Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

রাজকন্যের মন ভালো নেই। খায় না, দায় না, নিশিরাতে ঘুমোয় না। মুখ তার গোমড়া। চোখে জল টলমল । রাজা পড়েছেন ভাবনায় । রানি করেন চিন্তা । ব্যাপা...

রাজকন্যের হাসি -- নরওয়ের রূপকথা

রাজকন্যের মন ভালো নেই। খায় না, দায় না, নিশিরাতে ঘুমোয় না। মুখ তার গোমড়া। চোখে জল টলমল । রাজা পড়েছেন ভাবনায় । রানি করেন চিন্তা ।
ব্যাপার কী? ব্যাপার কী? ভেবে ভেবে হন প্রাণান্ত ।মন্ত্রীরাও পায় না কোনো কূলকিনারা ।
রাজ্য জুড়ে অশান্তি । রাজকন্যের মুখে হাসি নেই। রাজারও তাই মন খারাপ । রাজকাজে মন বসে না তার। রাজকন্যে রাজপ্রাসাদের আলো । তার মুখে হাসি থাকলে পুরী করে গমগম। বৃষ্টি নামে ঝমঝম। বাগানে ফুল ফোটে। পাখি গান গায়। চাঁদ ঢালে আলো । আর সেই রাজকন্যা সারাক্ষণ থাকে কিনা চুপচাপ । কারো সাথে কথা বলে না। রাজার মনে শান্তি থাকে কীভাবে?
ঘোষণা দিলেন তিনি---
কন্যার মুখে হাসি ফোটাতে পারবে যে তার সঙ্গে হবে তার বিয়ে । তাকে করা হবে এই রাজ্যের রাজা ?
দেশে দেশে জানানো হল সেই ঘোষণা ।
সেই ঘোষণা গিয়ে পৌছাল এক গাঁয়ে, এক চাষির ছেলের কানে। ফুটফুটে তার চেহারা। মায়াভরা তার চাউনি। মুখে কথার খই ফোটে। যেমন তার শরীর তেমনই তার শক্তি ।
রাজার ঘোষণা শুনে মন হল তার উতলা। চাষিকে বলল সে, বাবা, আমি রাজার মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আমাকে যেতে দাও।”
বাবা অবাক হলেন । ‘এই কাজ তুই পারবি কী করে? কেউ যা পারছে না— তুই সে সাহস করিস কী করে?”
চাষির ছেলে নাছোড়বান্দা । বাবা দিলেন অনুমতি । চাষির ছেলে চলল, রাজপ্রাসাদে যাবে সে । সঙ্গে নিল তার পোষা ঘোড়া । সেই ঘোড়ার পিঠে চাপলে সে থোড়াই কেয়ার করে অন্য কিছু।
শুভদিনে, শুভক্ষণে, মেঘভাঙা রোদ মাথায় নিয়ে রওনা দিল চাষির ছেলে । ছুট ছুট ছুট... ধু ধু মাঠ পেরিয়ে, বরফের পাহাড় পেরিয়ে ছুটিয়ে দিল ঘোড়া। মা তাকিয়ে রইল পথের পানে । বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আপন মনে ।
টগবগ, টগবগ ছুটছে ঘোড়া । রাজকন্যের মুখে যেভাবেই হোক হাসি ফোটাবে সে । এই ঘোড়ার ছিল অনেক গুণ । ঘোড়া যখন ছুটতে থাকে তখন কারো যদি স্পর্শ লাগে তবে সে আটকে যাবে ঘোড়ার সঙ্গে। ঘোড়া ছুটবে, সে-ও ছুটবে।
ঘোড়ার প্রভু হল চাষির ছেলে। সে যতক্ষণ না হাত বুলিয়ে দেবে ততক্ষণ ঘোড়াও ছাড়বে না কাউকে ।
চলতি পথে দেখা হল আজব রকম একপেয়ে একজন লোকের সঙ্গে ! একটা ঠ্যাং কাঁধে চাপিয়ে লোকটা দিব্যি লেংচে লেংচে হটছে । চাষির ছেলে তাকে দেখে অবাক হল ।
কী ব্যাপার! এইভাবে হাঁটছ কেন তুমি?
একপেয়ে লোকটা মুচকি হাসল। আমায় দেখে অবাক হয়াঁ না। দুই-পা মাটিতে থাকলে সেকেন্ডে আমি যাই একশো মাইল।
বলে কী লোকটা!
শুনে থ হয়ে যায় চাষির ছেলে । সঙ্গী করে নেয় লোকটাকে ।
আবার তাদের যাত্রা শুরু ।
যেতে যেতে এবার দেখে, পথের মধ্যিখানে একজন লোক চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে। আরেকটু হলে ঘোড়া তাকে মাড়িয়েই দিত আর কী!
ব্যাপার কী গো? ব্যাপার কী?”
দুঃখের কথা বলব কি ভাই– খোলা চোখে কাছের জিনিস দেখতে পাই না মোটেই। চোখ খুললেই একশো মাইল দূরের জিনিস দেখি ।
এ লোকটাকেও সঙ্গী করে নেয় ওরা । একপেয়ে, চোখ-বন্ধ আর চাষির ছেলে— তিনজনে চলল রাজপ্রাসাদের দিকে। সূর্য ডুবে রাত নামে। রাত পুইয়ে সকাল হয়।
যেতে যেতে দেখা হল আরেক অদ্ভুত লোকের সঙ্গে। পানিভরা বোতলের মুখ আঙুলে চেপে রাস্তার মধ্যে তিড়িং বিড়িং করে নাচছে সে।
“এমনভাবে নাচছ কেন ভায়া? প্রশ্ন শুনে উত্তর দিল বোতলঅলা, আঙুল খুললেই একশো মাইল বেগে ছুটবে পানি। বোতলের পানি অফুরন্ত। নিমেষে মরুভূমিকে বানিয়ে দিতে পারে সাগর। তাই না শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চাষির ছেলে একপেয়ে আর অন্ধের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বোতলঅ'লা আপনা আপনি সফরসঙ্গী হয়ে গেল । মুখগোমড়া রাজকন্যের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। এ আর এমন কী ব্যাপার! সবাই মিলে রওনা দিল রাজপ্রাসাদের দিকে ।
ইতিমধ্যে হয়েছে এক কাণ্ড! চলতি পথের লোকজন, গাছপালা, জীবজানোয়ার আটকে যাচ্ছে ঘোড়ার গায়ে । যাকে দেখে তাকেই টেনে নেয় ঘোড়া । খোড়া, কানা, ল্যাংড়া, লম্বা, ট্যাঙা— নানা ধরনের লোকজন, নানা ধরনের জীবজন্তু আটকে রয়েছে ঘোড়ার সঙ্গে। কেউ কাঁদছে, কেউ গোঙাচ্ছে, কেউ-বা চেঁচাচ্ছে প্রাণপণ ।
সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। যে দেখবে তারই হাসি পাবে। সদলবলে চলল এই বাহিনী । আর ওদিকে— শীত পেরিয়ে বসন্ত এসেছে। ডালে ডালে গজাল নতুন পাতা। বনে বনে গান গাইছে পাখিরা। তবু রাজকন্যের মুখে হাসি নেই। মুখ তার ছাইবরণ, চোখ তার টলোমলো | এমন সময় খবর এল প্রাসাদে দলেবলে হাজির হয়েছে একজন। রাজকন্যের মুখে হাসি ফোটাবে সে । সে রাজার দর্শন পেতে চায় ।
বুড়ো রাজা তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন । অদ্ভুত এই দলটাকে দেখেই অবাক হয়ে গেলেন রাজা । ঘোড়ার গায়ে লেপ্টে-থাকা লোকজন ও জন্তুজানোয়ারের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি দেখে রাজা হেসে ফেললেন ফিক করে। রাণী এলেন । তিনিও হাসলেন ফিক করে।
এ আবার কীরকম কাণ্ড বাপু ঘোড়ার গায়ে লেগে থাকে মানুষ! এ কোন চিড়িয়া বাবা!
রাজকন্যাকে নিয়ে আসা হল সামনে । রাজা হাসছেন । রাণী হাসছেন। মিষ্টি হাসির ঝিলিক খেলে গেল রাজকন্যের মুখেও ।
ভেঁপু বেজে উঠল। রাজ্য জুড়ে হেসে উঠল সবাই। গাছে গাছে পাখিরা গাইল গান। ফুল ফুটল। রাজ্যের লোকের আনন্দ আর ধরে না। রাজ্যের ওপর দিয়ে বয়ে গেল খুশির ঢেউ।
তারপরে সবাই খোঁজ লাগাল, কে সেই সৌভাগ্যবান যে রাজকন্যের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তাকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকজন। কে যেন বলল, আরে, এ যে চাষির ছেলে!’
এক কান, দুই কান— এই খবর ছড়িয়ে পড়ল সবখানে । রাজা ভঙ্গ করলেন নিজের ঘোষণা । অসম্ভব । চাষির ছেলের সঙ্গে রাজকন্যের বিয়ে হতে পারে না । এই না শুনে চাষির ছেলের মাথায় জ্বলল আগুন। কী? এতবড় অপমান? গেল সে মন্ত্রীর কাছে । আমি তো আমার কাজ করেছি। এবারে আপনাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন। মন্ত্রীর পেটে পেটে কূটবুদ্ধি। রাজার সঙ্গে পরামর্শ করল, কী করে চাষির ছেলেকে বিদায় করা যায়!
মন্ত্রী বলল, একশো মাইল দূরে আছে এক ঝরনা। একঘণ্টার মধ্যে সেই ঝরনার পানি এনে দিতে পারলে রাজসিংহাসনের যোগ্য বলে মনে করব তোমায় ।”
চাষির ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছিল একপেয়ে। চোখ কচলে হাই তুলে বলল, সে, “এ আবার এক কাজ হল? এই আমি চললাম। যেতে এক সেকেন্ড, ফিরতে এক সেকেন্ড!”
বলেই একপেয়ে কাঁধ থেকে নামিয়ে নিল এক-পা । চোখের পলকে সে হাওয়া । রাজা মন্ত্রী আর ‘জি হুজুরের দল’ সবাই ভাবল— এই অসম্ভব কাজ কীভাবে করবে চাষির ছেলে? যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল ।
এদিকে এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড যায়। কিন্তু কোনো পাত্তা নেই একপেয়ের । চোখ-বন্ধ তখন উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমি তো সারাক্ষণ বেগার বসে আছি । আমিই তবে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি।”
বলেই সে চোখ মেলল। দেখতে পেল, একশো মাইল দূরে ঝরনাতলায় চোখ মুদে শুয়ে আছে একপেয়ে । সময় এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত ।
কী করা যায়? কী করা যায়?
আর কোনো কথা নেই—
বোতলঅলা আঙুল খুলে ফেলল। বোতল থেকে একশো মাইল বেগে পানি গিয়ে আছড়ে পড়ল একপেয়ের গায়ে । চোখ মেলে চাইল সে । ঝটপট পানি নিয়ে একপেয়ে হাজির হল রাজপ্রাসাদে ।
ধন্য ধন্য পড়ে গেল চাষির ছেলের নামে ।
রাজার চক্ষু চড়কগাছ! বুড়ো মন্ত্রী ভাবল, এ বড় গুণী ছেলে । তবু তার মন সায় দেয় না। মন্ত্রী এবার বুদ্ধি দিল, চাষির ছেলেকে মেরে ফেলতে হবে। মন্ত্রী বলল, ‘ওগো চাষির ছেলে, সুদূর ঝরনার জল এনেছ তুমি নিমিষে। কী বলে যে জানাই তোমায় ধন্যবাদ। রাজপ্রাসাদের নিজস্ব মাঠে তোমায় দেয়া হবে অভিষেক ।
সবাই মিলে চলল ওরা মাঠে। গিয়ে দেখে এ কী! না আছে শামিয়ানা । না আছে ফুলের মালা। না আছে তোরণ। শুধু রাজার সৈন্যরা কসরত করছে। চাষির ছেলে বুঝে ফেলল, তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। বোতলঅলা আর দেরি করল না। হুউশ করে ছাড়া শুরু করল সে বোতলের পানি। সেকেন্ডে একশো মাইল বেগে ছুটছে পানি। যেন বান ডেকে যাবে দেশে। সৈন্যরা যে যেদিকে পারল দিল দৌড়। পানির তোড়ে কেউকেউ একশো মাইল দূরে ভেসে গেল।
রাজা আর মন্ত্রী তড়িঘড়ি ছুটে গেল।
বাঁচাও! বাঁচাও!! রক্ষা কর আমাদের '।বোতলঅলা মুখ বন্ধ করল ।
অমনি রাজ্য জুড়ে আনন্দের ঢল বইল ।
রাজকন্যে খুশিতে ডগমগ । সাত-সাত চোদ্দদিন বয়ে গেল খানাপিনার ঢল ।
চাষির ছেলে বসল সিংহাসনে। ওর সারাক্ষণের সঙ্গী— একপেয়ে, চোখ-বন্ধ আর বোতলঅলা ।
এখন, রাজকন্যে যখন-তখন হাসে আর সেই হাসিতে রাজপ্রাসাদ করে আলো ঝলমল ।

0 coment�rios: