গ্রামের নাম জ্যোৎঘনশ্যাম। যেমন দূর তেমনই নিবান্ধাপুর। এখনও দিনমানেও ওইসব গ্রামে যেতে গা ছমছম করে। তা আমার আশৈশবের বন্ধু মণিশঙ্করের বিয়ের চিঠি পেয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করতেই হল। অনেকদিন ধরেই বিয়ের কথাবার্তা চলছিল ওর। চলছিল আর ভেঙে যাচ্ছিল। এবারে একেবারে পাকাপাকি। সব ঠিকঠাক। রেজেষ্ট্রি চিঠিতে সবকিছু গুছিয়ে লিখেছ ও, কীভাবে যেতে হবে না হবে তার ম্যাপ এঁকে। আর এও লিখেছে, যেন নিমানে যাই। সকালের দিকে রওনা হয়ে দুপুরের মধ্যে পৌছই। না হলে কিন্তু পথে দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।
একে মণিশঙ্করের বিয়ে, তায় আবার পথ নির্দেশিকায় অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ। আমার সহকর্মী পরেশকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালাম আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। প্রথমটায় ও যেতে রাজি হয়নি। পরে আমার জেদাজেদিতে হল। রাজি না হওয়ার কারণও ছিল অবশ্য। মণির সঙ্গে আলাপ-পরিচয় দূরের কথা, মণিকে ও চোখেও দেখেনি কখনও। তায় আবার এমনি বেড়াতে যাওয়া নয়, বিয়েবাড়ি বলে কথা। তাই সংকোচ একটু হচ্ছিল। পরে যখন ওকে বুঝিয়ে বললাম, এটা শহর বাজার হলে আলাদা ব্যাপার ছিল। যেহেতু এটি সুদূর গ্রামে এবং নিমন্ত্রণপত্রেও লেখা আছে সবান্ধবে তখন না যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। বিশেষ করে ও জায়গায় এক যাওয়ার ঝক্কি অনেক। কাজেই পরেশ না গেলে আমাকেও হয়তো যাত্রা স্থগিত রাখতে হবে। তাই শুনে একটু কিন্তু-কিন্তু করেও রাজি হয়ে গেল ও। যাওয়ার আগের দিন রাত্রে পরেশ এসে আমার কাছে রইল। পরদিন খুব ভোরে আমরা দুজনে রওনা হলাম জ্যোৎঘনশ্যামের দিকে। রামরাজাতলা স্টেশনে এসে কোলাঘাটের দুটো টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেই মেজাজটা গেল বিগড়ে। ট্রেনের বগিতে একটা ভিখারি চারদিক নোংরা করে মরে পড়ে আছে। দেখে মনে হল মরবার আগে ভীষণ যন্ত্রণা পেয়েছে বেচারি! আমি তো থুঃ থুঃ করে ঘেন্নায় থুতু ছেটালাম। পরেশ বলল, যাত্রা শুভ। যাই হোক, আমরা পরের স্টেশন সাঁতরাগাছিতে নেমে অন্য বগিতে চলে এলাম।
যাত্রা যে কতটা শুভ তা টের পেলাম হাতেনাতে কোলাঘাট স্টেশনে নেমেই। কাঁসাই নদীর তীর পর্যন্ত বেশ কয়েক মাইল যে-বাসে আমরা যাব, গিয়ে শুনলাম কোনও একটি অজ্ঞাত কারণে সেই বাসটি নাকি আজ কয়েকদিন যাবৎ বন্ধ আছে।
শুভ কাজে যাত্রার শুরুতেই এইরকম ঘটে যাওয়ায় মনটা অত্যন্ত দমে গেল।
পরেশ বলল, “তা হলে উপায়? এতদূর এসে কি শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে হবে?”
“না না। ফিরে যাব কেন? বাস না থাকে সাইকেল রিকশা তো আছে। তাতেই যাব। তবে ভাড়া একটু বেশি পড়বে।”
“কত ?”
“তা ধরে না কেন কুড়ি-পঁচিশ টাকা তো নেবেই।”
“একটা রিকশাকে ধরে তা হলে।”
“দাঁড়া। আগে কোথাও বসে একটু জলযোগের ব্যাপারটা সেরে নিই। কেননা শুনেছি এ পথে কোথাও কিছু পাওয়া যায় না।” এই বলে রূপনারায়ণের বাঁধের ধারে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি খাবারের দোকানে বসে বেশটি করে দই মিষ্টি খেয়ে নিলাম।
তারপর অনেক দরদাম করে ত্রিশ টাকা ভাড়ায় রাজি করালাম একজন রিকশাওয়ালাকে। রিকশা আমাদের নিয়ে তিরতিরিয়ে গ্রামের পথ ধরে চলতে লাগল। চলেছি তো চলেছি। পথের আর যেন শেষ হয় না। একসময় কাঁসাই নদীর বাঁধের কাছে এসে থামলাম। রিকশা যেখানে আমাদের নামালো সেখানটা দারুণ নির্জন। এই নির্জনতা আমার কল্পনাপ্রবণ মনকে যেমন আনন্দ দিল তেমনই ভাবতে লাগলাম এই সমস্ত অঞ্চলে যেসব গ্রাম আছে সেইসব গ্রামের মানুষরা কীভাবে বেঁচে আছেন? ডাক্তার বদ্যি, ওষুধপত্তর, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর কীভাবে সংগ্রহ করেন এঁরা। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন যাচ্ছি তখন হঠাৎই এক জায়গায় একটি দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম দু’জনে। রাত্রি হলে হয়তো দুজনেই জ্ঞান হারাতাম কিন্তু যেহেতু এটি প্রকাশ্য দিবালোক, তাই ভয়ে এবং বিস্ময়ে দুজনের চোখের পাতা নড়ল না।
পরেশ বলল, “এও কি সম্ভব!”
“অসম্ভব কী ? চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছি যা দেখবার।”
আমরা দেখলাম বাঁধের ঢালে একটি ঘনপত্রবিশিষ্ট বটগাছের ছায়ায় রামরাজাতলা স্টেশনের ট্রেনের কামরায় দেখা মৃত ভিখারিটা সেই একই ভাবে সেইরকম যন্ত্রণাকাতর মুখে মরে পড়ে আছে। আমি আবার থুঃ করে থুতু ছেটালাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আর এক মুহুৰ্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে হনহন করে এগিয়ে চললাম নদীর ঘাটের দিকে। আমাদের দু’জনের সমস্ত আনন্দই তখন স্নান হয়ে গেছে।
এক সময় আমরা ঘাটে এসে পৌঁছলাম। এখানে দু-একটি চায়ের দোকান আছে। আমরা একটি চায়ের দোকানে চা খেতে বসলাম। একটি নৌকা লোকজন নিয়ে তখন ওপারের দিকে রওনা হয়েছে। সেটি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা ওপারে যেতে পারব না। চা খেতে খেতে দোকানদারের সঙ্গে সামান্য একটু আলাপ জমালাম। শুনলাম নৌকোয় ওপারে গিয়ে আবার রিকশা নিতে হবে। আরও দশ মাইল পথ গেলে তবেই সেই গ্রাম। দোকানদার জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কোথা থেকে আসছেন বাবা?”
বললাম, “রামরাজাতলা থেকে।” তারপর বললাম, “আচ্ছা ভাই, তোমাদের এখানে শ্মশান কোথায়?”
দোকানদার অবাক হয়ে বলল, “এত কিছু থাকতে হঠাৎ শ্মশানের খোঁজ নিচ্ছেন কেন বাবু? আমাদের এখানে শ্মশান বলে কিছু নেই। কেউ মরেটরে গেলে এই নদীর ঘাটেই যেখানে হোক একটি সুবিধেমতো জায়গায় তাকে পোড়ানো হয়।”
“গরিব দুঃখী লোকেরা কী করে? তারা কি পোড়ানোর অভাবে নদীর জলে ফেলে দেয়?”
“কী যে বলেন বাবু! এখানে নদীতে কেউ মড়া ফেলে না।”
“বিশ্বাস করলাম না।”
“কেন ফেলবে বলুন তো বাবু? এখানে কি কাঠকুটোর অভাব আছে, না মানুষজন নাই?
দরকার হলে পাঁচজনে চাঁদা তুলেও সৎকারটা করিয়ে দেয়।”
“তা যদি হয় তা হলে এই একটু আগে আমরা দুজনে ঘাটে আসবার পথে বটতলায় যে মানুষটাকে মরে পড়ে থাকতে দেখলাম তার কোনও ব্যবস্থা হয়নি কেন এখনও? দেখে তো মনে হল অনেকক্ষণ মরেছে। হয়তো একদিন আগেই মরেছে। এইভাবে রাস্তার ধারে মড়াটাকে ফেলে রাখা কি ঠিক? কিছু না হোক, লোকজন এনে নদীর গবায় অন্তত সরিয়ে রাখুন। যাতে পচন ধরে দুর্গন্ধ না ছড়ায়।”
বলুন দেখি আপনারা? কে এখানে বটতলায় মরে থাকবে। এই একটু আগে আমি এলাম, কিছু দেখলাম না, আর আপনারা বলছেন মড়া দেখলেন?”
“আপনার কি ধারণা আমরা মিথ্যে কথা বলছি?”
“নানা তা কেন?” বলেই ডাকলেন, “বিশে! এই বিশে!”
দোকানের পেছনদিকের খেতে একটি ছেলে আগাছা নিড়োচ্ছিল, দোকানদারের ডাকে এগিয়ে এসে বলল, “কী হয়েছে?”
“বাবুরা বলছেন এই বটতলায় কে নাকি মরে পড়ে আছে যা তো একবার দেখে যায় তো ব্যাপারটা কী।”
ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মাথায় গামছা বেঁধে ছুটল। এবং পরক্ষণেই ফিরে বলল, “কই না তো! কেউ তো নেই।”
আমরা দু’জনে দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম।
দোকানদার বলল, “ঠিক আছে। বিশে, তুই একটু দোকানে বোস। আমিই বাবুদের সঙ্গে গিয়ে দেখে আসছি ব্যাপারটা কী। এমন তো হয় না কখনও?”
আমাদের কৌতুহল তখন সীমাছাড়া হয়ে গেছে। তাই যেখানে ভিখারিটাকে মরে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, দোকানদারকে নিয়ে সেইখানে এলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! বটতলা তো ফাঁকা। সে মড়া তো সেখানে নেই।
দোকানদার বলল, “কী যে বলেন বাবু!” আমরা তখন রামরাজাতলার ট্রেনের ঘটনাটার ব্যাপারও দোকানদারকে বললাম। দোকানদার বয়স্ক লোক। আমাদের কথা সব সব শুনে বলল, “এইবার বুঝেছি। তা বাবু ও সবে আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না। তবে আমরা গ্রামের মানুষরা কিন্তু করি। আসলে আপনারা ভূত দেখেছেন।”
পরেশ তো লাফিয়ে উঠল, “ভূত! এইরকম দিনের বেলায় ভূত দেখা যায় নাকি?”
“দেখলেন তো! তা যদি না হবে আর গাঁজাটাজাও যদি না খেয়ে থাকেন তা হলে আপনারা আমায় মড়া দেখাতে পারলেন না কেন? আর একই মড়া দু’বার কেন দেখলেন বলুন? আমি তো মুর্খু লোক। কিন্তু আপনারা শিক্ষিত লোক হয়ে এইরকম কেন দেখলেন? আপনারাই এর একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিন। বুঝিয়ে দিন যে, ওটা অন্য কিছু।”
আমরা কী যে বলব তা ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলাম।
দোকানদার বললে, “ওই আপনাদের নৌকো আসছে। তাড়াতাড়ি পার হয়ে ওপারে নেমেই একটা রিকশা ধরে গ্রামে চলে যান। জ্যোৎঘনশ্যামও ভাল জায়গা নয়। তাই সন্ধের আগেই পৌছতে চেষ্টা করবেন। আর কোনওদিকে বেশি তাকাবেন না। রাতভিত একা একা কেউ বেরোবেন না। ও জিনিস দিনের বেলায় যখন আপনাদের পিছু নিয়েছে তখন রাত্তিরেও দেখা দেবে। যেখানে-সেখানে দেখবেন ওইরকম অবস্থায় পড়ে থাকবে। তখন কিন্তু দারুণ ভয় পেয়ে যাবেন, বলে দিলাম।”
আমরা আর আমাদের মধ্যে নেই তখন। দোকানদারকে চায়ের দাম দিয়ে ভাঙন বেয়ে নেমে এসে নৌকোয় চাপলাম। তারপর ওপারে পৌঁছেই রিকশা। একটিই মাত্র রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। কাজেই কোনওরকম দরদাম না করে সেই রিকশায় চেপে বসলাম। আলোছায়ার পথে পথে নদীর বাঁধ ধরে রিকশা এগিয়ে চলল জ্যোৎঘনশ্যামের দিকে। প্রকৃতির দৃশ্য উপভোগ করা মাথায় উঠে গেছে তখন। কেবলই ভয় হচ্ছে, এই বুঝি আবার ওই দৃশ্য দেখতে পাই!
যাই হোক, এক সময় ভর্তি দুপুরবেলায় আমরা জ্যোৎঘনশ্যামে রিকশা থেকে নামলাম। ওদের বাড়ির কাছ পর্যন্ত রিকশা গেল না। একটি উঁচু জায়গার কাছে এসে থেমে গেল। আমরা দু-একজন লোককে জিজ্ঞেস করে মণিশঙ্করদের বাড়িতে এসে হাজির হলাম।
সেখানে তখন দারুণ ব্যাপার। বাপের একমাত্র ছেলে। তার বিয়ে বলে কথা! কাজেই রীতিমতো ধুমধাম। রেকর্ডে লতা কিশোরের গান বাজছে। আমাদের দেখে তো মণিশঙ্কর দারুণ খুশি। পরেশকে বুকে জড়িয়ে এসো ভাই এসো’ বলে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। ওর মা-বাবা এলেন। জ্যাঠতুতো খুড়তুতো দিদিরা এল। সবার সঙ্গেই পরিচয় হলে মণিশঙ্কর ওদের পাশের বাড়িতে একজনদের একটি ঘরে নিয়ে গেল। মাটির ঘর এখানে। বলল, “ভাই, কাজের বাড়ি। তোমাদের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটবে খুব। তাই এই ঘরটা তোমাদের জন্য আলাদা রেখেছি। এখানে তোমরা ছাড়া কেউ ঢুকবে না। কেউ তোমাদের বিব্রত করবে না। এখন মুখ হাত ধোয়ার জল এনে দিচ্ছি। জামাকাপড় ছাড়ো দিকিনি।”
আমরা আলাদা একটি ঘর পেয়ে সত্যিই আনন্দ পেলাম খুব। মণির জন্য নিয়ে আসা সামান্য উপহারটুকু ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, “আমাদের জন্য তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি এবার তোমার আত্মীয় কুটুমদের দেখো। তোমার বিয়ে যেখানে হচ্ছে সেখানটা এখান থেকে কতদূর?”
“সে অনেকদূর ভাই। এখন একটু চা-জলখাবার খেয়ে তোমরা পাশের পুকুরে অথবা টিউবওয়েলে স্নানটা সেরে নাও। বিকেল চারটায় বাস আসবে। তারপরই আমরা রওনা দেব।”
যে বাড়িতে আমরা উঠেছিলাম তারাই মুখ-হাত ধোওয়ার জলটল দিল। তারপর মণির জ্যাঠতুতো বোন দুটো ডিশে করে বোদে আর পানতুয়া এনে খেতে দিল আমাদের। একজন চা-বিস্কুট নিয়ে এল।
খেতে-খেতেই মণি একটু অন্যত্র গেলে পরেশ বলল, “আমাদের ওই ব্যাপারটা আজকের দিনে আর মণির কানে তুলে কাজ নেই। রাস্তায় আসতে আসতে যা আমরা দেখেছি তা আমাদের দু'জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক।”
আমি বললাম, “সে তো বটেই, এখন চল, সময় কাটাবার জন্য আমরা গ্রামের আনাচে কানাচে একটু কোথাও ঘুরে আসি।”
পরেশ আর আমি দু’জনেই চললাম। কী চমৎকার গ্রাম! সত্যিকারের গ্রাম তা হলে আজও মরে যায়নি। গ্রাম ঘুরে মন ভরে গেল। গ্রামের বাঁধ ধরে ঘুরতে ঘুরতে একসময় আমরা শ্মশানে এসে পড়লাম। আর পোড়া কাঠ, মেটে কলসি ইত্যাদি দেখামাত্রই গা টা ছমছমিয়ে উঠল। মনে পড়ল পর পর দু’বার সেই দৃশটা। যদি আবার দেখি , সেই ভয়ে ফিরে এলাম মণিদের বাড়িতে।
দুপুরে স্নান-খাওয়ার পর সামান্য একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই বাস এসে গেল। কিন্তু এলে কী হবে। মেয়েদের সাজার পালা শেষ হতে হতেই বেলা হয়ে গেল। মণির বাবা অত্যন্ত বদরাগী লোক। প্রচন্ড ধমক দিয়ে একসময় যাহোক করে বাসে তুললেন সকলকে। মণিও আমাদের সঙ্গে ওই বাসেই চলল।
গ্রাম ছেড়ে বনজঙ্গলের পথ ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। বরযাত্রীতে ঠাসা বাস হাসি হুল্লোড় মুখর। অনেকেই বসবার জায়গা পায়নি। তাতে কী। এই আনন্দে সব কষ্ট সহ্য করে নেওয়া যায়। পরেশ আর আমি দু’জনেই বসবার জায়গা পেয়েছি। তাই মাঝেমধ্যে মণির সঙ্গে দুটাে-একটা কথা বলে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম অজানা অচেনা দেশের দিকে।
দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে গেল। সন্ধে পেরিয়ে রাত। বাস হু হু শব্দে ছুটে চলেছে তো চলেইছে। অনেকক্ষণ চলার পর বাস যেখানে এসে থামল সেখানে আর কোনও পথ নেই। যা রয়েছে তা হল কচুরিপানায় ভরা একটা পচা খাল।
ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে বলল, “কী আশ্চর্য! এরকম খাল তো এর আগে এখানে কখনও দেখিনি।”
মণির বাবা বললেন, “তুমি পথ ভুল করোনি তো হে ছোকরা!”
ড্রাইভার বলল, “কী যে বলেন কাকাবাবু! শুধু তাই নয়, আমার মনে হচ্ছে আমরা যেন একই পথে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছি।”
“বলো কী?”
“হ্যাঁ। পাছে আপনারা সবাই ভয় পান তাই এতক্ষণ কিছু বলিনি। কিন্তু...।”
“ওসব বাজে কথা রাখো। এখন চলো দেখি। গাড়ির মুখ অন্যদিকে ঘোরাও।”
“তা ঘোরাচ্ছি। তবে কোনও লাভ হবে না। আমরা নির্ঘাত ইদিলপুরের ভূতের মাঠে এসে পড়েছি।”
“তোমার মুণ্ডু। ঘোরাও অন্যদিকে গাড়ি।”
অগত্যা গাড়ির মুখ অন্যদিকে ঘোরানো হল। কিন্তু ঘোরালে কী হবে? আবার সেই যাকে তাই। ঘুরেফিরে গাড়ি আবার সেই পচা খালে।
পরেশ আর আমি তখন রীতিমতো ভগবানকে ডাকতে শুরু করেছি। হায় রে ভগবান! আজ কী কুক্ষণেই না ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম!
মণির বাবা, ওর জ্যাঠামশাই সকলেরই দেখলাম মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। তার কারণ, এইসব এলাকার গুণাগুণ তো এঁদের অজানা নয়। জনবসতিও এর কাছেপিঠেও কোথাও কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। এখন উপায়?
ড্রাইভার বলল,“যদি এটা সত্যিই ইদিলপুরের মাঠ হয় তা হলে কিন্তু আর আমাদের রক্ষে নেই। এই ফাঁকা মাঠে সকাল না হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকতে হবে।”
মণির বাবা বললেন,“সর্বনাশ! বিয়ে বলে কথা! শুধু গিয়ে পৌঁছতে না পারার জন্য লগ্নটাই বয়ে যাবে?”
“এছাড়া উপায় কী বলুন? সারারাত ধরে গাড়ি চালালেও সামনে পেছনে ডেইনে বাঁয়ে সর্বত্রই এই খাল আমাদের পিছু পিছু ধাওয়া করবে।
সব শুনে আমরাও খুব ভয় পেয়ে গেলাম। মণির মনের অবস্থার কথা না বলাই ভাল।
মেয়েরা তো রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিল।
মণির বাবা দারুণ রেগে সমানে দোষারোপ করতে লাগলেন মেয়েদের। বললেন, “কখন বিকেল চারটের সময় গাড়ি এসেছে। শুধু তোমাদের সাজের ঘটার জন্যই তো বাস ছাড়তে সন্ধে হয়ে গেল। আবার কাঁদছ যে বড়? আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে শুধু বরকে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিতাম তা হলে আজ আমার এই সর্বনাশটা হত না।”
যাই হোক, সকলের অনুরোধে ড্রাইভার যখন গাড়ি ছাড়বার - সময় দেখা গেল সেই অন্ধকারে হ্যাজাক জ্বেলে একদল লোক লাঠি-সেটিা হাতে নিয়ে হইহই করে বাসের দিকে এগিয়ে আসছে।
দেখেই তো বুক শুকিয়ে গেল ভয়ে। ডাকাত নয় তো! কেলেঙ্কারির চরম হয়ে যাবে তা হলে। কিন্তু না। যারা এল তারা আমাদেরই খোঁজে এল। এসেই উল্লাসে লাফিয়ে উঠল সকলে, “এই তো! এই তো! বর এসে গেছে।”
একজন বলল, “আমি জানতুম ওরা ঠিক আসবে। আর পথ ভুল করে ঢুকে পড়বে এই মাঠে।”
আর একজন বলল, “আপনাদের এত দেরি হল কেন?”
মণির বাবা বললেন, “আপনারা?”
“আমরা তো আপনাদের দেরি দেখে নিতে এসেছি।”
“এইটাই তা হলে বসন্তপুর?”
“আজ্ঞে না! এটা বসন্তপুর কী করে হবে? এ হল ইদিলপুরের ভুলো লাগার মাঠ। এই মাঠে সন্ধের পর একবার কেউ ভুল করে ঢুকে পড়লে আর তাকে প্রাণ নিয়ে বেরোতে হবে না। সারারাত মাঠময় ঘুরতে হবে আর ভোরবেলা এই মাঠের ভয়ঙ্কর সব ভূতেরা এসে গলা টিপে মারবে। সেই ভেবেই তো আমরা আপনাদের দেরি হচ্ছে দেখে এই মাঠে এসেছি। এখন চলুন। গাড়ি চালাও হে ড্রাইভার। আর কোনও ভয় নেই। সামনের দিকে মাইলখানেক গেলেই বসন্তপুর পেয়ে যাবে।”
সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা। এবং কিছু সময়ের মধ্যেই বিয়েবাড়িতে এসে পৌঁছলাম। বেশ বড়লোকের বাড়ি। লোকজনে আলোকসজ্জায় জমজম করছে। আমরা যাওয়ামাত্রই সে কী হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটে গেল, তা বর্ণনার অতীত। এমন আদর আপ্যায়নের ঠালা যে, অস্থির হয়ে উঠলাম একেবারে। একটানা শাঁখ বাজছে তো বাজছেই। লুচি ভাজার গন্ধে, তরকারি মিষ্টির গন্ধে চারদিক যেন মম করছে।
যাই হোক, মণির সঙ্গে আমরা আলাদা ঘরে বসলাম। মণির বাবা আর জ্যাঠামশাইকে পরম সমাদরে ওরা অন্যত্র নিয়ে গেল। মেয়েরা মিশে গেল মেয়েদের ভিড়ে। আমরা তিনজনে আলাদা একটি ঘরে বসে খোশগল্পে মেতে গেছি। দরজা-জানলায় উৎসাহী গ্রামবাসীদের মুখ। গল্প করতে করতেই মণি হঠাৎ আমার কানে কানে ফিসফিস করে একটা কথা বলল। কথাটা শুনেই আমি পরেশকে বললাম।
মণি বলল, “তাড়াতাড়ি। আমি আর চেপে রাখতে পারছি না কিন্তু।”
আমরা তিনজনেই চটপট বেরিয়ে এলাম বাইরে। একজন ছুটে এসে বললে, “কোথায় যান?” আমি তার কানে কানে ফিসফিস করে বলতেই সে বলল, “এই বা দিকে একটা বাঁশবন আছে। তার গায়েই বসিয়ে দেবেন। পাশেই পুকুর। কোনও অসুবিধে হবে না।”
আমি আর পরেশ বাশবনে না ঢুকে পুকুরপাড়েই বসিয়ে দিলাম মাণিকে নিয়ে যখন আমরা এদিকে-সেদিকে পায়চারি করছি তখনই দেখতে পেলাম সেই দৃশ্যটা। দেখলাম বাড়ির পেছনদিকের বাগানে যেখানে শামিয়ান খাটিয়ে রান্না হচ্ছে সেখানে এক অদ্ভুত দৃশ্য। মানুষের বদলে দুটাে কঙ্কাল রান্নাবান্নার কাজ করছে। তাছাড়া বিয়েবাড়ির যত লোকজন সব যেই আলোর আড়ালে চলে যাচ্ছে অমনই তাদের কঙ্কালমূর্তি ফুটে উঠছে। দেখেই তো চক্ষুস্থির আমাদের। পরেশ আর আমি দু’জনে দুজনকে নিঃশব্দে চেপে ধরলাম। আমাদের মনে প্রচণ্ড কৌতুহল। আমরা কি সত্যিই ভূত দেখছি? না কি সকাল থেকে যা দেখছি সবই আমাদের চোখের ভুল।
ততক্ষণে মণিও এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওরও চোখ কপালে উঠে গেছে তখন। মণি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কিছু বুঝতে পারছিস?”
“পারছি বইকী!”
“এ কোথায় এলাম রে আমরা?”
“যেখানেই আসি না কেন আর এই বাড়িতে ঢোকা নয়! অন্ধকারেই মাঠে মাঠে পালাই চল। যদি আশপাশে কোনও গ্রাম দেখতে পাই তা হলে সেখান থেকেই কোনও লোকজন নিয়ে আবার আসা যাবে।”
“কিন্তু আমার বাবা! জ্যাঠামশাই! আর সব বরযাত্রীরা ?”
“আপনি বাঁচলে বাপের নাম জানিস তো? এখন ঘরে গিয়ে ওদের ডাকাডাকি করতে গেলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
অতএব আমরা সকলের নজর এড়িয়ে সেই অন্ধকারে যখন অনেকদূর চলে গেছি তখন দেখি আবার একটি দল আলো জেলে লাঠি হাতে এই বাড়ির দিকে আসছে।
ওদের দেখেই ভয় আরও বেশি হল আমাদের। আবার কি নতুন করে কোনও ভূতের পাল্লায় পড়লাম আমরা? তাই আর দেখা না দিয়ে কৌশলে ওদের পিছু নিলাম এবং ওদের কথোপকথন শুনতে লাগলাম।
ওরা বলছে, “নিৰ্ঘাত ওই ভূতের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে ওরা। এত রাত্রে ওই বাড়িতে যখন আলো জ্বলছে তখন সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।”
আর একজন বলল, “তাই যদি হয় তা হলে ওদের উদ্ধার করবি কী করে?”
“আমি তো জামাই বাবাজিকে চিনি। যেভাবেই হোক তার সঙ্গে দেখা করে কানে কানে বলে দেব ব্যাপারটা। তারপর সবাইকে সতর্ক করে চুপিচুপি পালিয়ে আসতে বলব!”
"এত সোজা নাকি। ওই বাড়িতে ঢুকলে তোকেই তো গলা টিপে মারবে।”
মণি আর থাকতে না পেরে বলল, “আপনারা কোথা থেকে আসছেন?”
ওরা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা বসন্তপুর থেকে আসছি। আমাদের বর সহ বরযাত্রীর বাস আসবার কথা ছিল রাত্রি আটটার মধ্যে। কিন্তু রাত এখন একটা। তাদের কোনও খবর নেই।”
“বর কোথা থেকে আসবার কথা ছিল বলুন তো?”
“জ্যোৎঘনশ্যাম থেকে। বরেন নাম মণিশঙ্কর সামন্ত।”
“আমিই আপনাদের বর। আমরা সবাই ভূতের পাল্লায় পড়েছি। আমার বাবা, জ্যাঠামশাই, এমনকী একশো বরযাত্রী সবাই ওই ভূতের বাড়ির মধ্যে রয়ে গেছে। শুধু বিশেষ প্রয়োজনে আমরা একবার বাড়ির বাইরে বেরিয়েই ব্যাপারগ হতে পারি। আর তারপরই গা-ঢাকা দিই।”
ওরা সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরল আমাদের দু'জন তো কেলেই তুলে নিল মণিকে তারপর বলল, “ঠিক আছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনারা চলুন আমাদের সঙ্গে আপাতত শুভ কাজটা সম্পন্ন হোক। আর আমরা দলকে দল গ্রামসুদ্ধু লোক রোজা বদ্যি সঙ্গে নিয়ে ওই ভূতের বাড়িতে যাচ্ছি। গিয়ে দেখি কীভাবে ওদের উদ্ধার করতে পারি।”
এবারে আর ভূতের বাড়ি নয়। সত্যিকারের বিয়েবাড়িতেই ঢুকলাম আমরা। মণি ওর পরিচিত সবাইকেই দেখতে পেল।
আর ওরা করল কি, আমাদের সেই বিয়েবাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রায় শ দুই লোক, জনতা নিয়ে হইহই রবে সেই ভুতুড়ে বাড়ির দিকে ছুটে চলল। কথায় আছে দশ লাগে তো ভূত ভাগে। তাই হল। এত লোকের হইচইতে সব ভূতই ভেগে পালাল। আর বরযাত্রীদেরও নিরাপদে এ বাড়িতে আসতে অসুবিধে হল না কিছু।
খাওয়াদাওয়ার পর আমরা যখন বাসরঘরে ঢুকেছি তখন হঠাৎই একটা হইচই শুনে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কী ব্যাপার! ব্যাপারটা কী!
একজন বলল, “আর বলবেন না মশাই! দরজার সামনে কোথেকে একটা ভিখিরি এসে মরে পড়ে আছে। কোথাকার কে তা কে জানে? এই রাতদুপুরে কী কাণ্ড বলুন দেখি?”
বোঝে কারবার! পরেশ আর আমি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবলাম আর একটু পরেই ভোরের আলোটা একবার ফুটলে হয়! বরের গাড়ি জ্যোৎঘনশ্যামে পৌছে দিয়েই কেটে পড়ব আমরা। আর এক মুহূর্ত এখানে নয়!
ডাউনলোড PDF : ডাউনলোড
0 coment�rios: