গুরুদেব বিষ্ণুশর্ম রাজপুত্রদের একদিন নানান প্রশ্ন করলেন। রাজপুত্ররা তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিল। গুরুদেব খুশি হয়ে বললেন, আজ থেকে তোমাদের আমি প্রথম মিত্রভেদের গল্প শোনাতে শুরু করব। কি করে একটা বলদ ও সিংহের বন্ধুত্ব লোভী ও পাজি শেয়াল নষ্ট করেছিলো তার গল্প।
এই কথা শুনে রাজপুত্ররা আনন্দে বলে উঠল--কি করে অমন কাজ হয়েছিল গুরুদেব?
বলদ ও সিংহ
দক্ষিণদেশে সুবর্ণ নামে এক রাজ্য ছিল। সেখানে বর্ধমান নামে এক ধনী ব্যক্তি বাস করত। সেই লোকের প্রচুর টাকাপয়সা ধনরত্ন ছিল। এত ধনদৌলত থাকা সত্ত্বেও তার মনে শান্তি ছিল না। তার সবসময় মনে হতো তার থেকে ওর অন্যসব বন্ধুরা বেশি ধনী। এইজন্য নিজে সবসময় হীনম্মন্যতায় ভুগত। তার মন সবসময় অশান্তিতে ভরে থাকত। কথায় আছে, নিচের দিকে তাকাও, নিচের থেকে আরও নিচে দেখলে মনে শান্তি পাওয়া যায়। আর উপর দিকে তাকালে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। নিজেকে মনে হয় খুব তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র। লোকটি নিচের দিকে না তাকিয়ে শুধু উপরের দিকেই তাকাত। তাই ও সবসময়ই নিজেকে তুচ্ছ মনে করত, ভাবত ওর চেয়ে উপরের মানুষেরাই বেশি সুখী ! যার প্রচুর অর্থ আছে সে যদি খুনীও হয় তাহলেও সকলে তাকেই মান্য করে, আর যার ধনদৌলত নেই, সে যদি সদ্বংশেও জন্মায়, তবু তাকে শুধু অপমানিত হতে হয়। এসব ভেবে ভেবে সে মনে মনে ঠিক করল অলসের মতো বসে থেকে কাজ নেই, তার থেকে কিছু একটা করা ভাল। কারণ শাস্ত্রে আছে--আলস্য, স্ত্রীর বশীভূত হওয়া, রোগী, ঘরকুনো হওয়া, আত্মতুষ্টি এবং ভীরুতা-এই ছয়টি দোষ মানুষের উন্নতির বাধাস্বরূপ। তা ছাড়া--যা পাওয়ার অসাধ্য তাকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত, যা পাওয়া গেছে তা রক্ষা করা উচিত। আর সেই রক্ষিত জিনিসকে বাড়াতে হবে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বস্তু দান করতে হবে। এতসব চিন্তাভাবনা করে সে একটা গরুর গাড়ি কিনল ও তাতে প্রচুর জিনিসপত্র ভর্তি করে নন্দ ও সঞ্জীৰ নামে দুটি বলদকে জুড়ে নিয়ে চলল বিদেশে বাণিজ্য করতে। তখনকার দিনে তো এখনকার মতো পথঘাট ছিল না, কোথাও যেতে হলে বনবাদাড় ভেঙেই যেতে হতো। বনজঙ্গল সব ভেঙেই সে চলল বিদেশে। একদিন সে বিশাল এক বনে এসে পড়ল। এই বনটা পার হলেই একটা বড় রাজ্য। লোকটি ঠিক করল, এই বন পেরিয়ে ওই রাজ্যেই গিয়ে বাণিজ্য করবে।
সে খুব তাড়াহুড়ো করে বনটা পার হতে চাইল। কিন্তু পারল না। হঠাৎ সঞ্জীব বলদটার পা ভেঙে গেল। লোকটি মনে মনে খুব চটে গেল! এখন কি করবে? হঠাৎ ওর মনে হল এভাবে বোকা হয়ে বসে থেকে লাভ নেই। কথায় আছে---সব কাজের বাধা হচ্ছে এই হতভম্ব হওয়া। একে সবার আগে ত্যাগ করা উচিত। তাই সে এভাবে বসে না থেকে নিজের স্বার্থের কথাই সবার আগে ভাবল। এই ভেবে সে গাড়ি থেকে নেমে অন্য একটা গ্রাম থেকে নতুন বলদ কিনে এনে গাড়িতে জুড়ে দিল। আর সঞ্জীবকে পা-ভাঙা অবস্থায় বনের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেল!
বলদ বনের মধ্যে দিশেহারা। কি করবে বেচারা। একটি পা ভাঙা। তাই তিনপায়েই কোনোমতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে লাগল। কখন যে বাঘ সিংহ বেরিয়ে খেয়ে ফেলবে কে জানে। কোনমতে রাতটা কেটে গেল। এভাবে বেশ কয়েকট দিন কেটে গেল। একদিন ও সুস্থ হয়ে উঠল। প্রাণে যে মৃত্যুভয় ছিল সেটাও দূর হয়ে গেল। কথায়ই তো বলে—সমুদ্রে ডুবে গেলে, পাহাড় থেকে পড়ে গেলে, সাপে কামড়ালে, যদি আয়ু থাকে তবেই সে জীবন রক্ষা করতে পারে। আর যার কেউ নেই, তাকে সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করে। সৃষ্টিকর্তা রক্ষা না করলে মানুষও বিনাশ হয়। বনে পরিত্যক্ত অনাথও বেঁচে থাকে। অথচ গৃহে সুরক্ষিত মানুষও জীবিত থাকে না।
এখানে বলদটাকে সৃষ্টিকর্তাই বাঁচাল। ও শুধু প্রাণেই বাঁচল না, খেয়েদেয়ে সুস্থ ও সবল হয়ে উঠল। হাম্বা হাম্বা করে চিৎকার করতে লাগল। ওর ডাক শুনলে মনে হয় যেন মেঘ গৰ্জন করছে।
সেই বনের পশুরাজ হচ্ছে এক সিংহ। বনের অন্য সব পশুরা তাকে ভীষণ ভয় পায়। সিংহ পাত্রমিত্র সভাসদ নিয়ে মনের সুখে রাজত্ব করত।
একদিন পশুরাজ এক জলাশয়ে জল খেতে গেল। সেখানেই বলদটা ছিল। কেউ কাউকে দেখতে পেল না। পশুরাজ তো জলে নেমে সবে মুখ ডুবিয়ে জল খেতে যাবে ঠিক তখনই বলদ হাম্বা হাস্কা করে গর্জন করে উঠল। এই অচেনা হাম্বা ডাক শুনে সিংহ ভয়ে জল ছেড়ে এক লাফে তীরে উঠে এল। তারপর দে ছুট। সোজা দৌড়ে নিজের গুহায় ফিরে হাঁফাতে লাগল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল—এ আবার কি জন্তু? একে তো কোনোদিন দেখিনি! কি অদ্ভুতভাবে গর্জন করছে!
সিংহ যে এত ভয় পেয়েছে এটা শুধু টের পেল দুই মন্ত্ৰী। দমন ও করট নামে দুটো শেয়াল। সিংহ রাজা যে ভয়ে লুকিয়েছে তা ওরা লক্ষ করেছে। তাই দমন করটকে বলল; বল তো সিংহ কেন লুকিয়ে আছেন?
করট বলল, এসবে আমাদের কি দরকার? আমরা তো শুধু চাকর। শুধু ওর কাছে অবজ্ঞা পাই। কথায় আছে—অর্থের জন্য ভৃত্যরা কি না করে, নিজের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। ভূত্য ছাড়া আর কে আছে যে উন্নতির জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেয়-মনিবের জন্য সুখের চেয়ে দুঃখ বরণ করে? তা ছাড়া আরও আছে—যেমন প্রভুর সামনে ভৃত্য নীরব থাকলে সে মূর্খ। বেশি কথা বললে বাতুলতা, সহনশীল হলে ভীরু। অসহিষ্ণু হলে সদ্বংশ জাত নয়। সবসময় কাছে থাকলে ধৃষ্ট, আর দূরে গেলে অযোগ্য তা হলে দেখ সেবাদর্শ বড় জটিল। জ্ঞানীরাও বুঝতে পারেন না। অথচ ভৃত্যর সেবাপরায়ণ না হলে প্রভুর চামর দুলত না।
করট ফের বলল, তাই বলছি, কি দরকার আমাদের এই ব্যাপারে মাথা গলানোর। যে পরচর্চা করতে যায় সে কলীক উৎপাটনকারী বানরের মতোই নষ্ট হয়।
দমন করটের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বলল, কি রকম? কি রকম শুনি?
পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো একটি আর একটি গল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে প্রথম থেকে না পড়লে কিছুই বোঝা যাবে না। গল্পগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে চাইলে গল্পের তালিকা ব্যবহার করো।
0 coment�rios: