চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে টেনিদা বললে, ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক ।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, তার মানে কী ?
টেনিদা টক টক করে আমার মাথার ওপর দুটো টোকা মারল। বললে, তোর মগজ-ভর্তি খালি শুকনো ঘুটে—তুই এ-সব বুঝবিনি। এ হচ্ছে ফরাসী ভাষা ।
আমার ভারি অপমান বোধ হল । —ফরাসী ভাষা ? চালিয়াতির জায়গা পাওনি ? তুমি ফরাসী ভাষা কী করে জানলে ?
টেনিদা বললে, আমি সব জানি ।
—বটে ?—আমি চটে বললুম, আমিও তা হলে জার্মান ভাষা জানি ।
—জার্মান ভাষা ?—টেনিদা নাক কুঁচকে বললে, বল তো ?
আমি তক্ষুনি বললুম, হিটলার—নাৎসি—বার্লিন-কটাকট।
হাবুল সেন বসে বসে বেলের আঠা দিয়ে একমনে একটা ছেড়া ঘুড়িতে পট্টি লাগাচ্ছিল। এইবার মুখ তুলে ঢাকাই ভাষায় বললে, হঃ, কী জার্মান ভাষাডাই কইলি রে প্যালা ! খবরের কাগজের কতগুলিন নাম—তার লগে একটা কটকট জুইড়া দিয়া খুব ওস্তাদি কোরতে আছস ! আমি একটা ভাষা কমু ? ক দেখি—“মেকুরে হুড়ম খাইয়া হক্কৈড় করছে—এইডার মানে কী ?
টেনিদা ঘাবড়ে গিয়ে বললে, সে আবার কী রে! ম্যাডাগাস্কারের ভাষা বলছিস বুঝি ?
—ম্যাডাগাস্কার না হাতি !—বিজয়গর্বে হেসে হাবুল বললে, মেকুর কিনা বিড়াল, হুড়মা খাইয়া কিনা মুড়ি খাইয়া—হক্কৈড় করছে—মানে এঁটো করেছে।
হেরে গিয়ে টেনিদা ভীষণ বিরক্ত হল।
—রাখ বাপু তোর হুডুম দুডুম—শুনে আকেল গুডুম হয়ে যায়। এর চাইতে প্যালার জার্মান ‘কটাকট’ও ঢের ভালো ।
বলতে বলতে ক্যাবলা এসে হাজির ৷ চোখে প্রায় অদ্ধেকটা বুজে, খুব মন দিয়ে কী যেন চিবুচ্ছে। দেখেই টেনিদার চোখ দুটো জুলজুল করে উঠল।
—অ্যাই, খাচ্ছিস কী রে ?
আরও দরদ দিয়ে চিবুতে চিবুতে ক্যাবলা বললে, চুয়িং গাম।
—চুয়িং গাম!—টেনিদা মুখ বিচ্ছিরি করে বললে, দুনিয়ায় এত খাবার জিনিস থাকতে শেষে রবার চিবুচ্ছিস বসে বসে। এর পরে জুতোর সুখতলা খাবি এই তোকে বলে দিলুম। ছ্যাঃ ।
আমি বললুম, চুয়িং গাম থাক। কাল যে বিশ্বকর্মা পুজো—সেটা খেয়াল নেই বুঝি ?
টেনিদা বললে, খেয়াল থাকবে না কেন ? সেই জন্যেই তো বলছিলুম, ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিসি
ক্যাবলা পট করে বললে, মেফিস্টোফিলিস মানে শয়তান ।
—শয়তান !—চটে গিয়ে টেনিদা বললে, থাম থাম, বেশি পণ্ডিতি করিসনি। সব সময় এই ক্যাবলাটা মাস্টারি করতে আসে । কাল যখন মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক করে আকাশে উড়বে—তখন টের পাবি ।
—তার মানে ? —আমরা সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলুম।
—মানে ? মানে জানবি পরে—টেনিদা বললে, এখন বল দিকি, কাল বিশ্বকর্মা পুজোর কী রকম আয়োজন হল তোদের ?
আমি বললুম, আমি দু ডজন ঘুড়ি কিনেছি। হাবুল সেন বললে, আমি তিন ডজন। ক্যাবলা চুয়িং গাম চিবুতে চিবুতে বললে, আমি একটাও কিনিনি। তোদের ঘুড়িগুলো কাটা গেলে আমি সেইগুলো ধরে ওড়াব।
টেনিদা মিটমিট করে হেসে বললে, হয়েছে, বোঝা গেছে তোদের দৌড় । আর আমি কী ওড়াবা জনিস ? আমি—এই টেনি শর্মা ?—টেনিদা খাড়া নাকটাকে খাঁড়ার মতো উঁচু করে নিজের বুকে দুটো টোকা মেরে বললে, আমি যা ওড়াব—তা আকাশে বোঁ বোঁ করে উড়বে, গোঁ গোঁ করে এরোপ্লেনের মতো ডাক ছাড়বে—হুঁ! ডি-লা-গ্র্যান্ডি—
বাকিটা ক্যাবলা আর বলতে দিলে না। ফস করে বলে বসল : ঢাউস ঘুড়ি বানিয়েছ বুঝি?
—বানিয়েছ বুঝি ?—টেনিদা রেগে ভেংচে বললে, তুই আগে থেকে বলে দিলি কেন ? তোকে আমি বলতে বারণ করিনি ?
ক্যাবলা আশ্চর্য হয়ে বললে, তুমি আমাকে ঢাউস ঘুড়ির কথা বললেই বা কখন, বারণই বা করলে কবে ? আমি তো নিজেই ভেবে বললুম।
—কেন ভাবলি?--টেনিদা রকে একটা কিল মেরেই উঃ উঃ করে উঠল : বলি, আগ বাড়িয়ে তোকে এ-সব ভাবতে বলেছে কে র্যা ? প্যালা ভাবেনি, হাবলা ভাবেনি—তুই কেন ভাবতে গেলি ?
হাবুল সেন বললে, হ, ওইটাই ক্যাবলার দোষ । এত ভাইব্যা ভাইব্যা শ্যাষে একদিন ও কবি হইব।
আমি মাথা নেড়ে বললুম, হুঁ, কবি হওয়া খুব খারাপ। আমার পিসতুতো ভাই ফুচুদা একবার কবি হয়েছিল। দিনরাত কবিতা লিখত। একদিন রামধন ধোপার খাতায় কবিতা করে লিখল :
পাঁচখানা ধুতি, সাতখানা শাড়ি
এ—সব হিসাবে হইবে কিবা ?
এ-জগতে জীব কত ব্যথা পায়
তাই ভাবি আমি রাত্ৰি-দিবা ।
রামধনের ওই বৃদ্ধ গাধা।
মনটি তাহার বড়ই সাদা—
সে-বেচারা তার পিঠেতে চাপায়ে
কত শাড়ি-ধুতি-প্যান্ট লইয়া যায়—
মনোদুখে খালি বোঝা টেনে ফেরে গাধা
একখানা ধুতি-প্যান্ট পরিতে না পায় !
টেনিদা বললে, আহা-হা, বেশ লিখেছিল তো ! শুনে চোখে জল আসে !
হাবুল মাথা নেড়ে বললে, হ, খুবই করুণ ।
আমি বললুম, কবিতাটা পড়ে আমারও খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু পিসিমা ধোপার হিসেবের খাতায় এইসব দেখে ভীষণ রেগে গেল ! রেগে গিয়ে হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একটা চাল-কুমড়ো নিয়ে ফুচুদাকে তাড়া করলে। ঠিক যেন গদা হাতে নিয়ে শাড়িপরা ভীম দৌড়োচ্ছে ।
টেনিদা বললে, তোর পিসিমার কথা ছেড়ে দে—ভারি বেরসিক । কিন্তু কী প্যাথেটিক কবিতা যে শোনালি প্যালা-মনটা একেবারে মজে গেল । ইস—সত্যিই তো । গাধা কত ধুতি-প্যান্ট-শাড়ি টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু একখানা পরিতে না পায়। —বলে টেনিদা উদাস হয়ে দূরের একটা শালপাতার ঠোঙার দিকে তাকিয়ে রইল।
সাত্ত্বনা দিয়ে হাবুল বললে, মন খারাপ কইরা আর করবা কী । এই রকমই হয় । দ্যাখো না-গোবর হইল গিয়া গোরুর নিজের জিনিস, অন্য লোকে তাই দিয়া ঘুঁইট্যা দেয়। গোরু একখানা ঘুঁইট্যা দিতে পারে না।
দাঁত খিচিয়ে টেনিদা বললে, দিলে সব মাটি করে । এমন একটা ভাবের জিনিস—ধাঁ করে তার ভেতর গোবর আর ঘুঁটে নিয়ে এল। নে—ওঠ এখন, ঢাউস ঘুড়ি দেখবি চল ।
—ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক—
বলতে বলতে আমরা যখন গড়ের মাঠে পৌছলুম। তখন সবে সকাল হচ্ছে। চৌরঙ্গির এদিকে সূর্য উঠছে আর গঙ্গার দিকটা লালে লাল হয়ে গেছে। দিব্যি বির-ঝির করে হাওয়া দিচ্ছে-কখনও-কখনও বাতাসটা বেশ জোরালো । চারদিকে নতুন ঘাসে যেন ঢেউ খেলছে। সত্যি বলছি—আমি পটলডাঙার প্যালারাম, পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাই—আমারই ফুচুদার মতো কবি হতে ইচ্ছে হল ।
কখন যে সুর করে গাইতে শুরু করেছি—‘রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই’— সে আমি নিজেই জানিনে। হঠাৎ মাথার ওপর কাটাৎ করে গাট্টা মারল টেনিদা।
—অ্যাই সেরেছে ! এটা যে আবার গান গায় !
—তাই বলে তুমি আমার মাথার ওপর তাল দেবে নাকি ?—আমি চটে গেলুম।
—তাল বলে তাল ! আবার যদি চামচিকের মতো চিঁচিঁ করবি, তাহলে তোর পিঠে গোটাকয়েক ঝাঁপতাল বসিয়ে দেব সে বলে দিচ্ছি। এসেছি ঘুড়ি ওড়াতে—উনি আবার সুর ধরেছেন !
আমার মনটা বেজায় বিগড়ে গেল। খামকা সকালবেলায় নিরীহ ব্ৰাহ্মণ-সন্তানের মাথায় গাঁট্টা মারলে। মনে মনে অভিশাপ দিয়ে বললুম, হে ভগবান, তুমি ওড়বার আগেই একটা খোঁচা-টোঁচা দিয়ে টেনিদার ঢাউস ঘুড়ির ঢাউস পেটটা ফাঁসিয়ে দাও । ওকে বেশ করে আক্কেল পাইয়ে দাও একবার ।
ভগবান বোধহয় সকালে দাঁতন করতে করতে গড়ের মাঠে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন । আমার প্রার্থনা যে এমন করে তাঁর কানে যাবে—তা কে জানত ।
ওদিকে বিরাট ঢাউসকে আকাশে ওড়াবার চেষ্টা চলছে তখন । টেনিদা দড়ির মস্ত লাটাইটা ধরে আছে—আর হাবুল সেন হাঁপাতে হাঁপাতে প্ৰকাণ্ড ঢাউসটাকে ওপরে তুলে দিচ্ছে। কিন্তু ঢাউস উড়ছে না—ধপাৎ করে নীচে পড়ে যাচ্ছে।
টেনিদা ব্যাজার হয়ে বললে, এ কেমন ঢাউস রে । উড়ছে না যে !
হাবুল সেন মাথা নেড়ে বললে, হ, এইখান উড়ব না। এইটার থিক্য মনুমেন্ট উড়ান সহজ।
শুনে আমার যে কী ভালো লাগল। খামকা ব্ৰাহ্মণের চাঁদিতে গাঁট্টা মারা ! হুঁ হুঁ ! যতই পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাই, ব্ৰহ্মতেজ যাবে কোথায় ! ও ঘুড়ি আর উড়ছে না— দেখে নিয়ো ।
খালি ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল। বললে, ওড়াতে জানলে সব ঘুড়িই ওড়ে।
ওড়ে নাকি ? টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তবে দে না উড়িয়ে ।
ক্যাবলা বললে, তোমার ঘুড়ি তুমি ওড়াবে, আমি ও-সবের মধ্যে নেই। তবে বুদ্ধিটা বাতলে দিতে পারি। অত নীচ থেকে অত বড় ঘুড়ি ওড়ে ? ওপর থেকে ছাড়লে তবে তো হাওয়া পাবে। ওই বটগাছটার ডাল দেখছ ? ওখানে উঠে ঘুড়িটা ছেড়ে দাও । ডালটা অনেকখানি এদিকে বেরিয়ে এসেছে—ঘুড়ি গাছে আটকাবে না—ঠিক বোঁ করে উঠে যাবে আকাশে ।
টেনিদা বললে, ঠিক । এ-কথাটা আমিই তো ভাবতে যাচ্ছিলুম। তুই আগে থেকে ভাবলি কেন র্যা ? ভারি বাড় বেড়েছে—না ? তোকে পানিশমেন্ট দিলুম। যা-গাছে ওঠ—
ক্যাবলা বললে, বা-রে। লোকের ভালো করলে বুঝি এমনিই হয় ?
দাঁত খিচিয়ে টেনিদা বললে, তোকে ভালো করতে কে বলেছিল—শুনি ? দুনিয়ায় কারও ভালো করেছিস কি মরেছিস । যা—গাছে ওঠ—
—যদি কাঠপিঁপড়ে কামড়ায় ?
—কামড়াবে। আমাদের বেশ ভালোই লাগবে ।
—যদি ঘুড়ি ছিঁড়ে যায় ?
—তোর কান ছিড়ব ! যা—ওঠ বলছি—
কী আর করে—যেতেই হল ক্যাবলাকে । যাওয়ার সময় বললে, ঘুড়ির দড়িটা এই গোলপোস্ট বেঁধে দিয়ো টেনিদা। অত বড় ঢাউস-খুব জোর টান দেবে কিন্তু।
টেনিদা নাক কুঁচকে মুখটাকে হালুয়ার মতো করে বললে, যা—যা—বেশি বকিসনি। ঘুড়ি উড়িয়ে উড়িয়ে বুড়ো হয়ে গেলুম—তুই এসেছিস ওস্তাদি করতে । নিজের কাজ কর ।
ক্যাবলা বললে, বহুৎ আচ্ছা ।
হু হু করে হাওয়া বইছে তখন ৷ ডালের ডগায় উঠে ক্যাবলা ঢাউসকে ছেড়ে দিলে । সঙ্গে সঙ্গে গোঁ গোঁ করে ডাক ছেড়ে সেই পোল্লায় ঢাউস আকাশে উড়ল ।
টেনিদার ওপর সব রাগ ভুলে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি। কী চমৎকার যে দেখাচ্ছে ঢাউসকে । মাথার দুধারে দুটো পতাকা যেন বিজয়গর্বে পতপত উড়ছে—গোঁ-গোঁ আওয়াজ তুলে ঘুড়ি ওপরে উঠে যাচ্ছে। টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল: ডি-লা-গ্র্যান্ডি—
কিন্তু আচমকা টেনিদার চ্যাঁচানি বন্ধ হয়ে গেল । আর হউমাউ করে ডাক ছাড়ল হাবুল ।
—গেল—গেল—
কে গেল ? কোথায় গেল ?
কে আর যাবে ! অমন করে কেই বা যেতে পারে টেনিদা ছাড়া ? তাকিয়ে দেখেই আমার চোখ চড়াৎ করে কপালে উঠে গেল। কপালে বললেও ঠিক হয়। না, সোজা ব্ৰহ্মতালুতে ।
শুধু ঢাউসই ওড়েনি। সেই সঙ্গে টেনিদাও উড়ছে। চালিয়াতি করে লাটাই ধরে রেখেছিল হাতে, বাঘা ঢাউসের টানে সোজা হাত-দশেক উঠে গেছে ওপরে !
এক লাফে গাছ থেকে নেমে পড়ল ক্যাবলা। বললে, পাকড়ো-পাকড়ো—
কিন্তু কে কাকে পাকড়ায় । ততক্ষণে টেনিদা পনেরো হাত ওপরে ! সেখান থেকে তার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে: হাবুল রে—প্যালা রে—ক্যাবলা রে—
আমরা তিনজন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম। : —ছেড়ে দাও, লাটাই ছেড়ে দাও—
টেনিদা কাঁউ কাঁউ করে বললে, পড়ে যে হাত-পা ভাঙব!
হাবুল বললে, তবে আর কী করবা ! উইড়্যা যাও—
ঢাউস তখন আরও উপরে উঠেছে। জোরালো পুবের হাওয়ায় সোজা পশ্চিমমুখো ছুটেছে গোঁ-গোঁ করতে করতে । আর জালের সঙ্গে মাকড়সা যেমন করে ঝোলে, তেমনি করে মহাশূন্যে ঝুলতে ঝুলতে চলেছে টেনিদা।।
পিছনে পিছনে আমরাও ছুটব্লুম। সে কী দৃশ্য ! তোমরা কোনও রোমাঞ্চকর সিনেমাতেও তা দ্যাখোনি !
ওপর থেকে তারস্বরে টেনিদা বললে, কোথায় উড়ে যাচ্ছি বল তো ?
ছুটিতে ছুটতে আমরা বললুম, গঙ্গার দিকে !
—অ্যাঁ—ত্রিশূন্য থেকে টেনিদা কেঁউ কেঁউ করে বললে, গঙ্গায় পড়ব নাকি ?
হাবুল বললে, হাওড়া স্টেশনেও যাইতে পারো !
—অ্যাঁ ।
আমি বললুম, বর্ধমানেও নিয়ে যেতে পারে !
—বর্ধমান ! বলতে বলতে শূন্যে একটা ডিগবাজি খেয়ে গেল টেনিদা।
ক্যাবলা বললে, দিল্লি গেলেই বা আপত্তি কী ? সোজা কুতুবমিনারের চুড়ায় নামিয়ে দেবে এখন ।
টেনিদা। তখন প্ৰায় পাঁচিশ হাত ওপরে । সেখান থেকে গোঙাতে গোঙাতে বললে, এ যে আরও উঠছে! দিল্লি গিয়ে থামবে তো ? ঠিক বলছিস ?
আমি ভরসা দিয়ে বললুম, না থামলেই বা ভাবনা কী ? হয়ত মঙ্গল-গ্রহেও নিয়ে যেতে পারে ।
—মঙ্গল-গ্ৰহ!—আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে টেনিদা বললে, আমি মঙ্গল—গ্রহে এখন যেতে চাচ্ছি না । যাওয়ার কোনও দরকার দেখছি না !
ক্যাবলা বললে, তবু যেতেই হচ্ছে। যাওয়াই তো ভালো টেনিদা ! তুমিই বোধহয় প্রথম মানুষ যে মঙ্গল-গ্রহে যাচ্ছ। আমাদের পটলডাঙার কত বড় গৌরব সেটা ভেবে দ্যাখো !
—চুলোয় যাক পটলডাঙা । আমি—কিন্তু টেনিদা আর বলতে পারলে না, তক্ষুনি শূন্যে আর-একটা ডিগবাজি খেলে। খেয়েই আবার কাঁউ কাঁউ করে বললে, ঘুরপাক খাচ্ছি যে ! আমি মোটেই ঘুরতে চাচ্ছি না—তবু বোঁ বোঁ করে ঘুরে যাচ্ছি।
ঘুড়ি তখন ক্যালকাটা গ্রাউন্ডের কাছাকাছি। আমরা সমানে পিছনে ছুটছি। ছুটিতে ছুটতে আমি বললুম, ও-রকম ঘুরতে হয়। ওকে মাধ্যাকর্ষণ বলে। সায়েন্স পড়োনি?
অনেক ওপর থেকে টেনিদা যেন কী বললে। আমরা শুনতে পেলুম না । কেবল কাঁউ কাঁউ করে খানিকটা আওয়াজ আকাশ থেকে ভেসে এল ।
কিন্তু ওদিকে ঢাউস যত গঙ্গার দিকে এগোচ্ছে তত। হাওয়ার জোরও বাড়ছে। পিছনে ছুটে আমরা আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। টেনিদা উড়ছে আর ডিগবাজি খাচ্ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে আর উড়ছে।
স্ট্র্যান্ড রোড এসে পড়ল প্ৰায়। ঘুড়ি সমানে ছুটে চলেছে। এখুনি গঙ্গার ওপরে চলে যাবে। আমাদের লিডার যে সত্যিই গঙ্গা পেরিয়ে—বর্ধমান হয়ে—দিল্লি ছাড়িয়ে মঙ্গল-গ্রহেই চলল ! আমরা যে অনাথ হয়ে গেলুম !
আকাশ থেকে টেনিদা আবার আর্তস্বরে বললে, সত্যি বলছি—আমি মঙ্গল-গ্ৰহে যেতে চাই না—কিছুতেই যেতে চাই না—
আমরা এইবারে একবাক্যে বললুম, না—তুমি যেয়ো না ।
—কিন্তু নিয়ে যাচ্ছে যে !
—তা হলে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। —ক্যাবলা জানিয়ে দিলে।
—আর পৌঁছেই একটা চিঠি লিখো—আমি আরও মনে করিয়ে দিলুম ; চিঠি লেখাটা খুব দরকার।
টেনিদা বোধহয় বলতে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই চিঠি লিখবে, কিন্তু পুরোটা আর বলতে পারলে না। একবার কাঁউ করে উঠেই কোঁক করে থেমে গেল। আমরা দেখলুম, ঢাউস গোঁত্তা খাচ্ছে ।
সে কী গোঁত্তা ! মাথা নিচু করে বোঁ-বোঁ শব্দে নামছে তো নামছেই! নামতে নামতে একেবারে—ঝপাস করে সোজা গঙ্গায় । মঙ্গল-গ্ৰহে আর গেল না—মত বদলে পাতালের দিকে রওনা হল ।
আর টেনিদা ? টেনিদা কোথায় ? সেও কি ঘুড়ির সঙ্গে গঙ্গায় নামল ?
না-গঙ্গায় নামেনি । টেনিদা আটকে আছে । আটকে আছে আউটরাম ঘাটের একটা মস্ত গাছের মগডালে । আর বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে একদল কাক কা-কা করে টেনিদার চারপাশে চক্কর দিচ্ছে ।
ছুটতে ছুটতে আমরা গাছতলায় এসে হাজির হলুম। কেবল আমরাই নই। চারিদিক থেকে তখন প্রায় শ-দুই লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। পোর্ট কমিশনারের খালাসি, নৌকোর মাঝি, দুটো সাহেব-তিনটে মেম।
—ওঃ মই—হোয়াজজ্যাট (হোয়াটস দ্যাট) ?—বলেই একটা মেম ভিরমি গেল ।
কিন্তু তখন আর মেমের দিকে কে তাকায় ? আমি চেঁচিয়ে বললুম, টেনিদা, তা হলে মঙ্গল—গ্রহে গেলে না শেষ পর্যন্ত ?
টেনিদা ঢাউস ঘুড়ির মতো গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে বললে, কাকে ঠোকরাচ্ছো!
—নেমে এসো তা হলে ।
টেনিদা গা-গাঁ করে বললে, পারছি না! ওফ—কাকে মাথা ফুটো করে দিলে রে প্যালা ।
পোর্ট কমিশনারের একজন কুলি তখুনি ফায়ার-ব্রিগেডে টেলিফোন করতে ছুটল । ওরাই এসে মই বেয়ে নামিয়ে আনবে।
চাটুজ্যেদের রকে বসে আমি বললুম, ডি-লা-গ্র্যান্ডি—
সারা গায়ে আইডিন-মাখানো টেনিদা কাতর স্বরে বললে, থাক, ও আর বলিসনি। তার চাইতে একটা করুণ কিছু বল। তোর ফুচুদার লেখা ‘রামধনের ওই বৃদ্ধ গাধার’ কবিতাটাই শোনা । ভারি প্যাথেটিক। ভারি প্যাথেটিক ।
0 coment�rios: