অনেক অনেককাল আগে বনের মধ্যে এক গাঁয়ে থাকত এক সর্দার। সে ছিল গাঁয়ের সব মানুষের মাথা, সে গোষ্ঠীপতি। তার ছিল এক ছেলে। এমন দুষ্টু ছেলে কমই দেখা যায়। একটা দুষ্টুমি করেই সে আর একটা কি দুষ্টুমি করবে তা ভাবতে থাকে। বেশিক্ষণ ভাবেও না। দুষ্টুমির খেলা খেলতে তাকে কোনদিন বেশি কিছু ভাবতে হয় না।
একদিন গুলতি নিয়ে খেলছে। বাড়ির পাশের গাছে অনেক পাখি বসে রয়েছে। এর মধ্যেই গোটা তিনেক পাখিকে সে মেরেও ফেলেছে। এমন সময় দেখে পথ দিয়ে যাচ্ছে এক বুড়ি। মাথায় তার জলভর্তি কলসি। একটু হাসল সর্দারের ছেলে। টং করে আওয়াজ হল। কলসি গেল ভেঙে বুড়ি ভিজে গেল।
অনেক দূরের পাহাড়ি ঝরনা থেকে খাওয়ার জল আনতে হয়। বুড়ি রেগে গিয়ে বলল, “কোথাও শান্তি পাবি না। পাজি ছেলে কোথাকার! গোটা দুনিযা চষে বেড়ালেও শান্তি পাবি না। ওই দূরের অমর রাজ্যে গেলেও তুই শাস্তি পাবি না, এক মুহুর্ত বিশ্রাম পাবি না। এই বলে দিলাম।
কথাটা শুনে দুষ্ট ছেলে কেমন পালটে গেল। গুলতি ফেলে দিল দূরে। মুখ নিচু করে ঘরে ঢুকল। শুধু চিন্তা করছে বুড়ির কথা। মন খারাপ থাকে সবসময়। দুষ্টুমি করতে যায় না। শুধু ভাবে আর ভাবে । সে বেরিয়ে পড়তে চায় বিরাট দুনিয়ায়,– কোথায রয়েছে অমর রাজ্য, সে সেখানেই যাবে। কয়েকদিন ভাবনার পর সে সব ঠিক করে ফেলল। সর্দার-বাবার কাছে গিয়ে সে নতুন পোশাক চাইল, চাইল তরবারি আর একটা মোটা লাঠি। কথা শুনল না, বাবা-মাযের কথাও না। এইসব নিয়ে সে অজানা পথে রওনা দিল।
নিজের বাড়ি পেছনে পড়ে রইল।
সে পথ হাঁটছে। কত পথ পেছনে পড়ে রইল। কত গ্রাম পেরিয়ে গেল সে। বন পেরিয়ে এল, নদী পেরিয়ে এল। সে হাঁটছে, সে হাঁটছে।
শেষকালে বনের মধ্যে সে একজন সন্ন্যাসীর কুঁড়েঘর দেখতে পেল। পলকা দরজায় টোকা মারল। সন্ন্যাসী দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল। চোখ কুঁচকে বলল, "বাছা, তুমি কি চাও? এমন জায়গায় তুমি?
ছেলে বলল, “বলতে পার, কোথায় রয়েছে অমর রাজ্য? আমি সেখানে যাব। সন্ন্যাসী অবাক হয়ে চেয়ে রইল। একটু পরে বলল, "অমর রাজ্য তো আমি কখনও দেখিনি। অমর রাজ্যের নামও কখনও শুনিনি। কি জানি, কোথায় সে রাজ্য।
ছেলে দুঃখ পেল। সন্ন্যাসীও সে রাজ্যের কথা জানে না? বিড়বিড় করে বলল, ‘তাহলে এখন আমি কি করি? বাড়িতে তো ফিরতে পারব না। কখনই না।
এই কথা শুনে সন্ন্যাসী আস্তে আস্তে বলল, “সামনেই পড়বে ঘন বন। আলো ঢোকে না ওই বনে। নীচের দিকে অন্ধকার। ওই বনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাও। বনে রয়েছে অসংখ্য হিংস্র প্রাণী। যার সঙ্গে দেখা হবে তাকেই নত হয়ে অভিবাদন জানাবে, প্রত্যেককে। শেষকালে তুমি পৌঁছে যাবে একটা বিশাল রাজপ্রাসাদের সামনে। দেখবে, সামনে শুয়ে রয়েছে একটা মস্ত বড় সাপ। তাকেও নত হয়ে অভিবাদন জানাবে। মাথা সরিয়ে সে তোমায় পথ করে দেবে। সেখানে গেলে জানতে পারবে কোনদিকে কতদূরে যেতে হবে। এর বেশি আমি কিছু জানি না।
এগিয়ে চলল ছেলে। বনের ঘন অন্ধকারে সব পশু-পাখি-কীটপতঙ্গকে সে নত হয়ে অভিবাদন করল। কেউ কিছু বলল না। শেষকালে বন পেরিযে এল রাজপ্রাসাদের সামনে, বিশাল এক সাপ এধার-ওধার পথ জুড়ে শুয়ে আছে। ছেলে বলল, "বাঃ ! কি সুন্দর তোমার সোনালি দেহের রং-বাহার। তোমায় অভিবাদন জানাই।
সাপ খুব খুশি হল। মাথা একধারে সরিযে নিল। বলল, ‘খুব ভাগ্যবান তুমি। যদি আমায় অভিবাদন না জানাতে, এখুনি মেরে ফেলতাম তোমায়। খুব ভাগ্য ভালো তোমার। অল্প দূরে গিয়ে ছেলে থামল। পেছন ফিরে বলল, “আমাকে মারতে এলে তোমাকেও তালগোল পাকিযে দিতাম। কিংবা তুমি পড়ে থাকতে টুকরো টুকরো হয়ে। তুমিও ভাগ্যবান।
সর্দারের ছেলে রাজপ্রাসদের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দেখা হল এক বুড়োর সঙ্গে। বুড়োর ব্যস এই পৃথিবীর বয়সের সমান।খুব বুড়ো। সে বলল, "বাঃ, খুব সাহসী ছেলে তো! সাবাস। তা তুমি এখানে এলে কেন।’
‘আমি অমর রাজ্য খুঁজতে বেরিযেছি। এখনও পাই নি।
সে তো অনেক অনেক দূর। বহু দূরে। আজ পর্যন্ত কেউ সেখানে যেতে পারে নি, কেউ তার পথ জানে না। আমি জানি, শুধু আমি জানি। তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তাছাড়া আমার সব জীবজন্তুকে তুমি অভিবাদন জানিয়েছ, এতে আমি খুশি। ওরা আমার আদরের ছেলেমেয়ে। তোমায় আমি পথ বলে দেব। এই গোল বলটি তোমায় দিলাম। আসলে এতে জড়ানো আছে সোনার সুতো । এই তোমাকে পথ দেখাবে। এটাকে গড়িয়ে দেবে, আর এর পেছন পেছন যাবে। খুব ভালো লেগেছে তোমায়।
ছেলে নত হয়ে বুড়োকে বিদায় জানাল। বলটি মাটিতে জোরে গড়িয়ে দিল। বল পাহাড় ডিঙিয়ে, উপত্যক ছাড়িয়ে, শস্যখেত পেরিয়ে, মরুভূমি ছাড়িয়ে গড়িয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইল সরু সুতো, সোনার সুতো—ঠিক মাকড়সার জালের মতো। সুতোর পথ বেয়ে এগিয়ে চলল ছেলে। শেষকালে পোঁছল এক ওক গাছের নীচে। সেখানে সে থামল। সত্যি ক্লান্ত সে। বসে পড়ল গাছের নীচে।
গাছের নীচে পড়ে ছিল ওক ফলের একটা বীজ, ছেলে না দেখে তার ওপরে বসে পড়ল। বীজ ফেটে গেল, অঙ্কুর বেরিয়ে পড়ল। এত চাপ কি ছোট্ট বীজ সহ্য করতে পারে? সে ব্যথা পেয়ে বলে উঠল, “তুমি কে? তুমি তো খুব সুন্দর। তা তুমি চলেছ কোথায়?
‘আমি এক সর্দারের দুষ্টু ছেলে। আমি চলেছি অমর রাজ্যে। চিরকাল সেখানেই থাকব। সেখানেই যাচ্ছি।
বেশ ভালো, কিন্তু তুমি অমনভাবে আমার ওপরে বসে থেকে না। সবে আমার অঙ্কুর গজিয়েছে। এখনও আমি খুবই ছোট, বড়ই দুর্বল। তোমার চাপে গুড়ো হয়ে গেলাম। তুমি ওঠ। আমাকে বড় হতে দাও। ইচ্ছে করলে তুমি এখানেই থাকতে পার। কিছুদিন পরে আমি মস্ত বড় গাছ হব, ডালপালা-পাতায় ছড়িয়ে পড়ব। ততদিন তুমি আমার কাছেই থাক। তোমাকে একটা কথা বলি, আমি অনেক অনেকদিন বাঁচব, তারপর বুড়ো হব, ভেঙে পড়ব ঝড়ে, ধুলোর সঙ্গে মিশে যাব, ছোট ছোট পাখি সেই ধুলোয় আনন্দে গড়াগড়ি যাবে। সেই তখন তোমার শেষ দিন ঘনিয়ে আসবে, তার আগে নয়।
সর্দারের ছেলে একথা শুনে উঠে দাঁড়াল। নরম মাটি এনে অঙ্কুরের চারপাশে দিল, এটা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে। বিদায় জানিয়ে ছেলে রওনা দিল ।
অনেকদিন ধরে ছেলে পথ চলল। শেষকালে এক আঙুর খেতে এল। আঙুরের ভারে লতানো গাছ নুইয়ে পড়েছে। গাছের নীচের ছায়ায় সে বসে পড়ল। খুব ক্লান্ত সে। হাত বাড়িয়ে পাকা আঙুর তুলে খেতে লাগল। একটু পরে আঙুর গাছ বলল, ‘ওগো সুন্দর ছোট ছেলে, তুমি একা একা কোথায় চলেছ?
‘আমি চলেছি অমর রাজ্যে। চিরকাল সেখানেই থাকব। আঙুর গাছ বলল, আঙুরের একটা বীজ এই মাটিতে পুতে দাও। এই বীজ একদিন বড় হবে, তাতে অনেক আঙুর ফলবে। ইচ্ছে হলে তুমি এখানেই থেকে যেতে পার। আঙুর গাছ এত বড় হয়ে উঠবে যে মাটির নীচে আর শেকড় যেতে পারবে না, পাতা এত বেশি হবে যে সূর্যের আলো ঢুকতে পারবে না। ততদিন তুমি এখানে থেকে যাও আর আঙুর খাও। তুমি বাঁচবে ততদিন।
ছেলে আঙুরের একটা বীজ ভালোভাবে মাটিতে পুঁতে দিল, নরম মাটি চারপাশে রেখে দিল। তারপর বলল, “কত ভালো তুমি, তোমার ফলের রস খেয়ে আর আমার ক্লান্তি নেই। তোমার বীজ বড় হোক, তার ডালপালা ফুলে-ফলে ভরে উঠুক। কিন্তু আমায় যে আরও অনেক দুর যেতে হবে বন্ধু।
আঙুর বীজ বলল, ‘তুমি যাও, তোমার পথের বাঁধা দূর হোক। বিপদ না আসুক। এগিয়ে চলল ছেলে। চলছে, চলছে......হঠাৎ বনের পথে দেখতে পেল একটা ঈগল পাখি আহত হয়ে পড়ে রয়েছে। ছেলের দুষ্টু বুদ্ধি জেগে উঠল। তীর-ধনুক নিয়ে তাকে মারতে গেল। করুণ গলায় ঈগল বলল, ওগো সুন্দর ছেলে, তীর নামাও, আমাকে মেরো না। আমাকে একটু জল দাও, আমাকে সুস্থ করে তোল। আমি তোমার অনেক উপকার করব। আমাকে মেরো না, দোহাই তোমার। তুমি যখন কোন বিপদে পড়বে, শুধু একবার আমার কথা মনে আনবে। আমি তক্ষুনি তোমার কাছে উড়ে যাব। তোমার বিপদে পাশে থাকব ।
তির-ধনুক পিঠে রেখে দিল ছেলে। জল এনে ঈগলকে সুস্থ করে তুলল। তার ভাঙা ডানায় হাত বুলিয়ে দিল, গাছের রস লাগিয়ে দিল। গাছের ফল এনে তাকে খেতে দিল। আবার এগিয়ে চলল সামনে ।
একটু পরেই সে পৌঁছে গেল সমুদ্রের কাছে। বালির ওপর দিয়ে হঁটিতে হাঁটতে সে দেখতে পেল, তার সামনে সাদা মতন কি যেন চকচক করছে। আরও একটু এগিয়ে গেল। অবাক হয়ে গেল। ঢেউ পেছনে সরে গেল, মাছেদের রাজা বালির ওপর ছটপট করছে। সূর্যের তাপে বালি গরম হয়ে রয়েছে। মাছেদের রাজা চব্বিশ হাত লম্বা আর মানুষের মতো উচু। তার পাখনা রুপোলি রঙের আর আঁশ সোনালি রঙের। কোন মানুষ এমন মাছ আগে দেখেনি।
ছেলে মাছের পাশে গিয়ে বলল, "এমন সুন্দর দেখতে যে মাছ তার স্বাদও নিশ্চয়ই খুব ভালো হবে। খিদেও পেয়েছে......'
সোনালি মাছ বলে উঠল, ’ওগো সুন্দর ছেলে, তুমি আমাকে খেয়ো না। তুমি আমাকে মেরো না। সমুদ্রের গভীর জলে তুমি আমায় ভাসিয়ে দাও। যখনই তুমি বিপদে পড়বে, শুধু আমার কথা মনে করবে, আমি বিপদে তোমার পাশে থাকব।
মস্ত বড় একটা লাঠি কুড়িয়ে আনল সে। তারপর আস্তে আস্তে গড়িয়ে মাছেদের রাজাকে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিল।
আবার রওনা দিল ছেলে। হঠাৎ দেখতে পেল, একটা শেয়াল প্রাণের ভয়ে ছুটছে আর তার পেছনে অনেকগুলো বুনো কুকুর। শেয়ালের দেহ ক্ষতবিক্ষত, জিভ বের করে সে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছে। দুষ্ট বুদ্ধি জেগে উঠল ছেলের মনে। তীর-ধনুক ঠিক করছে এমন সময় শেয়াল বলে উঠল, ওগো সুন্দর ছেলে, আমাকে মেরো না, দোহাই তোমার। আমাকে বাঁচাও, বুনো কুকুরদের হাত থেকে বাঁচাও। আমার আঘাত ভালো করে দাও। একদিন হয়তো তোমার বিপদে কাজে লাগতেও পারি।
সর্দারের ছেলে বুনো কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে দিল, শেয়ালের গায়ে গাছের ঠান্ডা রস লাগিয়ে দিল। বেশ কয়েকদিন ধরে তার কাছে থাকল। শেয়াল ভালো হয়ে উঠল। বিদায় নেবার সময় শেয়াল বলল, “তুমি খুব ভালো ছেলে। তোমার ভালো হোক। যখনই তুমি বিপদে পড়বে, শুধু আমার কথা মনে করবে, আমি বিপদে তোমার পাশে থাকব।
আবার পথে নামল ছেলে। যতই এগোয় সোনার সুতোর বল ততই এগিয়ে যায়। কিন্তু বলটি ছোট হয়ে আসছে, অনেক সোনালি সুতো পেছনে রয়ে গিয়েছে। হঠাৎ ছেলে দেখতে পেল একটা গাছ। তার দুই ডালের মাঝখানে মাকড়সার জাল। সেই জালে আটকে পড়েছে একটা মশা। সে তাকে দেখেই কেঁদে উঠল, ওগো সুন্দর ছেলে। আমাকে বাঁচাও, যেমন করে পারি তোমাকে সাহায্য করব। আমি জানি তুমি কোথায় চলেছ। অমর রাজ্যে। আমাকে যদি বাঁচাও, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।
এই কথা শুনে ছেলে থামল, মাকড়সার জালের কাছে গেল। হাত বাড়িয়ে জালের মধ্যে থেকে মশাকে তুলে আনল। তখনও মশা ছটফট করছে। মশা বলল, "ছেলে, তোমার মন খুব ভালো, বড় দয়া তোমার। যখন কোন বিপদে পড়বে, আমার কথা মনে করবে, আমি তোমার পাশে থাকব। এগিয়ে যাও, কোন বিপদ হবে না। তোমাকে আর বেশি দূর যেতে হবে না, সামনেই তুমি একটা প্রাসাদ দেখতে পাবে। সোজা ঢুকে পড়বে, দেখবে রাজা বসে আছে সিংহাসনে। তার কাছে গিয়েই বলবে, আপনার ছোট মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিন। বিয়ে না হলে তুমি অমর রাজ্য শাসন করতে পারবে না। এগিয়ে যাও।
সর্দারের ছেলে এগিয়ে চলল। সোনালি সুতোর বল ছোট হচ্ছে, আরও ছোট হচ্ছে। আপেলের মতো হয়ে গেল, বাদামের মতো হয়ে গেল, মটরশুটির মতো হয়ে গেল,—মিলিয়ে গেল এক প্রাসাদের দরজার সামনে ।
অপূর্ব প্রাসাদ। প্রাসাদের সিংহদ্বার বন্ধ। ছেলে দ্বারে আঘাত করল। রাজা সেই আঘাত শুনে একজন সৈন্যকে পাঠালেন। সৈন্য দ্বার খুলে বলল, ‘কে তুমি, কোথা থেকে এসেছ, কেন এসেছ, কোথায় তুমি যেতে চাও?
সব প্রশ্নের উত্তর দিল ছেলে। তার উত্তর শুনে রাজা তাকে তার সামনে আনতে বললেন। ছেলে মাথা উঁচু করে বলল, “মহারাজ, আপনাকে প্রণাম জানাই। আমি এখানে এসেছি আপনার ছোট মেয়েকে বিয়ে করতে। আপনি কি রাজি আছেন? আপনার ছোট মেয়ে হবে আমার বউ।
রাজা হেসে বললেন, "কেন রাজি থাকব না? আমার ছোট মেয়েকে তোমার হাতেই দেব। কিন্তু একটা কথা। তোমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে, যদি কেউ খুঁজে না পায় তবেই মেয়ের বিয়ে দেব। তোমার সঙ্গে তখন ধুমধাম করে ওর বিয়ে দেব, তুমি চিরকাল থাকবে আমার কাছে। কেননা, আর যাওয়ার পথ নেই। এই প্রাসাদের এই সিংহদ্বার থেকে শুরু হয়েছে অমর রাজ্য।
অমর রাজ্যের কথা শুনেই ছেলের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আবার সঙ্গে সঙ্গে মুখে মেঘও নেমে এল। কেননা, সে কেমনভাবে লুকোবে তা জানে না! কেউ দেখবে না এমনভাবে লুকোতে হবে। সে তো এসব জানে না! সে ভাবছে, ভাবছে—হঠাৎ সেই আহত ঈগল পাখির কথা মনে পড়ল। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ছেলে দেখল তার পাশে ঈগল দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘এত মন খারাপ কেন বন্ধু? কি হয়েছে?’
‘তুমি এসে গিয়েছ ঈগল? বড় বিপদে পড়েছি। এমন বিপদ আগে বুঝিনি.... । ছেলে খুলে বলল বিপদের কথা।
‘এই ব্যাপার। কিছু ভাবতে হবে না।’ ঈগল আশ্বাস দিল।
ঈগল ছেলেকে তুলে নিল। উঁচু, উঁচু আকাশে লুকিয়ে ফেলল তাকে। নীচে নয়টা মেঘের স্তর। কেউ দেখতে পাবে না ছেলেকে । সেই রাজার ছিল তিন মেয়ে । তিনজনকে একই রকম দেখতে। তাদের মুখের গড়ন এক, মাথায় চুল এক, পোশাক এক, জুতোও একই রকমের। রাজা বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন, হাতে তার খোলা তরবারি। বড় মেয়েকে বললেন, "ছেলেকে খুঁজে বের করো। যদি না পাও, এক আঘাতে তোমার মাথা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।
বড় মেয়ে বাগানে গেল, এক সাজিভর্তি ফুল তুলল। তারপরে বাবার সঙ্গে ছেলেকে খুঁজতে গেল। মেয়ে পৃথিবীর চারদিকে তাকিয়ে দেখল, ছেলেকে দেখতে পেল না। মেয়ে সাগরের চারদিকে দেখল, ছেলেকে দেখতে পেল না। মেয়ে আকাশের দিকে চাইল, ছেলেকে দেখতে পেল। বলল, "ছেলে, মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসো। তোমায় দেখে ফেলেছি।
চোখের পলকে ঈগল ছেলেকে নিয়ে মেঘের আড়াল থেকে মাটিতে নেমে এল । তার দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, ‘ছেলে, তোমার মাথা কি লুটিয়ে দেব? তরবরি খোলা রয়েছে।’
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বড় মেয়ে বলে উঠল, “বাবা, প্রথমবারে ও হেরে গিয়েছে, ওকে ক্ষমা করো।
রাজা ক্ষমা করলেন, ‘শোনো, আমার মেজ মেয়ে যদি তোমায় খুঁজে পায়, তোমার মাথা কিন্তু দেহের ওপরে থাকবে না।
রাজা প্রাসাদে চলে গেলেন মেজ মেয়েকে আনতে। আহা! বেচারি ছেলে, মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। ভাবতে লাগল। কেমন করে এ বিপদ কাটবে? কোন পথ তো জানা নেই। হঠাৎ তার মনে পড়ল মাছেদের রাজার কথা। হঠাৎ সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেল, ঢেউ এসে লাগল প্রাসাদের দেয়ালে। আর ঢেউয়ের মধ্যে থেকে উঠে এল মাছেদের রাজা। এত মন খারাপ কেন? কি হয়েছে বন্ধু?
ছেলে সব বলল। এবার ঠিকমতো লুকোতে না পারলে রাজা তার মাথা কেটে দেবেন। বড় বিপদ তার।
‘কোন চিন্তা নেই। সমুদ্রের অতল গভীরে অনেক লুকোবার জায়গা আছে। আমি জানি। আমি তোমায় নিয়ে যাব। মাছেদের রাজা ছেলেকে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে নিল, তারপরে গভীর সমুদ্রে মিলিয়ে গেল।
রাজা মেজ মেয়েকে নিয়ে প্রাসাদের বাইরে এলেন। খোলা তরবারির দিকে চেয়ে বললেন, "ছেলেকে খুঁজে বের করো। যদি না পার, মাথা লুটিয়ে পড়বে মাটিতে।
মেজ মেয়ে বাগানে গেল, এক সাজিভর্তি ফুল তুলে এনে বাবার সঙ্গে চলল। মেয়ে পৃথিবীর চারদিকে তাকিয়ে দেখল, ছেলেকে খুঁজে পেল না। মেয়ে আকাশের চারদিকে দেখল, সূর্যের পেছনে চাঁদের পেছনে, ছেলেকে খুঁজে পেল না। শেষকালে সমুদ্রের নীচে চোখ ফেরাল, দেখতে পেল ছেলেকে, ‘বেরিয়ে এসো সমুদ্রের গভীর তল থেকে, আমি তোমায় দেখে ফেলেছি।
মাছেদের রাজা ছেলেকে চোখের পলকে রাজার সামনে নিয়ে এল। রাজা বললেন, ‘এবার তাহলে মাথা নিচু করো ‘
মেজ মেয়ে ছুটে গিয়ে রাজার হাত ধরে বলল, “বাবা, দ্বিতীয়বারেও হেরে গিয়েছে, ওকে এবারও ক্ষমা করো।’
‘বেশ তোমার কথাই রাখলাম। দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমা করলাম। ছেলে, আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমায় ক্ষমা করলাম। কিন্তু তৃতীয়বারেও যদি খুঁজে পাই, তাহলে সবুজ ঘাসে তোমার আর পা পড়বে না। সেই মুহুর্তেই..... ।
রাজা প্রাসাদের মধ্যে চলে গেলেন। ছেলে মাথায় হাত দিয়ে সবুজ ঘাসের ওপরে বসে পড়ল। তার বুক কাঁপছে, চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে। এখন সে কি করবে? রাজার তরবররি তার দেহের কাছে আসবে, তার পর সব শেষ। কোথায় পড়ে রইল তার বাবামা, কোথায় তার অমর রাজ্য। অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে।
হঠাৎ আহত শেয়ালের কথা মনে পড়ল। তাকিয়ে দেখে, পাশে বসে রয়েছে সেই শেয়াল। এত মন খারাপ কেন? কি বিপদ হয়েছে তোমার বন্ধু?
‘শোনো বন্ধু আমার বিপদের কথা .........
‘শান্ত হও। মন খারাপ করো না। এর জন্য অত ভাবতে হবে না। আমার সঙ্গে এস, আমি জানি কি করতে হবে?
শেয়াল এগিয়ে চলল। পেছনে পেছনে যাচ্ছে সর্দারের ছেলে। মুখচোখে কালো মেঘ। শেয়াল ফুলের বাগানে ঢুকল। ছেলেও। শেয়াল হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, লেজ দিয়ে ছেলের দেহ স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে সুন্দর ফুল হয়ে গেল। বাহারি রঙিন ফুলগাছের মধ্যে সে মিশে থাকল। সবচেয়ে সুন্দর ফুল হয়ে রইল।
রাজার ছোট মেয়ে ফুলের বাগানে ঢুকল। সাজিতে একটি মাত্র ফুল তুলল। ওই ফুলটাই তার সব চেয়ে ভালো লেগেছে। এত সুন্দর ফুল বাগানে আর দুটি নেই। সাজি হাতে বেরিয়ে এল বাগান থেকে। বাবার কাছে। বাবা খোলা তরবারির দিকে চেয়ে বললেন, ‘খুঁজে বের করো সেই ছেলেকে, নইলে তরবারির এক আঘাতে মাথা লুটিয়ে পড়বে মাটিতে ।
ছোট রাজকুমারী পৃথিবীর চারদিকে দেখল, ছেলেকে খুঁজে পেল না। মেয়ে সমুদ্রের চারদিকে দেখল, ছেলেকে খুঁজে পেল না। মেয়ে আকাশের চারিদিকে দেখল—তবু খুঁজে পেল না ছেলেকে। মেয়ে আবার পৃথিবীর গভীরে, সমুদ্রের তলায় ওপাশের আকাশে বারবার চেয়ে দেখল, কিন্তু খুঁজে পেল না সেই লুকনো ছেলেকে।
রাজা বললেন, "ভালোভাবে খুঁজে দেখো। তুমিই তাকে লুকিয়ে রেখেছ। গান ঝরে পড়ল গলায়। বিষাদের গান, ‘বাবা, আমি চারদিকে খুব ভালোভাবে দেখেছি, খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি তার ছায়া দেখেছি, কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছি না?
রাজার আর কিছু করার নেই। তিনি বলে উঠলেন, সাবাস সাহসী ছেলে, তুমি এবার বেরিয়ে এসো। আমার মেয়ে তোমায় খুঁজে পায়নি।
এই তো আমি এখানে, আপনার সামনে।
সত্যি তুমি বেজায় সাহসী। ছোট ছেলে, তোমার কাছে হেরে গিয়েছি। রাজা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তার সব বাজনাদারদের ডাকলেন। ছেলেকে নিয়ে গেলেন প্রাসাদের মধ্যে। যদি ছেলে ঠিকমতো ছোট রাজকুমারীকে চিনতে পারে, তবে এক্ষুনি হবে তাদের বিয়ে। আর যদি চিনতে না পারে, তবে ছেলের মাথা লুটিয়ে পড়বে প্রাসাদের মেঝেতে।
ছেলে ভেবেছিল, তার সব বিপদ কেটে গিয়েছে। কিন্তু নতুন বিপদ হল। অনেকক্ষণ কাঁদল। তার চোখদুটো লাল হয়ে উঠল। এইবার আমার জীবনের শেষ, সব শেষ। এবার রাজা ঠিক আমার মাথা কেটে ফেলবেন। রক্ষা নেই।
হঠাৎ তার সেই মশার কথা মনে পড়ল। দেখতে পেল, মশা তার কানের কাছে উড়ে এসে বসেছে। বন্ধু, এত মেঘ কেন তোমার মুখে? এমন করে কাঁদছ কেন? আমি তো রয়েছি ।
বন্ধু, তুমি একটা ছোট্ট মশা। কি করবে তুমি! আমি ভেবেছিলাম, আমাব সব বিপদ কেটে গিয়েছে। কিন্তু রাজা এবার সত্যিই আমার মাথা নামিয়ে দেবে। কেমন করে বলব, কোনজন রাজার ছোট মেয়ে। তিনজনেই যে একই রকম দেখতে ।
কিছু ভেবো না বন্ধু। আমি সব জানি। কে বড়, কে মেজো আর কে ছোট মেয়ে আমি বুঝতে পারি। আমি যে ওদের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি। এদের চিনব না? রাজা যখন তিন রাজকুমারীকে নিয়ে আসবে, আমি ছোট মেয়ের নাকের ওপরে উড়ে গিয়ে বসব। তাহলেই তুমি বুঝবে....।’
রাজার পেছনে তিন মেয়ে এগিয়ে এল। পাশাপাশি দাঁড়াল। এক চোখ, এক মুখ, মাথায় এক, পরে রয়েছে একই পোশাক। কেউ বলতে পারবে না, কে বড়, কে মেজো, কে ছোট। অসম্ভব। সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। ছেলের কানের ওপর থেকে মশা উড়ে গেল। ছোট মেয়ে হাত তুলে নাকের ওপরে বসা মশাকে তাড়াতে গেল। ছেলে এগিয়ে গিয়ে ছোট রাজকুমারীর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিযে বলল, “মহারাজ, এই মেয়েই ছোট রাজকুমারী।
রাজা অবাক হলেন। হেসে বললেন, ‘সাবাস ছোট ছেলে, তুমি ঠিক চিনতে পেরেছ।হ্যাঁ, ওই আমার ছোট মেয়ে।
ছোট মেয়ে সকাল বেলার সূর্যের মতো সুন্দরী, ফুটন্ত তুলসী ফুলের মতো মিষ্টি। রাজা ছেলেকে বরের সাজে সবার সামনে নিয়ে এলেন, পাশে রয়েছে ছোট রাজকুমারী। রাজা ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, "তোমায় আমার ছোট মেয়েকে তুলে দিলাম। সেই সঙ্গে দিলাম আমার গোটা রাজ্য। আজ থেকে তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। মৃত্যু কি, তা তুমি কোনদিন জানতে পারবে না, তুমি অমর হয়ে চিরকাল বেঁচে রইবে। তোমার রাজ্যে তুমি ঘুরে বেড়াও। এ রাজ্য আজ থেকে তোমার। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে, প্রাসাদের যে দ্বার দিয়ে তুমি একদিন এখানে ঢুকেছিলে, ভুলেও কখনও তার বাইরে যাবে না। তাহলে সর্বনাশ নেমে আসবে। ভীষণ বিপদ।
ধুমধাম করে দুজনের বিযে হয়ে গেল। ছেলে প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।
সে সোনালি বাগানে যায়, সোনালি গাছে গাছে ফল ধরেছে, ফলের ভারে গাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে। প্রাসাদের ঘরগুলো সোনায় মোড়া, রুপোয় মোড়া, তার মধ্যে অমূল্য সব উজ্জ্বল পাথর। প্রাসাদের কুয়োগুলো শ্বেতপাথরের, মধু আর দুধে ভর্তি নদীগুলো। ডালে ডালে গান-গাওয়া পাখি, পথগুলো সবুজ ঘাসে ঢাকা, ছোট ছোট লতানো ফুলে সাজানো। তার ওপর সকালের শিশির জমে, মনে হয় মুক্তো ঝরে আছে। এমন প্রাসাদ কেউ দেখেনি। সে রাজ্যে সূর্য ওঠে না, সূর্য ডোবে না। সূর্য সবসময় থাকে প্রাসাদের ওপরে। তার মিষ্টি নরম আলো প্রাসাদকে সবসময় উজ্জ্বল করে রাখে।
ছেলে যেন বাস করছে স্বর্গের উদ্যানে। একদিন ছেলে গিয়েছে শিকার করতে। হাতে তীর-ধনুক। প্রাসাদের প্রাচীরের দিকে তীর ছুড়ছে। প্রাচীর টপকে তীর ওধারে চলে গেল। তীরটা কোথায় পড়েছে? সে প্রাচীরের ওধারে তাকিয়ে দেখল। নীচে বেশ দূরে। তীরটা আনা দরকার। সে সিংহদ্বার খুলে ফেলল। ভুলে গেল রাজার নিষেধের কথা। ঘরের বাইরে এসেই সে দেখতে পেল, সেখানে পড়ে রয়েছে সোনালি সুতোর ছোট্ট বল। মনে পড়ল বাড়ির কথা, বাবা-মায়ের কথা। এতদিন সব ভুলে ছিল। বাবামায়ের কাছে যাবার জন্য মনে কেমন করে উঠল। বুকের মধ্যে বেদনা। সে একটু চিত্তা করল। তারপর ঠিক করে ফেলল, “সব কিছু পেছনে ফেলে যাব, যাব আমার বাবামায়ের কাছে। কেমনভাবে আমার বাবা-মা রয়েছে তা দেখতে যাব। যাবই। আহা ! কতদিন বাবা-মাকে দেখিনি।
সর্দারের সাহসী ছেলে রাজার কথা বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই কি কখনও হয়? বাবা-মা মরে গিয়েছে? তা কেমন করে হবে? এই তো সেদিন এলাম তাদের ছেড়ে । না, যেতেই হবে। ছেলে তৈরি হয়ে নিল। সে তার অস্ত্রগুলো সঙ্গে নিল। রাজাকে প্রণাম জানাল। বউয়ের হাত ধরে একটু তাকিয়ে রইল, বেরিয়ে পড়ল প্রাসাদ থেকে।
রাজা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, বউয়ের বুক ভিজে গেল। সোনালি সুতোর পথ ধরে ছেলে পেছন-পানে চলল। যে পথ দিয়ে সে অমর রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছিল, সেই পথ ধরে চলল। আবার অবিরাম চলা।
সে এল আঙুরের ক্ষেতে। ছোট আঙুরের গাছ ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড় পেরিয়ে গিয়েছে, কোথায় তার শেষ কেউ জানে না। আঙুর গাছ তাকে চিনতে পেরে বলল, ‘ওগো সাহসী ছেলে, আমার ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো। তুমি বড় ক্লান্ত।
আঙুর গাছ, তোমার কথা রাখতে পারছি না। কিছু মনে করো না। আমার সময় নেই। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছতে হবে ।
এগিয়ে গেল ছেলে। পৌঁছল ওক গাছের নীচে। ওক গাছ তাকে চিনতে পারল, ‘সাহসী ছেলে। অল্পক্ষণ জিরিয়ে নাও আমার ছায়ায়। তুমি আমার অনেক উপকার করেছিলে। সেদিনের কথা আমি ভুলিনি। যে ছোট্ট বীজকে তুমি সেদিন বঁচিয়েছিলে, সেই আমি আজ এত বড় হয়েছি। অনেক কাল কেটে গিয়েছে।
সর্দারের ছেলে অবাক হয়ে চেয়ে রইল ওক গাছের দিকে। সেই ছোট্ট বীজ আজ এত বড় হয়েছে? এই তো সেদিন আমার দেহের চাপে ওর অঙ্কুর বেরুল। এত সময় পেরিয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ভাবতে ভাবতে ছেলে এগিয়ে গেল।
শেষকালে পৌঁছল সেই জায়গায় যেখানে সে সোনালি সুতোর বল পেয়েছিল, সেইখানেই সে সেই সাপটকে দেখতে পেল। একি? সাপটা বুড়ো অথর্ব হয়ে পড়েছে। তার বিশাল দেহ শুকিয়ে ছোট হয়ে গিয়েছে। তবু সে চিনতে পারল ছেলেকে। খুব খুশি হল। মাথা নেড়ে বলল,‘আমি বুড়ো হয়েছি, তবুও তোমায় গিলতে গিয়েছিলাম। যেই তুমি অভিবাদন জানালে, তক্ষুনি তোমায় চিনতে পারলাম। ভালো আছো তো?
প্রাসাদে ঢুকল ছেলে। বুড়ো বসে রয়েছে। তার দাড়ি বরফের মতো সাদা, বিরাট লম্বা। শোবার সময় দাড়িকে ভাগ করে এক গুচ্ছের ওপরে সে শুয়ে পড়ে, অন্য গুচ্ছ গায়ে চাপা দেয়। তাহলে অনেক অনেক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ছেলে বুড়োকে দেখে ভাবছে। বুড়ো কোঁচকানো মুখে চোখের ভারী পাতা তুলে বলল, “তোমায় ঠিক চিনেছি ছেলে। যদি আবার এপথ দিয়ে কখনও যাও, যেমন করে পার আমার সঙ্গে দেখা করো, ভুলো না।
বুড়োর কাছে বিদায় নিয়ে ছেলে আরও এগিয়ে গেল। তার গায়ের বাড়ি আর বেশি দূর নয়। সে পৌঁছে গেল সন্ন্যাসীর কুঁড়েঘরের কাছে। কিন্তু কুঁড়েঘর নেই, সন্ন্যাসী নেই। ঘন জঙ্গলে ভরে উঠেছে সেই জায়গা। এত ঘন জঙ্গল যে তার ভয় হল। এখুনি হয়তো নেকড়ে বেরিয়ে তাকে ছিনভিন্ন করে দেবে।
কুঁড়েঘরের জায়গায় এত ঘন জঙ্গল দেখে এবার সত্যিই ছেলের বুক কেঁপে উঠল। মুখচোখে কালো মেঘ। সত্যিই তাহলে বহুকাল কেটে গিয়েছে। এত ঘন জঙ্গল হতে তো অনেক দিন সময় লাগে। তাহলে বাবা-মা বেঁচে নেই? সে ঠিক করে ফেলল, না ফিরেই যাই বউয়ের কাছে।
তবু ফিরে যেতে পারল না। বাবা-মা তাকে টানছে, তার গ্রাম তাকে টানছে। সেই বুড়ির কথা মনে পড়ল। সে এগিয়ে চলল। শেষকালে নিজের ছেড়ে আসা গ্রামে পৌঁছল। সে এদিকে-ওদিকে চাইল, কাউকে দেখতে পেল না। এক বিশাল ধ্বংসস্তুপ দেখতে পেল। অনুমানে বুঝল, এই তার সর্দার বাবার মাটির প্রাসাদ।
ফোকরের মধ্যে দিয়ে সে একটা কুঁড়েঘর দেখতে পেল। তার মধ্যে বসে রয়েছে এক বুড়ো, তার বয়স তিনশো বছর। বুড়ো, বলল, “হ্যাঁ, আমি আমার ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, এখানে এক সর্দারের প্রাসাদ ছিল, আমি সে সর্দারকে চোখে দেখিনি। শুনেছিলাম, তার একটা দুষ্ট ছেলে ছিল। সে বেরিয়ে পড়েছিল বিশাল পৃথিবীতে, সে যেতে চেয়েছিল অমর রাজ্যে, যেখানে মৃত্যু নেই। যেখানে মানুষের বয়েস বাড়ে না, যেখানে অনন্ত সুখ। আমি শুনেছি এসব কথা। তারপরে গায়ে মহামারী লাগল। সব মানুষ মরে গেল। সব পশুপাখি। এসব আমার শোনা কথা।
সর্দারের ছেলে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। অমর রাজ্যের রাজার কথা মনে পড়ল। তাহলে সব কথাই সত্যি। চোখের জল মুছে ছেলে ফিরে চলল। অনেক পথ পেরিয়ে সে অমর রাজ্যের সিংহদ্বারে পৌছল।
অবাক হল সে। ঘরের সামনে মাটির পাহাড় জমেছে। পা দিয়ে লাথি মেরে সে মাটি সরাতে লাগল। পাগলের মতো লাথি মারছে, মাটি এধার-ওধার ছিটকে পড়ছে। বেরিযে পড়ছে দরজার সামনের চৌকাঠ। হঠাৎ মাটির ফাঁক থেকে মৃত্যু বেরিয়ে এল, তার সারা দেহ কালো পোশাকে ঢাকা। মৃত্যু খুব রোগা, দেহ হাড় জিরজিরে। তার কাঁধে একটা কাস্তে। ছেলে মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে ভাবল, তাহলে আমার সব শেষ হল আজ। চরম মুহুর্ত। মৃত্যু সামনে দাঁড়িয়ে।
মৃত্যু খ্যানখেনে গলায় বলল, তাহলে, শেষ পর্যন্ত তুমি এলে। কতকাল তোমার জন্য এখানে বসে রয়েছি।
এক মুহূর্ত চিন্তা করে নিল ছেলে। মৃত্যু তার দিকে চেয়ে হাসছে। হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো ঘুরে দাঁড়াল ছেলে। প্রচণ্ড বেগে হাওয়ার গতিতে দৌড় দিল উলটো মুখে। পৌঁছে গেল বুড়ো রাজার প্রাসাদে। আর দৌড়াতে পারছে না। সে সাপকে অভিবাদন জানাল, খুব খুশি হয়ে সাপ মাথা সরিয়ে নিল, ছেলে প্রাসাদে ঢুকে পড়ল। ক্লান্ত দেহে হাঁপাতে হাপাতে ছেলে বলল, ওগো বুড়ো মানুষ, আমাকে বাঁচাও। আমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে না। আমাকে বলো কি করতে হবে। মৃত্যু আমাকে ধাওয়া করছে।
বুড়ো তখুনি তাকে পশমের একটা কটিবন্ধ দিল। বলল, “এই নাও, মৃত্যুকে এই পশমের কটিবন্ধ দাও। তাকে বলো, যতক্ষণ সুতো থাকবে ততক্ষণ সে যেন এটা কোমরে জড়াতে থাকে। এই পশমের সুতো শেষ হলেই সে শুধু তোমার কাছে আসতে পারবে। মৃত্যু এসে পড়েছে সাপের সামনে। কাস্তে তুলে মৃত্যু সাপকে টুকরো করে কাটতে গেল। বিরাট হা করল সাপ, তার জিভ আগুনের মতো লাল। আগুন বেরুতে লাগল সাপের মুখ থেকে। মৃত্যু কাছে আসতে পারছে না। সাপ চেঁচিয়ে বলছে, ‘নিষ্ঠুর মৃত্যু, তুমি থামো। এগিয়ো না। কেন মিছিমিছি মানুষের পেছনে ধাওয়া করো?
‘সে ভাবনা তোমার নয়। ওসব তুমি বুঝবে না। আমাকে প্রাসাদে ঢুকতে দাও । মৃত্যু কাস্তে চালচ্ছে।
“আমাকে তুমি অভিবাদন জানাও নি। তোমায় এক পা এগোতে দেব না। বাঁচতে চাও তো পালাও। কাছে এলে পুড়ে মরবে।
সাপের মূর্তি দেখে, আগুনের হলকায় ভয় পেয়ে মৃত্যু কিছু দূরে সরে গিয়ে চেঁচাতে লাগল, ‘প্রাসাদের বুড়ো মানুষ, সর্দারের ছেলেকে বের করে দাও। নইলে একটা একটা করে তোমার দাড়ি উপড়ে ফেলব।
এমন সময় পশমের কটিবন্ধ হাতে নিয়ে সর্দারের ছেলে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল, মৃত্যু, এই কটিবন্ধ নাও, এটাকে কোমরে জড়াও, যখন পশমের সব সুতো জড়ানো শেষ হবে, তখন আমার কাছে এসো?
মৃত্যু কটিবন্ধ নিয়ে কোমরে জড়াতে লাগল। দৌড় দিল ছেলে, তীরের বেগে। পৌঁছে গেল ওক গাছের নীচে। ওক গাছ বলল, ‘আবার এসেছ তুমি, খুব ভালো লাগছে আমার। আমার ছায়ায় একটু জিরিয়ে নাও।
‘বন্ধু, সে সময় আমার নেই। মৃত্যু আমার পেছনে ধাওয়া করেছে। ওক গাছ কেঁপে উঠল, দুঃখ পেল। বলল, “মৃত্যু যখন তোমার কাছে আসবে, তাকে এই লোহার ছড়িটা দেবে। বলবে, এই ছড়ি নিয়ে তুমি ঘুরে বেড়াও, নীচ থেকে এর হাতল পর্যন্ত যখন ক্ষয়ে যাবে তখন আসবে আমার কাছে।
ওক গাছকে বিদায় জানিয়ে ছেলে দৌড় শুরু করল। মৃত্যু তার পিছনে। পথ ছেড়ে দিয়ে ছেলে মাঠঘাট পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে ছুটছে। কোন জ্ঞান নেই তার। হঠাৎ মৃত্যু একদিন তার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘অনেক ছুটেছ সাহসী ছেলে, এবার থামো। তোমার দিন শেষ।
‘বেশ, দিন যদি শেষ হয়েই থাকে ভয় পাই না। কিন্তু তার আগে এই লোহার ছড়িটা নাও, এই ছড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াও । নীচ থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যখন হাতল পর্যন্ত ক্ষয়ে যাবে তখন এসো আমার কাছে।
মৃত্যু লোহার ছড়ি নিয়ে চলে গেল। মাটিতে ঠুকে ঠুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বেশি বেশি করে ঘুরছে, যাতে ছড়ি তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়।
মুক্ত হয়ে ছেলে আবার দৌড় দিল। তার যেন ডানা বেরিয়েছে, সে যেন হাওয়ায় ভেসে দেড়চ্ছে। পৌঁছে গেল আঙুর খেতের কাছে। দূর থেকে তাকে চিনতে পেরেই আঙুর গাছ বলে উঠল, ’সাবাস বন্ধু, আবার দেখা হল। অনেক আঙুর পেকেছে। ছায়ায় বসে বিশ্রাম করো, আঙুর খাও, ক্লান্তি দূর করো।
‘খুব ইচ্ছে করছে তোমার ছায়ায় বসে বিশ্রাম করি। কিন্তু উপায় নেই। অনেক পথ চলতে হবে, আমার চলার পথ অাঁকাবঁকা হয়ে উঠছে। সময় কোথায় বন্ধু। মৃত্যু আমার পেছনে ধাওয়া করেছে।
তাই বুঝি, তা অত ভাবনা কিসের? দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি। ‘বন্ধু, আর কিছু চাই না, শুধু তুমি আমায় বলে দাও কেমন করে নিষ্ঠুর মৃত্যুকে ঠেকাব। কি করলে মৃত্যু আমায় স্পর্শ করতে পারবে না ? এটা বলে দাও ।
'যদি সত্যি সত্যি মৃত্যু তোমার এত কাছে এসে থাকে, তুমি তাকে তোমার তরবারি দিয়ে বলবে, এই তরবারি যখন মরচে পড়ে পড়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখন তুমি আসবে আমার কাছে।
‘তুমি ভালো থেকো আঙুর গাছ, আমি তাই করব। মৃত্যু এলে তার পায়ের ওপরে আমার তরবারি ফেলে দেব। বিদায় বন্ধু।
আবার মাঠঘাট পেরিয়ে ছেলে ছুটে চলল। চলছে, চলছে। হঠাৎ মৃত্যু একদিন তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘এবার থামো সর্দারের ছেলে, তোমার দিন ফুরিয়েছে। ‘বেশ, তাতে আমি ভয় পাই না। শেষবারের মতো তোমায় একটা জিনিস দেব, শেষবারের মতো। এই তরবারি আমি কোনদিন কাছছাড়া করিনি। তবু তোমায় দিলাম আমার এই প্রিয়তম বস্তু। মরচে পড়ে পড়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে এটা যখন নিঃশেষ হয়ে যাবে তখন এসো আমার কাছে। তখন আর কোন অনুরোধ জানাব না। আর যদি এটা ক্ষয়ে না যায়, আমার পেছনে এসো না, আমি অমর রাজ্যে পৌঁছে যাব।
ছেলে তার প্রিয়তম তরবারি ফেলে দিল মৃত্যুর পায়ের ওপরে। আবার চলল এগিয়ে, বায়ুবেগে । তরবারিতে মরচে ধরল, ক্ষয়ে গেল, কিছুই বাকি রইল না। মৃত্যু ছুটে আসছে তার পেছনে, ধনুকের ছিলা থেকে ছাড়া-পাওয়া তীরের মতো। কিন্তু ছেলে পৌঁছে গিয়েছে প্রাসাদে, সিংহদ্বার খুলে গিয়েছে। ছোট মেয়ে ছুটে এল বরের কাছে। বরের একটা হাত ধরে ফেলল। কিন্তু খোলা দরজা দিয়ে মৃত্যুও ঢুকে পড়েছে, তীরের বেগে মৃত্যু ছেলের একটা পা চেপে ধরল। বলল, “থামো, তুমি এখন আমার। কোথায় যাচ্ছ তুমি?
ছোট রাজকুমারী কেঁপে কেঁপে বলে উঠল, 'না, ও তোমার নয়, ও আমার, শুধু আমার।
'না, ছেলে আমার। আমি মৃত্যু, ওকে ছেড়ে দাও। মেয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বলল, তাই যদি হয়, তবে আমি ছেলেকে একটা সোনার আপেল করে দেব, সোনার আপেলকে দূর আকাশে ছুড়ে দেব। যে তাকে ধরতে পারবে সে হবে তারই ।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে সর্দারের ছেলেকে সোনার আপেল করে দিল। আপেলটি হাতে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে দিল। আকাশের পথে যেতে যেতে দূর আকাশে মিলিয়ে গেল আপেল,— সে হল আকাশের ধ্রুবতারা।
এমন সময় রাজা ও অন্য দুই মেয়ে বেরিয়ে এসেছে। তক্ষুনি তারা বুঝে ফেলল কি হয়েছে। ছোট মেয়েকে তারা সোনার আপেল করে দিল, হাতে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে দিল। আপেলকে বলল, ‘আকাশে যাও, ছেলেকে খুঁজে নিয়ে আবার ফিরে এসো প্রাসাদে। তখন মৃত্যু আর তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সে অমর হয়ে রইবে।
মেয়ে আপেল হয়ে আকাশের পথে যেতে যেতে দূর আকাশে মিলিয়ে গেল,— সে হল আকাশের শুকতারা।
মৃত্যু এইসব দেখে ভীষণ রেগে গেল। রাগে কাঁপতে লাগল। শেষকালে রাজা ও দুই মেয়ের ছায়াকে পদাঘাত করল, সঙ্গে সঙ্গে তারা তিনটি পাথরের স্তম্ভ হয়ে গেল।
সেদিন থেকে ধ্রুবতারা আর শুকতারা আকাশে দেখা দিল, উজ্জ্বল হয়ে সেখানেই রয়ে গেল। আর আজও সেই দূর অমর রাজ্যের সিংহদ্বারের কাছে তিনটি পাথরের স্তম্ভ দেখতে পাবে। সেই থেকে সব প্রাসাদের সামনেই পাথরের স্তম্ভ থাকে।
বর-বউ অমর হয়ে ধ্রুবতারা-শুকতারা হয়ে আকাশেই রয়ে গেল।
ডাউনলোড PDF : ডাউনলোড
0 coment�rios: