অনেক অনেক কাল আগে এক মাকড়সা ছিল। তার নাম কোয়াকু আনানসে। সবাই জানে, আকাশ-দেবতা হলেন নিয়ান-কোনপোন। কোয়াকু একদিন আকাশ-দেবতার কাছে গেল। সে আকাশ-দেবতার সব গল্প কিনে নিতে চায়। তাই সে এসেছে।
নিয়ান-কোনপোন বললেন, ‘তুমি কেমন করে ভাবলে, তুমি আমার সব গল্প কিনে নিতে পারবে?
মাকড়সা বলল, “আমি জানি আমি কিনতে পারব। তাই এসেছি।
আকাশ দেবতা হাসলেন আর বললেন,‘কোকোফু, বেকওয়াই, আসুমেনগিয়া এসেছিল গল্প কিনতে। তারা যেমন বিশাল তেমনি শক্তিশালী। তারা পারে নি। আর তুমি এইটুকু প্রাণী। কিই-বা তোমার আছে? তুমি পারবে কেমন করে?
মাকড়সা বলল, “আপনার গল্পগুলোর দাম কত? একবার শুনি-ই না।’
আকাশ-দেবতা বললেন, “যদি তুমি অজগর সাপ ওনিনি, চিতা ওসেবো, পরি মোয়াতিয়া, আর ভিমরুল মোবোরোকে দিতে পার, তবেই আমার গল্পগুলো কিনতে পারবে।’
মাকড়সা বলল, “এ সবই আমি দেব। তার সঙ্গে আরও একটা জিনিস ফাউ দেব। সে হল আমার বুড়ি মা, নসিয়াকে।
আকাশ-দেবতা মাথা নেড়ে বললেন, ‘বেশ, তবে তাই নিয়ে এসো। গল্প তুমি পাবে।’
মাকড়সা নেমে এল পৃথিবীতে। সব কথা জানিয়ে বুড়ি মাকে বলল, “আমার ইচ্ছে আমি আকাশ-দেবতার সব গল্প কিনে নেব। আকাশ-দেবতাকে এর বদলে দিতে হবে অজগর সাপ, চিতা, পরি আর ভিমরুল। আমি বলেছি এসবের সঙ্গে আমি তোমাকেও দিয়ে আসব। তিনি রাজি।
মাকড়সার বউয়ের নাম আসো। আসোকে সে বলল, “এখন বুদ্ধি বের করতে হবে কীভাবে অজগর ওনিনিকে ধরা যায়।
বউ বলল, “বনে গিয়ে তালগাছের একটা বড় পাতাসমেত ডাল কেটে আনো, আর নিয়ে এসো শক্ত বুনো লতা। তাই নিয়ে গাঁয়ের শেষে ওই হ্রদে যাও।
আনানসে তাই নিয়ে এল। চলল হ্রদের তীরে। সেখানে গিয়ে আপন মনে বলল, মনে হয় এটা ওর চেয়ে লম্বায় বড়। না, না, তা কি করে হয়। বোধহয় ছোটই হবে।
তুমি মিথ্যে বলছ। এটা লম্বায় বড়ই হবে। ওটা তো হ্রদেই থাকে, ওই তো ওখানে।
অজগর জলের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত কথাবার্তা শুনল, অবাক হল। জলের ওপরে মাথা তুলে বলল, “কি হয়েছে? ব্যাপারটা কি?’
মাকড়সা বলল, আমার বউ আসো আমার সঙ্গে খালি তর্ক করছে। বলছে এই তালপাতার ডালটা লম্বায় তোমার চেয়ে বড়। এত মিথ্যে কথাও সে বলতে পারে মিথ্যাবাদী, একেবারে মিথ্যাবাদী।
অজগর বলল, "এত তর্কের কি আছে? আমি জল থেকে উঠছি। মেপে নিলেই হবে।’
অজগর টানটান করে লম্বা হয়ে পড়ল। মাকড়সা তার দেহ ঢেকে দিল তালপাতায়। তারপর বুনো লতা দিয়ে পাতা-সমেত অজগরকে জড়িয়ে ফেলতে লাগল। মুখে মাপবার শব্দ করতে লাগল— নোয়েনেনে, নোয়েনেনে, নোয়েনেনে। কাজ শেষ করে মাকড়সা বলল, “বোকা কোথাকার! এবার তোমাকে আকাশ-দেবতার কাছে বেঁচে দেব। আর তার বদলে পাব তার গল্পগুলো। চলো।’
মাকড়সা চলল আকাশ-দেবতার কাছে। বলল, “নিয়ে এসেছি অজগর ওনিনিকে।’
আকাশ-দেবতা বললেন, “আমি হাত দিয়ে ওকে স্পর্শ করলাম। যা আছে তাই থাকবে?
মাকড়সা ফিরে এসে সব কথা বউকে জানাল। বলল, ‘এবার ভিমরুলকে ধরতে হবে।
বউ বলল, “লাউয়ের একটা খোল জোগাড় করো, তাতে জল ভর্তি করে বনের পথে যাও।
মাকড়সা সব ঠিক করে নিয়ে বনের পথে রওনা দিল। কিছু দূরেই ভিমরুলের একটা চাক দেখতে পেল। একটা গাছে সেটা ঝুলছে। লাউয়ের খোল থেকে কিছুটা জল নিয়ে মাকড়সা চাকে ছুড়ে দিল, কিছুটা জল নিজের মাথায় ঢেলে নিল। তারপরে ভিমরুলদের বলল, ‘খুব বৃষ্টি পড়ছে, ওপর থেকে পাতা বেয়ে জল পড়ছে। এক কাজ করো। আমার এই লাউয়ের খোলের মধ্যে ঢুকে যাও, তাহলে আর বৃষ্টি মোটেই গায়ে লাগবে না।’
ভিমরুল বলল,‘কি ভালো তুমি, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই আকু, ধন্যবাদ জানাই আকু’।
এই না বলে বৃষ্টির ভয়ে ভিমরুলরা সব চাক থেকে উড়ে এসে লাউয়ের খোলে ঢুকতে লাগল। মুখটা ঢেকে মাকড়সা বলল, “বোকা কোথাকার। এবার তোমাদের আকাশ-দেবতার কাছে বেচে দেব। আর তার বদলে পাব তার গল্প। চলো।
মাকড়সা চলল আকাশ-দেবতার কাছে। আকাশ-দেবতা বললেন, “আমি হাত দিয়ে ওকে স্পর্শ করলাম। যা আছে তাই থাকবে।
আবার ফিরে এল মাকড়সা। বউকে বলল, ‘এবার চিতা ওসেবোকে ধরতে হবে।’
বউ বলল, ‘ঘন বনের মধ্যে চলে যাও আর একটা গর্ত করো।
মাকড়সা বলল, আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি।
মাকড়সা চলল ঘন বনের পথে। চিতার খোঁজে। চিতার থাবার চিহ্ন খুঁজতে লাগল। থাবার চিহ্ন দেখতে পেল। নজর রেখে এগোতে লাগল। একটু এগিয়েই এক বিরাট গর্ত খুঁড়ল। গাছের শুকনো ডালপালা দিয়ে গর্তের মুখটা বন্ধ করে দিল। ফিরে এল বাড়িতে। পরের দিন খুব ভোরে রওনা দিল মাকড়সা। তখনও সব কিছু চোখে ভালো দেখা যাচ্ছেনা। আস্তে আস্তে যেতে যেতে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। কি আনন্দ। গর্তের কাছে যেতেই গর্জন শুনতে পেল। ভেতরে পড়ে রয়েছে চিতা ওসেবো।
মাকড়সা বলল, ‘বাপের ছোট ছেলে, মায়ের ছোট ছেলে, তোমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। হল তো! বার বার বলেছি, মজানো তালের রস অত খেয়ো না, মাতাল হয়ে পড়বে। হল তো ! এমন মাতাল হয়ে পড়লে কাল রাতে যে গর্তেই পড়ে গেলে? আমি আগেই জানতাম। আমি তোমায় গর্ত থেকে তুলতে পারি। আহা ! যা হবার তাই হয়েছে। কিন্তু কালকেই তো তুমি সব কিছু ভুলে যাবে। আমাকে কিংবা আমার ছেলেমেয়েদের দেখলেই তেড়ে আসবে। ঠিক বলিনি?
চিতার মাথা কেমন গুলিয়ে গিয়েছে, চিন্তা তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাকড়সার কথার অর্থও সে বুঝতে পারছে না। কি বিপদেই পড়েছে। তাই তাড়াতাড়ি বলল, ‘ওঃ আমি কখনই এ কাজ করতে পারি না।
মাকড়সা তখন একটু দূরে গেল আর গাছের দুটাে ডাল কেটে আনল। একটা এখানে রাখল, আরেকটা ওখানে রাখল। বলল, “চিতা, তোমার একটা থাবা এখানে দাও, অন্য থাবাটা ওখানে বসাও।’
চিতা তার কথামতো তাই করল। চিতা ওপরে উঠে আসছে, অনেকটা ওপরে—হঠাৎ মাকড়সা তার চোখের নিমেষে তার ধারালো ছুরিটা বের করেই চিতার মাথায় বসিয়ে দিল। ধপ করে শব্দ হল। চিতা পড়ে গেল গর্তের মধ্যে। এখন আর আগের চিতা নেই। মই নিয়ে এসে তরতর করে গর্তের মধ্যে নেমে গেল। চিতাকে গর্তের বাইরে তুলে আনল। যাচ্ছে আর বলছে, ‘বোকা কোথাকার! এবার তোমাকে আকাশদেবতার কাছে বেচে দেব। আর তার বদলে পাব তার গল্পগুলো। চলো।
মাকড়সা চলল আকাশ-দেবতার কাছে। আকাশ-দেবতা বললেন, “আমি হাত দিয়ে ওকে স্পর্শ করলাম। যা আছে তাই থাকবে?
আবার ফিরে এল মাকড়সা। এবার ধরতে হবে পরি মোয়াতিয়াকে। মাকড়সা একটা কাঠের পুতুল তৈরি করল, পুতুলের মুখটা চ্যাপ্টা। তারপরে গাছের গোড়া থেকে আঠা এনে পুতুলটার সারা গায়ে লেপটে দিল। অনেকটা মেটে আলু সেদ্ধ করে মেখে কিছুটা রেখে দিল পুতুলটার হাতে, আর কিছুটা একটা পেতলের বাটিতে রেখে দিল। পুতুলের কোমরে একটা লম্বা দড়ি বাঁধল। পুতুলকে নিয়ে চলল বাগানের ওপাশে, শিমুল গাছের নীচে। প্রতিদিন রাতে ওখানে পরিরা নাচতে আসে একটু দুরে দড়ি ধরে মাকড়সা লুকিয়ে থাকল।
চাঁদনি রাত। উড়ে আসছে একটা ছোট্ট পরি। সোজা নেমে এল পুতুলের কাছে। বলে উঠল, ‘আকুয়া, তোমার হাতের আলু সেদ্ধ একটু খাব? মাকড়সা দড়ি ধরে টান দিল, পুতুল মাথা নাড়ল, সম্মতি দিল। আলুসেদ্ধ নিয়ে সে খেল। খুব ভালো আলু। বলল, “তোমায় ধন্যবাদ। পুতুল কোন সাড়া দিল না, মাথও নাড়ল না। রেগে গেল পরী। বলল, “তোমায় ধন্যবাদ জানালাম, তবু উত্তর দিলে না? পুতুল তবু কিছু বলল না। আরও রেগে গেল পরি। পুতুলের গালে এক চড় মারল। এ কি ! হাত পুতুলের দেহে আটকে গেল। অন্য হাতে পুতুলের বুকে রেখে দিয়ে চাপ দিয়ে ছাড়াতে গেল। একি ! ও হাতও আটকে গেল! বুক পেট দিয়ে পুতুলকে ধাক্কা মারতে গেল। এ কি! বুক-পেট আটকে গেল। নড়াচড়া করাই কঠিন।
মাকড়সা লুকনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এল। দড়ি দিয়ে পরিকে বেঁধে ফেলল।
বলল, “বোকা কোথাকার! এবার তোমাকে আকাশ-দেবতার কাছে বেচে দেব। আর তার বদলে পাব তার গল্পগুলো। চলো।
পরিকে নিয়ে মাকড়সা বাড়ি ফিরে এল। মাকড়সার মায়ের কাছে এসে বলল, ‘ওঠো, আকাশ-দেবতার কাছে যেতে হবে। তাকে বলেছিলাম তোমাকে ফাউ হিসেবে দেব। পরির সঙ্গে তোমাকেও যেতে হবে। ব্যাস, কাজ শেষ। এবার পাব গল্পগুলো। পরি ও মাকে নিয়ে মাকড়সা আকাশ-দেবতার কাছে চলল। সেখানে পৌঁছে বলল, ‘আকাশ-দেবতা, এই পরি মোয়াতিয়াকে নিয়ে এসেছি। আর কথামতো আমার বুড়ি মাকে ফাউ এনেছি।
আকাশ-দেবতা অবাক হলেন। তিনি তার রাজ্যের প্রধানদের ডাকলেন। দুই সর্দার কোনটিরে ও আকওয়ান এলেন, আরও এলেন গণ্যমান্য আদোনতেন, গিয়াসে, ওয়োকো, আনকো-বিয়া ও কাইদোম। আকাশ-দেবতা তাদের বললেন, ‘অনেক অনেক সর্দার এসেছে, অনেক গোষ্ঠীপতি এসেছে। তারা খুব শক্তিশালীও বটে। কিন্তু কেউ আমার গল্পগুলো কিনে নিয়ে যেতে পারে নি। সবাই হেরে গিয়েছে। কিন্তু কোয়াকু আনানসে গল্পগুলোর সব দাম মিটিয়ে দিয়েছে। আমি তার কাছ থেকে অজগর ওনিনি, চিতা ওসেবো, ভিমরুল মোবোরো ও পরি মোয়াতিয়াকে পেয়েছি। তার ওপরে ফাউ পেয়েছি তার মাকে। ওই দেখ, সবগুলো জিনিস ওখানে একসঙ্গে রয়েছে। তোমরা সকলে তার জয়গান কর ।
সবই ই ই বলে চিৎকার করে উঠল। গর্বে মাকড়সার বুক ফুলে উঠল।
সব গল্প তোমাকে দিলাম। আজ থেকে চিরকালের জন্য আমার এইসব গল্প তোমার হল। এ আমার উপহার। যোগ্য পাওনা। কোসে। কোসে। কোসে। আমি তোমায় আশীৰ্বাদ করছি। আজ থেকে আর কেউ ওগুলোকে আকাশ-দেবতার গল্প বলবে না। আজ থেকে সবাই বলবে,– কোয়াকু আনানসের গল্প, মাকড়সার গল্প। আমিও তাই বলব।’
আমার গল্প শেষ হল। আমি যা বললাম, তা যদি মিষ্টি লাগে, তা যদি মিষ্টি না-ও হয়, তবু অন্যদের এ গল্প বলবে। চারিদিকে ছড়িয়ে দেবে। আবার আমার কাছে ফিরে এসে এ গল্প বলবে। তবে তাই হোক।
0 coment�rios: