কি সুন্দর আমাদের লুসাই পাহাড়! কি সুন্দর! আর সুন্দর পাহাড়ের কোলে কোলে আমাদের ছোট ছোট গ্রাম। কি সুন্দর!
তখন তো অন্যরকম ছিল। সেই সময় এইসব গায়ে লুসাই কবি আর চারণেরা কত গান গাইতেন। মন ভরে যেত। সেসব মনমাতানো গান পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হত। সবাই মুগ্ধ হত। আবাক হত। সেদিন কোন মানুষ তখনও এখানে আসে নি। কোন সাদা মানুষও সেদিন এখানে আসেনি। এরাও নিজের এলাকা ছেড়ে কোথাও যেত না। নাড়ির টানে আটকে থাকত। সে কি কম কথা! বাঁধন-হারা লুসাই গান আর পাহাড়ের প্রকৃতি, ঝরনার গান আর সবুজ বনভূমি—কোথায় হারিয়ে গেল সেসব।
অনেক অনেক চারণ-কবির কথা আমরা জানি। তাদের ভুলিনি। তবু এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম ছিল পিহমুয়াকির। পিহমুয়াকিকে কেউ কোনদিন ভুলবে না। তার গলা ছিল বুলবুলির মতো মিষ্টি, ঝরনার মতো মধুঢ়ালা।ছোট মেয়ে পিহমুয়াকি। ছোট হলে কি হবে, সবসময় সে গল্প শুনতে ভালোবাসত। বনের পশুর গল্প, মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প, নানান দেশের গল্প, পুরাকালের গল্প কিংবদন্তি,—দাদু-ঠাকুমারা যে গল্প বলে তাই সে শোনে। এসব গল্প সেই কোন ভুলেযাওয়া কাল থেকে দাদু-দিদিমা-ঠাকুমারা শুনিয়েছে তাদের নাতি-নাতনিদের, বাবারা শুনিয়েছে ছেলেদের, মায়েরা শুনিয়েছে মেয়েদের। এমনি করে ডালে ডালে পাতায় পাতায় গল্প বয়ে এসেছে। সেসব কি ভোলা যায়? আর আছে গান। কত উৎসবে, কত পুজোতে এসব গান গাওয়া হত। ভোজের আসরেও গান গাওয়া হত। এই গান এখন আর তেমন শোনা যায় না।
এই গল্পের আসরে, গানের উৎসবে পিহমুয়াকি থাকবেই। গান শোনার বড় লোভ তার, এসব জায়গায় ছোট্ট মেয়েটি যাবেই যাবে। বছরের অনেক সময় বড় কষ্টে কাটে। কত অভাব, কত দুঃখ। বহু পরিশ্রমেও পেটের দানা জোটে না। কিন্তু সেই সময়? যখন খেতের ফসল ঘরে ওঠে, যখন খামার-গোলা ভরে যায়,—তখন তো কিছুদিনের জন্য আর কোন ভাবনা নেই। তখন আর পরের দিনগুলোর কথা কেই-বা-ভাবে। ভেবেই বা কি হবে? এ ভাবেই তো চলছে চিরকাল। প্রাণ খুলে তখন শুধুই গান গাওয়া, মন খুলে গল্প বলা। কি আনন্দের সেসব দিন।
অন্য মেয়েরা গাঁয়ের পথে খেলে বেড়ায়, ছেলেরা বনে যায় কাঠ কুড়োতে। সেই কাঠে সর্দারের বাড়িতে ভোজের আসর বসবে। পিহমুয়াকির কিন্তু এসব ভালো লাগে না। সে খেলে না, দূরে কোথাও যায় না। সে অন্যরকম। বুড়োবুড়িরা গান গাইতে শুরু করলেই সে ছুটে আসে, শান্ত হয়ে পাশে বসে পড়ে, ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে—গান শোনে।
অনেক সময় ধরে তারা গান গায়, ছোট মেয়ে চুপ করে সেসব শোনে। ক্লান্তি নেই।
পিহমুয়াকি যে গান শোনে, যে গল্প শোনে তাই তার স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে যায়। কিছুই সে ভোলে না, ভুলতে চায়ও না। ও যে তার প্রাণের জিনিস। কত ছোট সে, কিন্তু সে যত গান শিখেছে, সে যত গল্প জেনেছে—এলাকার কেউ তা জানে না। ছোটরাও জানে না, বড়রাও জানে না। শুধু জানত গায়ের কয়েকজন বুড়ো-বুড়ি। তাদের অনেক বয়স হয়েছে। তারা অনেক দেখেছে, অনেক শুনেছে—তারা তো অনেক কিছুই জানে।
পিহমুয়াকি তো আর চিরকাল ছোটটি থাকবে না। দেখতে দেখতে সেও বড় হল, কৈশোর পেরিয়ে সে যুবতী হল। অপূর্ব তার রুপ, অপরুপ তার লাবণ্য। বড় হল কিন্তু ছেলেবেলার স্বভাব তার বদলে গেল না। স্বভাব একই রকম রইল। ছেলেবেলা থেকে সে অনেক গান শিখেছিল, অনেক অনেক কাল আগেকার চারণ-কবিদের বিষয়ে সে সব কিছু জানত। তার রক্তে ছিল গান, মনে-প্রাণে সেও চারণ-কবি, সে আপনভোলা গায়িকা। তাই বড় হয়েও সে আপনমনে গান গেয়ে বেড়াত-পাহাড়ে, নদীর তীরে, ঝরনার পাশে, গাঁয়ের পাহাড়ি পথে পথে। আপন খেয়ালে মনের আনন্দে সে গান গাইত, যেমন গায় বনের পাখি।
অনেক গান সে শিখেছে। এবার নিজেই গান বাঁধতে শুরু করল। মনমাতানো সুরের সেসব গান যেন তার কন্ঠ থেকে আপনিই বেরিয়ে আসছে। সহজ সুরের সহজ গান। বাঁধন-হারা সেসব গান শুনলে মন যেন কেমন করত।
মাঠের পথে যেতে যেতে সে গান গাইত। বীজ বুনতে বুনতে নত হয়েও সে গান গাইত। ঝমঝম বৃষ্টির দিনে ধানগাছের গোড়া থেকে আগাছা তুলতে তুলতে সে গান গাইত, ফসলের গোছা মুঠোয় ধরে কাটতে কাটতে সে গান গাইত। সে বাড়িতেই থাকুক আর আকাশের নীচে খোলা মাঠেই থাকুক,—সে থাকত মনের আনন্দে, সে গাইত গান। এমন গান কবে কে শুনছে? অনেকেই তার কাছে গান শিখত। মনপ্রাণ ঢেলে সে গান শেখাত। তার শেখানো গান তার মিষ্টি সুরের গান এক কষ্ঠ থেকে অন্য কষ্ঠে বইতে বইতে সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। দেশের সবাই গান গাইতে ভালোবাসত। সেই গান তারা গাইত। সে গান তারা শিখেছে বুলবুলি পিহমুয়াকির কণ্ঠ থেকে।
এমনি করে সময় বয়ে যায়। সবার মুখে পিহমুয়াকির নাম, সবার কণ্ঠে পিহমুয়াকির গান, সবার হুদয়ে বুলবুলি পিহমুয়াকি।
কিন্তু এবার বিপদ ঘনিয়ে এল। মানুষের হিংসুটে স্বভাব এই বিপদ ডেকে আনল। সেই গাঁয়ের যে সর্দার, তার দেহে অসীম শক্তি, সে আগলে রাখে গোটা গোষ্ঠীকে। নির্ভীক সর্দারের দেহে যত শক্তি ছিল, বুদ্ধি তেমন ছিল না। তার ওপরে সে ছিল কিছুটা কান পাতলা। বিচারবুদ্ধি না থাকলে লোক তো অন্যের কথাতেই বেশি বিশ্বাস করে। হলও তাই।
সর্দারকে ঘিরে ছিল কয়েকজন গাঁওবুড়ো। তারাই সব কিছু পরামর্শ দিত সর্দারকে। চারিদিকে পিহমুয়াকির নাম। যেখানেই উৎসব হয়, নৃত্য-গীত হয় সেখানেই পিহমুয়াকির নাম। এতদিন সবাই সব কথায় সর্দার আর গাঁওবুড়োদের কথা বলত। এখন বলে অন্যের কথা। তার ধন-সম্পদ নেই, তার অনেক গোরু-মোষ-মিথুন নেই, তার বাড়ি বড় নয়—কি আছে তার যে সবাই তার নাম করবে! ঈর্ষা দেখা দিল সর্দারের মনে, ঈর্ষা দেখা দিল গাঁওবুড়োদের মনে। গাঁওবুড়োরা সর্দারের মনে আরও হিংসা জাগিয়ে তুলল।
সর্দার হল গ্রামের মাথা, আপদে-বিপদে সেই তো রক্ষা করে গাঁয়ের মানুষকে, সেই তো অসময়ে ধান দিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কি করেছে পিহমুয়াকি গাঁয়ের জন্য? বোকা সর্দার উত্তেজিত হয়, গাঁওবুড়োরা.মস্ত উনুনে কাঠ জুগিয়ে চলে। আগুন বেড়েই চলে।
কিছুদিনের মধ্যেই সর্দারের মনে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। পাহাড়ি বনভূমিতে দাবানল লাগল। গাঁওবুড়োদের সর্দার ডাকল, সর্দারের বাড়িতে গোপনে সলাপরামর্শ করল। সবাই একমত হল,— এমন পাকা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে আর কোনদিন পিহমুয়াকি তাদের বিরক্ত করতে না পারে। তার কণ্ঠই সব অনিষ্টের মূল, সেই গানকে চিরকালের জন্য থামিয়ে দিতে হবে। তারা বড় নিষ্ঠুর। হিংসা তাদের পশুর অধম করে তুলেছে। তারা সব কিছু ঠিক করে ফেলল।
পরের দিন সকাল বেলায় তারা গায়ের মধ্যে মস্ত বড় এক গর্ত তৈরি করল। পিহমুয়াকি তখন এলোচুলে তার ছোট্ট বাছুরকে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছিল আর আদরের গান গাইছিল। বাছুর গলা লম্বা করে বিশাল চোখ মেলে পিহমুয়াকির গান শুনছিল। আশেপাশে পাখিরাও গান গাইছিল। হঠাৎ কয়েকজন গাঁওবুড়ো সেখানে এসে কিচির-মিচির শুরু করে দিল। পিহমুয়াকি তখন অনেক দূরে চলে গিয়েছে।
তারা তাকে গর্তের কাছে এনে ঠেলে ফেলে দিল গর্তের মধ্যে। গর্ত অনেক গভীর।
তারা যখন টেনে আনছিল তখনও সে গান গাইছে, গর্তের মুখে যখন মাটি চাপা দিচ্ছে তখনও সে গান গাইছে। মাটি পড়ছে, পাথর পড়ছে, গাছের ডাল পড়ছে—বুলবুলি পিহমুয়াকি গাইছে। গাইছে আদরের গান, প্রাণের গান। গর্ত ভর্তি হয়ে আসছে, গানও ভেসে আসছে।
শেষকালে গর্ত ভরে গেল। সর্দার আর গাঁওবুড়োরা ভাবল,—যাক সব চুকেবুকে গেল। আর ভাবনা নেই। গান থেমে গেল চিরকালের মতো। তারা বাড়ির পথে হাটা দিল।
কিন্তু, না, গান থামল না। তখনও মাটির তলা থেকে মিষ্টি গান ভেসে আসছে, ছড়িয়ে পড়ছে উদার আকাশে, সবুজ বনভূমিতে। এ গান আগের চেয়ে মিষ্টি আরও মিষ্টি।
নিষ্ঠুর মানুষেরা তার দেহকে চিরদিনের জন্য মাটি চাপা দিয়ে দিল, কিন্তু গান বন্ধ করতে পারল না। সে গান ভেসে বেড়াতে লাগল দূর থেকে দূরান্তে।
সেই কবেকার কথা। আজও লুসাইরা সবাই পিহমুযাকির কথা বলে, বলে তার গানের কথা। গান হল ফুলের মতো—ফুলকে মাটিতে মিশিয়ে দিলেও তার বীজ নতুনভাবে সুন্দর হয়ে আগামী দিনে আবার ফুল ফোটাবে। পিহমুয়াকির গানও বেঁচে রইল,—সে যে মানুষের জন্যই গান গাইত। আহ পিহমুয়াকি।
0 coment�rios: