পিতার মৃত্যুর পরে শাহযাদা খুব ধুমধাম করে সিংহাসনে বসলো। রাজা বাদশার ঘরে ছেলে তার উপর একমাত্র ছেলে সে, বাদশাহ বেগমের খুব আদর যত্নেই তাঁর দিন কাটছিলো। বাদশাহী হাতে পেয়ে খুব আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠল। অনেক ইয়ার বন্ধু তার জুটলো। দু’হাতে ধন-দৌলত সে উড়াতে লাগল। তারপর বছর শেষ না হতেই বুঝতে পারলো ধন ভান্ডার শূন্য হয়ে এসেছে।
অতঃপর আমোদ-আহ্লাদে পড়লো ভাটা। ইয়ার বন্ধুর দল একে একে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়লো। শাহযাদা পড়লো ভাবনায়!
একদিন সে তার ছোট বোনকে ডেকে বললোঃ শাহীন, আমাদের ধন-দৌলত হীরা-জহরৎ কিছুই তো আর নেই। আজ আমি বাদশাহ হয়েও পথের কাঙাল। কিন্তু আমাদের এই কথা দেশের লোকেরা যেন জানতে না পারে। প্রজারা আমাদের এই অনটনের কথা জানতে পারে তবে ভারী লজ্জার কথা।
শাহীন জিজ্ঞাসা করলো তাহলে তুমি কি করতে চাও বলো?
শাহযাদা বললোঃ আমি ভেবেছি শাহীন, এবারে এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।
শাহীন কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলো। তারপর ধীরে ধীরে বললোঃ রাজ্য ছেড়ে গেলে দুশমনেরা তোমার সিংহাসন দখল করে বসবে।
শাহাযাদা বললঃ প্রধান উজীরের উপরে রাজ্যের ভার দিয়ে যাবো। আমার অবর্তমানে তিনিই রাজ্য চালাবেন।
শাহীন বললঃ তবে চলো, কিছুক্ষনের জন্য বইরে যাই। এ দেশ সে দেশ বেড়ালে বইরের জগতের অনেক কিছু আমরা জানতে পারবো। কিছুদিন পরে রাজ্যের শ্রী আর সুখ-সমৃদ্ধি ফিরে এলে আমরা আবার আসবো।
শাহীনের কথা শুনে শাহযাদা খুশি হলো। বললঃ তোমার পরামর্শ আমার পছন্দ হয়েছে। চলো, আজ রাত্রেই আমরা চলে যাই।
শেষ রাত্রিতে শাহযাদা ছোটো একটা পুটুলি আর শাহীনকে সঙ্গে নিয়ে রাজ-প্রসাদ থেকে বের হলো। পূর্ণিমার রাত্রি চারদিকে রূপালী জ্যোৎস্না ঝকঝক করছে। দু’জনে সম্মুখের পথ ধরে হেঁটে চললো।
যেতে-যেতে-যেতে যেতে অনেক দূর। পূর্ণিমার চাঁদ অস্ত গেল। পাখিরা গাছে গাছে কলরব করতে শুরু করলো। পূব আকাশ রাঙা করে সূর্য উঠলো। শাহাযাদা আর শাহীন তবু চলেছে--আর চলছে। চলতে চলতে নিজেদের রাজ্যের সীমানা ছেড়ে তারা অপর এক বাদশাহের সীমানায় গিয়ে হাজির হলো।
ধীরে ধীরে সূর্য উপরে উঠে এলো। দুপুরের রোদ মাথার উপরে ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। ক্ষুধায় আর পিপাসায় শরীর অবশ হয়ে এলো। অদূরে একটা খাল দেখতে পেয়ে শাহযাদা বললো, আমার বড্ডো তেষ্টা পেয়েছে শাহীন--খাল থেকে পানি খেয়ে আসি।
শাহীন বাধা দিয়ে বললঃ খালে পানি খুব নোংরা হবে।
শাহঙাদা বললঃ তা হোক শাহীন, জীবন রক্ষা করা এখন দায় হয়ে উঠেছে।
এই কথা বলে শাহযাদা ছুটে গেল। খালের ধারে দু’হাতে আঁজলা ভরে অনেকক্ষণ ধরে পানি পান করলেঅ। কিন্তু কি আশ্চর্য, শাহযাদা দেখতে দেখতে তৎক্ষণাৎ একটা হরিণ হয়ে গেল।
ভাইয়ের এমন চেহারা বদল হতে দেখে শাহীন ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো। দুঃখে আর ভাবনায় সে কেঁদে ফেললো।
শাহাযাদা যদিও হরিণের রূপ পেয়েছিল তথাপি মানুষের মতো কথা বলেলো, কেঁদো না বোন, সবই আমদের নসিব। খোদাকে স্মরণ করো। তিনি আমাদের রক্ষা করবেন। ঐ যে দূরে পাহাড়ের গায়ে ঝরণা দেখছো, ঐখানে গিয়ে আমরা বিশ্রাম করবো।
হরিণটাকে সঙ্গে নিয়ে শাহীন সেই ঝরণার ধারে গিয়ে হাজির হলো। সেই খানে ছিল এক মস্ত বড় গাছ।
হরিণ বললঃ শাহীন, তুমি এই গাছে উঠে যাও--একটা ডালের উপরে বসে অপেক্ষা করো--আমি চারদিকে খুঁজে দেখি, কোথাও কোন কিছু খাবার পাই কি না।
শাহীন গাছের উঁচু ডালে বসলো। হরিণটা গাছ-পাতার আড়ালে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
শাহীন সেই ডালের ওপরে একা বসে রইলো। তার খুব ভয় করতে লাগলো। ছিলো সে বাদশাযাদী। রাজপ্রাসাদের রাতদিন শত শত বাঁদী-নফর আর লোকজনে গমগম করেছে। এমন একা একা কোনদিন তাকে থাকতে হয়নি। আজ এই বিজন বনে লোকজনের চিহ্ন মাত্র নেই। এখানে সে একা অসহায়। শাহীনের দু’চোখ থেকে দর দর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
অনেকক্ষণ পরে হরিণটি ফিরে এলো। অনেক ফলমূল সে এনেছে তার সিঙের সঙ্গে বাঁধিয়ে। শাহীন গাছ থেকে নেমে এলো। ভাইবোন মিলে সেগুলো খেয়ে ফেললো।
এমনি করে তাদের দিন কাটতে লাগলো।
সেই গাছের পাশে ছিল একটা কুয়ো। প্রতি মাসে একদিন ঐ কুয়োতে বাদশাহের ঘোড়াগুলিকে পানি পান করাতে আনা হতো। মাসের সেই নির্দিষ্ট দিনে সহিসেরা অনেকগুলো ঘোড়াকে কুয়োর পাশে নিয়ে এলো। পানি পান করতে এসে ঘোড়াগুলো থমকে গেল।, কারণ, পানির মধ্যে শাহযাদী শাহীনের ছায়া পড়েছিলো-- তাই দেখে তারা কুয়োতে মুখ দিতে সাহস পেল না।
সহিসেরা মনে করলো, পানি হয়তো নোংরা তাই ঘোড়াগুলি পানি পান করছে না। তারা অগত্যা সেই পানিটা ফেলে দিয়ে ঝরণা থেকে পনি এনে কুয়ো পূর্ণ করলো। তথাপি ঘোড়াগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
ঘোড়াদের এই কান্ড দেখে সহিসেরা খুব ভাবনায় পড়লো। আজ ঘোড়াগুলো এমন করছে কেন! তারা নিরুপায় হয়ে ছুটলো বাদশাহকে খবর জানাবার জন্যে।
সহিসদের নিকট থেকে সংবাদটা পেয়ে বাদশাহ বললেনঃ নিশ্চয়ই পানিটা দুর্গন্ধযুক্ত আর দূষিত- নইলে তৃষ্ণার সময়ে তারা পানি পান করবে না কেন!
সহিসেরা জবাব দিলে, জাঁহাপনা, পানি আমরা বদল করে দিয়েছি তবু ঘোড়াগুলো পানি পান করছে না। হুকুম দিন, আমরা তাদের রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনি।
বাদশাহ বললেনঃ না, তোমরা আবার যাও। গিয়ে কুয়োর চারিদিকে দেখ, কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। তা নইলে ঘোড়াগুলো ভয় পাবে কেন!
বাদশাহের নির্দেশে সহিসেরা ফিরে গেল। তারা আশেপাশে এবং চারদিকে সন্ধান করে সহসা দেখতে পেলো, একটি পরমা রূপবতী কন্যা কুয়োর পাশের গাছের ওপরে বসে আছে। তারা তাড়াতাড়ি গিয়ে খবরটা বাদশাহকে জানালো। বাদশাহ তৎক্ষণাৎ ঘোড়ায় চড়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। গাছের ওপরে শাহযাদীকে দেখতে পেয়ে বললেনঃ তুমি কে গো অজানা মেয়ে? এসো, নেমে এসো। চলো আমার সঙ্গে রাজপুরীতে।
শাহযাদী শাহীন বাদশাহের কথায় রাজী হলো না। বললোঃ না, জাঁহাপনা, আমি কোথাও যাবো না।
বাদশার অনুনয় করে বললেনঃ তুমি নেমে এস কন্যা, তোমাকে অনেক সোনা-দানা হীরা-জহরৎ দেবো।
শাহীন তবুও সম্মত হলো না। বাহশাহ ক্ষুণ্ন হয়ে রাজপ্রসাদে ফিরে গেলেন। তিনি চাকর-নফরদের হুকুম করলেন কুয়োর পাশের ঐ গাছটা এক্ষুনি কেটে ফেলতে।
আদেশ পেয়ে নফর, চাকরেরা তখুনি কুড়ুল নিয়ে ছুটলো। গাছের কাছে গিয়ে তারা শুরু করলো ঠক্ ঠকা ঠক্--ঠক্ ঠকা ঠক্--ঠক্ ঠকা ঠক্--
কাটতে কাটকে সন্ধা হয়ে এলা। গাছ কাটা তবু শেষ হয়না। তারা ভাবলো, পরের দিন সকাল বেলা এসে বাকিটুকু কেটে গিাছটি মাটিতে ফেলবে।
চাকর, নফরেরা চলে যেতেই হরণিটা বন থেকে বের হয়ে এলা। শাহীনকে জিজ্ঞাসা করলো, বাদশাহের লোকেরা গাছ কাটছে কেন?
শাহীন জবাব দিলোঃ আমি গাছ থেকে নামছি না বলে বাদশাহ গাছ কাটার হুকুম দিয়েছেন।
হরিণ বললোঃ আমি নিষেধ করছি, শত প্রলোভনেও গাছ থেকে নেমো না।
তারপর গাছের কাটা অংশটায় সে জিভ দিয়ে চাটতে আরম্ভ করলো। কিছুক্ষনের মধ্যে গাছটা পূর্বের মতো হয়ে গেল। কাটার আর কোন চিহ্নই রইলো না।
পরের দিন নফররা এসে দেখতে পেল, গাছের গায়ে কাটার দাগ একটুও নেই। তারা হয়ে গেল। এমন অদ্ভুত ব্যাপার তারা জীবনে দেখেনি। তারা এ ওর সুখের দিকে তাকাতে লাগলো। তারপর তারা আবার গাছ কাটা আরম্ভ করলো।
দু’জনে সারাদিন ঠুক্ ঠাক করে গাছটাকে কেটে শেষ করতে পারলো না। সন্ধার কালো ছায়া এমে এলা-সেই সময়ে তারা থামলো। ভাবলো, পরদিন এসে বাকিটুকু কাটবে।কিন্তু ভোরবেলা এসে অবাক হয়ে দেখতে পেলো, গাছটার গায়ে কান কাটা চিহ্ন নেই। তারা সেদিন আর কুড়ুল হাতে নিল না- ছুটে গিয়ে বাদশাহের কাছে খবরটা জানালো। বাদশাহ তৎক্ষণাৎ সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, গাছের উপরে যে রূপবতী কন্যা আছে তাকে নিচে নামাতে হলে একজন যাদুকরী রমণীর সাহায্য নিতে হবে। নতুবা নাগাল পাওয়া যাবে না।
বাদশাহ চারিদিকে লোক-লস্কর পাঠালেন সাত রাজ্যের সবচেয়ে সেরা যে জাদুকরী তাকে নিয়ে আসবার জন্য। চারিদিকে অনেক খুঁজে পেতে লোকজনেরা একজন বৃদ্ধা যাদুকরীকে বাদশাহের দরবারে এনে হাজির করলো।
বাদশা তাকে বললেনঃ ওগো যাদুকরী, এবারে দেখবো তোমার যাদুর বাহাদুরী। যদি তুমি মাহযাদীকে গাছ থেকে নিচে নামাতে পারো তা’হলে তোমাকে পাঁচশ মোহর বকশিশ দেবো।
বখশিশের কথা শুনে যাদুকরী খুব খুশি হলো। সে কুয়োর পাশে গিয়ে বসলো। শাহযাদী শাহীনের মন ভুলাবার জন্য নানারকম মিষ্টি কথা বলে নিচে আনবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু শাহযাদী তার কথায় একেবারেই কান দিলো না।
যারাদিন কেটে গেল। যাদুকরী নানরকম তুক তাক আর যাদুমন্ত্র পড়ে শাহযাদীকে বশীভূত করবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু সমস্তই বৃথা হলো। কোন মন্ত্র দ্বারাই কাজ হলো না।
সন্ধার অন্ধকার ঘন হয়ে এলো।
পরদিন যাদুকরী একজন বৃদ্ধা ভিখারিণীর ছদ্মবেশ ধরলো। একখানা লাঠি হাতে নিয়ে ঠক ঠক করতে করতে কুয়োর পাশ দিয়ে যেতে হোঁচট খাবার ভান করে উপুড় গয়ে পড়ে গেল। সেই যে পড়লো আর উঠার নাম নেই।
শাহযাদী বৃদ্ধা ভিখারিণীকে পড়ে যেতে দেখে খুবিই দুঃখিত আর ব্যাথিত হলো। তারপর যখন সে দেখতে পেলো, বৃদ্ধাটি পড়ে গেল- আর উঠলো না তখন আর সে স্থির থাকতে পারলো না। নিজের অবস্থার কথা ভুলে গেল। বৃদ্ধাকে ধরে তুলবার জন্য সে তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে এলো। এসে তাকে ধুরে তুললো। ঠিক সেই সময়ে বাদশাহ ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে এলেন। তারপর শাহযাদীকে ঘোড়ার উপরে উঠিয়ে নিয়ে রাজপ্রাসাদে গিয়ে হাজির হলেন।
কয়েকদিন কেটে যাবার পরে বাদশাহ প্রস্তাব করলেন, শাহযাদীকে তিনি বিয়ে করবেন। শাহযাদী বললোঃ আমার ভাই বনের মধ্যে হরিণ হয়ে আছে। তাকে আমার কাছে এনে দিতে হবে। তাকে না পেলে আমি বিয়ে করতে রাজী হবো না।
বাদশাহ সেই হরিণটিকে খুজে বের করবার জন্য সিপাহী পাইকদের হুকুম দিলেন। তারা তৎক্ষণাৎ হাতিয়ার, ফাঁদ আর জাল নিয়ে ছুটলো সেই বনের দিকে। অনেক খোঁজাখুঁজি অনেক মেহনত করে তারা সেই হরিণটিকে জালে আটকে ফেলে বাদশাহহের কাছে এসে হাজির করলো। বাদশাহ আদর করে হরিণটির গায়ে হাত বুলালেন তারপর শাহযাদীর নিকট পৌছে দিলেন। হরিণটিকে ফিরে পেয়ে শাহযাদীর খুমির সীমা রইল না। মহা হৈ চৈ আর আমোদ প্রমোদের মাঝে বাদশাহের সঙ্গে শাহীনের বিয়ে হয়ে গেল। বাদশাহের অন্দর মহলে একজন বাঁদী ছিল। সে ছিল যেমন কুৎসিৎ-তার মনটাও ছিলো তেমনি হিংসায় ভরা। বন থেকে কুড়িয়ে আনা একটা মেয়েকে বিয়ে করায় তার মন জ্বলতে লাহলো। সে এতকাল বাদশাহের রাজপুরীতে রয়েছে- সে হলো না বেগম- হলো কিনা পথ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটি মেয়ে! হিংসায় সে ছটফট করতে লাগলো। এই আপদটাকে দূর করতেই হবে।
সেইদিন থেকে সে নতুন বেগম শাহযাদী শাহীনের খুব বাধ্য আর অনুগত হয়ে সর্বদা তার কাছে কাছে থাকতে আরম্ভ করলো। বেগমের মুখ থেকে কথাটি বের না হতেই সে কাজটি করে দিয়ে তার খুব প্রিয় আর বিশ্বাসী হবার চেষ্টা করলো।
একদিন সন্ধার কিছু আগে শাহযাদী সেই বাঁদীটিকে সঙ্গে নিয়ে ফুলের বাগানের মধ্যে বেড়াচ্ছিল। গাছে গাছে নানান রঙের ফুল-- ফুলে ফুলে প্রজাপতি আর ভ্রমরের ভির। শাহযাদী অনেক রকমের ফুল তুলে বাঁদিটির হাতে দিলো। বললঃএ্গিুলি দিয়ে দু’ছড়া মালা গেঁথে আমারয় দিবি।
বাঁদীটি বললঃ জি আচ্ছা, বেগম সাহেবা। কিন্তু পুকুরের ওই কোণে শ্বেতপদ্ম ফুটে আছে। ওর কয়েকটা ফুল এই মালার সঙ্গে গাঁথলে চমৎকার দেখা যেত।
শাহযাদী তার কথা শুনে খুব খুশি হলো। তাড়াতাড়ি পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে সে নেমে গেল। তারপর নিচু হয়ে পদ্ম তুলবার জন্য যেই হাত বাড়িয়েছে অমনি বাঁদীটি পিছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে পানিতে ফেলে দিলো। পুকুরে ছিলো মস্ত বড়ো একটা বোয়াল মাছ। মাছটি এক বিরাট হাঁ করে শাহযাদীকে গিলে ফেলেলো।
বাঁদীটি চুটতে ছুটতে রাজপুরীতে ফিরে গেল। শাহযাদীর যে দামী পোশাক আর কাপড় ছিল তাই পরে সে বেগম সেজে রইলো।
সন্ধার পরে বাদশাহ অন্দর মহলে এলেন। তাঁকে দেখে বাঁদীটি খুব ঘোমটা টেনে বাদশাহের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
বাদশা জিজ্ঞাসা করলেন, আজ এত ঘেঅমটা দিয়েছো কেন বেগম।
বাঁদীটি উত্তর দিলো, দুপুর বেলায় রান্না করবার সময়ে মুখে আগুনের তাপ লেগেছে তাই মুখটা কালো হয়ে আছে। মুখে ওষুধ লাগিয়েছি। ওষুধে আলো বাতাস লাগানো নিষেধ--তাই ঘোমটা টেনেছি।
বাদশাহ তার কথা বিশ্বাস করলেন।
বাদশাহ ও বেগম সন্ধার পর একত্রে কৌচে এসে বসলে হরিণটি দু’জনের পাশে এসে দাঁড়াতো। বাদশাহ ও বেগমের হাঁটুর সঙ্গে গলাটা বার বার বুলাতে তাকতো। আজ বাঁদীটি লক্ষ্য করলো, হরিণটি বাদশাহের দেহের সঙ্গেই গলা আর মাথা বুলালো, কিন্তু তার কাছেও এলো না। বাঁদীটি মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলো। হয়তো বাদশাহ তাকে সন্দেহ করবেন। ধরা পড়লে তার গর্দান যাবে।
হরিণের এই ব্যবহার বাদশাহ লক্ষ করলেন না। তিনি শরবৎ পান করে অন্যত্র চলে গেলেন। বাঁদীটি হাফ ফেড়ে বাঁচলো। হরিণটিকে কিরূপে দূর করা যায় সেই কথা চিন্তা করতে লাগলো।
পরের দিন সকাল বেলা সে অসুখের ভান করে পড়ে রইল। অসুখের সংবাদ পেয়ে হেকীম সাহের ছুটে এলেন। বাঁদীটি তাঁকে তাঁকে বললোঃ হেকিম সাহেব, ঐ ছোটো হরিণটির কলিজা খাবার আমার খুব ইচ্ছে। আপনি বাদশাহকে বলবেন, বেগম সাহেবার খুব শক্ত ব্যাধি। ঐ হরিণটির কলিজা না খেলে তার অসুখ ভালো হবে না। এ কথা বলে হাকিমের হাতে সে অনেকগুলো মোহর দিলো।
সোনার মোহর পেয়ে হাকিম সাহেব খুশি হলেন। তিনি এসে বাদশাহের নিকটে বাঁদীর শেখানো কথা গুলো বললেন।
শুনে বাদশাহ চমকে উঠলেন। তিনি তাড়াতাড়ি বাঁদীটির কাছে এসে বললেনঃ হেকিম তো বড্ডো কঠিন কথা বলেছে। তোমার ভাইয়ের কলিজা তুমি কি করে খাবে?
বাঁদী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললোঃতাই তো ভাবছি জাঁহাপনা। কিন্তু অসুখের জন্য সবই করতে হয়। আমি যদি মরে যাই তবে হরিণের বা কি দশা হবে। তার জীবনের চেয়ে আমার জীবনের মূল্য বেশি।
বাদশাহ তখন কসাইদের হুকুম করলেন ছুরিতে ধার দেবার জন্য। বাহশাহের আদেশ তৎক্ষণাৎ পালিত হলো। কসাইরা ছুরি বের করে ধারদিতে আরম্ভ করলো।
হরিণ বুঝতে পারলো তাকেই হত্যা করবার এই আয়োজন। আর দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়- এই কথা ভেবে সে ছুটে চললো বাগানের দিকে। বাদশাহ মনে করলেন, হরিণটি হয়তো পালিয়ে যাবে, তাই তিনি তার পিছু নিলেন।
হরিণটি সেই পুকুরের পাড়ের গিয়ে বলতে লাগলোঃ
ছোট বোন শাহীণ মণি-
এখন বড় বিপদ গণি।
কসাই ছুরি দিচ্ছে ধার
প্রাণ মোর বাঁচে না আর।
উপায় কিবা কররেবা বলো!
বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো।
মাছের পেট থেকে শাহযাদী শাহীন জবাব দিলোঃ
শাহযাদা হরিণ ভাই
আমার কোন উপাই নাই।
মাছের পেটে আছি হেথায়
কোলে সোনার খোকা ঘুমায়।
বাদশাহকে মোর খবর দাও
যদি তুমি বাঁচতে চাও।
শাহযাদীর কথাগুলো বাদশাহ শুনতে পেলেন। তিনি গাছের আড়াল থেকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে হরিণটিকে কোল তুলে নিলেন। তারপর গম্ভীরভাবে প্রাসাদে ফিরে গেলেন। তিনি পাইক সিপাহীকে ডেকে হুকুম দিলেন, জেলেদের ডেকে আনো। পুকুরে জাল ফেলে রাঘব বোয়ালটিকে এখনি ডাঙায় তুলতে হবে।
সিপাহীরা তাৎক্ষণাৎ জেলেদের ডেকে আনলেন। জালে জালে পুকুরের পানি ছেয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেলেরা সেই মস্তবড় রাঘব বোয়ালটিকে ধরে ডাঙায় তুলে ফেললো। তারপর মাছটিকে তারা বাদশাহের মুমুখে এনে হাজির করলো।
বাদশাহের হুকুমে অতি সাবধানে মাছটিকে কাটা হলো। কাটতেই তার পেট থেকে বেরিয়ে এলো শাহযাদী। তার কোলে টুকটুকে খোকা। বাদশাহ খুব খুশি হয়ে খোকাকে কোলে তুলে নিলেন।
সেই রাঘব বোয়ালটার পেট থেকে রক্তের সঙ্গে ঘাসের মতো কি একটা সবুজ জিনিস বের হয়েছিলো--হরিণ সেটাকে খেয়ে ফেললো। সেই মুহূর্তে একটি অভাবনীয় কান্ড ঘটলো। হরিণটা দেখতে দেখতে একটা মানুষের আকার ধারণ করলো। হরিণকে মানুষ হতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।
শাহযাদী ছুটে এসে তার হাত ধরে বলেলোঃ ভাই, তোমাকে ফিরিয়ে পেয়েছি। আজ আমার কি ভাগ্য!
ভাই আর বোন আনন্দে দিশেহারা হয়ে গলে।
বাদশাহ সেই কুৎসিত বাঁদীটির সবকিছু চক্রান্ত বুঝতে পারলেন। তিনি দারুল রেগে সেই বাঁদীটির গর্দান নেবার হুকুম দিলেন।
তারপর?
তারপর শাহীন বেগমকে এবং চাঁদের মতো খোকাটিকে নিয়ে বাদশাহ মনে সুখে দিন কাটাতে লাগলেন। শাহযাদা তার বোন ও বাদশাহের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে গেল।
(সমাপ্ত)
0 coment�rios: