Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

     মানুষ যখন প্রথম এই পৃথিবীতে এল, মানুষ যখন প্রথম জন্মাল,— তখন মানুষ কেমন করে রান্না করতে হয় জানত না, স্নান করতে জানত না, কাপড় পরতে জান...

আগুন - আদিবাসী লোককথা

     মানুষ যখন প্রথম এই পৃথিবীতে এল, মানুষ যখন প্রথম জন্মাল,— তখন মানুষ কেমন করে রান্না করতে হয় জানত না, স্নান করতে জানত না, কাপড় পরতে জানত না।
     দেহে তাদের কোনকিছুই থাকত না। তাদের হাত-পায়ের নখগুলো বিরাট বিরাট হয়ে থাকত, কেননা তারা এগুলো কেমন করে কাটতে হবে তা জানত না। তাদের কোন গ্রাম ছিল না, ঘরদোর ছিল না। পাঁচ-দশজন একসঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত। আর ঘন পাতার গাছের নীচে কিংবা কোন পাহাড়ি গুহায় থাকত।
     সেই সময়ে এক বছর খুব খরা হল, সব বাঁশগাছ শুকিয়ে গেল। বাঁশের সবুজ রঙ পালটে গেল, ছালগুলো আপনিই খসে খসে পড়তে লাগল। সে কি অসহ্য গরম কাল! বৃষ্টি নেই, তার নামগন্ধও নেই। আকাশে মেঘের ছিটেফোটাও দেখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমে শুকনো বাঁশগুলো ফেটে ফেটে যেতে লাগল। প্রচণ্ড বেগে শুকনো হাওয়া বইছে, তোড়ে বাঁশগুলো এধার-ওধার করছে। একটার সঙ্গে আরেকটার ঘর্ষণ হচ্ছে। চারিদিকে বাঁশের ক্যাঁচকোচ শব্দ।
     হঠাৎ বাশে বাঁশে ঘষা লেগে আগুন জ্বলে উঠল। বাঁশগাছ জ্বলছে, অন্য বাঁশগাছে আগুন ছড়াল। বনের সব গাছই শুকনো কাঠের মতো হয়ে রয়েছে। কোন গাছে রস নেই, শুকনো বাকল চড়চড় করছে। তাই বাঁশের আগুন চারিদিকে। দাউ দাউ দাবানল। বন পুড়ল। শেষকালে একদিন আগুন নিভল। তখন বড় বড় নখওয়ালা সেই মানুষেরা বনের মধ্যে ঢুকল। চারিদিকে পোড়া কাঠ, পোড়া পাতার ছাই। আর চারিদিকে অনেক পশু-পাখি ঝলসে-পুড়ে মরে পড়ে রয়েছে। ছাইগাদার মধ্যে তাদের ঝলসানো দেহ।
     একজন মানুষ বলল, ‘এগুলো কি? আগে তো কখনও দেখিনি? সে সাহস করে একটা পশুর দেহে আঙুল ছোয়াল, গরম নরম দেহের মধ্যে নখসমেত তার আঙুল অনায়াসে ঢুকে গেল। আঙুল পুড়ে যাবার মতো অবস্থা। তাড়াতাড়ি আঙুল টেনে বের করে সে ব্যথায় লাফাতে লাগল। আঙুল যেন নিজে নিজেই তার মুখের ভেতর চলে গেল। আঃ। কি সুন্দর ঠান্ডা। মুখে কেমন স্বাদ লাগছে। এ স্বাদ সে তো কখনও আগে পায়নি! আঙুলটা নিয়ে নাকের কাছে ধরল। কি মিষ্টি গন্ধ ! এ গন্ধ তো আগে কখনও পায়নি।
     আপনমনে মানুষটি বলল, “এ তো সুন্দর খেতে। গন্ধও বড় ভালো। আগের মতো নয়।
    সে অন্য বন্ধুদের ডাকল। সে যা জেনেছে তা সবাইকে বলল। সবাই অবাক হল। তারপরে সবাই মিলে ঝলসানো পশুর মাংস খেতে শুরু করল। অগুনতি পশু, অল্প মানুষ। সে এক মহাভোজ। সে এক নতুন আনন্দ।
      পরের দিন তারা শিকার করতে গেল। অনেক কষ্টের পরে একটা খরগোশ মারতে পারল। আগে হলে তখনই ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে খেতে শুরু করত। কিন্তু গতদিনের মাংস খাওয়ার পরে আর কাঁচা মাংস খেতে চাইল না। তারা খরগোশটাকে ঝলসানোর চেষ্টা করল। দেখাই যাক না কি হয়।
     তারা খরগোশকে একটা গাছের বাকলের সঙ্গে বাঁধল। সেটা ঝুলিয়ে দিল গাছের একটা নিচু ডালের সঙ্গে। বনে তখনও গাছের অনেক ডাল ধিকিধিকি জ্বলছিল। তারই একটা নিয়ে এসে ঝুলন্ত পশুটার নীচে রাখল। শুকনো পাতা নিয়ে এসে জ্বলন্ত কাঠের ওপরে দিল। দাউ দাউ করে পাতাগুলো জ্বলে উঠল। বাকল পুড়ে গেল, খরগোশটা ধপ করে আগুনের ওপর পড়ে গেল। আগুন গেল নিভে। তাকিয়ে দেখে, খরগোশের চামড়ার ওপরের লোমগুলো পুড়ে গিয়েছে, কিন্তু দেহের মাংস একই রকম রয়েছে। খুব খিদে–কি আর করে? সেই মাংসই তারা খেয়ে নিল।
     পরের দিন সেই মানুষগুলো আবার শিকার করতে গেল। অনেক কষ্টে একটা হরিণ মারল। বেশ বড় হরিণ। প্রথমেই তারা পশুটার চামড়া ছাড়িয়ে ফেলল। তারপরে মাংসকে টুকরো টুকরো করে কাটল। তারপরে হরিণের চামড়ায় মাংসের টুকরোগুলোকে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। তলায় জ্বালল আগুন। অনেকক্ষণ পুড়ল। শেষকালে চামড়া খুলে মাংসের টুকরো মুখে দিল। বাঃ, চমৎকার লাগছে। বেশ হয়েছে। দলের সবাই খুব খুশি হল। এবার বুঝেছে ব্যাপারটা।
     বুড়ো-মতন একজন বুঝল, তারা তো আগুন জ্বালাতে জানে না। আগুন নিভে গেলে কি হবে? তাই বন থেকে জ্বলন্ত একটা কাঠ এনে একটা গর্তের মধ্যে রেখে দিল। আর তাতে সব সময় শুকনো কাঠ দিতে লাগল। বনের আগুন এখন তাদের নিজের হল। আগুন আছে সবসময়, তাই আর কাঁচা মাংস খেতে হচ্ছে না।
     কিন্তু সেই লোকগুলোর কোন পাত্র ছিল না। তাই তারা পাত্রের মধ্যে মাংস চড়িয়ে রান্না করতে পারত না কিংবা পাত্রের মধ্যে জল ঢেলে ফুটন্ত জলে কোন কিছু সেদ্ধ করতে পারত না। রান্নার ব্যাপারে চামড়াই একমাত্র সম্বল।
     তারা যাযাবর। এখানে-ওখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। অনেক কিছু দেখে। অনেক নতুন কিছু শেখে। জানার আগ্রহও বেড়েছে।
     বর্ষাকাল। ওপর থেকে বৃষ্টি পড়ে। নীচে কাদামাটি। তারা পথ চলে। পায়ের গোড়ালি ডুবে যায় কাদায়। আঙুলের ফাঁকে আঁটকে থাকে কাদা। একদিন তারা দেখল, পায়ের আঙুলের কাদা শুকিযে গিয়েছে, আঙুলে ভালোভাবে আটকে গিয়েছে। গুহায় ফিরে এল। বেশ শীত শীত করছে। আগুনের পাশে বসে হাত-পা গরম করে নিচ্ছে। আরে! একি! আগুনের তাপ লেগে পায়ের আঙুলের মধ্যে জমে-থাকা কাদাগুলো যে আরও শক্ত হয়ে গেল। আশ্চর্য! হাত দিয়ে কাদা ভাঙতে লাগল।
     এক বুড়ো একদিন আগুন পোয়াচ্ছে আর বনের দিকে চেয়ে আছে। হঠাৎ সে ভাবল, "আচ্ছা, আগুনের তাপ লেগে আঙুলের কাদা যদি এমন শক্ত হয়ে যায়, তাহলে কাদা দিয়ে তো বেশ পাত্র তৈরি করা যায়। দেখাই যাক না।
     সে ভিজে ভিজে কাদা তুলে আনল গর্ত থেকে। তাই দিয়ে তৈরি করল একটা পাত্র। বেশ কয়েকদিন সেই পাত্রকে খোলা আকাশের নীচে রেখে দিল। সূর্যের তাপ পেয়ে পাত্রটি শুকিয়ে উঠল। বেশ শক্ত-পোক্ত হয়েছে।
      একদিন পশুশিকার করে এনে সে মাংসকে টুকরো টুকরো করল। পাত্রের মধ্যে অনেকটা জল ঢেলে চাপিয়ে দিল উনুনে। মাংসের টুকরোগুলো ফেলে দিল পাত্রের জলে। তিনটে পাথর দিয়ে সে উনুন তৈরি করেছিল। হঠাৎ পাত্র ফেটে গেল, সে চমকে উঠল। পাত্রের জল ও মাংস উনুনে পড়ল। আগুন নিভে গেল। বুড়ো ভাবনায় পড়ল। পাত্র তো বেশ শক্তই হয়েছিল। তবে? তবে এমন হল কেন? এত কষ্ট করলাম, শেষে ফেটে গেল? আগুন নিভে গেল?
     বুড়ো আবার ভাবতে বসল। ভাবল, সূর্যের তাপ তেমন নয়, ওতে পাত্র শক্ত হবে না। যদি আগুন দিয়েই, আগুন জ্বালিয়েই রান্না করতে হয়—তবে আগুন দিয়েই পাত্র তৈরি করতে হবে। আগুনের জিনিস আগুনেই তৈরি করতে হবে।      বুড়ো অনেক ভাবল ।
   এবার বুড়ো আবার ভিজে ভিজে মাটি দিয়ে মস্ত এক পাত্র তৈরি করল। সেই পাত্র একটু শুকিয়ে এলে তাকে আগুনে দিল। ভালোভাবে পোড়াল। পাত্র কালো হয়ে এল। বেশ শক্ত। আঙুল দিলে কেমন টঙ টঙ আওয়াজ হচ্ছে। বুড়ো খুশি।
বুড়ো গেল শিকার করতে। অনেক কষ্টে পেল একটা পশু। তার মাংস টুকরো টুকরো করে পাত্রের জলে ছেড়ে দিল। দাউ দাউ করে উনুন জ্বলছে, টগবগ করে জল ফুটছে। পাত্র ঠিক রয়েছে, ফাটছে না, ভাঙছে না। সুন্দর সেদ্ধ হল মাংস। আঃ, কি আনন্দ! আগুন আছে, বনের পশু আছে—আর এবার তৈরি হল শক্ত পাত্র। আগুনে দিলে এ পাত্র ফাটে না, ভাঙে না। আঃ, কি সুন্দর স্বাদ এই মাংসের !
     সেই তখন থেকে মানুষ শক্ত পাত্র তৈরি করতে শিখল। সেই তখন থেকে আগুন দিয়ে রান্না করতে শিখল।

0 coment�rios: