Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

      কাঠবেড়াল খুব কাজের লোক। এক মুহূর্ত সে চুপ করে বসে থাকে না। সবসময় কাজ করে। সেইসঙ্গে চটপটেও খুব। শুধু যখন আবছা অাঁধার ঘনিয়ে আসে, চোখে...

কার ফসল কে ঘরে তোলে - আদিবাসী লোককথা

      কাঠবেড়াল খুব কাজের লোক। এক মুহূর্ত সে চুপ করে বসে থাকে না। সবসময় কাজ করে। সেইসঙ্গে চটপটেও খুব। শুধু যখন আবছা অাঁধার ঘনিয়ে আসে, চোখে দেখতে পায় না,—তখনই ফিরে আসে গাছের কোটরের বাসায়। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে তার, তার ওপরে বুড়ো বাবা-মা রয়েছে। এতগুলো মুখে খাবার জোগাতে তাকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়।
      আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে। শুধু জল পড়ছে। জমি নরম হয়েছে। পাথুরে জমিও শেষকালে নরম হল। কাঠবেড়ালের ছিল একফালি জমি। সময় নষ্ট না করে সে কাজে লেগে গেল। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই জমিতে নেমে গেল। গায়ের লোম ভিজে উঠছে, বারবার চোখ থেকে জল সরাতে হচ্ছে। খুব কষ্ট। তবু কাজের বিরাম নেই। কিন্তু একটা কাজ করতে সে ভুলে গেল। জমিতে যাওয়ার আলপথ সে তৈরি করেনি। সে সাধাসিধে মানুষ। বিপদ যে এদিক থেকে আসবে তা আঁচ করতে পারেনি। আর তাছাড়া অত ঘোরপ্যাঁচও সে বোঝে না। এই তো অল্প ফসল, এর জন্য আবার আলপথের কি দরকার। গাছে গাছে লাফিয়ে, এদিক-ওদিক তিড়িং-বিড়িং লাফিয়েই সে জমিতে পৌছে যায়।

        সেই বনে এক গাছের বাসায় থাকত এক মাকড়সা। ভারি চালাক। ভীষণ দুষ্টুবুদ্ধি তার। বসে বসে খাওয়ার ফন্দি আঁটে। মোটেই খাটে না, খাটতে চায়ও না। এমনি একদিন সে খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে। যেতে যেতে দেখে একফালি জমিতে সবুজ ফসল ফলে আছে। সবুজ ফিকে হয়ে আসছে। ফসল পাকতে আর দেরি নেই। জমিটা ভালোভাবে দেখে মাকড়সা অন্য কোথাও চলে গেল।
       কয়েকদিন কেটে গিয়েছে। মাকড়সা প্রতিদিনই এসে জমি দেখে যায়। লুকিয়ে লুকিয়ে। বাঃ, ফসল পেকে গিয়েছে। এবার ফসল কাটার সময়।
      পরের দিন ভোরবেলা ছেলেমেয়ে নাতিপুতি নিয়ে মাকড়সা জমিতে চলে এল। সঙ্গে কয়েকটা ছোট ধামা। তারা এসেই আলপথ তৈরি করতে লেগে গেল। জাল দিয়ে পথ বানাল। জালের পথ হয়ে গেল। তারা কুটুস কুটুস করে ফসলের গোড়া কাটতে লাগল। আঁটি বেঁধে জমির একপাশে জড়ো করে রাখল। অাঁটি বাঁধছে, আর জড়ো করছে।
       জমির ফসল পেকে উঠেছে। আগাছা আর বাছতে হচ্ছে না তাই জমিতে কোনই কাজ নেই। কাঠবেড়ালও দু-তিন দিন এদিকে আসে নি। আসার তো আর কোন দরকার নেই! সেদিন জমিতে এসেই তার চোখ কপালে উঠে গেল। সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বুক কাঁপতে লাগল। তার সব পাকা সোনার ফসল মাকড়সা কেটে ফেলেছে, জমির পাশে জড়ো করে রেখেছে।
        চোখ-ভর্তি জল নিয়ে কাঠবেড়াল বলল, “বন্ধু, মাকড়সা, এ তুমি কি করছ? আমার জমির ফসল তুমি কাটছ কেন? কত কষ্টের ফসল আমার।
      মাকড়সা গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে বলল, তার মানে? এ জমি বুঝি তোমার? এ ফসল তুমি ফলিয়েছ? কেমন করে জমি চষলে?
      ভেতরে ভেতরে খুব রেগে উঠল কাঠবেড়াল। তবু রাগ চেপে নরম গলায় বলল, এ জমি আমার। আর ফসল ফলিয়েছি আমি নিজেই। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, আধপেটা খেয়ে। আজ এসেছি ফসল কাটতে। এ ফসল আমার নয়তো কার? এসব কি কথা বলছ তুমি?
      ফন্দিবাজ মাকড়সা। চট করে বলে বসল, ‘বেশ, মেনে নিচ্ছি তোমার কথা। ভালো কথা। কিন্তু, এ জমি যদি তোমার হয়, এ ফসল যদি তোমার হয়, তবে জমিতে আসার আলপথ কোথায়?
       কাঠবেড়াল অবাক হয়ে বলল, "আলপথ? আমার তো পথের দরকার হয় না। গাছে গাছে লাফিয়ে, তিড়িং-বিড়িং লাফিয়ে আমি সব জায়গায যেতে পারি। এমনি করে জমিতেও পৌঁছে যাই। কি দরকার আমার পথের?
       মাকড়সা চোখদুটো আরও গোল করে ঠাট্টা করে বলল, "বাঃ ! বেশ মজার কথা শোনালে তো! জমি তোমার, সেই জমি তুমি চাষ করেছ, আর আলপথ বানাও নি! কে বিশ্বাস করবে তোমার কথা? কেউ কবে শুনেছে এমন কথা? তুমি আমাকে বোকা বানাবে? বাঃ ! বাঃ ! বেশ।
      কাঠবেড়াল গো-বেচারি, সাদাসিধে মানুষ ! অত মারপ্যাচ বোঝে না। কি আর করে? দৌড়ে গেল পশুদের কাছে। সব খুলে বলল। কেঁদেও ফেলল।
       সর্দার পশুরা বলল, "কাঠবেড়াল, এ তো ঠিক কথা নয়। এ তো বিশ্বাস করা যায় না। তুমি জমি চাষ করেছ অথচ আলপথ বানাও নি? এ কেমন করে হবে? আর মাকড়সা? সে জমি চাষ করেছে, তার নিজের মতো করে জালের পথও বানিয়েছে। সে পথ বানিয়ে জমি চাষ করেছে। ও ফসল মাকড়সার। তুমি আজকাল বড্ড মিছে কথা বলতে শিখেছ।
      হাই তুলছে সর্দার পশুরা। তাদের সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে। গা চুলকোচ্ছে সর্দার পশুরা। তাদের থাবা-নখ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে কয়েকবার তাকিয়ে কাঠবেড়াল ফিরে চলল। পথ দেখতে পারছে না। বন-পথ-আকাশ ঝাপসা লাগছে। চোখ-ভর্তি জল। ফিরে এল গাছের কোটরের বাসায়। সেখানে অনেকগুলো ক্ষুধার্ত মুখ তার পথ চেয়ে বসে রয়েছে। তার চোখ আরও লাল হয়ে উঠেছে। চোখের কোল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুক কেঁপে উঠল। এবার বোধহয় সবাইকে না খেয়েই মরতে হবে। বুক বুঝি ফেটে যাবে।
       ওদিকে ফসলের পাহাড় বয়ে মাকড়সা চলেছে বাড়ির পথে। জালের পথ বেয়ে। খুব ছোটরাও ছোট ছোট আটি নিয়েছে। সার বেঁধে চলেছে তারা।
       এমন সময় একটা দমকা হাওয়া এল। পটাং করে ছিড়ে গেল জালের পথ। অাঁটি সমেত মাকড়সারা ঝুপ করে পথের ওপরে পড়ে গেল। আচমকা একটু ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।.এমন সময় নামল বৃষ্টি। ওরা তাড়াতাড়ি একটা শুকনো গাছের কোটরে ঢুকে পড়ল। আর একটুখানি পথ বাকি রয়েছে। এ বৃষ্টি আর কতক্ষণ। থেমে গেলেই ফসল তোলা যাবে গাছের বাসায়। সোনার ফসলে ভরে উঠবে গাছের কোটর। সারা বছর আর ভাবতে হবে না। বুদ্ধি থাকলে তেমন খাটতে হয় না। মাকড়সা ভাবছে, কার ফসল কে ঘরে তোলে। চোখে দুষ্টুমির হাসি।
       শেষকালে বৃষ্টি ধরে এল। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এতে অসুবিধে কিছু হবে না। মাকড়সা কোটর থেকে বেরিয়ে এল, পেছনে পেছনে আর সবাই। গুটিগুটি আসছে। কিন্তু এ কি? মাকড়সার চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।
       একটা মস্ত বড় বাজপাখি তার বিরাট দুটো ডানা দুপাশে মেলে ফসলের ওপরে বসে রয়েছে। বৃষ্টির জলে দেহের ডানা-পালক সব ভিজে কালচে হয়ে উঠেছে। লাল চোখ জ্বলছে। বাজপাখি বৃষ্টি থেকে ফসল বাঁচাচ্ছে। ঠোঁটদুটো অল্প ফাঁক করে রয়েছে, বুক ওঠাপড়া করছে।
       বাজপাখি বেজায় রাগি, ভীষণ হিংসুটে। গায়ের জোর খুব, ঠোঁটের ধার ভীষণ। চোখদুটো তার জ্বলছে। তবু ভয়ে ভয়ে মাকড়সা এল বাজপাখির সামনে। চোখের দিকে তাকিয়ে মাকড়সার বুকের রক্ত জল হয়ে গেল। কোনরকমে চোখ নামিয়ে ঢোক গিলে বলল, ‘প্রভু, আপনি খুব ভালো, খুব উপকারী। আমার ফসলগুলোকে কত কষ্টে বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়েছেন। গলা আটকে গেল মাকড়সার, আর কোন শব্দ বেরুল না।
       কর্কশ আওয়াজ হল। হাওয়ার ধাক্কা খেয়ে আওয়াজ অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ল। মাকড়সা দু-পা পিছিয়ে এল। আকাশে থেকে বুঝি বাজ পড়ল। চোখ ঘুরিয়ে বাজপাখি বলল, “কি? কি বললি? তোর ফসল? কে কবে শুনেছে—নিজের জমির ফসল পথের মাঝে ফেলে রেখে কেউ চলে যায়? চালাকি করিস না আমার সঙ্গে। এক ঠোকরে তোর..... ।এ ফসল আমার। এক কুটোও পাবি না। আর একবার মুখ খুললে উবে যাবি?
       পেছন দিকে হাঁটতে লাগল মাকড়সা। চোখ রইল বাজপাখির দিকে। বেশ দূরে এসে সে থামল। আর একটু হলেই হয়েছিল আর কি ! টুক করে বাজের মুখে ঢুকে যেতাম। খুব বাঁচা বেঁচেছি। ঢের হয়েছে, আর না।
       পায়ের নখে ফসলের আঁটি চেপে ধরল বাজপাখি, ডানা মেলে দিল, ওপরে উঠল। তারপর হাওয়ায় ভেসে চলল। অনেক নীচ থেকে মাকড়সা দেখল,—বাজপাখি দূরে আরও দূরে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। ভাবল—কার ফসল কে ঘরে তোলে।

0 coment�rios: