গজপতি চত্রবর্তী আর তাঁর স্ত্রী ব্যাঙ্কের লকার থেকে গহনা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে দরজার তালা খুলে বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। গজপতিবাবুর এক হাতে তালা অন্য হাতে চাবি। তার পিছনে তার স্ত্রী হাসিরাশি দেবী। তার হাতে ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতরে গহনাগুলো রাখা আছে। গজপতিবাবু তালা খুলে একটা পা ঘরের মধ্যে দিতেই তার নজরে পড়ল একটুকরো ছোট সাদা কাগজ। কাগজটি তুলে নিলেন তিনি। কাগজটিতে লাল কালি দিয়ে লেখা, ‘আজ সন্ধে সাতটায় আসব’। শেষ শব্দটি দু তিনবার বোলানো হয়েছে। তবু অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। আর কিছু লেখা নেই। কোনও সই নেই। কারোর নাম নেই। লেখার শেষে দু-তিনবার ঘষে কী একটা আঁকার চেষ্টা করেছে অথবা লেখার চেষ্টা করেছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গজপতিবাবুর মনে হল একটা ছােরা আঁকা আছে আর দু-তিন ফোটা রক্ত। কাগজটা কে দিয়েছে? কেন দিয়েছে? কখন দিয়েছে? কে আসবে? কেন আসবে? এই সব হাজার প্রশ্ন গজপতিবাবুর মাথায় কিলবিল করতে লাগল।
গজপতিবাবু কাগজটি আবার পড়লেন। লাল কালিতে বেশ পরিষ্কার মুক্তাক্ষরে অথবা রক্তক্ষরে লেখা রয়েছে “আজ সন্ধে সাতটায় আসব।”
গজপতিবাবু ভাল করে বোঝার চেষ্টা করলেন এ কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী হতে পারে? আর তখনই তার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মত একটা আশঙ্কা ঝলসে উঠল। কোনও সমাজবিরোধী নাকি কোন ডাকাত ?
তিনি এবং তার স্ত্রী যে আজ ব্যাঙ্কের লকার থেকে গহনা তুলে এনেছেন কেউ কি তা জেনেছে বা লক্ষ করেছে? তার ফলেই কি এই লাল চিঠি ?
তিনি ঠিক করলেন স্থানীয় থানায় গিয়ে সমস্ত জানাবেন। সাবধানের মার নেই। তাঁর স্ত্রীকে বললেন—“আমি একটু থানা থেকে ঘুরে আসছি।”
তাঁর স্ত্রী হাসিরাশি দেবীর বুদ্ধি আরও প্রখর। তিনি বললেন,—“না, থানায় যেতে হবে না। তুমি বরং ফোন করে সমস্ত জানাও।”
গজপতিবাবু স্ত্রীর বুদ্ধির তারিখ করে থানায় ফোন করে সব কিছু বললেন। থানার বড়বাবু গজপতিবাবুকে আশ্বাস দিলেন,—কোনও ভয় নেই। বিকেল পাঁচটা থেকে চারজন সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁর বাড়ির চারিদিকে পাহারা দেবে। থানার বড়বাবু গজপতিবাবুকে এই টিপস জানানোর জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন,—“একটা ডাকাতের দল গত একমাসের মধ্যে এরকম ডাকাতি তিনটে বাড়িতে করেছে। একটা বাড়িতে বাড়ির মালিককে ভোজালি দিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেছে। এদের কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। এদের সাহস খুব বেড়ে গেছে। আপনাকে এই সংবাদ জানানোর জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজ এদের ধরবই।”
ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে থানার বড়বাবু গজপতিবাবুকে যা বললেন, তাতে গজপতিবাবুর বুকের মধ্যে কী রকম একটা ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ঠোঁট শুকিয়ে গেল। তিনি এক গ্লাস জল খেলেন। তার কানের কাছে একটা ফাটা রেকর্ড অনবরত বাজতে লাগিল,—“ডাকাত দল একটা বাড়িতে বাড়ির মালিককে ভোজালি দিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেছে। জখম করেছে। জখম করেছে।”
তার আশঙ্কা হল তাকেও আজ সন্ধে সাতটায় সেই ডাকাতদল ভোজলি দিয়ে খুন করে গয়নাগুলো নিয়ে পালাবে।
নাঃ! আত্মরক্ষার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এই চিন্তাটা যেই মাথায় এল, গজপতিবাবু আর দেরি না করে পাড়ার রাজু মস্তানের কাছে ছুটলেন। অথচ রাজু মস্তান জিজ্ঞাসা করল,—‘মেসোেমশায় বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা আমাকে কী করতে হবে?”
তখন গজপতিবাবু আমতা আমতা করে বললেন,— “না, মানে, ইয়ে—ঐ সময় একটা পাওনাদার আসবে আমার কাছে। কিন্তু যদি সে আমার গায়ে হাত তোলে তখন তুমি তাকে বাড়ির বাইরে বার করে দেবে।”
রাজু তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলল,—“কিন্তু মেসোমশায় ‘আমার রেট পাঁচশ টাকা। আর সেটা আগাম দিতে হবে।”
গজপতিবাবু তাতেই রাজি হলেন। টাকা আগাম দিয়ে রাজুকে ঠিক করে বাড়িতে এসে ভাবতে লাগলেন আর কী কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে লাফিয়ে উঠলেন, “ইউরেকা, ইউরেকা।” তিনি স্ত্রীকে ডেকে বললেন,—“শিগগির গয়নাগুলো দাও।”
—“গয়নাগুলো নিয়ে কী করবো?”
—‘জীবনের নিরাপত্তা আগে না গয়না আগে? তুমি শিগগির গয়নাগুলো দাও। ওগুলো ব্যাঙ্কে রেখে আসি।”
গজপতিবাবুর স্ত্রী অনিচ্ছা সত্ত্বেও গয়নাগুলো এনে দিলেন। গজপতিবাবু দুটাে বাজার আগেই ব্যাঙ্কে পৌঁছে গয়নাগুলো আবার লকারে রেখে বাড়িতে ফিরে এলেন। এবার মনে বেশ একটা শান্তি পেলেন। যাক, অন্তত মূল্যবান গহনাগুলো তো আর ডাকাতদল আজি সন্ধে সাতটায় নিতে পারবে না।
গজপতিবাবু ঠিক করলেন, এবার নাওয়া খাওয়া-দাওয়া করে একটু ঘুমিয়ে নেবেন। সকাল এগারোটা থেকে দুটাে পর্যন্ত খুব টেনশনে গেছে।
বিকেল পাঁচটা বাজতেই রাজু এসে পিস্তল নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল,—“মেসোমশায়, কোথায় পজিশন নেব?”
পিস্তল দেখে গজপতিবাবু বললেন,—“না,-না বাবা গুলিটুলি ছুঁড়তে হবে না। তুমি এখানেই বসে থাক, মানে আমার কাছে কাছে থাক। বিপদ বুঝলে আমি তোমাকে বলব।
সময় কাটছে। ছটা বাজিল। সাড়ে ছটা বাজল। পৌনে সাতটা বাজল। গজপতিবাবু একবার চারিদিকে দেখে এলেন। হ্যাঁ, পুলিশের লোক এসে গেছে।
সাতটা বাজতে তিন মিনিট বাকি আছে। গজপতিবাবু আর ঘড়ির দিকে তাকাতে পারছেন না। শত্রু যেন ঘড়ির কাঁটার পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে আসছে। রাজু তার কাছে বসে আছে। বাইরে পুলিশের লোক রয়েছে। তবু গজপতিবাবু চােখ বুজে দুৰ্গানাম জপতে শুরু করলেন।
হঠাৎ একটা গাড়ি এসে গজপতিবাবুর বাড়ির সামনে থামল। গাড়ি থামার শব্দ শুনেই গজপতিবাবু চােখ বন্ধ রেখেই রাজুর হাত চেপে ধরলেন, “রাজু, কটা গাড়ি এসেছে?”
—“মেসোমশায় একটা অ্যামবাসাডর গাড়ি এসেছে। ও রাজু একাই উড়িয়ে দেবে। আঃ! হাতটা ছাডুন তো। পিস্তলটা বের করতে দিন।”
—“বাবা রাজু, দুম করে গুলি ছুঁড়বে না। আগে দেখে নাও ক’জন এসেছে।”
—“মেসোমশায়, মাত্র দু’জন। একজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলা।” রাজুর শেষ কথাটা শুনে গজপতিবাবুর বুকের ব্যথাটা কমে গেল। নিঃশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হল। তিনি চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলেন এবং দেখেই লাফিয়ে উঠলেন—“আরে! বিশ্বনাথ,—তুমি!”
বিশ্বনাথ ওরফে বিশু অর্থাৎ গজপতিবাবুর একমাত্র শ্যালককে দেখে গজপতিবাবু চিৎকার করে উঠলেন, ‘হ্যাঁগো, দ্যাখো কে এসেছে?”
গজপতিবাবুর স্ত্রী ছুটে এসে ভাইকে দেখে একগাল হেসে বললেন,—“তুই হঠাৎ?”
—কেন? আমার চিঠি পাসনি?
—চিঠি?
—আজ সকালে এসেছিলাম। তোদের কাউকে বাড়িতে পেলাম না।
ভদ্রলোক বললেন তিনি তোদের আধঘণ্টা আগে বাড়িতেই দেখেছিলেন। কিন্তু তোরা কোথায় গেছিস বলতে পারলাম না। তখন একটা কাগজে গিন্নির লাল লিপস্টিক দিয়ে কোনও রকমে লিখলাম আজ সন্ধে সাতটায় আসব, এইটুকু লেখার পরে দেখলাম। আর লেখা যাচ্ছে না। অনেক ঘষে নামটা লেখার চেষ্টা করলাম। তাও লেখা গেল না । শেষে রাগ করে কাগজটা তোদের দরজার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিয়ে আমি ফিরে গেলাম।”
গজপতিবাবুর গলায় কথাগুলো আটকে গেল, “তুমি লিখেছিলে ঐ লাল কালির চিঠি ? এ কথা আগে জানলে.....”
গজপতিবাবু খুশিতে নাচতে লাগলেন। “বাবা রাজু, তুমি এসো বাবা। তোমাকে আর আটটা পর্যন্ত থাকতে হবে না।”
………..হ্যাঁগো চা কর। গলা শুকিয়ে গেছে। এবার একটু আরাম করে চা খাই।”
0 coment�rios: