সেই পুরনো কালে আচিক আসোঙ-আসোঙদের মধ্যে এক মস্ত ধনী সর্দার বাস করত। তার ছিল অগাধ সম্পত্তি আর একটি অপরূপ রূপসী মেয়ে। এই মেয়েই তার একমাত্র সস্তান। এই আমাদের জনগোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক। এই সমাজের নিয়ম অনুসারে সেই মেয়েই হল সবকিছুর উত্তরাধিকারী। সেই পাবে সব। বাবার পরে মেয়েই পাবে সব।
মেয়ে বড় হল। আরও হল রূপসী। অমন রূপ কেউ দেখেনি। তার বিয়ে ঠিক হল তারই এক ভাইয়ের সঙ্গে। বাবার দিকের এক খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে। ছেলেটিও খুব সুন্দর দেখতে। একদিন দুজনের বিয়ে হল।
অনেক কিছুই পেল মেয়ে। ধনী সর্দার তার মেয়েকে সব দিল। আর সেইসঙ্গে মেয়েকে দিল আর একটি মহা মূল্যবান বস্তু। এক টুকরো রেশমি কাপড়। খুব অদ্ভুতভাবে বোনা এই রেশমি কাপড়, চিত্র-বিচিত্র নকশায় বোনা এই রেশমি কাপড়। এ কাপড় দিয়েছিলেন একজন দেবী। এ কাপড় দেবী প্রথম দিয়েছিলেন সর্দারের বউয়ের ঠাকুমার মায়ের মাকে। তখন থেকেই এই কাপড় পরিবারের এক মহারত্ন। এটা এতদিন ছিল সর্দারের কাছে। সর্দার আদরের মেযেকে এই মহারত্ন বিয়ের সময় উপহার দিল। মেয়ে-জামাই পেল জাদু রেশমি কাপড়। কেন মহরত্ন এই রেশমি কাপড়? দেবী বলেছিলেন, এই জাদু রেশমি কাপড় হাত দিয়ে ছোয়ার আগে একটা বিশেষ মন্ত্র পড়তে হবে। যখনই স্পর্শ করবে, তখনই আগে মন্ত্র পড়ে নিতে হবে। যদি কেউ ছোয়ার আগে মন্ত্র পড়তে ভুলে যায়, তবে ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পাখি হয়ে যাবে, রেশমি কাপড়টি হবে তার পুচ্ছ, তার পালক, তার ডানা। এ নিষেধ অমান্য করলে তাকে পাখি হতেই হবে।
মেয়ে ছেলেবেলা থেকে দেখছে এই কাপড়। রেশমি কাপড়। জাদু রেশমি কাপড়। বাবা-মা তাকে ছেলেবেলা থেকেই মন্ত্র শিখিয়েছে—বহুবার সে মন্ত্র পড়েছে, কাপড় স্পর্শ করেছে। বারবার করতে করতে মেয়ের কখনও ভুল হয় না, কাপড় স্পর্শ করার আগে মন্ত্র পড়তে ভুল হয় না। তাই মন্ত্র পড়ে ইচ্ছেমতো যখন-তখন সে রেশমি কাপড়ে হাত দিতে পারে। কখনও ভুল হয়নি। নতুন জামাই কিন্তু এসব কিছুই জানে না। সে অনেকবার দেখেছে এই কাপড়। কিন্তু এ যে জাদু কাপড়, মহামূল্যবান কাপড়, তা সে জানে না। সে ভাবে, অতি সাধারণ একটি কাপড়, শুধু দেখতেই সুন্দর। পুরনো জিনিস, বাবা মেয়েকে আদর করে দিয়েছে। বাবা বুড়ো হলেন, মা বুড়ি হলেন। একদিন বাবা-মা মারা গেলেন। মেয়ে খুব কাঁদল। কত সুখের স্মৃতি। কত আদর। এখন মেয়েই হল বাড়ির কর্ত্রী, গৃহিণী। একমাত্র উত্তরাধিকারী। সবই এখন মেয়ের হল। তাই যে নিয়ম।
একদিন বেশ রোদ উঠেছে। পরিষ্কার আকাশ। মস্ত উঠোনে মেয়ে সেই রেশমি কাপড় মেলে দিয়েছে। রোদ লাগা দরকার। অনেকদিন রোদে দেওয়া হয়নি। তারপরে স্বামীকে ডেকে বলল, এই কাপড়টা রোদে মেলে দিলাম। তুমি এটা ছোবে না। যদি ঝমঝম বৃষ্টি নামে, যদি ঝড়ে গাছ থেকে আঙুর পড়ার মতো শিলাবৃষ্টিও হয়, বৃষ্টিতে চারদিক যদি সাদাও হয়ে যায়,-তবু তুমি কিন্তু এই কাপড়ে হাত দেবে না। ভুলেও হাত দিয়ে না। মনে থাকবে তো? এই রেশমি কাপড় ছোবে না। স্বামী মাথা নাড়ল। মেয়ে গেল পাশের এক ছোট নদীতে। মেয়ে গেল চিংড়ি ধরতে। পেছন ফিরে স্বামীকে আর একবার নিষেধ করে সে পাহাড়ি ঢালুতে নেমে গেল।
পাহাড়ি মেঘ বড় অদ্ভুত। এই ছিল টনটনে রোদ। হঠাৎ দূর থেকে কালো মেঘ বিদ্যুৎ বেগে ধেয়ে এল, ঘনিয়ে তুলল আকাশকে। কালো হয়ে উঠল চারিদিক। দেখতে দেখতে ফোটা ফোটা বৃষ্টি-- মুহুর্তেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এল। সে কি বৃষ্টি।
দাওয়ায় বসে ছিল স্বামী। সে দেখছে বউ আসছে না। সে তো ছোবে না রেশমি কাপড়, তুলবে না সেই কাপড়। কিন্তু এদিকে যে বৃষ্টিতে সব দিক ভেসে যাচ্ছে, উঠোনে জলের ধারা। কাপড় ভিজে চুপসে গিয়েছে তবু তো বউয়ের দেখা নেই! সে উতলা হয়ে উঠল। চিৎকার করে বউকে ডাকতে লাগল। মাটিতে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে, গাছের ডালে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে—চারিদিকে বৃষ্টির একটানা শব্দ। বউ শুনবে কেমন করে? স্বামী আরও উতলা হল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল সে। এবার বউ শুনতে পেয়েছে। স্বামীর এমন উতলা গলা শুনেই বউ রওনা দিল বাড়ির পথে। কিন্তু পাহাড়ি পথ বড় পেছল, সাদা বৃষ্টি, চোখে ভালো ঠাহর হয় না। তাড়াতাড়ি আসবে কেমন করে বউ?
বউ তবু চলে এসেছে উঠোনের খুব কাছে। বৃষ্টিতে স্বামী তাকে দেখতে পেল না। সুন্দর কাপড়টা নষ্ট হয়ে গেল! স্বামী ভুলে গেল নিষেধের কথা, বউয়ের কথা। সে এমন উতলা হয়ে উঠল যে কোন কিছুই তার মনে পড়ল না। দাওয়া থেকে ঝড়ের বেগে নেমে এল উঠোনে। নেমেই স্বামী এক টানে তুলে আনল সেই জাদু রেশমি কাপড়। সে তো মন্ত্রের কথা কিছুই জানে না। কাপড়ে হাত লাগা মাত্র স্বামী পাখি হয়ে গেল। বিরাট পাখি, সুন্দর পাখি, বিচিত্র-রঙা পাখি। পুরুষ পাখি। দেহে রঙের কি বাহার।
উঠোনে পৌঁছল বউ। চমকে উঠল। তার সামনে স্বামী নেই-একটি অতি সুন্দর, বিচিত্র-রঙা বিরাট পাখি। তার দিকে অবাক চোখে পাখি চেয়ে রয়েছে। এ কি হল? মেয়ে ভুলে গেল সবকিছু ভুলে গেল মস্ত্রের কথা। মন্ত্র না পড়েই সে ছুঁয়ে ফেলল জাদু রেশমি কাপড়। কেমন যেন হয়ে গিয়েছে মেয়ে। হায়। হায়! হায়! মেয়ে বলে উঠল, একি করলাম? তুমি একি করলে? আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল। হায়। মেয়েও আর মেয়ে রইল না। সেও হয়ে গেল পাখি। বিরাট পাখি, সুন্দর পাখি, বিচিত্র-রঙা পাখি। দেহের পালকের কি বাহার। সেও পাখি হল, মেয়ে পাখি। এই স্বামী-পাখি আর বউ-পাখিই হল ময়ূর-ময়ূরী। তারা আর মানুষ রইল না। কিন্তু একদিন তারা স্বামী ছিল, বউ ছিল। বড় সুখের সংসার। ময়ূরের দেহের পালক, পুচ্ছ, ডানা বেশি রাঙানো, বেশি চিত্রবিচিত্র, বেশি সুন্দর। কেননা, জাদু রেশমি কাপড়ের বেশি অংশ থেকেই ময়ূরের জন্ম। বউ এসেছিল পরে, তাই ময়ূরীর পুচ্ছ ময়ূরের মতো বড় নয়। দেহের রঙের অমন বাহার নেই। হায় ময়ূর! হায় ময়ূরী!
আজও যখন আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে, ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যুৎ চমকায়, কালচে মেঘের আনাগোনায় চারদিক থমথম করে ওঠে, গলা তুলে ডেকে ওঠে ময়ুর-ময়ূরী। ওই বুঝি বৃষ্টি আসছে, ঝমঝম বৃষ্টি ! আর সেই বৃষ্টিতে তাদের দেহের বিচিত্র-রঙা পোশাক যদি নষ্ট হয়ে যায়? তাহলে?
0 coment�rios: