উত্তরদিকের পর্বতে প্রকাণ্ড এক সিংহ বাস করত। এই সিংহটি নামেও যেমন দুর্দান্ত কাজেও তেমনি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী হলে কি হবে, সিংহের গুহায় একবার ভয়ানক ইঁদুরের উৎপাত শুরু হল। রাতে সিংহ কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। হয় ইঁদুর ওর কেশর কেটে নিয়ে যাচ্ছে, নয়তো সরু লেজের ডগা দিয়ে নাকে কানে সুরসুরি দিচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সিংহ কিছুতেই ইঁদুরকে শায়েস্তা করতে পারছে না ! অত পিচ্চি পিচ্চি ইদুরগুলোকে ধরবে কি করে? ধরতে গেলেই ওরা পটাপট গর্তে গিয়ে ঢুকে পড়ে। খুব জ্বালাতনে পড়েছে সিংহ। মনের মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা—কি করে ওই ইঁদুরগুলোকে শায়েস্তা করা যায়। হঠাৎ ওর মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি এল।
আর সেই পুরনো কথাটাও মনে পড়ল-—ক্ষুদ্র শক্রকে শক্তি দ্বারা নাশ করা যায় না। তাকে বিনাশ করতে হলে তার মতোই ক্ষুদ্র সৈনিক নিয়োগ করতে হয়।
এই না ভেবে সিংহ পরের দিন পাশের গ্রাম থেকে দধি নামে একটা বিড়াল এনে ওর হাতে রেখে দিল। বিড়ালটা রোজ রোজ দই চুরি করে খেত বলে ওর নাম হয়েছে দধি। সিংহ দধিকে খুব আদর যত্ন করে খাওয়াল। বিড়াল তো মহাসুখে খায়দায় আর গুহা পাহারা দেয়।
এদিকে ইঁদুরগুলোর হয়েছে খুব বিপদ। কি করে এখন তারা সিংহের কেশর কাটে? খাবারের জন্য ওরা গর্তের বাইরেই আসতে পাৱে না ওই দধি বিড়ালের জন্যে। এবার না খেয়ে দেয়ে গর্তে লুকিয়ে থাক। এভাবে বেশ ভালই দিনগুলো কাটছিল সিংহের ।
ইঁদুরগুলো না খেতে পেয়ে আর গর্তের ভিতর থাকতে পারে না। পেটের জ্বলায় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে, ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে দধি বাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর আর পটাপট ধরে খেতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই ইঁদুরের খেল পতম। ইঁদুরের আর সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দু দিনের মধ্যেই সিংহ তা টের পায়। ইঁদুরের আর ঋটাপটি শুনতে পায় না। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। ইঁদুরের উৎপাতের হাত থেকে রেহাই পেয়ে সিংহ আর আগের মতো বিড়ালকে খাতির যত্ন করে না। আদর করে খাবার দেয় না। ওই সবের জন্যে বিড়ালের মনে খুবই কষ্ট। ও দিন-দিন শুকিয়ে যেতে লাগল।
এই পর্যন্ত বলে দমন করটের দিকে তাকিয়ে বলল, এর জন্যই বলছিলাম মনিবের কাছে ভৃত্যের কখনোই প্রয়োজনবোধশূন্য হতে নেই। তা হলে ওই দধি বিড়ালের মধ্যে দুৰ্গতি হয়। যাক, এবার চল ষাঁড়টার কাছে যাই।
এই বলে দমন করটকে একটা গাছের তলায় বসিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হল ষাঁড়ের কাছে।
ষাঁড় তো মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে। দমনকে সামনে দেখেই মুখ তুলে তাকাল।
দমন বলল, কি হে, তুমি কোথা থেকে এখানে এসেছ? তুমি রাজার অনুমতি ছাড়া কেন এই বনে এসেছ? যদি ভাল চাও তো এখনই আমাদের সেনাপতির কাছে যাও। তানাহলে এই বন থেকে এখনই দূর হয়ে যাও। নইলে তোমার কপালে বিপদ আছে।
দমনের কথায় ষাঁড় তো হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শিয়ালের দিকে। দমন শিয়াল বলল, তুমি তো চেননা আমাদের মনিবকে। যদি খুব ক্ষেপে যায় তাহলে যে কি অঘটন ঘটবে তা কে জানে? ভালোয় ভালোয় এখনও সময় আছে জলদি কেটে পড়।
কচি ঘাস খাওয়া সঞ্জীবের মাথায় উঠল। সব ফেলে দিয়ে ছুটে গেল করটের কাছে। করটকে বলল, বলুন আমি এখন কি করব?
করট একটা লম্বা হাই তুলে মুখে হুঁম-ম-ম শব্দ করে বলল, এক কাজ কর । যাও এখনই গিয়ে আমাদের রাজ্যকে প্রণাম করে এসে।
সঞ্জীব ফের বলল, সেনাপতি যদি আমাকে অভয় দেন তো।
করট বলল, না না, তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি কি জান না ঝড়ে হওয়া কোমল, ক্ষুদ্র ও সর্বপ্রকারের নিচু তৃণকে উৎপাটিত করে না। উন্নত বৃক্ষকেই ভাঙে বা উপড়ে ফেলে। সবল দুর্বলের প্রতিই শৌর্য প্রদর্শন করে। যাকগে, এবার চল এই বলে করট ও দমন সঞ্জীবকে নিয়ে চলল রাজার কাছে। সিংহরাজের গুহার কাছেই সঞ্জীবকে একটা ঝোপের আড়ালে রেখে ওরা দুজনে গুহার ভেতরে ঢুকল।.
রাজা ওদের দেখে খুশি হয়ে বলল, প্রাণীটার খোঁজখবর কিছু পেলে?
দমন বলল, হ্যাঁ, মহারাজ ; আপনি ঠিকই বলেছেন। ওই প্রাণীটার গর্জন যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি দেখতেও। ওকে নিয়ে এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে। চলুন মহারাজ, দেখবেন চলুন।
সিংহ তো এই কথা শুনে হাত—পা এলিয়ে বসে পড়ল, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। সেই কথায় আছে, জলের বেগে আপনিই বাঁধ ভেঙ্গে যায়, গোপন না রাখলে গোপন মন্ত্রও প্রকাশ হয়ে যায়। এখানে সিংহেরও তাই হল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তা, তা হলে তুমি বলছ সে এখানেই আছে?
দমন সাহস দিয়ে বলল, আপনি ভয় পাবেন না। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আপনি তো জানেন—শব্দের কারণ না জেনে শুধু শব্দ শুনেই ভয় পাওয়া উচিত নয়। শব্দের কারণ জেনেই তো এক দূতী কাজে সম্মান লাভ করেছিল।
সিংহরাজ এই কথা শুনে বলল-সে কি রকম শুনি? দমন বলতে শুরু করল—
পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো একটি আর একটি গল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে প্রথম থেকে না পড়লে কিছুই বোঝা যাবে না। গল্পগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে চাইলে গল্পের তালিকা ব্যবহার করো।
0 coment�rios: