আফ্রিদি দৈত্যটার হুঙ্কারে ভয় না পেয়ে যুবকদের মধ্যে থেকে বুনো ছাগলের মালিক প্রথম মিঞা এগিয়ে এসে বলল, দয়া করে সওদাগরের অপরাধ ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে আমার এ-বুনো ছাগলটার কাহিনী শোনাতে চাই। আমার কাহিনী যদি তোমার মনকে খুশি করতে পারে তবে সওদাগরের অপরাধ ক্ষমা করে দিবে, কথা দাও্।’
আফ্রিদি দৈত্য অট্টহাসি হেসে বলল, খুব ভাল কথা! তোমার কাহিনী যদি আমার মনকে খুশি করতে পারে তবে আমি সওদাগরের তিনভাগের এক ভাগ অপরাধ ক্ষমা করে দেব।, কথা দিচ্ছি।’
এবার বুনো ছাগলের মালিক যুবকটি তার কাহিনী শুরু করল--‘ হে দৈত্য, আমার সঙ্গে এই যে বুনো ছাগল দেখতে পাচ্ছ, এটা কিন্তু আসলে ছাগল নয়। এ আমার বিবি। ত্রিশটা বছর আমরা একসাথে থাকি। ছোটবেলাতে এ যাদুবিদ্যা শিখেছিল।
আমার আপশোষ একটাই, ত্রিশ বছর এক সঙ্গে ঘর করলাম কিন্তু আমাদের কোন ছেলে-মেয়ে হল না। মনের দুঃখে শেষ পর্যন্ত বাড়ির চাকরানিকে বিয়ে করেছিলাম। আর তার পেটে আমার প্রথম ছেলে সন্তান হল।আমার ছেলে যখন পনের বছরে পা দিল তখন আমাকে টাকা পয়সা রোজগারের জন্য বিদেশে যেতে হয়েছিল।
আমার বিবি এই সুযোগে যাদুবলে আমার ছেলেকে বাছুর আর তার মাকে গাই করে ফেলল। কিছুদিন পরে আমি ঘরে ফিরে বিবিকে বললাম, আমার ছেলে আর তার মাকে দেখছিনা যে। তারা কোথায় গেছে?
আমার কথার উত্তরে বিবি আমাকে মিথ্যা কথা বলল, আমার ছেলে ঘর থেকে চলে গেছে আর বউ মারা গেছে। বিবির মুখে এ কথা শুনে আমি আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না। মনের দুঃখে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।
একসময় আমাদের কুরবানির ঈদ চলে এল। আমি চাকরকে হাট থেকে একটা মোটা সোটা স্বাস্থবান গরু কিনে নিয়ে আনতে বললাম। সে ইয়া বড় একটা গরু কিনে আনল। আমি চাকু নিয়ে তার দিকে এগোতেই দেখলাম, তার চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়ছে। আর করুণ স্বরে ডাকাডাকি করছে। কিছুতেই আমি গরুটাকে কোরবানি দিতে পারলাম না। চাকরটাকে বললাম, ‘তুই যদি পারিস কোরবানি কর। আমার মন চাইছে না।’
আসলে তখন আমার জানা ছিল না যে, সেই গরুটা আমার ছেলের মা ছিল । আমার দ্বিতীয় বিবি। আমার বড় বউ তাকে যাদুবলে গাই বানিয়ে রেখেছিল।
নিজের হাতে কোরবানি দিতে না পারায় চাকরকে আবার হাটে পাঠালাম। এবার বললাম, একটা মোটাসোটা বাছুর নিয়ে আসতে। চাকর তাই নিয়ে এল। আমি কোরবানি দেবার জন্য চাকু নিয়ে যেতেই বাছুরটা আমার দুপায়ের কাছে এসে শুয়ে পড়ল। তার চোখ দিয়ে শুধুই পানি ঝরছিল আর ঠোঁটটা কাঁপছিল। দেখে মনে হচ্ছিল সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু বাছুর বলে আমি তার কথা বুঝতে পারছিলাম না।
আমার বুকের ভেতরটা আবার কেঁদে উঠল, এবারও কোরবানি দিতে পারলাম না। চাকরকে বললাম , কিছুতেই বাছুরটাকে জবাই করতে আমার মন চাইছে না। এর চেয়ে বরং তাকে ছেড়ে দেয়া যাক। তুই বরং আরেকটা গরু কিনে নিয়ে আয়।’
ব্যাস এ পর্যন্ত গল্পটা বলে শাহরাজাদ থেমে গেল। আর এগোল না। দুনিয়াজাদ দিদির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, --‘ কী সুন্দর তোমার গল্প! কী মিষ্টি তোমার গলা! তুমি কী সুন্দর করে গল্প বল!’
শাহরাজাদ তখন বোনকে বলল, ‘আসল গল্প তো শুরুই হয়নি। বোন, যদি ঈশ্বর বাঁচিয়ে রাখে তবে কাল রাতে বাকিটুকু শোনাব।’
দুনিয়াজাদ এবার ঘুমিয়ে পড়ল। বাদশা শারিয়ারেরও খুব ঘুম পেয়েছিল। ঘুমানোর আগে বাদশা শারিয়ার শাহরাজাদ কে বলল, বিবি, তুমি সুন্দর একটা গল্প শুরু করেছিলে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ যে, ভোর হবার আগে তা শেষ হল না।এমন সুন্দর একটা গল্পের শেষ শোনার আগে তোমাকে মারা ঠিক হবে না।’ এই বলে বাদশা শারিয়ার ঘুমিয়ে পড়ল।
শাহরাজাদ জানালার পর্দাগুলো খুলে দিয়ে দেখল, ভোর হয়ে গেছে। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। বেগম শাহরাজাদ সেই রাতের জন্য বেঁচে গেল।
সূচিপত্র...
0 coment�rios: