এক চাষী বীজ বুনল, ফসল হল আশ্চৰ্য, ঘরে তোলাই দায়। আঁটি তুলে ঝাড়াই মাড়াই করে ভর ভরন্ত গোলায় তুলল। গোলায় তুলে চাষী ভাবল: “সুখেস্বচ্ছন্দে দিন কাটবে এবার।”
এদিকে এক ইঁদুর আর এক চড়াই সুরু করল চাষীর গোলায় যাতায়াত। দিনে বার পাঁচেক করে আসে; পেট পুরে খেয়ে চলে যায় – ইঁদুর যায় তার গর্তে আর চড়াই তার বাসায়। এমনি করেই মিলেমিশে তিন বছর কাটল তাদের। গোলার সব দানা শেষ হল, রইল কিছুটা ক্ষুদকুড়ো পড়ে। ইঁদুর দেখে ভাঁড়ার তো শেষ হয়-হয়, চড়াইটার ওপর বাটপারি করে একলাই বাকিটুকু দখল করা যাক। এই ভেবে মেঝেতে সিঁধ কেটে বাকি দানা সব মাটির নীচে জমা করল।
সকালে চড়াই গোলায় খেতে এসে দেখে, একটা দানাও পড়ে নেই। বেচারা ক্ষিদে নিয়েই ফিরে গেল। ভাবল:
“হতভাগা ইঁদুরটা আমায় ঠকিয়েছে! গিয়ে একবার পশরাজ সিংহের কাছে নালিশ করি। পশরাজ নিশ্চয়ই ন্যায় বিচার করবেন।”
এই ভেবে চড়াই উড়ে চলল সিংহের কাছে।
পশুরাজের কাছে গিয়ে চড়াই কুর্নিশ করে বলল, “সিংহমশাই, আপনি পশুরাজ ! আমি আপনার এক পশু, দে’তো ইঁদুরের সঙ্গে ছিলাম। গত তিন বছর ধরে একই গোলা থেকে আমরা খেয়েছি, কোনদিন ঝগড়া বিবাদ করিনি। কিন্তু খাবার ফুরিয়ে আসতেই ইঁদুর আমাকে ভারি ঠকিয়েছে। গোলার মেঝেয় সিঁধ কেটে বাকি দানাগলো সব মাটির নীচে চালান করে দিয়েছে। আমি উপোস করে মরছি। ন্যায্য মতে আপনি বিচার করে দিন। আর যদি বিচার না করেন, তবে আমি আমাদের রাজা ঈগলমহারাজের কাছে আর্জি করব।”
‘তাই যা বাপু, যেখানে পারিস যা’, সিংহ বলল।
চড়াই গিয়ে কুর্নিশ করলে ঈগলের কাছে। ইঁদুর কী রকম ঠকিয়েছে, আর পশরাজই বা কেমন এক-চোখোমি করলেন – সে সব কথা ঈগলমহারাজকে খুলে বলল।
শুনে ঈগলমহারাজ রেগে লাল। তক্ষণি সিংহের কাছে দূতের হাতে খবর পাঠাল: কাল অমুক সময়, অমুক মাঠে তোমার সব জস্তুজানোয়ার নিয়ে হাজির থেকো, আমিও আমার পাখীর দল জুটিয়ে তৈরী থাকব। যুদ্ধ হবে।
পশরাজ সিংহ তাই ঢেঁড়া দিলে, পশদের ডাক পড়ল যুদ্ধে। জুটল তারা কাতারে কাতারে। কিন্তু যেই ওরা খোলা মাঠে এসেছে অমনি যত ডানাওয়ালা সৈন্য নিয়ে মেঘের মতো ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ঈগল। তিন ঘণ্টা তিন মিনিট ধরে যুদ্ধ চলল। জিত হল ঈগলমহারাজের। সারা মাঠ ভরে উঠল পশুদের লাসে। ঈগল তখন পাখীদের বাড়ী পাঠিয়ে নিজে চলে গেল এক গহীন বনে, বসল এক মস্ত ওক গাছের মাথায়, সারা গায়ে জখম, ভাবতে লাগল, কী করে আবার আগের শক্তি ফিরে পাওয়া যায়।
এ সব অনেক পরোকালের কথা। সেই সময় একলা একলা বাস করত এক সওদাগর আর তার বৌ। তাদের একটিও ছেলে মেয়ে ছিল না। সকালে উঠে সওদাগর তার বৌকে বলল:
গিন্নী, বড় খারাপ স্বপ্ন দেখেছি, এক মস্ত পাখী এসেছে আমাদের কাছে। আস্ত ষাঁড় গিলে খায়, পুরো গামলা চুমুক দেয়। হাত থেকে তার রেহাই নেই, না খাইয়ে উপায় নেই। যাই, বনের মধ্যে গিয়ে খানিকটা ঘুরে আসি।”
সওদাগর বন্দুক নিয়ে বনে চলে গেল। বনে বনে সে ঘুরলে অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষণ, শেষকালে এল সেই ওক গাছটার কাছে। দেখে, একটা ঈগল, বন্দুক তুলে গুলি করতে যাবে। হঠাৎ মানুষের ভাষায় কথা কয়ে উঠল পাখী:
‘মেরো না ভালোমানুষের পো, আমায় মেরে তোমার কোন লাভ হবে না।তার চেয়ে আমায় বাড়ী নিয়ে চলো। তিন বছর তিন মাসের তিন দিন আমায় খাইয়ো। তোমার ওখানে সেরে উঠি, ডানায় পালক গজাক, গায়ে জোর ফিরুক, তখন তোমার উপকারের শোধ দেব।”
“ঈগল আবার কী দেবে?” এই ভেবে সওদাগর আবার বন্দকে তুলল। ঈগল ফের সেই কথা বলে। আবার সওদাগর বন্দুক তুলল, বার বার তিনবার। ঈগল ফের বলল:
‘মেরো না ভালোমানষের পো, তিন বছর তিন মাস তিন দিন আমায় খাইয়ে দাইয়ে তোমার বাড়ীতে রাখো। সেরে উঠি, ডানায় পালক গজাক, গায়ে জোর হোক, তোমার সব উপকার শোধ দেব।’
দয়া হল সওদাগরের, ঈগলকে বয়ে নিয়ে এল বাড়ীতে। বাড়ী এসেই সওদাগর তক্ষুণি একটা ষাঁড় মেরে এক গামলা ভর্তি মধুর সরবৎ করে রাখল। ভাবল এতে ঈগলটার বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ঈগল কিন্তু এক গ্রাসেই সব শেষ করে দিল। অনাহত অতিথ নিয়ে খুবই বিপদ হল সওদাগরের, একেবারে নিঃসম্বল হয়ে পড়ল সে। তা দেখে ঈগল সওদাগরকে বলল:
‘শোনো কর্তা, খোলা মাঠটায় চলে যাও, দেখবে সেখানে আহত-নিহত অনেক পশু পড়ে আছে। জন্তুগুলোর ছাল ছাড়িয়ে দামী ফার নিয়ে শহরে বেচে এসো। প্রচুর টাকা হবে। সে টাকায় আমি খেয়ে, তুমি খেয়েও বাকি থাকবে।”
সওদাগর খোলা মাঠে গিয়ে দেখে, সত্যিই আহত-নিহত অনেক পশু পড়ে আছে । তা থেকে দামী দামী চামড়া ছাড়িয়ে, শহরে ফার বেচে সওদাগর অনেক টাকা পেল।
এক বছর কেটে গেল। ঈগল সওদাগরকে বলল; যেখানে বড় বড় ওক গাছ আছে সেখানে আমায় নিয়ে চলো। সওদাগর গাড়ীতে ঘোড়া জুতল তারপর ঈগলকে নিয়ে গেল বড় বড় ওক গাছগুলোর কাছে। ঈগল মেঘের চেয়েও উঁচুতে উড়ে গেল। তারপর সোঁ করে নেমে এসে যত জোরে সম্ভব তার বুক দিয়ে একটা ওক গাছে মারল ধাক্কা। গাছ দু’টুকরো হয়ে গেল।
ঈগল বলল, ‘না সওদাগর, এখনও আমার আগের শক্তি ফিরে পাইনি, আরও পুরো একবছর আমায় খাওয়াতে হবে।’
দ্বিতীয় বছরও কেটে গেল। ঈগল আবার কালো মেঘের মাথার উপর উড়ে গেল, তারপর সোঁ করে নেমে এসে ধাক্কা মারল গাছে। কয়েক টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল গাছ।
আরও একবছর খাওয়াতে হবে সওদাগর, ভালোমানুষের পো, আগের শক্তি এখনও আসেনি গায়ে।’
এই ভাবে তিন বছর তিন মাস তিন দিন কেটে যেতেই ঈগল সওদাগরকে বলল:
‘আবার আমাকে সেই বড় বড় ওক গাছের কাছে নিয়ে চলো।’
সওদাগর ঈগলকে ওক গাছগুলোর কাছে নিয়ে গেল। এবার ঈগল আগের চেয়েও উঁচুতে উড়ে গেল, তারপর সবচেয়ে বড়ো ওক গাছটার গায়ে মারল এক প্রচন্ড ধাক্কা। গাছটা আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। কেঁপে উঠল সারা বন।
ঈগল বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ তোমায় সওদাগর, ভালোমানুষের পো, এবার আমি আগের শক্তি ফিরে পেয়েছি। ঘোড়া ছেড়ে আমার পিঠে চড়ে বসো। আমার বাড়ী নিয়ে গিয়ে তোমার সব উপকারের শোধ দেব।’
সওদাগর ঈগলের পিঠে চড়ে বসল। ঈগল নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে উঠে গেল একেবারে উঁচুতে। বলল:
‘নীল সমুদ্রটা একবার দেখো তো, কত বড়?
সওদাগর উত্তর দিল, ‘একটা বড় চাকার মতো।”
তখন মৃত্যুভয় দেখাবার জন্যে সওদাগরকে পিঠ থেকে ফেলে দিল ঈগল, কিন্তু সমুদ্রে পড়বার আগেই ঈগল তাকে ধরে ফেলল। তারপর আরো উঁচুতে উঠে গেল।
‘এবার নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলো তো, কত বড়?”
‘মুরগীর ডিমের মতো।’
ঈগল আবার এক ঝাঁকুনি দিয়ে সওদাগরকে ফেলে দিল, তারপর সমুদ্রে পড়বার আগেই ধরে নিয়ে আরও উঁচুতে উড়ে চলল।
‘এবার দেখো তো, নীল সমুদ্র কত বড়?’
‘একটা দোপাটির বাঁচির মতো।”
এবার তৃতীয় বার ঈগল এক ঝাঁকুনি দিয়ে সওদাগরকে ফেলে দিল একেবারে সেই আকাশ থেকে। কিন্তু এবারেও সমুদ্রে পড়ে যাবার আগেই ধরে ফেলল। বলল:
‘কী সওদাগর, ভালোমানুষের পো, এবার বুঝেছো মৃত্যুভয় কাকে বলে?’
সওদাগর উত্তর দিল, ‘বুঝেছি, মনে হয়েছিল এই শেষ।’
‘আমার দিকে যখন বন্দুক তুলে তাগ করেছিলে আমারও তাই মনে হয়েছিল।’
ঈগল সওদাগরকে নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে সোজা উড়ে চলল তামার রাজ্যে।
ঈগল বলল, “এখানে আমার বড় বোন থাকে। আমরা তার অতিথি হব। ও যখন উপহার দিতে চাইবে, কিছু নিও না যেন, কেবল তামার কোঁটা চাইবে।”
এই বলে ঈগল নেমে সোঁদা মাটিতে আছাড় খেতেই একটি সুন্দর তরুণ হয়ে গেল।
মস্ত একটা আঙিনা পেরিয়ে চলেছে ওরা, বোন ওদের দেখতে পেয়ে ভারি খুশী হয়ে স্বাগত জানাল।
‘ভাই আমার, সোনা আমার, তুই বেঁচে আছিস ! কোথা হতে এলি? তিন বছর তোকে দেখিনি। ভেবেছিলাম বুঝি বা মরেই গেছিস। কী তোকে খেতে দিই, কী দিয়ে আপ্যায়ন করি?’
‘আমায় শুধিয়ো না দিদি, আমায় জিজ্ঞেস করো না, আমি তো বাড়ীর লোক। এই লোকটিকে জিজ্ঞেস করো, একে শুধোও। আমায় তিন বছর খাইয়েছে, দাইয়েছে, উপোসে রাখেনি।’
মেয়েটি ওদের এক নক্সী জাজিম ঢাকা ওক কাঠের টেবিলে বসালে, খাওয়ালে, আপ্যায়ন করলে। তারপর রত্নভাণ্ডারে নিয়ে গিয়ে তার অগুনতি ধনসম্পদ দেখিয়ে সওদাগরকে বলল:
‘এই তোমার সোনা, রপো, মণিমাণিক্য যত নেবে নাও।’
সওদাগর বলল: ‘সোনা চাই না, রুপো চাই না, মণিমাণিক্য চাই না; আমায় কেবল তামার কৌটাটি দাও।”
যতই করো, সেটি হচ্ছে না। বাঁদরের গলায় কি আর মুক্তোর হার?’
বোনের কথা শুনে ভাই খুব রেগে উঠল, তাই সে আবার ঈগল হয়ে সওদাগরকে পিঠে নিয়ে উড়ে চলে গেল।
দিদি চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, ‘ভাই আমার, সোনা আমার, ফিরে আয়! না হয় তামার কোঁটাই দেব, আপত্তি করব না!’
‘এখন আর হয় না দিদি, দেরি হয়ে গেছে, এই বলে ঈগল আকাশের ভিতর দিয়ে উড়ে চলল।
ঈগল বলল, “দেখো তো সওদাগর, ভালোমানুষের পো, কী দেখছো সামনে, কী দেখছো পিছনে?”
চারদিক দেখে সওদাগর বলে:
‘পিছনে জলন্ত আগুন আর সামনে ফুটন্ত ফুল।’
‘তারমানে তামার রাজ্য পুরে যাচ্ছে, আর রুপোর রাজ্যে ফুল ফুটছে। রুপোর রাজ্যে থাকে আমার মেজ বোন। আমরা তার অতিথি হব। সে যখন উপহার দিতে চাইবে আর কিছু নিও না, শুধু ঐ রপোর কোঁটা চাইবে।”
পৌছল ঈগল, সোঁদা মাটিতে আছাড় খেতেই আবার একটি সুন্দর তরুণ হয়ে গেল।
মেজ বোন বলল, ‘ভাই আমার, সোনা আমার, কোথেকে এলি? কোথায় ছিলি, এতদিন আসিসনি কেন? কী দিয়ে তোর আপ্যায়ন করি?
‘আমায় জিজ্ঞেস করো না দিদি, শুধিয়ো না, আমি তো বাড়ীর লোক। এই ভালোমানুষের পোকে জিজ্ঞেস করো, এর আপ্যায়ন করো। আমায় পুরো তিন বঝর খাইয়েছে, দাইয়েছে,উপোসে রাখেনি।
মেজ বোন ওদের নক্সী জাজিম ঢাকা ওক কাঠের টেবিলে বসিয়ে খাওয়ালে, আপ্যায়ন করলে। তারপর রত্নভাণ্ডারে নিয়ে গিয়ে বলল:
‘এই রইল সোনা, রুপো, মণিমাণিক্য যত খুশী সাধ মিটিয়ে নাও।’
‘সোনা চাই না আমার, রুপো চাই না, মণিমাণিক্য চাই না; আমায় কেবল রুপোর কোঁটাটি দাও।”
না ভালোমানুষের পো, সেটি হচ্ছে না। ও কোঁটা তোমার গলায় ঠেকে মরবে।’
বোনের কথায় রাগ হয়ে গেল ভাইয়ের, তাই ফের সে পাখী হয়ে সওদাগরকে পিঠে চাপিয়ে উড়ে গেল।
‘ফিরে আয় ভাই, ফিরে আয়! না হয় কোঁটাই দেব, আপত্তি করব না!’
‘আর হয় না দিদি, দেরি হয়ে গেছে।’
ঈগল আবার উড়ে চলল আকাশে।
‘চেয়ে দেখো সওদাগর, ভালোমানুষের পো, কী দেখছো সামনে, কী দেখছো পিছনে?”
পিছনে জলন্ত আগুন, সামনে ফুটন্ত ফুল।’
সোনার রাজ্যে ফুল ফুটছে। আমরা ওর অতিথি হব। সে যখন উপহার দিতে চাইবে কিছু নিও না, শুধু তার সোনার কোঁটা চাইবে।”
উড়তে উড়তে সোনার রাজ্যে পৌঁছে ঈগল আবার সেই সুন্দর তরণ হয়ে গেল।
ছোট বোন বলল, ‘ভাই আমার, সোনা আমার, কোথেকে এলি? কোথায় ছিলি, এতদিন আসিসনি কেন? কী তোকে দিই, কী দিয়ে আপ্যায়ন করি?
‘আমায় জিজ্ঞেস করো না দিদি, আমায় আপ্যায়ন কোরো না, আমি তো বাড়ীর লোক। জিজ্ঞেস করো এই সওদাগরকে। ও আমায় তিন বছর খাইয়েছে, দাইয়েছে, উপোসে রাখেনি।’
নক্সী জাজিম ঢাকা ওক কাঠের টেবিলে বসিয়ে মেয়েটি ওদের খাওয়ালে, দাওয়ালে। তারপর রত্নভান্ডারে নিয়ে গিয়ে সওদাগরকে সোনা, রুপো, মণিমাণিক্য সব দিতে চাইল।
কিছু চাই না আমার, কেবল ঐ সোনার কোঁটাটি দাও।’
বোন বলল, “এই নাও। ভাগ্য ফিরবে তোমার। তুমিই আমার ভাইকে তিন বছর খাইয়েছো, দাইয়েছো, উপোসে রাখোনি। আমার ভাইয়ের জন্যে তোমায় না দিতে পারি এমন কিছু নেই।’
তাই সোনার রাজ্যে দিন কাটাল সওদাগর, ভোজ খেল। শেষে একদিন বিদায় নেবার সময় এল।
ঈগল বলল, “বিদায় বন্ধু। ক্রটির কথা ভুলে যেয়ো, আর মনে রেখো, বাড়ী না পৌছনো পর্যন্ত কৌটা খুলবে না কিন্তু।’
সওদাগর বাড়ীর দিকে রওনা হল। গেল অনেক দিন, নাকি অল্প দিন, ক্লান্ত হয়ে সওদাগর ভাবল একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। থামল সে এক বিভূই মাঠে, রাজা অদীক্ষিত ললাটের রাজ্যে। সোনার কোঁটার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে সওদাগর, শেষে আর পারল না, খুলে ফেলল কোঁটা। কোঁটা খোলামাত্র দেখে — কোথা থেকে জেগে উঠল এক মন্ত রাজপুরী, কত তার সাজজ্জা। লোকজন দাসদাসী গিজগিজ করছে। সওদাগর খেল, দেল, বিছানায় গা এলাল।
রাজা অদীক্ষিত ললাট দেখে, তার রাজ্যে মস্ত এক রাজপুরী। দূতকে বললে:
‘দেখে এসো তো, কোন শয়তান আমার রাজ্যে আমার অনুমতি ছাড়া প্রাসাদ তুলেছে। ভালোয় ভালোয় এক্ষণি যেন রাজ্য ছেড়ে চলে যায়।’
এই শাসানি শুনে সওদাগর ভাবতে লাগল কী করে আবার রাজপরীকে কোঁটার ভিতরে ঢোকানো যায়। ভেবে ভেবেও কোন উপায় বের করতে পারল না।
দূতকে বলল, ‘খুশী হয়েই যেতে রাজি, কিন্তু কী করে যে যাব, সেটাই জানি না।’
দূত ফিরে গিয়ে রাজাকে সব কথা জানাল। রাজা বললে, ‘ওর বাড়ীতে অজানা যেটি আছে সেটি আমায় দিক, তবে আমি প্রাসাদটা আবার সোনার কোঁটায় পুরে দেব।’
সওদাগর আর কী করে, প্রতিজ্ঞা করল বাড়ীতে তার অজানা যা আছে সেটি দেবে রাজাকে। রাজা অদীক্ষিত ললাট তক্ষুণি প্রাসাদটা মুড়ে কোঁটায় ঢুকিয়ে দিল। সওদাগর কোঁটা নিয়ে রওনা হল বাড়ীমুখো।
গেল অনেকদিন, নাকি অল্পদিন, এল বাড়ীতে। বৌ বলল: ‘এসো গো, ঘরে এসো! কোথায় ছিলে?’
‘যেখানে ছিলাম ছিলাম, এখন তো আর নেই।’
‘তুমি যখন বাড়ীতে ছিলে না, ভগবান তখন একটি খোকা দিয়েছেন আমাদের।’
‘এটাই তাহলে আমার অজানা জিনিস!’ মনে মনে ভাবল সওদাগর, দুঃখ হল তার, শোক হল।
বৌ বলল, ‘তোমার কী হয়েছে? নাকি বাড়ীতে মন টিকছে না।’
সওদাগর বলল, 'না, না, সে কথা নয়।’ তারপর সব ঘটনা খুলে বলল বৌকে।
ওরা তখন খুব দুঃখ করে কাঁদতে লাগল, কিন্তু চিরকাল তো আর কেউ কাঁদে না।
সওদাগর তাই সোনার কোঁটা খুলল। দেখতে দেখতে তৈরী হয়ে গেল একটা মস্ত জমকালো রাজপুরী, কত তার সাজসজ্জা। স্ত্রীপুত্র নিয়ে সওদাগর মনের সুখে থাকে সেখানে। ধন তাদের উপচে ওঠে।
বছর দশ পেরিয়ে গেল। রূপবান বুদ্ধিমান হয়ে বেড়ে উঠল সওদাগরপুত্র, যেমন রুপে তেমনি গুণে।
একদিন মনমরা হয়ে ঘুম ভাঙল ছেলেটির, বাবাকে বলল: ‘রাজা অদীক্ষিত ললাট আমায় স্বপ্নে দেখা দিয়েছে বাবা, বলেছে তার কাছে যেতে। অনেকদিন থেকে নাকি অপেক্ষা করে আছে, আর চলে না।’
চোখের জল ফেললো বাবা মা। তারপর আশীর্বাদ করে ছেলেকে দূর দেশে পাঠিয়ে দিলে।
যায় সে সড়ক বেয়ে, পথ উজিয়ে, শুন্যি কান্তার, স্তেপের প্রান্তর, পেরিয়ে এল এক গহন বনে। জন নেই, প্রাণী নেই। কেবল একটেরে একটি কুঁড়ে, বনের দিকে মুখ আর সওদাগরপত্র ইভানের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কুঁড়েঘর, ও কুঁড়েঘর, বনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াও।’
কুড়েঘর ইভানের কথামত বনের দিকে পিঠ করে ঘুরে দাঁড়াল। সওদাগরপত্র ইভান ভিতরে ঢুকে দেখে, খেংরাকাঠি পা, বাবা-ইয়াগা ডাইনী শুয়ে। ইভানকে দেখে ডাইনী বলল:
‘রুশী মানুষ যে, না শুনেছি কানে, না হেরেছি নয়নে, আজ দেখি আপনা থেকেই হাজির। কোথা থেকে আসছো কুমার, কোন পথ ধরেছো?’
‘ধিক তোকে, বুড়ি ডাইনী, অতিথির জন্যে খাবার নেই, দাবার নেই, শুরু করেছিস জেরা!’
বাবা-আয়াগা টেবিল সাজিয়ে খাবার দিলে, দাবার দিলে, ভোজন শেষে শুইয়ে দিলে। ভোর হতেই জাগিয়ে তুলে শুরু করলে জিজ্ঞাসাবাদ। সওদাগরপত্র ইভান আদ্যোপান্ত সব বলে জিজ্ঞেস করল:
‘বলো দিদিমা, রাজা অদীক্ষিত ললাটের কাছে যাব কী করে?’
‘ভাগ্যে এ পথে এসেছিলে, সাক্ষাৎ যমের হাতে পড়তে। রাজার কাছে এতদিন যাওনি বলে সে ভীষণ রেগে আছে। শোনো বলি, এই পথ ধরে যাও, পুকুর পাবে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকো। উড়ে আসবে তিনটি কপোত, তিন সন্দুরী, রাজার তিন মেয়ে। এসে তারা ডানা খুলে রেখে, পোষাক ছেড়ে পুকুরে নাইবে। একজনের ডানায় দাগ-ফুটকি। সুযোগ বুঝে সেই ডানা জোড়াটি ছিনিয়ে নিও। তারপর যতক্ষণ না তোমায় বিয়ে করতে রাজি হয় কিছুতেই ফেরত দিও না। ব্যস, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
বাবা-ইয়াগার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইভান তার কথামত পথ ধরে চলতে লাগল।
হাঁটতে হাঁটতে এল সেই পুকুরটার কাছে। লুকিয়ে রইল একটা ঝাঁকড়া গাছের আড়ালে। কিছুক্ষণ পরে তিনটি কপোত উড়ে এসে নামল, একজনের ডানায় দাগ-ফুটকি। মাটিতে আছাড় খেতেই তিনটি সন্দেরী মেয়ে হয়ে গেল তারা। ডানা খালে, জামা ছেড়ে তারা নাইতে নামল। ইভান ওদিকে ওঁৎ পেতে ছিল, চুপিচুপি গুটিগুটি এগিয়ে দাগ-ফুটকি ডানা জোড়া চুরি করে নিল। দেখে, কী হয়। সুন্দরীরা স্নান শেষ করে জল ছেড়ে উঠে এল পাড়ে। জামাকাপড় পরে ডানা লাগিয়ে কপোত হয়ে উড়ে চলে গেল দুজন, কিন্তু বাকি একজন পড়ে রইল, খুঁজতে লাগল হারানো ডানা।
খোঁজে, খোঁজে, আর বলে: ‘সাড়া দাও গো, বলো, কে আমার ডানা নিয়েছো। যদি বড়ো মানুষ হও তবে তোমায় বাবা বলব, যদি মাঝবয়সী হও তবে তোমায় কাকা বলব, কিন্তু যদি রপবান কুমার হও তবে হবে আমার স্বামী।’
এই শুনে গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এল সওদাগরপত্র ইভান।
‘এই নাও তোমার ডানা!’
‘বলো কুমার, বাগদত্ত বর আমার, কী তোমার কুল, কী গোত্র? কোথায় চলেছো?’
‘সওদাগরপুত্র ইভান আমি, চলেছি তোমার বাবা, রাজা অদীক্ষিত ললাটের কাছে।”
‘আমার নাম যাদকেরী ভাসিলিসা।’
যাদুকরী ভাসিলিসা ছিল বাবার সবচেয়ে আদরের কন্যা। যেমন রুপে তেমনি তার বুদ্ধি। ভাসিলিসা ইভানকে রাজা অদীক্ষিত ললাটের দেশে যাবার পথ বলে দিয়ে নিজে কপোত হয়ে অন্য বোনদের পিছন পিছন উড়ে চলে গেল।
ইভান প্রাসাদে পৌছলে রাজা তাকে লাগালে রান্নাঘরের কাজে: কাঠ কাটতে, জল তুলতে। রান্নাঘরের বাবুর্চি কেলেভুষো কিন্তু ইভানকে দুচোখে দেখতে পারত না। রাজার কাছে গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে ইভানের নামে লাগাতে শুরু করল সে।
‘হুজুর মহারাজ, ঐ সওদাগরপত্র ইভানটা বড়াই করে, সে নাকি এক রাত্রের মধ্যে গহন বন কেটে, কাঠ গাদা করে, শিকড় উপড়িয়ে, জমি চষে, বীজ বনে, গম কেটে, ঝেড়ে বেছে, পিষে, আপনার সকালে খাওয়ার জন্যে পিঠে তৈরী করে দিতে পারে।’
রাজা বললে, “ডেকে আনো ওকে।’
এল ইভান।
‘শুনছি খুব নাকি বড়াই করো: এক রাত্রের মধ্যে তুমি গহন বন কেটে, কাঠ গাদা করে, শিকড় উপড়িয়ে, জমি চষে, বীজ বনে, গম কেটে, ঝেড়ে বেছে, পিষে, আমার সকালে খাবার মতো পিঠে তৈরী করে দিতে পারো। বেশ, কাল সকালের মধ্যেই করে দেখাও।”
সওদাগরপত্র ইভান যতই অস্বীকার করুক কোনো লাভ হল না। হুকুম হয়ে গেছে, মানতেই হবে। উঁচু মাথা নীচু করে সে ফিরল রাজার কাছ থেকে। রাজার মেয়ে, যাদুকরী ভাসিলিসা তাকে দেখে বলল:
‘এত দুঃখ কেন তোমার?’
‘তোমায় বলে কী হবে, তুমি তো আর উপায় করতে পারবে না!’
‘বলা যায় না, হয়ত পারব!’
ইভান তখন ভাসিলিসাকে সব বলল, রাজা অদীক্ষিত ললাট তাকে কী কাজ করতে দিয়েছে।
‘ধ্যুৎ, এ আবার একটা কাজ নাকি, এতো ছেলেখেলা! আসল কাজ পরে আসছে। ঘুমতে যাও; রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে, কাল সকালের মধ্যে সবই ঠিক হয়ে যাবে।’
ঠিক রাত দুপ্রহর হতেই ভাসিলিসা প্রাসাদের রাঙা অলিন্দে দাঁড়াল। জোর গলায় ডাক পাঠাল। এক মিনিটের মধ্যেই চারিদিক থেকে ভিড় করে এল মজুর, লোকে লোকারণ্য। কেউ গাছ কাটে, কেউ মাটি খুড়ে শিকড় উপড়ায়, কেউ জমি চষে। একজায়গায় বীজ পোঁতে, ততক্ষণে অন্য জায়গায় ফসল কেটে শুরু হয়ে যায় ঝাড়াই মাড়াই। ধুলোর মেঘে ছেয়ে গেল। সকালের মধ্যে ময়দা করে পিঠে ভেজে সারা। রাজার সকালের জলযোগের জন্যে ইভান নিয়ে গেল পিঠেগুলো।
বাহবা!" বলে রাজা রাজভান্ডার থেকে ইভানকে পরস্কার দেবার হকুম দিলে।
বাবুর্চি কেলেভুষো এতে গেল আরো রেগে। রাজার কাছে সে নতুন করে লাগাতে গেল:
‘হুজুর, ইভান বলছে সে নাকি রাতারাতি এমন একটা জাহাজ বানিয়ে দিতে পারে যেটা আকাশে উড়বে।’
‘বেশ, ডেকে নিয়ে এসো ওকে।’
ডেকে আনা হল সওদাগরপত্র ইভানকে।
‘তুমি নাকি আমার দাসদাসীর কাছে বড়াই করেছো, এমন একটা চমৎকার জাহাজ রাতারাতি বানাতে পারো যেটা আকাশেও উড়বে? অথচ আমায় সে কথা জানাওনি! শোনো, কাল সকালের মধ্যেই ওরকম একটা জাহাজ তৈরী করে দিতে হবে।’
দুঃখে ইভানের উঁচু মাথা হেট হয়ে নামল কাঁধের নীচে। রাজার কাছ থেকে ফিরে এল যেন আর সে মানুষটি নয়। যাদুকরী ভাসিলিসা তাকে দেখে বললে:
‘কীসের দুঃখ তোমার, কীসের খেদ?’
দুঃখ না করে কী করি বলো, রাজা আদেশ করেছে এক রাত্রের মধ্যে একটা উড়ো জাহাজ বানিয়ে দিতে হবে।’
এ আবার কাজ নাকি, এতো ছেলেখেলা! আসল কাজ পরে। ঘুমতে যাও তো; রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে, কাল সকালের মধ্যে সবই ঠিক হয়ে যাবে।’
মাঝ রাত্রে ভাসিলিসা প্রাসাদের রাঙা অলিন্দে এসে জোরে জোরে ডাক পাঠাল। এক মহুর্তে চারদিক থেকে ছুতোরের দল ছুটে এল। তারপর করাত, কুড়ল নিয়ে ফুর্তি করে কাজে লেগে গেল সব। সকালের মধ্যে সব তৈরী।
রাজা বললে, 'খাসা হয়েছে! চলো আমরা একটু বেড়িয়ে আসি।”
উঠে বসল ওরা দুজনে। সঙ্গে নিল বাবুর্চি কেলেভুষোকেও। জাহাজ উড়ে চলল আকাশ দিয়ে। রাজার বুনো জানোয়ারগুলোকে যেখানে রাখা হত তার ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় কেলেভুষো উঁকি মেরে যেই দেখতে গেছে, অমনি ইভান তাকে এক ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিল। চোখের পলকে জানোয়ারগুলো বাবুর্চিকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিল।
ইভান চীৎকার করে উঠল, 'যাঃ! কেলেভুষো যে পড়ে গেল!’
রাজা বললে, ‘চুলোয় যাক গে! কুকুরের মরণ কুত্তার মতোই!’
প্রাসাদে ফিরে এল ওরা। রাজা বললে, ‘তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে, ইভান। এবার তিন নম্বরের কাজঃ একটা বুনো ঘোড়াকে বশ করতে হবে। যদি পারো, আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব।’
খুশী হয়ে সওদাগরপত্র ইভান ফিরে এল, ভাবল: “এ আর কঠিন কী।”
ফের যাদুকরী ভাসিলিসার সঙ্গে ইভানের দেখা। সব কথা শুনে ভাসিলিসা বলল:
‘বোঝোনি তুমি, ইভান। এবার সত্যিই তোমার কাজটা সহজ নয়, কঠিন কাজ, কারণ বুনো ঘোড়াটি হচ্ছে স্বয়ং রাজা অদীক্ষিত ললাট নিজে। উড়িয়ে তোমায় নিয়ে যাবে বাড়ন্ত গাছের উঁচুতে, উড়ন্ত মেঘের নিচুতে, খোলা মাঠে ছড়াবে তোমার হাড়গোড়। এক্ষুণি দৌড়ে কামার বাড়ী যাও। বলো একটা তিন পুদ ওজনের লোহার হাতুড়ি বানিয়ে দিতে। ঘোড়ার পিঠে শক্ত হয়ে চড়ে বসেই ওটার মাথায় বাড়ি মেরে ঠাণ্ডা রেখো।'
পরদিন আস্তাবল থেকে সহিসরা বের করে নিয়ে এল একটা বুনো ঘোড়া। ধরে রাখাই দায়। কী তার ডাক, কী তার চাঁট! সওদাগরপত্র ইভান পিঠে চড়ে বসতেই ঘোড়াটা উঠে গেল একেবারে বাড়ন্ত গাছের উঁচুতে, উড়ন্ত মেঘের নীচুতে, ছুটতে লাগল বাতাসের আগে আগে। ইভান কিন্তু শক্ত হয়ে বসে ঘোড়াটার মাথায় হাতুড়ি মেরে চলল ক্রমাগত। শেষ পর্যন্ত হয়রান হয়ে ঘোড়াটা নামল সোঁদা মাটিতে। সওদাগরপত্র ইভান ঘোড়াটা সহিসদের কাছে ফেরত দিয়ে একটু বিশ্রাম করে প্রাসাদে ফিরে গেল। গিয়ে দেখে, রাজা অদীক্ষিত ললাটের মাথায় পট্টি বাঁধা।
‘বুনো ঘোড়াটাকে বাগ মানিয়েছি, মহারাজ।”
‘বেশ, কাল এসো। বউ পছন্দ করে নিও। আজ আমার মাথাটা ধরেছে।’
পরদিন সকালে যাদুকেরী ভাসিলিসা সওদাগরপত্র ইভানকে বলল:
‘আমরা রাজার তিন মেয়ে। রাজা তিনজনকেই মাদী ঘোড়া বানিয়ে দিয়ে তোমায় বলবে বৌ বেছে নিতে। ভালো করে নজর রেখো, দেখবে আমার লাগামের একটা মণি প্যাটপ্যাট করছে। তারপর রাজা আমাদের কপোত করে দেবে। বোনেরা দানা খুটে খুটে খাবে। আর থেকে থেকেই আমি ডানার ঝাপটা মারব। তিন বারের বার আমাদের তিন কন্যে করে দেবে, তিনজনের একই মুখ, মাথায় এক, একই রকম চুল। আমি ইচ্ছে করে রুমোল নাড়াব; তাই দেখে চিনে নিও।”
যাদুকরী ভাসিলিসা যা বলেছিল তাই হল। রাজা তিনটে ঠিক একরকমের মাদী ঘোড়া এনে সার করে দাঁড় করিয়ে দিলে।
‘যেটা খুশী বেছে নিও।’
সওদাগরপত্র ইভান ভাল করে নজর করলে; দেখল, একটার লাগামের মণি প্যাটপ্যাট করছে। ইভান সেই লাগামটা ধরে বলল:
‘এই আমার বৌ!’
‘ভালোটা ছেড়ে খারাপটাই বেছেছো।’
‘তা হোক, এই আমার ভালো।’
‘আর একবার বাছো ।”
তিনটে কপোত ছাড়ল রাজা, পালকে পালকে অবিকল এক, দানা ছড়িয়ে দিলে। ইভান দেখল একটা কপোত কেবলি ডানার ঝাপটা মারছে। ইভান তার ডানা চেপে ধরল।
‘এই আমার বৌ!”
‘ঠিকটিকে ধরলে না। পরে পস্তাবে। বরং বারবার তিনবার বেছে দেখো।’
রাজা তিন কন্যা এনে দাঁড় করিয়ে দিলে। তিনজনের একই মুখ, মাথায় এক, একই রকম চুল। ইভান দেখল একজন রুমোল নাড়াচ্ছে। অমনি ইভান গিয়ে তার হাত চেপে ধরল।
‘এই আমার বৌ!"
আর উপায় নেই। রাজা অদীক্ষিত ললাট তাই ইভানের হাতেই যাদুকরী ভাসিলিসাকে সম্প্রদান করল। বিয়ে হয়ে গেল খুব ধামধাম করে।
গেল অল্পদিন, নাকি অনেকদিন, সওদাগরপত্র ইভান ঠিক করল এবার ভাসিলিসাকে নিয়ে নিজের দেশে পালিয়ে যাবে। ঘোড়ায় লাগাম পরিয়ে অন্ধকার রাতে বেরিয়ে পড়ল ওরা দুজন। পরদিন সকালে রাজা টের পেলে, ধরে আনবার জন্যে লোক ছুটল।
ভাসিলিসা স্বামীকে বলল, সোঁদা মাটিতে কান পাতো দেখি, কী শুনতে পাচ্ছো বলো!”
ইভান মাটিতে কান পেতে বলল: ‘ঘোড়ার ডাক শুনতে পাচ্ছি।’
ভাসিলিসা অমনি স্বামীকে একটা ছোট সবজি ক্ষেত বানিয়ে দিয়ে নিজে একটা বাঁধাকপি হয়ে গেল। যারা ধরতে এসেছিল তারা রাজার কাছে ফিরে গেল শূন্য হাতে।
‘হুজুর মহারাজ, খোলা মাঠে কিছুই দেখলাম না, শুধু একটা সবজি ক্ষেত ছাড়া, সে ক্ষেতের মধ্যে একটা বাঁধাকপির মাথা।’
‘যাও, ঐ বাঁধাকপিটাই কেটে নিয়ে এসো। এ ওই মেয়েরই একটা যাদু।”
লোকজন আবার ছুটল ওদের ধরতে। ইভান আবার সোঁদা মাটিতে কান পেতে শনেল। বলল:
‘ঘোড়ার ডাক শুনতে পাচ্ছি।’
ভাসিলিসা তখন নিজে একটা কুয়ো হয়ে গেল। আর ইভানকে করে দিল একটা ঝলমলে বাজপাখি। পাখিটা কুয়ো থেকে জল খেতে লাগল।
লোকজনেরা কুয়োর পাড়ে এসে দেখে, রাস্তাটা সেখানেই শেষ হয়ে গেছে। তাই ফিরে গেল আবার।
‘হুজুর মহারাজ, খোলা মাঠে কিছুই দেখলাম না, কেবল একটা কুয়ো আর তার পাশে একটা ঝলমলে বাজপাখি বসে জল খাচ্ছে।’
এবার রাজা অদীক্ষিত ললাট নিজেই বেরল। যাদুকরী ভাসিলিসা ইভানকে বলল, ‘এবার দেখো তো, মাটিতে কান পেতে কী শুনতে পাও!”
‘ওরে বাবা! আগের চেয়েও যে জোরালো ধপধপি, গরগর!’ ‘তার মানে এবার বাবা আসছে নিজে। কী করি? কী উপায়?’
‘আমার মাথাতেও আর কিছ আসছে না।’
যাদুকরী ভাসিলিসার কাছে ছিল তিনটি জিনিস: একটা বুরুশ, একটা চিরণী আর একটা তোয়ালে। সেগুলোর কথা মনে পড়তে ভাসিলিসা বলে উঠল:
‘আছে রাজা অদীক্ষিত ললাটের হাত থেকে বাঁচার উপায়।’
ভাসিলিসা বুরুশটা দোলাতেই হয়ে গেল একটা বিরাট গহন বন, গাছে গাছে এত ঠেসাঠেসি যে হাত গলে না। তিন বছরেও সারা বনটা ঘরে আসা যাবে না। রাজা অদীক্ষিত ললাট এখানে কামড়ায়, সেখানে কামড়ায় শেষ পযন্ত অতিকষ্টে একটু পথ করে নিয়ে আবার ধাওয়া শুরু করল। রাজা তাদের প্রায় ধরে ধরে, হাত বাড়ালেই হয়; ভাসিলিসা তার চিরুণীটা দুলিয়ে দিল – অমনি পথ আটকে দাঁড়াল একটা বিরাট খাঁড়া পাহাড়। পায়ে, হেঁটে ডিঙনো যায় না, ঘোড়ায় চড়ে পেরনো যায় না।
রাজা পাহাড়টার গায়ে সুড়ঙ্গ কাটতে শুরে করল। কাটতে কাটতে এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ হয়ে যেতেই রাজা আবার ধাওয়া শুরু করল। ভাসিলিসা তখন তোয়ালেটা পিছন দিকে দোলাতেই অমনি একটা বিরাট সমুদ্র হয়ে গেল। ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁর পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়াল রাজা – রাস্তা বন্ধ। ফিরে যেতে হল।
ভাসিলিসা আর ইভান যখন প্রায় এসে গেছে ইভান বলল: ‘আমি আগে গিয়ে বাবা-মাকে খবর দিই, তুমি ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করো।’
যাদুকরী ভাসিলিসা বলল, ‘শুধু একটা কথা মনে রেখো কিন্তু, বাড়ী পৌছে সবাইকে চুমো দিও। কিন্তু ধর্মমাকে কে নয়, ধর্মমাকে চুমো দিলেই আমার কথা সব ভুলে যাবে।’
সওদাগরপুত্র ইভান বাড়ী ফিরে এল, খুশী হয়ে চুম খেল সবাইকে। ধর্মামাকেও চুম দিল, ভুলে গেল যাদুকরী ভাসিলিসার কথা। আর বেচারী ভাসিলিসা একা একা রাস্তায় অপেক্ষা করে; ইভান আর আসে না। তাই শহরে গিয়ে এক বুড়ীর বাড়ী কাজ নিল ভাসিলিসা। এদিকে সওদাগরপত্র ইভানের বিয়ে করার ইচ্ছে হল। একটি কনে পছন্দ করে বিরাট ভোজের আয়োজন করতে লাগল।
যাদুকরী ভাসিলিসা তা জানতে পেরে ভিখারী সেজে সওদাগরের বাড়ী গেল ভিক্ষে করতে।
সওদাগরের বৌ বলল, ‘একটু দাঁড়াও, বাছা; তোমায় একটা ছোটো পিঠে ভেজে দিই। বিয়ের বড়ো পিঠেটা কাটবার আমার ইচ্ছে নেই।’
‘যা দাও মা, তাই ভাল। মঙ্গল হোক তোমার।’ বড়ো পিঠেটা কিন্তু পুড়ে গেল, আর সেই ছোটো পিঠেটা হল ভারি সুন্দর। সওদাগরের বৌ ছোটো পিঠেটা ভোজের জন্যে রেখে পোড়া পিঠেটা দিল ভিখারীকে। ছোটো পিঠেটা টেবিলের ওপর কাটতেই ফুড়ৎ করে বেরিয়ে এল এক জোড়া ঘুঘু ।
ঘুঘু তার জুড়ীকে বলে, “আমায় একটা চুম দাও না!’
'না, দেব না। তাহলে তুমিও আমায় ভুলে যাবে, সওদাগরপত্র ইভান যেমন ভুলে গেছে যাদুকরী ভাসিলিসাকে।’
ঘুঘু বারবার তিনবার বলল, "চুমো দাও না!’
'না, দেব না। তবে তুমিও আমায় ভুলে যাবে, সওদাগরপত্র ইভান যেমন ভুলে গেছে যাদুকরী ভাসিলিসাকে।’
সবকথা মনে পড়ে গেল ইভানের, চিনতে পারলে কে ঐ ভিখারী মেয়েটি। বাবা-মাকে অতিথি অভ্যাগতকে সে বললে: ‘এই আমার বৌ !’
‘তা তোমার যখন এক বৌ আছেই, তখন তার সঙ্গেই ঘর করো!’
নতুন কনেটিকে তারা দামী দামী উপহার দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিল। আর সওদাগরপত্র ইভান তার যাদুকরী ভাসিলিসার সঙ্গে মনের সুখে ঘরকন্না করতে লাগল। ধনধান্যে ঘর ভরা, দুঃখের মুখ দেখে না।
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
অনেক অনেক সুন্দর।
উত্তরমুছুন