয়া দাওয়া, সুন্দরবন বেড়ানো, বাস। খবরের কাগজ জোগাড় করে দেওয়া...সব। চতুর্থ দিন সকালে প্রৌঢ় বললেন— আর মাত্ৰ কটা দিন। আপনাদের আটকে রাখব। এই কদিনে আপনারা আমাদের জন্য দুটাে কাজ করে দেবেন।”
বন্দীত্ব ঘুচবে গুনে উৎসাহে অপু বলে—“কি কাজ বলুন না। এখনই করে দিচ্ছি।
—ব্যস্ত হবেন না। আপনাদের কোন ক্ষতি আমরা করব না। কাল সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে আমরা এক জায়গায় যাব। যাবার পথে বলব কি কাজ।
মুক্তি পাব বলে খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু কি কাজ, না পারলে কি শাস্তি হবে-এই সব ভেবে আবার একটা ভয় চেপে ধরল। অবশ্য যারা আমাদের চুরি করে এনেছে তাদের হাবভাব, আচার-আচরণ কিন্তু ডাকাতসুলভ নয়। উপরি যে গ্রামে আমরা নজরবন্দী সেই গ্রামের ছেলে।পুলেরা আমাদের দলটাকে দেখলে বেশ সমীহ করছে।
সেদিন সকাল সকাল খেতে দিল। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বেলা বারোটা আন্দাজ-একদল লোক এসে বলল—“তৈরি হয়ে নিন বেরোতে হবে।” বাধ্য ছেলের মত বাড়িটা থেকে বেরিয়ে বুক শুকিয়ে গেল। সারা পাড়ার যত ছেলে বুড়ো জড়ো হয়েছে বাড়ির সামনে। সঙ্গে ঢাক ঢোলও আছে। আমরা বেরোতেই পাড়ার মেয়ে বৌরা ফুলের মালা আর চন্দনের টিপ পরিয়ে দিল। কালীঘাটের মন্দিরে ছাগল বলি দেবার সময় ছাগলটাকে যেমন মালা চন্দন পরানো হয় তেমন হতে লাগল আমাদের সাথে৷ কথাটা ফিসফিস করে অপুকে বলতেই অপু ভেউভেউ করে কেঁদে উঠল—“আমাদের কি বলি দেবেন আপনারা।” জনতা হৈ হৈ করে উঠল। এবার আমরা সবাই ভয় পেলাম, মুখ কাঁদ কাঁদ আর আমাদের অবস্থা দেখে জমায়েতে হাসির রোল উঠিল, ঢাক বেজে উঠল। আমাদের সামনে রেখে জনতা হাঁটতে শুরু করল। আমরা কাকুতি মিনতি করতে লাগলাম বাঁচার জন্য। কে শোনে কার কথা। কোল পাঁজা করে ভুটভুটিতে নিয়ে তুলল। এবার আর কান্না চাপতে পারলাম না, সবাই কেঁদে ফেললাম। নিশ্চিত মৃত্যু সামনে দেখতে পাচ্ছি। প্রৌঢ় ভদ্রলোক উঠতেই ভুটভুটি চলতে শুরু করল। প্রৌঢ় কাছে আসতে তার পায়ে পড়লাম। প্রৌঢ় বললেন—“তোমাদের বাঁচাতে পারি কিন্তু দুটাে কাজ করতে হবে।” সমস্বরে বললাম-করব! করব!
প্রৌঢ় বললেন— ‘তবে ধৈর্য ধরুন।’ ইতিমধ্যে আমাদের পিছনে আরো পাঁচখানা ভুটভুটিতে গ্রামের লোক ভর্তি হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ চলার পর মনে হল নদীর ধারের দৃশ্য চেনা লাগছে। তিমির বলল—‘আরো এ যে রাঙাদ্বীপ!’
সত্যিই তো আমাদের ভুটভুটি রাঙাম্বীপের ঘাটে ভিড়ছে। ঘাটের আশপাশে প্রচুর নৌকা, ভুটভুটি, ট্রলার দাঁড়িয়ে। চারিদিকে খুব ভীড়। অপু আক্ষেপ করে বলল—ইশ! কোথায় এই দ্বীপে খেলব, না ডাকাতের খপ্পরে পড়লাম।
প্রৌঢ় বললেন—নামতে হবে।
আশ্চর্যের ব্যাপার প্রৌঢ় আর তাদের গ্রামের লোকজন আমাদের নিয়ে খেলার মাঠের দিকেই চলেছে। মাঠের কাছে গিয়ে প্রৌঢ় বললেন—“বাছারা কোন প্রশ্ন না করে খেলার জামা, গেঞ্জি, বুট করে নাও।” আমাদের পরার জন্য জার্সি দেওয়া হল। ধরাচূড়ো পরে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছি। প্রৌঢ় বললেন—“বাবারা তোমাদের কাজ আর কিছু নয়। আমাদের গ্রামের ক্লাবের হয়ে খেলে দুটাে ম্যাচ জিততে হবে।”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বললাম—“সে আগেই বলতে পারতেন। শুধু শুধু এই কটাদিন আমরা কি না চিন্তা করলাম।”
প্রৌঢ় বললেন— দুঃখিত বাবারা। কিন্তু কি করব বল। এত বছর প্রতিযোগিতা হচ্ছে অথচ স্থানীয় কোন দল আজ পর্যন্ত জিততে পারল না। গত বছর তোমাদের খেলা দেখে ভালো লাগে। তখনই ঠিক করেছিলাম আমাদের দলের হয়ে তোমাদের খেলাব। এবছর অনেক কষ্টে আমাদের দল সেমিফাইনালে উঠেছে। আর মাত্র দুটাে খেলায় জিতলে সুন্দরবনের ধ্বজা আকাশে উড়বে। বাবারা তোমরা ভরসা। অনেক অবিচার করেছি তোমাদের ওপর। কিন্তু সুন্দরবনের মানুষের মন থেকে হেরো তকমা তোলার জন্য তোমাদের ধরে আমাদের দলে খেলাচ্ছি। অপরাধ হলে ক্ষমা কর।” প্রৌঢ়ের চোখে জল। প্রৌঢ় যখন কথা বলছিল গ্রামের সমর্থকরা আমাদের ঘিরে ধরেছিল। তাদের প্রত্যেকের চোখে একই আকুতি—“আমরা জিততে চাই।” আমাদের দলনেতা তিমির বলল—“ঠিক আছে আমরা খেলাব।”
মাঠে নেমে শুনি সুন্দরবন ক্লাবের হয়ে সেমিফাইনালে আমাদের খেলতে হবে সেই ফ্রেন্ডস ইউনিয়ানের বিপক্ষে যেখানে খেলে আমরা বড় হয়েছি। অর্থাৎ আমাদের নিজেদের ক্লাবের বিরুদ্ধে। ধন্দে পড়লাম, সুন্দরবন ক্লাবের কর্তাদের অনুমতি নিয়ে আমরা ছুটলাম ফ্রেন্ডসের কোচ আমাদের প্রিয় বাবুদার কাছে। তাকে সব বলতে তিনি অনুমতি দিয়ে বললেন—যারা খেলাকে এত ভালোবাসে তাদের হয়ে খেলা গৌরবের।” ব্যাস সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছেড়ে আমরা সুন্দরবন ক্লাবের হয়ে খেললাম। দু দুটাে খেলাতেই জিতে চ্যাম্পিয়ান হলাম। ঢাক ঢোল বাজিয়ে সবাই খুব মজা করতে লাগল।
পরদিন আমাদের মুক্তির দিন। বিদায় জানাতে এলো গ্রামের সবাই। প্রৌঢ় বললেন—“বুনো ডাকাতদের ক্ষমা কোরো বাবারা।”
দলনেতা তিমির বলল—“আগামী বছরও আপনাদের দলের হয়ে খেলব।”
আনন্দে আর কৃতজ্ঞতায় ভেউ ভেউ করে কাঁদেত লাগল গ্রাম ভর্তি শতেক বুনো ডাকাত, কাঁদতে লাগল শহুরে ছটা ছেলেও।
0 coment�rios: