পাহাড়ি ঘন এক জঙ্গলের পাশে ছিল এক গ্রাম। আর সেই গ্রামে থাকত একটা লোক। সে খুব গরিব। তার চেয়ে গরিব আর কেউ সেই গ্রামে ছিল না। তার কোনো জমিজিরেত ছিল না, লাঙল ছিল না, ছিল না একটাও হেলে বলদ। এমন মানুষ গায়ে দুটি নেই ; তবে তার ছিল এক জোড়া ছাগল। এই তার একমাত্র সম্পদ।
এমনি করে দিন যায়। কিন্তু দিন তো আর কাটে না। কত সহ্য করবে সে। শেষকালে সে মন ঠিক করে ফেলল,— আর নয়, এই এক জোড়া ছাগল দিয়েই চাষ করব। দেখি না কি হয়।
লোকটা ছিল একগুঁয়ে। লেগে গেল কাজে। সে বন থেকে গাছের ডাল কেটে আনল। তাই দিয়ে ছোট্ট একটা লাঙল তৈরি করল। বড় লাঙলে কাজ হবে না। ছাগলদের মাপে ছোট লাঙল তৈরি করল। ছাগল দুটাের ঘাড়ে জুড়ে দিল লাঙল। তারপর চলল জমিতে। তার নিজের কোন জমি নেই। কিন্তু চাষ তাকে করতেই হবে। দূরে উঁচু ডাঙায় রয়েছে জমি। কাঁকুরে মাটি, কেউ কোনকালে সেখানে চাষ করে না। কেননা করেও লাভ নেই, ফসল ফলবে না। সে জমির দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। সে জমি কারও নয়। ছাগল লাঙল নিয়ে লোকটি গেল সেই কাঁকুরে ডাঙা জমিতে। শুরু করল লাঙল চালাতে। বড় পরিশ্রম, ঘাম ঝরছে দেহে, শক্ত মাটি। তবু সে হাল ছাড়ল না। শেষকালে জমি চাষ করা হয়ে গেল।
কিন্তু জমিতে বুনবে কি? তার তো বীজধান নেই। শস্য তো বুনতে হবে। সে গেল এক পড়শির কাছে। ধার চাইল কিছুটা বীজধান। পড়শি হাসল, ফিরিয়ে দিল তাকে। বীজধান নিলে শোধ করবে কেমন করে? ওই জমিতে ফসল ফলবে?
ফিরে এল লোকটি। দুঃখ পেল, হাল ছাড়ল না। আরও কয়েকজন পড়শির কাছে ধার চাইল বীজধান। সবাই ফিরিয়ে দিল। সবার মুখেই এক কথা।
এবার লোকটি গেল আর এক পড়শির কাছে। না, ধার চাইতে নয়। ভিক্ষে চাইতে। তার বীজধান ভিক্ষে চাই না, ধানের অল্প তুষ হলেই চলবে। তুষ ভিক্ষে? সঙ্গে সঙ্গে পড়শি রাজি। ধানের তুষ তাকে দিল। সে ফিরে এল জমিতে।
ধানের তুষে বীজ নেই। ভেতরে চাল নেই। নাই-বা থাকুক। পরম যত্নে আদর করে সে তাই বুনে দিল জমিতে। এমনভাবে বুনছে যেন মনে হল সে বীজধানই বুনছে। সকাল হলেই সে চলে যায় জমিতে। সারাদিন বসে থাকে গাছের নীচে।
অবাক কাণ্ড। কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু সত্যি তাই ঘটল। সবুজ লকলকে চারা বেরুল তুষ থেকে। কচি কচি চারা, হাওয়ায় দুলছে। লোকটির চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ। চারা বড় হচ্ছে, আরও বড়, আর লকলকে। একদিন তাতে ধান হল, গাছভর্তি ধান। এত ধান আর কারও জমিতে কোনদিন ফলেনি। ধানের ভারে গাছ নুয়ে পড়ছে।
সারাদিন ধরে লোকটি নিজের ফসল দেখাশোনা করে। রাতে অল্পক্ষণের জন্য বাড়িতে যায়। ধান পেকে এল। আর দু-চার দিনের মধ্যেই ফসল কাটার সময় আসবে।
সেই সকালেও সে তাড়াতাড়ি চলল জমিতে। মনে ফুর্তি। এ কি সর্বনাশ ! দূর থেকেই সে দেখতে পেল, জমি কেমন ফাঁকা ফাঁকা। দৌড়ে এল। জমির কাছে এসে দুঃখে মাথায় হাত দিয়ে লোকটি বসে পড়ল। তার সব ধান গাছ দলে পিষে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পাশের পাহাড়ি ঘন বন থেকে এক পাল বুনো মোষ রাতে এসেছিল। যতটা পারে ধান গাছ খেয়েছে, আর তাদের পায়ের চাপে দেহের চাপে সব ধান গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ বসে রইল সে। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার জমির দিকে।
আর তো কিছুই নেই। সব গেল। কি হবে এই গায়ে থেকে? তার চেয়ে মোষগুলোর পেছন ধাওয়া করাই ভালো। জঙ্গলে ওদের হদিস ঠিক পাওয়া যাবে। সে চলল পাহাড়ি ঘন জঙ্গলের পথে। বুনো মোষের পাল কোনদিকে গিয়েছে তা খুঁজে বের করা মোটেই কঠিন হল না। শত শত খুরের চিহ্ন সারা পথে-মাঠে ছড়ানো। খুরের চিহ্ন-দেওয়া পথ দিয়ে সে এগোতে লাগল। মাঠ ছাড়িয়ে বনে ঢুকল। আরও গভীর বনে। শেষকালে বনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌছল। চারিদিকে শাল-মহুয়ার গাছ, মাঝখানে অনেকটা জায়গা। সেখানে বুনো মোষের পাল রাতে ঘুমোয়। সুন্দর জায়গা, আকাশ ফাঁকা, চারিদিকে ঘেরা। সেখানেই ঘুমিয়ে থাকে বুনো মোষের পাল। এরাই তার জমির ধান দলে-পিষে নষ্ট করে এসেছে।
একটা গাছের নীচে অনেকক্ষণ লোকটি বসে রইল। বড় বিশ্রি গন্ধ বেরুচ্ছে। জায়গাটা বড় অপরিষ্কার। রাতের ফেলে-রাখা দলাদলা গোবর। মোষেরা তার ওপরেই শুয়ে থাকে। লোকটিরও কোন কাজ নেই। বড় একঘেয়ে লাগছে। উঠে পড়ল সে। গাছের লম্বা লম্বা কয়েকটা ডাল ভাঙল। একসঙ্গে করে লম্বা ঝাঁটার মতো তৈরি করল। আর অপরিষ্কার খোলা জায়গাটিকে ঝাঁট দিতে লাগল। অনেক দিনের নোংরা। বাঃ ! বেশ সুন্দর লাগছে। কি পরিষ্কার !
একটা গাছের নীচে সূর্য ডুবে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। অন্ধকার চারিদিকে। এমন সময় লোকটি বহু খুরের আওয়াজ পেল। বুঝল, বুনো মোষের পাল ফিরে আসছে। সে তাড়াতাড়ি একটা শুকনো শাল গাছের কোটরের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। বুনো মোষের পাল তাদের পরিচিত ফাঁকা জায়গায় এসে অবাক হল। আঃ! কি পরিষ্কার ! শোবার মতো জায়গাই বটে। তারা অবাক হল, খুশিও হল। কিন্তু ভেবে পেল না, কে তাদের জন্য এমন সুন্দরভাবে জায়গাটা পরিষ্কার করে রেখেছে। ঘুমিয়ে পড়ল তারা। বড় ক্লান্ত।
পরের দিন ভোর বেলা দূর বনে-মাঠে যাওয়ার সময় মোষেরা এধার-ওধার তাকিয়ে দেখল। তারপরে পাল বেঁধে মিলিয়ে গেল ঘন বনের মধ্যে।
লোকটি তো সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। সে বেরিয়ে এল গাছের কোটর থেকে। আবার ঝাঁটা দিয়ে তাদের ঘুমিয়ে থাকার জায়গাটি পরিপাটি করে পরিষ্কার করে রাখল। খুব যত্ন করে অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁট দিল। তারপরে গাছের নীচে ছায়ায় বসে বিশ্রাম করতে লাগল।
সন্ধ্যার পরে ফিরে এসে মোষের পাল আবার অবাক হল। সেই একই কাণ্ড। এদিন জায়গাটি যেন আরও ঝকঝকে তকতকে লাগছে। কে করছে এমন উপকার? সে রাতে তারা ঠিক করল, পরের দিন একজনকে এখানে রেখে যেতে হবে। সে নজর রাখবে কে এমন উপকার করছে।
পরের দিন ভোরবেলা মাঠে-বনে চরতে যাওয়ার সময় তারা একটা মোষকে সেখানে রেখে গেল। সে ছিল খোড়া। সবাই চলে গেল। সে রইল খোলা জায়গায়। দুপুর হল। ওপর থেকে আগুন ঝরছে। কোন কাজ নেই। ক্লান্ত হয়ে খোড়া মোষটা গাছের নীচে বসে পড়ল। ঘাড়টা বেঁকিয়ে পায়ের ওপরে রাখল। চোখ আপনিই বন্ধ হয়ে এল। সে ঘুমিয়ে পড়ল।
লোকটি সব দেখছে। বেরিয়ে এল গাছের কোটর থেকে। হাতে ডালের ঝাঁটা নিয়ে খুব আস্তে আস্তে ঝাঁট দিতে লাগল। কোন শব্দ না করে। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে আবার লুকিয়ে পড়ল কোটরে। মোষটা তখনও ঘুমোচ্ছে।
মোষরা ফিরে এল। এবার আরও অবাক হল। কেননা, খোড়া মোষটা কাউকেই দেখেনি। অথচ খোলা জায়গাটি তেমনি পরিষ্কার। এবার তারা আর একটা মোষকে ঠিক করল। সে অন্ধ। কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু অন্ধ বলেই তার কান অন্যদের চেয়ে বেশি সজাগ। অল্প শব্দ হলেও সে ঠিক টের পায়।
অন্ধ মোষ দুপুরে গাছের নীচে শুয়ে রয়েছে। কিন্তু সে ঘুমোবে না। ধরতেই হবে তাকে যে এমন উপকার করছে। চোখ বন্ধ করে সে শুয়ে রইল।
লোকটি সব দেখছে। সে বেরিয়ে এল গাছের কোটর থেকে। ডালের ঝাঁটা তুলে নিল হাতে। কান খাড়া করে রইল মোষ। সে সব বুঝতে পারছে। ঝাঁট দেওয়া শেষ হল। লোকটির চলার শব্দ হচ্ছে মাটিতে। এক জায়গায় গিয়ে শব্দ থেমে গেল। মোষ সব বুঝল।
বুনো মোষের পাল ফিরে এল। অন্ধ মোষ সব বলল। দেখিয়ে দিল লোকটির লুকোনোর জায়গা। মোষেরা কোটরের কাছে গেল। উঁকি মেরে দেখল, ভেতরে বসে রয়েছে তাদের উপকারী বন্ধু। তাকে বাইরে আসতে বলল। লোকটি একটু ভয় পেল।
মোষ সর্দার বলল, “তুমি খুব ভালো লোক। ভয়ের কি আছে? তুমি আমাদের কত উপকার করছ। আমরাও তোমাকে দেখব। তোমার সব দায়িত্ব আমরা নিলাম। তুমি আমাদের মধ্যেই থাকবে । রাজি তো?
লোকটির জমি-জিরেত নেই, সংসার নেই, বউ-ছেলেমেয়ে কেউ নেই। গরিব বলে পড়শিরাও তেমন খোঁজ নেয় না। সে যাবেই বা কোথায়? সে রাজি। বুনো মোষের পালের সঙ্গেই সে থাকবে। সে রাজি। মোষের পাল খুশি হল। মোষের পাল তার দেখাশোনা করবে, আর সে মোষের পালের ঘুমোবার জায়গা পরিষ্কার করবে। এমনি করে দিন কাটে।
একদিন বনের পথ দিয়ে কয়েকজন পথিক চলেছিল। তাদের সঙ্গে অনেক অনেক জিনিসপত্র। মোষের পাল তৈরি ছিল। শিং বাগিয়ে তেড়ে গেল। বুনো মোষের পাল দেখে পথিকরা যে যার জিনিসপত্র ফেলে পালিয়ে গেল। সব জিনিস শিঙে তুলে নিয়ে চলে এল সেই ফাঁকা জায়গায়। লোকটিকে দিল। জামা-কাপড়-চিরুনি,—অনেক কিছু। লোকটির আর কোন অভাব থাকল না। এরকম মাঝে-মধ্যেই ঘটে। পথিক সে পথে গেলেই মোষের পাল শিং বাগিয়ে তেড়ে যায়। তারাও প্রাণ নিয়ে পালায়। ফেলে যায় তাদের জিনিসপত্র। শিঙে তুলে মোষেরা সেগুলো আনে লোকটির কাছে। বেশ সুখে দিন কাটছে ।
সারা দিন লোকটি একা থাকে। কোথায় কি বিপদ ঘটে তার ঠিক নেই। মোষের পাল তাই চিন্তিত। শেষে একদিন মোষ সদার লোকটিকে দুটাে শিং দিয়ে বলল, “বন্ধু তুমি একা একা থাকো। কোথায় কি বিপদ ঘটে কে জানে। কোন বিপদ ঘটলেই তুমি এই শিঙের শিঙা বাজাবে, আমরা যেখানেই থাকি না কেন তোমার কাছে ছুটে আসব। কোন বিপদ তোমার হতে দেব না। কেউ তোমার কিছু করবে তা আমরা সহ্য করব না। তুমি যে আমাদের বন্ধু?
লোকটি মোষের শিঙের শিঙা সবসময় নিজের কাছে রাখে। বন্ধুর দান। একদিন লোকটি পাহাড়ি নদীতে স্নান করছে। ঘাসের ওপরে শিংদুটাে রেখে দিয়েছে। এমন সময় কয়েকটা কাক ঠোঁটে করে তার শিঙা নিয়ে উড়ে কোথায় পালিয়ে গেল। জল থেকে তাড়াতাড়ি সে উঠে এল, ধাওয়া করল কিছুটা পথ। কিন্তু পাখিদের আর দেখা গেল না। তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু এই হারিয়ে যাওয়ার কথা সে আর মোষেদের বলল না। লজা পেল।
আর একদিন স্নান করতে গিয়েছে পাহাড়ি নদীতে। স্নান সেরে নদীর পারে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে, কতদিন চুল কাটা হয়নি। বিরাট লম্বা হয়েছে। মাথা থেকে নেমে চুল হাঁটুর কাছে এসেছে। আঁচড়াতে আঁচড়াতে একটা চুল গোড়া থেকে উপড়ে এল। পাশে পড়ে ছিল একটা লোয়া ফল। সে ফলটাকে দুভাগ করে তার মধ্যে চুলটাকে জড়িয়ে ঢুকিয়ে দিল। আবার লোয়া ফলটিকে বন্ধ করে আপন খেয়ালে ফেলে দিল নদীর জলে। লোয়া ফল ভাসতে ভাসতে স্রোতের টানে অনেক দূর চলে গেল। সে তাকিয়ে রইল। আরও দূরে। এখন আর ফলটিকে দেখা যাচ্ছে না। সে ফিরে এল মোষেদের আস্তানায়। এখন হয়েছে কি, ফল ভাসছে, ভাসছে। ভাসতে ভাসতে অনেক দূর চলে গিয়েছে। নদীর এক জায়গায় স্নান করছিল সেই গাঁয়ের সর্দারের মেয়ে। লোয়া ফল মেয়ের পাশ দিয়ে যেতেই সে সেটাকে ধরে ফেলল। ফাঁক করল। ভেতরে দেখতে পেল লম্বা চুল। তাড়াতাড়ি চলে এল বাবার কাছে। মেয়ে বলল, “এই লম্বা চুল যে মানুষটির, আমি তাকেই বিয়ে করব। আর কাউকে নয়।
সর্দার বিরাট ধনী মানুষ। বিরাট বাড়িঘর, মস্ত গা। আর ওই একমাত্র মেয়ে। কত ভালো বর জুটবে মেয়ের। সবই তো পাবে ওই মেয়ে আর জামাই। এখন কোথাকার কে তার ঠিক নেই, তার সঙ্গে এমন মেয়ের বিয়ে? কিন্তু মেয়ের প্রতিজ্ঞা, মেয়ে নাছোরবান্দা। সে ওই লম্বা চুলের মানুষটিকেই বিয়ে করবে। বড় আদুরে মেয়ে। কি আর করবে বাবা! নদীর উজান পথে লোক পাঠাল। অনেকে চলল মেয়ের বরের খোঁজে।
খুঁজতে খুঁজতে একজন মোষের পালের আস্তানায় তার দেখা পেল। হ্যাঁ, এই সেই লোক। চুল দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাকে নিয়ে এল সর্দারের গাঁয়ে। সর্দারের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হবে।
খুব খাওয়া-দাওয়া, হইচই আর ধুমধামের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। সর্দারও কথা দিলেন তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে এই জামাই। সুখে-শাস্তিতে দিন কাটতে লাগল। আর কোন অভাব নেই।
একদিন জামাই ঘেরা উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশেপাশে একটু দূরে কিছু সঙ্গীসাথী। এমন সময় আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল কয়েকটা কাক। হঠাৎ তাদের ঠোঁট থেকে মোষের দুটো শিং তার পায়ের কাছে পড়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি তুলে নিল। হাতে নিয়েই চিনতে পারল। তার হারিয়ে-যাওয়া শিঙের শিঙা। মোষ সর্দার বন্ধুকে দিয়েছিল। আনন্দে মন ভরে গেল।
সে ভালোভাবে দেখছে শিং দুটো। কয়েকজন সঙ্গীসাথী তার কাছে এল। বলল, "এমন করে দেখার কি আছে? ও-তো মোষের শিং।
জামাই হাসল। বলল, ‘হ্যা, তাই বটে। তবে এর অনেক গুণ। আমি যদি এই শিঙা বাজাই, তবে এক মুহুর্তে এই বিরাট গ্রাম মাটিতে মিশে যেতে পারে। তখন আর গ্রাম বলেই চেনা যাবে না।
জামাই কি পাগল? বলে কি? শিঙা বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম মাটিতে মিশে যাবে কেন? তারা ঠাট্টা করতে লাগল। তাই আবার হয় নাকি? ঠাট্টার কথা শুনে জামাই রেগে গেল। বিশ্বাস হচ্ছে না? আবারও ঠাট্টা। এবার ভীষণ রেগে গেল সে। মুখের কাছে শিঙের শিঙা এনে জোরে ফুঁ দিল। বেজে উঠল শিঙা। সবাই চুপচাপ।
হঠাৎ দূর বনের মধ্যে থেকে ভীষণ শব্দ ভেসে এল। মাটিতে দাপাদাপির শব্দ। মাটি কাঁপছে। শব্দ কাছে আসছে, মাটি আরও বেশি কাঁপছে। বনে গাছপালা নড়াচড়া করছে। আরও শব্দ। হঠাৎ বনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল এক পাল কালো মোঘ। এক পাল বুনো মোষ মাথা নিচু করে শত শত বুনো মোষ ধেয়ে আসছে গ্রামের দিকে। যারা দেখছিল তাদের বুক কেঁপে উঠল। হাঁ গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে বটে।
না, কোন অঘটন ঘটল না। গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে গেল না। লোকটি ঝড়ের বেগে ঘেরা-দেওয়া উঠোন থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে খোলা মাঠে। তাকে দেখেই মোষের পাল গতি আস্তে করল। না, বন্ধু অক্ষত আছে। তার কোন বিপদ ঘটেনি। আস্তে আস্তে বন্ধুর সামনে বুনো মোষের পাল দাঁড়িয়ে গেল। মোষ সর্দারের গায়ে হাত রেখে বলল, ‘না আমার কোন বিপদ ঘটেনি। আমি ঠিক আছি। অনেকদিন তোমাদের দেখিনি। তাই। বন্ধুর কথায় মোষের পাল শান্ত হল। যাক, বন্ধু ভালো আছে। তারা বসে পড়ল সেখনে। তখন সর্দারের বাড়ি থেকে সমস্ত খড় দানা শস্য বের করে আনা হল। জামাইয়ের বন্ধু বুনো মোষের পালকে খেতে দিতে হবে। তারা অতিথি। প্রাণভরে তারা খেল। চোঁ চোঁ করে পুকুরের জল খেল। তারা আবার ফিরে চলল পাহাড়ি ঘন বনের দিকে। সবাই চলে গেল দুজন ছাড়া।
দুটি মোষ রয়ে গেল বন্ধুর কাছে। সর্দারের বাড়িতে, গাঁয়ে। এই একজোড়া মোষ আর বনে ফিরে গেল না। তারা হল গৃহপালিত, তারা হল পোষা। তাদের বুনো স্বভাব চলে গেল। আজ যে আমরা ঘরে ঘরে এত পোষা মোষ দেখতে পাই, তারা সবাই ওই একজোড়া মোষের বাচ্চা থেকেই এসেছে। ওদের বাচ্চারাই ঘরে ঘরে পোষা হয়ে রইল। বনে রইল বুনো মোষ, ঘরে রইল পোষা মোষ।
0 coment�rios: