ভুলে যাওয়া সেই কালের কথা। কতদিন আগের কথা। সেই কালে সবে আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি। কেউ কোথাও নেই। আদিতে সূর্য ছিল না, না ছিল কোন তারা। চারদিকে আঁধার, শুধু ছিল জল। জলময় চারিদিক। তারপরে সব হল। সবদিক আলোকিত হল, রাত আলোকিত হল চাঁদের আলোয়। সূর্যের তাপে জল শুকোতে শুরু করল। ডাঙা জেগে উঠল। তারপরেই তো আমরা পৃথিবীতে এলাম। আমরা মানে মাত্র একজন। আমাদের প্রথম মানুষ।
সেই মানুষ একা একা থাকত। এখানে ওখানে ঘন বনভূমি, অল্প দূরে তীরতীরে বয়ে যাওয়া নদী, উঁচু পাহাড়, পাহাড়ে অনেক গুহা, আশেপাশে জলাভূমি, এসবের মধ্যে সেই একজন মানুষ, দীর্ঘদেহী, মাথায় ঘন চুল, হাত পায়ের গড়ন পাহাড়ের পাথরের মতো। কথা বলার লোক নেই, তাই সে শুধু চেয়ে থাকে, অবাক হয়, সময় কাটে কিন্তু বড় নিঃসঙ্গ সে। আশেপাশে প্রকৃতি ছাড়া আর কেউ নেই। না, কেউ নেই। সে আগুন জ্বালাতে জানে না। গাছের ফল, শেকড় কিংবা মাটির নীচের বাদাম খেয়ে বেঁচে থাকে। সবই কাঁচা খায়। রাতে বড় কষ্ট, চাঁদের আলো থাকলে ভালো লাগে। কিন্তু চাঁদ তো প্রতিদিন আকাশে ওঠে না। কেন যে ওঠে না? তার ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে রাতে বড় শীত করে। সে যদি আগুন জ্বালাতে পারত, তার এত কষ্ট হত না। উপায় নেই, এভাবেই তার দিন কাটে, রাত পেরিয়ে যায়।
তার দেহে কোন পোশাক নেই। পোশাক সে বানাতে জানে না। পোশাক যে পরতে হয় তা সে জানেই না। পোশাক বুনবেই বা কি করে। সে তো কোন কিছুই শেখেনি। সে মানুষ বড় ক্লান্ত। গাছের শেকড় খুঁজে খুঁজে সে ক্লান্ত। মাটি খুঁড়ে বাদাম খুঁজতে খুঁজতে সে ক্লান্ত। অনেক উঁচু ডালের ফল পাড়তে পাড়তে সে ক্লান্ত। তার মনও ভালো নেই। বড় একঘেয়ে খাবার। নিত্যিদিন কি এক জিনিস খেতে ভালো লাগে? তার অরুচি ধরে গেল। নাঃ, আর ভালো লাগে না। কয়েকদিন সে কিছুই খেল না। নরম সূর্যের আলোয় শুধু শুয়ে থাকল। সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। আগে স্বপ্ন দেখত না, এখন চোখ খুলে সাদা আকাশের দিকে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখে। মেঘ ভেসে যাচ্ছে, সেই ভেসে যাওয়া মেঘের দিকে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখে। উঁচু গাছের ডালপালা হাওয়ায় মাথা নাড়ছে, সেদিকে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখে। জলায় জলের ঢেউ খেলছে বাতাসের ছোয়ায়, সেদিকে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখে।
একদিন স্বপ্ন দেখছে। ক্লান্ত চোখের পাতা রয়েছে বন্ধ। চোখ মেলে সে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। চমকে উঠল। ভয় পেল। এরকম কিছু তো সে আগে কখনও দেখেনি। তার সামনের সেই দেহ এবার কথা বলল। কি মিষ্টি যে তার কথা। সেই মানুষের ভয় ভাঙল, মনে খুব আনন্দ হল। হৃদয় ভরে গেল।
সামনে দাঁড়িয়ে একজন নারী। তার দেহ সোনালি রঙের, মাথার চুল রুপোলি, পিঠের ওপর দুলছে—ঠোঁট রয়েছে অল্প খোলা, সাদা মেঘের মতো দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে, ঠোঁটদুটি জলে ভেজা। চোখদুটিও যেন হাসছে। কি অপরুপ দেহ। তার দেহেও কোন পোশাক নেই। সে কি মেঘের রাজ্য থেকে নেমে এল?
মানুষটি এই প্রথম হাসল। হেসে তাকে কাছে ডাকল। মেয়ে কাছে এল না। মানুষটি দাঁড়িয়ে তার কাছে এগিয়ে গেল, মেয়ে দূরে সরে গেল। তার পেছন দেখা যাচ্ছে, পিঠের ওপরে চুলগুলো দুলছে, আর খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
আরও এগিয়ে গেল সে, মেয়ে আরও দূরে চলে গেল। মানুষটি যত এগোয়, মেয়েও তত দূরে চলে যায়। শেষকালে মেয়ে এল নদীর কাছে। অনেকটা দূর থেকে মানুষটি বলল, “ওগো মেয়ে, তুমি যখন আমার কাছে এসেছ, আর দূরে চলে যেয়ো না। আমি বড় একা, আমার কেউ নেই, কথা বলার কেউ নেই, বড় কষ্ট আমার। কাছে থাকো, দূরে যেয়ো না।
আস্তে আস্তে মেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে বলল, “বেশ, আমি কোনদিন আর দূরে চলে যাব না। কিন্তু আমি তোমাকে যা যা করতে বলব, তোমাকে তাই করতে হবে। তুমি যদি আমার কথা শোনো, আমি চিরকাল তোমার কাছে থাকব। কথা দাও - মানুষটি বলল, “তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব। শুধু তুমি আমার কাছ থেকে দূরে চলে যেয়ো না। আমি বড় একা।
সোনালি মেয়ে মিষ্টি হেসে কাছে এগিয়ে এল। এসে তার হাত ধরল। দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে রইল। মানুষটি জীবনে এত আনন্দ পায়নি। তার মন ভরে গেল। হাত ধরে এগিয়ে গেল সেই মেয়ে। নদীর ধার দিয়ে জলাভূমি পেরিয়ে এসে মেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা ডাঙা জমির ওপরে। সেই জমিতে পড়ে রয়েছে অনেক শুকনো ঘাস। রোদে পুড়ে খুব শুকনো হয়ে রয়েছে সেই লম্বা লম্বা মোটা ঘাস।
মেয়ে নিচু হয়ে সবচেয়ে মোটা দুটাে শুকনো ঘাস তুলে নিল। পুরুষের হাতে ঘাস দুটো দিয়ে সে বলল, “হাতের তালুর মধ্যে দুটো ঘাস নাও। তালু দুটো চেপে খুব জোরে জোরে ঘষতে থাকো?
পুরুষটি তাই করল। কিন্তু কিছুই হল না। ঘাস দুটাে সেরকমেই রইল। মেয়েটি ঘাস দুটাে নিয়ে কীভাবে ঘষতে হবে দেখিয়ে দিল। কৌশল শিখিয়ে দিল।
মেয়েটি ঞাস দুটো নিয়ে কীভাবে ঘষতে হবে দেখিয়ে দিল। কৌশল শিখিয়ে দিল। আরও জোরে, খুব তাড়াতাড়ি ঘষতে হবে।‘তুমি জোয়ান পুরুষ, গোয়ে তোমার অসীম শক্তি। ঠিক পারবে।
এবারে জোরে জোরে ঘষতে ঘষতে ঘাস দুটোয় আগুন জ্বলে উঠল। হাতের তালুতে তাপ লাগছে, পুরুষ ঘাসদুটাে ফেলে দিল। জ্বলে-ওঠা ঘাস নীচে পড়ল, আশেপাশের শুকনো ঘাসে দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠল।
পুরুষ ভয় পেয়ে দূরে দৌড়ে গেল। সে কখনও আগুন দেখেনি। সে আগুন দেখেছে সূর্যের মধ্যে, ভর দুপুরে। কিন্তু সে তো দূরের আগুন। গায়ে আঁচ লাগেনা।
মেয়ে এল পুরুষের পাশে। দাউ দাউ জ্বলছে মাঠ। মেয়ে বলল, এই আগুনই আমাদের বঁচিয়ে রাখবে। আমরা সুখি হব।’
আগুন নিভে গেল। গোটা মাঠে কালো শুকনো ছাই। সব ঘাস পুড়ে গিয়েছে। মেয়ে বলল, “ওই জলা থেকে অজিলা করে জল এনে মাঠে দাও। আমিও জল আনছি।
পুরুষ অজলা করে জল আনছে। মাঠে দিচ্ছে, আবার যাচ্ছে। মেয়ে জলায় চুল ভিজিয়ে নিচ্ছে, জমিতে এনে চুল নিঙড়ে জল ফেলছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল। ভর দুপুর। তারা একটা বড় ঘন গাছের ছায়ায় বসে রইল। মেয়ে আর কোন কথা বলছে না।
গাছের ছায়া একদিকে বড় হচ্ছে। অনেক বড়। রোদের তেজ কমে এসেছে। সূর্য ওই দিকে ঢলে পড়ছে। দূরে অাঁধার আঁধার দেখা যাচ্ছে। এবার সন্ধ্যা হল।
মেয়ে উঠে দাঁড়াল, একবারে পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপরে আস্তে আস্তে বলল, “আমি এই জমিতে শুয়ে পড়ছি, তুমি আমার চুল ধরে এই জমির ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে। জমির এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিকে। আমার দেহের ছোঁয়া যেন জমির সবখানে লাগে।
মেয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু পুরুষটি চুপ করে দাড়িয়ে রইল। মেয়ে হাত নেড়ে ইশারা করে ডাকল। পুরুষ তবু নড়ে না।
পুরুষ বলল, “এ আমি পারব না। তোমার ব্যথা লাগবে, তোমার চুল ধরে টানলে তোমার ব্যথা লাগবে। দেহ জমির ওপর দিয়ে নিয়ে গেলে তোমার দেহে লাগবে, কেটে যাবে, রক্ত ঝরবে।’
মেয়ে বলল, “হয়তো একটু লাগবে, হয়তো ছড়ে যাবে। কিন্তু উপায় নেই। বাঁচতে হলে একাজ করতে হবে। আমার দেহের ছোঁয়া ছাড়া জমি কোন কথা শুনবে না। আমার দেহ সমস্ত জমিতে না গড়ালে জমি কিছুই দেবে না। আমার দেহের ছোঁয়ায় জমির চেহারা যে পালটে যাবে। কথা শোনো। যে আনন্দ আমরা পাব তাতে দেহের ওই ব্যথা কিছুই নয়। আর তুমি তো আমায় কথা দিয়েছ সব কথা শুনবে।
পুরুষ নেমে এল জমিতে। মেয়ের চুল গোছা করে ধরল। তার খুব কষ্ট হচ্ছে, তবু সে মেয়ের কথা শুনল।
পুরুষ আস্তে করে টানল। কিন্তু সোনালি মেয়ের দেহ বড়, বেশ ভারী। এত আস্তে টানলে চলবে না। পুরুষ জোরে টান দিল, মেয়ের দেহ এগিয়ে আসছে। মেয়ের সোনালি দেহ কালো পোড়া ঘাস ও কাদায় অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। দেহে কালো কাদা, জলের ছিটে। পুরুষ সমস্ত মাঠে মেয়ের দেহ নিয়ে ঘুরছে, এপাশ থেকে ওপাশে, ওপাশ থেকে এপাশে। জমিও কেমন যেন কাদামাটি হয়ে উঠছে। জমির চেহারা পালটে যাচ্ছে।
অনেক সময় কেটে গেল। এখন চারিদিকে অন্ধকার। তারা নদীতে গেল, দেহ পরিষ্কার করল। আবার মেয়ের সোনালি রঙ ফিরে এল। তারা গুহায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বড় ক্লান্তি, তারা ঘুমিয়ে পড়ল।
এক সময় পুরুষের ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখে মেয়ে নেই। তার বুক কেঁপে উঠল। ঝড়ের বেগে গুহা থেকে বেরিয়ে এল। অল্প দূরে দেখতে পেল, সকালের রোদে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই মেয়ে। রোদ এসে পড়েছে তার সোনালি দেহে, রুপোলি চুলে। সে দুহাত সামনে মেলে ধরেছে, মনে হচ্ছে সোনালি রঙের একটা গাছ।
আস্তে আস্তে পরুষ এগিয়ে গেল। এল মেয়ের পাশে। মেয়ে মিষ্টি হেসে জমির দিকে তাকিয়ে রইল। দিন যায় রাত যায়। সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। বৃষ্টির দিন শেষ হয়ে গেল। রোজ মেয়ে জমিতে যায়, অনেকক্ষণ থাকে। পুরুষ তখন ফল আনে, শেকড় আনে, বাদাম তোলে। একদিন সকালে মেয়ে পুরুষের হাত ধরে জমির পাশে গেল। জমির দিকে তাকিয়ে পুরুষ অবাক হয়ে গেল। মেয়ের চোখের দিকে চেয়ে দেখল। মেয়ে হাসছে।
সোনালি ফসলে মাঠ ভরে গিয়েছে। ফসলের ডগায় রুপোলি শিষ। মেয়ের সোনালি দেঞের ছোঁয়ায় ফসলের রঙ হয়েছে সোনালি, আর রুপোলি চুলের ছোঁয়ায় ফসলের শিষ হয়েছে রুপোলি।
মেয়ে বলল, "এই ফসল আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে, এই ফসল আমাদের সুখি করে তুলবে। আমাদের মিলনে যারা জন্মাবে তারা এই ফসল খেয়েই বেঁচে থাকবে। এই এক মাঠ ফসল থেকে অনেক ফসল হবে। পাশের জমিতে, তার পাশের জমিতে, সব জায়গায় ।
তাই আমরা আমাদের প্রথম মাকে ভুলিনি। তার রুপোলি চুলের ছোঁয়া আজও তোমরা দেখতে পাবে সোনালি ফসলের শিষে।
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
0 coment�rios: