চিংড়ি আর ফড়িং। দুই বোন! যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী।
আঁকের ক্লাসে আমরা বসে থাকতুম ‘থ’ হয়ে। বিদ্যুতের মতো আঁক কষে যেত দুবোন। গেল সন ওদের ‘জন্মদিন’। আমরা ক্লাসের বান্ধবীরা প্রেজেন্ট নিয়ে গেলুম দেখতে। অঙ্কের মিস জামিলা মেহতাব আমাদেরও আগে এসে যোগ দিয়েছেন। মিস জানালেন, তিনি এসেছেন ম্যাজিক দেখাতে-আজকে এ জন্মদিনে।
ম্যাজিক? জামিলা আপা ম্যাজিক জানেন?
কিছুক্ষণ পর মিস গিয়ে দাঁড়ালেন হলের মধ্যিখানে। ডাকলেন, ‘বয়।’
একজন বয় আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে। ডাকতেই সে ভেতরে এসে কতগুলো জিনিস টেবিলে, আর মাটিতে একটা দাঁড়িপাল্লা রেখে গেল।
‘এদিকে এসো।’ জামিলা আপা আমাদের ডাকলেন।
আমরা গিয়ে দেখি, টেবিলের ওপর আটটা সোনার দুল চকচক করছে।
মিস বললেন, ‘আটটা দুল দেখছ তো? বিশেষ ফরমাশে তৈরি এগুলো। প্রতিটি দুলই অবিকল সমান ওজনের; একটি ছাড়া। সামান্য একটু খাদ মেশানো আছে বলে একটা দুল ওজনে একটু কম। বলো তো কোনটা?’
আমরা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করলুম। কী সুন্দর প্যাটার্ন! আটটাই অবিকল এক রকম। কোনটাতে যে খাদ আছে, বের করা শক্ত।
কী ভেবে চট করে চিংড়ি এসে সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আপা, আমি কিন্তু পারব।’ বলেই সে দাঁড়িপাল্লাটা তুলে নিলে! মজা দেখতে আমরা বসে পড়লুম।
দাঁড়িপাল্লাটা নিয়ে চিংড়ি আটটি দুলের চারটি রাখলে এ-পাল্লায় আর চারটি রাখলে ও-পাল্লায়। এখন যেদিকের পাল্লা ওজনে কম হলো বলে ওপরের দিকে উঠে গেল, বোঝা গেল খাদওয়ালা কম ওজনের দুলটা সেদিকেই আছে। কাজেই পাতলা দিকের দুল চারটি নিয়ে ফের পরীক্ষা চলল। দুটো এদিকে, দুটো ওদিকে রাখা গেল দাঁড়ির। যেদিকটার পাল্লা ওপরের দিকে ঝুঁকল, বোঝা গেল সেদিকটাতেই খাদওয়ালা দুলটা আছে। আবার সে দুটোকে নিয়ে পরীক্ষা চলল, একটা এদিকে, একটা ওদিকে। এবার যেদিকের পাল্লা ওপরের দিকে ঝুঁকল, স্পষ্ট বোঝা গেল, সে দুলটিই খাদওয়ালা। চিংড়ির বুদ্ধি দেখে সবাই খুশিতে হেসে উঠলাম।
মিস কিন্তু হাসলেন না। বললেন, ‘চিংড়ি, তুমি তো তিনবার দাঁড়ি ব্যবহার করেছ খাদওয়ালা দুলটা বের করতে। নয় কি?’
চিংড়ি বলে, ‘হ্যাঁ।’
‘তিনবার কেন? দুবারে কি পারা যায় না?’
চিংড়ি একটু বি্নিত হলো।
‘আপনি কি বলতে চান আপা, দুবার মাত্র দাঁড়ি ব্যবহার করে আটটা দুলের ভেতর থেকে খাদওয়ালা দুলটা বের করতে পারা যাবে?’
‘হ্যাঁ’
‘সে কেমন করে হবে, আপা? সে যে অসম্ভব!’
এতক্ষণ ফড়িং কোনো কথা বলেনি। সে যেন মনে মনে ভীষণ একটা চিন্তা করছিল। এখন সে এসে দাঁড়াল! বলল, ‘আপা, আমি পারব।’
‘পারবে? কবারে? দুবারে?’
‘দুবারে।’
আমাদের একজন বলল, ‘বোকা মেয়ে।’
‘দেখই না।’ বলে ফড়িং আটটা দুলের তিনটে রাখল দাঁড়ির এ-পাল্লায়, তিনটে ও-পাল্লায় আর বাকি দুটো রাখলে মাটিতে। দেখা গেল, দাঁড়িটা কোনো দিকেই হেলছে না। ফড়িং বলল, ‘এ থেকে পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, খাদওয়ালা দুলটা দাঁড়িতে নেই। মাটিতে আছে। নয় কি?’
আমরা সমস্বরে বললুম, ‘হ্যাঁ।’
তারপর মাটি থেকে দুল দুটো তুলে নিয়ে সে ফের চাপাল দাঁড়িতে-এদিকে একটা, ওদিকে একটা। যেদিকের পাল্লা ওপরের দিকে ঝুঁকল, সেদিকের দুলটিই খাদওয়ালা বোঝা গেল। কাজেই পরিষ্কার দেখা গেল, দুবারের বেশি দাঁড়ি ব্যবহার করতে হলো না।
আমরা বললুম, ‘কিন্তু?’
‘কিন্তু কী?’
‘দাঁড়ি ভাগ্যচক্রে সমান থাকাতে যেন তুমি বুঝতে পেরেছ মাটিতে আছে খাদওয়ালাটা। কিন্তু ফড়িং, দাঁড়ি সমান না-ও তো থাকতে পারত।’
‘তবে তো আরও মজা হতো’, বলল ফড়িং হেসে, ‘দাঁড়ি সমান না থাকলে নিশ্চয় একদিকে ঝুঁকত। বোঝা যেত, যেদিকটা ওপরের দিকে ঝুঁকছে, সে দিকটাতেই খাদওয়ালা দুলটা আছে। তারপর আমি করতুম কী? পাতলা দিকের দুল তিনটে নিয়ে ফের দাঁড়িপাল্লায় চাপাতুম-এদিকে একটা, ওদিকে একটা, আরেকটা রাখতুম মাটিতে। এখন যদি দাঁড়িপাল্লাটা হেলত, তবে বুঝতাম, যেদিকটা ওপরের দিকে হেলছে, সেদিকটার দুলটাই খাদওয়ালা। আর যদি কোনো দিকেই না হেলত, তবে বোঝা যেত যে মাটির দুলটিই খাদওয়ালা। নয় কি? কাজেই খাদওয়ালা দুলটা বের করতে কোনো সময়ই দাঁড়ি দুবারের বেশি ব্যবহার করতে হতো না।’
মেয়ের বুদ্ধি দেখে ফড়িংয়ের মা-বাবার তাক লেগে গেল। আমাদের তো আনন্দ আর ধরে না। এতক্ষণে মিস মেহতাব হাসলেন। বললেন, ‘দেখলেন তো আমার ম্যাজিশিয়ান মেয়েদের, তাদের এ জন্মদিনে। কিন্তু ভাগ করে দেবার ভার আপনার ওপরেই রইল!’ বলে এগিয়ে এসে মিস মেহতাব আটটা চকচকে লোভনীয় সোনার দুল চিংড়ি-ফড়িংয়ের বাবার হাতে তুলে দিলেন।
0 coment�rios: