দক্ষিণ পর্বতের পাশে একটা নগর ছিল। লোকে বলত সেই পর্বতের চূড়ায় ঘন্টাকর্ণ নামে এক রাক্ষস বাস করত একদিন এক চোর এক গৃহস্থের বাড়ি থেকে একটা ঘণ্টা চুরি করে। চোর ঘণ্টাটা নিয়ে একটা গোপন পথ দিয়ে পর্বতের চূড়ার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। পথে একটা বাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে চোরটাকে খেয়ে ফেলল।
এই খবর কেউই জানল না। ওই পর্বতের কতগুলো বানর সেই ঘণ্টাটা কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে গেল। ওরা তো মনের সুখে ঘন্টা বাজায় রোজই টিংটিং করে। ঘন্টা বাজায় আর নাচে মহা আনন্দে।
এমনিতেই জায়গাটা পাহাড়ী এলাকা। খুবই নির্জন। ওই ঘণ্টার শব্দ শহরের লোকেরা শুনতে পেত। কাঠুরিয়ার পর্বতে কাঠ কাটতে যেত। ওরাও একদিন বাঘে খাওয়া এক পথিকের হাড়গোড় দেখতে পেল। হাড়গোড় দেখে ওরা ভাবল এটা নিশ্চয়ই রাক্ষসের কাজ। ৱাক্ষসই ওকে খেয়েছে। তারপর ঘণ্টার শব্দ শুনে ভাবল, এটাও রাক্ষসই বাজাচ্ছে। তারপর থেকে ওরা যখনই ঘন্টার শব্দ শুনত তখনই ভাবত রাক্ষসই মানুষ খাচ্ছে আর ঘণ্টা বাজাচ্ছে। রাক্ষসের ভয়ে শহরের সব লোক রাজ্য ছেড়ে পালাতে লাগল। সবার মনে ভয় এই বুঝি রাক্ষস তাদের খেয়ে ফেলবে।
প্রজাদের রাজ্য ছেড়ে পালানো দেখে রাজা মহাবিপদে পড়লেন। ভাবলেন, প্রজার যদি রাজ্যই ছেড়ে চলে যায়—তা হলে তিনি কাকে নিয়ে রাজত্ব করবেন!”
রাজার কয়ালা নামে এক বিশ্বাসী চাকর ছিল। সে ভাবল, রাক্ষস যদি মানুষই খাবে, তবে ঘণ্টা বাজাবে কেন? তা হলে মানুষতো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে। তা ছাড়া এই পর্বতে যে রাক্ষস আছে তার কি প্রমাণ আছে? এই ভেবে কয়ালা কারণ খুঁজতে লাগল এবং সত্যি জানতে পারল যে এই ঘণ্টা বাজানোর কাজ হচ্ছে বানরদের !
মহারাজ, যদি আদেশ করেন তাহলে আমি ঘণ্টাকর্ণকে বশীভূত করতে পারি। তবে আপনাকে এর জন্য একটু খরচ করতে হবে।
তাই খুব সাহস নিয়ে কয়ালা একদিন রাজার কাছে হাজির হয়ে বলল, মহারাজ, যদি আদেশ করেন তাহলে আমি ঘন্টাকর্ণকে বশীভূত করতে পারি। তবে আপনাকে এর জন্য একটু খরচা করতে হবে।
কয়ালার কথা শুনে রাজা খুব খুশি হলেন তক্ষুনি তাঁকে অনেক টাকা-পয়সা বকশিষ দিয়ে বললেন, তুমি যদি রাক্ষসকে বশীভূত করতে পার তাহলে তোমাকে আরো অনেক ধনদৌলত দেব। কিন্তু যদি না পর তবে তোমার গর্দান যাবে।
—বেশ, তাই হবে মহারাজ! তারপর কয়ালা অনেকগুলো কলা কিনে পর্বতের এক জায়গায় সেগুলোকে ছড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বানরগুলো অত কিছু বোঝে না, ওরা কলা পেয়ে ঘণ্টাটা মাটিতে রেখে মনের সুখে কলা খেতে লাগল। বানরগুলো যখন কলা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে কয়ালা মাটি থেকে ঘণ্টাটা তুলে নিল। ঘণ্টা নিয়ে সোজা রাজবাড়ির দিকে রওনা দিল। রাজার হাতে ঘণ্টাটা তুলে দিল।
—এই নিন মহারাজ রাক্ষসের ঘণ্টা। রাজা ঘণ্টা পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। কয়ালাকে অনেক ধনদৌলত দিলেন। আর প্রজারাও এই খবর শুনে মনে মনে ভাবল, যাক, বাঁচা গেল---আর রাক্ষসের ভয় নেই।
এই ঘটনায় কয়ালা যা সম্মান পেল তা ভাবাই যায় না। এই গল্প বলে দমন বলল, তাই তো বলছি, শব্দের কারণ না জেনেই সবাই ভয় পেয়েছিল, শব্দের কারণ জানলে কি সবাই ভয় পেত?
তারপর দমন ও করট বলদটাকে নিয়ে হাজির করল সিংহের কাছে। প্রথমে সিংহ খুব ভয় পেয়েছিল। পরে বলদকে দেখে যখন বুঝল এটা একটা গরু ছাড় আর কিছুই নয়, তখন সিংহের ভয় এক নিমিষে উড়ে গেল। সিংহ ইচ্ছা করলে গরুটাকে তখনই খেয়ে ফেলতে পারত, কিন্তু ও তা করল না। ভাবল এতবড় প্রাণীটাকে না খেয়ে যদি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় তা হলে ভবিষ্যতে অনেক উপকার হতে পারে। তাই সিংহ ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে একসাথে বাস করতে লাগল।
ওদের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। তবে একদিন সিংহের ভাই এল তার সাথে দেখা করতে। সিংহ তাকে দেখে খুব খুশি হল। খুব খাতির যত্ন করে খেতে দিল। খাওয়াদাওয়া সেরে ওরা বসে কথা বলছে, এমন সময় বলদ এসে বলল-আজ এত বেশি প্রাণীহত্যা করা হয়েছে—তার মাংস সব কোথায় গেল?
সিংহরাজ হেসে বলল, তার উত্তর দমন ও করটই জানে।
বলদ বলল, তা, ওরা দুজনই এত মাংস খেয়েছে?
পশুরাজ একটু হেসে বলল, না না, ওরা কি এত মাংস খেতে পারে? কিছু খেয়েছে, কিছু ফেলেছে, রোজই তো ওরা এমন করে। এ আর এমন কি ঘটনা!
বলদ অবাক হয়ে বলল, সেকি আপনার অনুমতি ছাড়াই ওরা এই কম করে? না না, এ তো ভাল কথা নয়। কথায় বলে—বিপদ নিবারণ ছাড়া রাজার কাছে না বলে কোনো কাজ নিজের ইচ্ছামতো করা উচিত নয়। যে বিবেচক এক কপর্দকও বৃদ্ধি করতে সক্ষম সেই শ্রেষ্ঠ। ধনশালীর ধনই প্রাণ, অন্য কিছু নয়। আর যে অন্যের কথা বিবেচনা না করে যা খুশি তা করে সে কুবেরের মতো ধনশালী হলেও খুব তাড়াতাড়িই ভিক্ষুকের মতো গরিব হয়ে পড়ে।
সঞ্জীবের এই উপদেশ শুনে সিংহের ভাই বলল, হ্যাঁ, বলদ ভাই ঠিকই বলেছে। দমন ও করট নামে শেয়াল দুটো তো যুদ্ধের কাজেই নিযুক্ত। তাদের কেন মাংস আনার কাজে নিয়োগ করেছ? কাকে কোন কাজে নিয়োগ করতে হয় তা তুমি জান না? শাস্ত্রে আছেঃ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও আত্মীয়স্বজনকে ধনদৌলতের দায়িত্বে নিয়োগ করা উচিত নয়, ব্যয় করবার জন্য রাজার অনুমতিপ্রাপ্ত অর্থও ব্রাহ্মণ অতিকষ্টে দান করেন না। ধন রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ক্ষত্রিয় নিশ্চয় খড়গ প্রদর্শন করে। মানে ঘুষ দিয়ে লোককে বশীভূত করে রাজ্যলাভে অস্ত্ৰধারণ করে। আত্মীয়স্বজনেরা সুযোগ পেয়ে অর্থ গ্রাস করে ; এই বলে সিংহের ভাই বলল, এবার তুমি বুঝে দেখ। কি করা উচিৎ আর না করা উচিৎ।
সিংহ সব শুনে বলল, কি বলব ভাই, পাজি শেয়াল দুটো আমার কোনো কথাই শোনে না। .
ভাই বলল, না না, এ তো ঠিক নয়, কথায় তো আছে—নিশ্চেষ্ট ব্যক্তির যশ নষ্ট হয়, খলের নষ্ট হয় মিত্র, চরিত্রহীনের কুল, অর্থলোভীয় যশ, জুয়াখেলায় আসক্ত ব্যক্তির নষ্ট হয় শাস্ত্রজ্ঞান, কৃপণের সুখ আর খারাপ মন্ত্রীর জন্য নষ্ট হয় রাজ্য। চোর কর্মচারী, রাজার প্রিয়জন ও নিজের লোভ থেকে রাজা প্রজাকে প্রতিপালন করবেন। এখন ভাই তুমি বলদকে খাদ্যরক্ষার কাজে নিয়োগ কর।
ভাইয়ের কথামত সিংহ সমস্ত ভার বলদের উপর দিয়ে দুজনে বন্ধুর মতো দিন কাটাতে লাগল।
এদিকে করট আর দমন দুজনে মহাবিপদে পড়ল। হাঁদারাম বলদটার দৌলতে খাবারদাবার জোটে না। একদিন দমন করটকে ডেকে বলল, বন্ধু, মহা মুশকিলে পড়া গেল দেখছি! কি করা যায় বল তো? এইরকম দুর্ভাগ্যের জন্য আমরাই দায়ী। বলদটাকে আমরা ডেকে আমলাম, এখন কিনা আমাদেরই পেটে লাথি। তাই তো দেখ না, কেতু নামে এক অভিযাত্রী রেখা নামে কোনো এক পরীর ছবি স্পর্শ করে; এক মহিলা নিজেকে দড়িতে বেঁধে এবং এক সাধু মণি নিতে গিয়ে নিজের দোযেই কষ্ট ভোগ করেছিলেন। এখন হয়েছে আমাদের সেই দশা।
করট শুনে বলল, তা কি রকম ঘটনা বলো-না শুনি । দমন তখন বলতে শুরু করল ---
পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো একটি আর একটি গল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে প্রথম থেকে না পড়লে কিছুই বোঝা যাবে না। গল্পগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে চাইলে গল্পের তালিকা ব্যবহার করো।
0 coment�rios: