অনেক অনেক কাল আগে একটি ছোট ছেলে ছিল। খুব ছেলেবেলায় তার মা মারা যায়। আদরের ছোট ছেলেকে ছেড়ে মা চিরকালের জন্য চলে গেল। বাবা তাকে খুব ভালোবাসত। মায়ের অভার বুঝতে দিত না বাবা। সেই ছিল ছেলেটির বাবা, ছেলেটির মা। এমনি করে সুখে দিন কাটতে লাগল।
বেশ কিছুদিন পরে বাবা আবার বিয়ে করল। এই সৎ মা কিন্তু মোটেই ভালো ছিল না। ছেলেটাকে দুচোখে দেখতে পারত না। আকারণে ছোট ছেলেকে সৎ মা বেদম মারত, একটুও দয়ামায়া দেখাত না। ছেলেটি কোন দোষ করেনি, তাই বুঝতে পারত না কেন তাকে মা মারছে! বুঝবেই বা কেমন করে? ও যে বড় ছোট। আর খাওয়া? মা ছেলেকে খেতে দিত আধ-সেদ্ধ যত খাবার। মাংসের ঝোল আর শুধুই হাড় দিত। হাড়গুলোতে একটুও মাংস লেগে থাকত না। তার ওপরে পুরো সেদ্ধ না হওয়ায় ঝোলে-হাড়ে কেমন গন্ধ বেরুত। কি করবে ছোট ছেলে! খিদের জ্বালায় আর মার খাওয়ার ভয়ে তাই খেত। কোন অভিযোগ করত না, প্রতিবাদ করত না, ছোট ছেলেদের মতো গুই গুই করত না। সব সহ্য করত। হাসিমুখে যা পেত তাই খেয়ে নিত। বড় ভালো মিষ্টি ছেলে।
বাবার চোখে পড়ে গেলে মা বকুনি খেত। অকারণে কেন বাচ্চা ছেলেকে মারছ? ও তো কোন দোষ করেনি? তবে? বাবা মাঝে-মধ্যে বাধা দিত তাই রক্ষে। না হলে কখনই বাবার কাছে নালিশ করত না। তাই একইভাবে চলতে লাগল ছেলেটির কষ্টের জীবন। এই অল্প বয়স। তবু বাড়িতে সকালে-দুপুরে-সন্ধেবেলা ছেলেকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হত। কাজে ভুল হলে কিংবা টিলেমি দিলে মায়ের কাছে বকুনি আর মার জুটত। অন্য ছেলেরা কেমন পাহাড়ি ঢালুতে খেলে বেড়ায়—আর তাকে আটকা থাকতে হয় বাড়িতে। তবু সব কিছু সে সহ্য করে। বড় ভালো ছেলে সে।
আর কিছুদিন পরে মা তাকে পাঠাল অন্যের জমিতে জুমচাষ করতে। পাহাড়ি জমিতে জুমচাষ কত কষ্টের। কি ভীষণ খাটুনি। সারা দুপুর কাজ। তবু মা তাকে খাবার দিত সামান্যই। কাজের ফাঁকে কলাপাতার মোড়ক খুলে সে তাই খেত। এত অল্পে কি পেট ভরে? তার ওপরে ভাত তরকারিতে কেমন ইঁদুর-ইঁদুর গন্ধ। আধ-সেদ্ধ খাবার গন্ধ খাবার খেয়েই তাকে থাকতে হত। কি-ই বা করার ছিল তার! শুধু কি তাই? অন্য অনেক ছেলে-মেয়েও জুমচাষে সাহায্য করত। তাদের কত ভালো খাবার। ওদের সামনে কলাপাতা খুলতে খুলতে তার কেমন লজ্জা-লজ্জা লাগত। তাই খাওয়ার সময় সে একটু দূরে উঁচু জুম-বাড়ির নীচে বসে খেত। একা একা বসে খেত। মনে কত কষ্ট। সে একটু একটু করে খেত। চোখ ভিজে যেত।
প্রথম প্রথম সঙ্গী-সাথীরা কিছুই বুঝত না। পরে তারা সব জেনে ফেলল। তাই মাঝে-মধ্যেই তাকে নিজেদের কাছে ডেকে আনত। নিজেদের খাবার ভাগ করে তাকেও দিত। ওরা তো বন্ধু! বন্ধুর মনের কষ্ট বুঝত। কিন্তু ভালো খাবার খেয়েও তার মনে কোন আনন্দ হত না। বন্ধুরা দিত, সে খেত কিন্তু মনমরা হয়েই সেগুলো সে খেত। বরং তার খারাপ খাবার একা একা খেতেই সে ভালোবাসত। এতে তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মনে ফুর্তি নেই। ভালো খাবার মুখে রুচবে কেমন করে? খারাপ খাবারেই সে সাত্বনা খুঁজে পেত।
একদিন খুব সুন্দর বিকেল। চারিদিকে অপরূপ দৃশ্য, সুন্দর সবুজ পাহাড়ি বন। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গিয়েছে। কাজও শেষ। তারা জুম-বাড়িতে বিশ্রাম করছে। একটু পরে সবাই বাড়ি ফিরবে। মনেও আনন্দ। হঠাৎ ছেলেটি বন্ধুদের কাছে তাদের সুন্দর ঝলমলে পোশাক চাইল। সে একবার পরে দেখবে তাকে কেমন লাগে। সে তো কোনদিন এমন সুন্দর পোশাক পরে নি। খুব ইচ্ছে হয়েছে। তার পোশাক নোংরা, ছেঁড়া, কেমন যেন। আর সেগুলো অনেক পুরনো, রঙ-ওঠা , কেমন যেন।
বন্ধুরা তক্ষুনি রাজি। তারা হাসতে হাসতে আনন্দ করে বলল, “বন্ধু, আমাদের আপন বন্ধু, কি সুন্দর তোমাকে দেখতে। কিন্তু তুমি এমন পোশাক পরে থাকো বলে মোটেই ভালো লাগে না। তোমাকে এমন সুন্দর দেখতে। এমন কি রাজকুমারীও তার ছেলেমেয়ের বাবা হবার জন্য তোমাকে পছন্দ করবে।
ছেলেটি লজ্জা পেল। বন্ধুরা তাকে পোশাক দিল। নিজেরাই ঠিকঠাক পরিয়ে দিল। আঃ কি সুন্দর। পোশাক পরে ছেলেটি উচ্ছল হয়ে উঠল। তারপরে আস্তে আস্তে বলল, 'ওঃ, যদি আমার এরকম একটাও পোশাক থাকত, তবে আমি পরবের সময় তোমাদের সঙ্গে নাচতাম। আঃ, কি ভালোই লাগত। কি আনন্দ হত।’
বন্ধুদেরও খুব আনন্দ হয়েছে। সবাই তার রূপের প্রশংসা করছে। তারপরে তারা তাকে একটা উঁচু ঢিবির ওপরে দাঁড় করিয়ে দিল। বন্ধুকে তারা আরও ভালোভাবে দেখতে চায়। বন্ধু ওপরে, তারা একটু নীচে। আঃ, কি সুন্দর লাগছে বন্ধুকে।
ছেলেটি ঢিপির ওপরে দাড়িয়ে ওপরে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ধনেশ পাখির মতো উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। বনের ওপর দিয়ে, পাহাড়ের পাশ দিয়ে। ওই উঁচুতে, ওই ওখানে। বন্ধু তোমরা যদি আমাকে এই সুন্দর পোশাকটি দাও, তবে আমি অনেক অনেক দূরে, অনেক অনেক উঁচুতে, সাদা মেঘের দেশে, সবুজ বনের গভীরে ধনেশ পাখি হয়ে উড়ে যেতে পারি। আর পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার পরে যদি আর কখনও তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা না হয়, যদি আর কখনও এই পৃথিবীর মানুষের খুব কাছে না থাকি তবু আমি তোমাদের মনে রাখব। আকাশ-পথে উড়ে যাওয়ার সময় আমার দেহের সবচেয়ে সুন্দর করে রাঙানো পালক আমি উড়িয়ে দেব, তোমাদের ছেলেমেয়েরা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নাচের আসরে যাবে। চুলে পরবে, মাথায় গুজবে, পোশাকে লাগাবে। আমার দেহের সবচেয়ে সুন্দর পালক। তোমরা জানবে, আমি আর কোনদিন তোমাদের একজন হয়ে তোমাদের পাশেপাশে নাচের আসরে যেতে পারব না, তোমাদের কাছের সঙ্গী হব না। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি আবার কিছুদিন পরে আমাদের গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যাব। তখন তোমরা আমার ডানাদুটোর আওয়াজ শুনতে পাবে, সে আওয়াজ মিষ্টি গানের মতো। ডানার শব্দে মিষ্টি গান ভেসে আসবে।’
এই কথা শুনে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে-থাকা বন্ধুরা অবাক হল। বন্ধুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে? এ বেদনা তারা ভুলবে কেমন করে? কয়েকজন হাহাকার করে উঠল। এ বিচ্ছেদ, এ বেদনা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু তাদের মধ্যেই কয়েকজন বলল,—বন্ধু পাখি হয়ে উড়ে যাক। ধনেশ পাখি হয়ে দূর পাহাড়ে মিলিয়ে যাক। সেই ভালো, সেই ভালো। সে হোক সবুজ বনের সুখি ধনেশ পাখি। নিত্যদিনের যাতনা থেকে এ অনেক ভালো। এক নিষ্ঠুর মা রয়েছে তার বাড়িতে, এত কষ্ট তো আর কেউ সহ্য করেনি। ওর মনের ব্যথা কেউ বুঝবে কেমন করে? সেই ভালো। বন্ধু ধনেশ পাখি হয়ে উড়ে যাক। আমাদের কষ্ট হোক। ওর আর কষ্ট থাকবে না, বনের সবচেয়ে সুস্বাদু মিষ্টি ফল ও খাবে, পচে-ওঠা ইঁদুর-ইঁদুর গন্ধ-মাখা খাবার ওকে আর খেতে হবে না। ও হবে সুন্দর ধনেশ পাখি! বনের পাখিদের রাজ্যে ধনেশ হবে পাখির রাজা। সর্বশ্রেষ্ঠ পাখি। দূর আকাশের, সবুজ বনের, পাহাড়ি বনের পাখি। তাই হোক। ছেলেটি জল-ভরা চোখে ওদের বিদায় জানাল। হাত তুলে বিদায় জানাল। তারপরে মতো করে হাতদুটো নাড়তে লাগল, ঢিপি ছেড়ে ওপরে উঠল। ডানা মেলে ধনেশ পাখি হয়ে সাদা মেঘের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। দিন যায়, রাত আসে। সময় বয়ে যায়। হঠাৎ একদিন হিমেল হাওয়ার বিকেলে একটি ধনেশ পাখি উড়ে এল সেই পাহাড়ি গাঁয়ে। বন্ধুরা, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখেই দৌড়ে এল খোলা আকাশের নীচে, মাঠের ওপরে, সেই ঢিপিটার কাছে। হাত তুলে তারা চিৎকার করে বলল, ধনেশ পাখি, তুমি কি আমাদের সেই অতি-চেনা বন্ধু? তোমাকে আজও আমরা ভুলতে পারি নি। কোনদিন ভুলবও না। সব সময় মনে পড়ে তোমার কথা। যদি সত্যিই তুমি আমাদের সেই বন্ধু হও, তবে তোমার দেহের সুন্দর একটা রাঙানো পালক আমাদের দাও। তোমার উপহার।
হঠাৎ ধনেশ পাখির দেহ থেকে সবচেয়ে সুন্দর একটি পালক খসে গেল, ঘুরতে ঘুরতে নেমে এল পালক। পালক এসে পড়ল বন্ধুদের মাঝখানে। রাঙানো পালক। অপরূপ পালক। ওপরে ডানার শব্দে মিষ্টি গান ভেসে আসছে।
অনেক মানুষের মধ্যে সেই মাঠে ছেলেটির সৎ মাও এসেছিল। সেও তাকিয়ে রয়েছে ওপর দিকে। উপহার দেখে সৎ মা বলল, ’ও আমার সোনার ছেলে, আমি তোমার মা, আমাকেও একটা রাঙানো পালক দাও। তোমার উপহার।
ধনেশ পাখি মায়ের মাথার ওপরে ডানা মেলে স্থির হয়ে বইল। দেহ থেকে কিছুটা নোংরা ফেলে দিল নীচে। তা সোজা এসে পড়ল মায়ের চোখে। মা চিরকালের জন্য অন্ধ হয়ে গেল। এই সুন্দর সবুজ পৃথিবী, সাদা আকাশ, পাহাড়ি বন তার চোখ থেকে মুছে গেল। পালক হাতে বন্ধুরা নীচে হাত নাড়ছে, সাদা মেঘের ভেলায় ধনেশ পাখি ডানা মেলেছে, মিষ্টি গান ভেসে আসছে-ডানার গান, বন্ধুর গান।
0 coment�rios: