ঘাটশিলার শান্তিঠাকুর বলেছিলেন আমায় গল্পটা… ভারি মজার গল্প।
দারুণ এক দুরন্ত ছেলের কাহিনী…
যত রাজ্যের দুষ্টবুদ্ধি খেলত ওর মাথায়। মুক্তিপদ ছিল তার নাম, আর দুষ্টুমিরাও যেন পদে-পদে মুক্তি পেত ওর থেকে। আর হাতে-হাতে ঘটত যত অঘটন!
এই রকম অযথা হস্তক্ষেপ আর পদক্ষেপের ফলে একদিন যা একটা কান্ড ঘটল…
গাঁয়ের শিবমন্দিরের ঘণ্টাটার ওপর ওর লোভ ছিল অনেক দিনের।
শিবঠাকুরের মাথার ওপর ঘণ্টাটা থাকত ঝোলানো। শিবরাত্রির দিন ওটাতে দড়ি বেঁধে দেওয়া হত। ভক্তরা সেই দড়ি ধরে টান মেরে একবার করে বাজিয়ে যেত ঘণ্টাটা।
কী মিষ্টি যে ছিল তার আওয়াজ!
শিবরাত্রির পর্ব ছাড়া আর কোনোদিন ওটা বাজানো হত না কিন্তু।
শিবঠাকুরের পাশেই ছিলেন পার্বতী দেবী। তাঁর মাথায় ঝকমক করত সোনার মুকুট। কিন্তু সেদিকে মুক্তিপদের মোটেই নজর ছিল না।
মুক্তিপদ তক্কে তক্কে থাকত কী করে ঘণ্টাটা হাতানো যায়।
একদিন সে দেখল পুজারি ঠাকুর কোথায় যেন বেরিয়েছে, মন্দির ফাঁকা পড়ে। চারধারে কেউ কোথ্থাও নেই।
সুবর্ণসুযোগ জ্ঞান করে সে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে সেঁধুল।
কিন্তু হাত বাড়িয়ে দ্যাখে যে ঘণ্টাটা তার নাগালের বাইরে। যদ্দূর তার হাত যায়, তার থেকেও এক হাত ছাড়িয়ে উপরে রয়েছে ঘণ্টাটা।
ওটাকে পাড়ার জন্য সে তাই শিবলিঙ্গের মাথার ওপরে খাড়া হল।
কিন্তু তখনও সেটাকে হাত দিয়ে পাকড়ানো যায় না, আঙুলে ঠেকে, কিন্তু মুঠোর মধ্যে আনা যায় না ঘণ্টাটাকে।
ভারি মুশকিল তো! কিন্তু এ কী…! শিবের মাথায় চড়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটল সেই অঘটনটা!
স্বয়ং শিবঠাকুর তার সম্মুখে আবির্ভূত! মুক্তিপদর পদক্ষেপেই দেবাদিদেব মুক্তি পেলেন নাকি?
‘বৎস, তোমার ভক্তিতে আমি প্রীত হয়েছি, তুমি বর প্রার্থনা করো।’
‘অ্যাঁ?’ হকচকিয়ে গেছে মুক্তিপদ।
‘ভয় খেয়ো না। তুমি কি আমায় চিনতে পারছ না?’
‘চিনব না কেন? তুমি শিবঠাকুর। দেখেই টের পেয়েছি। পটে দেখেছি তো। পটের সঙ্গে বেশ মিলে যায়।’
‘তোর মতন ভক্ত আর হয় না।’ শিবঠাকুর বলেন, ‘লোকে আমার মাথায় ফুল বেলপাতা চড়ায়, তুই নিজেকেই আমার ওপর চড়িয়েছিস। তোর সবটাই দিয়েছিস আমায়। তোর মতন ভক্ত আমি দেখিনি। এখন বল্ তুই কী চাস?’
‘কী আবার চাইব!’ থতমত খেয়ে সে বলে।
‘রাজা হতে চাস তুই?’
‘রাজা!’
‘অনেক লোক-লস্কর নিয়ে বিরাট রাজ্যের অধীশ্বর হবার বাসনা আছে তোর?’
মুক্তিপদ ভাবতে থাকে।
‘সে ভারি ঝামেলা!’ ভেবেচিন্তে সে জানায়: ‘রাজা হতে আমার প্রাণ চায় না। রাজ্যি চালানো আমার কম্মো নয়। কী করে রাজ্য চালায় তাই আমি জানিনে!’
‘তা হলে কী চাস বল? পরমাসুন্দরী এক রাজকন্যে?’
‘রাজকন্যে নিয়ে আমি কী করব?’
‘কেন বিয়ে করে সুখে ঘরকন্না করবি? আবার কী?’
‘বিয়ে! এখনই আমি বিয়ে করব কী! আমার গোঁফ বেরয়নি এখনও। তুমি বলছ কী ঠাকুর?’
‘তা হলে হাতি ঘোড়া কী চাস বল্ তুই!’ বর দিতে এসে এমন বিড়ম্বনা শিবঠাকুরের বুঝি কখনও হয়নি।– ‘আমি তোকে বর দিতে চাই। বর না দিয়ে আমি ছাড়ব না।’
‘হাতি ঘোড়া কি কেউ চায় নাকি আবার?’
‘টাকাকড়ি ধনদৌলত?’
‘রাখব কোথায়? বাবা টের পেলে মারবে না? একবার বাবার একটা টাকা সরিয়েছিলাম, তাইতেই এমন একখানা চড় খেয়েছিলাম যে!… এখনও আমার মনে আছে বেশ। না, টাকাকড়ি আমার চাইনে।’
‘তোর দেখছি কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি নেই। মুক্তপুরুষ মনে হচ্ছে। তা হলে তুই কী চাস– ভক্তি, মুক্তি?’
‘সে তো আমার পাওয়া গো! আমার নামই মুক্তি। আর আমার বাবার নাম ভক্তিপদ– ভক্তি মুক্তি তো না-চাইতেই পেয়ে গেছি।’
‘তা হলে তুই হয়তো চাস, মনে হচ্ছে, ত্যাগ, বৈরাগ্য, তিতিক্ষা–‘
‘সে তো বিবেকানন্দরা চায়। পড়েছি বইয়ে। আমি বিবেকানন্দ হতে চাই না।’
‘ভালো ফ্যাসাদ হল দেখছি!’ মহাদেব নিজের জটাজূট চুলকোন। ছেলেরা কী চাইতে পারে, কী তাদের চাওয়ানো যায়, কিছুই তিনি ভেবে পান না।
নিজের ছেলেবেলায় কী সাধ ছিল তাঁর? তাও কিছু তাঁর স্মরণ নেই এখন। সেই সুদূর অতীত বাল্যকালের কথা তাঁর মনেই পড়ে না আর। কবে যে তিনি দুগ্ধপোষ্য বালক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কি না কখনো– কিছুই তাঁর ঠাওর হয় না।
কী চাইতে পারে ছেলেটা? কী পছন্দ হতে পারে ছেলেটার? তিনি খতিয়ে দেখতে যান। তাঁর আর তার টান সমান হবার কথা নয়। আদ্যিকালের তিনি আর সেদিনকার এই ছোঁড়ার রুচি কি এক হবে? যে বস্তু তার প্রিয় ওর কাছে হয়তো তা মূল্যহীন। ছেলেটা এই বয়সেই চোখে ধুতরো ফুল দেখতে রাজি হবে কি? বিল্বফলের জন্যেও সাধ করে হাত বাড়াবে না নিশ্চয়?
মাথায় হাত দিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। কূল-কিনারা পান না কিছু।
হঠাৎ নিজের কপালের চাঁদে তাঁর হাত ঠেকে যায়। হাতে যেন চাঁদ পান তখন।
‘এই চাঁদ?’ তিনি উচ্ছ্বসিত হন– ‘এই চাঁদখানা তুমি পেতে চাও নিশ্চয়? এমন চাঁদ পাবার সাধ হয় না তোমার?’
প্রস্তাবটা শুনে মুক্তিপদ নাক সিঁটকোয়। চাঁদ নিয়ে সে কী করবে? মা যেমন খোঁপায় চুলদের আটকে রাখার জন্য চিরুনি লাগান, শিবঠাকুর তেমনি নিজের জটাজূট সামলাতে ঐ চাঁদটাকে লাগিয়েছেন।
মুক্তিপদর তো ঝাঁকড়া চুলের বালাই নেই, দিব্যি ব্যাক-ব্রাশ চুল তার। চাঁদকে মাথায় করে রাখবার শখ নেইকো মোটেই। চাঁদ না হয়ে চন্দ্রপুলি হলে না হয় দেখা যেত।
‘ও তো আধখানা চাঁদ, ও নিয়ে আমি কী করব? আপনি বুঝি আমায় অর্ধচন্দ্র দিচ্ছেন? ঘুরিয়ে অপমান করছেন আমায়?’ ফোঁস করে ওঠে সে– ‘আপনি সোজাসুজিই বলতে পারতেন, আমার মন্দির থেকে বেরিয়ে যাও।’
‘না না। তা বলব কেন? তা কি বলতে আছে?’ শিবঠাকুর শশব্যস্ত হন– ‘এত বড় ভক্ত তুমি আমার। তোমাকে আমি অমন কথা বলতে পারি কখনো? ভক্তাধীন ভোলানাথ, শোননি নাকি কথাটা?’
‘তাই বলুন!’
‘আমি ভাবছিলাম চাঁদের টুকরোটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে তুমি দেখতে যদি একবারটি। আর যদি তোমার পছন্দ হত…’
‘চাঁদে হাত দিতে যাব কেন আমি? আমি কি বামন নাকি যে…? বামনরাই তো চাঁদের দিকে হাত বাড়ায়। আমি বেশ ঢ্যাঙা, দেখছ না? এর মধ্যেই পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি। বাবা বলেছেন, আরো আমি ঢ্যাঙা হব। আমাদের বংশে সবাই নাকি তালগাছ!’
‘তা হলে তো তুমি এমনিতেই চাঁদ পাবে। তালগাছের মাথাতেও চাঁদ থাকে। দেখা যায় প্রায়। দেখোনি তুমি?’
‘পুকুরের জলের মধ্যেও দেখেছি। ডোবার মধ্যেও আবার।’
‘চাঁদের সঙ্গে আমাকেও তুমি ডোবালে দেখছি! ভারি ফ্যাসাদে ফেললে আমায়। বর দেব বলে কথা দিয়েছি, অথচ কিছুই তোমায় দিতে পারছি না। কিছুই তুমি চাও না। অথচ দিতেই হবে আমায় কিছু। না দিয়ে উপায় নেই। নইলে আমার কথাটা মিথ্যে হয়ে যায়। মিথ্যে কথা আমি বলি না আবার। কী মুশকিলে যে পড়লাম! আচ্ছা, তুমি কি কিছু খেতে চাও?’
খাবারের কথায় তার উৎসাহ দেখা দেয়– ‘কী খাওয়াবেন বলুন?’
‘কী খাওয়ানো যায় তোমায় ভাবচি তাই।’ শিবঠাকুর বলেন– ‘সত্যি বলতে, আমাকেই সবাই ভোগ দেয়, আমি কখনো কাউকে ভোগ দিইনি কোনো। এমনকি তোমার ওই পার্বতী ঠাকরুনকেও না। তোমার ভোগে কী লাগতে পারে ভেবে দেখি এখন…।’ তিনি ভাবতে থাকেন।
‘তারকেশ্বরের ডাব?’ হাতের কাছে প্রথমেই তিনি ডাবটা পান, সেটাই পাড়েন সবার আগে।
‘ডাব? ডাব কেন? আপনার সঙ্গে আমার তো আড়ি হয়নি যে ডাব দিয়ে ভাব পাতাতে হবে?’
‘তা হলে বৈদ্যনাথধামের প্যাঁড়া?… কাশীর মালাই-লচ্ছি? কৈলাসের ভাং?’
‘ভাংটা কী জিনিস?’ জানতে চায় মুক্তিপদ।
কিন্তু মহাদেব ওর বেশি ভাঙতে যান না। ছোট্ট ছেলের কাছে নেশার কথা পাড়াটা ঠিক হবে না তাঁর মনে হয়।– নন্দী ভৃঙ্গী ঘোঁটে, তারাই বানায়, তারাই জানে কী জিনিস।
তারপর ঘুরিয়ে বলেন কথাটা ‘ভাং মানে, এই সিদ্ধি আর কি– শুদ্ধ ভাষায়। তুমি কি সিদ্ধিলাভ করতে চাও?’
‘একদম না। ও তো সাধক লোকেরা চায়। আমি কি সাধক? যোগী ঋষি আমি? তাহলেও শুনি তো–‘
‘আমি খাই কেবল। মানে, আমি পান করি মাত্র।’
‘খেতে কেমন? সিরাপের মতন কি? আখের রস যেমনধারা হয়ে থাকে? খেতে মিষ্টি হলে দিতে পারেন আমায়।’
‘না, তা খেয়ে তোমার কাজ নেই। পানীয় তো আর খাদ্য নয়। ওতে পেট ভরে না। তোমাকে আর কী দেওয়া যায় দেখছি…’ মনে মনে তিনি দিগ্ধিদিক ঘোরেন, যে খাবারগুলো তার দিব্যনেত্রে দেখতে পান, আউড়ে যান…
‘মালদেহের খাজা খাবে? কেষ্টনগরের সরভাজা? বর্ধমানের মিহিদানা? রানাঘাটের ছানার জিলিপি? জনাইয়ের মনোহরা? পাঁশকুড়োর অমৃতি? নাটোরে দেদোমন্ডা…?’
‘গন্ডা গন্ডা?’ মুক্তিপদ বাধা দিয়ে জানতে চায়।
‘যত চাও! বাগবাজারের রসগোল্লা? ভীমনাগের সন্দেশ?…’ শিবঠাকুরের ফিরিস্তি আর ফুরোয় না: ‘চাই তোমার? কোনটা চাই বলো আমায়? না, সবগুলোই চাও তুমি?’
‘আমার জন্যে হয়রান হয়ে ঘুরে ঘুরে আপনি যোগাড় করবেন তা আমি চাই না, আপনার হাতের কাছে যা আছে তাই আমায় দিন।’
‘হাতের কাছে? পার্বতী দেবীর ঐ স্বর্ণমুকুটটা চাও বুঝি?’ তিনি দেবীর দিকে হাত বাড়ান।
‘না না। সোনার মুকুট নিয়ে আমি কী করব? ওটা তো পরাও যাবে না। পরতে গেলে লাগবে আমার মাথায়। তা ছাড়া মুকুট পরে বেরুলে পাড়ার ছেলেরাই-বা বলবে কী?’
‘তা হলে কী তোমার চাই বলো তাই।’
‘আপনার মাথার ওপরে ঐ যে ঘণ্টা। ওটাই আমি চাই– ওইটে আমায় পেড়ে দিন।!’
‘বাঁচালে!’ বলে হাঁপ ছেড়ে মহাদেব ওর হাতে ঘণ্টাটা তুলে দেন। দিয়েই অন্তর্ধান হন।
মুক্তিও ঘণ্টাটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসে।
ঘণ্টাটা তাকে কষ্ট করে বাজাতেও হয় না। ওর লাফঝাঁপের দাপটে সেটা আপনিই বাজতে থাকে।
0 coment�rios: