Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

     বহুকাল আগে এক রাজা ছিলেন। তার সব মেয়েরাই সুন্দরী। কিন্তু তাদের মধ্যে ছোটোটির রূপের তুলনা নেই। সূর্য অনেক সুন্দর জিনিস দেখেছে। কিন্তু এ...

ব্যাঙ-রাজা - জার্মানের রূপকথা

     বহুকাল আগে এক রাজা ছিলেন। তার সব মেয়েরাই সুন্দরী। কিন্তু তাদের মধ্যে ছোটোটির রূপের তুলনা নেই। সূর্য অনেক সুন্দর জিনিস দেখেছে। কিন্তু এই ছোটো মেয়েটির দিকে সূর্য যতবার তাকাত ততবারই অবাক হয়ে যেত। রাজার দুর্গের কাছে ছিল বিরাট একটা অন্ধকার বন। সেই বনে বুড়ো একটা লিন্‌ডেন গাছের নীচে ছিল একটা কুয়ো। গরমের দিনে সেই ঠাণ্ডা কুয়োপাড়ে গিয়ে বসত ছোটো রাজকন্যে৷ একঘেয়ে লাগলে সোনার একটা বল শূন্যে ছুড়ে সে লোফালুফি করত। এটাই ছিল তার প্রিয় খেলা।
     একবার হল কি—সেই সোনার বলটা তার হাত ফস্কে মাটির উপর গড়িয়ে গিয়ে পড়ল সেই কুয়োর জলে। তার চোখের সামনে দিয়ে বলটা অদৃশ্য হয়ে গেল। কুয়োটা খুব গভীর। এত গভীর যে তলা দেখা যায় না। রাজকন্যে কাঁদতে শুরু করল। আর তার কান্না ক্রমশই চলল বেড়ে। কিছুতেই আর থামতে পারে না। এমন সময় কে যেন বলে উঠল, “কী হয়েছে রাজকন্যে? তোমার কান্না শুনে যে পাথর গলে যায় ।” স্বরটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্য চারি দিকে সে, তাকাল। তার পর তার চোখে পড়ল একটা ব্যাঙ-জলের উপর তার কুচ্ছিত ফোলা-ফোলা মুখটা ভেসে।
     রাজকন্যে বলল, “কী কাণ্ড ! তুই কথা বলছিস, বুড়ো ব্যাঙ? আমি কাঁদছি আমার সোনার বলটার জন্যে। কুয়োয় সেটা পড়ে গেছে।” 
     ব্যাঙ বলল, “কেঁদো না । আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি। তোমার খেলনাটা এনে দিলে কী দেবে, বল।”
    রাজকন্যে বলল, “যা চাইবে তাই দেব। আমার পোশাক, আমার হীরে-মুক্তো-জহরত, এমন-কি, আমার সোনার মুকুটটাও।”
     ব্যাঙ বলল, “তোমার পোশাক, তোমার হীরে-মুক্তো-জহরত, তোমার সোনার মুকুট-ওগুলোর কোনোটাই চাই না। আমায় যদি ভালোবাসো, তোমার খেলার সঙ্গী করে নাও, খাবার টেবিলে তোমার পাশে বসতে দাও, তোমার ছোটো সোনার প্লেট থেকে খাবার আর ছোটো গেলাস থেকে জল খেতে দাও, তোমার ছোটো বিছানায় শুতে দাও— তা হলে ডুবে গেলে তোমার সোনার বলটা এনে দেব।”
     রাজকন্যে বলল, “বেশ। কথা দিচ্ছি—বলটা এনে দিলে যা চাইবে তাই দেব।” মনে মনে ভাবল, “ব্যাঙটার যত সব হাবিজাবি কথা! ওটা তো শুধু জলে বসে অন্য ব্যাঙদের সঙ্গে মকমক করে ডাকতে পারে। কোনো মানুষের বন্ধু হবে কী করে?”
     রাজকন্যের কথা আদায় করে ব্যাঙটা জলে ডুব দিল আর খানিক পরে বল মুখে নিয়ে ভেসে উঠে সেটা ছুড়ে দিল ঘাসের উপর। প্রিয় খেলনাটা আবার দেখতে পেয়ে বেজায় খুশি হল রাজকন্যে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে সে দৌড়ে চলে গেল।
     ব্যাঙ চেঁচিয়ে উঠল, “থামো ! থামো! আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল। অত জোরে আমি ছুটতে পারি না।”
     কিন্তু তার চেঁচামেচিতে কোনো ফল হল না। রাজকন্যে কানেই তুলল না তার কোনো কথা! এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে সব কথা বেমালুম সে ভুলে গেল ! বেচারা ব্যাঙ কী আর করে–আবার সে তার কুয়োয় গিয়ে নামলে।
     পরের দিন রাজা আর সব সভাসদের সঙ্গে রাজকন্যে খাবার টেবিলের সামনে বসে নিজের ছোটো সোনার প্লেট থেকে সবে খেতে শুরু করেছে এমন সময় শোনা গেল একটা থপথপ্‌ থপ্‌থপ্‌ শব্দ। কে যেন শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “ছোটো রাজকন্যে। ছোটো রাজকন্যে ! আমাকে ঢুকতে দাও।”
     বাইরে কে এসেছে দেখার জন্যে দরজার কাছে ছুটে গেল ছোটো রাজকন্যে , আর দরজা খুলতেই দেখে—ও মা ! সেই ব্যাঙটা সেখানে বসে। দড়াম্‌ করে দরজা বন্ধ করে দারুণ ঘাবড়ে তাড়াতাড়ি সে ফিরে এল নিজের জায়গায়। রাজা লক্ষ্য করলেন তার বুক বেজায় ঢিবঢিব করছে। তিনি বললেন :
     “ভয় পেয়েছিস কেন? তোকে নিয়ে পালাবার জন্যে দোরগোড়ায় কি একটা দৈত্য এসে হাজির হয়েছে?”
     সে বলল, “না-না। কোনো দৈত্যদানা নয়—কুচ্ছিত একটা ব্যাঙ।” 
     “তোর কাছে ব্যাঙটা কী চায়?”
     “জানো বাবা, গতকাল বনের মধ্যে কুয়োপাড়ে খেলা করার সময় আমার সোনার বলটা জলে পড়ে যায়। আমি খুব কাঁদি। তাই ব্যাঙটা সোনার বল নিয়ে আসে। সে বলে তাকে আমার সঙ্গী করে নিতে। তাকে কথা দিয়েছিলাম আমার সঙ্গী করব বলে। কিন্ত কক্ষনো ভাবি নি জল ছেড়ে এত দূরে সে আসতে পারবে। এখন সে বাইরে। ভেতরে আসতে চায়।”
     আবার দরজায় টোকা পড়ল আর শোনা গেল এই কথাগুলো !

“ছোটো রাজকন্যে, 
ছোটো রাজকন্যে, 
আমায় আসতে দাও।
ঠাণ্ডা কুয়োতলে 
কাল যে কথা দিয়েছিলে। 
ছোটো রাজকন্যে, 
ছোটো রাজকন্যে, 
অামায় আসতে দাও।”

     রাজা বললেন, “কথার খেলাপ করতে নেই। ওকে ভেতরে নিয়ে আয় ।”
     ছোটো রাজকন্যে দরজা খুলতে থপথপ্‌ করে তার পিছন-পিছন চেয়ারের কাছে এসে ব্যাঙ বলল, “তোমার কাছে আমাকে তুলে নাও।”
     ছোটো রাজকন্যে শিউরে উঠল। কিন্তু রাজা তাকে আদেশ দিলেন ব্যাঙের কথা শুনতে। ব্যাঙ কিন্তু চেয়ারে বসে সন্তুষ্ট হল না। বলল তাকে টেবিলে তুলে দিতে। টেবিলে উঠে সে বলল, “তোমার সোনার ছোটো প্লেটটা কাছে সরিয়ে আনো যাতে একসঙ্গে আমরা খেতে পারি।” ছোট রাজকন্য তাই করল । কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল মোটেই এটা সে পছন্দ করছে না। 
     চেটেপুটে ব্যাঙ খেল। কিন্তু ছোটো রাজকন্যে প্রায় কিছুই মুখে তুলতে পারল না। খাওয়া শেষ হলে ব্যাঙ বলল, “আমার পেট ভরে গেছে। আমি এখন ক্লান্ত। এবার তোমার ছোটো ঘরে নিয়ে গিয়ে সিল্কের বিছানা পেতে দাও। আমরা পাশাপাশি শুয়ে ঘুমব।” 
     ঠাণ্ডা ব্যাঙ—যাকে ছোবে তার গা ঘিনঘিন করবে—সে তার সুন্দর পরিষ্কার বিছানায় ঘুমুবে ভেবে ছোটো রাজকন্যে, এবার কাঁদতে শুরু করল ।
     তার উপর চটে উঠে রাজা বললেন, “দরকারের সময় আমাদের যারা সাহায্য করেছে, পরে তাদের ঘেন্না করতে নেই?”
     তাই ছোটো রাজকন্যে তার সুন্দর দুটো আঙুল দিয়ে ব্যাঙকে তুলে উপরতলায় এনে এক কোণে নামিয়ে দিল। কিন্তু সে বিছানায় শোবার পর বিছানার পাশে এসে ব্যাঙ বলল, “আমি ক্লান্ত। আমিও বিছানায় শুতে চাই। আমাকে তুলে নাও। নইলে তোমার বাবাকে বলে দেব।” 
     এইবার সত্যি-সত্যি ক্ষেপে উঠল ছোটো রাজকন্যে। ব্যাঙটাকে-তুলে সজোরে দেয়ালে আছড়ে সে বলল— “হতকুচ্ছিৎ ব্যাঙ৷ এবার যত খুশি ঘুমো ।” 
     কিন্তু মাটিতে পড়ার পর দেখা গেল সে আর ব্যাঙ নেই—এক রাজপুত্ত্বর। চোখ দুটি ভারি সুন্দর, হাসিহাসি। রাজার কথায় সে হয়ে উঠল ছোটো রাজকন্যের প্রিয় বন্ধু আর খেলার সঙ্গী। তাকে রাজপুত্ত্বর বলল, কী করে এক বুড়ি শয়তান ডাইনি তুকতাক করে তাকে ব্যাঙ বানিয়ে দিয়েছিল। জানাল ছোটো রাজকন্যে ছাড়া আর কেউই কুয়ো থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারত না। আরো বলল, আগামী কাল ছোটো রাজকন্যেকে সে সঙ্গে নিয়ে যাবে নিজের রাজত্বে। তারা ঘুমিয়ে পড়ল আর পরের দিন সকালে সূর্য ওঠার পর দেখা গেল আটটা সাদা ঘোড়ায়-টানা একটা গাড়ি দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঘোড়াগুলোর মাথায় সাদা পালক দুলছ ! তাদের গায়ে সোনার সাজ। পিছনে দাঁড়িয়ে তরুণ রাজার বিশ্বস্ত ভূত্য হেনরি। তার প্রভু ব্যাঙ হয়ে যাবার পর সে এমন দুঃখ পায় যে, তিনটে লোহার পাত দিয়ে নিজের বুক সে বাঁধে—যাতে শোকে তার বুকটা না ভাঙে৷
     বিশ্বস্ত হেনরি তার প্রভু আর ছোটো রাজকন্যেকে উঠতে সাহায্য করে নিজে আবার গিয়ে উঠল গাড়িটার পিছনে । গাড়িটা তাদের নিয়ে চলল রাজপুত্তুরের রাজত্বে।

0 coment�rios: