চাষীর একটি মাত্র মেয়ে। বড়ই আদরের। মেয়েটি একদিন বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছে, তার যেন বিবাহ হইল। তারপর একটি সুন্দর ফুটফুটে ছেলে হইল। হঠাৎ জ্বর হইয়া ছেলেটি মারা গেল। যেই এই কথা ভাবা অমনি মেয়েটি আছাড়ি পাছাড়ি করিয়া কাঁদিতে লাগিল, "ওরে আমার সোনারে! -ওরে আমার মানিকরে! তুই আমাকে ছাড়িয়া কোথায় গেলিরে।"
মেয়ের মা আসিয়া মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে, “খুকী তুই কেন কাঁদিতেছিস বল।" মেয়ে যখন মাকে সকল কথা বলিল, শুনিয়া মাও ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে লাগিল।
কান্না শুনিয়া চাষী বাড়ি আসিল। না জানি কি হইয়াছে। বউ আর মেয়ে চাষীকে দেখিয়া আরও জোরে জোরে কাঁদিতে লাগিল। চাষী যতই জিজ্ঞাসা করে তোমরা কেন কাঁদিতেছ, তাহারা ততই চিৎকার করিয়া কাঁদে। তখন চাষী ধমক দিয়া বলিল, “কেন কাঁদিতেছ শিগগীর বল।" তখন চাষীর বউ বলিল, “আমাদের মেয়ের তো বিবাহ হইবে। তখন তার কোলে একটি ফুটফুটে ছেলে হইবে। জ্বর হইয়া ছেলেটি যদি মরিয়া যায় সেই জন্য আমরা কাঁদিতেছি।"
সমস্ত শুনিয়া চাষী বলিল, “আমাদের মেয়ের এখনও বিবাহ হয় নাই। বিবাহের পরে তার ছেলে হইবে কি না, তাও কেহ জানে না। আর সেই ছেলে যে জ্বর হইয়া মরিবে তাও কেহ বলিতে পারে না। তোমাদের মতো এমন বোকা কোথায়ও দেখি নাই। এখন কান্না থামাইয়া ভাত রাঁধ। আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছে।"
চাষীর বউ ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, "বেশ সুখে আছ তুমি। বলি ও মুখপোড়া! কোন মুখে তুমি ভাত গিলিবে? ছেলেটি যদি মারা যায় তবে বুড়ো বয়সে কে আমাকে, আমাদের মেয়েকে আর তোমাকে কামাই করিয়া খাওয়াইবে?"
বউ আর মেয়ে আবার কান্না আরম্ভ করিল। কেহই ভাত রাঁধিতে গেল না ।
তখন চাষী বলে, “তোমাদের মতো এমন বোকা লোক লইয়া ঘর করা ঝকমারি। এই আমি দেশ ছাড়িয়া চলিলাম। যে দেশে তোমাদের মতো বোকা লোক নাই সেই দেশে যাইয়া বাস করিব। যদি এমন দেশ খুঁজিয়া না পাই তবে ফিরিয়া আসিব। নতুবা এই আমার শেষ বিদায়।"
সত্য সত্যই চাষী বাড়ি হইতে বাহির হইল। যাইতে যাইতে সে এক দেশে যাইয়া দেখে, নদীর ধারে লম্বা একটি কাঠ লইয়া বহুলোক টানাটানি করিতেছে। চাষী তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা এই কাঠ লইয়া টানাটানি করিতেছ কেন?" তাহাদের মধ্যে একজন বলিল, আমাদের রাজা এই নদীতে একটি পুল তৈরি করিতে হুকুম দিয়াছেন। কিন্তু এই কাঠখানা নদীর এপারে ওপারে নাগাল পায় না। তাই উহা টানিয়া লম্বা করিতেছি। আজ সাতদিন হইতে আমরা এই কাজ করিতেছি। যত মজুর কাঠ টানিতে আসে রাজা তাহাদের বেতন দেন আর বলেন, “যত টাকা লাগে আমি দিব, কিন্তু কাঠ টানিয়া লম্বা করা চাই ।”
চাষী সমস্ত শুনিয়া রাজসভায় যাইয়া বলিল, “মহারাজ! আপনার লোকজন যতই টানাটানি করুক, কাঠ টানিয়া লম্বা করিতে পরিবে না। পুলও তৈরি হইবে না। আমি যাহা যাহা চাই যদি দেন তবে সাতদিনের মধ্যে আমি পুল তৈরি করিয়া দিতে পারি।"
রাজা বলিলেন, “বেশ, তুমি যাহা চাহিবে তাহাই পাইবে। পুল তৈরি করিয়া দাও, তোমাকে বকশিশ করিব।”
চাষী রাজার লোকের নিকট হইতে কাঠ, লোহা আর চুন, সুরকি লইয়া বহু রাজমিস্ত্রী খাটাইয়া সাত দিনের মধ্যে পুল তৈরি করিয়া দিল। রাজা তখন খুশী হইয়া চাষীকে হাজার এক টাকা বকশিশ করিলেন। চাষী মনে মনে ভাবিল এটাও বোকার দেশ। সুতরাং চাষী সে দেশ ছাড়িয়া আর এক দেশে গেল ।
সেই দেশের রাজবাড়িতে যাইয়া চাষী দেখিতে পাইল, হাজার হাজার জেলে জাল ফেলিয়া কি যেন একটি ঘরের মধ্যে ফেলিতেছে। তাহাদের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া চাষী জানিল যে, দেশের রাজা না থাকায় ঘরের মধ্যে অন্ধকার। তাই রাজা হুকুম করিয়াছেন, বাহির হইতে আলো জালে আটকাইয়া ঘরের মধ্যে ফেলিয়া দিতে। হাজার হাজার জেলে প্রায় দুই মাস এই কাজ করিতেছে। কিন্তু ঘরে এখনো আলো হয় নাই। রাজা তাহাদের দ্বিগুণ বেতন দিয়া বলিয়াছেন, আরও যত লোক দরকার কাজে লাগাও। বাহির হইতে আলো আনিয়া ঘর আলো করা চাই।"
চাষী তখন রাজার কাছে যাইয়া বলিল, “মহারাজা ঝাকি জাল আর খেপলা জাল লইয়া যতই বাহিরের আলো ঘরে ফেলিতে চেষ্টা করিবেন কিছুতেই ঘর আলো হইবে না। আমাকে যদি হুকুম করেন আমি ঘর আলো করিতে পারি।"
রাজা বলিলেন, “বেশ! তা যদি করিতে পার আমি তোমাকে হাজার এক টাকা বকশিশ করিব।"
চাষী তখন রাজমিস্ত্রী লইয়া রাজার ঘরে অনেকগুলি জানালা দরজা করিয়া দিল। রাজা ঘরে যাইয়া দেখিলেন, ঘর আলোতে ঝলমল করিতেছে। রাজা খুশী হইয়া চাষীকে হাজার এক টাকা বকশিশ করিলেন। চাষী ভাবিল, “এটাও বোকার দেশ। এদেশেও থাকা চলিবে না।" চাষী সে দেশ ছাড়িয়া আর এক দেশে গেল।
পথে যাইতে যাইতে চাষী দেখে দুইটি হিন্দু মেয়ে কথা বলিতে বলিতে আগে আগে চলিয়াছে। তাহাদের সঙ্গে একটি ছাগল ।
তাহারা একজন অপরকে বলিতেছে, “দেখ বোন, আমার এই ছাগলের নাম রাখিয়াছি রাম। রামকে যেদিন কিনি সেদিন হইতেই আমাদের অবস্থা ভালো হইতে লাগিল। আমার স্বামী এখন ব্যবসা করিয়া লক্ষ টাকার মালিক।"
এই কথা শুনিয়া চাষী সেই স্ত্রীলোকটির সামনে যাইয়া পায় হাত দিয়া প্ৰণাম করিয়া বলিল, “মাসীমা! আমি আপনার বোনপো। আপনি কোথায় যাইতেছেন ?" একটি ভালো পোশাক পরা লোক তাকে মাসীমা বলিয়া ডাকিয়াছে। স্ত্রীলোকটি আনন্দে গদগদ হইয়া গেল। সে খুব স্নেহের সঙ্গে বলিল, “এই যে বোনপো! নদী হইতে রামকে স্নান করাইয়া বাড়ি ফিরিতেছি।”
চাষী বলিল, “মাসীমা, রামের বড় ভঅই শ্যাম আমার কাছে আছে। আগে আমার অবস্থা বড়ই খারাপ ছিল কিন্তু শ্যামকে কেনার পর ক্রমেই আমার অবস্থা ভালো হইতেছে। এখন আমি লক্ষ টাকার মালিক ৷”
মাসী বলিল, “আমার রাম যখন আমাদের এত টাকা করিয়া দিয়াছে, তার বড় ভাই যে তোমার ভাগ্য ফিরাইয়াছে এতে আর আশ্চর্য কি!"
চাষী বুঝিল মাসী তাহাকে বিশ্বাস করিয়াছে। সে তখন আরও কাছে যাইয়া বলিল, “মাসীমা! কাল আমার শ্যামের বিবাহ ঠিক করিয়াছি। কিন্তু শ্যাম বলিয়াছে, অমুক দেশে আমার ছোট ভাই আছে। তাকে যদি আনিতে পার তবেই আমি বিবাহ করিব। নতুবা কিছুতেই আমি বিবাহ সভায় যাইব না। এখন আমি বড়ই মুস্কিলে পড়িয়াছি। এদিকে বিবাহের জন্য অলঙ্কার পত্রও গড়াইয়াছি। লোকজনও নিমন্ত্রণ করিয়াছি। কিন্তু ছোট ভাই রামকে ছাড়া শ্যাম কিছুতেই বিবাহ করিতে রাজী হয় না। আপনি যদি এক দিনের জন্য আপনার রামকে আমার সঙ্গে দেন, বিবাহের পর কালই আমি রামকে ফিরাইয়া দিয়া যাইব ।”
মাসী বলিল, “তা বাছা! লইয়া যাও। কিন্তু কালই রামকে লইয়া আসিও। রাম আমাকে ছাড়া এক দণ্ডও থাকিতে পারে না।"
চাষী কহিল, “সেকথা কি আর বলিতে! কাল আমি রামকে লইয়া আসিব ।" মাসীর হাত হইতে ছাগলের দড়ি ধরিয়া কিছুদূর যাইয়া চাষী আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “মাসীমা! একটা কথা বলিব। কিছু মনে করিবেন না। রাম তো বিবাহের নিমন্ত্রণে যাইবে! আমনি খালি গায়ে যদি যায় লোকে কি বলিবে। আপনার হারছড়া যদি রামের গলায় পরাইয়া দেন, দেখিয়া লোকে আপনার তারিফ করিবে।" মাসী তখন অপর স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞাসা করিল, “বল তো বোন কি করা যায় ?"
চাষী তখন নিজের পকেট হইতে দুই হাজার টাকা দেখাইয়া বলিল, “আমাকে বিশ্বাস করিতেছেন না ? দেখুন, আমার কত টাকা আছে! আমি গরীব লোক না।" অপর স্ত্রীলোকটি বলিল, “এ লোকটির কথাবার্তা এত ভালো! একে বিশ্বাস করা যায়।"
মাসী তখন হারছড়াটি খুলিয়া ছাগলের গলায় পরাইয়া দিল। চাষী ছাগলের দড়ি ধরিয়া টানিতে টানিতে সামনের পথে আগাইয়া চলিল। অজানা লোকের সঙ্গে ছাগল কি যাইতে চাহে। সে এদিকে ঘাস দেখিয়া মুখ দেয়, ওদিকে মাঠ দেখিয়া ছুট দেয়। বিরক্ত হইয়া চাষী ছাগলের গলা হইতে হারছড়াটি খুলিয়া লইয়া তাহাকে বনের মধ্যে ছাড়িয়া দিল। তারপর হনহন করিয়া পথ চলিতে লাগিল ।
এদিকে মাসী বাড়ি ফিরিতে তার স্বামী জিজ্ঞাসা করিল,“আজ স্নান করিতে এত দেরি হইল কেন ? আমি এদিকে ক্ষুধায় মরিয়া যাইতেছি।”
- এক গাল হাসিয়া মাসী বলিল, “পথে বোনপোর সঙ্গে দেখা হইল। তাহার সঙ্গে কথাবার্তা বলিতে দেরী হইয়া গেল! রামের ভাই শ্যামের বিবাহ কি না ! তাই রামকে লইতে আসিয়াছিল।"
স্বামী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার গলার সোনার হারছড়াটি তো দেখিতেছি না?"
বউ বলিল, “রামের বড় ভাইয়ের বিবাহ। সেখানে রামকে তো খালি গায় পাঠাইতে পারি না। তাই আমার গলার হারছড়া রামের গলায় পরাইয়া দিয়াছি। তুমি ভাবিও না। বোনপো কালই রামকে দিয়া যাইবে।”
স্বামী রাগিয়া কহিল, “তোমাকে যখন আমি বিবাহ করি তখন তো তোমার কোনো বোনপোর কথা শুনি নাই। এখন বোনপো আসিল কোথা হইতে ? তার নাম কি ? বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?”
বউ বলিল, “না তো! সে কথা তো জিজ্ঞাসা করি নাই।”
স্বামী বলিল, “তোমার মতো বোকা কোথাও দেখি নাই। সে লোকটা কোন দিকে গিয়াছে ?"
বউ বলিল, “সে উত্তরের দিকের রাস্তা দিয়া গিয়াছে।" স্বামী তখন উত্তরের রাস্তা দিয়া ঘোড়া ছুটাইয়া চলিল। যাইতে যাইতে পথের মধ্যে চাষীকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “দেখ ভাই! এই পথ দিয়া একটি লোককে ছাগল লইয়া যাইতে দেখিয়াছ ? সেই ছাগলের গলায় একটি সোনার হার ।"
চাষী বলিল, “দেখিয়াছি, সে এই পথ ঘুরিয়া ডাইনে গেল, তারপর বাম দিকে চলিল। আপনি একা গেলে তাহাকে ধরিতে পারিবেন না। আমার পথ-ঘাট সবই জানা আছে। এক কাজ করুন। আপনি এখানে দাঁড়ান। আমি ঘোড়া ছুটাইয়া তাড়াতাড়ি যাইয়া তাহাকে ধরিয়া লইয়া আসি ।"
লোকটি চাষীকে অনেক ধন্যবাদ দিয়া ঘোড়াটি তাহাকে দিল ।
চাষী ঘোড়ায় চড়িয়া দিল ছুট। যাইতে যাইতে সে ভাবিল, “সকল দেশেই তো আমার বউ-এর মতো বোকা লোক আছে। বোকা নাই এমন দেশ যখন কোথাও পাইলাম না, তখন বউ-এর কাছেই ফিরিয়া যাই।”
0 coment�rios: