ওই যে আমদের গাঁয়ের পাশে যে পাহাড় দেখতে পাচ্ছ, ওই যে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া জলরাশির ধারা দেখতে পাচ্ছ, কি মনে হয় তোমাদের? পাহাড় থেকে যে জলধারা নামছে তার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখো। মনে হবে, এক কেশবতী কন্যা পেছন দিয়ে বসে রয়েছে খাড়া উঁচু পাহাড়ের ধারে, আর তার লম্বা সাদা কেশরাশি পাহাড় বেয়ে নামছে। আমরা একে বলি, কেশবতীর ধারা, কেশবতী জলপ্রপাত। কেন বলি তাই শোনো।
অনেক অনেক কাল আগে আমাদের গাঁয়ে কিংবা ওই পাহাড়ে কোন জল ছিল না। জলের কোন উৎস নেই, কোন ধারা নেই। আকাশের জল ছিল একমাত্র ভরসা। বৃষ্টির সময়ে গাঁয়ের লোকেরা জল ধরে রাখত। সেই জল খেত, সেই জলেই হত চাষবাস। আর যে বছরে হত খরা, বৃষ্টির নামগন্ধ নেই, সে বছরে অনেক দূর থেকে, পাহাড়ের ওপাশ থেকে জল বয়ে আনতে হত। ওখানে আছে একটা ছোট নদী। কিন্তু সে জলে তেষ্টা মিটত। চাষবাস করা যেত না। অতদূর থেকে অত জল আনবে কে? ফসল হত না, বড়ই কষ্ট ছিল।
এই পাহাড়ি গাঁয়ে থাকত এক মেয়ে । খুব গরিব ঘরের মেয়ে। তার মেঘবরণ চুল, দাঁড়কাকের বুকের পালকের মতো রং সে চুলের। এই কেশবতী কন্যার চুল পিঠ ছাড়িয়ে কোমর ছাড়িয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেউ খেলত। কি যে তার নাম ছিল গাঁয়ের লোক ভুলে গিয়েছিল। তাগে ডাকত কেশবতী কন্যা বলে। সবাই তাকে ভালোবাসত। কেননা, এমন হৃদয় আর কারও ছিল না। বড় ভালো সেই মেয়ে। মেয়ের কেউ নেই, আছে এক বুড়ি মা। সে বিছানায় শুয়ে থাকে। সে অসুস্থ। তার সেবা করে মেয়ে। এতেই তার আনন্দ। মেয়ের ছিল একপাল শুয়োর। তাই থেকেই মা-মেয়ের কষ্টের সংসার চলে যেত। কোনরকমে। খরার সময় মেয়ে ভোর রাতে উঠে চলে যেত ওই দূরের ছোট নদীতে। জল আনতে। তারপরে যেত পাহাড়ে। সেখানে বুনো ফল, কচু, রসাল গাছের গোড়া নিয়ে আসত। শুয়োরদের জন্য। মেয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু খেটেই চলত। খুব কষ্ট মেয়ের। সংসারে কাজের লোক সে একা ।
এমনি একদিনের কথা। ঝুড়ি হাতে চলেছে পাহাড়ে ফলমুল খুঁজতে। হঠাৎ পাহাড়ের এক জায়গায় দেখল, একটা সুন্দর ওলকপি ফলে রয়েছে। ভালোই হল, রান্না করে মাকে দেব, নিজেও খাব। এই ভেবে সে ওলকপির কাছে গেল। পাতাগুলো আশ্চর্য সবুজ, পাতাগুলো খুব পুষ্ট।
ঝুড়ি নামিয়ে রেখে দুহাতে জোরে টান দিল। গোড়া বেশ শক্ত। উঠে এল ওলকপি। ওলকপির নীচের অংশ বেশ বড়, লাল রঙের আর সুন্দর গোল। একটা ছোট গর্ত হল পাহাড়ি কাকুরে মাটিতে। অবাক কাণ্ড! সেই গর্ত থেকে ঝরনার জলের মতো জল বেরোচ্ছে। উপচে পড়ছে গর্ত। ভিজে যাচ্ছে আশপাশের মাটি। "হুশ করে শব্দ হল। ওলকপি তার হাত থেকে লাফিয়ে পড়ল। আবার গর্তে বসে পড়ল। জল বন্ধ হয়ে গেল। মেয়ে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে। আনন্দে, ভয়ে, বিস্ময়ে।
খুব তেষ্টা পেয়েছে কেশবতী কন্যার। সে আবার তুলে আনল ওলকপি। আবার গর্ত ছাপিয়ে জল পড়তে লাগল। নিচু হয়ে মুখ কছে আনল। প্রাণভরে জল খেল। ঠান্ডা বরফের মতো জল, ফলের রসের মতো মিষ্টি জল। গর্ত থেকে মুখ সরিয়ে আনবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের হাত থেকে ওলকপি লাফিয়ে পড়ল। ঠিক গর্তে। জলের ধারা বন্ধ হল।
বুনো লতাপাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়ে। অবাক চোখে পাহাড়ের চারপাশ দেখছে। পাহাড়কে আজ অনেক বেশি ভালো লাগছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এল। মেয়েকে যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল। মেয়ে এসে পড়ল একটা গুহার সামনে। আর দমকা হাওয়া নেই।
এদিক ওদিক চাইতেই মেয়ে দেখল, সামনে একটা পাহাড়ের ওপরে বসে রয়েছে একজন লোক। তার সারা দেহ কটা রঙের লোমে ভর্তি। লোমশ মানুষ। মেয়ের দিকে চেয়ে বলল, ও তুমি, তাহলে তুমিই আমার গোপন ঝরনার কথা জেনে ফেলেছ। শোনো, একথা তুমি কাউকে বলবে না। একজনকেও নয়। তুমি যদি বলো কিংবা কেউ যদি আমার ঝরনার জল নিতে আসে, আমি তোমাকে জ্যান্ত মেরে ফেলব। মনে রেখো আমার কথাগুলো। আমি এই পাহাড়ের দেবতা। ভুললে বিপদ।
আর একটা দমকা হাওয়া এল। মেয়ে ছিটকে এসে পড়ল পাহাড়ের নীচে। পাহাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়ে। আর দমকা হাওয়া নেই। সে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে এল।
মেয়ে মাকে কিছুই বলল না। সেই কোন ভোররাতে চলে যায় দূরের নদীতে, জল আনতে। সারাদিন খাটে। কিন্তু, এরকম তো আগেও ছিল। তবু ঝরনার গোপন খবর জানার পর থেকে মেয়ে যেন আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।
এবারে প্রচণ্ড খরা। এক ফোটা বৃষ্টি নেই। আকাশে মাঝেমধ্যে মেঘ দেখা দেয়। সবাই চেয়ে থাকে ওপর পানে। না, বৃষ্টি হল না। মেঘ কোথায় উড়ে গেল। চাষের মাঠ ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছে। মাটি আর পাথরে কোনো তফাৎ নেই। লাঙল দেওয়া যায় না মাটিতে। গ্রামবাসীর সে কি কষ্ট। জলের ধারা কোথায় আছে মেয়ে জানে। অথচ বলতে পারছে না। বললেই মৃত্যু। সব মানুষ, কচি-বুড়ো সবাই হাঁপাচ্ছে, জলের জন্য হাহাকার করছে। অত দূর থেকে কি নিত্যি নিত্যি এতদিন ধরে জল বয়ে আনা যায়? হায়! মেয়ে যদি জলের কথা বলতে পারত! কোন পরিশ্রম নেই। পাহাড়ের ওপরে ওই ওলকপি সরিয়ে ফেলো, গর্তটা গাইতি দিয়ে আরও বড় করো, উপচে পড়বে জল। মিষ্টি শীতল জল। ভাবে আর শিউরে ওঠে। মনে পড়ে সেই ভয়ানক মানুষটির কথা, লোমশ লোকটির কথা। সে নিজের মনেই চেপে থাকে। গুমরে মরে নিজের মনেই।
মনে মনে খুব দুঃখ পেতে লাগল কেশবতী কন্যা। এক চিন্তা সব সময়। তার খিদে চলে গেল, রাতে চোখের পাতা এক হয় না। শুধুই দুশ্চিন্তা। আস্তে আস্তে মেয়ে হয়ে উঠল এক নির্বাক প্রাণী। কোন কথা বলে না। শুধু কাজ করে। কি যেন ভাবে। চোখে ছিল তার স্নিগ্ধ দীপ্তি, কোথায় গেল সেই উজ্জ্বলতা। প্রাণহীন চোখ দুটোয় কোন ভাষা নেই। গালদুটিতে ছিল গোলাপি ফুলের আভা। কোথায় গেল সেই আভা। আর আশ্চর্য! মেঘবরণ লম্বা চুল আস্তে আস্তে কেমন জট পাকিয়ে গেল, উসকো খুসকো চুলে আর চেনাই যায় না কেশবতী কন্যাকে।
মা শুয়ে থাকলেও এসব বুঝতে পারে। একদিন মেয়ের রোগা রোগা হাতখানি ধরে মা করুণ গলায় বলল, "বাছা, তোর কিসের কষ্ট? কি হয়েছে তোর? এত কাহিল হয়ে পড়ছিস কেন মা?
মেয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল, চোখে আতঙ্ক, বুকের মধ্যে কেমন যেন করছে। কিছু বলতে পারলে সে হালকা হত। কিন্তু না, সে পারল না। কিছুই বলল না মাকে।
দিন চলে যায়, মাস বয়ে যায়। কারও জন্য তারা বসে থাকে না। কেশবতী কন্যার ঘন চুলের রাশির রঙ একেবারে পালটে গেল। বরফের মতো সাদা হয়ে গেল। চুলে পড়ে না চিরুনি, হাত পড়ে না মাথায়। পিঠ ছাপিয়ে সাদা রঙের কেশরাশি আলুলায়িত থাকে। কি ছিরি হয়েছে সে সুন্দর চুলের । লম্বা সাদা ঝোপ।
গায়ের লোক মেয়েকে দেখে আড়ালে বলে, ‘অবাক কাণ্ড! এক রত্তি মেয়ে, এই তো কচি বয়েস, কিন্তু মেয়ের চুল এমনধারা সাদা হয়ে গেল কেমন করে? এমন কাণ্ড দেখিনি কখনও। মেয়েকে তারা খুব ভালোবাসে বলে আরও বেশি দুঃখ করে। মেয়ের কোন খেয়াল নেই।
মেয়ে নিজের বাড়ির বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। উদাস চোখে পাহাড়ের দিকে কিংবা মেঘের চলার পথে তাকিয়ে থাকে। কখনও পথিকের হেঁটে যাওয়া দেখে। গাঁয়ের কোন চেনা মানুষকে দেখে মেয়ে বিড়বিড় করে বলে,—দূরের ওই উঁচু পাহাড়ে... কিন্তু কথাটা শেষ করে না। জোরে ঠোঁট কামড়ে ধরে, এত জোরে চেপে ধরে ঠোঁট যেন মনে হয় দাঁতের চাপে রক্ত ছুটে বেরুবে। রক্ত টলটল করে সুন্দর ঠোটে। গায়ের মানুষ আধখানা কথা বহুবার শুনেছে। থেমে গিয়েছে পুরো কথা শোনার জন্য। আজও শুনতে পায়নি।
এমনি একদিনের কথা। মেয়ে উদাস চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেড়ার ধারে। কতশত ভাবছে মেয়ে। এমন সময় সামনের পায়ে-চলা পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন বুড়োমতন লোক। তার সব দাড়ি পাকা। হাওয়ায় দুলছে। তার হাতে জলের একটা পাত্র। ওই দূরের ঝরনা থেকে সে জল বয়ে আনছে। আহা! বুড়ো মানুষ। তার পা কাঁপছে। অত দূরের পথে হাটা কি সহজ। হঠাৎ বুড়ো একটা পাথরে হোচট খেল। টাল সামলাতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে পথে পড়ে গেল। ছিটকে গেল জলের পাত্র। জল গেল গড়িয়ে। পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উঠে গিয়েছে, পাথরে লেগে কপাল ফেটেছে। রক্ত বেরুচ্ছে গলগল করে। মাথা নিচু করে বুড়ে উঠবার চেষ্টা করছে।
আঁৎকে উঠল কেশবতী কন্যা। ছুটে গেল বুড়োর কাছে। তার পোশাকের ধার থেকে ছিড়ে ফেলল এক টুকরো কাপড়। নিচু হয়ে বসে পড়ল মেয়ে। আদরে-যত্নে বুড়োকে বসিয়ে বেঁধে দিল তার আঘাতের জায়গা দুটো। রক্ত বন্ধ হল। বুড়ো গোঙাচ্ছে, চোখ ভিজে উঠেছে, যন্ত্রণায় মুখের চেহারা অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। মেয়ে করুণ চোখে বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে রইল। বুড়োর গোটা মুখ বয়সের ভারে কুচকে গিয়েছে। যন্ত্রণায় কুঁচকে-যাওয়া চামড়া কাঁপছে। বুড়ো চোখ বন্ধ করে রয়েছে।
মনে মনে কেশবতী কন্যা বলল, “আমি এত ভিতু? এত স্বার্থপর? নিজের কথাই শুধু চিন্তা করছি। আমার এত মৃত্যুভয়? ছিঃ, ছিঃ ! মাঠ শুকিয়ে গিয়েছে, ফসল জ্বলে গিয়েছে। খাওয়ার জল পর্যন্ত নেই। জলের হাহাকার। মানুষের এত কষ্ট। অথচ আমি জানি... । গায়ের লোকের তো এত কষ্ট হবার কথা নয়। আমি তো উপায় জানি। আমার জন্যই এই বুড়ো মানুষের পা ভেঙেছে, কপাল ফেটেছে। ভিতু, ভিতু কোথাকার! এবার বোধহয় পাগল হয়ে যাবে মেয়ে। আর সহ্য করতে পারছে না, কথা চেপে রাখতে পারছে না। বুক বুঝি ফেটে যাবে। গলা শুকিয়ে উঠেছে। নাঃ, অনেক হয়েছে, আর না।
মেয়ে বুড়োর রক্ত-মাখা কপালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বাবা, দূরের ওই উচু পাহাড়ে একটা ঝরনা রয়েছে। ঝরনার মুখে বসানো রয়েছে একটা ওলকপি । ঝরনার মুখ থেকে ওলকপিটা তুলে নেবে। টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে। দূরে ফেলে দেবে। গাইতি চালিয়ে ঝরনার মুখের গর্তটা অনেক বড় করে দেবে। পাহাড়ের কোল ছাপিয়ে, পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার ধারা নামবে। অফুরন্ত জল। ঠান্ডা মিষ্টি জল। এ গল্পকথা নয়, সত্যি। আমি নিজে চোখে ঝরনার ধারা দেখেছি। আঃ, কি শান্তি ।
বুড়ো যেন কিছু বলবে। কিন্তু তাকিয়ে দেখে মেয়ে আর বসে নেই। পথ দিয়ে সামনে হেঁটে চলেছে। পেছনে দুলছে লম্বা চুলের রাশি, বরফের মতো সাদা।
হঠাৎ মেয়ে দৌড়তে লাগল। ছুটে গেল গাঁয়ের ভেতরে। চিৎকার করে বলল, সবাই বেরিয়ে এসো। সবাই। ওই দূরের পাহাড়ে একটা ঝরনা আছে। আমি জেনে এসেছি। সবাই এসো।
গায়ের মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। মেয়ের চারপাশে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন পরে তারা কেশবতী কন্যার কথা শুনল। অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে মেয়ের দিকে। কারও মুখে কথা নেই। এ মেয়েকে তারা অবিশ্বাস করতে পারে না। এ কি কথা শোনাচ্ছে মেয়ে?
মেয়ে সব খুলে বলল। ডাগর চোখে সে চেয়ে রয়েছে গাঁয়ের মানুষের দিকে। মেয়ে বলল ঝরনার কথা, কেমন করে খুঁজে পেয়েছে সেই ঝরনা, কি করতে হবে তাদের। সব বলল। শুধু পাহাড়ের দেবতার সেই ভয়ানক কথার কিছুই জানাল না। দেবতার কথাও বলল না। মেয়েকে তারা সবাই খুব ভালোবাসে। অবিশ্বাস করবে কেন তার কথা? তারা মেয়ের পিছু পিছু চলল।
মেয়ে চলেছে এগিয়ে। পেছনে হাওয়ায় দুলছে কেশরাশি। অনেকের হাতে গাইতি, কারও হাতে ধারালো ছুরি। সামনে বেঁকে তারা পাহাড়ে উঠছে, মেয়ে পথ দেখিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পৌঁছে গেল গুপ্ত ঝরনার কাছে। নিচু হয়ে ঝরনার মুখ থেকে তুলে নিল সেই ওলকপিটা। দূরে ফেলে দিল। বলল, টুকরো টুকরো করে কেটে ফেল ওটাকে।
একসঙ্গে কয়েকটা ছুরির আঘাত পড়ল ছোট ওলকপির ওপরে। শত টুকরো হয়ে গেল ওলকপি । ছোট গর্ত থেকে জল উপচে পড়ছে। ঝিরিঝিরি জল। ভিজে উঠেছে পাশের পাহাড়ি মাটি।
কেশবতী কন্যা শান্ত মিষ্টি গলায় বলল, “দেরি নয়, গর্তের মুখ বড় করতে হবে। গাইতি নাও। খুব তাড়াতাড়ি। যত বড় পারবে তত বড় করবে। তাড়াতাড়ি। নইলে... !
ঠোঁট কামড়ে ধরল মেয়ে।
অতশত দেখার সময় নেই। মনও নেই। অনেক গাইতি পড়ল গর্তের মুখে। মাটি উঠছে, জলের ধারা নামছে। ভীষণ শব্দ করে জল বেরুচ্ছে। পায়ের পাতা ডুবল, জল উঠেছে, হাঁটু ডুবছে। জলের ধারা পাহাড়ের কোল ছাপিয়ে, গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে নীচে, গাঁয়ের দিকে, গাঁয়ের পাশ দিয়ে। ছোট নদী বয়ে চলেছে গাঁয়ের পাশ দিয়ে। অফুরন্ত জলের উৎস, অফুরন্ত জলের ধারা। আনন্দে নাচছে গাঁয়ের মানুষজন, তারা জল ছিটিয়ে সবাইকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আঃ, কি শান্তি !
হঠাৎ পাহাড়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেল একটা দমকা হাওয়া। এত লোকের চোখের সামনে থেকে নিমেষে মিলিয়ে গেল কেশবতী কন্যা। শুধু একজন নেই সবাই আছে। কিন্তু এসব দেখার সময় নেই তাদের। তারা জানতেই পারল না, কেশবতী কন্যা এখন আর তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে নেই।
হঠাৎ একজন বলে উঠল, ‘আরে! কেশবতী কন্যা কোথায়? সে কোথায় গেল? অন্য একজন বলল, “সে বোধহয় বাড়িতে গিয়েছে। সবার আগেই চলে গিয়েছে। বুড়িমা একা রয়েছে। সবাই মেনে নিল তার যুক্তি। পাহাড় থেকে নেমে এল তারা। সবাই যেন অন্য মানুষ। নতুন শক্তি তাদের দেহে, মনে।
কিন্তু কেশবতী কন্যা তো আর তার বাড়িতে যায় নি! দমকা হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে সেই ভয়াবহ গুহার সামনে। পাহাড়ের দেবতা বসে রয়েছে। পাথরের ওপরে। চোখ জ্বলছে।
হুংকার ছাড়ল পাহাড়ের দেবতা, ‘আমি নিষেধ করেছিলাম তোমাকে। ঝরনার কথা কাউকে বলবে না। সবাইকে বলে দিলে। তাদের নিয়ে এলে পাহাড়ি ঝরনার কাছে। তারা টুকরো টুকরো করে ফেলল আমার জাদু ওলকপি। তারা গাইতি চালিয়ে আমার গুপ্ত ঝরনার মুখ বড় করে ফেলল। আমি নিষেধ করেছিলাম। এবার আমি তোমায় জ্যান্ত মেরে ফেলব। দেবতা দাঁতে দাঁত ঘষল।
কেশবতী কন্যার আলুলায়িত কেশরাশি পিঠের ওপরে হাওয়ায় দুলছে। মিষ্টি সুরে শান্ত গলায় মেয়ে বলল, ‘গাঁয়ের মানুষজনের দুঃখ ঘুচেছে। আমি হাসিমুখে মরতে পারব। আনন্দে মরব। কোন ভয় নেই আমার। আমি তৈরি।
পাহাড়ের ভয়ানক দেবতা আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠল। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে সে হাসি হাজার হাসি হয়ে ফেটে পড়ল। তোমাকে মরতে হবে। কিন্তু অত সহজে তোমাকে মারব না। যন্ত্রণায় ছটফট করে কান্নায় ভেঙে পড়ে তিলে তিলে তোমায় মরতে হবে।
মেয়ে শান্ত চোখে চেয়ে রইল। মেঘের লুকোচুরি খেলা চলেছে। মেয়েকে ছুঁয়ে মেঘেরা পাহাড়ের পাশ দিয়ে ভেসে চলেছে। মেয়ের ঠোঁটের কোণে পবিত্র হাসি।
হঠাৎ দেবতা হুংকার দিয়ে উঠল, “ওই নীচে মসৃণ পাথরের উপরে তোমাকে শুইয়ে দেব। ওই পাথরে, যায় ওপরে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ি ঝরনার জল। তোমার শয়তানিতে ছোট ঝরনা জলপ্রপাত হয়েছে। তার নীচে তোমায় শুইয়ে দেব। জলের আঘাতে দেহ ওলটপালট হয়ে যাবে, হূদয় ফাটবে, দম বন্ধ হয়ে আসবে। যন্ত্রণা, ভীষণ যন্ত্রণা। তিলে তিলে মৃত্যু। নিষেধ না মানার প্রতিফল। দাঁতে দাত ঘষছে দেবতা।
সাদা মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে মেয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘গায়ের মানুষদের ভালোর জন্য আমি ওই পাথরের ওপরে শুয়ে পড়তে একটুও ভয় পাই না। আমার দেহে জলের ধারা আঘাত করুক। কিন্তু হে পাহাড়ের দেবতা, তোমায় প্রণাম জানিয়ে আমি একটা ছোট্ট ভিক্ষা চাই। ভিক্ষা দেবে? মেয়ের হাসিমুখে মুক্তো ঝরছে।
কি তোমার ভিক্ষা? আগে শুনি।
মেয়ে চোখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “আমার কেউ নেই। রয়েছে এক বুড়িমা। কোন কাজ মা করতে পারে না। অনেক বয়েস। আর রয়েছে শুয়োরের কয়েকটা ছোট্ট ছানা। তারাও নিজেরা খেতে পারে না। হায়! দেবতা, মরবার আগে একবার আমায় বাড়ি যেতে দাও। ওদের ভার একজনের ওপরে দিয়েই আমি ফিরে আসব। আমি কখনও মিছে কথা বলি না। দোহাই তোমার, একবার বাড়ি যেতে দাও । মেয়ে কাঁদছে।
‘বেশ, তুমি যেতে পারো। কিন্তু একটা শর্তে। যদি তুমি ফিরে না এসে কোথাও পালিয়ে যাও, তাহলে আমি ঝরনার মুখ চিরকালের মতো বন্ধ করে দেব। আর, আর গাঁয়ের সব মানুষকে পাথরে পিষে মেরে ফেলব। মনে থাকবে? অল্প থেমে দেবতা কথাগুলো বলল। দুচোখে তার আগুন ঝরছে।
মেয়ে আস্তে আস্তে পাহাড়ি পথে হেঁটে চলল। পেছনে দেবতা বসে রইল। হঠাৎ দেবতা বলল, “দাঁড়াও। ফিরে যখন আসবে তখন আমার কাছে আসবার দরকার নেই। সোজা মসৃণ পাথরের ওপরে চলে যাবে, শুয়ে পড়বে। জলের ভীষণ ধারার নীচে শুয়ে পড়বে। আমি সব জানতে পারব।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মেয়ে হেঁটে চলল। পাহাড়ি পথে মেয়ে নেমে আসছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এল। মেয়েকে উড়িয়ে নিয়ে পাহাড়ের নীচে পায়েচলা পথে নামিয়ে দিল। দমকা হাওয়া মিলিয়ে গেল। আঃ, কি শান্তি। সাদা জলের ধারা ফেনা তুলে নীচে আছড়ে পড়ছে। অফুরন্ত জলের ধারা। জলের ধারা শুকনো জমির ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। কত ফসল ফলবে এবার। মেয়ে খুশির হাওয়া বইয়ে পালকের মতো ভেসে চলল। গাঁয়ের পথে, বাড়ির পথে।
বাড়িতে পৌঁছে গেল কেশবতী কন্যা। কিন্তু ঘরে ঢুকেই সে কেমন দমে গেল। মাকে সত্যি কথা বলবে কেমন করে? একথা শুনেই মা যদি...। মেয়ের বুক কেঁপে উঠল।
মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে মেয়ে বলল, “মা, আমাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে নদী বয়ে চলেছে, খেতে খেতে ফসল ফলানো অফুরন্ত জল। সব জল আসছে পাহাড়ি ঝরনা থেকে। আর.কোন ভাবনা নেই। জলের ভাবনা নেই।
মা চেয়ে আছে মেয়ের দিকে। শুকনো মুখেও হাসি। মেয়ে আবার বলল, ‘মা, আমি তো পাহাড়ে যেতাম ফল কুড়োতে, সেখানে পাশের গাঁয়ের কয়েকজন মেয়ে আমার সই হয়েছে। নতুন সই। ওরা আমায় নেমন্তন্ন করেছে। ওদের সঙ্গে কয়েকদিন থাকব, আনন্দ করব। এই ক'দিন পাশের বাড়ির খুড়িমা তোমাকেও দেখবে, শুয়োরের ছানাদেরও দেখবে। ভাবনা নেই। আমি যাব?
মায়ের মুখে কি সুন্দর হাসি। মেয়ে আবার আগের মতো আব্দার করছে, মুখে খই ফুটছে, এই তো আমার সেই মেয়ে। মা তক্ষুনি রাজি হল। মেয়ে পাশের বাড়ির খুড়িমার সঙ্গে দেখা করে এল। মায়ের আর ছানাদের কোন অযত্ন হবে না। খুড়িমা রাজি।
মেয়ে ফিরে এল মায়ের কাছে। বলল, “মা, আমায় বোধহয় ওরা সহজে ছাড়বে না। দিন পনেরো থাকতে হবে। কেমন? তুমি যেতে দেবে?
সে কি কথা? তুই যাবি বেড়াতে, আর আমি মত দেব না? খুব আনন্দ কর ওখানে গিয়ে। অনেক কষ্ট তোর। বাছা, কিছু ভাবিস না। পাশের বাড়ির বউ খুব ভালো।
কেশবতী কন্যা মায়ের হাত দুটো চেপে ধরল, কপালে চুমো দিল। মেয়ের চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। মুখ ফিরিয়ে নিল মেয়ে। শুয়োরের ছানাদের কাছে গেল। তাদের কোলে তুলে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করল। ছানাদের দেহ ভিজে গেল। দোরের কাছে এসে মেয়ে বলল, “মা আমি যাচ্ছি। আর কিছু বলতে পারল না। ছুটে চলল পাহাড়ি জলপ্রপাতের দিকে। পেছনে দুলছে মেয়ের সাদা আলুলায়িত চুলের রাশি।
পথের মধ্যে রয়েছে এক বিশাল বটগাছ। চারিদিকে ঝুরি নেমেছে। বটগাছের ঘন ছায়ার তলা দিয়ে যাবার সময় মেয়ে গাছের গুড়ি ছুঁয়ে বলল, ‘বটগাছ, আজ থেকে আমি আর তোমার কাছে আসব না। আসতে পারব না। তোমার ঘন ছায়ায় আর কোনদিন জিরোতে আসব না। দেহ শাস্ত করতে আর আসব না। শেষ বিদায়।
হঠাৎ মোটা বটগাছের ওপাশ থেকে একজন বুড়ো মেয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। তার মাথাভর্তি চুল সবুজ, বুকের ওপরে দোলানো দাঁড়ি সবুজ, তার দেহের পোশাক সবুজ। যেন একজন সবুজ মানুষ মেয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।
মিষ্টি হাসি হেসে সবুজ বুড়ো বলল, ‘কেশবতী কন্যা, তুমি কোথায় চলেছ? দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল, মেয়ে কোন কথা না বলে আস্তে করে মাথা নোয়াল। সবুজ বুড়ো হাসল। মাথা নেড়ে বলল, “তোমার সব কথা আমি জানি। মেয়ে, তোমার যে কি বিপদ তাও আমি জানি। আমার কাছে কোন কথাই লুকনো থাকে না। তোমার এমন মন, সবার জন্য তুমি চিন্তা কর। বড় ভালো মেয়ে তুমি। তোমায় আমি বাঁচাব। বাঁচাবই। নইলে বেঁচে থেকে লাভ কি? আমি পাথর কুদে একটি মেয়ের মূর্তি গড়েছি, তোমার মতো দেখতে। যেন তোমারই মূর্তি। পাথরের বুকে সে চোখ মেলে রয়েছে। গাছের এপাশে এসে দেখ।
গাছের ওপাশে গেল মেয়ে। পাথরের মূর্তি দেখে চমকে উঠল। সবুজ বুড়ো কি আগে তাকে দেখেছে। সে তো কখনও তাকে দেখেনি? নিখুঁত মূর্তি, তারই মূর্তি। কত বড় শিল্পী এই সবুজ বুড়ো! শুধু মূর্তির মাথায় তার মতো চুল নেই। আর সব একরকম। মেয়ে তাকিয়ে রয়েছে, পলক পড়ছে না চোখে।
বুড়ো মিষ্টি গলায় বলল, ‘পাহাড়ের দেবতা তোমাকে ওই জলধারার নীচে শুয়ে পড়তে আদেশ দিয়েছে। তাকে অমান্য করতে পারবে না। কিন্তু ওই আছাড়ে-পড়া জলের নীচে শুয়ে পড়লে তোমার কি হবে তা তুমি জানো? হাঁ, তুমি ঠিকই জানো। পাথর ছাড়া ও আঘাত কেউ সইতে পারে না। পাথরও কেঁপে ওঠে, ক্ষয়ে যায়। আর তুমি তো একরত্তি মেয়ে। আমি পাথরের মূর্তিটাকে বয়ে নিয়ে যাব জলধারার নীচে। তোমার হয়ে পাথর-মেয়ে সেখানে শুয়ে থাকবে। আঘাত লাগবে তার দেহে, তোমার দেহে আঘাত লাগতে দেব না। কিন্তু পাথর-মেয়ের তোমার মতো চুল নেই। একটু কষ্ট করতে হবে। ব্যথা পাবে, কিন্তু উপায় নেই। তোমার চুলগুলো ছিড়ে আমি পাথরমেয়ের মাথায় লাগিয়ে দেব। সে হবে কেশবতী কন্যা, ঠিক তোমার মতো। পাহাড়দেবতা দেখতে পেলেও কোন সন্দেহ করবে না। ভাববে, তুমিই শুয়ে রয়েছ। নইলে.... ? বুড়ো চুপ করে গেল। মেয়ে নিঃশব্দে মাথা এগিয়ে দিল বুড়োর কাছে। বুড়ো পাথরে বসে মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে কেশরাশি ছিড়ে ফেলতে লাগল। উঃ, কি অসহ্য যন্ত্রণা। চোখ ভরে এল জলে। একটুও শব্দ করল না মেয়ে। আশ্চর্য সহ্যের ক্ষমতা।
মেয়ের চুলগুলো পাথরের মূর্তির মাথায় স্পর্শ করামাত্র সেগুলো পাথর-মেয়ের মাথায় বসে গেল। পাথর-মেয়ের সত্যিকারের চুল। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছে। সাদা চুলের গোছায় মূর্তির রূপ আরও বেড়ে গেল। সত্যিকারের কেশবতী কন্যা যেন। আর কেশবতী কন্যা দাঁড়িয়ে রয়েছে মূর্তির সামনে—তার মাথায় কোন চুল নেই। মেয়ের কান্না পেল।
বুড়োর মুখে হাসি নেই। আকাশের কালো মেঘ সবুজ বুড়োর মুখে। কাঁপা গলায় বলল, ‘মেয়ে, এবার তুমি ঘরে যাও। আর কোন ভয় নেই। গাঁয়ে এখন অনেক জল, ফসলের জমি নরম হয়েছে, চাষ করো, পরিশ্রম করো। সবাই মিলে ফসল ফলাও । তুমি, তোমরা সুখে জীবন কাটাও। ফলে ফুলে শস্যে তোমাদের জীবন ভরে উঠুক?
সবুজ বুড়ো চোখ নামিয়ে নিল। মেয়ের দিকে আর চেয়ে দেখল না। ভারী পাথরের মূর্তিটা অনেক কষ্টে কাঁধে তুলে নিল। পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলল। পাথর পেরিয়ে যাচ্ছে, বুড়ো কাঁপছে, মূর্তি হেলে পড়ছে। বুড়ো এগিয়ে চলল। পৌঁছল আছড়ে-পড়া জলধারার নীচে। শুইয়ে দিল পাথর-মেয়েকে। আছড়ে পড়ল জল, সাদা ফেনায় ভরা জলরাশি। মেয়ের মাথার সাদা চুল ওলটপালট খাচ্ছে, এধার ওধার করছে, ভেসে উঠছে, লেপটে যাচ্ছে মেয়ের দেহে। জল পাথরের দেহ ছুঁয়ে বয়ে চলেছে আরও নীচে, ফসলের জমির দিকে।
মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বটগাছের নীচে। সে বাড়ির পথে যায় নি। সব দেখছে। বুক ভেসে যাচ্ছে। না, তার কেশরাশি গিয়েছে বলে নয়। তাকে বাঁচাবার জন্য সবুজ বুড়ো যে কষ্ট করেছে, তাই দেখে মেয়ে কাঁদছে। আহা, কত ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছে সে !
কেশবতী কন্যার মাথা চুলকোচ্ছে। চিড়বিড় করছে। মাথায় হাত দিল সে। খোঁচা খোঁচা চুল। জমি থেকে ধান কেটে নিলে যেমন থাকে। এ কি! চুল বেড়ে যাচ্ছে। মাথায় আর খোঁচা খোঁচা লাগছে না। নরম হয়ে আসছে চুলের রাশি। ছেলেদের মাথার মতো চুল। আরও বড়ো হচ্ছে আরও বড়। কাঁধ ছাড়াল, বুক ছাড়াল, কোমর পেরিয়ে গেল, চুলের রাশি মাটি ছুঁয়ে গেল। থেমে গেল বড় হওয়া। কেশবতী কন্যা দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ি হাওয়ায় কেশরাশি উড়ছে। হাতের মুঠোয় চুলের রাশি সামনে তুলে ধরল। চোখের সামনে। দাঁড়কাকের গলার পালকের মতো কালো কেশ। লাফিয়ে উঠল আনন্দে। নাচের ছন্দে ঘুরে গেল মেয়ে। দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে আনন্দে নাচছে কেশবতী কন্যা। সহজ আনন্দে বনের প্রাণী মুক্ত হাওয়ায় নাচছে।
থেমে গেল মেয়ে। তাকিয়ে রইল পাহাড়ি পথে। অনেকক্ষণ। পথের দিকে চেয়ে রয়েছে। কিন্তু সবুজ বুড়ো কই ফিরছে না তো? অনেক সময় বয়ে গেল।
হঠাৎ বটগাছের ডালপালা কেঁপে উঠল, পাতাগুলো কেঁপে উঠল। সেই কাঁপা-কাঁপা পাতার মাঝখান থেকে ভেসে এল কার কণ্ঠস্বর? সে বলছে, ‘ওগো, কেশবতী কন্যা, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। পাহাড়ের দেবতাকে আমরা সত্যি সত্যি বোকা বানিয়েছি। ভয় নেই, বাড়ি ফিরে যাও। সুখে থাকো, ভালো থাকো।
উঁচু পাহাড় থেকে জলধারা আছড়ে পড়ছে নীচে, পাথরের ওপরে। মেয়ে সেদিকে চেয়ে রইল। নীচে পাহাড়ের কোল জুড়ে সবুজ ফসলের খেত, মাঠের পারে হাসিহাসি চোখ-মেলা বধূরা। সবুজ পাতায় ভরা বিরাট বটগাছ, নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়ে। বনের হরিণের মতো চমকে উঠে পাহাড়ি হাওয়ায় চুল ভাসিয়ে গানের ছন্দে মেয়ে নেমে আসছে পাহাড়ি পথে। মেয়ে হাওয়ায় ভেসে আসছে, মেয়ে চলেছে গাঁয়ের পথে। সবুজ ফসলের ওপর দিয়ে জলের ধারার মতো আসছে কেশবতী কন্যা।
ডাউনলোড PDF: ডাউনলোড
0 coment�rios: